- Views: 722
- Replies: 5
আভিধানিক অর্থে ‘খারেজী’ শব্দটি আরবী ‘খুরূজ’ (الخروج) শব্দ হ’তে নির্গত, যার অর্থ ‘বের হওয়া বা বেরিয়ে যাওয়া’। বহুবচনে ‘খাওয়ারিজ’ ব্যবহৃত হয়। পারিভাষিক অর্থে শাহরাস্তানী (মৃঃ ৫৪৮ হিঃ) এর মতে খারেজী হ’ল- ‘প্রত্যেক এমন ব্যক্তি যে এমন হক ইমামের (শাসক) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাকে লোকেরা ইমাম হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছে। চাই এই বিদ্রোহ সাহাবীগণের যুগে হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদার বিরুদ্ধে হোক বা তাদের পরবর্তী তাবেঈনে এযামের যুগে কিংবা তৎপরবর্তী যে কোন শাসকের যুগে হোক’।
ইবনু হাযম আন্দালুসী (রহঃ)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘খারেজী বলতে প্রত্যেক এমন সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মতামত কিংবা তাদের রায় অবলম্বনকারী, তা যেকোন যুগেই হোক না কেন’। ড. নাছির আল-আক্বল বলেন, ‘খারেজী হচ্ছে, যারা গোনাহের কারণে অন্য মুসলমানকে কাফের বলে এবং মুসলিম শাসক ও সাধারণ লোকজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে’। তিনি আরো বলেন, ‘খারেজী’ নামটি যেমন পূর্বের খারেজীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি প্রত্যেক এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যে তাদের নীতি গ্রহণ করে এবং তাদের পন্থা অবলম্বন করে। উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদের প্রধান দু’টি আলামত বা লক্ষণ হ’ল, তারা কবীরা গোনাহগারকে কাফের বলে এবং মুসলিম শাসকের বিরদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদেরকে ‘খারেজী’ বলা হয় এজন্য যে, তারা দ্বীন অথবা জামা‘আত অথবা আলী (রাঃ)-এর আনুগত্য থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।
রাসূল (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ও খারেজীদের উত্থান :
ইসলামের প্রথম বাতিল দল হ’ল ‘খারেজী’। অনেকে মনে করেন খারেজীদের উত্থান রাসূল (ﷺ)-এর যুগেই হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ব্যক্তি পর্যায়ের ঘটনা। এর প্রমাণ স্বরূপ তারা ‘যুল খুওয়াইছারা’র ঘটনা উল্লেখ করেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,
بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ يَقْسِمُ قَسْمًا أَتَاهُ ذُو الْخُوَيْصِرَةِ، وَهْوَ رَجُلٌ مِنْ بَنِي تَمِيْمٍ، فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ اعْدِلْ. فَقَالَ وَيْلَكَ، وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَعْدِلْ قَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُولَ اللهِ ائْذَنْ لِي فِيهِ، فَأَضْرِبَ عُنُقَهُ. فَقَالَ دَعْهُ فَإِنَّ لَهُ أَصْحَابًا، يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ مَعَ صَلاَتِهِمْ وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ، يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ، يُنْظَرُ إِلَى نَصْلِهِ فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى رِصَافِهِ فَمَا يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى نَضِيِّهِ، وَهُوَ قِدْحُهُ، فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، ثُمَّ يُنْظَرُ إِلَى قُذَذِهِ فَلاَ يُوجَدُ فِيهِ شَىْءٌ، قَدْ سَبَقَ الْفَرْثَ وَالدَّمَ، آيَتُهُمْ رَجُلٌ أَسْوَدُ إِحْدَى عَضُدَيْهِ مِثْلُ ثَدْىِ الْمَرْأَةِ، أَوْ مِثْلُ الْبَضْعَةِ تَدَرْدَرُ وَيَخْرُجُونَ عَلَى حِينِ فُرْقَةٍ مِنَ النَّاسِ-
‘আমরা রাসূল (ﷺ)-এর নিকটে উপস্থিত ছিলাম। তিনি কিছু গণীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তখন বনু তামীম গোত্রের ‘যুল খুওয়াইছারা’ নামক এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইনছাফ করুন’। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি ইনছাফ না করি, তাহ’লে কে ইনছাফ করবে? আমি যদি ইনছাফ না করি, তাহ’লে তো তুমি ক্ষতিগ্রস্ত ও নিষ্ফল হব। ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ! আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি ওর গর্দান উড়িয়ে দেই। তিনি বললেন, ‘ওকে যেতে দাও। তার কিছু সঙ্গী-সাথী রয়েছে। তোমাদের কেউ তাদের ছালাতের তুলনায় নিজের ছালাত এবং তাদের ছিয়ামের তুলনায় নিজের ছিয়ামকে তুচ্ছ মনে করবে। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালীর নিম্নদেশে প্রবেশ করে না। এরা দ্বীন থেকে এত দ্রুত বেরিয়ে যাবে, যেমন তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তীরের অগ্রভাগের লোহা দেখা যাবে, কিন্তু (শিকারের) চিহ্ন দেখা যাবে না। কাঠের অংশটুকু দেখলে তাতেও কোন কিছুর দেখা মিলবে না। মধ্যবর্তী অংশটুকু দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। তার পালক দেখলে তাতেও কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে না। অথচ তীরটি শিকারের নাড়িভুঁড়ি ভেদ করে রক্ত-মাংস অতিক্রম করে বেরিয়ে গেছে। এদের নিদর্শন হ’ল এমন একজন কালো মানুষ, যার একটি বাহু নারীর স্তনের ন্যায় অথবা গোশতের টুকরার ন্যায় নড়াচড়া করবে। তারা মানুষের মধ্যে বিরোধ কালে আত্মপ্রকাশ করবে।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الإِسْلاَمِ مُرُوقَ السَّهْمِ مِنَ الرَّمِيَّةِ، يَقْتُلُونَ أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَيَدَعُونَ أَهْلَ الأَوْثَانِ، لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ-
‘লোকটি চলে যাওয়ার পর রাসূল (ﷺ) বললেন, ঐ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন কিছু লোক আসবে যারা কুরআন পড়বে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন শিকারের দেহ ভেদ করে তীর বের হয়ে যায়। তারা মূর্তিপূজারীদেরকে ছেড়ে দিবে এবং মুসলমানদেরক হত্যা করবে। যদি আমি তাদেরকে পাই তাহ’লে ‘আদ’ জাতির মত তাদেরকে হত্যা করব’।[2]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-এর কাছে ‘জি‘রানা’ নামক স্থানে দেখা করে। এটি সেই স্থান যেখানে রাসূল (ﷺ) হুনায়নের যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। সাহাবী বিলাল (রাঃ)-এর কাপড়ের ওপর রূপার টুকরাগুলো রাখা ছিল। রাসূল (ﷺ) মুষ্ঠিবদ্ধভাবে মানুষকে দান করছিলেন। তখন উপস্থিত ঐ লোকটি বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি আল্লাহ্কে ভয় করুন ও ইনছাফ করুন! রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘ধ্বংস তোমার জন্য। আমি যদি ইনছাফ না করি তবে কে ইনছাফ করবে? আল্লাহর কসম! আমার পরে তোমরা এমন কোন লোক পাবে না, যে আমার চেয়ে অধিক ন্যায়পরায়ণ হবে’। সঙ্গে সঙ্গে ওমর (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই’। তিনি বললেন, ‘না, আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, যদি এমন কর, তবে লোকেরা বলবে, আমি আমার সাথীদের হত্যা করি...’।[3] এই ব্যক্তিই ছিল প্রথম ‘খারেজী’ যে নবী করীম (ﷺ)-এর বণ্টনের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে এবং নিজ প্রবৃত্তির রায়কে প্রাধান্য দেয়।
অন্যদিকে ওছমান (রাঃ)-এর হত্যার ষড়যন্ত্রকারী এবং পরে অন্যায়ভাবে তাঁকে হত্যাকারী উচ্ছৃঙ্খল জনতাকেও ত্বাবারী ও ইবনু কাছীর (রহঃ) ‘খারেজী’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে তখনও ‘খারেজী’ একটি পৃথক দল ও মতবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেনি। এই ব্যক্তির বংশধর ও অনুসারীরাই ‘খারেজী’। এরা কেমন হবে? কি করবে? রাসূল (ﷺ) এ সম্পর্কে বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তিনি বলেন,
سَيَخْرُجُ قَوْمٌ فِى آخِرِ الزَّمَانِ، حُدَّاثُ الأَسْنَانِ، سُفَهَاءُ الأَحْلاَمِ، يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ، لاَ يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ-
‘শেষ যামানায় এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা হবে অল্পবয়স্ক যুবক ও নির্বোধ। তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম কথা থেকে আবৃত্তি করবে। অথচ তাদের ঈমান তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না...’।[4]
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) অন্যত্র বলেন,
يَخْرُجُ نَاسٌ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ وَيَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ، ثُمَّ لاَ يَعُودُونَ فِيهِ حَتَّى يَعُودَ السَّهْمُ إِلَى فُوقِهِ. قِيلَ مَا سِيمَاهُمْ. قَالَ سِيمَاهُمُ التَّحْلِيقُ. أَوْ قَالَ التَّسْبِيد-
‘পূর্বাঞ্চল থেকে একদল লোকের আবির্ভাব ঘটবে। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে ধনুক শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তারা আর দ্বীনের মধ্যে ফিরে আসবে না, যেমনভাবে ধনুক ছিলায় ফিরে আসে না। বলা হ’ল, তাদের আলামত কি? তিনি বললেন, ‘তাদের আলামত হচ্ছে মাথা মুন্ডন করা’।[5]
মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে আমার উম্মতের মধ্যে মতানৈক্য ও ফিরক্বা সৃষ্টি হবে। এমতাবস্থায় এমন এক সম্প্রদায় বের হবে, যারা সুন্দর ও ভাল কথা বলবে আর কাজ করবে মন্দ। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমনভাবে তীর শিকার ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তারা সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট। ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ, যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং যুদ্ধে তাদের দ্বারা শাহাদত বরণ করবে। তারা মানুষকে আল্লাহর কিতাবের দিকে ডাকবে অথচ তারা আমার কোন আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়। যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, সে অপরাপর উম্মতের তুলনায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় হবে’। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাদের আলামত কী? তিনি বললেন, ‘অধিক মাথা মুন্ডন করা’।[6]
খারেজী মতবাদ সৃষ্টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর সকল ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত খারেজীরা আত্মপ্রকাশ করে। হিজরী ৩৭ সালে একটি ঘটনার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে সকল ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায়। আলী (রাঃ)-এর শাসনামলে খলীফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুনাফিক ও খারেজীদের চক্রান্তে মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক দল আলী (রাঃ)-এর এবং অন্য দল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষাবলম্বন করে। ক্রমে অবস্থা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায়। অবশেষে ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে ‘ছিফ্ফীন’ নামক স্থানে আলী (রাঃ)-এর সাথে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধকালে সমস্যার সমাধানের লক্ষে দু’জন বিচারক নির্ধারণ করা হয় এই মর্মে যে, তারা দু’জনে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য যে সিদ্ধান্ত দিবেন তা উভয় পক্ষ মেনে নিবে। আলী (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) এবং মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে নির্ধারণ করা হয়। ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে ‘তাহকীম’ বা সালিস নির্ধারণ নামে পরিচিত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শাম ও ইরাকের সকল সাহাবীর ঐক্যমতে বিচার ব্যবস্থা পৃথকীকরণ এবং আলী (রাঃ)-এর কুফায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তকে অমান্য করে তখনই আলী (রাঃ)-এর দল থেকে কিছু লোক বের হয়ে যায় এবং ‘হারুরা’ নামক প্রান্তরে এসে অবস্থান করে। তাদের সংখ্যা মতান্তরে ৬, ৮, ১২ অথবা ১৬ হাযার হবে। বিচ্ছিন্নতার সংবাদ পেয়ে আলী (রাঃ) দূরদর্শী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি তাদের সংশয়গুলিকে বিচক্ষণতার সাথে খন্ডন করায় বেরিয়ে যাওয়াদের মধ্য থেকে প্রায় ৪ অথবা ৬ হাযার লোক আলী (রাঃ)-এর আনুগত্যে ফিরে আসেন। অতঃপর আলী (রাঃ) কুফার মসজিদে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলে মসজিদের এক কোনায় ‘লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ’ ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানি না’ স্লোগানে তারা মসজিদ প্রকম্পিত করে তুলে। তারা আলী (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলে যে, আপনি বিচার ব্যবস্থা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন! অথচ বিচারের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। আপনি সূরা আন‘আমের ৫৭নং আয়াত (ان الحكم الا لله) ‘আল্লাহ ব্যতীত কারো ফায়ছালা গ্রহণযোগ্য নয়’-এর হুকুম ভঙ্গ করেছেন। আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের দরুন আপনি মুশরিক হয়ে গেছেন ইত্যাদি।
তাদের মতে আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আছ সহ তাহকীমকে সমর্থনকারী সকল সাহাবী কুফরী করেছেন এবং কাফের হয়ে গেছেন। অথচ সত্য হ’ল, মানুষের ফায়ছালার জন্য মানুষকেই বিচারক হ’তে হবে। আর ফায়ছালা হবে আল্লাহর আইন অনুসারে।
খারেজীরা নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতাকে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে রূপ দান করে এবং মুসলমানদের মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে। আলী (রাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১. তোমাদেরকে মসজিদে আসতে আমরা নিষেধ করব না ২. রাষ্ট্রীয় সম্পদ হ’তে আমরা তোমাদের বঞ্চিত করব না ৩. তোমরা আগে ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।
কিছুদিন পর তারা সাধারণ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। তখন আব্দুল্লাহ বিন খাববাব (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-এর ফিৎনা সংক্রান্ত হাদীস শুনালে তারা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীর পেট ফেড়ে বাচ্চা বের করে ফেলে দেয় এবং দু’টুকরো করে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আলী (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, ‘আব্দুল্লাহ্কে কে হত্যা করেছে? জবাবে তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলে, আমরা সবাই মিলে হত্যা করেছি। এরপর আলী (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নেন। যুদ্ধের আগে তিনি নিজে ইবনু আববাস ও আবু আইয়ূব (রাঃ) সহ তাদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেন এবং তাদের সংশয়গুলিকে দূর করতঃ সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
আলী (রাঃ)-এর পক্ষ থেকে খারেজীদের সংশয় সমূহের যথার্থ জবাব :
খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পূর্বে আলী (রাঃ) তাদের বেরিয়ে যওয়ার কারণগুলি জানতে চাইলে তারা কিছু সংশয় উপস্থাপন করে এবং তিনি প্রত্যেকটির যথার্থ জবাব দেন। তাদের সংশয়গুলির সংক্ষিপ্ত জবাব নিমণরূপ-
প্রথম সংশয় : উষ্ট্রের যুদ্ধে তাদের জন্য নারী ও শিশুদেরকে যুদ্ধবন্দী ও ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করার বৈধতা কেন দেওয়া হয়নি, যেমন দেওয়া হয়েছিল অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে? আলী (রাঃ) জবাব দেন কয়েকটি দিক থেকে, (১) ত্বালহা ও যুবায়র (রাঃ) বায়তুল মাল থেকে যে সামান্য অর্থ নিয়েছিলেন তার বিনিময়ে তাদের জন্য মাল নেয়ার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়াও তা ছিল খুবই সামান্য সম্পদ। (২) নারী ও শিশুরা তো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তাছাড়াও তারা ইসলামী ভূমিতে বসবাসকারী মুসলিম। তারা মুরতাদ হয়েও যায়নি যে, তাদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা জায়েয হবে। (৩) তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আমি যদি নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ করতাম তাহ’লে তোমাদের মধ্যে কে আছে যে (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা (রাঃ)-কে নিজের অংশে ক্রীতদাস হিসাবে গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখ?! তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাদের মধ্যে অনেকেই সঠিক পথে ফিরে এসে আলী (রাঃ)-এর আনুগত্য মেনে নেয়।
দ্বিতীয় সংশয় : আলী (রাঃ) কেন মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর সাথে ছিফ্ফীনের সন্ধি চুক্তি লেখার সময় নিজের নামের প্রথমে ‘আমীরুল মুমিনীন’ কথাটি মুছে ফেলেন এবং তাঁর কথা মেনে নিলেন? তিনি জবাব দেন এই বলে যে, ‘আমি তো তাই করেছি যা স্বয়ং রাসূল (ﷺ) হুদায়বিয়ার সন্ধিতে করেছিলেন। তিনি নিজের নামের প্রথম থেকে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কাফেরদের দাবী অনুযায়ী মুছে ফেলেন’।
তৃতীয় সংশয় : তিনি হকের পথে থাকার পরেও কেন তাহকীম বা শালিস নিয়োগ করলেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘হক্বের পথে থাকার পরেও রাসূল (ﷺ) বানু কুরায়যা-এর ক্ষেত্রে সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-কে শালিস নিয়োগ করেছিলেন’।
চতুর্থ সংশয় : আলী (রাঃ) বলেছিলেন, ‘আমি যদি খেলাফতের হকদার হয়ে থাকি, তাহ’লে তারা আমাকে খলীফা নির্বাচন করবে’। খারেজীদের দাবী তিনি নিজের খলীফা হওয়ার যোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন। এর জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা ছিল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর প্রতি ইনছাফ করা। যেমন রাসূল (ﷺ) নাজরানের নাছারাদেরকে মুবাহালার জন্য আহবান করেছিলেন তাদের প্রতি ইনছাফ প্রদর্শনের জন্য। এরপর তাদের অনেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে এবং তাঁর আনুগত্য মেনে নেয়। আর বাকীদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেন, যা ‘নাহরাওয়ান’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এতে তারা নয় জন ব্যতীত সকলেই নিহত হয়। পক্ষান্তরে আলী (রাঃ)-এর পক্ষের নয় জন শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধেই খারেজী নেতা আব্দুল্লাহ বিন ওহাব রাসবী নিহত হয়। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে খারেজীরা পরাজিত হয় এবং তাদের ফিৎনাও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বলা হয়, সেদিন বেঁচে যাওয়া নয়জন খারেজীই বিভিন্ন দেশে তাদের বীজ বপন করে। পরাজিত খারেজীদের বংশধর ও অনুসারীরা এর পরেও বিভিন্ন সময় আত্মপ্রকাশ করে এবং ফিৎনা-ফাসাদ বাধানোর চেষ্টা করে। যদিও রাসূল (ﷺ)-এর সময়ে ও পরবর্তীতে আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর যুগে কিছু খারেজী আক্বীদার লোক ছিল, কিন্তু তাদের ফিৎনা সবচাইতে মারাত্মক আকার ধারণ করে আলী (রাঃ)-এর খিলাফতকালে। সেই থেকে যুগে যুগে বিভিন্ন নামে-বেনামে খারেজী দল বা ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে।
খারেজীদের কিছু বৈশিষ্ট্য ও আলামত :
১. তারা হবে নবীন, তরুণ ও নির্বোধ, অথচ নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী ভাববে।[7] ২. তারা সর্বোত্তম কথা বলবে, কিন্ত সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ করবে।[8] ৩. বাহ্যিকভাবে সুন্দর কথা বলবে।[9] ৪. মুখে ঈমানের কথা বললেও তাদের অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র থাকবে না।[10] ৫. তাদের ঈমান ও ছালাত তাদের গ্রীবাদেশ অতিক্রম করবে না।[11] ৬. পথভ্রষ্ট হওয়ার পর এরা আর ঈমানের দিকে ফিরে আসবে না। যেমন তীর আর ধনুকের ছিলাতে ফিরে আসে না।[12] ৭. তারা হবে ইবাদতে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী কিন্তু নিজেদের ইবাদতের জন্য হবে অহংকারী। লোকেরা তাদের ইবাদত দেখে অবাক হবে।[13] ৮. তাদের নিদর্শন হ’ল, তাদের মাথা থাকবে ন্যাড়া।[14] ৯. তারা মুসলমানদের হত্যা করবে আর কাফের, মুশরিক ও মূর্তিপূজারীদের ছেড়ে দিবে।[15] ১০. তারা দ্বীনদারিতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে, এমনকি দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে।[16] ১১. তারা মুসলিম শাসকদের নিন্দা করে, অপবাদ দেয় এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও কাফির বলে দাবী করে। যেমনটি খুওয়াইছারা রাসূল (ﷺ)-এর সাথে করেছিল। ১২. তারা মানুষকে কিতাবুল্লাহর দিকে আহবান করবে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই থাকবে না। অর্থাৎ কিতাবুল্লাহ দিয়ে দলীল গ্রহণ করবে। কিন্তু না বুঝার কারণে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল করবে।[17] ১৩. তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করবে।[18] ১৪. তারা সর্বোত্তম দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। যেমন আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে করেছিল।[19] ১৫. তারা তাদের নিহতদেরকে জান্নাতী মনে করে। যেমন তারা নাহ্রাওয়ানের যুদ্ধের ময়দানে পরস্পরকে ‘জান্নাতমুখী’ ‘জান্নাতমুখী’ বলে ডাকছিল’।[20] ১৬. ওরা এমন জাতি যাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা।[21] ১৭. মতভেদ ও মতানৈক্যের সময় এদের আবির্ভাব হবে।[22] ১৮. তাদের উৎপত্তি পূর্ব দিক (ইরাক ও তৎসংলগ্ন) থেকে হবে।[23] ১৯. যেসব আয়াত কাফেরের জন্য প্রযোজ্য তারা সেগুলিকে মুমিনদের উপর প্রয়োগ করবে।[24] ২০. তাদের আগমন ঘটবে শেষ যামানায়।[25] ২১. তারাও কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েই কথা বলবে কিন্তু অপব্যাখ্যা করবে।[26] ফলে তারা আলেমদের সাথে সবচেয়ে বেশী শত্রুতা পোষণকারী হবে। প্রতিপক্ষের বিরোধিতা করতে গিয়ে জাল হাদীস পর্যন্ত রচনা করে।[27] ২২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নামে এ সম্পর্কিত শরী‘আতের দলীলগুলিকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে। ২৩. তারা কেবল ভীতি প্রদর্শন সংক্রান্ত আয়াতগুলি দিয়ে দলীল গ্রহণ করে। কিন্তু ভাল কাজের পুরস্কার বা উৎসাহমূলক আয়াতগুলিকে পরিত্যাগ করে। ২৪. তারা আলেমগণকে মূল্যায়ন করবে না। নিজেদেরকেই বড় জ্ঞানী মনে করবে। যেমন খারেজীরা নিজেদেরকে আলী, ইবনু আববাস সহ সকল সাহাবী (রাঃ)-এর চেয়ে জ্ঞানী দাবী করেছিল। ২৫. ওরা হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে।[28] ২৬. তারাই সর্বপ্রথম মুসলিমদের জামা‘আত হ’তে বেরিয়ে গেছে এবং তাদেরকে পাপের কারণে কাফের সাব্যস্ত করেছে।[29] ২৭. তারা ক্বিয়াস (ধারণা বা অনুমান) ভিত্তিক কাজে বেশী বিশ্বাসী।[30] ২৮. তারা মনে করে যালেম শাসকের শাসন জায়েয নয়।[31] ৩০. ওরা মুখে আহলে ইল্মদের কথার বকওয়ায করে কিন্তু তার মর্মাথ বুঝে না।[32] ৩০. ওরা লোকদেরকে মুসলিম সমাজ হ’তে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আহবান জানায়। ফলে তারা নিজেরা মাদরাসা, শিক্ষা ইন্সটিটিউট, বিশববিদ্যালয়, সরকারী চাকুরী এবং মুসলমানদের সাথে বসবাস করা পরিহার করে।[33] ৩১. তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে এবং অন্যকে হত্যার মাধ্যমে সীমালংঘন করতঃ রক্তপাত ঘটাবে। ৩২. যতবারই তাদের আবির্ভাব হবে, ততবারই তারা ধ্বংস হবে। এভাবে রাসূল (ﷺ) বিশ বার বলেন।[34] ৩৪. ভূপৃষ্ঠে সর্বদাই খারেজী আক্বীদার লোক থাকবে এবং সর্বশেষ এদের মাঝেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।[35] ৩৫. তারা হবে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি।[36]
খারেজীদের বিষাক্ত ছোবলে কলংকিত ইসলামের ইতিহাস :
খলীফা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর সময় খারেজীরা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু আবু লু’লু নামক জনৈক অগ্নিপূজক বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে গোপনে মদীনায় প্রবেশ করে। ২৩ হিজরীর ২৬শে যিলহজ্জ তারিখে ওমর (রাঃ) ফজরের ছালাতে ইমামতি করছিলেন, এমন সময় সে ছদ্মবেশে প্রথম কাতারে অবস্থান নেয়। অতঃপর সুযোগ বুঝে তীক্ষ্ণ তরবারী দ্বারা তিন অথবা ছয়বার তাঁর কোমরে আঘাত করে। তিনদিন পর তিনি শাহাদত বরণ করেন। ফলে চরমপন্থী তৎপরতার পুনরুত্থান ঘটে। উল্লেখ্য, ঐ দিন সে আরো ১৩ জন সাহাবীকে আঘাত করে। তন্মধ্যে ৯ জন শাহাদত বরণ করেন। ঐ ঘাতক পালিয়ে যেতে না পেরে নিজের অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করে।
ইহুদী আব্দুল্লাহ বিন সাবার ষড়যন্ত্রে খারেজী চরমপন্থীদের হাতেই ৩৫ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখ জুম‘আর দিন রাসূল (ﷺ)-এর জামাতা ৮২ বছর বয়সী ওছমান (রাঃ) নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। নাহরাওয়ানের যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া খারেজীরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। অতঃপর তারা আলী (রাঃ)-কে হত্যা করার জন্য গোপনে আব্দুর রহমান বিন মুলজামকে ঠিক করে। অনুরূপভাবে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর কে হত্যা করার জন্য বারাক বিন আব্দুল্লাহকে এবং আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে হত্যা করার জন্য আমর বিন বাকরকে নির্বাচন করে। এভাবে তারা একই দিনে হত্যা করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। আব্দুর রহমান বিন মুলজাম তার দু’জন সহযোগী ওরদান ও শাবীবকে সঙ্গে নিয়ে ৪০ হিজরীর ১৭ই রামাযান জুম‘আর রাতে কূফায় গমন করে। ফজরের সময় আলী (রাঃ)-এর বাড়ীর দরজার আড়ালে অস্ত্র নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। তিনি বাড়ী থেকে বের হয়ে যখন ‘ছালাত’ ‘ছালাত’ বলে মানুষকে ডাকতে ডাকতে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই তারা আলী (রাঃ)-এর মাথায় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এতে তাঁর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় আলী (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে ঐ রক্তপিপাসু বলেছিল,لا حكم إلا لله ليس لك يا علي ولا لأصحابك، ‘হে আলী! আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান নেই। তোমার জন্যও নেই এবং তোমার সাথীদের জন্যও নেই হে আলী’। তাকে হত্যা করার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে উঠে,شحذته أربعين صباحا وسألت الله أن أقتل به شر خلقه ‘আমি চল্লিশ দিন যাবৎ তরবারিকে ধার দিয়েছি এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছি, আমি যেন এই অস্ত্র দ্বারা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারি’ (নাঊযুবিল্লাহ্)।
আলী (রাঃ) বলেছিলেন, আমি মারা গেলে তোমরা তাকে হত্যা করবে। আর বেঁচে থাকলে আমিই যা করার করব। কিন্তু তিনদিন পর ৪০ হিজরীর ২১শে রামাযান ৬৩ বা ৬৪ বছর বয়সে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ঐ দিন একই সময় মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে আঘাত করলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আমর ইবনুল আছ (রাঃ) ভীষণ অসুস্থ থাকায় তিনি সেদিন মসজিদে আসতে পারেননি। ফলে তিনি বেঁচে যান। তবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ইমাম খারেজাহ ইবনু আবী হাবীবাকে ঐ ঘাতক হত্যা করে। এভাবেই খারেজীরা খুলাফায়ে রাশেদার মত জান্নাতী ও বিশিষ্ট সাহাবীগণের প্রাণনাশ ঘটিয়ে ইসলামের সোনালী ইতিহাসকে কলংকিত করে।
খারেজীদের অপব্যাখ্যা ও তার জবাব :
খারেজীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য কুরআন ও হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে সালাফে ছালেহীন-এর বুঝকে উপেক্ষা করে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা করা। নিম্নে তাদের অপব্যাখ্যার কিছু নমুনা জবাব সহ আলোচিত হ’ল।-
এক : আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ ‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের কেউ কাফির এবং কেউ মুমিন’ (তাগাবুন ৬৪/২)। অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কাফির ও মুমিন দু’ভাগে সীমাবদ্ধ করেছেন। আর ফাসিকরা মুমিন নয়। সুতরাং তারা কাফির।
জবাব : এ আয়াত দ্বারা মানুষকে কেবল দু’ভাগের মাঝে সীমাবদ্ধ করা হয়নি। কেননা আরও এক প্রকার মানুষ রয়েছে, তারা হ’ল পাপী। আর দু’প্রকার উল্লেখ করার কারণে বাকিগুলিকে অস্বীকার করা বুঝায় না। তাছাড়া এখানে বলা হয়েছে, কিছু মানুষ কাফির আর কিছু মুমিন। এর বাস্তবতা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা বুঝায় না যে, পাপী মুমিনেরা কাফির যেমন দাবী করেছে খারেজীরা।
দুই : রাসূল (ﷺ) বলেন,
لاَ يَزْنِى الزَّانِىْ حِيْنَ يَزْنِى وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيْهَا أَبْصَارَهُمْ وَهْوَ مُؤْمِنٌ
‘কোন ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন সে মুমিন থাকে না। সে মুমিন থাকা অবস্থায় মদ পান করতে পারে না। সে মুমিন থাকা অবস্থায় চুরি করতে পারে না। ছিনতাইকারী যখন প্রকাশ্যে ছিনতাই করে, আর লোক অসহায় ও নিরূপায় হয়ে তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে, তখন সে মুমিন থাকে না’।[37]
তারা এ হাদীসটি দ্বারা কবীরা গোনাহকারীকে ঈমান থেকে পুরোপুরি খারিজ দাবী করে।
জবাব : বিদ্বানগণ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে যে ব্যক্তি উল্লিখিত পাপগুলিকে হালাল মনে করে করবে তার ক্ষেত্রে এটি বলা হয়েছে। অথবা হাদীসে ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ ঈমানদার নয় বুঝানো হয়েছে। এ হাদীসে উল্লিখিত পাপের কারণে যদি দ্বীন থেকে খারিজ উদ্দেশ্য হ’ত, তাহ’লে তার জন্য শুধু ‘হদ’ জারি করাই যথেষ্ট মনে করা হ’ত না। এজন্যই যুহরী (রহঃ) এ ধরনের হাদীস সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা এগুলিকে প্রয়োগ কর যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণ প্রয়োগ করতেন। অন্য হাদীসে এসেছে, আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যদি কোন বান্দা বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং এর উপরেই মৃত্যুবরণ করে, তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যদি সে যেনা করে এবং চুরি করে তবুও? তিনি বললেন, যদিও সে যেনা করে এবং চুরি করে। এভাবে আমি তিন বার বললাম, প্রত্যেকবার তিনি একই উত্তর দিলেন। চতুর্থবার বললেন, ‘যদিও আবু যারের নাক ভূলুণ্ঠিত হয়...’।[38]
তিন : মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ ‘যে সব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়ছালা করে না তারা কাফির’ (মায়েদা ৫/৪৪)। তাদের দাবী এ আয়াত সকল প্রকার পাপীকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা তারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুযায়ী ফায়ছালা করে না। সুতরাং তাদের কাফের হওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
জবাবঃ অত্র আয়াতটি তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে এবং গায়রুল্লাহর বিধান দিয়ে ফায়ছালা করাকে বৈধ মনে করে। কিন্তু যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং স্বীকার করে যে, তাঁর বিধান সত্য, তাহ’লে সে কাফির নয়, সে পাপী হিসাবে গণ্য হবে কুফরীর সুস্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত। সারা পৃথিবীতে যখন মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। নেতৃত্বসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে শতধাবিভক্ত। এমনি করুণ মুহূর্তে এ বিদ‘আতী খারেজী দলের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম শাসকদের দোষ-ত্রুটির কারণে তাদেরকে কাফের, মুরতাদ ফৎওয়া দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা খারেজীদের ধর্ম। এই বিষয়টি এত ধ্বংসাত্মক যে, আপনি প্রত্যেকটা আক্বীদার কিতাব খুলে দেখুন মুসলিম শাসকদের অন্যায় বা যুলুম-অত্যাচার সত্ত্বেও সৎকাজে তাদের প্রতি অনুগত থাকা এবং কোন মতেই বিদ্রোহ না করার কথা বলা হয়েছে।
চারঃ মহান আল্লাহ বলেন, ان الحكم إلا لله ‘আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম নেই’ (উইসুফ ৪০/৬৭)। খারেজীরা অজ্ঞতাহেতু এ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলে, মানুষকে শালিস নিয়োগ করা কুরআন পরিপন্থী এবং কুফরী। এর জবাবে আলী (রাঃ) বলেছিলেন, كلمة حق أريد بها باطل ‘কথা সত্য, কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ’। কেননা মানুষের ফায়ছালা মানুষই করবে, আর তা হবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী (নিসা ৪/৩৫; মায়েদা ৫/৯৫)।
খারেজী আক্বীদা বনাম আহলেহাদীসদের আক্বীদা :
কবীরা গোনাহগার সম্পর্কে : খারেজীদের মতে, মানুষ হয় মুমিন, নয় কাফির। একই বান্দার মাঝে ছওয়াব ও শাস্তি জমা হ’তে পারে না। তাই প্রত্যেক কবীরা গোনাহ কুফরী। আর কবীরা গোনাহগার কাফির। যে কোন মুসলিম কবীরা গোনাহ করলে তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায় এবং সে মুরতাদ হয়ে যায় ও কুফরীতে প্রবেশ করে। এ অবস্থায় অথবা একবার মিথ্যা বলে ছগীরা গোনাহ করে তওবা না করে মারা গেলে সে মুশরিক ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। যারা কবীরা গোনাহ করে তওবা করে না, তাদেরকে হত্যা করা তারা বৈধ মনে করে।
আহলেহাদীসদের আক্বীদা : কবীরা গোনাহগার কাফের নয়। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয়। তাকে হত্যা করাও জায়েয নয়। যদি সে তওবা না করে মারা যায়, তাহ’লে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি তাকে ক্ষমাও করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও নয়। বরং অপরাধের শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহর দয়ায় আবার সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে কবীরা গোনাহের কারণে অসম্পূর্ণ মুমিন অথবা ফাসেক। কিন্তু ঈমানের কারণে সে মুমিন। এটিই খারেজীদের চরমপন্থা এবং মু‘তাযিলা ও মুরজিয়াদের চরম শিথিলতার বিপরীতে মধ্যমপন্থী আক্বীদা। মহান আল্লাহ্ কবীরা গোনাহকারীদেরকে মুমিন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ‘যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহ’লে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। এ আয়াতের তাফসীরে হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,
فسماهم مؤمنين مع الاقتتال، وبهذا استدل البخاري وغيره على أنه لايخرج عن الإيمان بالمعصية وإن عظمت، لا كما يقوله الخوارج ومن تابعهم.
‘পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে মুমিন নামকরণ করেছেন। এ আয়াত দ্বারা ইমাম বুখারী ও অন্যান্য বিদ্বানগণ দলীল গ্রহণ করেছেন যে, পাপের কারণে সে ঈমান থেকে বের হয়ে যায় না, যদিও পাপ বড় হয়। বিষয়টি এমন নয় যেমন খারেজী ও তাদের দোসররা বলে’।
ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,
فسمى الله هؤلاء مؤمنين مع مع ما وقع بينهم من القتال الذي يعد من أكبر الكبائر، ومن بين أنهم لم يحرجوا من الإيمان بالكلية.
‘তারা পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে যা সবচেয়ে বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত, তবুও আল্লাহ তাদেরকে মুমিন নামকরণ করেছেন। এতদসত্ত্বেও তারা ঈমান থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যায়নি। এজন্যই ইমাম মালেক (রহঃ) বলতেন,أهل الذنوب أي الكبائر مؤمنون مذنبون ‘কবীরা গোনাহকারীরা পাপী মুমিন’।
শাসক ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে : খারেজীদের মতে, কোন মুসলিম শাসক যদি তাদের মানহাজ না মানে অথবা ফাসেকী ও যুলুম করে, তাহ’লে তার জন্য ক্ষমতায় থাকা বৈধ নয়। এমন শাসকের আনুগত্য করাও জায়েয নয়। তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা ওয়াজিব। তার অধীনে সরকারী চাকুরী, সরকারী বাসভবনে বসবাস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা জায়েয নয়। তার অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মী ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে হত্যা করা জায়েয। তাদের মতে কোন মুসলিম বিচারক যদি আল্লাহর বিধান মতে বিচার না করেন, তাহ’লে তিনি অবশ্যই কাফের। তাকে হত্যা করা জায়েয, যদি তিনি তওবা না করেন।
আহলেহাদীসদের আক্বীদা : ইমাম ত্বাহাবী (রহঃ) বলেন, ‘আমীর ও শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে আমরা জায়েয মনে করি না, যদিও তারা যুলুম করে। আমরা তাদের অভিশাপও করি না, আনুগত্য হ’তে হাত গুটিয়ে নেই না। তাদের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য সাপেক্ষে ফরয, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ দেয়। আমরা তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য দো‘আ করব’।
কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে : যে সকল সুন্নাত তাদের দাবী অনুযায়ী কুরআনের বাহ্যিক অর্থ বিরোধী মনে হয়, তারা তা অস্বীকার করে। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘তারা কুরআনের অপব্যাখ্যা করে’। তারা সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করতঃ ব্যভিচারীকে রজম করার বিধান অস্বীকার করে।
আহলেহাদীসদের আক্বীদা : কুরআন-সুন্নাহ দু’টিই অহী। রাসূল (ﷺ) বলেন, ألا إني أوتيت القرآن ومثله معه... ‘জেনে রাখো! আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি ও তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত’...।[39] হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা স্বরূপ। মহান আল্লাহ্ বলেন, وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُوْنَ ‘আমরা আপনার নিকটে ‘যিকর’ নাযিল করেছি, যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশ্যে নাযিলকৃত বিষয়গুলি তাদের নিকট ব্যাখ্যা করে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহ্ল ১৬/৪৪)। সুতরাং এ দু’য়ের মাঝে কোন বৈপরীত্য নেই।
নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে : খারেজীদের কোন কোন দল নবী-রাসূলগণের দ্বারাও ছগীরা ও কবীরা গোনাহ সংঘটিত হওয়াকে জায়েয মনে করে। তাই তাদের মতে কোন নবীকেও কবীরা গোনাহের কারণে কাফের বলা যায়। যতক্ষণ না তিনি তওবা করে ফিরে আসেন (নাঊযুবিল্লাহ)। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘খারেজীরা রাসূল (ﷺ)-এর ক্ষেত্রে যুলুম এবং তিনি তাঁর সুন্নাতের ক্ষেত্রে ভ্রষ্ট এমন অপবাদ আরোপ করা জায়েয করেছে। আর তাঁর আনুগত্য ও ইত্তেবা করা ওয়াজিব মনে করত না’। নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে খারেজীদের এমন আক্বীদা কুফরীর শামিল।
সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে : তাদের মতে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কবীরা গোনাহ ও কুফরী করেছেন। তারা ওছমান (রাঃ)-কে কাফের ও মুরতাদ মনে করত এবং তাকে হত্যাকারীদের প্রশংসা করত। যেমন তারা আলী, মু‘আবিয়া, আমর ইবনুল আছ, আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) সহ যে সকল সাহাবী শালিস নিয়োগ করাকে সমর্থন করেছেন তাদেরকে কাফের ও মুরতাদ ঘোষণা করতঃ তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল।
আহলেহাদীসদের আক্বীদা : সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে খারেজীদের যে আক্বীদা তা স্পষ্টত ফাসেকী। কেননা, ‘আল্লাহ তাদের উপর সন্তষ্ট তারাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট’ (মায়েদা ৫/১১৯)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিও না। সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করে তবুও তা তাদের এক অঞ্জলি বা অর্ধাঞ্জলি দানের সমতুল্য হবে না।
পরকালে শাফা‘আত সম্পর্কে : তারা কবীরা গোনাহকারীর জন্য শাফা‘আতকে অস্বীকার করে। তাদের দাবী শাফা‘আত কেবল মুত্তাক্বীদের জন্য। তাদের মতে যাকে একবার জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী থাকবে।
আহলেহাদীসদের আক্বীদা : খারেজীদের এমন আক্বীদা স্পষ্ট সুন্নাহ বিরোধী। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আমার শাফা‘আত আমার উম্মতের মধ্যে যারা কবীরা গোনাহগার তাদের জন্য’।[40]
খারেজীদের বিধান :
দুনিয়াবী বিধান : খারেজীদের হুকুম সম্পর্কে বিদ্বানগণের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন তারা কাফের। তাদের দলীল- যুল খুওয়াইছারার ঘটনা, তাদের দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়া মর্মে বর্ণিত হাদীস সমূহ এবং আলী, মু‘আবিয়া সহ প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীগণের সাথে তাদের ন্যক্কারজনক আচরণ। আবার অনেকেই বলেন, তারা ফাসিক ও বিদ‘আতী। কারণ কাউকে ইসলাম বহির্ভূত বলা সহজ বিষয় নয়। তবে স্পষ্ট কুফরী প্রমাণিত হ’লে তা ভিন্ন কথা। মোদ্দাকথা হ’ল, তাদের কথা, কর্ম ও আক্বীদার ভিত্তিতে তাদের ওপর হুকুম প্রযোজ্য হবে। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’তে বহির্ভূত’। ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন, ‘ফিরক্বা নাজিয়া ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করায় তাদেরকে ভ্রষ্ট দল হিসাবে ধরা হয়’। সালাফে ছালেহীন যদিও তাদেরকে কাফের বলেন না। তবে তাদেরকে হাদীসে বর্ণিত ৭২টি ভ্রান্ত দলের একটি গণ্য করেন।
পরকালীন বিধান : রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘খারেজীরা জাহান্নামের কুকুর’।[41]
উপসংহার : খারেজীদের সম্পর্কে ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন,
إذ لو قووا هؤلاء لأفسدوا الأرض كلها عراقا وشاما، ولم يتركوا طفلا ولا طفلة ولا رجلا ولا امرأة : لأن الناس عندهم قد فسدوا فسادا لا يصلحهم إلا القتل جملة.
‘যদি খারেজীরা শক্তিশালী হয় তথা ক্ষমতা পায়, তখন তারা ইরাক ও শামের সর্বত্র ফাসাদ সৃষ্টি (মুসলমানদেরকে তাকফীর ও হত্যা...ইত্যাদি) করে বেড়াবে। তারা কোন ছেলে শিশু, মেয়ে শিশু এবং নারী-পুরুষ কাউকে রেহাই দিবে না। কেননা তাদের আক্বীদা হ’ল, মানুষ এমনভাবে ফাসাদে লিপ্ত হয়েছে যে, তাদেরকে সামগ্রিকভাবে হত্যা করা ব্যতীত তারা সংশোধিত হবে না। খারেজীদের ভয়ানক রূপ সম্পর্কে ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন,
لم يكن أحد شرا على المسلمين منهم، لا اليهود ولا النصارى، فإنهم كانوا مجتهدين في قتل كل مسلم لم يوافقهم، مستحلين لدماء المسلمين وأموالهم، وقتل أولادهم، مكفرين لهم، وكانوا متدينين بذلك لعظم جهلهم وبدعتهم المضلة.
‘মুসলমানদের জন্য তাদের চাইতে ক্ষতিকর আর কেউ ছিল না। ইহুদীও নয়, নাছারাও নয়। কেননা যেসকল মুসলিম তাদেরকে সমর্থন করেনি, তারা তাদেরকে হত্যা করতে সদা তৎপর ছিল। মুসলমানদের রক্ত ও সম্পদ এবং তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করা হালাল মনে করে তাদেরকে কাফের গণ্য করে। এরপরেও তাদের ব্যাপক অজ্ঞতা ও ভ্রষ্ট বিদ‘আত সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে দ্বীনদার মনে করত।
অতএব পথভ্রষ্ট খারেজী দল ও তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা সমূহ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুণ-আমীন!
- মীযানুর রহমান মাদানী।
[1]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/১০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৯৪।
[2]. বুখারী হা/৭৪৩২; মুসলিম হা/১০৬৪; মিশকাত হা/৫৮৯৪।
[3]. মুসলিম হা/১০৬৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৮৭৮।
[4]. বুখারী হা/৬৯৩০; মিশকাত হা/৩৫৩৫।
[5]. বুখারী হা/৭৫৬২।
[6]. আবু দাউদ হা/৪৭৬৫; মিশকাত হা/৩৫৪৩, সনদ ছহীহ।
[7]. বুখারী হা/৩৬১১, ৫০৫৭, ৬৯৩৪; মুসলিম হা/২৪৬২, ২৪৬৯।
[8]. মুসলিম হা/২৪৬২; আবুদাঊদ হা/৪৭৬৭; আহমাদ হা/২০৪৪৬।
[9]. বুখারী হা/৫০৫৭।
[10]. বুখারী হা/৩৪১৫।
[11]. মুসলিম হা/২৪৬২।
[12]. বুখারী হা/২৪৬২।
[13]. আহমাদ হা/১২৯৭২; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ হা/৯৪৫; আলবানী একে ছহীহ বলেছেন, যিলালুল জান্নাহ হা/৯৪৫।
[14]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১; ইবনু মাজাহ হা/১৫৭।
[15]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১।
[16]. বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১; আহমাদ হা/৭০৩৮; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ, হা/৯২৯-৯৩০।
[17]. আবুদাঊদ হা/৪৭৬৫; আহমাদ হা/১৩৩৩৮; মিশকাত হা/৩৫৪৩; আলবানী ছহীহ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৬৮।
[18]. আহমাদ হা/১২৯৭২; বায়হাক্বী, মাজমা যাওয়ায়েদ ২২৯/৬; আলবানী ছহীহ বলেছেন, যিলালুল জান্নাহ হা/৯৪৫।
[19]. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/৩০৫।
[20]. আল-বিদায়া ১০/৫৮৭।
[21]. আলে-ইমরান ১০৬ নং আয়াতের তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ হা/২২৩১৩।
[22]. বুখারী হা/৬৯৩৩।
[23]. বুখারী হা/৭১২৩।
[24]. বুখারী, হুজ্জাত কায়েম হওয়ার পর খাওয়ারেজ ও মুলহিদদের হত্যা করা অধ্যায়, ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত।
[25]. আবুদাঊদ হা/৪৭৬৯।
[26]. বুখারী হা/৩৪১৫।
[27]. আল-খাওয়ারিজ আক্বীদাতান ওয়া ফিকরান ৫৪-৬৮ পৃঃ।
[28]. আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬।
[29]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৭৯/৩৪৯, ৭/৩।
[30]. আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল ১১৬/১।
[31]. মাকালাতুল ইসলামমিয়্যন ২০৪/১।
[32]. আশ-শারী‘আহ ২৮ পৃঃ।
[33]. দিরাসাতুন আনিল ফিরাক্ব ওয়া তারীখিল মুসলিমীন পৃঃ ১৩৪।
[34]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৪; আলবানী হাসান বলেছেন, ছহীহুল জামে‘ হা/৮১৭২; আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন, মুসনাদ ৩৯৮/৯।
[35]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৪; আলবানী একে হাসান বলেছেন, ছহীহা হা/২৪৫৫।
[36]. মুসলিম হা/২৪৬৯, ২৪৫৭।
[37]. বুখারী হা/৬৭৭২; মুসলিম হা/৫৭; মিশকাত হা/৫৩।
[38]. বুখারী হা/৫৮২৭; মুসলিম হা/৯৪; মিশকাত হা/২৬।
[39]. আহমাদ হা/১৭২১৩।
[40]. আবু দাউদ হা/৪৭৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩১০; মিশকাত হা/৫৫৯৯, সনদ ছহীহ।
[41]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৩, সনদ ছহীহ।