খারেজী সম্প্রদায়ঃ পরিচয়, উৎপত্তি ও চিন্তাধারা - ২

  • Thread Author

খারেজী সম্প্রদায়ঃ পরিচয়, উৎপত্তি ও চিন্তাধারা - ২​

━━━━━━━━━━━━━━━━​


কেনো এই গোঁড়ামি ও চরমপন্থা ?

বিভিন্ন কারণে সমাজে গৌড়ামী ও চরমপন্থার উদ্ভব হয়ে থাকে। নিয়ে গোঁড়ামী ও চরমপন্থার কয়েকটি কারণ আলােচনা করা হলােঃ

১. দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞানের অভাবঃ

গোঁড়ামীর মৌলিক কারণগুলাের মধ্যে একটা অন্যতম কারণ হলাে দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞানের অভাব। দ্বীনি প্রজ্ঞার স্বল্পতা, দ্বীনের রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থতা এবং তার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও স্পিরিট অনুধাবনে অক্ষমতা। এসব কথার মাধ্যমে দ্বীন সম্বন্ধে পূর্ণ অজ্ঞতার কথা বুঝানাে হচ্ছে না। কারণ পূর্ণ অজ্ঞতা সম্ভবতঃ বাড়াবাড়ি ও উগ্রপন্থার দিকে নিয়ে যায় না বরং তার উল্টো দিকেই নিয়ে যায়। অর্থাৎ তা নৈতিক অবক্ষয় ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকেই ধাবিত করে। সুতরাং প্রকৃত জ্ঞানের অভাব বলতে অপরিপক্ক জ্ঞান বুঝানাে হচ্ছে। যে 'অপরিপক্ক জ্ঞান তাকে 'জ্ঞানী বলে ধারণা দেয় অথচ সে অনেক কিছুই জানে না। সে এখান-সেখান হতে কিছু জ্ঞানার্জন করে-যা পরস্পর সম্পর্কহীন ও শৃঙ্খলাহীন। অর্থাৎ সে ভাসাভাসা জ্ঞানের অধিকারী হয় ঠিকই, কিন্তু জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সে দ্বীনের একক বিষয়গুলােকে 'মুহকামাত তথা সন্দেহহীন বিষয়গুলাের সাথে, আর অনির্ভরযােগ্য বিষয়গুলােকে নির্ভরযােগ্য বিষয়ের সাথে তুলনা করতে পারে না। সে পরস্পরবিরােধী দলিলসমূহের মধ্যে সমন্বয়সাধন ও তারজীহ তথা অগ্রাধিকার দানের কৌশল রপ্ত করতে পারে না। কোন্ দলিল অগ্রাধিকার যােগ্য আর কোন বিষয় প্রাধান্যপ্রাপ্তির যােগ্য তা উপলব্ধি করতে পারে না।➝ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, আল সাহওাতুল ইসলামিয়া বাইনাল জুহুদি ওয়াত তাতাররুফ, কায়রাে: দারুস সাহওয়া ১৪১২ হিজরী, পর. ৩৩-৩৬

এভাবে শরীয়তের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য না বুঝে ইচ্ছামত অভিমত গ্রহণ করে। এদের প্রতি হাদীসে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে :

عن عبد الله بن عمرو بن العاص قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد ولكن يقبض العلم يقبض العلماء حتى إذا آش يبق عالما اخد التاش ژوسا جهالا فشلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا۔

"আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের নিকট থেকে ইলমকে ছিনিয়ে নিবেন না। বরং তিনি আলেমদেরকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে জ্ঞানকে উঠিয়ে নিবেন। ফলে কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবেনা। তখন মানুষ অজ্ঞদেরকে নেতা বানাবে। মানুষ তাদের কাছে দ্বীনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে। তখন তারা না জেনে ফতওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা বিভ্রান্ত হবে এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করবে"। ➝সহীহ আল-বুখারী: ১০০: সহীহ মুসলিম: ৬৯৭১

মূলতঃ অহংকারযুক্ত অল্পবিদ্যা পূর্ণ অজ্ঞতার চেয়ে অত্যধিক বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। কারণ অল্পবিদ্যার অধিকারী ব্যক্তি কম্মিনকালেও তার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দৃঢ় বিশ্বাস পােষণ করে। এ মর্মে হাফেজ ইবনু কাসীর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) (৭০১-৭৭৪ হিজরী,) বলেছেন :

يعتقدون يجهلهم وقلة علمهم وعقلهم ، إن هذا الأمر يرضي رب الأرض والسماوات، ولم يعلموا أنه من أكبر الكبائر الموبقات والعظائم والخطيئات وأنه مما زينه لهم إبليس الشيطان الرجيم المطرود-

তাদের অজ্ঞতা ও বিদ্যা-বুদ্ধির স্বল্পতার কারনে তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের এ কাজে আসমান-জমিনের প্রতিপালক তুষ্ট হবেন। কিন্তু তারা জানে না যে, এটা কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে অধিক ধ্বংসাত্মক, মারাত্মক ও অত্যন্ত ক্ষতিকর। বহিস্কৃত ও বিতাড়িত ইবলিস এ কাজে অনুপ্রাণিত করে। ➝ইবনু কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, কায়রো: দারুর রাইয়ান, ১৪০৮ হি/১৯৮৮ খৃ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৭

২. দ্বীন সম্পর্কে বিকৃত ও ভুল ধারণাঃ

গোঁড়ামী ও চরমপন্থা উদ্ভবের আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে শরীয়তের বিধিবিধানসমূহ ভুল বা বেঠিকভাবে অনুধাবন করা। ইসলাম অনুধাবনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, ইসলামী শরীয়ত ও রিসালাতের মূল উদ্দেশ্য অনেকের কাছে অস্পষ্ট থাকার কারণে দ্বীনের অনেক বিধান সম্পর্কে তারা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়। এ সম্পর্কে শাইখ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ আল-বদর বলেন

ومن سوء الفهم في الدين . ما حصل للخوارج الذين خرجوا على على رضى ال له عنه و قاتلوه فإنهم فهموا النصوص الشرعية فهما خاطئا , مخالفا لفهم الصحابة رضي الله عنهم ولهذا لما ناظر ابن عباس فرجع من رجع منهم

'দ্বীন সম্পর্কে ভুল ধারণা যা খারিজীরা পােষণ করতাে। যারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর দল থেকে বের হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে হত্যা করেছিল। তারা শরীয়তের দলিলসমূহকে ভ্রান্তভাবে বুঝতাে, যা ছিল সাহাবায়ে কিরামের বুঝের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ কারণে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের সাথে আলােচনা করে যখন তাদের কাছে দলিলসমূহের সঠিক বুঝ উপস্থাপন করলেন তখন তাদের মধ্যে যারা ফিরে আসার তারা ফিরে আসলাে। ➝ আব্দুল মুহসিন ইবনু হামদ আল-আব্বাদ আল-বদর, বিআইয়ে আকলিন ওয়াদ্বীনিন ইয়াকুনুত তাফজীর ওয়াত তাদমীর জিহাদান (রিয়াদ: দারুল মুগনী লিন নাশর ওয়াত তাওযি ১ম প্রকাশ, ২০০৩/১৪২৪ হি, পৃ. ৬

৩. ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাস্তবতা, জীবন ও বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবঃ

চরমপন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তিগত শুধু ধর্মীয় জ্ঞানেই অপরিপক্ক নয়; ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাস্তবতা, জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহর সুন্নাত তথা নিয়ম সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান অপরিপক্ক। ফলে তাদের কাউকে কাউকে দেখা যায় যে, এমনকিছু পেতে চায় যা পাওয়া সম্ভব নয়। এমন কিছু ইচ্ছা করে যা হতে পারে না। এমন অলীক কল্পনা করে যা অবাস্তব। আর বাস্তবতাকে বােঝে অপ্রকৃতভাবে এবং তারা তাদের মস্তিষ্কে বিদ্যমান ধারণামতে সব কিছুর ব্যাখ্যা দেয়। যার কোন ভিত্তি নেই আল্লাহর সৃষ্টিতে, আল্লাহর বিধানে এবং তাঁর শরীয়তের বিধি-বিধানে।

চরমপন্থী ও গোঁড়া ব্যক্তিরা গােটা সমাজ পাল্টে দিতে চায়। তারা চায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনা, নিয়ম-নীতি, চরিত্র ও বিধান ইত্যাদি কাল্পনিক ও অবাস্তব নিয়ম-নীতির মাধ্যমে পরিবর্তন করে দিতে। পরিবর্তন চায় এমন দুঃসাহস, বীরত্ব ও আত্মেসর্গের মাধ্যমে যাতে মূল্যবান প্রাণের কুরবানী বেশী হয়। তারা মৃত্যুকে পরােয়া করে না। এ মৃত্যু তাদের হােক বা অন্য কারাে হােক। তারা ফলাফলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না সেটা যা-ই হােক না কেন।

৪. বিকৃত চিন্তাধারার থেকে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের ব্যাখ্যাঃ

গোঁড়া ও চরমপন্থীরা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের গভীরে প্রবেশ করে না। তারা-এর অর্থ, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য না বুঝে আক্ষরিক ও বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে। যেমন নিম্নোক্ত নাস-এর প্রতি লক্ষ্য করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ইমাম মালিক, বুখারী, মুসলিম ও সুনান গ্রন্থের লেখকগণ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদের দেশে ও শত্রুভূমিতে কুরআন নিয়ে সফর করতে নিষেধ করেছেন।

এ নিষেধাজ্ঞার প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন কাফিররা কুরআনের অসম্মান করবে বা তার কোন ক্ষতি করবে এ ভয়ে।

যদি কখনাে মুসলমানরা এ জাতীয় ভয় হতে মুক্ত হন তখন তারা তাদের সফরের সময় অমুসলিম দেশে নিজের সাথে আল-কুরআন নির্দ্বিধায় নিয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়ে সমগ্র বিশ্ব আজকে একমত, কারােরই কোন দ্বিমত নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মালম্বীরা বর্তমান যুগে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সহজ ভাবে পৌছাবার প্রতিযােগিতায় লিপ্ত। যাতে মানুষ তাদের দ্বীন ধর্ম সম্পর্কে অবগত হতে পারে, আর তাদের ধর্মের দাওয়াত অন্যের কাছে পৌঁছে যায়। মুসলমানরাও এ পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করছে-যে দেশের মানুষের ভাষা আরবী নয় সেদেশের স্থানীয় ভাষায় আল-কুরআন অনুবাদ করে পৌছানোর মাধ্যমে। সুতরাং শত্রুভূমিতে কুরআন নিয়ে সফর করতে নিষেধ করা আক্ষরিক অর্থে সর্বযুগ ও সকল অবস্থার জন্য প্রযােজ্য নয়।

৫. সুস্পষ্ট দলিল বাদ দিয়ে দ্ব্যর্থবােধক দলিলের অনুসরণ করাঃ

গোঁড়ামী ও চরমপন্থার আরেকটি কারণ হচ্ছে মুহকাম বা সুস্পষ্ট দলিল বাদ দিয়ে "মুতাশাবিহ বা দ্ব্যর্থবােধক দলিলের অনুসরণ করা। ➝উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী জাগরণ, পৃ. ৮৬-৮৭

বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি এরূপ করে না। যাদের অন্তরে বক্রতা বিদ্যমান তারাই এমন করে। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ

وهو الذي أنزل عليك الكتاب منه آيات نگات له أم الكتاب وأخر متقابهات فأما قابة منه البعاء الفثلة وابعاء تأويله الذين في قلوبهم زيع فرعون

"তিনিই তােমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার কিছু আয়াত 'মুহকাম এগুলাে কিতাবের মূল, আর অন্যগুলাে ‘মুতাশাবিহ'। যাদের অন্তরে সত্য-লঙ্ঘন করার প্রবণতা রয়েছে তারাই মুতাশাবিহ আয়াতগুলির অনুসরণ করে ফিতনা বিস্তার ও অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে।➝সূরা আলে ইমরানঃ ৭

এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে :

عن عالية قالت تلا رسول الله صلى الله عليه وسلم- هذه الآية فقال: إذا رأيم الذين غوث ما نشانه مثه فأولئك الذين سقى الله فاخوشم »

আয়শা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত তিলাওয়াত করে বললেন- যখন তোমরা কোন মানুষকে দ্ব্যর্থবােধক আয়াতের অনুসরণ করতে দেখবে তখন জানবে এদের কথাই আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তাদেরকে পরিত্যাগ করবে। ➝সহীহ আল-বুখারী : ৪৫৪৭; সহীহ মুসলিম : ৬৯৪৬

চরমপন্থীরা সাধারণত মুতাশাবিহ দলিলের অনুসরণ করে চলে। তারা এসব দলিল দ্বারা নিজেদের হীন উদ্দেশ্য সফল করতে সচেষ্ট হয়। তারা বিভিন্ন বিষয়ের অর্থ ও তাৎপর্য নির্ধারণেও মুতাশাবিহ দলিলের উপরে নির্ভর করে। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের মূল্যায়নে, তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে, মুমিন বা কাফির প্রমাণে মারাত্নক ভ্রান্তিতে উপনীত হয়। ➝ড. ইউসুফ আল-কারজাভী, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, রূপান্তর মুহাম্মদ আখুঞ্জী (ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন, ২০০৫,পৃ. ৫৭-৫৮) উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী জাগরণ, পৃ. ৮৭

সুতরাং কুরআন-হাদীস ভালভাবে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

৬. চরমপন্থার বেড়াজালে ইসলাম প্রচারে প্রতিবন্ধকতাঃ

ইসলাম প্রচারে স্বাধীনতা না থাকা বা ইসলামী দাওয়াতদানে প্রতিবন্ধকতা চরমপন্থা উৎপত্তির আরেকটি কারণ। ➝ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, রূপান্তর মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী, ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন,২০০৫,পৃ. ৭৯

ইসলাম শুধু ব্যক্তির জন্য নয় বরং সমষ্টির জন্য। একক ব্যক্তির বদলে সমাজের সকলকে বাঁচার প্রতি আহ্বান করে। পরস্পরের সহযােগিতা ও সৎ কাজের আদেশ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয় বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। দাওয়াতী ক্ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক। কাজেই ইসলাম বিরােধী শক্তি যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামী তৎপরতাকে নস্যাতের পাঁয়তারা করে, ইসলাম প্রচারের শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে তখন ধর্মপ্রাণ মুসলিম শক্তিও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়েই মােকাবিলা করার দিকে পা বাড়াতে পারে। উক্ত কারণে মুসলমানদেরকে সুষ্ঠু ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করার সুযােগ দিতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিবন্ধকতা গােপন সহিংসতা বা চরমপন্থার জন্ম দিতে পারে।

মুসলিম দেশগুলােতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, মার্কসবাদ, লিবারেলিজম ইত্যাদি মতবাদের প্রবক্তারা যখন স্বাধীনভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযােগ পায় এবং মুসলিম জনতা ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন চরমপন্থা জন্ম নেয়।

৭. যথার্থ ধর্মীয় পরিবেশের অনুপস্থিতিঃ

সমাজে বা দেশে ধর্মীয় পরিবেশ না থাকলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে চরম আঘাত লাগে। ফলে তারা সমাজে ও রাষ্ট্রে ধর্মীয় পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। যার ফলশ্রুতিতে চরমপন্থা ও গোঁড়ামীর পথে কেউ কেউ যাওয়ার চিন্তা করতে পারে।

সুতরাং মুসলিম দেশে যখন ইসলামী পরিবেশের পরিবর্তে অনৈসলামী পরিবেশ গড়ে ওঠে, ইসলামের পৃষ্ঠপােষকতার বদলে ফ্যাসিবাদ, মার্কসবাদ, সেকুলারিজম, সােসালিজম ইত্যাদি লালন করা হয় তখন সেখানে গােঁড়ামী সৃষ্টি হয়। তাছাড়া মুসলিম দেশের শাসকগণ যখন কুরআন-সুন্নাহর বিধানের বদলে মানবরচিত বিধানকে অগ্রাধিকার দেয়, ন্যায়নীতির পরিবর্তে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, ধর্মীয় শাসনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনকে প্রাধান্য দেয় তখন গৌঁড়ামীর উত্থান ঘটে। কারণ ইসলামের বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব ঐক্যবদ্ধ কিন্তু মুসলিম বিশ্ব ইসলামের ব্যাপারে উদাসীন। এমন বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হলেও মুসলিম শাসকগণ মুখে কুলুপ এটে নিশ্চুপ বসে থাকেন যা গোঁড়ামী ও চরমপন্থাকে উস্কে দেয়। ২

৮. মুসলিম উম্মার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আক্রমণ এবং গােপন ষড়যন্ত্রঃ

প্রাচ্যের ও প্রাতিচ্যের, দক্ষিণের ও উত্তরের মুসলিম বিশ্বগুলাে এবং তাদের পবিত্র স্থানগুলাে ন্যাক্কারজনক হামলা ও আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে কখনাে প্রকাশ্য আবার কখনাে গােপন যে সব যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার ফলেও চরমপন্থার উদ্ভব ঘটতে পারে।

➝ আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী, উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলাম, অনুবাদক ড. মাহফুজুর রহমান, খায়রুন প্রাকাশনী, ২০০৪, পৃ. ১২৭-১৩০
➝ ড. ইউসুফ আল-কারজাভী, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, রূপান্তর মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী (ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন, ২০০৫, পৃ. ৭২-৭৩; উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী জাগরণ, পৃ. ১১৬-১১৯

৯. প্রবৃত্তির অনুসরণ

গোঁড়ামী ও চরমপন্থার আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। ➝ফাতহী ইয়াকান, ইসলামী সমাজ বিপ্লবে যুবসমাজের ভূমিকা, অনুবাদ ড.মাহফুজুর রহমান ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৪/১৪২৫ হি:, পৃ. ৩৩

আর মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে কুরআন-হাদীস ছেড়ে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত হয়। শাইখ আব্দুল মুহসিন বলেন :

فان للشيطان مدخلين على المسلمين ، ينفذ منهما إلى أغوائهم وأصلالهم، أحدهما أنه إذا كان المسلم من أهل التفريط والمعاصی ، زين له المعاصي والشهوات ليبقى بعيدا عن طاعة الله ورسوله. والثاني : أنه إذا كان المسلم من أهل الطاعة والعيادة ، زين لها الإفراط والغلو في الدين ، ليفسد عليه دينه

মুসলমানদের বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট করার ক্ষেত্রে শয়তানের দুটি পদ্ধতি রয়েছে, যা মানুষকে বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট করতে সে প্রয়ােগ করে। প্রথমত: যদি মুসলিম ব্যক্তি চরমপন্থী ও অবাধ্য হয় তাহলে তার নিকট অবাধ্যতা ও প্রবৃত্তিকে শয়তান সুশােভিত করে উপস্থাপন করে যাতে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ থেকে দূরে থাকে। দ্বিতীয়ত: যদি মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত ও ইবাদতগুজার হয় তাহলে শয়তান গোঁড়ামী ও চরমপন্থাকে তার সামনে সুন্দর করে উপস্থাপন করে যাতে তার দ্বীন পালনে সে বিভ্রান্ত হয়"➝আব্দুল মুহসিন ইবনু হামদ আল-আব্বাদ আল-বদর, বিআইয়ে আকলিন ওয়াদ্বীনিন ইয়াকুনুত তাফজীর ওয়াত তাদমীর জিহাদান (রিয়াদ: দারুল মুগনী লিন নাস ওয়াত তাওযি ১ম প্রকাশ, ২০০৩/১৪২৪ হি:, পৃ. ৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসেও এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

"জান্নাতকে অপছন্দনীয় জিনিস দ্বারা এবং জাহান্নামকে প্রবৃত্তি দ্বারা আবৃত করে রাখা হয়েছে"। ➝সহীহ মুসলিম : ৭৩০৮

শাইখ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ আরাে বলেন :

ومن مكائد الشيطان لهؤلاء المفرطين الغالين أنه يزين لهم أتباع الهوى وركوب رؤوسهم الفهم في الدين ويزهدهم في الرجوع إلى أهل العلم لئلا يبروهم ويرشدهم إلى الصواب وليبقوا في غيهم وضلالهم -

শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণাই চুড়ান্ত গোঁড়া ও চরমপন্থিদের সামনে প্রবৃত্তির অনুসরণ, ঔদ্ধত্যের শীর্ষে আরােহণ ও দ্বীন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করা সুসজ্জিত করে উপস্থাপন করে এবং বিজ্ঞ আলিমদের থেকে বিমুখ করে রাখে, যাতে বিদ্বানরা তাদের সঠিক জ্ঞান ও সুসজ্জিত করে উপস্থাপন করে এবং বিজ্ঞ আলিমদের থেকে বিমুখ করে রাখে, যাতে বিদ্বানরা তাদের সঠিক জ্ঞান ও সুপথ প্রদর্শন করতে না পারে। আর তারা (চরমপন্থীরা) যেন তাদের সীমালঙ্ন ও ভ্রষ্টতার মধ্যেই ডুবে থাকে। ➝আব্দুল মুহসিন ইবনু হামদ আল-আব্বাদ আল-বদর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪-৫

সুতরাং চরমপন্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির অনুসরণ যে একটি অন্যতম কারণ তা বলাই বাহুল্য।

মহান আল্লাহ প্রবৃত্তির অনুসারীকে বিভ্রান্ত বলে ঘােষণা করে বলেছেন

ومن أضل ممن اتبع هواه يعير هدى من الله به

“আল্লাহর পথনির্দেশকে অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে?" ➝ সূরা আল-কাসাস ৫০

তিনি আরাে বলেছেন :

ولا تتبع الهوى فيضلك عن سبيل الله

"আপনি প্রবৃত্তি অনুসরণ করবেন না। কারণ তা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে"। ➝সূরা সােয়াদ : ২৬

আল্লাহ তা'আলা আরাে বলেছেন

ولا تتبعوا أهواء قوم قد ضلوا من قبل وأضلوا كثيرا وضلوا عن سواء السبيل
“যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং যারা সরল পথ থেকেও বিচ্যুত হয়েছে, তােমরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করাে না”। ➝ সূরা আল-মায়িদা : ৭৭

১০. শরীয়তের উপর ব্যক্তিপূজার প্রাধান্য

ব্যক্তিপূজার মাধ্যমেও গোঁড়ামীর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। অথ্যাৎ ব্যক্তির আনুগত্যে সীমালঙ্নের মধ্য দিয়ে গোঁড়ামীর উদ্ভব ঘটে। একারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم فإنما أنا عيده فقولوا عبيد الله ورسوله

“তােমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাে না খ্রিষ্টানরা যেমন ঈসা আলাইহিস সালাম এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি কেবল আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তােমরা বল আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল"। ➝ সহীহ আল-বুখারী: ৩৪৪৫

সমাজের একশ্রেণীর মানুষ নীতি ও আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিপূজায় বেশি ব্যস্ত। আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক হয় গভীর। এর ফলে মুসলিম সমাজে ফিতনা- ফাসাদ সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে তাকওয়া ও শরীয়তের চেয়ে ব্যক্তির প্রতি তাদের আসক্তি অত্যধিক। এর ফলে সমাজে বিভেদ, দলাদলি ও মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিপ্রেম ও প্রবৃত্তিপূজা আদর্শ ও মূল্যবােধের স্থান দখল করে। ফলশ্রুতিতে গোঁড়ামী ও চরমপন্থার সৃষ্টি হয়। ➝ ইসলামী সমাজ বিপ্লবে যুবসমাজের ভূমিকা, পৃ. ৩১-৩২

উপরােক্ত কারণগুলাে গোঁড়ামী ও চরমপন্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কারণ হতে পারে; তবে কোন কোন কারণ চরমপন্থীদের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। যারা চরমপন্থা ও উগ্রবাদকে দমন করতে চান তাদের এ বিষয়গুলাের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার জন্য সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে।

━━━━━━━━━━━━━━

জয়নাল বিন তোফাজ্জল
ইসলামিক স্টাডিস(বিভাগ), দনিয়া ইউনিভার্সিটি ঢাকা​
 
Similar threads Most view View more
Back
Top