খারেজী সম্প্রদায়ঃ পরিচয়, উৎপত্তি ও চিন্তাধারা - ১
━━━━━━━━━━━━━━━━
ইসলামের ইতিহাসে সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থানের প্রথম ঘটনা আমরা দেখতে পাই খারিজী সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড। ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬ খু.) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান উসমান ইবনু আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এরপর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাপতি ও গভর্নরগণ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু সিরিয়ার গভর্নর মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু আলীর আনুগত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি দাবি জানান যে, আগে খলীফা উসমানের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। আলী দাবি জানান যে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পূর্বে বিদ্রোহীদের বিচার শুরু করলে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে পারে, কাজেই আগে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি জোরালাে হয়ে গৃহ যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। সিফফীনের যুদ্ধে উভয়পক্ষে হতাহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ আলােচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য একটি সালিশী মজলিস গঠন করেন। এই পর্যায়ে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অনুসারীগণের মধ্য থেকে কয়েক হাজার মানুষ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষ ত্যাগ করেন। এদেরকে ‘খারিজী দলত্যাগী বা বিদ্রোহী বলা হয়। এরা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ, যারা রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের প্রায় সকলেই ছিলেন যুবক। এরা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান আবেগী মুসলিম। এরা দাবি করেন যে, একমাত্র কুরআনের আইন ও আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই চলবে না।আল্লাহর বিধান অবাধ্যদের সাথে লড়তে হবে। আল্লাহ বলেছেন:
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
"মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তােমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর অত্যাচার বা সীমালঙ্ন করলে তােমরা জুলুমকারী দলের সাথে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে"। ➝সূরা আল-হুজুরাত: ৯
এছাড়া কুরআনুল কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ
কর্তৃত্ব শুধুমাত্র আল্লাহরই বা "বিধান শুধু আল্লাহরই। ➝সূরা আল-আনআম: ৫৭কাজেই মানুষকে ফয়সালা করার দায়িত্ব প্রদান কুরআনের নির্দেশের স্পষ্ট লঙ্ঘন। কুরআনুল কারীমে আরাে এরশাদ করা হয়েছে,
ومن لم يخ بما أنزل الله فأولية هم الكافرون ۞
"আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির"। ➝সূরা আল-মায়িদাহ: ৪৪
তারা কুরআনের এসব নির্দেশনার অপব্যাখ্যা করে। আলী ও তার অনুগামীগণ যেহেতু আল্লাহর নাযিল করা বিধান মত মু'আবিয়ার সাথে যুদ্ধ না চালিয়ে, সালিশের বিধান দিয়েছেন, সেহেতু তাঁরা কাফির।
তারা দাবি করেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁদের অনুসারীগণ সকলেই কুরআনের আইন অমান্য করে কাফির হয়ে গিয়েছেন। কাজেই তাদের তাওবা করতে হবে। তাঁরা তাঁদের কর্মকে অপরাধ বলে মানতে অস্বীকার করলে তারা তাঁদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে।
তাঁরা তাঁদের মতের পক্ষে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করতে থাকেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবী তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, কুরআন ও হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পারঙ্গম হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আজীবনের সহচর সাহাবীগণ। কুরআন ও হাদীসের তােমরা যে অর্থ বুঝেছ তা সঠিক নয়, বরং সাহাবীদের ব্যাখ্যাই সঠিক। এতে কিছু মানুষ উগ্রতা ত্যাগ করলেও বাকিরা তাদের মতকেই সঠিক বলে দাবি করেন।
এরা ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে 'পিউরিটান' ধারণা লালন করত। তারা মনে করত যে, ইসলামী বিধিবিধানের লংঘন হলেই মুসলিম ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হয়। এজন্য তারা এইরূপ কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা রাজনৈতিক পর্যায়ে ইসলামী বিধিবিধান পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে দলবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। পাশাপশি এই মহান উদ্দেশ্যে (!) যুদ্ধের ময়দান ছাড়া অন্যত্র গুপ্ত হত্যা করে। এছাড়া তারা আলীকে কাফির মনে করেন না এরূপ সাধারণ অযােদ্ধা পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করতে থাকে।
খারিজীদের ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বাণীঃ
━━━━━━━━━━━━━━━━
আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ━━━━━━━━━━━━━━━━
بَاب إِثْمُ مَنْ رَاءَى بِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ أَوْ تَأَكَّلَ بِهِ أَوْ فَخَرَ بِهِ. عَبْدُ اللهِ بْنُ يُوْسُفَ أَخْبَرَنَا مَالِكٌ عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيْدٍ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيْمَ بْنِ الْحَارِثِ التَّيْمِيِّ عَنْ أَبِيْ سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ يَخْرُجُ فِيْكُمْ قَوْمٌ تَحْقِرُوْنَ صَلَاتَكُمْ مَعَ صَلَاتِهِمْ وَصِيَامَكُمْ مَعَ صِيَامِهِمْ وَعَمَلَكُمْ مَعَ عَمَلِهِمْ وَيَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْ الدِّيْنِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ يَنْظُرُ فِي النَّصْلِ فَلَا يَرَى شَيْئًا وَيَنْظُرُ فِي الْقِدْحِ فَلَا يَرَى شَيْئًا وَيَنْظُرُ فِي الرِّيْشِ فَلَا يَرَى شَيْئًا وَيَتَمَارَى فِي الْفُوْقِ.
ভবিষ্যতে এমন সব লোকের আগমন ঘটবে, যাদের সালাতের তুলনায় তোমাদের সালাতকে, তাদের সওমের তুলনায় তোমাদের সওমকে এবং তাদের ‘আমালের তুলনায় তোমাদের ‘আমালকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে (অর্থাৎ অন্তরে) প্রবেশ করবে না। এরা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমনভাবে নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। আর শিকারী সেই তীরের আগা পরীক্ষা করে দেখতে পায়, তাতে কোন চিহ্ন নেই। সে তীরের ফলার পার্শ্বদেশে নযর করে; অথচ সেখানে কিছু দেখতে পায় না। শেষে ঐ ব্যক্তি কোন কিছু পাওয়ার জন্য তীরের নিম্নভাগে সন্দেহ পোষণ করে। ➝ সহীহ আল-বুখারীঃ ৫০৫৮
এদের পরিচয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে দিয়েছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
يأتي في آخر الزمان قوم حدثاء الأسنان سفهاء الأحلام يقولون من خير قول البرية يمرقون من الإسلام كما يمرق السهم من الرمية لا يجاوز إيمانهم حنجرهم، فإذا لقيتموهم فاقتلوهم فإن في قتلهم أجرا لمن قتلهم عند الله يوم القيامة
“শেষ যুগে এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান অপরিপক্কতা, বােকামি ও প্রগলভতায় পূর্ণ। মানুষ যত কথা বলে তন্মধ্যে সর্বোত্তম কথা তারা বলবে। কিন্তু তারা ইসলাম থেকে তেমনি ছিটকে বেরিয়ে যাবে, যেমন করে তীর শিকারের দেহ ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তােমরা যখন তাদেরকে পাবে তখন তাদেরকে হত্যা করবে। কারণ তাদেরকে যারা হত্যা করবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুরস্কার থাকবে"।
এখানে ইসলামের নামে বা সত্য, ন্যায় ও হক্ক প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত মানুষদের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে:
প্রথমত, এরা অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের। এদের নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি সবই যুবক বা তরুণদের হাতে। সমাজের বয়স্ক ও অভিজ্ঞ আলিম ও নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব বা পরামর্শ এরা মূল্যায়ন করে না।
দ্বিতীয়ত, এদের বুদ্ধি অপরিপক্ক ও প্রগলভতাপূর্ণ। আমরা আগেই দেখেছি যে, সকল সন্ত্রাসই মূলত রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য অস্থিরতা ও অদুরদর্শিতা সন্ত্রাসী কর্মের অন্যতম কারণ। অপরিপক্ক বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার অভাব ও দূরদর্শিতার কমতির সাথে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির অহঙ্কার এ সকল সত্যান্বেষী ও ধার্মিক যুবককে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করেছিল।
খারিজী সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তির কারণঃ
━━━━━━━━━━━━━━━━
━━━━━━━━━━━━━━━━
১. জ্ঞানের অহঙ্কার :
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের এই ঘটনা পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, জ্ঞানের অহঙ্কারই ছিল তাদের বিভ্রান্তির উৎস। আমরা এরূপ উগ্রতা ও সন্ত্রাসে লিপ্তদের দুটি বৈশিষ্টের দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ কথা উল্লেখ করেছেন: তারুণ্য এবং বুদ্ধির অপরিপক্কতা বা হটকারিতা। এ কারণে তারা ইসলাম বুঝার ক্ষেত্রে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের বুঝকেই -এর আজীবনের সহচর ও দীন সম্পর্কে অধিক চূড়ান্ত মনে করত। রাসূলুল্লাহর জ্ঞানী সাহাবীগণের মতামতকে অবজ্ঞা করা বা তাদের পরামর্শ গ্রহণকে তারা অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে করত। তাদের বুঝের বাইরে মত-প্রকাশ'কারীদের-কে ঢালাওভাবে তারা অবজ্ঞা করত। এমনকি কাফির আখ্যায়িত করত।
উপর্যুক্ত বিভ্রান্তি থেকে তারা বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যেগুলির কারণে তারা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জিহাদ বলে মনে করে।
২. মুসলিমদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে কাফির আখ্যা দেয়া
খারিজীদের বিদ্রোহ, উৎপত্তি ও বিকাশের প্রথম সূত্র ছিল, কুরআনুল কারীমের কিছু আয়াতের আলােকে আল্লাহর বিধানমত ফয়সালা না দেওয়া কুফুরি কাজ। এটিই ছিল খারিজীদের প্রথম মূলনীতি। তারা কুরআনের কিছু আয়াতের বাহ্যিক অর্থের ভিত্তিতে দাবি করে যে, মুসলিম পাপে লিপ্ত হলে সে কাফির বা ঈমান হারা হয়ে যায়। তাদের মতে ইসলামের যে কোন অনুশাসন ত্যাগ করাই কুফুরি । কাজেই যে ব্যক্তি ইসলামের কোনাে অনুশাসন লঙ্ঘন করে সে ঈমানহারা বা কাফিরে পরিণত হয়।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে কুরআন হাদীসের আলােকে স্পষ্টতই পাপ। যেমন, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার ইত্যাদি। খারিজীগণ শুধু এগুলিকেই কুফরী বলে গণ্য করেনি। উপরন্তু, তাদের মতের বিপরীত রাজনৈতিক কর্ম বা সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে 'পাপ বলে গণ্য করেছে, এরপর তারা সেই পাপকে কুফরী বলে গণ্য করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কাফির আখ্যা দিয়েছে।
প্রকৃত পক্ষে খারিজীগণের কাফির-কথনের মূল ভিত্তি 'পাপ নয়, বরং রাজনৈতিক মতাদর্শ তারা তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় এরূপ সকল মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করত।
৩. কাফিরকে ঢালাও ভাবে হত্যা করা বৈধ মনে করাঃ
কাউকে কাফির বলে গণ্য করা আর তাকে হত্যা করা কখনােই এক বিষয় নয়। কিন্তু খারিজীরা সাধারণ মুসলিমদেরকে কাফির বলেই ক্ষান্ত হয় নি, তারা তাদেরকে ঢালাওভাবে হত্যা করার বৈধতা দাবি করেছে।
৪. রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও ইমাম সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণাঃ
রাষ্ট্রের আনুগত্যের বাইরে যাওয়া কত বড় অপরাধ তা তারা কোন ভাবেই বুঝার চেষ্টা করত না; বরং তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতাকে কখনাে কখনাে বৈধ কাজ মনে করত। খারিজীগণ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপ্রধান ইত্যাদির কোনাে গুরুত্ব স্বীকার করত না। পরবর্তীতে কেউ কেউ তাদেরকে রাষ্ট্র, ইমাম, বাইয়াত ইত্যাদির গুরুত্বের বিষয়ে বললে তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে 'আমীর বা ইমাম বলে বাইয়াত করে নেয়। এভাবে তারা রাষ্ট্রীয় পরিভাষাগুলিকে 'দলের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করে। ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিভিন্ন নতুন চিন্তাধারা সৃষ্টি হয়।
৫. জিহাদকে ব্যক্তিগত ফরয বলে গণ্য করে ইচ্ছামত জিহাদ ঘােষণা করাঃ
কুরআন-হাদীসে অগণিত স্থানে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জিহাদের জন্য মহান পুরস্কার ঘােষণা করা হয়েছে। কাফিরদের সাথে যুদ্ধ ছাড়াও মুসলিম-অমুসলিম সকলের মধ্যে সৎকাজে আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভ্রান্তির ফলে খারিজীগণ রাষ্ট্রীয় ফরয ও ব্যক্তিগত ফযের মধ্যে কোনাে পার্থক্য করত না। তারা জিহাদ ও 'আদেশ নিষেধ বিষয়ক কুরআনী নির্দেশনার আলােকে প্রচার করে যে, জিহাদ ও আদেশ-নিষেধ ইসলামের রুকন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।
(এ প্রবন্ধটি প্রফেসর ড. খােন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর লেখ "ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ" গ্রন্থ থেকে সংকলিত ও সম্পাদক কর্তৃক পরিমার্জিত ও সম্পাদিত।)
খারেজীদের কিছু বৈশিষ্ট্য ও আলামত
━━━━━━━━━━━━━━━━
❑ তারা হবে নবীন, তরুণ ও নির্বোধ, অথচ নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী ভাববে।━━━━━━━━━━━━━━━━
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১১, ৫০৫৭, ৬৯৩৪; মুসলিম হা/ ২৪৬২, ২৪৬৯ ]
❑ তারা সর্বোত্তম (অর্থাৎ খুব ভালো ভালো) কথা বলবে, কিন্ত সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ (অর্থাৎ নিত্যনতুন ফিত্না সৃষ্টি) করবে।
— [ সূত্রঃ মুসলিম হা/২৪৬২; আবুদাঊদ হা/৪৭৬৭; আহমাদ হা/২০৪৪৬ ]
❑ বাহ্যিকভাবে সুন্দর কথা বলবে অর্থাৎ তাদের কথাগুলো সঠিক মনে হবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৫০৫৭ ]
❑ মুখে ঈমানের কথা বললেও তাদের অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র থাকবে না।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/৩৪১৫ ]
❑ তাদের ঈমান ও ছালাত তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না।
— [ সূত্রঃ মুসলিম হা/২৪৬২ ]
❑ পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এরা আর ঈমানের দিকে ফিরে আসবে না। যেমন তীর আর ধনুকের ছিলাতে ফিরে আসে না।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ২৪৬২ ]
❑ তারা হবে ইবাদতে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী অর্থাৎ ইবাদাতে তারা আগে আগে থাকবে, কিন্তু নিজেদের ইবাদতের জন্য হবে অহংকারী। লোকেরা তাদের ইবাদত দেখে অবাক হবে।
— [ সূত্রঃ আহমাদ হা/১২৯৭২; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ হা/৯৪৫ ]
❑ তাদের নিদর্শন হ’ল, তাদের মাথা থাকবে ন্যাড়া।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১; ইবনু মাজাহ হা/১৫৭ ]
❑ তারা মুসলমানদের হত্যা করবে আর কাফের, মুশরিক ও মূর্তিপূজারীদের ছেড়ে দিবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১০; মুসলিম হা/ ২৪৫১ ]
❑ তারা দ্বীনদারিতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে, এমনকি দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১০; মুসলিম হা/ ২৪৫১; আহমাদ হা/ ৭০৩৮; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ, হা/ ৯২৯-৯৩০ ]
❑ তারা মুসলিম শাসকদের নিন্দা করে, অপবাদ দেয় এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও কাফির বলে দাবী করে। যেমনটি খুওয়াইছারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে করেছিল।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১০; মুসলিম হা/ ১০৬৪; মিশকাত হা/ ৫৮৯৪ ]
❑ তারা মানুষকে কিতাবুল্লাহর দিকে আহবান করবে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই থাকবে না। অর্থাৎ কিতাবুল্লাহ দিয়ে দলীল গ্রহণ করবে। কিন্তু না বুঝার কারণে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল করবে।
— [ সূত্রঃ আবুদাঊদ হা/ ৪৭৬৫; আহমাদ হা/ ১৩৩৩৮; মিশকাত হা/ ৩৫৪৩ ]
❑ তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করবে।
— [ সূত্রঃ আহমাদ হা/১২৯৭২; বায়হাক্বী, মাজমা যাওয়ায়েদ ২২৯/৬ ]
❑ তারা সর্বোত্তম দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। যেমন আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে করেছিল।
— [ সূত্রঃ আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/৩০৫ ]
❑ তারা তাদের নিহতদেরকে জান্নাতী মনে করে। যেমন তারা নাহ্রাওয়ানের যুদ্ধের ময়দানে পরস্পরকে ‘জান্নাতমুখী’ ‘জান্নাতমুখী’ বলে ডাকছিল’।
— [ সূত্রঃ আল-বিদায়া ১০/৫৮৭ ]
❑ ওরা এমন জাতি যাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা।
— [ সূরা আলে-ইমরান ১০৬ নং আয়াতের তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ হা/২২৩১৩ ]
❑ মতভেদ ও মতানৈক্যের সময় এদের আবির্ভাব হবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৬৯৩৩ ]
❑ মক্কা থেকে পূর্বের কোন এলাকা থেকে দলটির আবির্ভাব হবে।
— [ সূত্রঃ সহীহ আল বুখারী, হা/ ৭১২৩ ]
❑ যেসব আয়াত কাফেরের জন্য প্রযোজ্য তারা সেগুলিকে মুমিনদের উপর প্রয়োগ করবে।
— [ সূত্রঃ আবুদাঊদ হা/৪৭৬৯ ]
❑ তাদের আগমন ঘটবে শেষ যামানায়।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/৩৪১৫ ]
❑ তারাও কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েই কথা বলবে কিন্তু অপব্যাখ্যা করবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৪১৫ ]
❑ কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েই কথা বলবে কিন্তু অপব্যাখ্যা করবে: ফলে তারা আলেমদের সাথে সবচেয়ে বেশী শত্রুতা পোষণকারী হবে। প্রতিপক্ষের বিরোধিতা করতে গিয়ে জাল হাদীছ পর্যন্ত রচনা করে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আক্বীদাতান ওয়া ফিকরান ৫৪-৬৮ পৃঃ ]
❑ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নামে এ সম্পর্কিত শরী‘আতের দলীলগুলিকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]
❑ ক্বুরআনুল কারিম থেকে তারা কেবল ভীতি প্রদর্শন সংক্রান্ত আয়াতগুলি দিয়ে দলীল গ্রহণ করে। কিন্তু ভাল কাজের পুরস্কার বা উৎসাহমূলক আয়াতগুলিকে পরিত্যাগ করে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]
❑ তারা আলেমগণকে মূল্যায়ন করবে না। নিজেদেরকেই বড় জ্ঞানী মনে করবে। যেমন খারেজীরা নিজেদেরকে হযরত আলী রাঃ, হযরত ইবনু আববাস রাঃ সহ সকল ছাহাবী (রাঃ)-এর চেয়ে জ্ঞানী দাবী করেছিল।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]
❑ ওরা হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]
❑ তারাই সর্বপ্রথম মুসলিমদের জামা‘আত তথা আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামা'আত হ’তে বেরিয়ে গেছে এবং তাদেরকে পাপের কারণে কাফের সাব্যস্ত করেছে।
— [ সূত্রঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৭৯/৩৪৯, ৭/৩ ]
❑ তারা ক্বিয়াস (ধারণা বা অনুমান) ভিত্তিক কাজে বেশী বিশ্বাসী।
— [ সূত্রঃ আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল ১১৬/১ ]
❑ তারা মনে করে যালেম শাসকের শাসন জায়েয নয়।
— [ সূত্রঃ মাকালাতুল ইসলামমিয়্যন ২০৪/১ ]
❑ ওরা মুখে আহলে ইল্মদের তথা মুহাদ্দিসিন ও ফুকাহানে ক্বিরামে ইমামগণের কথার বকওয়ায করে কিন্তু তার মর্মাথ বুঝে না।
— [ সূত্রঃ আশ-শারী‘আহ ২৮ পৃঃ ]
❑ যতবারই তাদের আবির্ভাব হবে, ততবারই তারা ধ্বংস হবে। এভাবে রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) বিশ বার বলেন।
— [ সূত্রঃ ইবনু মাজাহ হা/১৭৪; আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন, মুসনাদ ৩৯৮/৯ ]
❑ ভূপৃষ্ঠে সর্বদাই খারেজী আক্বীদার লোক থাকবে এবং সর্বশেষ এদের মাঝেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।
— [ সূত্রঃ ইবনু মাজাহ হা/১৭৪ ]
❑ তারা হবে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি।
— [ সূত্রঃ মুসলিম হা/ ২৪৬৯, ২৪৫৭ ]
(চলবে)
জয়নাল বিন তোফাজ্জল
ইসলামিক স্টাডিস(বিভাগ), দনিয়া ইউনিভার্সিটি ঢাকা
Last edited: