প্রথমত: আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করার বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ হল, আল্লাহ তা‘আলাকে ঐ গুণে গুণান্বিত করা যে গুণে আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা রাসূল (ﷺ) আল্লাহকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন সেগুলোর কোনরূপ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, অপব্যাখ্যা, সাদৃশ্যদান, ধরন বর্ণনা ও নিস্ক্রীয়করণ ছাড়া যেভাবে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস ও গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত কিছু মূলনীতি অনুসরণ করে থাকে।
যেমন একটি মূলনীতি হলো আল্লাহর নাম ও গুণাবলি তাওক্বীফিয়্যাহ তথা বিলকুল কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর, কুরআন ও হাদিসের দলীল ছাড়া আল্লাহর জন্য কোন গুণ বা বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা যাবে না। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর যেসব গুণের উল্লেখ রয়েছে তাঁর জন্য শুধু সে গুণগুলো সাব্যস্ত করতে হবে এবং কোন মাখলুকের সাথে আল্লাহর গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যতাকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে হবে। যেহেতু আল্লাহ নিজেই বলেছেন- لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُঅর্থ- “তাঁর মত কিছুই নেই, তিনি হচ্ছে সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”[সূরা শুরা, আয়াত: ১১]
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তথা গুণসমূহ সর্বমোট তিন বিভক্ত করা যায়: (১). সাব্যস্তজাত গুণ (২). অসাব্যস্তজাত গুণ। (৩). এমন সিফাত বা গুন যা সাব্যস্তজাত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে আবার অসাব্যস্তজাত হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে।
প্রথম প্রকার: সাব্যস্তজাত গুণ: যা আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে অথবা তার রাসূলের যবানে নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আর এসবই হলো পূর্ণাঙ্গ গুণ যাতে কোনো অপূর্ণাঙ্গতা নেই। যেমন হায়ত (জীবন), ইলম, (জ্ঞান), কুদরত, (ক্ষমতা) শ্রবণ, দর্শন, রহমত, ইয্যত (পরাক্রমশালিতা), হিকমত (প্রজ্ঞা), সর্বোচ্চে থাকা, আযমত (মহত্ব) ইত্যাদি। এসব গুণ আল্লাহ তা‘আলার জন্য তাঁর শান অনুযায়ী প্রকৃত অর্থে সাব্যস্ত করা ওয়াজিব।
দ্বিতীয় প্রকার: অসাব্যস্তজাত সিফাত: আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে যা অসাব্যস্ত করেছেন তা। আর এসবই হলো আল্লাহর জন্য অপূর্ণাঙ্গ গুণ। যেমন মৃত্যু, নিদ্রা, অজ্ঞতা, ভুলে যাওয়া, অক্ষমতা,অবিচার, বিশ্বাসঘাতকতা এবং অবসাদ ইত্যাদি। অতএব এসব গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত না করা ওয়াজিব। এর পাশাপাশি এসবের বিপরীত গুণগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা ওয়াজিব। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য যা অসাব্যস্ত করেছেন তা এ জন্য অসাব্যস্ত করেছেন যে এসবের বিপরীতগুলো আল্লাহর জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে সাব্যস্ত। শুধু অসাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা অসাব্যস্ত করা কোনো পূর্ণাঙ্গতা নয়। তবে যদি অসাব্যস্তকরণ পূর্ণাঙ্গতা শামিল করে তবে তার কথা ভিন্ন। এটা এ কারণে যে অসাব্যস্ত বিষয় হলো অস্তিত্বহীন বিষয়। আর অস্তিত্বহীন বিষয় কোনো বিষয়ই না। অতএব তা পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর অসাব্যস্তকরণ কখনো কখনো পাত্রের অনুপযোগিতার কারণে হয়ে থাকে। অতএব এ অবস্থায়ও তা পূর্ণাঙ্গতাকে হারায়। উদাহরণত, যদি বলি দেওয়াল জুলুম করে না, তবে এ কথা শুদ্ধ হবে না; কারণ দেওয়ালের জুলুম করার কোনো ক্ষমতাই নাই।
তৃতীয় প্রকার: এমন সিফাত যা সাব্যস্তজাত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে আবার অসাব্যস্তজাত হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে। অর্থাৎ যদি গুণটি এমন হয় যা এক অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ এবং অন্য অবস্থায় অপূর্ণাঙ্গ, তবে তা উন্মুক্তভাবে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বৈধও নয়, আবার নিষিদ্ধ তথা নাকোচ করাও বৈধ নয়। বরং এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা রয়েছে। অর্থাৎ যে অবস্থায় গুণটি পূর্ণাঙ্গ সে অবস্থায় তা আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে। আর যে অবস্থায় তা অপূর্ণাঙ্গ সে অবস্থায় তা আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে না। যেমন ষড়যন্ত্র, কৌশল অবলম্বন, ধোঁকা ইত্যাদি। এসব গুণ ওই অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ বলে বিবেচিত হবে যে অবস্থায় তা এমন কারো বিরুদ্ধে করা হবে যে অনুরূপ কর্ম করতে সক্ষম; কেননা তা সে অবস্থায় এটা বোঝাবে যে এ কর্মের কর্তা অভিন্ন ধরনের কর্ম অথবা তার থেকেও শক্তিশালী কর্ম দিয়ে তার শত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম। এ অবস্থার বিপরীত হলে এ গুণগুলো অপূর্ণাঙ্গ গুণ বলে বিবেচিত হবে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তা এমন লোকদের মোকাবিলায় উল্লেখ করেছেন যারা তার সঙ্গে এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে একই আচরণ করে।
উদাহরণস্বরূপ: মহান আল্লাহ বলেন: ﴿وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ) “আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন উত্তম কৌশলী। (সূরা আল আনফাল: ৮: ৩০) তিনি আরো বলেছেন إِنَّهُمۡ يَكِيدُونَ كَيۡدٗا ١٥ وَأَكِيدُ كَيۡدٗا) “নিশ্চয় তারা ভীষণ কৌশল করছে। আর আমিও ভীষণ কৌশল করছি।’ (সূরা আত তারিক: ৮৬: ১৫-১৬) তিনি আরো বলেছেন,﴿ وَٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِنَا سَنَسۡتَدۡرِجُهُم مِّنۡ حَيۡثُ لَا يَعۡلَمُونَ ١٨٢ وَأُمۡلِي لَهُمۡۚ إِنَّ كَيۡدِي مَتِينٌ ١٨٣ ﴾”আর যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে ধীরে ধীরে এমনভাবে পাকড়াও করব যে, তারা জানতেও পারবে না। আর আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি। নিশ্চয় আমার কৌশল শক্তিশালী। (সূরা আল আরাফ: ৭: ১৮২-১৮৩)
উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে আমরা আল্লাহর জন্য “কোমর” সাব্যস্ত করা হয়েছে কিনা সেটা পরিস্কার করার চেষ্টা করবো, মূলত যে হদীসটির আলোকে একদল সালাফ “কোমর” আল্লাহর জন্য সত্তাগত সিফাত সাবস্ত করেন সে হাদীসটি হচ্ছে, রাসূল ﷺ বলেছেন
আল্লাহ তা‘আলা যখন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন ‘রেহেম (আত্মীয়তা)’ উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কোমর ধরল। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? সে বলল, এটা হ’ল আত্মীয়তা ছিন্নকারী হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিনণ করব? রেহেম বলল, জ্বী হ্যাঁ, প্রভু! তিনি বললেন, এটা তো তোমারই জন্য। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ইচ্ছা হ’লে পড়তে পার, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে”।(সূর মুহাম্মাদ ৪৭/২২সহীহ বুখারী হা/৪৮৩০)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফাউমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
“হাকউন (কোমর) হলো লুঙ্গি বাধার স্থান আর তা হলো কোমর। অতঃপর তারা এ বিষয়ে অর্থের প্রশস্ততা রেখেছেন। এমনকি তারা নামকরণ করেছেন : লুঙ্গি বাধার জায়গা। যা লজ্জাস্থানের উপর শক্ত করে লুঙ্গি বাঁধা হয়। বহুবচন হল আহাক্কু ও হুকী। যেমন (فلس) ফালসুন এর বহুবচন (فلوس) ফুলুসুন। আর কখনো কখনো (حقاء) হিক্বায়ুনও বহুবচন করা হয়। যেমন ( سهم) সাহমুন এর বহুবচন ( سهام) সিহামুন”।(মিসবাহুল-মুনির; ১৪৫, ইবনে সাইয়িদা; খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৫৬)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] সিলসিলাতূস সহিহাহ-এর মধ্যে বলেছেন: الحجزة (হুজ্জাহ) (হা বর্ণে পেশ দিয়ে করতে হয়) যার অর্থ হলো যেই স্থানে লুঙ্গি শক্ত করে বাধা হয়। বলা হয় আমি তার বাঁধার মাধ্যমে গ্রহণ করেছি অর্থাৎ আমি তার দ্বারা সাহায্য চেয়েছি এবং তার সাথে মিলে গেছি যেমনটি অভিধানে এসেছে।আর হাকওয়া হল তার অর্থের ক্ষেত্রে একই রকম। এ শব্দটিকে লুঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন উম্মে আতিয়ার হাদিসে রয়েছে: فأعطاها حقوه সে তাকে তার লুঙ্গি দিল। ইবনু হাজার আসকালানী ফাতুহল বারীতে বলেছেন: হাকওয়া শব্দটি মূলত লুঙ্গির স্থানকে বুঝাই। তবে রূপকভাবে এ শব্দটির দ্বারা লুঙ্গিকে বুঝায়।(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-১৮৮০৭১)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হাদিসটির অর্থ থেকে কি এটা প্রমানিত হয় যে,মহান আল্লাহ তাআলার মর্যাদা ও বড়ত্বের অনুযায়ী যেভাবে শোভনীয় ঠিক সেভাবেই তার সত্তাগত সিফাত “কোমর” রয়েছে? নাকি এই হাদিসের অর্থের বাহ্যিকতা এমন যে,এটি পরোক্ষভাবে আত্মীয়তার অধিকারের মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং তার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করার ইঙ্গিত করে। অতঃপর তা আল্লাহ তাআলার দিকে সম্বন্ধিত করা হয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং মর্যাদাসূচক হিসেবে?
উপরোক্ত এই সম্ভাবনার উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের দুটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত।
প্রথমত: নির্দিষ্ট অর্থের উপর প্রমাণিত নির্দিষ্ট দলিল হওয়া। এটি হলো ইজতিহাদ ও গবেষণামূলক মাসআলা-মাসায়েল এর অন্তর্ভুক্ত। এই অর্থটি প্রকাশিত হওয়া ও না হওয়া মূলত একটি আপেক্ষিক বিষয়। যা মুজতাহিদ ব্যক্তির প্রাধান্য অনুযায়ী ও তার গবেষণা অনুযায়ী হয়ে থাকে।যেমন:শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ: বলেন,”الخفاء والظهور من الأمور النسبية الإضافية فقد يتضح لبعض الناس أو للإنسان في بعض الأحوال ما لا يتضح لغيره أو له في وقت آخر “সম্বন্ধযুক্ত আপেক্ষিক বিষয়গুলোর মধ্য হতে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিষয়গুলো কতিপয় মানুষের কাছে স্পষ্ট অথবা কিছু অবস্থায় মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় যা অন্যান্যদের কাছে অস্পষ্ট অথবা অন্য সময়ে আরেকজন ব্যক্তির কাছে অস্পষ্ট”। (রদাউ তায়ারুজ; খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৩০)
দ্বিতীয়: নিশ্চয়ই এটি অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা দেয় এমন মাসআলার স্বীকৃতি দেওয়া অথবা অকাট্যভাবে আমল করার স্বীকৃতি দেওয়া অথবা অতি প্রয়োজনীয় বিধানের স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে কোন গবেষণা বা মতভেদ করার সুযোগ নেই; তা আবশ্যক করে না। বরং অকাট্য জ্ঞান ও আমল সংক্রান্ত মাসআলার ক্ষেত্রে ইজতেহাদ ও গবেষণা এবং তাতে সম্ভাবনাময় পরিধি রয়েছে। একজন আলেম বা বক্তা এমন কিছু নিশ্চিতভাবে দাবি করতে পারেন,যা অন্য কেউ জানে না। তার ধারণা প্রবণ অথবা সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া ছাড়াও। যেমন: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
আমল সংক্রান্ত অনেক মাসআলা অকাট্য বা নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয়। আবার ইলম/জ্ঞান সংক্রান্ত অনেক মাসআলা অকাট্য বা নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয় না। আর মাসআলাটি অকাট্য বা ধারণা প্রমাণ হওয়া মূলত সমন্ধনীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো মাসআলাটি একজন ব্যক্তির কাছে অকাট্য দলিল প্রকাশ পাওয়ার কারণে নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয়। যেমন একজন ব্যক্তি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে স্পষ্ট দলিল শুনেছেন এবং তার উদ্দেশ্য দৃঢ়তার সাথে বুঝেছেন। আবার আরেকজন ব্যক্তির কাছে মাসআলাটি ধারণাপ্রবণ জ্ঞানের উপকারিতা দেয় না। যদিও সেটি অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা দেয়। যেমন হয়তো সে ব্যক্তি নিজে স্পষ্ট দলিলের কাছে পৌঁছাতে পারেনি বা তার কাছে তা সাব্যস্ত হয়নি অথবা তার অর্থের মাধ্যমে অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা অর্জন করা অসম্ভব। (মাজমুউল ফাতাওয়া ২৩/৩৪৭)। তিনি এটাও বলেছেন,وخفاءُ الدلالة وظهورُها : أمرٌ نِسْبِى ؛ فقد يَخْفى على هذا ، ما يَظْهر لهذا”আর অর্থের স্পষ্ট ও অস্পষ্ট হওয়া এটি একটি সম্বন্ধনীয়/ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিষয়। এটি কখনো একজনের নিকট অস্পষ্ট থাকলেও অন্যজনের কাছে তা স্পষ্ট। (জামিউল মাসায়ীল ২/২৮৮)।
তৃতীয়ত: বড় মাসআলা ছাড়া যেমন ইলম, আমলের মাসআলা অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে যার কাছে দলিলের সাব্যস্তটা প্রাধান্য পাবে তার দলিলটা জ্ঞান এবং আমলের মাসআলার উপর প্রমাণ করবে। যদি কথাটি তার আবশ্যকের মাধ্যমে হয়ে থাকে যদিও সেটা স্পষ্ট পদ্ধতিতে ছিল অথবা ধারণা প্রবাল থাকে তাহলে সেটা ইয়াকিন কিংবা কতয়ী এর পদ্ধতিতে হবে না।যেমন:শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: “মানুষদের মধ্য হতে যারা বলে যে, উসূল তথা মৌলিক মূলনীতিগুলোর মাসআলা মাসায়েল (তাওহীদ/আক্বিদাহ)-এর ক্ষেত্রে অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা দেয় এমন দলিল দ্বারা গ্রহণ করা বৈধ রয়েছে। প্রবল ধারণার উপকারিতা দেয়, তা দ্বারা গ্রহণ করা বৈধ নয়। এটি কি সঠিক?
এক্ষেত্রে দুটি মতামত রয়েছে: যদি এ সকল বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে আমরা আদিষ্টত হই। যেমন: আল্লাহর একত্ববাদ, রাসূলের প্রতি ঈমান আনা ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনার প্রতি বিশ্বাস রাখা। তবে যে সব ক্ষেত্রে আমরা দৃঢ়তার সাথে আদিষ্টিত না,সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারী এমন দলিল ছাড়া তা সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। আর যে সকল বিষয়ে আমাদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব নয়, যেমন প্রতিদান ও শাস্তি-এর বিবরণ এবং কতিপয় নামসমূহ ও গুণাবলীর অর্থের বিবরণ ইত্যাদি; সুতরাং এগুলোর ক্ষেত্রে যদি নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয় এমন দলিল পাওয়া না যায়, যা দুই দিকের যেকোনো এক দিক প্রমাণ করে, তবে দলিলদাতার প্রাধান্যময় কথা গ্রহণযোগ্য হবে। এটি হল ন্যায়সঙ্গত সঠিক প্রাধান্যময় বাহ্যিকতা। বরং শুধু অজ্ঞ থাকার থেকে এটি অধিকতর উত্তম। তবে মানুষদের মধ্যে হতে যারা দ্বন্দ্বপূর্ণ মাসআলা গুলো কিংবা সূক্ষ্ম মাসআলা গুলোর ক্ষেত্রে নিশ্চিত জ্ঞানের কাছে পৌঁছার ক্ষমতা রাখে না, সেক্ষেত্রে তারা তাদের সাধ্য ও ইজতিহাদ অনুযায়ী কথা বলবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা কাউকে সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। (বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়াহ ৮/৪৫৪, জাওয়াবু ইতিরাযাতিল মিসরিয়াহ আলাল ফাতওয়ায়ীল হামাবিয়াহ ৪৯ – ৫৩)।
চতুর্থত: কতিপয় আলেম মত দিয়েছেন যে, আবু হুরায়রা উল্লেখিত হাদিসটি সিফাতের হাদিসের অন্তর্ভুক্ত। হাকউন (কোমর) শব্দটি আল্লাহ তায়ালার দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার গুণ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ বলেন:
এটি ঐ সমস্ত হাদিসের অন্তর্ভুক্ত যারা এই কথাগুলোকে মান্য করে তাদের জন্য দলিলস্বরূপ আর যারা সেটাকে অস্বীকার করে তাদের জন্য প্রতিবাদস্বরূপ। তিনি কাযি আবি ইয়ালা থেকে এবং তার শায়েখ আবু আব্দুল্লাহ ইবনু হামিদ থেকে সাব্যস্ত করার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আর এটা ইবনু হামিদ বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্ভল থেকে। তিনি বলেছেন: প্রতিটি হাদিস যেরূপ বর্ণিত হয়েছে, অনুরূপ থাকবে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে উদ্দেশ্যে হলো এই হাদিসটি সমষ্টিগতভাবে সিফাতের হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত, যার ব্যাপারে ইমামগন দলিল বর্ণনা করেছেন যে, এটি যেরূপ বর্ণিত হয়েছে, অনুরূপই থাকবে। আর তারা তার আবশ্যকতাকে নাকচকারী ব্যক্তিদের প্রত্যাখ্যান করেছেন”।(বায়ানু তালবিসীল জাহমিয়া ৬/২০৫-২৪১), (কিতাব-সুন্নাহতে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার গুণাবলী: শাইখ উলুব্বী আশ-শাক্বাফ: ১২৫-১২৮)।
দ্বিতীয় কথা: পক্ষান্তরে একদল আলেমদের মতে এই হাদিসটি আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত হাদিস নয়। আর এই জন্যই অধিকাংশ ইমামগন তাদের গ্রন্থে আকিদা অধ্যায়ে এটি উল্লেখ করেননি। তারা কুরআন-সুন্নাহতে বর্ণিত আল্লাহ তায়ালার সিফাতগুলোকে একত্রিত করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম বুখারী সহ কোন মুহাদ্দিস এই সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে তার উপর কোন অধ্যায় রচনা করে নি। এমনকি তাদের কেউ ধারণা করেছেন যে, এটা সবার ঐক্যমতে এই (আক্বীদা) অধ্যায়ের বহির্ভূত বিষয়। এটি মূলত পরোক্ষভাবে আত্মীয়তা সম্পর্ক এর অধিকারের মর্যাদা নিশ্চিত হওয়া সম্পর্কিত হাদিস। যেমন: অপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ রক্ত সম্পর্কে মূল হল রাহমান। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ যে তোমার সাথে সুসম্পর্ক রাখবে, আমি তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমা হতে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও সে লোক হতে সম্পর্ক ছিন্ন করব।(সহীহ বুখারী হা/৫৯৮৮) অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, আবদুর রাহমান (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ পরিপূর্ণ কল্যাণ ও প্রাচুর্যের অধিকারী আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ ‘আমিই আল্লাহ্ এবং আমিই রাহমান। আত্মীয়তার সম্পর্ককে আমিই সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম হতে নির্গত করে এই নাম (রাহমান হতে রেহেম) রেখেছি। যে ব্যক্তি এই সম্পর্ক বহাল রাখবে আমিও তার সাথে (রাহমাতের) সম্পর্ক বহাল রাখব। আর এই সম্পর্ক যে ব্যক্তি ছিন্ন করবে আমিও তার হতে (রাহমাতের) সম্পর্ক ছিন্ন করব”।(সিলসিলা সহীহাহ হা ৫২০; মুসনাদ আহমাদ/১৬৮৯)।
সৌদি আরবের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সা‘ঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অনুষদ সদস্য ও অধ্যাপক,আকিদা ও ফিকহের প্রাজ্ঞ পণ্ডিত, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ‘আব্দুর রহমান বিন নাসির আল-বাররাক (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫২ হি./১৯৩৩ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: এই হাদিসে কি “কোমর” সিফাত আল্লাহ তা’আলার উপযুক্ত মহত্ত্ব ও মর্যাদার সাথে তার জন্য সাব্যস্ত হওয়ার উপর প্রমাণ করে?
الحمد لله، وصلى الله وسلم على نبينا محمد، أما بعد؛ فنقول كما قال الإمام الشافعي رحمه الله : “آمنا بالله وبما جاء عن الله على مراد الله، وآمنا برسول الله وبما جاء عن رسول الله على مراد رسول الله” !!وهذا يشمل ما ظهر لنا معناه، وما لم يظهر معناه ؛ فما ظهر معناه قلنا: هذا مراد الله، أو مراد رسول الله صلى الله عليه وسلم، وما لم يظهر معناه نفوض علمه إلى عالمه.وهذا الحديث مما يشتبه معناه ؛ هل المراد حقيقة هذه الكلمات: الأخذ، الرحم، الحقو، أو هو تمثيل لحق الرحم، وهي القرابة عند الله تعالى؟ لأن من المعلوم أن الرحم مطلقا يدل على المعنى الكلي المشترك بين كل قرابة، وقد دلت النصوص على أن القرابة صلةٌ تستوجب حقا للقريب على قريبه، بحسب حاله ودرجة قرابته، فأوجبت الشريعة صلة الرحم، وحرمت القطيعة، فقال تعالى في الثناء: ( وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ )، وقال في الذم: ( وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ )، وقال سبحانه: ( فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ )، وعلى هذا فالحديث يشبه قوله صلى الله عليه وسلم عن الله: ( قال الله عز وجل: الكبرياء ردائي والعظمة إزاري )، ويشبه من حيث الأسلوب قوله صلى الله عليه وسلم: ( وأنا آخذ بحُجَزكم عن النار، وأنتم تفلتون من يدي )، وهذا الاحتمال عندي أنه أظهر، وذلك لأن جنس الرحم ليست شيئا معينا موجودا في الخارج، بل الموجود أفراد الرحم، وهي لقرابات التي بين الناس، كما تقدم.ويحسن هنا أن نثبت قول شيخ الإسلام ابن تيمية في نقض التأسيس: (6/222) (ط.مجمع الملك فهد)، قال رحمه الله: “هذا الحديث في الجملة من أحاديث الصفات التي نص الأئمة على أنه يمر كما جاء، وردوا على من نفى موجَبه”أهـ. وعلى هذا : فالحقو لله صفة له سبحانه، ليس شيئا بائنا عنه، ولا عدول لنا عن مذهب أهل السنة، وما نص عليه الأئمة… ”
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরুদ ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর: ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন আমরা সেটাই বলবো: আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করি এবং আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে যা এসেছে তার প্রতিও ঈমান আনয়ন করি, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান আনেন করি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু উদ্দেশ্য করে নিয়ে এসেছেন সেগুলোর প্রতিও ঈমান আনেন করি। এই হাদীসটি অন্তর্ভুক্ত করে ঐ সমস্ত জিনিসকে যার অর্থটা আমাদের কাছে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট উভয় অর্থই শামিল করে। ফলে যেগুলোর অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট সেগুলোর ব্যাপারে আমরা বলবো এটি আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্য। অস্পষ্ট অর্থগুলোর ক্ষেত্রে আমরা বলবো যে, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ভালো জানেন।
এই হাদিসটি তার অর্থকে সাদৃশ্যপূর্ণ করে। الأخذ، الرحم، الحقو এই শব্দগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি: সেটা কি আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার দৃষ্টান্ত যেটা আল্লাহ তায়ালা আত্মীয়তার কথা বলেছেন? কেননা সবার জানা বিষয়ে রিহমুন (আত্মীয়তার সম্পর্ক) বিষয়টি সমস্ত আত্মীয়তা সম্পর্ককে শামিল করে। কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি বন্ধন; যা একজন নিকটাত্মীয়ের কাছে আরেকজন নিকটাত্মীয়ের অবস্থা ও মর্যাদা অনুপাতে অধিকার আবশ্যক করে।
তাই শরীয়ত আত্মীয়তার সম্পর্কের বন্ধন আবশ্যক করে দিয়েছে এবং সম্পর্ক ছিন্ন করাকে হারাম করেছে। আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তা-সম্পর্কের বন্ধন সম্পর্কে প্রশংসা করে বলেন,وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ.আর তারা সে সব সম্পর্ক সম্বন্ধ বহাল রাখে যা বহাল রাখার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন।(সূরা রাদ: ২১)। তিনি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীদের নিন্দা করে বলেন,وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ.এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ আল্লাহ করেছেন,তা ছিন্ন করে,(সূরা বাকারা: ২৭)।
তিনি আরো বলেন, فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ.”তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?(সূরা মুহাম্মাদ: ২২) তাই এর উপর ভিত্তি করে, আলোচ্য হাদিসটি আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে রাসূলের নিম্নোক্ত বাণীর সাদৃশ্য রাখে। যেমন: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ قال الله عز وجل: الكبرياء ردائي والعظمة إزاري.মহান আল্লাহ বলেন, অহংকার হলো আমার চাঁদর এবং মহত্ব হলো আমার লুঙ্গি।
যে কেউ এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।(সুনানে আবু দাউদ হা/৪০৯০) অনুরূপভাবে আলোচ্য হাদিসটি নীতিগত দিক থেকে রাসুলের নিম্নোক্ত বাণীর সাদৃশ্য রাখে।রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, وأنا آخذ بحُجَزكم عن النار، وأنتم تفلتون من يدي.” আমি আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমরবন্ধ ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ”।(সহিহ মুসলিম হা/৫৮৫২) এই সম্ভাবনাময় উত্তরটি আমার কাছে বেশি স্পষ্ট। কারণ আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন কোন নির্দিষ্ট বিষয় না যে এটি মানুষের বহির্ভূত (ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিষয়)। বরং আত্মীয়তার সম্পর্কের প্রত্যেকের মাঝে অন্তর্ভুক্ত বিষয়। মানুষের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্কের একটি বন্ধন। যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে।
এখানে আলোচ্য হাদীসে ভ্রান্ত মতাদর্শকে খন্ডনের ক্ষেত্রে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এর উক্তিকে মেনে নেওয়া শোভনীয়। (মুদ্রণ: কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স ৬/২২২ এ তিনি (ইবনে তাইমিয়া) বলেন, এখানে উদ্দেশ্যে হলো এই হাদিসটি সমষ্টিগতভাবে সিফাতের হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। যার ব্যাপারে ইমামগন দলিল বর্ণনা করেছেন যে, এটি যেরূপ বর্ণিত হয়েছে, অনুরূপই থাকবে। আর তারা তার আবশ্যকতাকে নাকচকারী ব্যক্তিদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, আল্লাহ তাআলার “কোমর” মূলত তার (সত্তাগত) সিফাত, আর এটি স্পষ্ট। এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ এবং ইমামদের দলিল-প্রমাণাদি থেকে আমাদের দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০৫৬৫০)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
যেমন একটি মূলনীতি হলো আল্লাহর নাম ও গুণাবলি তাওক্বীফিয়্যাহ তথা বিলকুল কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর, কুরআন ও হাদিসের দলীল ছাড়া আল্লাহর জন্য কোন গুণ বা বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা যাবে না। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর যেসব গুণের উল্লেখ রয়েছে তাঁর জন্য শুধু সে গুণগুলো সাব্যস্ত করতে হবে এবং কোন মাখলুকের সাথে আল্লাহর গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যতাকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে হবে। যেহেতু আল্লাহ নিজেই বলেছেন- لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُঅর্থ- “তাঁর মত কিছুই নেই, তিনি হচ্ছে সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”[সূরা শুরা, আয়াত: ১১]
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তথা গুণসমূহ সর্বমোট তিন বিভক্ত করা যায়: (১). সাব্যস্তজাত গুণ (২). অসাব্যস্তজাত গুণ। (৩). এমন সিফাত বা গুন যা সাব্যস্তজাত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে আবার অসাব্যস্তজাত হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে।
প্রথম প্রকার: সাব্যস্তজাত গুণ: যা আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে অথবা তার রাসূলের যবানে নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আর এসবই হলো পূর্ণাঙ্গ গুণ যাতে কোনো অপূর্ণাঙ্গতা নেই। যেমন হায়ত (জীবন), ইলম, (জ্ঞান), কুদরত, (ক্ষমতা) শ্রবণ, দর্শন, রহমত, ইয্যত (পরাক্রমশালিতা), হিকমত (প্রজ্ঞা), সর্বোচ্চে থাকা, আযমত (মহত্ব) ইত্যাদি। এসব গুণ আল্লাহ তা‘আলার জন্য তাঁর শান অনুযায়ী প্রকৃত অর্থে সাব্যস্ত করা ওয়াজিব।
দ্বিতীয় প্রকার: অসাব্যস্তজাত সিফাত: আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে যা অসাব্যস্ত করেছেন তা। আর এসবই হলো আল্লাহর জন্য অপূর্ণাঙ্গ গুণ। যেমন মৃত্যু, নিদ্রা, অজ্ঞতা, ভুলে যাওয়া, অক্ষমতা,অবিচার, বিশ্বাসঘাতকতা এবং অবসাদ ইত্যাদি। অতএব এসব গুণ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত না করা ওয়াজিব। এর পাশাপাশি এসবের বিপরীত গুণগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা ওয়াজিব। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য যা অসাব্যস্ত করেছেন তা এ জন্য অসাব্যস্ত করেছেন যে এসবের বিপরীতগুলো আল্লাহর জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে সাব্যস্ত। শুধু অসাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা অসাব্যস্ত করা কোনো পূর্ণাঙ্গতা নয়। তবে যদি অসাব্যস্তকরণ পূর্ণাঙ্গতা শামিল করে তবে তার কথা ভিন্ন। এটা এ কারণে যে অসাব্যস্ত বিষয় হলো অস্তিত্বহীন বিষয়। আর অস্তিত্বহীন বিষয় কোনো বিষয়ই না। অতএব তা পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আর অসাব্যস্তকরণ কখনো কখনো পাত্রের অনুপযোগিতার কারণে হয়ে থাকে। অতএব এ অবস্থায়ও তা পূর্ণাঙ্গতাকে হারায়। উদাহরণত, যদি বলি দেওয়াল জুলুম করে না, তবে এ কথা শুদ্ধ হবে না; কারণ দেওয়ালের জুলুম করার কোনো ক্ষমতাই নাই।
তৃতীয় প্রকার: এমন সিফাত যা সাব্যস্তজাত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে আবার অসাব্যস্তজাত হওয়ারও সম্ভাবনা রাখে। অর্থাৎ যদি গুণটি এমন হয় যা এক অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ এবং অন্য অবস্থায় অপূর্ণাঙ্গ, তবে তা উন্মুক্তভাবে আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বৈধও নয়, আবার নিষিদ্ধ তথা নাকোচ করাও বৈধ নয়। বরং এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা রয়েছে। অর্থাৎ যে অবস্থায় গুণটি পূর্ণাঙ্গ সে অবস্থায় তা আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে। আর যে অবস্থায় তা অপূর্ণাঙ্গ সে অবস্থায় তা আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে না। যেমন ষড়যন্ত্র, কৌশল অবলম্বন, ধোঁকা ইত্যাদি। এসব গুণ ওই অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ বলে বিবেচিত হবে যে অবস্থায় তা এমন কারো বিরুদ্ধে করা হবে যে অনুরূপ কর্ম করতে সক্ষম; কেননা তা সে অবস্থায় এটা বোঝাবে যে এ কর্মের কর্তা অভিন্ন ধরনের কর্ম অথবা তার থেকেও শক্তিশালী কর্ম দিয়ে তার শত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম। এ অবস্থার বিপরীত হলে এ গুণগুলো অপূর্ণাঙ্গ গুণ বলে বিবেচিত হবে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তা এমন লোকদের মোকাবিলায় উল্লেখ করেছেন যারা তার সঙ্গে এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে একই আচরণ করে।
উদাহরণস্বরূপ: মহান আল্লাহ বলেন: ﴿وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ) “আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন উত্তম কৌশলী। (সূরা আল আনফাল: ৮: ৩০) তিনি আরো বলেছেন إِنَّهُمۡ يَكِيدُونَ كَيۡدٗا ١٥ وَأَكِيدُ كَيۡدٗا) “নিশ্চয় তারা ভীষণ কৌশল করছে। আর আমিও ভীষণ কৌশল করছি।’ (সূরা আত তারিক: ৮৬: ১৫-১৬) তিনি আরো বলেছেন,﴿ وَٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِنَا سَنَسۡتَدۡرِجُهُم مِّنۡ حَيۡثُ لَا يَعۡلَمُونَ ١٨٢ وَأُمۡلِي لَهُمۡۚ إِنَّ كَيۡدِي مَتِينٌ ١٨٣ ﴾”আর যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে ধীরে ধীরে এমনভাবে পাকড়াও করব যে, তারা জানতেও পারবে না। আর আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি। নিশ্চয় আমার কৌশল শক্তিশালী। (সূরা আল আরাফ: ৭: ১৮২-১৮৩)
উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে আমরা আল্লাহর জন্য “কোমর” সাব্যস্ত করা হয়েছে কিনা সেটা পরিস্কার করার চেষ্টা করবো, মূলত যে হদীসটির আলোকে একদল সালাফ “কোমর” আল্লাহর জন্য সত্তাগত সিফাত সাবস্ত করেন সে হাদীসটি হচ্ছে, রাসূল ﷺ বলেছেন
خَلَقَ اللهُ الْخَلْقَ، فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَامَتِ الرَّحِمُ فَأَخَذَتْ بِحَقْوِ الرَّحْمَنِ فَقَالَ لَهَا مَهْ. قَالَتْ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيْعَةِ. قَالَ أَلاَ تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ. قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ. قَالَ فَذَاكِ لَكِ. قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ (فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوْا فِى الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوْا أَرْحَامَكُمْ).”
আল্লাহ তা‘আলা যখন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টি করলেন, তখন ‘রেহেম (আত্মীয়তা)’ উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কোমর ধরল। আল্লাহ তা‘আলা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? সে বলল, এটা হ’ল আত্মীয়তা ছিন্নকারী হ’তে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান! তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিনণ করব? রেহেম বলল, জ্বী হ্যাঁ, প্রভু! তিনি বললেন, এটা তো তোমারই জন্য। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ইচ্ছা হ’লে পড়তে পার, ‘তবে কি (হে মুনাফিক সমাজ!) তোমরা আধিপত্য লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন সমূহকে ছিন্ন করবে”।(সূর মুহাম্মাদ ৪৭/২২সহীহ বুখারী হা/৪৮৩০)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফাউমী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
“হাকউন (কোমর) হলো লুঙ্গি বাধার স্থান আর তা হলো কোমর। অতঃপর তারা এ বিষয়ে অর্থের প্রশস্ততা রেখেছেন। এমনকি তারা নামকরণ করেছেন : লুঙ্গি বাধার জায়গা। যা লজ্জাস্থানের উপর শক্ত করে লুঙ্গি বাঁধা হয়। বহুবচন হল আহাক্কু ও হুকী। যেমন (فلس) ফালসুন এর বহুবচন (فلوس) ফুলুসুন। আর কখনো কখনো (حقاء) হিক্বায়ুনও বহুবচন করা হয়। যেমন ( سهم) সাহমুন এর বহুবচন ( سهام) সিহামুন”।(মিসবাহুল-মুনির; ১৪৫, ইবনে সাইয়িদা; খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৫৬)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] সিলসিলাতূস সহিহাহ-এর মধ্যে বলেছেন: الحجزة (হুজ্জাহ) (হা বর্ণে পেশ দিয়ে করতে হয়) যার অর্থ হলো যেই স্থানে লুঙ্গি শক্ত করে বাধা হয়। বলা হয় আমি তার বাঁধার মাধ্যমে গ্রহণ করেছি অর্থাৎ আমি তার দ্বারা সাহায্য চেয়েছি এবং তার সাথে মিলে গেছি যেমনটি অভিধানে এসেছে।আর হাকওয়া হল তার অর্থের ক্ষেত্রে একই রকম। এ শব্দটিকে লুঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন উম্মে আতিয়ার হাদিসে রয়েছে: فأعطاها حقوه সে তাকে তার লুঙ্গি দিল। ইবনু হাজার আসকালানী ফাতুহল বারীতে বলেছেন: হাকওয়া শব্দটি মূলত লুঙ্গির স্থানকে বুঝাই। তবে রূপকভাবে এ শব্দটির দ্বারা লুঙ্গিকে বুঝায়।(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-১৮৮০৭১)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হাদিসটির অর্থ থেকে কি এটা প্রমানিত হয় যে,মহান আল্লাহ তাআলার মর্যাদা ও বড়ত্বের অনুযায়ী যেভাবে শোভনীয় ঠিক সেভাবেই তার সত্তাগত সিফাত “কোমর” রয়েছে? নাকি এই হাদিসের অর্থের বাহ্যিকতা এমন যে,এটি পরোক্ষভাবে আত্মীয়তার অধিকারের মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং তার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করার ইঙ্গিত করে। অতঃপর তা আল্লাহ তাআলার দিকে সম্বন্ধিত করা হয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান এবং মর্যাদাসূচক হিসেবে?
উপরোক্ত এই সম্ভাবনার উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের দুটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত।
প্রথমত: নির্দিষ্ট অর্থের উপর প্রমাণিত নির্দিষ্ট দলিল হওয়া। এটি হলো ইজতিহাদ ও গবেষণামূলক মাসআলা-মাসায়েল এর অন্তর্ভুক্ত। এই অর্থটি প্রকাশিত হওয়া ও না হওয়া মূলত একটি আপেক্ষিক বিষয়। যা মুজতাহিদ ব্যক্তির প্রাধান্য অনুযায়ী ও তার গবেষণা অনুযায়ী হয়ে থাকে।যেমন:শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ: বলেন,”الخفاء والظهور من الأمور النسبية الإضافية فقد يتضح لبعض الناس أو للإنسان في بعض الأحوال ما لا يتضح لغيره أو له في وقت آخر “সম্বন্ধযুক্ত আপেক্ষিক বিষয়গুলোর মধ্য হতে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিষয়গুলো কতিপয় মানুষের কাছে স্পষ্ট অথবা কিছু অবস্থায় মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় যা অন্যান্যদের কাছে অস্পষ্ট অথবা অন্য সময়ে আরেকজন ব্যক্তির কাছে অস্পষ্ট”। (রদাউ তায়ারুজ; খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৩০)
দ্বিতীয়: নিশ্চয়ই এটি অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা দেয় এমন মাসআলার স্বীকৃতি দেওয়া অথবা অকাট্যভাবে আমল করার স্বীকৃতি দেওয়া অথবা অতি প্রয়োজনীয় বিধানের স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে কোন গবেষণা বা মতভেদ করার সুযোগ নেই; তা আবশ্যক করে না। বরং অকাট্য জ্ঞান ও আমল সংক্রান্ত মাসআলার ক্ষেত্রে ইজতেহাদ ও গবেষণা এবং তাতে সম্ভাবনাময় পরিধি রয়েছে। একজন আলেম বা বক্তা এমন কিছু নিশ্চিতভাবে দাবি করতে পারেন,যা অন্য কেউ জানে না। তার ধারণা প্রবণ অথবা সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া ছাড়াও। যেমন: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
“كَثِيرٌ مِنْ مَسَائِلِ الْعَمَلِ قَطْعِيَّةٌ ، وَكَثِيرٌ مِنْ مَسَائِلِ الْعِلْمِ لَيْسَتْ قَطْعِيَّةً ، وَكَوْنُ الْمَسْأَلَةِ قَطْعِيَّةً أَوْ ظَنِّيَّةً هُوَ مِنْ الْأُمُورِ الْإِضَافِيَّةِ ، وَقَدْ تَكُونُ الْمَسْأَلَةُ عِنْدَ رَجُلٍ قَطْعِيَّةً لِظُهُورِ الدَّلِيلِ الْقَاطِعِ لَهُ ، كَمَنْ سَمِعَ النَّصَّ مِنْ الرَّسُولِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَيَقَّنَ مُرَادَهُ مِنْهُ ، وَعِنْدَ رَجُلٍ لَا تَكُونُ ظَنِّيَّةً ، فَضْلًا عَنْ أَنْ تَكُونَ قَطْعِيَّةً ، لِعَدَمِ بُلُوغِ النَّصِّ إيَّاهُ ، أَوْ لِعَدَمِ ثُبُوتِهِ عِنْدَهُ ، أَوْ لِعَدَمِ تَمَكُّنِهِ مِنْ الْعِلْمِ بِدَلَالَتِهِ “
আমল সংক্রান্ত অনেক মাসআলা অকাট্য বা নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয়। আবার ইলম/জ্ঞান সংক্রান্ত অনেক মাসআলা অকাট্য বা নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয় না। আর মাসআলাটি অকাট্য বা ধারণা প্রমাণ হওয়া মূলত সমন্ধনীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো মাসআলাটি একজন ব্যক্তির কাছে অকাট্য দলিল প্রকাশ পাওয়ার কারণে নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয়। যেমন একজন ব্যক্তি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে স্পষ্ট দলিল শুনেছেন এবং তার উদ্দেশ্য দৃঢ়তার সাথে বুঝেছেন। আবার আরেকজন ব্যক্তির কাছে মাসআলাটি ধারণাপ্রবণ জ্ঞানের উপকারিতা দেয় না। যদিও সেটি অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা দেয়। যেমন হয়তো সে ব্যক্তি নিজে স্পষ্ট দলিলের কাছে পৌঁছাতে পারেনি বা তার কাছে তা সাব্যস্ত হয়নি অথবা তার অর্থের মাধ্যমে অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা অর্জন করা অসম্ভব। (মাজমুউল ফাতাওয়া ২৩/৩৪৭)। তিনি এটাও বলেছেন,وخفاءُ الدلالة وظهورُها : أمرٌ نِسْبِى ؛ فقد يَخْفى على هذا ، ما يَظْهر لهذا”আর অর্থের স্পষ্ট ও অস্পষ্ট হওয়া এটি একটি সম্বন্ধনীয়/ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিষয়। এটি কখনো একজনের নিকট অস্পষ্ট থাকলেও অন্যজনের কাছে তা স্পষ্ট। (জামিউল মাসায়ীল ২/২৮৮)।
তৃতীয়ত: বড় মাসআলা ছাড়া যেমন ইলম, আমলের মাসআলা অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে যার কাছে দলিলের সাব্যস্তটা প্রাধান্য পাবে তার দলিলটা জ্ঞান এবং আমলের মাসআলার উপর প্রমাণ করবে। যদি কথাটি তার আবশ্যকের মাধ্যমে হয়ে থাকে যদিও সেটা স্পষ্ট পদ্ধতিতে ছিল অথবা ধারণা প্রবাল থাকে তাহলে সেটা ইয়াকিন কিংবা কতয়ী এর পদ্ধতিতে হবে না।যেমন:শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: “মানুষদের মধ্য হতে যারা বলে যে, উসূল তথা মৌলিক মূলনীতিগুলোর মাসআলা মাসায়েল (তাওহীদ/আক্বিদাহ)-এর ক্ষেত্রে অকাট্য জ্ঞানের উপকারিতা দেয় এমন দলিল দ্বারা গ্রহণ করা বৈধ রয়েছে। প্রবল ধারণার উপকারিতা দেয়, তা দ্বারা গ্রহণ করা বৈধ নয়। এটি কি সঠিক?
এক্ষেত্রে দুটি মতামত রয়েছে: যদি এ সকল বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে আমরা আদিষ্টত হই। যেমন: আল্লাহর একত্ববাদ, রাসূলের প্রতি ঈমান আনা ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনার প্রতি বিশ্বাস রাখা। তবে যে সব ক্ষেত্রে আমরা দৃঢ়তার সাথে আদিষ্টিত না,সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারী এমন দলিল ছাড়া তা সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। আর যে সকল বিষয়ে আমাদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব নয়, যেমন প্রতিদান ও শাস্তি-এর বিবরণ এবং কতিপয় নামসমূহ ও গুণাবলীর অর্থের বিবরণ ইত্যাদি; সুতরাং এগুলোর ক্ষেত্রে যদি নিশ্চিত জ্ঞানের উপকারিতা দেয় এমন দলিল পাওয়া না যায়, যা দুই দিকের যেকোনো এক দিক প্রমাণ করে, তবে দলিলদাতার প্রাধান্যময় কথা গ্রহণযোগ্য হবে। এটি হল ন্যায়সঙ্গত সঠিক প্রাধান্যময় বাহ্যিকতা। বরং শুধু অজ্ঞ থাকার থেকে এটি অধিকতর উত্তম। তবে মানুষদের মধ্যে হতে যারা দ্বন্দ্বপূর্ণ মাসআলা গুলো কিংবা সূক্ষ্ম মাসআলা গুলোর ক্ষেত্রে নিশ্চিত জ্ঞানের কাছে পৌঁছার ক্ষমতা রাখে না, সেক্ষেত্রে তারা তাদের সাধ্য ও ইজতিহাদ অনুযায়ী কথা বলবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা কাউকে সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। (বায়ানু তালবীসিল জাহমিয়াহ ৮/৪৫৪, জাওয়াবু ইতিরাযাতিল মিসরিয়াহ আলাল ফাতওয়ায়ীল হামাবিয়াহ ৪৯ – ৫৩)।
চতুর্থত: কতিপয় আলেম মত দিয়েছেন যে, আবু হুরায়রা উল্লেখিত হাদিসটি সিফাতের হাদিসের অন্তর্ভুক্ত। হাকউন (কোমর) শব্দটি আল্লাহ তায়ালার দিকে সম্পর্কিত করা হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার গুণ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ বলেন:
هذا من الأخبار التي يقره من يقر نظيره والنزاع فيه كالنزاع في نظيره ..”ثم نقل الإثبات عن القاضي أبي يعلى ، وشيخه أبي عبد الله بن حامد ، ونقله ابن حامد عن الإمام أحمد ؛ قال : ” يُمْضى كلُّ حديث على ما جاء ” .ثم قال شيخ الإسلام :” والمقصود هنا : أن هذا الحديث في الجملة من أحاديث الصفات التي نص الأئمة على أنه يمر كما جاء ، وردوا على من نفى موجبه “
এটি ঐ সমস্ত হাদিসের অন্তর্ভুক্ত যারা এই কথাগুলোকে মান্য করে তাদের জন্য দলিলস্বরূপ আর যারা সেটাকে অস্বীকার করে তাদের জন্য প্রতিবাদস্বরূপ। তিনি কাযি আবি ইয়ালা থেকে এবং তার শায়েখ আবু আব্দুল্লাহ ইবনু হামিদ থেকে সাব্যস্ত করার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। আর এটা ইবনু হামিদ বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্ভল থেকে। তিনি বলেছেন: প্রতিটি হাদিস যেরূপ বর্ণিত হয়েছে, অনুরূপ থাকবে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে উদ্দেশ্যে হলো এই হাদিসটি সমষ্টিগতভাবে সিফাতের হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত, যার ব্যাপারে ইমামগন দলিল বর্ণনা করেছেন যে, এটি যেরূপ বর্ণিত হয়েছে, অনুরূপই থাকবে। আর তারা তার আবশ্যকতাকে নাকচকারী ব্যক্তিদের প্রত্যাখ্যান করেছেন”।(বায়ানু তালবিসীল জাহমিয়া ৬/২০৫-২৪১), (কিতাব-সুন্নাহতে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার গুণাবলী: শাইখ উলুব্বী আশ-শাক্বাফ: ১২৫-১২৮)।
দ্বিতীয় কথা: পক্ষান্তরে একদল আলেমদের মতে এই হাদিসটি আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত হাদিস নয়। আর এই জন্যই অধিকাংশ ইমামগন তাদের গ্রন্থে আকিদা অধ্যায়ে এটি উল্লেখ করেননি। তারা কুরআন-সুন্নাহতে বর্ণিত আল্লাহ তায়ালার সিফাতগুলোকে একত্রিত করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম বুখারী সহ কোন মুহাদ্দিস এই সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে তার উপর কোন অধ্যায় রচনা করে নি। এমনকি তাদের কেউ ধারণা করেছেন যে, এটা সবার ঐক্যমতে এই (আক্বীদা) অধ্যায়ের বহির্ভূত বিষয়। এটি মূলত পরোক্ষভাবে আত্মীয়তা সম্পর্ক এর অধিকারের মর্যাদা নিশ্চিত হওয়া সম্পর্কিত হাদিস। যেমন: অপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ রক্ত সম্পর্কে মূল হল রাহমান। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ যে তোমার সাথে সুসম্পর্ক রাখবে, আমি তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমা হতে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও সে লোক হতে সম্পর্ক ছিন্ন করব।(সহীহ বুখারী হা/৫৯৮৮) অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, আবদুর রাহমান (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছিঃ পরিপূর্ণ কল্যাণ ও প্রাচুর্যের অধিকারী আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ ‘আমিই আল্লাহ্ এবং আমিই রাহমান। আত্মীয়তার সম্পর্ককে আমিই সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম হতে নির্গত করে এই নাম (রাহমান হতে রেহেম) রেখেছি। যে ব্যক্তি এই সম্পর্ক বহাল রাখবে আমিও তার সাথে (রাহমাতের) সম্পর্ক বহাল রাখব। আর এই সম্পর্ক যে ব্যক্তি ছিন্ন করবে আমিও তার হতে (রাহমাতের) সম্পর্ক ছিন্ন করব”।(সিলসিলা সহীহাহ হা ৫২০; মুসনাদ আহমাদ/১৬৮৯)।
সৌদি আরবের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সা‘ঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অনুষদ সদস্য ও অধ্যাপক,আকিদা ও ফিকহের প্রাজ্ঞ পণ্ডিত, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ‘আব্দুর রহমান বিন নাসির আল-বাররাক (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫২ হি./১৯৩৩ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: এই হাদিসে কি “কোমর” সিফাত আল্লাহ তা’আলার উপযুক্ত মহত্ত্ব ও মর্যাদার সাথে তার জন্য সাব্যস্ত হওয়ার উপর প্রমাণ করে?
তিনি উত্তরে বলেন:الحمد لله، وصلى الله وسلم على نبينا محمد، أما بعد؛ فنقول كما قال الإمام الشافعي رحمه الله : “آمنا بالله وبما جاء عن الله على مراد الله، وآمنا برسول الله وبما جاء عن رسول الله على مراد رسول الله” !!وهذا يشمل ما ظهر لنا معناه، وما لم يظهر معناه ؛ فما ظهر معناه قلنا: هذا مراد الله، أو مراد رسول الله صلى الله عليه وسلم، وما لم يظهر معناه نفوض علمه إلى عالمه.وهذا الحديث مما يشتبه معناه ؛ هل المراد حقيقة هذه الكلمات: الأخذ، الرحم، الحقو، أو هو تمثيل لحق الرحم، وهي القرابة عند الله تعالى؟ لأن من المعلوم أن الرحم مطلقا يدل على المعنى الكلي المشترك بين كل قرابة، وقد دلت النصوص على أن القرابة صلةٌ تستوجب حقا للقريب على قريبه، بحسب حاله ودرجة قرابته، فأوجبت الشريعة صلة الرحم، وحرمت القطيعة، فقال تعالى في الثناء: ( وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ )، وقال في الذم: ( وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ )، وقال سبحانه: ( فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ )، وعلى هذا فالحديث يشبه قوله صلى الله عليه وسلم عن الله: ( قال الله عز وجل: الكبرياء ردائي والعظمة إزاري )، ويشبه من حيث الأسلوب قوله صلى الله عليه وسلم: ( وأنا آخذ بحُجَزكم عن النار، وأنتم تفلتون من يدي )، وهذا الاحتمال عندي أنه أظهر، وذلك لأن جنس الرحم ليست شيئا معينا موجودا في الخارج، بل الموجود أفراد الرحم، وهي لقرابات التي بين الناس، كما تقدم.ويحسن هنا أن نثبت قول شيخ الإسلام ابن تيمية في نقض التأسيس: (6/222) (ط.مجمع الملك فهد)، قال رحمه الله: “هذا الحديث في الجملة من أحاديث الصفات التي نص الأئمة على أنه يمر كما جاء، وردوا على من نفى موجَبه”أهـ. وعلى هذا : فالحقو لله صفة له سبحانه، ليس شيئا بائنا عنه، ولا عدول لنا عن مذهب أهل السنة، وما نص عليه الأئمة… ”
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরুদ ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর: ইমাম শাফেয়ী রহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন আমরা সেটাই বলবো: আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করি এবং আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে যা এসেছে তার প্রতিও ঈমান আনয়ন করি, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান আনেন করি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু উদ্দেশ্য করে নিয়ে এসেছেন সেগুলোর প্রতিও ঈমান আনেন করি। এই হাদীসটি অন্তর্ভুক্ত করে ঐ সমস্ত জিনিসকে যার অর্থটা আমাদের কাছে স্পষ্ট ও অস্পষ্ট উভয় অর্থই শামিল করে। ফলে যেগুলোর অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট সেগুলোর ব্যাপারে আমরা বলবো এটি আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্য। অস্পষ্ট অর্থগুলোর ক্ষেত্রে আমরা বলবো যে, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ভালো জানেন।
এই হাদিসটি তার অর্থকে সাদৃশ্যপূর্ণ করে। الأخذ، الرحم، الحقو এই শব্দগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য কি: সেটা কি আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার দৃষ্টান্ত যেটা আল্লাহ তায়ালা আত্মীয়তার কথা বলেছেন? কেননা সবার জানা বিষয়ে রিহমুন (আত্মীয়তার সম্পর্ক) বিষয়টি সমস্ত আত্মীয়তা সম্পর্ককে শামিল করে। কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি বন্ধন; যা একজন নিকটাত্মীয়ের কাছে আরেকজন নিকটাত্মীয়ের অবস্থা ও মর্যাদা অনুপাতে অধিকার আবশ্যক করে।
তাই শরীয়ত আত্মীয়তার সম্পর্কের বন্ধন আবশ্যক করে দিয়েছে এবং সম্পর্ক ছিন্ন করাকে হারাম করেছে। আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তা-সম্পর্কের বন্ধন সম্পর্কে প্রশংসা করে বলেন,وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ.আর তারা সে সব সম্পর্ক সম্বন্ধ বহাল রাখে যা বহাল রাখার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন।(সূরা রাদ: ২১)। তিনি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীদের নিন্দা করে বলেন,وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ.এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ আল্লাহ করেছেন,তা ছিন্ন করে,(সূরা বাকারা: ২৭)।
তিনি আরো বলেন, فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ.”তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?(সূরা মুহাম্মাদ: ২২) তাই এর উপর ভিত্তি করে, আলোচ্য হাদিসটি আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে রাসূলের নিম্নোক্ত বাণীর সাদৃশ্য রাখে। যেমন: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ قال الله عز وجل: الكبرياء ردائي والعظمة إزاري.মহান আল্লাহ বলেন, অহংকার হলো আমার চাঁদর এবং মহত্ব হলো আমার লুঙ্গি।
যে কেউ এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।(সুনানে আবু দাউদ হা/৪০৯০) অনুরূপভাবে আলোচ্য হাদিসটি নীতিগত দিক থেকে রাসুলের নিম্নোক্ত বাণীর সাদৃশ্য রাখে।রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, وأنا آخذ بحُجَزكم عن النار، وأنتم تفلتون من يدي.” আমি আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমরবন্ধ ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ”।(সহিহ মুসলিম হা/৫৮৫২) এই সম্ভাবনাময় উত্তরটি আমার কাছে বেশি স্পষ্ট। কারণ আত্মীয়তার সম্পর্ক এমন কোন নির্দিষ্ট বিষয় না যে এটি মানুষের বহির্ভূত (ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিষয়)। বরং আত্মীয়তার সম্পর্কের প্রত্যেকের মাঝে অন্তর্ভুক্ত বিষয়। মানুষের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্কের একটি বন্ধন। যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে।
এখানে আলোচ্য হাদীসে ভ্রান্ত মতাদর্শকে খন্ডনের ক্ষেত্রে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এর উক্তিকে মেনে নেওয়া শোভনীয়। (মুদ্রণ: কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স ৬/২২২ এ তিনি (ইবনে তাইমিয়া) বলেন, এখানে উদ্দেশ্যে হলো এই হাদিসটি সমষ্টিগতভাবে সিফাতের হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। যার ব্যাপারে ইমামগন দলিল বর্ণনা করেছেন যে, এটি যেরূপ বর্ণিত হয়েছে, অনুরূপই থাকবে। আর তারা তার আবশ্যকতাকে নাকচকারী ব্যক্তিদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, আল্লাহ তাআলার “কোমর” মূলত তার (সত্তাগত) সিফাত, আর এটি স্পষ্ট। এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ এবং ইমামদের দলিল-প্রমাণাদি থেকে আমাদের দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২০৫৬৫০)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।