সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।
খারেজীদের অভিযোগের অপনোদনে ইবনু আব্বাস রাদ্বিআল্লাহু আনহু

খারেজীদের অভিযোগের অপনোদনে ইবনু আব্বাস রাদ্বিআল্লাহু আনহু

ibnAbbasAndKhawariz.webp

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: আলী (রা) এর বাহিনী থেকে (হারুরিয়্যাহ) খাওয়ারিজরা বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা একত্রিত হয়। তাদের সংখ্যা ছিল ছয় হাজারের মতো। তারা(খারেজীরা) নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে এ ব্যাপারে একমত হলো যে, তারা সাইয়্যেদুনা আলী (রা) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। লোকেরা ক্রমাগত সাইয়্যিদুনা আলীর কাছে আসতে থাকে এবং খবর দিতে লাগলো, খাওয়ারিজরা আলী (রা) বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তখন সাইয়্যিদুনা আলী (রা) বলেছিলেন: ❝আমি তাদের কিছু বলব না, যতক্ষণ না তারা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বের হচ্ছে। তবে তারা অবশ্যই বেরিয়ে আসবে এবং লড়াই করবে।❞

ইবনু আব্বাস (রা) আবার কাহিনী বলতে শুরু করলেন…
একদিন জোহরের নামাজের সময় আমি[ইবনু আব্বাস] আলী (রা) সামনে হাজির হয়ে বললাম: ❝হে আমীরুল মুমিনীন, আজ সলাতে একটু বিলম্ব করুন। আজ হয়তো আমি খাওয়ারিজের কাছে গিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব।❞

তখন আল্লাহর রাসুলের মেয়ের জামাই আলী (রা) বললেনঃ ❝আমি ভয় পাচ্ছি যে তারা আপনার ক্ষতি করবে।❞
তখন আমি বলেছিলাম: ❝ইনশাআল্লাহ তা হবেনা। যেহেতু আমি সদাচারী ছিলাম এবং কখনো কারো ক্ষতি করিনি।❞

অতঃপর আমিরুল মুমিনীন আমাকে অনুমতি দিলেন সেখানে যাওয়ার জন্যে। আমি সুন্দর একটা জামা পরিধান করে নিলাম যেটি আমি ইয়েমেন থেকে এনেছিলাম এবং আমি আমার চুল আঁচড়ে নিলাম। অতঃপর রউনা দিয়ে দিলাম এবং পৌঁছলাম সেই মুহূর্তে যখন তারা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলো।

আমি এমন এক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবেশ করেছি, যাদের মত ইবাদত গুজার আর কখনোই কাউকে দেখিনি। প্রতিনিয়ত সিজদার কারণে তাদের কপালে কালো দাগ পড়ে গিয়েছিলো এবং তাদের হস্তদ্বয় উঠের পায়ের মত রুক্ষ শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। তারা সুন্দর জামা পরেছিলো এবং তাদের চেহারায় যেনো পূর্নিমার আলো হার মানে। অতঃপর আমি তাদের সালাম দিলাম;

তারা বললো: ❝মারহাবা! হে, আব্বাসের বেটা! এতো দামি কাপড়চোপড় পরেছেন যে!!❞
তখন আমি বললামঃ ❝সমস্যাটা কোথায়? আমি নিজে আল্লাহর রাসুলকে সবচেয়ে সুন্দর জামা পরতে দেখেছি। এই সূত্রেই কুরআনুল কারীমের এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে : হে নবী, আপনি বলুন : আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য যে সাজসজ্জা ও উত্তম খাবার উৎপন্ন করেছেন, সেসব কে হারাম করলো? (আল আরাফ : ৩২)❞

তারা আবার জিজ্ঞাসা করলোঃ ❝তা কি মনে করে এলেন?❞
আমি বললামঃ ❝আমি নবী সাঃ এর-মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের পক্ষ থেকে এসেছি, তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতার পক্ষ থেকে এসেছি, তোমাদের কাছে। শোনো, কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের উপস্থিতিতেই, তাদের উপরেই এবং তাদের একজনও তোমাদের সাথে নেই। আমি এসেছি, যেন তোমাদের কথা তাদের কাছে, এবং তাদের কথা তোমাদের কাছে পোঁছে দিতে পারি।❞

তখন তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক আমার সাথে বিতর্কে এলো।

আমি বললাম : ❝আলী সহ অন্যান্য সাহাবীদের ব্যাপারে তোমাদের অভিযোগগুলো কী?❞
তারা বললো : ❝তিনটি❞
আমি বললাম : ❝কী কী?❞

তারা বললো : ❝প্রথমটি হলো—যে বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা, সে বিষয়ে তিনি(আলী) মানুষকে সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। অথচ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ( إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّ) ফায়সালার মালিক একমাত্র আল্লাহ। বলুন, মানুষ ফায়সালা দেওয়ার কে?❞

আমি বললাম :❝আচ্ছা একটা হলো। এবার পরেরটা বলো।❞

তারা বললো : ❝তিনি যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে শত্রুদেরকে বন্দি করেননি, তাদের সম্পদকে গণীমত হিসেবেও গ্রহণ করেননি। তারা যদি কাফের হয়ে থাকে, তাহলে তাদেরকে বন্দি করা বৈধ ছিল; আর যদি মুমিন হয়ে থাকে, তাহলে তাদেরকে বন্দি করা যেমন বৈধ ছিল না, যুদ্ধ করাও তো বৈধ ছিল না।❞

আমি বললাম : ❝আচ্ছা! এবার তিন নাম্বারটা?❞

তারা বললো : ❝তিনি নিজের নাম থেকে ‘আমিরুল মুমিনীন’ অংশ মুছে দিয়েছেন। তিনি যদি আমিরুল মুমিনীন না হোন তাহলে আমিরুল কাফিরীন হবেন।❞

আমি বললাম : ❝আর কোন অভিযোগ আছে?❞

তারা বললো : ❝এই তিনটাই যথেষ্ট।❞

আমি বললাম : ❝আচ্ছা এবার বলো, আমি যদি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এমন দলীল হাজির করি, যা তোমাদের অভিযোগগুলোকে রদ করে দেয়, তাহলে তোমরা কি ফিরে আসবে?❞

তারা বললো : ❝হ্যাঁ, অবশ্যই❞

আমি বললাম : ❝প্রথমত তোমরা যে বললে, আলী রাঃ আল্লাহ তাআলা ফায়সালা করার কথা এমন একটি বিষয়ে মানুষকে সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন, এখন আমি তোমাদেরকে পড়ে শোনাচ্ছি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনে নিজে তার একটি বিষয়ে মানুষকে সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে দায়িত্ব দিচ্ছেন। সিদ্ধান্তটি হলো এক দিরহামের এক চতুর্থাংশের মূল্য নিয়ে। দেখো আল্লাহ তাআলা কী বলছেন
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تَقْتُلُوا الصَّيْدَ وَأَنتُمْ حُرُمٌ ۚ وَمَن قَتَلَهُۥ مِنكُم مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآءٌ مِّثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ يَحْكُمُ بِهِۦ ذَوَا عَدْلٍ مِّنكُمْ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইহরাম পরা অবস্থায় শিকারকে বধ করো না, এবং তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছা করে একে বধ করবে, প্রতিবিধান হিসেবে সে যা হত্যা করেছে, তার সমপরিমাণ একটি নাআম দিবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিবে তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন বিশ্বস্ত ইনসাফওয়ালা মানুষ।” (মাইয়েদা - ৯৫)

এই যে, এখানে তো মানুষের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে!
আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, বলো, একটি খরগোশের ব্যাপারে মানুষ ফায়সালা করা উত্তম, নাকি এর চেয়ে অনেক উত্তম হলো দুই দলের বিবাদ মিটিয়ে তাদের রক্তপাত বন্ধ করার ফায়সালা করা?❞

তারা বললো : ❝অবশ্যই দ্বিতীয়টি অনেক উত্তম।❞

আমি বললাম : ❝শুধু তাই না; স্বামী স্ত্রীর ক্ষেত্রেও এমনটি করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলছেন :
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِۦ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَآ إِن يُرِيدَآ إِصْلٰحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَآ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا
“আর যদি তোমরা মনে করো তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হবে, তাহলে তার পরিবার থেকে একজন ও অপরজনের পরিবার থেকে একজন বিচারক প্রেরণ করো” ( নিসা: ৩৫)।
সুতরাং, তোমরা দুটো ভ্রান্তির মাঝখানে পড়ে গেছো। এ থেকে মুক্তির কোন উপায় জানা আছে তোমাদের? থাকলে সেটা আনো তো! জানি পারবেনা। এইবার বলো, এ অভিযোগ কি উঠিয়ে নিচ্ছো?❞

তারা বললো : ❝হ্যাঁ।❞

আমি আবার বললাম : ❝তোমরা যে বললে তিনি তাদেরকে বন্দি করেননি, তাদের মালসমূহকে গণীমত হিসেবেও গ্রহণ করেননি, বলো তো, তোমরা কি তোমাদের মাতা আয়েশা রা. কে বন্দি করতে চাও! অন্য সাধারণ দাসীর সাথে যে বিষয়গুলো বৈধ মানো, তার সাথেও এরকম করাকে বৈধ বলতে চাও? অথচ তিনি তোমাদের মা! যদি বলো ‘হ্যাঁ, আমরা তার সাথেও সেরূপ করা বৈধ মনে করি’, তাহলে তোমরা কাফের হয়ে যাবে। আবার যদি বলো, আমরা তাকে মা বলে মানি না, তাহলেও কাফের হয়ে যাবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন (النَّبِىُّ أَوْلٰى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوٰجُهُۥٓ أُمَّهٰتُهُمْ) নবী মুমিনদের নিকট তাদের প্রাণের চেযেও অধিক মূল্যবান এবং তার স্ত্রীগণ তাদের মাতা (আল আহযাব : ৬)।

সুতরাং, দেখতেই পাচ্ছো—এখানেও তোমারা দুটি বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে আছো। এ থেকে তোমাদের মুক্তির উপায় কী?
বলো, এই অভিযোগটিও কি উঠিয়ে নিচ্ছো?❞

তারা বললো : ❝হ্যাঁ❞

আমি আবার বললাম : ❝এবার তোমরা তিন নাম্বারে যে অভিযোগটি করলে যে, তিনি নিজের নাম থেকে ‘আমিরুল মুমিনিন’ মুছে দিয়েছেন, তো, আমি একটি প্রমাণ নিয়ে আসছি। এটি তোমাদের অভিযোগকে মিথ্যা বলে প্রমাণিত করবে।

তোমরা তো জানো, হুদাইবিয়ার দিনে রাসুলুল্লাহ মুশরিকদের সাথে সন্ধি করেছিলেন। সে সময় তিনি আলী রা.কে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন : ‘আলী, লেখো, এ হলো চুক্তিপত্র, এর উপরই আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সন্ধি করেছেন’। এটা লেখার পর মুশরিকরা আপত্তি জানিয়ে বলেছিল : এটা লেখা যাবে না। কারণ, আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করতাম, তাহলে তো আপনার সাথে যুদ্ধ করতেই আসতাম না।
তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আলী, কথাটি মুছে দাও; ইয়া আল্লাহ, আপনি তো জানেন আমি আল্লাহর রাসূল; আলী, এটা মুছে দিয়ে লেখো — এই হলো চুক্তিপত্র, যার উপর আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ সন্ধি করেছে।

আল্লাহর কসম, আলী থেকে আল্লাহর রাসূল অবশ্যই উত্তম ছিলেন; অথচ, তিনি নিজেই নিজের ‘রাসূল’ পরিচয়টি মুছতে বলছেন, এবং এখান থেকে মুছে ফেলার অর্থ ‘নবুওয়াত’ থেকে মুছে ফেলা ছিল না।
এবার বলো, তোমরা কি এই অভিযোগটিও উঠিয়ে নিচ্ছো?❞

তারা বললো : ❝হ্যাঁ।❞

এরপর দুই হাজার খারেজী ইবনে আব্বাস রা. এর সাথে একাত্মতা পোষণ করে মুসলমানদের মাঝে ফিরে এলো; কিন্তু বাকিরা তাদের বিভ্রান্তিতে অবিচল হয়ে রইলো এবং এই বিভ্রান্তির উপর থেকেই তারা সাহাবায়ে কেরামের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ তাদেরকে হত্যা করলেন।

━━━━━━━━━━━━━━━━

📜
বর্ননার দলিলঃ আদ-দারেমী তার সুনানে (১/৬৮-৬৯) । এই বর্ণনাটি 'আমর ইবনে সালমা' থেকে বর্ণিত করেছেন এবং আল-আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন।
এই গল্পের অন্যান্য বর্ণনা রয়েছে। এটি আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ বর্ণনা করেছেন:জাওয়ায়েদ আল-জুহুদ, (পৃ. ৪২৮) এবং আবু নাইম : হিলিয়াহ আল-আউলিয়াহ, (৪/৩৮০-৩৮১)। এছাড়াও রয়েছে আল-তাবরানীতে আরো রয়েছে আব্দুর-রাজ্জাক: আল-মুসান্নাফ, (৫৪০৯)। আল-হাইছামী এটি বর্ণনা করেছেন: মাজমাউল-জাওয়ায়েদ, (১/১৮১) এবং এটিকে সহিহ বলেছেন।


▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃▃‎‎▃▃▃▃

— [
✍🏻
জয়নাল বিন তোফাজ্জল ] •
— [
⏲
সময়কালঃ ১৪ই জমাদিউস-সানি, ১৪৪৪ হিজরী ] •​
 
Top