সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।

মানহাজ ইবনু হাজার ও নাওয়াউয়ি কি আশ‘আরী মানহাজের ছিলেন?

abdulazizulhakimgrameen

Altruistic

Uploader
Salafi User
LV
12
 
Awards
22
Credit
14,183
প্রখ্যাত সালাফি বিদ্বান, কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ অনুষদের অধ্যাপক, আশ-শাইখ, আল-আল্লামাহ, ড. ফালাহ বিন ইসমাঈল আল-মুনদাকার (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৯৫০ খ্রি.] বলেছেন—

আশ‘আরী মতাদর্শ। এটি একটি ঈপ্সিত বিষয়। এখন আমরা কাকে এই মতাদর্শ থেকে মুক্ত প্রমাণ করব? হ্যাঁ? আচ্ছা, তিনি ছাড়া আরও অনেকেই এ ধরনের কথা বলেছেন। এখানে ইমাম নাওয়াউয়িকে উক্ত মতাদর্শ থেকে মুক্ত প্রমাণ করা হবে। ইমাম নাওয়াউয়ি, ইবনু হাজার [১] এবং আরও অনেক (ভুলে পতিত) ইমামের ব্যাপারে আমরা বলি, আল্লাহর কসম, তাঁরা আশ‘আরী ছিলেন না। (আমাদের এসব বলতে হয়) যখন কেউ এ জাতীয় আলোচনায় সমুপস্থিত হয়।

পক্ষান্তরে গোঁড়া লোকদের কথা আলাদা। যেমন একজন বলেছে, ‘নাওয়াউয়ি আশ‘আরী ছিলেন, তাতে যে খুশি হওয়ার সে খুশি হোক, আর যে রেগে যাওয়ার সে রেগে যাক।’ এটা কী ধরনের কথা? তুমি দলিল নিয়ে আসো। ‘যে খুশি হওয়ার সে খুশি হোক, আর যে রেগে যাওয়ার সে রেগে যাক’—এসব কথা বলে কোনো লাভ হবে? শাইখ, এসব কথা কীভাবে ফলপ্রসূ হবে? এ তো বাজারের লোকদের কথা! এ কথা তালিবুল ইলমদের হতে পারে না।

আচ্ছা, আশ‘আরী মতবাদ কী? আমরা বলেছি, খারিজীদের মূলনীতি আছে, শিয়াদের নীতিমালা আছে। বলেছি, না বলিনি? অনুরূপভাবে মুতাযিলা ও কাদারিয়্যাহ-সহ সবার বৈশিষ্ট্য আছে। তাহলে আশ‘আরী মতবাদ আসলে কী? আশ‘আরী মতাদর্শের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন মুতাযিলাদের কয়টি বৈশিষ্ট্য? পাঁচটি। তো আশ‘আরী মতবাদ মূলত তিনটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আবর্তিত হয়। আল্লাহর বান্দা, এগুলো মুখস্থ করে নাও। এগুলো মুখস্থ করে নাও। খুবই সহজ।

সুতরাং এমন কাউকে আশ‘আরী বলা যাবে না, যার মধ্যে আশ‘আরী মতাদর্শের অস্তিত্ব নেই। যেই মতাদর্শ তিনটি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এসবের মধ্যে প্রথমটি কী?

প্রথম বৈশিষ্ট্য: বিবেককে কুরআন-সুন্নাহর ওপর প্রাধান্য দেওয়া। একেবারে নিঃশর্তভাবে প্রাধান্য দিতে হবে। আর এ কাজ করা ওয়াজিব। তারা এমনটাই বলে থাকে। আর-রাযি এ কথা বলেছেন, জুওয়াইনি [২] বলেছেন। এদের সংখ্যা অনেক। ইবনু ফূরাক [৩] বলেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মানবীয় বিবেককে কুরআন-সুন্নাহর ওপর প্রাধান্য দেওয়া ওয়াজিব।

এর মানে যখন আল্লাহ ও রাসুলের কোনো বক্তব্য নিয়ে আসা হবে, তখন সে বক্তব্যকে বিবেকের নিকট পেশ করতে হবে। বিবেক যদি তা মেনে নেয়, তাহলে সেটাকে গ্রহণ করা হবে। আর বিবেক যদি তা মেনে না নেয়, তাহলে হয় সেটা প্রত্যাখ্যাত হবে। প্রত্যাখ্যাত বলতে সেটা দুর্বল সাব্যস্ত হবে, যদি তাতে সনদ থাকে। কিন্তু তা যদি দুর্বল না হয়, অথবা দলিলের যোগ্য হয়, তাহলে সেটাকে তাবিল (ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান) করা [৪] ওয়াজিব। অর্থাৎ সেটাকে ঘোরাতে থাক, যতক্ষণ না তা বিবেকের সাথে মিলে যায়।

শাইখ, এটা আশ‘আরীদের প্রথম বৈশিষ্ট্য। যা আমরা মনে রেখেছি। ‘বিবেককে কুরআন-সুন্নাহর ওপর প্রাধান্য দেওয়া।’

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য: কুরআন-সুন্নাহর দলিলকে দুভাগে ভাগকরণ। সকল নাক্বল (দলিল) দুই ভাগে বিভক্ত। নাক্বল মানে কী? নাক্বল মানে কুরআন ও সুন্নাহ। তারা বলে, কুরআন-সুন্নাহর দলিলগুলো একই পর্যায়ের নয়। এগুলোকে কয় ভাগে ভাগ করা অত্যাবশ্যক? দুই ভাগে। আবশ্যক শ্রেণিকরণ হচ্ছে—তুমি দলিলগুলোকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করবে। এক প্রকার দলিলের ব্যাপারে তারা বলে, এটা মুতাওয়াতির [৫] পর্যায়ের, আমরা এর দ্বারা দলিল গ্রহণ করি।

আর দ্বিতীয় প্রকার দলিল হচ্ছে আহাদ [৬] পর্যায়ের। আকিদার ক্ষেত্রে এই প্রকারভুক্ত হাদিস বা প্রমাণ দিয়ে দলিলগ্রহণ করা না-জায়েজ। আকিদার মাসায়েলে আহাদ হাদিস দ্বারা দলিল গ্রহণ করা জায়েয নয়। চাই সে হাদিস কুদসি হোক, কিংবা নাবাউয়ি হোক। না-জায়েয! কেন? আহাদ হাদিসের সমস্যা কী? তারা বলে, আহাদ হাদিস দিয়ে আমরা ওজু, নামায, পবিত্রতা, হজ প্রভৃতি (ফিকহি) মাসায়েলে দলিলগ্রহণ করব। কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে করব না।

কারণ আকিদার ক্ষেত্রে কাকে প্রাধান্য দিতে হবে? বিবেককে। আর এই (আহাদ পর্যায়ের) দলিলকে গ্রহণ করা হবে না। যত আহাদ হাদিস আছে, তার কোনোটাই গ্রহণীয় হবে না।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য: আমরা যে মুতাওয়াতির দলিল গ্রহণ করলাম, সেটাকে কীসের মাধ্যমে শোধন করব? তৃতীয় মূলনীতির মাধ্যমে। তারা বলে, সকল দলিলকে তাবিল করতে হবে, যতক্ষণ না তা বিবেকের সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ এ দুই মূলনীতি কীসের পৃষ্ঠপোষকতা করছে? বিবেকের। দলিলকে তাবিল করতে হবে।

আল্লাহ বলেছেন, الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ “দয়াময় আল্লাহ আরশের ওপর সমুন্নত হয়েছেন।” [৭] সমুন্নত হয়েছেন! আল্লাহর পানাহ, আউজুবিল্লাহ! আশ‘আরী বলে, ‘সমুন্নত হলেন কীভাবে? আউযুবিল্লাহ। শাইখ, এ তো শির্ক!’ সে বলে, “আপনি ‘ইস্তাওয়া’ই পড়বেন। কারণ কুরআনে ‘ইস্তাওয়া’ লেখা আছে। কিন্তু আপনার বিবেক কী বলবে? ইস্তাওলা (যার মানে দয়াময় আল্লাহ আরশ দখল করেছেন)।”

এরা শব্দে কী বাড়িয়েছে? ‘লাম’ বর্ণ বাড়িয়েছে। ইহুদিরা ‘নুন’ বর্ণ বৃদ্ধি করেছিল। [৮] এরা করেছে লাম। ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) ইহুদিদের নুনের সাথে আশ‘আরীদের লামের সাদৃশ্য দিয়েছেন। আল্লাহ (ইহুদিদেরকে) বলতে বলেছিলেন, হিত্তাহ। এর মানে, ইয়া আল্লাহ, আমাদের ভুলগুলো মার্জনা করুন। কিন্তু তারা কী বলেছে? হিনতাহ! হিনতাহ (গম) নিয়ে আসো, যা খাওয়া যায়। ওরা ‘হিত্তাহ’ শব্দে ‘নুন’ বৃদ্ধি করেছে, আর এরা ‘ইস্তাওয়া’ শব্দে ‘লাম’ বৃদ্ধি করেছে। একটার সাথে অপরটার কতইনা মিল!

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বলেছেন, الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ “দয়াময় আল্লাহ আরশের ওপর সমুন্নত হয়েছেন।” এর মানে ইস্তাওয়া (তিনি সমুন্নত হয়েছেন)।

সুতরাং বোঝা গেল, এই তিনটি মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্য যখন কোনো বইয়ে কিংবা ব্যক্তির মাঝে পাওয়া যাবে, তখন জানতে হবে সে আশ‘আরী। ওই বই আশ‘আরী মতাদর্শের বই। আর ওই লোক কী? আশ‘আরী। একশোতে একশো, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। এগুলো আশ‘আরী মতবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কোনো আশ‘আরী এই তিনটি মূলনীতি ব্যতিরেকে আশ‘আরী হতে পারে না। এগুলো সবই তাদের বইপুস্তকে বিদ্যমান রয়েছে।

আজ তুমি আশ‘আরীদের সব বই পড়ে দেখ। আল্লাহর কসম, এরকমই পাবে। ঠিক এই তিনটি মূলনীতির প্রতিফলন। এমনকি যদি আশ‘আরীদের খণ্ডন করে লেখা বইগুলো পড়, দেখতে পাবে, এই তিনটি মূলনীতির ওপর আলোচনা আবর্তিত হচ্ছে। ইমামদের নিকটে যখন তাদের কথা বলা হয়, তখন তাঁরা বলেন, কুরআন-সুন্নাহকে প্রাধান্য দেওয়া সালাফিয়্যাহর মূলনীতি। তাঁরা কী বলেন? ওরা—আশ‘আরীরা—বলে, বিবেককে প্রাধান্য দিতে হবে। আর আহলুস সুন্নাহ বলে, কুরআন-সুন্নাহকে নিঃশর্তভাবে প্রাধান্য দিতে হবে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা কী বলে? ভাগকরণের কথা বলে। আহলুস সুন্নাহ বলে, কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে, কিংবা আহাদ ও মুতাওয়াতিরের মধ্যে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। সবগুলো প্রতিষ্ঠিত দলিল। মুতাওয়াতির-আহাদ উভয়ের মাধ্যমেই আল্লাহর দলিল প্রতিষ্ঠিত। মহান আল্লাহ নিজে তাঁর নাবীদেরকে একাকী অবস্থায় (আহাদ করে) পাঠিয়েছেন, শাইখ। আর আপনারা কিনা আহাদ হাদিস প্রত্যাখ্যান করছেন!

(আহলুস সুন্নাহর নিকট) তৃতীয় মূলনীতি হচ্ছে, কুরআন-সুন্নাহর দলিলকে তার বাহ্যিক অর্থের ওপর বহমান রাখা। অর্থাৎ ভাষায় ব্যবহৃত বাহ্যিক অর্থ। আর (কুরআন-সুন্নাহর দলিলকে) তাবিল না করা, তাহরিফ (শব্দ বা অর্থগত বিকৃতি) না করা। সালাফীদের এই চলমান তিনটি মূলনীতি আশ‘আরীদের মূলনীতির বিপরীত। ইমাম নাওয়াউয়ি ও ইমাম ইবনু হাজার (রহমাতুল্লাহি আলাইহিমা)’র ব্যাপারে আমি এ জায়গায় বসে চ্যালেঞ্জ করছি।

বইপুস্তক বিদ্যমান রয়েছে। নাওয়াউয়ির গ্রন্থাবলি বিদ্যমান রয়েছে, ইবনু হাজারের গ্রন্থাবলি বিদ্যমান রয়েছে। ইবনু হাজার ও নাওয়াউয়ির বইপুস্তক থেকে একটি জায়গা দেখাও, যেখানে ইবনু হাজার কুরআন-সুন্নাহর ওপর বিবেককে প্রাধান্য দিয়েছেন, কিংবা নাওয়াউয়ি কুরআন-সুন্নাহর ওপর বিবেককে প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহর কসম, এই নীতি তাঁদের বইপুস্তকে বিলকুল অনুপস্থিত।

বরং যারা কিতাব, সুন্নাহ ও উম্মতের সালাফবর্গ ব্যতিরেকে অন্যকিছুকে মূলনীতি বানিয়েছে, তাদের ব্যাপারে এঁরা নিন্দা করেছেন—বলে তোমার কাছে প্রতিভাত হবে। ইবনু হাজার ও নাওয়াউয়ি থেকে এ অবস্থান জানা যায়। সুতরাং আশ‘আরীদের এ মূলনীতি তাঁদের নিকট অনুপস্থিত, একদম বিলকুল অনুপস্থিত। আল্লাহর বান্দা, আমি রবের কসম করে বলছি, কিতাব ও সুন্নাহর প্রতি তাঁদের অপরিসীম সম্মান ছিল।

এ ছিল প্রথম বৈশিষ্ট্যের কথা। আল্লাহর কসম, নাওয়াউয়ি সমালোচনা করেছেন। বলে দিয়েছেন, ‘তারা এমন সব নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা না আছে কিতাবে, না আছে সুন্নাহয়, আর না আছে উম্মতের সালাফদের থেকে প্রাপ্ত প্রমাণে।’ এরপরেও এ নিয়ে জটিলতা তৈরি করার মানে কী? তুমি কী চাও?

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে বলতে হয়, তাঁরা (মুতাওয়াতির ও আহাদের মাঝে) পার্থক্য করতেন না। বরং তাঁরা আহাদ হাদিসের ব্যাপারে বলেছেন, এই হাদিসের মাধ্যমে দলিল সাব্যস্ত হয়। কীসের মাধ্যমে? আহাদ হাদিসের মাধ্যমে। তুমি দুই ইমাম তথা নাওয়াউয়ি ও ইবনু হাজার—উভয়ের থেকেই এ বিষয়ের প্রমাণ পাবে। আল্লাহর কসম, এমন কোনো শরাহ নেই (যাতে এ ব্যাপারটা পাওয়া যায় না)।

বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) আহাদ হাদিস দিয়ে তাঁর ‘সহিহ’ গ্রন্থ শুরু করেছেন, আবার আহাদ হাদিস দিয়েই সমাপ্ত করেছেন। যেন তিনি বলছেন, দুই মোড়কের মধ্যে যা আছে তার সবই আহাদের মাঝেই বিদ্যমান। এদিকে তুমি দেওয়ালে মাথা কুঁটে চলেছ, কেন আহাদ হাদিস তুমি গ্রহণ করবে তা ভেবে ভেবে। ইবনু হাজার সে গ্রন্থের ভাষ্য লিখতে গিয়ে বলেছেন, তিনি আহাদ হাদিস দিয়ে তাঁর কিতাব শুরু করেছেন, আবার আহাদ হাদিস দিয়েই সমাপ্ত করেছেন। সুতরাং আহাদ ও মুতাওয়াতির—সব হাদিসই দলিলযোগ্য।

এটা তাঁর কথা। তিনি আশ‘আরী?! তিনি এই মূলনীতি বর্জন করেছেন। অতএব নাওয়াউয়ি ও ইবনু হাজারের লিখনসমগ্রে প্রথম মূলনীতির কোনো অস্তিত্ব নেই। তদনুরূপ নাওয়াউয়ি ও ইবনু হাজারের লিখনসমগ্রে দ্বিতীয় মূলনীতিরও কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে তাঁদের নিকটে ছিলটা কী? তাঁদের নিকটে ছিল এটা—তাবিল। ইবনু হাজারের লিখনে তাবিল আছে, নাওয়াউয়ির লেখায় তাবিল আছে। কিন্তু নিঃশর্ত বা বিলকুল তাবিল নয়।

কখনো তাঁরা এ পথে চলেছেন, কখনো আবার সালাফদের পথে চলেছেন। মানে তাঁদের নিকটে কী ছিল? দোটানা, দোদুল্যমানতা। আসলে তাঁরা এটাকে হক মনে করতেন। এগুলো তাঁদের শাইখদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলেন। নাওয়াউয়ির সকল শাইখ ছিলেন আশ‘আরী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর কাছে এ ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতো।

নাওয়াউয়ি (রাহিমাহুল্লাহ)’র একটি বই আছে। বইটির নাম কী? আল-জুযউ কিংবা জুযউন। এ বইয়ে মহান আল্লাহর হরফ ও সওত (অক্ষর ও আওয়াজ) সাব্যস্ত করা হয়েছে। [৯] সমুদয় আশ‘আরী এ কথা শুনে প্রকম্পিত হবে। আল্লাহর বান্দা, কোনো আশ‘আরী আল্লাহর হরফ ও সওত সাব্যস্ত করে? নাওয়াউয়ি আল্লাহর হরফ ও সওত সাব্যস্ত করেছেন। অথচ সকল আশ‘আরী আল্লাহর কালাম তথা কথার ব্যাপারে কী বলে? কালামুন নাফসি (মনে মনে কথা বলা)। মানে তাঁর কথায় কোনো হরফ ও সওত নেই।

কিন্তু নাওয়াউয়ি আল্লাহর হরফ ও সওত সাব্যস্ত করেছেন এবং আশ‘আরীদের খণ্ডন করেছেন। বলে দিয়েছেন, কীভাবে তোমরা এ কথা বলছ? বলেছেন, আমার কাছে আশ্চর্য লাগে। তিনি নিজে উল্লেখ করেছেন, আশ্চর্য! কালামশাস্ত্র চর্চাকারীরা [১০] কীভাবে মহান আল্লাহর হরফ ও সওত অস্বীকার করছে! নাওয়াউয়ি এ ব্যাপারে আশ্চর্য বোধ করেছেন। কিন্তু তৃতীয় মূলনীতির ব্যাপারে তাঁদের তথা নাওয়াউয়ি ও ইবনু হাজারের দোটানা ও দোলাচলতা রয়েছে।

এর ওপর ভিত্তি করে কি তাঁদেরকে আশ‘আরী বলা যায়? আমরা বলি, তাঁরা আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে কতিপয় মাসআলায় আশ‘আরীদের সাথে মিলে গেছেন। যেমন তাঁরা অনেক মাসালায় সালাফদের সাথেও মিলে গেছেন। প্রথম মূলনীতির ক্ষেত্রে—যা কিনা সবচেয়ে গুরুতর—তাঁরা সালাফদের সাথে একমত হয়েছেন। দ্বিতীয় মূলনীতির ক্ষেত্রেও সালাফদের সাথে একমত হয়েছেন। এগুলো সব তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ।

আর শেষের মূলনীতিতে তাঁরা ছিলেন মাঝামাঝি পর্যায়ে, ছিলেন দোটানায় দোদুল্যমান। এর ওপর ভিত্তি করে তুমি বলে দিবে, তাঁরা আশ‘আরী ছিলেন?! আল্লাহর বান্দা, এ কাজ কি ন্যায়সঙ্গত হবে? জবাব দাও। তুমি সালাফী বলতে চাইছ না, তোমাকে বলতে হবে না। কিন্তু এ কাজ মোটেই ন্যায়সঙ্গত হবে না যে, তুমি বলে বেড়াবে, সে কী? আশ‘আরী! কখনোই না। কিন্তু আমি ঘোষণা করছি, আল্লাহর কসম, প্রথম বৈশিষ্ট্যে তথা বিবেক ও কুরআন-সুন্নাহর ইস্যুতে তাঁরা দুজনেই সালাফদের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

আবার আহাদ ও মুতাওয়াতিরের ইস্যুতেও তাঁরা দুজন সালাফদের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আর এই (শেষোক্ত) ইস্যুতে তাঁরা দোটানায় পতিত হয়েছিলেন। একবার এ কথা বলেছেন। আরেকবার ও কথা বলেছেন। তাঁরা আল্লাহর কথা সাব্যস্ত করেছেন। সাব্যস্ত করেছেন, কুরআন আল্লাহর কথা। সাব্যস্ত করেছেন, আল্লাহর কথায় হরফ ও সওত রয়েছে। কোনো আশ‘আরী এসব বিষয় সাব্যস্ত করবে, এ স্রেফ অসম্ভব। আল্লাহর বান্দা, এবার বল দেখি, এতকিছুর পরেও তাঁরা কীভাবে আশ‘আরী হলেন? আল্লাহর কসম, এ ব্যাপারে তোমাকে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।[১১]


পাদটীকা:

[১]. মুহিউদ্দিন ইয়াহইয়া বিন শারফ আন-নাওয়াউয়ি ও হাফিয ইবনু হাজার আল-আসকালানি আহলুস সুন্নাহর দুজন মহান ইমাম। যথাক্রমে তাঁদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্ম—সহিহ মুসলিমের ভাষ্য আল-মিনহাজ ও সহিহ বুখারির ভাষ্য ফাতহুল বারি। দুজনেই শাফেয়ি মাযহাবের মুজতাহিদ ছিলেন। তাঁদের দুজনের মৃত্যুসন যথাক্রমে ৬৭৬ ও ৮৫২ হিজরি।

[২]. ফাখরুদ্দিন আর-রাযি (মৃত: ৬০৬ হি.) ছিলেন আশ‘আরীদের অন্যতম ইমাম ও দার্শনিক। আর আবুল মাআলি আল-জুওয়াইনি (মৃত: ৪৭৮ হি.) আশ‘আরীদের প্রধান ইমামদের অন্যতম। মৃত্যুর পূর্বে তাঁরা দুজনেই তাঁদের কিছু বাতিল মতাদর্শ থেকে ফিরে এসেছিলেন বলে জানা যায়।

[৩]. ইবনু ফূরাক, মুহাম্মাদ বিন হুসাইন (মৃত: ৪০৬ হি.)। ইমাম আশ‘আরীর ছাত্র বাহিলির নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পূর্ববর্তী আশ‘আরীদের বিরোধিতা করে আল্লাহর ঊর্ধ্বতা ও আরশের ওপর আরোহণের সিফাত অস্বীকার করেছিলেন।

[৪]. আরবি তা’উয়িল (তাবিল) শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করা। আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে এর পারিভাষিক অর্থ—কোনো সিফাতের প্রকাশ্য অর্থকে অগ্রহণীয় কোনো অর্থে রূপান্তর করা। যেমন: আল্লাহর সিফাত ‘ইয়াদ’—যার অর্থ ‘হাত’—এর তাবিল করে এরূপ বলা যে, এর মানে কুদরত বা ক্ষমতা।

[৫]. যে হাদিসের সনদ বা রাবি পরম্পরার প্রতিটি স্তরে এত বিপুলসংখ্যক রাবি থাকে যে, সেটা বানোয়াট হতে পারে—এমন ধারণা অসম্ভব বলে মনে হয়, সে হাদিসকে ‘মুতাওয়াতির’ বলা হয়।

[৬]. মুতাওয়াতির হাদিসের পর্যায়ে পৌঁছেনি, এমন প্রতিটি হাদিসকে ‘আহাদ’ বলা হয়।

[৭]. সুরা তহা: ৫।

[৮]. মুসা (عليه السلام) এর আমলে তাঁর অনুসারীদেরকে বাইতুল মাকদিসের শহর জেরুজালেম দখল করে রাখা ‘আমালেকা’ নামক কাফের সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ‘তিহ’ প্রান্তরে নির্বাসন দেন। পরবর্তীতে আল্লাহ তাদেরকে বিজয়ী করেন এবং শহরে প্রবেশের সময় অধোমুখী হয়ে ‘হিত্তাহ’ (ইয়া আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করুন) উচ্চারণ করে মাফ চাইতে বলেন। কিন্তু তারা ‘হিত্তাহ’ না বলে একটি ‘নুন’ বর্ণ বৃদ্ধি করে বলেছিল, হিনতাহ। যার মানে গম। তাদের এ হঠকারিতার কথা সুরা বাকারার ৫৮ ও ৫৯ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবনে কাসিরে সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসির)

[৯]. আহলুস সুন্নাহর আকিদা অনুযায়ী, আল্লাহ কথা বলেন। তাঁর কথায় হরফ (অক্ষর) ও সওত (আওয়াজ) আছে। এ আকিদা কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের বাণী থেকে সুপ্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আশ‘আরীরা মনে করে, আল্লাহর কথা দ্বারা ‘মনে মনে কথা বলা’ উদ্দেশ্য এবং তাঁর কথায় কোনো হরফ ও সওত নেই। সর্বপ্রথম ইবনু কুল্লাব (মৃত: ২৪১ হি.) এ বিদআতী আকিদা প্রচার করে। আর ইমাম আশ‘আরী, হারিস আল-মুহাসিবি-সহ আরও অনেকে তাঁর অনুগমন করেন। যদিও ইমাম আশ‘আরী ও হারিস আল-মুহাসিবি জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে এই বিদআতী আকিদা পরিত্যাগ করেছিলেন বলে জানা যায়।

[১০]. মুসলিমদের মধ্যে কালামশাস্ত্র চর্চা করার ধারা জাহমি-মুতাজিলাদের মাধ্যমে চালু হয়। যারা গ্রিক দার্শনিকদের থেকে ধার করা ইলমুল কালাম বা যুক্তিবিদ্যা দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করত। সালাফগণ এ শাস্ত্র চর্চাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এ ধারার অন্যতম কয়েকটি ফের্কা তথা কালামি সম্প্রদায় হচ্ছে জাহমিয়্যাহ, মুতাজিলা, আশ‘আরিয়্যাহ, মাতুরিদিয়্যাহ, কুল্লাবিয়্যাহ প্রভৃতি।

[১১]. বক্তব্যের লিংক:



ভাষান্তর: মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মৃধা
সম্পাদনা: উস্তায আখতারুল আমান মাদানী​
 

Create an account or login to comment

You must be a member in order to leave a comment

Create account

Create an account on our community. It's easy!

Log in

Already have an account? Log in here.

Total Threads
12,662Threads
Total Messages
15,959Comments
Total Members
3,171Members
Latest Messages
rifat217Latest member
Top