সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।

ভ্রান্তি নিরসন হাদিস কি ২০০ হিজরির পরে লিপিবদ্ধ হয়েছিল?

Joynal Bin Tofajjal

Student Of Knowledge

Forum Staff
Moderator
Uploader
Exposer
HistoryLover
Salafi User
Threads
344
Comments
479
Reactions
5,168
Credits
3,501
হাদিস অস্বীকারকারিদের অপপ্রচারের বদৌলতে একথা আজ খুব প্রচলিত হয়ে গেছে যে, ২০০ হিজরির আগে হাদিস লিপিবদ্ধকরণ শুরুই হয় নাই। হাদিসকে যারা একেবারে অস্বীকার করেন না তারাও এই প্রোপাগান্ডার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হাদিসকে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করতে শুরু করেছেন এবং যেনতেন ভাবে অনেক শক্তিশালী সহিহ হাদিসকেও কুরআনের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছেন।

কুরআন সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও শ্রুতি এবং স্মৃতিই যেমন প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, লিপিবদ্ধকরণ সহায়ক মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে, হাদিসের ক্ষেত্রেও তাই। আল্লাহতায়ালা কুরআনকে যেসকল মানুষের শ্রুতি, স্মৃতি এবং বিশ্বস্ততার দ্বারা সংরক্ষণ করেছেন, হাদিসের ক্ষেত্রে সেই একই মানুষের শ্রুতি, স্মৃতি এবং বিশ্বস্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানুষকে ধীরে ধীরে কুরআনের প্রতিই আস্থাহীন ও সংশয়ী করে তুলবে।

একথা সত্য যে কুরআন অবতরণের প্রাথমিক দিকে হাদিস লিপিবদ্ধকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তার সম্ভাব্য কারণ কী ছিল?
  • মূখ্য কারণ হতে পারে কুরআন এবং হাদিস মিশ্রিত হয়ে যাবার আশঙ্কা এবং
  • গৌণ কারণ হতে পারে লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমের অপ্রতুলতা।
কিন্তু যেক্ষেত্রে এবং যে সময়ে এই আশঙ্কা বিদ্যমান ছিল না, সেক্ষেত্রে এবং সেসময়ে হাদিস লিপিবদ্ধকরণের এই নিষেধাজ্ঞাও বহাল ছিল না; বরং হাদিস লিপিবদ্ধকরণ শুরু হয় স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাতেই। এটা যে নিছক দাবি নয় বরং ঐতিহাসিক বাস্তবতা সেটাই এই লেখায় তুলে ধরা হবে ইনশা-আল্লাহ।

এক. হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞার স্বরূপ

১.১ হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা

প্রথমেই সেই বিখ্যাত হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত হাদিসটি একটু দেখে নিই।

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
তোমরা আমার থেকে লিখো না। কুরআন ব্যতীত কেউ যদি আমার থেকে কিছু লিখে থাকে তবে যেন তা মুছে ফেলে। আমার থেকে হাদিস বর্ণনা কর, এতে কোন অসুবিধা নেই। যে ব্যাক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করবে- হাম্মাম (র.) বলেন, আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ – তবে সে যেন দোযখে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩০০৪]

লক্ষ্য করুন,
১.১.১ | এখানে যেমন কুরআন ব্যতীত অন্য কোন কিছু লিপিবদ্ধকরণকে নিষেধ করা হচ্ছে।

১.১.২ | ঠিক তেমনি হাদিস বর্ণনা করার নির্দেশও প্রদান করা হচ্ছে।

১.১.৩ | অর্থাৎ লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা কখনোই হাদিসের প্রচার প্রসারকে রূদ্ধ করার জন্য ছিল না।

১.২ হাদিস লিপিবদ্ধকরণের অনুমতি ও অনুপ্রেরণা
এবার আমরা হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে হাদিস লিপিবদ্ধকরণের অনুমতি ও অনুপ্রেরণার অনুসন্ধান করবো।

আবু ক্বাবিল বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.-কে বলতে শুনেছি, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে বসে লিখতাম। (একদা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো: দু’শহরের কোন্ শহরটি সর্বপ্রথম বিজিত হবে, কনস্টানটিনোপল, না-কি রোম? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, বরং হিরাকল (হিরাক্লিয়াস)-এর শহর (কনস্টানটিনোপল) সর্বপ্রথম বিজিত হবে।” [সুনানে দারিমী, হাদিস নং ৫০৩ , সহিহ হাদিস]

আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের মধ্যে আমার অপেক্ষা অধিক হাদিস কেউ বর্ণনা করেন নাই, আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ব্যতীত যিনি লিখে রাখতেন আর আমি কথনই তা করতাম না। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১১৩]

এখানে লক্ষ্যণীয়ঃ এই বর্ণনাগুলো অনুযায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (ইবনুল আস)(রা.) সবসময়ই হাদিস লিখতেন। তাহলে একথা কি বলা যায় না যে, হয় তিনি হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিলেন অথবা তিনি এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোপনে হাদিস লিপিবদ্ধ করতেন।(আল্লাহ মাফ করুন)

আসুন একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক প্রকৃত ঘটনা কী ছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর বিন আল ‘আস হতে বর্ণিত: আমি রাসূলুল্লাহ হতে যা শুনতাম তার সবই লিখে রাখতাম। আমি তা মুখস্ত করার ইচ্ছা করতাম। কুরাইশগণ আমাকে বাধা দিয়ে বলত: তুমি কি তাঁর থেকে যা শুন তাই লিখে রাখ যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ: তিনি রাগ এবং আনন্দাবস্থায় কথা বলেন। কাজেই আমি লেখা বন্ধ করলাম এবং এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি আঙুল দ্বারা তাঁর মুখের দিকে ইশারা করে বললেনঃ লিখ, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! শুধু হক [সত্য]-ই এখান থেকে বের হয়।
[আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৬৩৯]

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর(রা.) গোপনে বা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হাদিস লিপিবদ্ধ করতেন না, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতিসাপেক্ষে তাঁরই অনুপ্রেরণা ও নির্দেশে তিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করতেন।

কাজেই এই ধারণা খুবই যৌক্তিক যে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে ছিলেন। অতঃএব হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা সকলের ওপরই প্রযোজ্য ছিল তেমনটা নাও হতে পারে।

১.৩ হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
এখন আমরা দেখতে চেষ্টা করবো হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা, শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে সবার জন্যই উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল কি-না।

আবদুল্লাহ ইবনে উকায়ম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ জুহায়না নামক স্থানে আমাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ পাঠ করে শোনান হয়, আর এ সময় আমি যুবক ছিলাম। তাতে লেখা ছিলঃ তোমরা মৃত জন্তুর কাঁচা চামড়া এবং এর পাছাকে কাজে ব্যবহার করবে না, (দাবাগত করা ব্যতীত)। [আবু দাউদ, হাদিস নং ৪০৮১]

এবার আমরা হাদিস লিপিবদ্ধকরণের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের শেষভাগের আমল অনুসন্ধান করবো, কেননা তাঁর সর্বশেষ আমলই কোন বিষয়ে তাঁর চুড়ান্ত অবস্থান।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মক্কা বিজয় দান করলেন, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লোকদের মাঝে দাঁড়িয়ে আল্লাহর হাম্‌দ ও সানা (প্রশংসা) বর্ণনা করলেন। এরপর বললেন, আল্লাহ তা’আলা মক্কায় (আবরাহার) হস্তি বাহিনীকে প্রবেশ করতে দেননি এবং তিনি তাঁর রাসূল ও মু’মিন বান্দাদেরকে মক্কার উপর আধিপত্য দান করেছেন। আমার আগে অন্য কারো জন্য মক্কায় যুদ্ধ করা বৈধ ছিল না, তবে আমার পক্ষে দিনের সামান্য সময়ের জন্য বৈধ করা হয়েছিল, আর তা আমার পরেও কারো জন্য বৈধ হবে না। কাজেই এখানকার শিকার তাড়ানো যাবে না, এখানকার গাছ কাটা ও উপড়ানো যাবে না, ঘোষণাকারী ব্যাক্তি ব্যতীত এখানকার পড়ে থাকা জিনিস তুলে নেওয়া যাবে না।

যার কোন লোক এখানে নিহত হয় তবে দু’টির মধ্যে তার কাছে যা ভাল বলে বিবেচিত হয়, তা গ্রহণ করবে। ফিদ্‌ইয়া গ্রহণ অথবা কিসাস। আব্বাস (রা.) বলেন, ইযখিরের অনুমতি দিন। কেননা আমরা এগুলো আমাদের কবরের উপর এবং ঘরের কাজে ব্যবহার করে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইযখির ব্যতীত (অর্থাৎ তা কাটা ও ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হল)। তখন ইয়ামানবাসী আবু শাহ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে লিখে দিন। তিনি বললেন, তোমরা আবু শাহকে লিখে দাও। (ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম বলেন) আমি আওযায়ীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে লিখে দিন- তাঁর এ উক্তির অর্থ কি? তিনি বলেন, এ ভাষণ যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, তা লিখে দিন। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২২৭১]

অতএব হাদিস লিপিবদ্ধকরণের নিষেধাজ্ঞা ছিল একটি প্রাথমিক ও সাময়িক বিধান যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাতেই উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

দুই.

নববী যুগের হাদিস সংকলনঃ সহিফা আস সাদিকাহ

সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আমর বিন আল আস(রা.) (মৃত্যু ৬৩ হিজরি) ছিলেন হাদিসের এক একান্ত অনুরাগী। নবীজি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর মুখ নি:সৃত যে কোন বাণী শোনামাত্র লিখে রাখতেন। কেউ কেউ আপত্তি করেছিলেন, এভাবে যাচাই বাছাই না করে সব কথা লিখে রাখার জন্য। কিন্তু স্বয়ং নবীজি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে লিখে রাখার অনুমতি দান দিয়েছিলেন। এভাবে তিলে তিলে গড়ে তোলা সহিফাটির তিনি একটা নামও দিয়েছিলেন ‘আস-সাদিকাহ’।

২.১
আবু রশিদ আল হুবরানি বলেন: আমি আবদুল্লাহ বিন ‘আমর বিন আল ‘আস এর কাছে গেলাম এবং তাকে বললাম: “রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে আপনি যা শুনেছেন তা আমার কাছে বর্ণনা করুন । তিনি আমার হাতে একটি সহিফা দিয়ে বললেন: “এটা হচ্ছে যা আমি রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে লিখেছিলাম।...” [মুসনাদ আহমাদ, হাদিস ৬৫৫৫]
২.২
মুজাহিদ(র.) বলেন: আমি আবদুল্লাহ বিন ‘আমর বিন আল ‘আস এর কাছে একটি সহিফা দেখলাম, কাজেই আমি সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন: এটা হচ্ছে আস-সাদিকাহ! এতে রয়েছে তা, যা আমি রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে শুনেছি। এতে আমার এবং তাঁর মাঝে আর কেউ নেই। [তাবাক্বাত আল কুবরা -ইবনে সা’দ, ২য় খন্ড, পৃ. ৩২২]

তিন

সাহাবাদের (রা.) হাদিস লিপিবদ্ধকরণ

৩.১. আবু বকর রা.

৩.১.১ হাদিস পোড়ানোর কাহিনী

প্রচলিত একটি বর্ণনার সূত্র ধরে বলা হয়ে থাকে যে আবু বকর রা. তাঁর সংরক্ষিত ৫০০ হাদিস পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। এই কথা শুনে শ্রোতার মনে এমন একটা ধারণা আসতেই পারে যে হাদিস সংরক্ষণ যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতো, আবু বকর রা. তো তাহলে এমনটা কিছুতেই করতেন না। বরং হাদিস লিপিবদ্ধকরণই যেন একটি অপরাধ ছিল যার প্রায়শ্চিত্ত তিনি করেছেন সেগুলো পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে।

প্রথমেই আমরা বর্ণনাটি দেখে নিই।

আয়িশা রা. বলেনঃ
আমার পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসসমূহ সংগ্রহ করেছিলেন এবং তা ছিল পাঁচশত হাদীস। এক রাতে, তিনি খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন, এপাশ ওপাশ করছিলেন এবং খুব বেশি পার্শ্ব পরিবর্তন করছিলেন। আমিও এ কারণে অস্বস্তিবোধ করছিলাম, তাই আমি বললাম, ‘আপনি কোনও অসুস্থতার কারণে ঘুরছেন, নাকি এমন খবর শুনেছেন যা আপনাকে বিচলিত করেছে?’ সকালে তিনি বললেন, ‘হে কন্যা, তোমার কাছে যে হাদিসসমূহ রয়েছে তা নিয়ে এসো।’ আমি সেগুলো নিয়ে এলাম এবং তিনি আগুন চাইলেন ও সেগুলো পুড়িয়ে ফেললেন। আমি বললাম, ‘আপনি এগুলো জ্বালিয়ে ফেললেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি আশংকা করছি যে এগুলো সাথে থাকা অবস্থায় আমি মারা যাব যাতে এমন বর্ণনাও রয়েছে যা আমি এমন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে শুনেছিলাম যাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম এবং যার বিবরণগুলিকে আমি সত্য বলে মনে করেছি যদিও বাস্তবে তা নয়; তবে তো আমি তার থেকে ভুল বর্ণনা উদ্ধৃত করতাম ।
এই হাদিসের চেইনে আলী ইবনে সালিহ নামে একজন অপরিচিত বর্ণনাকারী থাকায় ইবনে কাছির র. এই বর্ণনাটির প্রতি আপত্তি প্রকাশ করেছেন বলে কানযুল উম্মালে উল্লেখ রয়েছে।
যাহাবি র. তার তাযকিরাতুল হুফফাযে এই বর্ণনাটি সহিহ নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
[তাযকিরাতুল হুফফায, ভলি. ১, পৃ. ৫; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ২৯৪৬০]
দেখুনঃ https://hadithanswers.com/did-abu-bakr-radiyallahu-anhu-burn-his-hadith-collection/

প্রথম কথা হচ্ছে বর্ণনাটি সঠিক নয়।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যদি সাময়িকভাবে ধরেও নিই বর্ণনাটি সঠিক, তবু তা কিন্তু হাদিস লিপিবদ্ধকরণের বিপক্ষে কোন প্রমাণ হচ্ছে না। কেননা,
  • একদিকে, ৫০০ হাদিস লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা লিপিবদ্ধকরণের চর্চাকেই প্রমাণ করছে।
  • অন্যদিকে, হাদিস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ বা হাদিস সংরক্ষণ ঠিক নয়, তাই তিনি হাদিস পুড়িয়ে ফেলেছিলেন- বিষয়টা কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। বরং এই সংকলনে এমন কিছু হাদিস থাকা সম্ভব বলে তিনি আশংকা করেছিলেন যেটা তিনি অন্য কারো নিকট হতে শুনেছিলেন যিনি বিশ্বস্ত নাও হতে পারেন। অর্থাৎ হাদিসের সংরক্ষণের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতেই তিনি হাদিস পুড়িয়েছিলেন, হাদিস ধ্বংস করার জন্য নয়।

৩.১.২ হাদিস লিপিবদ্ধকরণ
এই অংশে আমি কেবল হাদিসের কিছু সূত্র উল্লেখ করলেই পারতাম বা অংশবিশেষ উল্লেখ করলেও পারতাম। কিন্তু তা না করে অনেকগুলো বড় বড় হাদিস উল্লেখ করবো যেগুলো বিস্তারিত পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন কত বিশদ ও বিস্তারিত বিধান আবু বকর রা. হাদিস থেকে আহরণ করেছিলেন এবং তা লিখিতভাবে অন্যদের প্রদান করেছেন।

৩.১.২.১
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, আবু বকর (রা.) তাঁকে বাহরাইন পাঠানোর সময় এই বিধানটি তাঁর জন্য লিখে দেনঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটাই যাকাতের নিসাব যা নির্ধারণ করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের প্রতি এবং যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নির্দেশ দিয়েছেন। মুসলিমদের মধ্যে যার কাছ থেকে নিয়মানুযায়ী চাওয়া হয়, সে যেন তা আদায় করে দেয় আর তার চেয়ে বেশী চাওয়া হলে তা যেন আদায় না করে। চব্বিশ ও তার চাইতে কম সংখ্যক উটের যাকাত বকরী দ্বারা আদায় করা হবে। প্রতি পাঁচটি উটে একটি বকরী এবং উটের সংখ্যা পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত হলে একটি মাদী বিনতে মাখায (যে উটের বয়স এক বছর পূর্ণ হয়েছে)। ছত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত একটি মাদী বিনতে লাবূন (যে উটের বয়স দু’বছর পূর্ণ হয়েছে)। ছয়চল্লিশ থেকে ষাট পর্যন্ত ষাঁড়ের পেলযোগ্য একটি হিককা (যে উটের বয়স তিন বছর পূর্ণ হয়েছে) একষট্টি থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত একটি জাযা‘আ (যে উটের বয়স চার বছর পূর্ণ হয়েছে) ছিয়াত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত দু’টি বিনতে লাবূন, একানব্বইটি থেকে একশ’ বিশ পর্যন্ত ষাঁড়ের পেলযোগ্য দু’টি হিককা। সংখ্যায় একশ’ বিশের অধিক হলে (অতিরিক্ত) প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে বিনতে লাবূন এবং (অতিরিক্ত) প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে হিককা।
যার চারটির বেশী উট নেই, সেগুলোর উপর কোন যাকাত নেই, তবে মালিক স্বেচ্ছায় কিছু দিতে চাইলে দিতে পারবে। কিন্তু যখন পাঁচে পৌঁছে তখন একটি বকরী ওয়াজিব। আর বকরীর যাকাত সম্পর্কেঃ সায়েমা বকরী চল্লিশটি থেকে একশ’ বিশটি পর্যন্ত একটি বকরী। এর বেশী হলে দু’শটি পর্যন্ত দু’টি বকরী। দু’শর অধিক হলে তিনশ’ পর্যন্ত তিনটি বকরী। তিনশ’র অধিক হলে প্রতি একশ’ তে একটি করে বকরী। কারো সায়েমা বকরীর সংখ্যা চল্লিশ থেকে একটিও কম হলে তার উপর যাকাত নেই। তবে স্বেচ্ছায় দান করলে তা করতে পারে। রূপার যকাত চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। একশ নব্বই দিরহাম হলে তার যাকাত নেই, তবে মালিক স্বেচ্ছায় কিছু দান করলে করতে পারে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩৭০]

৩.১.২.২
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, আবু বকর (রা.) তাঁর কাছে আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যে বিধান দিয়েছেন তা লিখে পাঠানঃ যে ব্যাক্তির উপর উটের যাকাত হিসাবে জাযা‘আ (যে উটের বয়স চার বছর পূর্ণ হয়েছে) ফরয হয়েছে, অথচ তার কাছে জাযা‘আ নেই বরং তার নিকট হিককা (যে উটের বয়স তিন বছর পূর্ণ হয়েছে) তখন হিককা গ্রহন করা হবে। এর সাথে সম্ভব হলে (পরিপুরকরূপে) দু’টি বকরী দিবে, অথবা বিশটি দিরহাম দিবে। আর যার উপর যাকাত হিসাবে হিককা ফরয হয়েছে, অথচ তার কাছে হিককা নেই বরং জাযা‘আ রয়েছে, তখন তার থেকে জাযা‘আ গ্রহণ করা হবে। আর যাকাত উসূলকারী (ক্ষতিপূরণ স্বরূপ) মালিককে বিশটি দিরহাম বা দু’টি বকরী দিবে।

যার উপর হিককা ফরয হয়েছে, অথচ তার নিকট বিনতে লাবূন রয়েছে, তখন বিনতে লাবূনই গ্রহণ করা হবে। তবে মালিক দু’টি বকরী বা বিশটি দিরহাম দিবে। আর যার উপর বিনতে লাবূন ফরয হয়েছে, কিন্তু তার কাছে হিককা রয়েছে, তখন তার থেকে হিককা গ্রহণ করা হবে এবং আদায়কারী মালিককে বিশটি দিরহাম বা দু’টি বকরী দিবে। আর যার উপর বিনতে লাবূন (যে উটের বয়স দু’বছর পূর্ণ হয়েছে) ফরয হয়েছে, কিন্তু তার নিকট তা নেই বরং বিনতে মাখায (যে উটের বয়স এক বছর পূর্ণ হয়েছে) রয়েছে, তবে তাই গ্রহন করা হবে, অবশ্য মালিক বিশটি দিরহাম বা দু’টি বকরী দিবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩৬৯]

৩.১.২.৩
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, আবু বকর (রা.) আনাস (রা.) এর কাছে আল্লাহ তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যাকাত সম্পর্কে যে বিধান দিয়েছেন সে সম্পর্কে লিখে জানালেন, যে ব্যাক্তির উপর যাকাত হিসাবে বিনত্ মাখায (যে উটের বয়স এক বছর পূর্ণ হয়েছে) ওয়াজিব হয়েছে কিন্তু তার কাছে তা নেই বরং বিনত্ লাবূন (যে উটের বয়স দু’বছর পূর্ণ হয়েছে) রয়েছে, তা হলে তা-ই গ্রহন করা হবে। এমতাবস্থায় আদায়কারীর যাকাত দাতাকে কিছু দিতে হবে না। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩৬৪]

৩.১.২.৪
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাত সম্পর্কে যে বিধান দিয়েছেন তা আবু বকর (রা.) তাঁর নিকট লিখে পাঠান, যাকাত-এর (পরিমাণ কম-বেশী হওয়ার) আশংকায় পৃথক (প্রাণী)-গুলোকে একত্রিত করা যাবেনা এবং একত্রিতগুলো পৃথক করা যাবে না। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩৬৬]

৩.১.২.৫
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাত সম্পর্কে যে বিধান দিয়েছেন আবু বকর (রা.) তা তাকে লিখে জানালেন এক অংশীদার অপর অংশীদারের নিকট থেকে তার প্রাপ্য আদায় করে নিবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩৬৭]

৩.১.২.৬
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাঁর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যাকাতের যে বিধান দিয়েছেন তা আবু বকর (রা.) তাঁর নিকট লিখে পাঠান তাতে রয়েছেঃ অধিক বয়সে দাঁত পড়া বৃদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ বকরী এবং পাঁঠা যাকাত হিসাবে গ্রহণ করা যাবেনা, তবে উসূলকারী যা ইচ্ছা করেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৩৭১]

৩.১.২.৭
আনাস (ইবনে মালিক) (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতের বিধান হিসাবে যা নির্দিষ্ট করেছিলেন, আবু বকর (রা.) তা আমাকে লিখে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, যেখানে দু’জন অংশীদার থেকে (যাকাত প্রদানের পর) তারা দু’জনে নিজ নিজ অংশ আদান-প্রদান করে নেবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২৩২৫]

৩.১.২.৮
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত সাদাকা সম্পর্কে আবু বকর (রা.) তার কাছে একটি ফরমান পাঠান। এতে লিখেন যে, সাদাকা প্রদানের আশংকায় যেন বিচ্ছিন্ন মালকে একত্রিত করা না হয় এবং একাত্রিত মালকে যেন বিচ্ছিন্ন করা না হয়। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬৪৮৫]


- মুহাম্মাদ সাদাত
 
Top