উত্তর: পোশাক-পরিচ্ছদ নারী-পুরুষের দেহ সজ্জিত করা এবং সতর আবৃত করার অন্যতম মাধ্যম। কেননা পোশাক দ্বারা লজ্জা নিবারণের পাশাপাশি এটা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তির প্রকৃতি অনুভব করা যায়।মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যেসব নে‘মত দান করেছেন, পোশাক তার মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ বলেন,‘হে আদাম সন্তান! আমরা তোমাদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার জন্য এবং শোভা বর্ধনের জন্য। আর তাক্বওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম। ওটা আল্লাহর নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা আ‘রাফ ৭/২৬).
মুসলিম নারীদের জন্য শাড়ী পরিধান করা হারাম অথবা নিষিদ্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া এই বক্তব্য সরাসরি সঠিক নয়। কেননা এটিকে সরাসরি হারাম সাব্যস্ত করার কোন দলিল ইসলামী শরীয়তে নেই।তাছাড়া ইসলামী শরীয়ত নারী-পুরুষ কারো জন্য নির্দিষ্ট কোন পোশাক পরিধান করা বাধ্যতা মূলক করে নি।বরং প্রত্যেক জাতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরিধান করবে যদিনা ইসলামের নিয়ম-কানুনের বিরোধী হয়।সে দৃষ্টিকোণ থেকে শাড়ি কোন ধর্মের নিদর্শন মূলক পোষাক হিসাবে গণ্য নয়।তাছাড়া শুধু শাড়ি কেন নারীরা তাদের স্বামীর সামনে যেকোন পোশাক পরিধান করতে পারে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২৪/৩৪) মহান আল্লাহ বলেন,তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা) তাদের পোশাক’।[সূরা বাকারা, ২:১৮৭] অনুরূপভাবে স্বাভাবিক শালীনতা বজায় রেখে নারীরা তাদের মাহরাম নারী-পুরুষ অঙ্গনেও শাড়ি পরিধান করতে পারে।মহান আল্লাহ বলেন,তারা (নারীরা) যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।”(স্বামী এবং উক্ত আয়াতে উল্লেখিত মাহরাম পুরুষগণ ছাড়া অন্যদের সামনে)(সূরা নূর:২৪/ ৩১)
বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ,ফাদ্বীলাতুশ শাইখ
শায়খ ইবনে উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-ও সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলেমগণ বলেন,যখন কোন পোষাক মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটা আর ধর্মীয় পোষাক থাকে না (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১০/৩০৭; ইবনে উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/৪৭-৪৮, ১২/২৯০; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৩/৩০৬-৩১০)
এবার শাড়ি পরিধান সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক মুসলিম শব্দের অর্থ যে নিজের ইচ্ছা আল্লাহর নিকট সমর্পন করে দিয়েছে। মুসলিমগন নিজের দেশের সংস্কৃতি মেনে চলতে পারে যদিনা ইসলামের নিয়ম-কানুনের বিরোধী না হয়। যেমন অনেকেই প্রশ্ন করে যে মুসলিম নারীগন কি শাড়ি পড়তে পারবে? এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো পোশাকের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য শরী‘আত যে শর্ত আরোপ করেছে, সেই শর্ত পালন করে যদি কোন নারী শাড়ি পরিধান কর তাহলে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। শর্তগুলো হল, পোশাক যেন তাকওয়াপূর্ণ হয় এবং পুরো শরীরকে আবৃত করে, ঢিলেঢালা ও প্রশস্ত হয়, পাতলা-ফিনফিনে যেন না হয়, শরীরে যে অঙ্গগুলো ঢাকা আবশ্যক সেগুলো যেন প্রকাশিত না হয়, বিপরীত লিঙ্গ পুরুষ ও কাফিরদের ধর্মীয় পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয় ইত্যাদি (বিস্তারিত দেখুন সূরা আ‘রাফ ৭/২৬ সূরা নূর ২৪/৩১, আহযাব ৩৩/৫৯, সহীহ বুখারী হা/৫৪৮৫; সহীহ মুসলিম হা/২১২৮; আবূদাঊদ হা/৪০৩১ও ৪১০৪ নাসাঈ হা/৫১২৬ মিশকত হা/৩৫২৪, ৪৩৭৫,৪৪২৯ মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৮৩; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৩৪০৬)।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন সংকীর্ণ পোশাক যে, সৃষ্টির অবয়ব প্রকাশিত হয় বা এমন ফিনফিনে পোশাক যে, চামড়া আবৃত হয় না তা পরিধান করা নিষেধ। কেননা মহিলাদেরকে এ জাতীয় পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করা হয়েছে। অভিভাবকদের (বাবা ও স্বামী) উচিত তাদের এধরনের পোশাক পরতে নিষেধ করা’ (ফাতাওয়া আল-কুবরা, ৫/৩৫৩ পৃ.)।
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সংকীর্ণ বা আটোসাঁটো পোশাক পরিধান করা অপছন্দনীয়। মধ্যবর্তী পোশাক পরিধান করাই শরী‘আত সম্মত। এমন আটোসাঁটো বা সংকীর্ণও নয় যে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোচরীভূত হয়, আবার এমন শিথিল বা ঢিলেঢালাও নয় যে, রক্ষণাবেক্ষণ করা দুষ্কর হয়ে যায়। বরং এই দু’য়ের মধ্যবর্তী পোশাক হতে হবে। মুমিন নারী-পুরুষের জন্য ফিনফিনে, অল্পায়তন, স্বল্পায়তন, সংকীর্ন ও আটোসাঁটো পোশাক পরিধান করা অশোভনীয়।
(মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ২৯/২২৭ পৃ.)।
শায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে পোশাক শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অবয়বকে আবৃত করতে পারে না সে পোশাক পরিধান করা হারাম। যেমন, কিছু পুরুষ এমন ফিনফিনে পোশাক পরিধান করে যে, চামড়ার রং পর্যন্ত দেখা যায়, বা এমন সংকীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে যে, অন্তর্বাস পর্যন্ত দেখা যায়, নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ফরয লজ্জাস্থানটাও পূর্ণাঙ্গ আবৃত হয় না। এই ধরনের পোশাক পরিধান করে ছালাত আদায় করা যাবে না। অনুরূপভাবে কিছু মহিলাও এমন ছোট ও সংকীর্ণ অথবা ফিনফিনে পোশাক পরিধান করে যে, তার শরীরের চামড়ার রং দৃশ্যমান হয় এবং দেহের উঁচু-নিচু স্থানগুলো প্রকাশিত হয়। মহিলাদের জন্য এ জাতীয় পোশাক পরিধান করা হারাম।’ (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, ১১/৮৫-৯৮)।
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোচরীভূত হয় বা লজ্জাস্থান বিকশিত হয় এমন পোশাক পরিধান করা অবৈধ। যেমন কিছু ট্রাউজার, জিম বা সুইমিংয়ের পোশাক ইত্যাদি
(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩/৪৩০, ২৪/৪০ পৃ.)।
তবে একথাও দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার যে,বর্তমানে বহু মুসলিম মহিলা পাতলা ফিনফিনে শাড়ী পরিধান করে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে এবং বিবাহসহ নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করে। যার ফলাফল হিসেবে সমাজে ফিতনা,বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অনেক নারী তো আবার শাড়ি পরিধান করে নাভি, পেট, পীঠ ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন অংশ উন্মুক্ত রাখে! ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এভাবে উন্মুক্ত চলাফেরা করা শুধু হারাম নয় বরং চরম গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ এধরণের নারীদের পরিনতি সম্পর্কে আজ থেকে ১৫০০ বছর পূর্বে প্রিয় নবী রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মাকে হুঁশিয়ারি করে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘জাহান্নামবাসীদের মধ্যে দুই প্রকার মানুষ, যাদের আমি (এখনো পর্যন্ত) দেখিনি। একদল মানুষ, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা লোকজনকে মারবে (অর্থাৎ মানুষের উপর অত্যাচার করবে) এবং একদল স্ত্রী লোক, যারা বস্ত্র পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্রা বা উলঙ্গ হবে, যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা হবে, আর তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের মত হবে। ওরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না। অথচ এত এত দূর হতে তার সুগন্ধি পাওয়া যায়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২১২৮)। ‘যারা বস্ত্র পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্রা বা উলঙ্গ’ এই শব্দের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, فهن كاسيات بالإسم و عاريات في الحقيقة ‘তারা কিন্তু নামমাত্র বস্ত্র পরিহিতা, বাস্তবে কিন্তু তারা বিবস্ত্রা বা উলঙ্গ’ (আত-তামহীদ, ১৩/২০৪ পৃ.)।শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহি’মাহুল্লাহ এই হাদীসের ব্যখ্যায় বলেছেন, “কাপড় পরিধান করেও উলংগ কথাটির অর্থ হচ্ছেঃ সেই সমস্ত নারী, যারা এতো পাতলা কাপড় পরিধান করবে যে, কাপড়ের মধ্য দিয়ে তাদের শরীরের চামড়া দেখা যাবে। অথবা এমন টাইট পোশাক পরবে যে, যার কারণে তাদের শরীরের আকৃতি বোঝা যাবে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমু’ ফাতাওয়াঃ ১৪৬/২২)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,‘তোমাদের নারীদের মধ্যে নিকৃষ্ট হ’ল যারা পর্দাহীনা অহংকারিণী। আর তারা হ’ল মুনাফিক নারী। তাদের মধ্য হ’তে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না কেবল সাদা পা বিশিষ্ট কাকের ন্যায় ব্যতীত’(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হ/১৩৮৬০; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮৪৯)
প্রিয় নবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন,আমার উম্মতের শেষ সময়ে নারীরা নগ্ন-উলঙ্গ পোষাক পরিধান করবে। তারা নিজেরা অন্যকে তাদের প্রতি আকর্ষণ করবে (নিজেরাও তাদের প্রতি আকর্ষিত হবে)। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। যদিও এর সুঘ্রাণ পঞ্চাশ হাযার বছর পথের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়’।(মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৩৮৪; বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৮০০, সনদ সহীহ)অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘তাদের মাথা হবে হেলে দুলে পড়া দুর্ভাগা উটের কুজের ন্যায়। অবশ্যই তারা অভিশপ্ত’।[সহীহ মুসলিম হা/২১২৮; ছহীহাহ হা/১৩২৬; মিশকাত হা/৩৫২৪, সনদ সহীহ)
উল্লেখ্য যে,মহিলাদের জন্য শুধু শাড়ি পরিধান করে সালাত আদায় করা যাবেনা। কেননা মহিলাদের জন্য সালাতের মধ্যে পুরো শরীর তথা মাথা, মাথার চুল, ঝুলে পড়া চুল, দুই কান, গলা, চিবুকের নিম্নাংশ, পায়ের পাতা সহ পুরা শরীর আবৃত করা ফরয। শুধু মুখমণ্ডল ও কব্জি পর্যন্ত দুই হাত খোলা থাকবে। কিন্তু শাড়ী পরলে এটা সম্ভব হয় না। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا يَقْبَلُ اللهُ صَلَاةَ حَائِضٍ إِلَّا بِخِمَارٍ ‘ওড়না ছাড়া প্রাপ্তবয়স্কা কোন মেয়ের ছালাত কবুল হবে না’ (আবূ দাঊদ, হা/৬৪১)। আর ওড়না হল, যা চুল ও চামড়াকে ঢেকে রাখে (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৫০৪৯)। মহিলারা লুঙ্গী বা কামিস, জামা বা ম্যাক্সি এবং খিমার বা ওড়না পরিধান পরেই ছালাত আদায় করবে। (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৫০৩১; সনদ হাসান, আল-মুনফারিদাতু ওয়াল ওয়াহদান,পৃ. ২২৪)
পরিশেষে,উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে মুসলিম নারীদের জন্য শাড়ি পরিধান করা জায়েজ। শর্ত হল আপনার মাথা ঢাকতে হবে যাতে একটা চুলও দেখা না যায়। পেট ও পিঠ ঢাকতে হবে যেন কোন অঙ্গ প্রকাশ না পায়। মোটকথা শাড়ি পরিধান করে যদি সারা দেহকে ঢেকে নেয়া হয়,তাহলে শাড়ি পরিধানে কোন আপত্তি নেই। পাশাপাশি নন মাহারাম ও বাড়ির বাহিরে যেতে হলে পরিপূর্ণ পর্দা অর্থাৎ শাড়ির উপর বোরকা পরিধান করা অপরিহার্য কেননা নন মাহারাম নারী-পুরুষ একে অপরের থেকে পর্দা করা ফরজ (সূরা নূর,২৪/৩০-৩১)।সুতরাং আপনি যদি এসব অনুসরন করে শাড়ি পরধান করতে পারেন তাহলে কোন সমস্যা নেই। আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
মুসলিম নারীদের জন্য শাড়ী পরিধান করা হারাম অথবা নিষিদ্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া এই বক্তব্য সরাসরি সঠিক নয়। কেননা এটিকে সরাসরি হারাম সাব্যস্ত করার কোন দলিল ইসলামী শরীয়তে নেই।তাছাড়া ইসলামী শরীয়ত নারী-পুরুষ কারো জন্য নির্দিষ্ট কোন পোশাক পরিধান করা বাধ্যতা মূলক করে নি।বরং প্রত্যেক জাতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরিধান করবে যদিনা ইসলামের নিয়ম-কানুনের বিরোধী হয়।সে দৃষ্টিকোণ থেকে শাড়ি কোন ধর্মের নিদর্শন মূলক পোষাক হিসাবে গণ্য নয়।তাছাড়া শুধু শাড়ি কেন নারীরা তাদের স্বামীর সামনে যেকোন পোশাক পরিধান করতে পারে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২৪/৩৪) মহান আল্লাহ বলেন,তারা (স্ত্রীরা) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা) তাদের পোশাক’।[সূরা বাকারা, ২:১৮৭] অনুরূপভাবে স্বাভাবিক শালীনতা বজায় রেখে নারীরা তাদের মাহরাম নারী-পুরুষ অঙ্গনেও শাড়ি পরিধান করতে পারে।মহান আল্লাহ বলেন,তারা (নারীরা) যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।”(স্বামী এবং উক্ত আয়াতে উল্লেখিত মাহরাম পুরুষগণ ছাড়া অন্যদের সামনে)(সূরা নূর:২৪/ ৩১)
বিগত শতাব্দীতে সৌদি ‘আরবের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ,ফাদ্বীলাতুশ শাইখ
শায়খ ইবনে উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-ও সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলেমগণ বলেন,যখন কোন পোষাক মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটা আর ধর্মীয় পোষাক থাকে না (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১০/৩০৭; ইবনে উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/৪৭-৪৮, ১২/২৯০; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৩/৩০৬-৩১০)
এবার শাড়ি পরিধান সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক মুসলিম শব্দের অর্থ যে নিজের ইচ্ছা আল্লাহর নিকট সমর্পন করে দিয়েছে। মুসলিমগন নিজের দেশের সংস্কৃতি মেনে চলতে পারে যদিনা ইসলামের নিয়ম-কানুনের বিরোধী না হয়। যেমন অনেকেই প্রশ্ন করে যে মুসলিম নারীগন কি শাড়ি পড়তে পারবে? এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো পোশাকের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য শরী‘আত যে শর্ত আরোপ করেছে, সেই শর্ত পালন করে যদি কোন নারী শাড়ি পরিধান কর তাহলে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। শর্তগুলো হল, পোশাক যেন তাকওয়াপূর্ণ হয় এবং পুরো শরীরকে আবৃত করে, ঢিলেঢালা ও প্রশস্ত হয়, পাতলা-ফিনফিনে যেন না হয়, শরীরে যে অঙ্গগুলো ঢাকা আবশ্যক সেগুলো যেন প্রকাশিত না হয়, বিপরীত লিঙ্গ পুরুষ ও কাফিরদের ধর্মীয় পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয় ইত্যাদি (বিস্তারিত দেখুন সূরা আ‘রাফ ৭/২৬ সূরা নূর ২৪/৩১, আহযাব ৩৩/৫৯, সহীহ বুখারী হা/৫৪৮৫; সহীহ মুসলিম হা/২১২৮; আবূদাঊদ হা/৪০৩১ও ৪১০৪ নাসাঈ হা/৫১২৬ মিশকত হা/৩৫২৪, ৪৩৭৫,৪৪২৯ মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৮৩; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১২৩৪০৬)।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এমন সংকীর্ণ পোশাক যে, সৃষ্টির অবয়ব প্রকাশিত হয় বা এমন ফিনফিনে পোশাক যে, চামড়া আবৃত হয় না তা পরিধান করা নিষেধ। কেননা মহিলাদেরকে এ জাতীয় পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করা হয়েছে। অভিভাবকদের (বাবা ও স্বামী) উচিত তাদের এধরনের পোশাক পরতে নিষেধ করা’ (ফাতাওয়া আল-কুবরা, ৫/৩৫৩ পৃ.)।
শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সংকীর্ণ বা আটোসাঁটো পোশাক পরিধান করা অপছন্দনীয়। মধ্যবর্তী পোশাক পরিধান করাই শরী‘আত সম্মত। এমন আটোসাঁটো বা সংকীর্ণও নয় যে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোচরীভূত হয়, আবার এমন শিথিল বা ঢিলেঢালাও নয় যে, রক্ষণাবেক্ষণ করা দুষ্কর হয়ে যায়। বরং এই দু’য়ের মধ্যবর্তী পোশাক হতে হবে। মুমিন নারী-পুরুষের জন্য ফিনফিনে, অল্পায়তন, স্বল্পায়তন, সংকীর্ন ও আটোসাঁটো পোশাক পরিধান করা অশোভনীয়।
(মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ২৯/২২৭ পৃ.)।
শায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে পোশাক শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অবয়বকে আবৃত করতে পারে না সে পোশাক পরিধান করা হারাম। যেমন, কিছু পুরুষ এমন ফিনফিনে পোশাক পরিধান করে যে, চামড়ার রং পর্যন্ত দেখা যায়, বা এমন সংকীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে যে, অন্তর্বাস পর্যন্ত দেখা যায়, নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ফরয লজ্জাস্থানটাও পূর্ণাঙ্গ আবৃত হয় না। এই ধরনের পোশাক পরিধান করে ছালাত আদায় করা যাবে না। অনুরূপভাবে কিছু মহিলাও এমন ছোট ও সংকীর্ণ অথবা ফিনফিনে পোশাক পরিধান করে যে, তার শরীরের চামড়ার রং দৃশ্যমান হয় এবং দেহের উঁচু-নিচু স্থানগুলো প্রকাশিত হয়। মহিলাদের জন্য এ জাতীয় পোশাক পরিধান করা হারাম।’ (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, ১১/৮৫-৯৮)।
সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি বলেন, ‘দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোচরীভূত হয় বা লজ্জাস্থান বিকশিত হয় এমন পোশাক পরিধান করা অবৈধ। যেমন কিছু ট্রাউজার, জিম বা সুইমিংয়ের পোশাক ইত্যাদি
(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৩/৪৩০, ২৪/৪০ পৃ.)।
তবে একথাও দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার যে,বর্তমানে বহু মুসলিম মহিলা পাতলা ফিনফিনে শাড়ী পরিধান করে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে এবং বিবাহসহ নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করে। যার ফলাফল হিসেবে সমাজে ফিতনা,বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অনেক নারী তো আবার শাড়ি পরিধান করে নাভি, পেট, পীঠ ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন অংশ উন্মুক্ত রাখে! ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এভাবে উন্মুক্ত চলাফেরা করা শুধু হারাম নয় বরং চরম গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ এধরণের নারীদের পরিনতি সম্পর্কে আজ থেকে ১৫০০ বছর পূর্বে প্রিয় নবী রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মাকে হুঁশিয়ারি করে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘জাহান্নামবাসীদের মধ্যে দুই প্রকার মানুষ, যাদের আমি (এখনো পর্যন্ত) দেখিনি। একদল মানুষ, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা লোকজনকে মারবে (অর্থাৎ মানুষের উপর অত্যাচার করবে) এবং একদল স্ত্রী লোক, যারা বস্ত্র পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্রা বা উলঙ্গ হবে, যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা হবে, আর তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের মত হবে। ওরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না। অথচ এত এত দূর হতে তার সুগন্ধি পাওয়া যায়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/২১২৮)। ‘যারা বস্ত্র পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্রা বা উলঙ্গ’ এই শব্দের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, فهن كاسيات بالإسم و عاريات في الحقيقة ‘তারা কিন্তু নামমাত্র বস্ত্র পরিহিতা, বাস্তবে কিন্তু তারা বিবস্ত্রা বা উলঙ্গ’ (আত-তামহীদ, ১৩/২০৪ পৃ.)।শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহি’মাহুল্লাহ এই হাদীসের ব্যখ্যায় বলেছেন, “কাপড় পরিধান করেও উলংগ কথাটির অর্থ হচ্ছেঃ সেই সমস্ত নারী, যারা এতো পাতলা কাপড় পরিধান করবে যে, কাপড়ের মধ্য দিয়ে তাদের শরীরের চামড়া দেখা যাবে। অথবা এমন টাইট পোশাক পরবে যে, যার কারণে তাদের শরীরের আকৃতি বোঝা যাবে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমু’ ফাতাওয়াঃ ১৪৬/২২)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,‘তোমাদের নারীদের মধ্যে নিকৃষ্ট হ’ল যারা পর্দাহীনা অহংকারিণী। আর তারা হ’ল মুনাফিক নারী। তাদের মধ্য হ’তে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না কেবল সাদা পা বিশিষ্ট কাকের ন্যায় ব্যতীত’(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হ/১৩৮৬০; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮৪৯)
প্রিয় নবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন,আমার উম্মতের শেষ সময়ে নারীরা নগ্ন-উলঙ্গ পোষাক পরিধান করবে। তারা নিজেরা অন্যকে তাদের প্রতি আকর্ষণ করবে (নিজেরাও তাদের প্রতি আকর্ষিত হবে)। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। যদিও এর সুঘ্রাণ পঞ্চাশ হাযার বছর পথের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়’।(মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৩৮৪; বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৮০০, সনদ সহীহ)অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘তাদের মাথা হবে হেলে দুলে পড়া দুর্ভাগা উটের কুজের ন্যায়। অবশ্যই তারা অভিশপ্ত’।[সহীহ মুসলিম হা/২১২৮; ছহীহাহ হা/১৩২৬; মিশকাত হা/৩৫২৪, সনদ সহীহ)
উল্লেখ্য যে,মহিলাদের জন্য শুধু শাড়ি পরিধান করে সালাত আদায় করা যাবেনা। কেননা মহিলাদের জন্য সালাতের মধ্যে পুরো শরীর তথা মাথা, মাথার চুল, ঝুলে পড়া চুল, দুই কান, গলা, চিবুকের নিম্নাংশ, পায়ের পাতা সহ পুরা শরীর আবৃত করা ফরয। শুধু মুখমণ্ডল ও কব্জি পর্যন্ত দুই হাত খোলা থাকবে। কিন্তু শাড়ী পরলে এটা সম্ভব হয় না। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا يَقْبَلُ اللهُ صَلَاةَ حَائِضٍ إِلَّا بِخِمَارٍ ‘ওড়না ছাড়া প্রাপ্তবয়স্কা কোন মেয়ের ছালাত কবুল হবে না’ (আবূ দাঊদ, হা/৬৪১)। আর ওড়না হল, যা চুল ও চামড়াকে ঢেকে রাখে (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৫০৪৯)। মহিলারা লুঙ্গী বা কামিস, জামা বা ম্যাক্সি এবং খিমার বা ওড়না পরিধান পরেই ছালাত আদায় করবে। (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হা/৫০৩১; সনদ হাসান, আল-মুনফারিদাতু ওয়াল ওয়াহদান,পৃ. ২২৪)
পরিশেষে,উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে মুসলিম নারীদের জন্য শাড়ি পরিধান করা জায়েজ। শর্ত হল আপনার মাথা ঢাকতে হবে যাতে একটা চুলও দেখা না যায়। পেট ও পিঠ ঢাকতে হবে যেন কোন অঙ্গ প্রকাশ না পায়। মোটকথা শাড়ি পরিধান করে যদি সারা দেহকে ঢেকে নেয়া হয়,তাহলে শাড়ি পরিধানে কোন আপত্তি নেই। পাশাপাশি নন মাহারাম ও বাড়ির বাহিরে যেতে হলে পরিপূর্ণ পর্দা অর্থাৎ শাড়ির উপর বোরকা পরিধান করা অপরিহার্য কেননা নন মাহারাম নারী-পুরুষ একে অপরের থেকে পর্দা করা ফরজ (সূরা নূর,২৪/৩০-৩১)।সুতরাং আপনি যদি এসব অনুসরন করে শাড়ি পরধান করতে পারেন তাহলে কোন সমস্যা নেই। আশা করি উত্তরটি পেয়েছেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Last edited by a moderator: