সকল প্রশংসা একক ও প্রতাপশালী আল্লাহ তা‘আলার জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবারবর্গ ও প্রিয় সাহাবীগণের প্রতি। সেই আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করছি যিনি বলেন,
‘আর তোমার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনিত করেন’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৬৮)। নবী হিসাবে সঠিক মানুষকে বাছাই করাটা আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, তাঁর এককত্ব, পূর্ণাঙ্গ হিকমাত, পূর্ণ জ্ঞান ও সক্ষমতার প্রমাণ।
আল্লাহ তা‘আলা কতিপয় দিন ও মাসকে অপর কিছু দিন ও মাসের উপর মর্যাদা দান করেছেন। তিনি চারটি মাসকে সাম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বারোমাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের উপর কোন যুলুম কর না’ (সূরা আত-তওবা : ৩৬)। উক্ত আয়াতে হারাম মাসগুলোকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। তবে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ বাকরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন,
‘আল্লাহ তা‘আলা যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবেই আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মাঝে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-ক্ব‘আদাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহাররম এই তিন মাস ধারাবাহিক রয়েছে। আর একটি হল, রজবে মুযার, যা জুমাদাল আখের ও শা‘বান মাসের মাঝামাঝি’।[১]
রজব মাসকে ‘মুযার’ নামে নামকরণ করার কারণ হল- মুযার গোত্র রজব মাসের সময়কে কখনো পরিবর্তন করত না; তা যথাস্থানে রেখেই মাসের হিসাব করত। কিন্তু বাকী আরবরা ছিল এর ব্যতিক্রম। তারা যুদ্ধের অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে রজব মাসকে পিছিয়ে দিত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফুরী বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা কাফিররা পথভ্রষ্ট হয়, তারা এটি এক বছর হালাল করে এবং আরেক বছর হারাম করে। যাতে তারা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার সংখ্যা ঠিক রাখে। ফলে আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা তারা হালাল করে’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৩৭)।
অন্যত্র বলা হয়েছে, রজব মাসকে মুযার গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত করার কারণ হল- তারা এ মাসকে অধিক সম্মান করত ও এর মর্যাদা রক্ষা করত। তাই এই মাসকে ‘মুযার’ নামে নমকরণ করা হয়েছে।
জাহেলী যুগের লোকেরা রজব মাসকে مُنَصِّلُ الْأَسِنَّةِ ‘তীর থেকে ফলা বিচ্ছিন্ন করার মাস’ নামে আখ্যায়িত করত। আবূ রাজা আল-‘আত্বারিদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমরা (জাহেলী যুগে) পাথরের পূজা করতাম। যদি তার চেয়ে ভাল কোন পাথর পেতাম, তাহলে পূর্বেরটা ফেলে দিয়ে নতুনটার পূজা শুরু করতম। আর যদি কোন পাথর না পেতাম, তবে কিছু মাটি স্তূপ করে নিতাম। অতঃপর একটি বকরী নিয়ে এসে স্তূপের ওপর রেখে দোহন করতাম আর তার চারপাশে ত্বাওয়াফ করতাম। আর যখন আমাদের মাঝে রজব মাস প্রবেশ করত, তখন আমরা বলতামمُنَصِّلُ الْأَسِنَّةِ ‘তীর থেকে ফলা বিচ্ছিন্ন করার মাস’। সুতরাং আমরা এ সময় আমাদের সকল বর্শা ও তীর থেকে লোহার ফলা খুলে রাখতাম ও রজব মাসব্যাপী এগুলো ব্যবহার থেকে বিরত থাকতাম’।[২] বায়হাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জাহেলী যুগের লোকেরা এই হারাম মাসগুলোকে সম্মান করত। বিশেষভাবে রজব মাসকে। সুতরাং তারা রজব মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হত না’।[৩]
রজব হল হারাম মাস
হারাম মাসগুলোর বিরাট মর্যাদা আছে। রজব মাস তন্মধ্যে অন্যতম। কেননা এটা হারাম মাসগুলোর অন্যতম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে মুমিনগণ! তোমরা অসম্মান কর না আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ও হারাম মাসের’ (সূরা আল-মায়েদা : ২)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর কৃত হারামগুলোকে হালাল মনে কর না। যে হারাম বিষয়গুলোর ব্যাপারে সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন ও যে পাপাচারিতার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন, সেগুলোকে লঙ্ঘন কর না। এখানে নিষেধাজ্ঞাটা খারাপ কাজ ও খারাপ আক্বীদা উভয়কে শামিল করে।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
‘তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের উপর কোন যুলুম কর না’ (সূরা আত-তওবাহ : ৩৬)।
উক্ত আয়াতে বর্ণিত هُنَّ যমীরটা হারাম চার মাসের দিকে প্রত্যাবর্তন করছে। ইমান ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) যেমনটি বলেছেন। সুতরাং এই মাসসমূহের হারাম বিষয়গুলো সম্পর্কে যত্নবান হওয়া উচিত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এই মাসগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং এ সময়ে অবাধ্যতা ও পাপাচারে লিপ্ক হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ মাসগুলোর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এছাড়া আল্লাহ তা‘আলার নিষিদ্ধ সময়ে কোন অবাধ্যতা সংঘটিত হলে তা আরো বড় অপরাধ হয়ে থাকে। এ জন্যই পূর্বোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি যুলুম করা থেকে সতর্ক করেছেন। এতদ্ভিন্ন অপরাধ যে কোন মাসেই সংঘটিত হোক তা হারাম।
হারাম মাসসমূহে লড়াই বা যুদ্ধ করা
আল্লাহ তা‘আলা
‘তারা আপনাকে হারাম মাস সম্পর্কে তাতে লড়াই করা বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, তাতে লড়াই করা বড় পাপ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৭)। ‘আলেমগণের মতে, হারাম মাসসমূহে যুদ্ধ হারাম হওয়ার বিধান আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা মানসূখ হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘অতঃপর যখন হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুাশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর’ (সূরা আত-তওবাহ : ৫)।
এ ছাড়াও তাদের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যানগণ দলীল পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ত্বায়েফবাসীর সাথে যিলক্বদ মাসে যুদ্ধ করেছেন। আর এটা ছিল একটি হারাম মাস।
অন্যরা বলেন, ‘হারাম মাসসমূহে যুদ্ধ শুরু করা জায়েয নেই, তবে যদি হারাম মাসের আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে হারাম মাসেও চলে তবে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া জায়েয। তারাও ত্বায়েফবাসীর সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুদ্ধ সংক্রান্ত হাদীস দ্বারাই দলীল পেশ করেছেন। কেননা তাদের সাথে প্রথমে হুনায়নে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা ছিল শাওয়াল মাস। আর যে যুদ্ধের কথা বলা হল এতে প্রতিরোধ উদ্দেশ্য ছিল না। সুতরাং শত্রু বাহিনী যখন কোন মুসলিম জনপদে আক্রমণ করে, তখন কাফেরদের প্রতিরোধ করা ঐ জনপদের অধিবাসীদের ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়, সেটা হারাম মাস হোক বা অন্য কোন মাস।
‘আতীরা বা পশু যব্হ করা
জাহেলী যুগে আরবরা তাদের মূর্তির নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে রজব মাসে পশু যব্হ করত। অতঃপর যখন ইসলাম আল্লাহর নামে যব্হ করার বিধান নিয়ে আসল, তখন জাহেলী প্রথা বাতিল হয়ে গেল। আর রজব মাসে পশু যব্হ করার বিধানের ব্যাপারে ফক্বীহগণ মতানৈক্য করেছেন। হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের বিদ্যানগণ বলেন, ‘আতীরা তথা রজব মাসে পশু যব্হ করার বিধান রহিত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তারা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা দলীল পেশ করেছেন,
‘ইসলামে ফারা‘ ও ‘আতীরা নেই। ফারা‘ হল উটের সে প্রথম বাচ্চা, যা তারা তাদের দেবদেবীর নামে যব্হ করত। আর ‘আতীরা হল, রজব মাসে যে জন্তু যব্হ করত’।[৪]
শাফেঈগণ বলেন, ‘আতীরার বিধান মানসূখ হয়নি। এমনকি তাদের মতে ‘আতীরা মুস্তাহাব। এটা ইবনু সীরীনের কথা। ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শাফেঈগণের মতকে শক্তিশালী করছে আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ বর্ণিত একটি হাদীস। হাদীসটিকে হাকেম ও ইবনুল মুনযির সহীহ বলেছেন। হাদীসটি হল, নুবায়শা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন লোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে ডেকে বলল,
‘আমরা জাহেলী যুগে রজব মাসে ‘আতীরা করতাম। এ বিষয়ে আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দিবেন? তিনি বললেন, তোমরা যে কোন মাসে পশু যব্হ কর’।[৫]
ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উল্লিখিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মূলত ‘আতীরাকে বাতিল করেননি। বরং তিনি নির্দিষ্টভাবে রজব মাসে পশু যব্হকে বাতিল করেছেন।[৬]
রজব মাসে সিয়াম
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কোন সাহাবী থেকে নির্দিষ্টভাবে রজব মাসের সিয়ামের কোন ফযীলত সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়নি। তবে অন্যান্য মাসে স্বাভাবিকভাবে যে সকল সিয়াম রাখা যায় এ মাসেও তা রাখা যাবে। যেমন, প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহষ্পতিবার, মাসে তিনটি তথা আইয়ামে বীযের সিয়াম, একদিন পরপর সিয়াম রাখা, সারারুশ শাহ্র এর সিয়াম রাখা ইত্যাদি। কিছু আলেম বলেন, سرر الشهر দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মাসের শুরুর দিক। আবার কেউ বলেন, মাসের মাঝামাঝি। আবার কারো মতে তা মাসের শেষাংশ।
জাহেলী যুগের আমলের সাথে সাদৃশ্য থাকার কারণে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রজব মাসে সিয়াম রাখতে নিষেধ করতেন। যেমন খারাশা বিন হুর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি দেখেছি যারা রজব মাসকে কেন্দ্র করে খানাপিনা থেকে হাত গুটিয়ে রাখত, তথা সিয়াম রাখত, তাদেরকে সিয়াম না ভাঙ্গা পর্যন্ত ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রহার করতেন এবং বলতেন, তোমরা খাও। কেননা এটা এমন একটি মাস, যাকে জাহেলী যুগের লোকেরা সম্মান করল’।[৭]
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরামহীনভাবে তথা টানা তিন মাস (রজব, শা‘বান ও রামাযান) সিয়াম রাখতেন না। যেমনটা কিছু মানুষ করত। আর তিনি রজব মাসে কখনোই সিয়াম রাখেননি এবং এটাকে পসন্দও করতেন না’।[৮]
ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রজব মাস ও নির্দিষ্টভাবে তাতে সিয়াম রাখা বা রাত্রি জাগরণ করার ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল বর্ণিত হয়নি। এ ব্যাপারে আমার চেয়ে আরো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ইমাম হাফেয আবূ ইসমাইল আল-হারাবী। অনুরূপ এটা আমরা অন্যদের থেকেও বর্ণনা করেছি’।[৯]
‘ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমা’তে বলা হয়েছে, ‘রজব মাসের কোন দিনকে সিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে শরী‘আতে কোন বিধান আছে বলে আমাদের জানা নেই’।[১০]
রজব মাসে ওমরাহ
বিভিন্ন হাদীস প্রমাণ করে যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসে ওমরাহ করেননি। যেমন মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি ও ওরওয়া ইবনু যুবায়ের মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলাম। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হুজরার পার্শ্বে বসা ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতবার ওমরাহ পালন করেছেন? তিনি বললেন, চার বার; এর মধ্যে একবার রজব মাসে। আমরা তাঁর কথা প্রত্যাখান করতে অপসন্দ করলাম। রাবী বলেন, এসময় আমরা হুজরার মধ্যে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মেসওয়াক করার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফলে ওরওয়া বলল, ‘হে মা! হে উম্মুল মুমিনীন! আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না, আবূ আব্দুর রহমান কী বলেছেন? তিনি জানতে চাইলেন, কী বলছেন? ওরওয়া বললেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারবার হজ্জ করেছেন, তার মধ্যে একবার করেছেন রজব মাসে। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আবূ আব্দুর রহমানের উপর রহম করুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতবার ওমরাহ করেছেন, প্রত্যেকবার তিনি (ইবনু ওমর) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সাথে উপস্থিত ছিলেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসে কখনো ওমরাহ পালন করেননি’।[১১]
সহীহ মুসলিমে এসেছে, ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর কথা শুনে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি।[১২]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর কথা শুনেও ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) -এর কোন প্রতিবাদ না করা এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর কাছে বিষয়টি সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল অথবা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন অথবা তাঁর সন্দেহ ছিল’।[১৩]
অতএব রজব মাসকে ওমরার জন্য নির্দিষ্ট করা নিকৃষ্ট বিদ‘আত। অনুরূপভাবে রজব মাসে ওমরাহ করলে নির্দিষ্ট কোন ফযীলত আছে এই আক্বীদা পোষণ করাও বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসে ওমরাহ করেছেন মর্মে কোন প্রমাণ নেই। শায়খ আলী ইবনু ইবরাহীম আল-‘আত্বার (মৃ.৭২৪ হি.) বলেন, ‘আমার কাছে মক্কাবাসীদের (আল্লাহ মক্কাবসীদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিন) নিকট থেকে আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, রজব মাসে ওমরাহ করাই সাধারণ নিয়ম। (ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর কোন ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, রামাযান মাসের একটি ওমরাহ একটি হজ্জের সমান’।[১৪]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কবর জিয়ারত বা অন্য যে কোন আমলের জন্য যদি রজব মাসের কোন দিনকে নির্দিষ্ট করা হয় তবে তা বিদ‘আত হবে। কেননা তার কোন ভিত্তি নেই। এ কথাকে সমর্থন করেছেন ইমাম আবূ শামাহ। তিনি তাঁর كتاب البدع والحوادث নামক গ্রন্থে বলেন, শরী‘আত নির্ধারণ করে দেয়নি, এমন কোন সময়কে কোন শারঈ আমলের জন্য হলেও নির্দিষ্ট করা ও ফযীলতের প্রত্যাশা করা জায়েয নেই। এজন্যই আলেমগণ বেশি বেশি ওমরাহ পালনের জন্য রজব মাসকে নির্দিষ্ট করাকে অপসন্দ করেছেন। তবে কেউ যদি রজব মাসে নির্দিষ্ট কোন ফযীলতের আক্বীদা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে ওমরাহ করে অথবা এ সময় ওমরাহ করা তার জন্য সহজ হয়, তবে এসময় ওমরাহ করলে কোন ক্ষতি নেই’।[১৫]
রজব মাসে বিদ‘আত
দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করা গুরুতর অপরাধ। কেননা এটা কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের পরিপন্থী। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পূর্বেই দ্বীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পসন্দ করলাম’ (সূরা আল-মায়িদা : ৩)। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কেউ যদি এমন কিছুর উদ্ভব ঘটায়, যা আমাদের শরী‘আতে নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত’।[১৬] সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে যার ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই তবে তা প্রত্যাখ্যাত’।[১৭] কিছু মানুষ রজব মাসে বিভিন্ন রকমের বিদ‘আত করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কিছু বিদ‘আত নিম্নরূপ:
১). সালাতুর রাগায়েব
এই সালাত সোনালী যুগের পর বিশেষভাবে চতুর্থ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা উদ্ভব ঘটিয়েছিল কিছু মিথ্যুক। এই সালাত রজব মাসের প্রথম রাত্রে পড়া হয়। শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইমাম মালেক, শাফেঈ, আবূ হানীফা, ছাওরী, আওযাঈ, লাইছ (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ সকল আলেমের ঐকমত্যে সালাতুর রাগায়েব বিদ‘আত। আর হাদীস বিশারদগণের মতে এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস মিথ্যা।[১৮]
২). বর্ণিত আছে যে, রজব মাসে বিরাট একটি ঘটনা ঘটেছে। যদিও এর কোন সত্যতা নেই। ঘটনাটি হল, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসের প্রথম রাত্রে জন্ম গ্রহণ করেছেন। আবার তিনি এই মাসের ২৭ তারিখে নবী হিসাবে প্রেরিত হয়েছেন। ২৫ তারিখের কথাও বলা হয়েছে। তবে এ সকল বর্ণনার কোনটিরই সত্যতা নেই। ক্বাসেম ইবনু মুহাম্মাদ থেকে অন্য একটি হাদীস বর্ণিত আছে। আর হাদীসের সনদও সহীহ নয়। হাদীসটি হল, রজব মাসের ২৭ তারিখে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে। আর ইবরাহীম আল-হারবী ও অন্যরা এ বর্ণনাকে মুনকার বলেছেন।[১৯]
সুতরাং রজব মাসের ২৭ তারিখে মি‘রাজের ঘটনা বর্ণনা বা কোন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা স্পষ্ট বিদ‘আত। অনুরূপভাবে নির্দিষ্টভাবে শুধু এই রাতে অতিরিক্ত ইবাদত তথা ক্বিয়ামুল লাইল করা অথবা এই দিন সিয়াম পালন করাও বিদ‘আত। অথবা দুই ঈদে আমরা যে আনন্দ করে থাকি তেমন কোন আনন্দ প্রকাশ বা ইর্ষা করা হারাম। কেননা মুসলিমদের ঈদের দিন দু’টি। সুতরাং এর চেয়ে বেশি কেউ কিছু করতে চাইলে তা বিদ‘আত হবে।
এর সাথে আমি আরো একটু যোগ করতে চাই, এই মাসে মি‘রাজের যে ঘটনা বর্ণিত আছে, তা দৃঢ়ভাবে কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। আর এই মাসে মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার কোন দলীল যদি পাওয়াও যেত, তবুও এ মাসে কোন ধরনের অনুষ্ঠান করা জায়েয হত না। কেননা তা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কোন সাহাবী বা কোন সালাফে ছালেহীনের নিকট থেকে অনুষ্ঠান করার কোন দলীল পাওয়া যায় না। আর এ মাসে কোন অনুষ্ঠান করা যদি জায়েয হত, তবে আমাদের তুলনায় সালাফগণই সে অনুষ্ঠান পালনে অগ্রগামী হতেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন।
৩). মধ্য রজবে দাঊদ (আলাইহিস সালাম) -এর মায়ের সালাত। অর্থাৎ মধ্য রজবে দাঊদ (আলাইহিস সালাম) -এর মা সালাত আদায় করতেন মনে করে তাঁর অনুসরণে সালাত আদায় করা বিদ‘আত।
৪). মৃতদের রূহের মাগফিরাতের জন্য রজব মাসে ছাদাক্বাহ করা বিদ‘আত।
৫). রজব মাসের সাথে নির্দিষ্ট করে যত দু‘আ করা হয়, তা সবই বিদ‘আত।
৬). নির্দিষ্টভাবে রজব মাসে কবর যিয়ারত করা। এটাও একটা নিকৃষ্ট বিদ‘আত। সুতরাং কবর যিয়ারত হতে হবে সারা বছরের যে কোন সময়।
পরিশেষে আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত, করেন যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় তাঁর হারামকে যথাযথ সম্মান করে ও নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে।
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৩১৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৭৯।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/৪৩৭৬।
[৩]. বায়হাক্বী, ফাযাইলুল আওক্বাত, পৃ. ৮১।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/৫৪৭৩, ৫৪৭৪; সহীহ মুসলিম, হা/১৯৭৬।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/২৮৩০; নাসাঈ, হা/৪২২৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩১৬৭, সনদ সহীহ।
[৬]. ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.), ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৯৭।
[৭]. আল-ইরওয়াউল গালীল, হা/৯৫৭, সনদ সহীহ।
[৮]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়লি ইবাদ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭তম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৪।
[৯]. ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, তাবঈনুল ‘আজ্বি বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রজব, পৃ. ২।
[১০]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫০৮-৫০৯।
[১১]. সহীহ বুখারী, হা/১৭৭৫, ৪২৫৩; সহীহ মুসলিম, হা/১২৫৫।
[১২]. সহীহ মুসলিম, হা/১২৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৩২৪।
[১৩]. আবূ যাকারিয়া মুহীউদ্দীন ইয়াহইয়া ইবনু শারফ আন-নববী, আল-মিনহাজু শারহু সহীহ মুসলিম (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯২ হি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৩৫।
[১৪]. ফাতাওয়া ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৩৬৭৬৬।
[১৫]. মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আলুশ শায়খ, ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১১৫; ফাতাওয়া ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৩৬৭৬৬।
[১৬]. সহীহ বুখারী হা/২৬৯৭; সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮।
[১৭]. সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮।
[১৮]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৩তম খ-, পৃ. ১৩৪।
[১৯]. ফাতাওয়া ইয়াসআলুনাক, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮; শায়খ আলী হাশীশ, সিলসিলাতুল আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ, পৃ. ২২২।
وَ رَبُّکَ یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ وَ یَخۡتَارُ
‘আর তোমার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনিত করেন’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৬৮)। নবী হিসাবে সঠিক মানুষকে বাছাই করাটা আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, তাঁর এককত্ব, পূর্ণাঙ্গ হিকমাত, পূর্ণ জ্ঞান ও সক্ষমতার প্রমাণ।
আল্লাহ তা‘আলা কতিপয় দিন ও মাসকে অপর কিছু দিন ও মাসের উপর মর্যাদা দান করেছেন। তিনি চারটি মাসকে সাম্মানিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ عِدَّۃَ الشُّہُوۡرِ عِنۡدَ اللّٰہِ اثۡنَا عَشَرَ شَہۡرًا فِیۡ کِتٰبِ اللّٰہِ یَوۡمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ مِنۡہَاۤ اَرۡبَعَۃٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِکَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ۬ۙ فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡہِنَّ اَنۡفُسَکُمۡ
‘নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বারোমাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের উপর কোন যুলুম কর না’ (সূরা আত-তওবা : ৩৬)। উক্ত আয়াতে হারাম মাসগুলোকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। তবে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ বাকরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন,
الزَّمَانُ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ثَلَاثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِى بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ
‘আল্লাহ তা‘আলা যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবেই আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মাঝে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-ক্ব‘আদাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহাররম এই তিন মাস ধারাবাহিক রয়েছে। আর একটি হল, রজবে মুযার, যা জুমাদাল আখের ও শা‘বান মাসের মাঝামাঝি’।[১]
রজব মাসকে ‘মুযার’ নামে নামকরণ করার কারণ হল- মুযার গোত্র রজব মাসের সময়কে কখনো পরিবর্তন করত না; তা যথাস্থানে রেখেই মাসের হিসাব করত। কিন্তু বাকী আরবরা ছিল এর ব্যতিক্রম। তারা যুদ্ধের অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে রজব মাসকে পিছিয়ে দিত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّمَا النَّسِیۡٓءُ زِیَادَۃٌ فِی الۡکُفۡرِ یُضَلُّ بِہِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُحِلُّوۡنَہٗ عَامًا وَّ یُحَرِّمُوۡنَہٗ عَامًا لِّیُوَاطِـُٔوۡا عِدَّۃَ مَا حَرَّمَ اللّٰہُ فَیُحِلُّوۡا مَا حَرَّمَ اللّٰہُ
‘নিশ্চয় কোন মাসকে পিছিয়ে দেয়া কুফুরী বৃদ্ধি করে। এর দ্বারা কাফিররা পথভ্রষ্ট হয়, তারা এটি এক বছর হালাল করে এবং আরেক বছর হারাম করে। যাতে তারা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার সংখ্যা ঠিক রাখে। ফলে আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা তারা হালাল করে’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৩৭)।
অন্যত্র বলা হয়েছে, রজব মাসকে মুযার গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত করার কারণ হল- তারা এ মাসকে অধিক সম্মান করত ও এর মর্যাদা রক্ষা করত। তাই এই মাসকে ‘মুযার’ নামে নমকরণ করা হয়েছে।
জাহেলী যুগের লোকেরা রজব মাসকে مُنَصِّلُ الْأَسِنَّةِ ‘তীর থেকে ফলা বিচ্ছিন্ন করার মাস’ নামে আখ্যায়িত করত। আবূ রাজা আল-‘আত্বারিদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমরা (জাহেলী যুগে) পাথরের পূজা করতাম। যদি তার চেয়ে ভাল কোন পাথর পেতাম, তাহলে পূর্বেরটা ফেলে দিয়ে নতুনটার পূজা শুরু করতম। আর যদি কোন পাথর না পেতাম, তবে কিছু মাটি স্তূপ করে নিতাম। অতঃপর একটি বকরী নিয়ে এসে স্তূপের ওপর রেখে দোহন করতাম আর তার চারপাশে ত্বাওয়াফ করতাম। আর যখন আমাদের মাঝে রজব মাস প্রবেশ করত, তখন আমরা বলতামمُنَصِّلُ الْأَسِنَّةِ ‘তীর থেকে ফলা বিচ্ছিন্ন করার মাস’। সুতরাং আমরা এ সময় আমাদের সকল বর্শা ও তীর থেকে লোহার ফলা খুলে রাখতাম ও রজব মাসব্যাপী এগুলো ব্যবহার থেকে বিরত থাকতাম’।[২] বায়হাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জাহেলী যুগের লোকেরা এই হারাম মাসগুলোকে সম্মান করত। বিশেষভাবে রজব মাসকে। সুতরাং তারা রজব মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হত না’।[৩]
রজব হল হারাম মাস
হারাম মাসগুলোর বিরাট মর্যাদা আছে। রজব মাস তন্মধ্যে অন্যতম। কেননা এটা হারাম মাসগুলোর অন্যতম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحِلُّوۡا شَعَآئِرَ اللّٰہِ وَ لَا الشَّہۡرَ الۡحَرَامَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা অসম্মান কর না আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ও হারাম মাসের’ (সূরা আল-মায়েদা : ২)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর কৃত হারামগুলোকে হালাল মনে কর না। যে হারাম বিষয়গুলোর ব্যাপারে সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন ও যে পাপাচারিতার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন, সেগুলোকে লঙ্ঘন কর না। এখানে নিষেধাজ্ঞাটা খারাপ কাজ ও খারাপ আক্বীদা উভয়কে শামিল করে।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡہِنَّ اَنۡفُسَکُمۡ
‘তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের উপর কোন যুলুম কর না’ (সূরা আত-তওবাহ : ৩৬)।
উক্ত আয়াতে বর্ণিত هُنَّ যমীরটা হারাম চার মাসের দিকে প্রত্যাবর্তন করছে। ইমান ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) যেমনটি বলেছেন। সুতরাং এই মাসসমূহের হারাম বিষয়গুলো সম্পর্কে যত্নবান হওয়া উচিত। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এই মাসগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং এ সময়ে অবাধ্যতা ও পাপাচারে লিপ্ক হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ মাসগুলোর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এছাড়া আল্লাহ তা‘আলার নিষিদ্ধ সময়ে কোন অবাধ্যতা সংঘটিত হলে তা আরো বড় অপরাধ হয়ে থাকে। এ জন্যই পূর্বোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি যুলুম করা থেকে সতর্ক করেছেন। এতদ্ভিন্ন অপরাধ যে কোন মাসেই সংঘটিত হোক তা হারাম।
হারাম মাসসমূহে লড়াই বা যুদ্ধ করা
আল্লাহ তা‘আলা
یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الشَّہۡرِ الۡحَرَامِ قِتَالٍ فِیۡہِ ؕ قُلۡ قِتَالٌ فِیۡہِ کَبِیۡرٌ
‘তারা আপনাকে হারাম মাস সম্পর্কে তাতে লড়াই করা বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, তাতে লড়াই করা বড় পাপ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৭)। ‘আলেমগণের মতে, হারাম মাসসমূহে যুদ্ধ হারাম হওয়ার বিধান আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা মানসূখ হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاِذَا انۡسَلَخَ الۡاَشۡہُرُ الۡحُرُمُ فَاقۡتُلُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ حَیۡثُ وَجَدۡتُّمُوۡہُمۡ
‘অতঃপর যখন হারাম মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুাশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর’ (সূরা আত-তওবাহ : ৫)।
এ ছাড়াও তাদের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যানগণ দলীল পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ত্বায়েফবাসীর সাথে যিলক্বদ মাসে যুদ্ধ করেছেন। আর এটা ছিল একটি হারাম মাস।
অন্যরা বলেন, ‘হারাম মাসসমূহে যুদ্ধ শুরু করা জায়েয নেই, তবে যদি হারাম মাসের আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে হারাম মাসেও চলে তবে যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া জায়েয। তারাও ত্বায়েফবাসীর সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুদ্ধ সংক্রান্ত হাদীস দ্বারাই দলীল পেশ করেছেন। কেননা তাদের সাথে প্রথমে হুনায়নে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা ছিল শাওয়াল মাস। আর যে যুদ্ধের কথা বলা হল এতে প্রতিরোধ উদ্দেশ্য ছিল না। সুতরাং শত্রু বাহিনী যখন কোন মুসলিম জনপদে আক্রমণ করে, তখন কাফেরদের প্রতিরোধ করা ঐ জনপদের অধিবাসীদের ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়, সেটা হারাম মাস হোক বা অন্য কোন মাস।
‘আতীরা বা পশু যব্হ করা
জাহেলী যুগে আরবরা তাদের মূর্তির নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে রজব মাসে পশু যব্হ করত। অতঃপর যখন ইসলাম আল্লাহর নামে যব্হ করার বিধান নিয়ে আসল, তখন জাহেলী প্রথা বাতিল হয়ে গেল। আর রজব মাসে পশু যব্হ করার বিধানের ব্যাপারে ফক্বীহগণ মতানৈক্য করেছেন। হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের বিদ্যানগণ বলেন, ‘আতীরা তথা রজব মাসে পশু যব্হ করার বিধান রহিত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তারা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা দলীল পেশ করেছেন,
لَا فَرَعَ وَلَا عَتِيْرَةَ وَالْفَرَعُ أَوَّلُ النِّتَاجِ كَانُوْا يَذْبَحُوْنَهُ لَطِوَاغِيْتِهِمْ وَالْعَتِيْرَةُ فِىْ رَجَبٍ
‘ইসলামে ফারা‘ ও ‘আতীরা নেই। ফারা‘ হল উটের সে প্রথম বাচ্চা, যা তারা তাদের দেবদেবীর নামে যব্হ করত। আর ‘আতীরা হল, রজব মাসে যে জন্তু যব্হ করত’।[৪]
শাফেঈগণ বলেন, ‘আতীরার বিধান মানসূখ হয়নি। এমনকি তাদের মতে ‘আতীরা মুস্তাহাব। এটা ইবনু সীরীনের কথা। ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শাফেঈগণের মতকে শক্তিশালী করছে আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ বর্ণিত একটি হাদীস। হাদীসটিকে হাকেম ও ইবনুল মুনযির সহীহ বলেছেন। হাদীসটি হল, নুবায়শা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন লোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে ডেকে বলল,
إِنَّا كُنَّا نَعْتِرُ عَتِيْرَةً فِى الْجَاهِلِيَّةِ فِىْ رَجَبٍ فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ اذْبَحُوْا لِلهِ فِىْ أَىِّ شَهْرٍ
‘আমরা জাহেলী যুগে রজব মাসে ‘আতীরা করতাম। এ বিষয়ে আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দিবেন? তিনি বললেন, তোমরা যে কোন মাসে পশু যব্হ কর’।[৫]
ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উল্লিখিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মূলত ‘আতীরাকে বাতিল করেননি। বরং তিনি নির্দিষ্টভাবে রজব মাসে পশু যব্হকে বাতিল করেছেন।[৬]
রজব মাসে সিয়াম
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কোন সাহাবী থেকে নির্দিষ্টভাবে রজব মাসের সিয়ামের কোন ফযীলত সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়নি। তবে অন্যান্য মাসে স্বাভাবিকভাবে যে সকল সিয়াম রাখা যায় এ মাসেও তা রাখা যাবে। যেমন, প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহষ্পতিবার, মাসে তিনটি তথা আইয়ামে বীযের সিয়াম, একদিন পরপর সিয়াম রাখা, সারারুশ শাহ্র এর সিয়াম রাখা ইত্যাদি। কিছু আলেম বলেন, سرر الشهر দ্বারা উদ্দেশ্য হল, মাসের শুরুর দিক। আবার কেউ বলেন, মাসের মাঝামাঝি। আবার কারো মতে তা মাসের শেষাংশ।
জাহেলী যুগের আমলের সাথে সাদৃশ্য থাকার কারণে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রজব মাসে সিয়াম রাখতে নিষেধ করতেন। যেমন খারাশা বিন হুর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি দেখেছি যারা রজব মাসকে কেন্দ্র করে খানাপিনা থেকে হাত গুটিয়ে রাখত, তথা সিয়াম রাখত, তাদেরকে সিয়াম না ভাঙ্গা পর্যন্ত ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রহার করতেন এবং বলতেন, তোমরা খাও। কেননা এটা এমন একটি মাস, যাকে জাহেলী যুগের লোকেরা সম্মান করল’।[৭]
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরামহীনভাবে তথা টানা তিন মাস (রজব, শা‘বান ও রামাযান) সিয়াম রাখতেন না। যেমনটা কিছু মানুষ করত। আর তিনি রজব মাসে কখনোই সিয়াম রাখেননি এবং এটাকে পসন্দও করতেন না’।[৮]
ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রজব মাস ও নির্দিষ্টভাবে তাতে সিয়াম রাখা বা রাত্রি জাগরণ করার ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল বর্ণিত হয়নি। এ ব্যাপারে আমার চেয়ে আরো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ইমাম হাফেয আবূ ইসমাইল আল-হারাবী। অনুরূপ এটা আমরা অন্যদের থেকেও বর্ণনা করেছি’।[৯]
‘ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমা’তে বলা হয়েছে, ‘রজব মাসের কোন দিনকে সিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে শরী‘আতে কোন বিধান আছে বলে আমাদের জানা নেই’।[১০]
রজব মাসে ওমরাহ
বিভিন্ন হাদীস প্রমাণ করে যে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসে ওমরাহ করেননি। যেমন মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমি ও ওরওয়া ইবনু যুবায়ের মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলাম। এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হুজরার পার্শ্বে বসা ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতবার ওমরাহ পালন করেছেন? তিনি বললেন, চার বার; এর মধ্যে একবার রজব মাসে। আমরা তাঁর কথা প্রত্যাখান করতে অপসন্দ করলাম। রাবী বলেন, এসময় আমরা হুজরার মধ্যে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মেসওয়াক করার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফলে ওরওয়া বলল, ‘হে মা! হে উম্মুল মুমিনীন! আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না, আবূ আব্দুর রহমান কী বলেছেন? তিনি জানতে চাইলেন, কী বলছেন? ওরওয়া বললেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারবার হজ্জ করেছেন, তার মধ্যে একবার করেছেন রজব মাসে। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আবূ আব্দুর রহমানের উপর রহম করুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতবার ওমরাহ করেছেন, প্রত্যেকবার তিনি (ইবনু ওমর) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সাথে উপস্থিত ছিলেন। তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসে কখনো ওমরাহ পালন করেননি’।[১১]
সহীহ মুসলিমে এসেছে, ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর কথা শুনে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি।[১২]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর কথা শুনেও ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) -এর কোন প্রতিবাদ না করা এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর কাছে বিষয়টি সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল অথবা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন অথবা তাঁর সন্দেহ ছিল’।[১৩]
অতএব রজব মাসকে ওমরার জন্য নির্দিষ্ট করা নিকৃষ্ট বিদ‘আত। অনুরূপভাবে রজব মাসে ওমরাহ করলে নির্দিষ্ট কোন ফযীলত আছে এই আক্বীদা পোষণ করাও বিদ‘আত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসে ওমরাহ করেছেন মর্মে কোন প্রমাণ নেই। শায়খ আলী ইবনু ইবরাহীম আল-‘আত্বার (মৃ.৭২৪ হি.) বলেন, ‘আমার কাছে মক্কাবাসীদের (আল্লাহ মক্কাবসীদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিন) নিকট থেকে আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, রজব মাসে ওমরাহ করাই সাধারণ নিয়ম। (ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর কোন ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। বরং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, রামাযান মাসের একটি ওমরাহ একটি হজ্জের সমান’।[১৪]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কবর জিয়ারত বা অন্য যে কোন আমলের জন্য যদি রজব মাসের কোন দিনকে নির্দিষ্ট করা হয় তবে তা বিদ‘আত হবে। কেননা তার কোন ভিত্তি নেই। এ কথাকে সমর্থন করেছেন ইমাম আবূ শামাহ। তিনি তাঁর كتاب البدع والحوادث নামক গ্রন্থে বলেন, শরী‘আত নির্ধারণ করে দেয়নি, এমন কোন সময়কে কোন শারঈ আমলের জন্য হলেও নির্দিষ্ট করা ও ফযীলতের প্রত্যাশা করা জায়েয নেই। এজন্যই আলেমগণ বেশি বেশি ওমরাহ পালনের জন্য রজব মাসকে নির্দিষ্ট করাকে অপসন্দ করেছেন। তবে কেউ যদি রজব মাসে নির্দিষ্ট কোন ফযীলতের আক্বীদা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে ওমরাহ করে অথবা এ সময় ওমরাহ করা তার জন্য সহজ হয়, তবে এসময় ওমরাহ করলে কোন ক্ষতি নেই’।[১৫]
রজব মাসে বিদ‘আত
দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করা গুরুতর অপরাধ। কেননা এটা কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের পরিপন্থী। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পূর্বেই দ্বীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পসন্দ করলাম’ (সূরা আল-মায়িদা : ৩)। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কেউ যদি এমন কিছুর উদ্ভব ঘটায়, যা আমাদের শরী‘আতে নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত’।[১৬] সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে যার ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই তবে তা প্রত্যাখ্যাত’।[১৭] কিছু মানুষ রজব মাসে বিভিন্ন রকমের বিদ‘আত করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কিছু বিদ‘আত নিম্নরূপ:
১). সালাতুর রাগায়েব
এই সালাত সোনালী যুগের পর বিশেষভাবে চতুর্থ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা উদ্ভব ঘটিয়েছিল কিছু মিথ্যুক। এই সালাত রজব মাসের প্রথম রাত্রে পড়া হয়। শাইখুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইমাম মালেক, শাফেঈ, আবূ হানীফা, ছাওরী, আওযাঈ, লাইছ (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ সকল আলেমের ঐকমত্যে সালাতুর রাগায়েব বিদ‘আত। আর হাদীস বিশারদগণের মতে এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস মিথ্যা।[১৮]
২). বর্ণিত আছে যে, রজব মাসে বিরাট একটি ঘটনা ঘটেছে। যদিও এর কোন সত্যতা নেই। ঘটনাটি হল, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রজব মাসের প্রথম রাত্রে জন্ম গ্রহণ করেছেন। আবার তিনি এই মাসের ২৭ তারিখে নবী হিসাবে প্রেরিত হয়েছেন। ২৫ তারিখের কথাও বলা হয়েছে। তবে এ সকল বর্ণনার কোনটিরই সত্যতা নেই। ক্বাসেম ইবনু মুহাম্মাদ থেকে অন্য একটি হাদীস বর্ণিত আছে। আর হাদীসের সনদও সহীহ নয়। হাদীসটি হল, রজব মাসের ২৭ তারিখে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে। আর ইবরাহীম আল-হারবী ও অন্যরা এ বর্ণনাকে মুনকার বলেছেন।[১৯]
সুতরাং রজব মাসের ২৭ তারিখে মি‘রাজের ঘটনা বর্ণনা বা কোন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা স্পষ্ট বিদ‘আত। অনুরূপভাবে নির্দিষ্টভাবে শুধু এই রাতে অতিরিক্ত ইবাদত তথা ক্বিয়ামুল লাইল করা অথবা এই দিন সিয়াম পালন করাও বিদ‘আত। অথবা দুই ঈদে আমরা যে আনন্দ করে থাকি তেমন কোন আনন্দ প্রকাশ বা ইর্ষা করা হারাম। কেননা মুসলিমদের ঈদের দিন দু’টি। সুতরাং এর চেয়ে বেশি কেউ কিছু করতে চাইলে তা বিদ‘আত হবে।
এর সাথে আমি আরো একটু যোগ করতে চাই, এই মাসে মি‘রাজের যে ঘটনা বর্ণিত আছে, তা দৃঢ়ভাবে কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। আর এই মাসে মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার কোন দলীল যদি পাওয়াও যেত, তবুও এ মাসে কোন ধরনের অনুষ্ঠান করা জায়েয হত না। কেননা তা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কোন সাহাবী বা কোন সালাফে ছালেহীনের নিকট থেকে অনুষ্ঠান করার কোন দলীল পাওয়া যায় না। আর এ মাসে কোন অনুষ্ঠান করা যদি জায়েয হত, তবে আমাদের তুলনায় সালাফগণই সে অনুষ্ঠান পালনে অগ্রগামী হতেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন।
৩). মধ্য রজবে দাঊদ (আলাইহিস সালাম) -এর মায়ের সালাত। অর্থাৎ মধ্য রজবে দাঊদ (আলাইহিস সালাম) -এর মা সালাত আদায় করতেন মনে করে তাঁর অনুসরণে সালাত আদায় করা বিদ‘আত।
৪). মৃতদের রূহের মাগফিরাতের জন্য রজব মাসে ছাদাক্বাহ করা বিদ‘আত।
৫). রজব মাসের সাথে নির্দিষ্ট করে যত দু‘আ করা হয়, তা সবই বিদ‘আত।
৬). নির্দিষ্টভাবে রজব মাসে কবর যিয়ারত করা। এটাও একটা নিকৃষ্ট বিদ‘আত। সুতরাং কবর যিয়ারত হতে হবে সারা বছরের যে কোন সময়।
পরিশেষে আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত, করেন যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় তাঁর হারামকে যথাযথ সম্মান করে ও নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে।
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৩১৯৭; সহীহ মুসলিম, হা/১৬৭৯।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/৪৩৭৬।
[৩]. বায়হাক্বী, ফাযাইলুল আওক্বাত, পৃ. ৮১।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/৫৪৭৩, ৫৪৭৪; সহীহ মুসলিম, হা/১৯৭৬।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/২৮৩০; নাসাঈ, হা/৪২২৯; ইবনু মাজাহ, হা/৩১৬৭, সনদ সহীহ।
[৬]. ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু সহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ১৩৭৯ হি.), ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৯৭।
[৭]. আল-ইরওয়াউল গালীল, হা/৯৫৭, সনদ সহীহ।
[৮]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়লি ইবাদ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭তম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৪।
[৯]. ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, তাবঈনুল ‘আজ্বি বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রজব, পৃ. ২।
[১০]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫০৮-৫০৯।
[১১]. সহীহ বুখারী, হা/১৭৭৫, ৪২৫৩; সহীহ মুসলিম, হা/১২৫৫।
[১২]. সহীহ মুসলিম, হা/১২৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৩২৪।
[১৩]. আবূ যাকারিয়া মুহীউদ্দীন ইয়াহইয়া ইবনু শারফ আন-নববী, আল-মিনহাজু শারহু সহীহ মুসলিম (বৈরূত : দারু ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯২ হি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৩৫।
[১৪]. ফাতাওয়া ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৩৬৭৬৬।
[১৫]. মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আলুশ শায়খ, ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১১৫; ফাতাওয়া ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৩৬৭৬৬।
[১৬]. সহীহ বুখারী হা/২৬৯৭; সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮।
[১৭]. সহীহ মুসলিম হা/১৭১৮।
[১৮]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৩তম খ-, পৃ. ১৩৪।
[১৯]. ফাতাওয়া ইয়াসআলুনাক, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮; শায়খ আলী হাশীশ, সিলসিলাতুল আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ, পৃ. ২২২।
-মুল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ)
-অনুবাদ : ইউনুস বিন আহসান*
Last edited: