- Joined
- Jul 24, 2023
- Threads
- 520
- Comments
- 533
- Reactions
- 5,571
- Thread Author
- #1
যতগুলো কারণে মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল বিভক্তি। আক্বীদা ও উছূলগত বিতর্কের কারণে বিভক্তি স্থায়ী রূপ নিয়েছে। ইসলামী খেলাফত ধ্বংস হয়েছে, মুসলিম জাহান খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ আজ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইহুদী-খ্রীস্টান ও বিধর্মী কর্তৃক সর্বত্র যুলুম-নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই বিভক্তির কারণ অন্বেষণ করে তা থেকে উত্তরণের পথ বের করা অপরিহার্য।
ফের্কাবাজির পরিণাম
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ ও মূলনীতি থেকে যারা বিচ্যুত হবে, তারাই ফের্কাবন্দী ও দলাদলির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাদের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর আপনার পালনকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই সব মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন, কিন্তু তারা পরস্পর ইখতিলাফকারী হিসাবেই থেকে গেল। তবে তারা নয়, যাদেরকে আপনার রব দয়া করেছেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আপনার আল্লাহর কথাই পূর্ণ হল যে, আমি জিন ও মানুষ উভয়ের দ্বারা জাহান্নামকে পূর্ণ করব’ (সূরা হূদ : ১১৮-১১৯)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের নিকট প্রকাশ্য দলীল আসার পরও বিভক্ত হয়েছে ও মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)।
অন্যত্র বলেন,
‘আর সমস্ত মানুষ একই উম্মতভুক্ত ছিল, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। আর রবের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তার মীমাংসাতো হয়েই যেত’ (সূরা ইউনুস : ১৯)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
‘যারা তাদের দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৯)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র এরশাদ করেন,
‘তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে। আর প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে খুশী। অতএব কিছুকাল তাদেরকে তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে থাকতে দিন’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৫৩-৫৪)।
উক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় যে, শারঈ বিধান থাকা সত্ত্বেও যারা মতভেদ ও বিভক্তি সৃষ্টি করবে, তাদের জন্য করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। কারণ আল্লাহ প্রদত্ত অভ্রান্ত দলীলের অনুসরণ না করলে কেউই জান্নাতের পথ তথা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথিক হতে পারবে না। বরং অসংখ্য ভ্রষ্ট পথে ঢুকে পড়বে, যেগুলো জাহান্নামের পথ। এগুলো থেকে সতর্ক করার জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা একটি সরল রেখা টানলেন এবং বললেন, এটা আল্লাহর পথ। এরপর তিনি এই রেখার ডানে ও বামে আরো কয়েকটি রেখা টানলেন এবং বললেন, এগুলোও পথ। বিভক্ত এই প্রত্যেক পথেই শয়তান রয়েছে। সে তার পথের দিকে ডাকছে। অতঃপর তিনি তাঁর কথার প্রমাণ স্বরূপ কুরআনের আয়াত পাঠ করলেন, ‘নিশ্চয় এটাই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য পথের অনুসরণ করবে না। অন্যথা তা তোমাদেরকে ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬৩)।[১]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি একটি সরল রেখা টানলেন এবং তার ডান দিকে দু’টি রেখা টানলেন এবং বাম দিকেও দু’টি রেখা টানালেন। অতঃপর তিনি মধ্যবর্তী রেখার উপর তাঁর হাত রেখে বলেন, এটা আল্লাহর রাস্তা। অতঃপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘আর এ সরল পথটিই আমার পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য পথের অনুসরণ করবে না, অন্যথা তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৩)।[২]
বিভক্তির কারণ সমূহ
(১) গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সৃষ্টির সাথে সাথে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে অভ্রান্ত জীবন বিধান নাযিল করেছেন। সেই সাথে উক্ত বিধানের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জাতির মাঝে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত উক্ত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলে বিভক্তি ও মতভেদ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দম্ভ ও অহংকারের দাপটে সেই বিধান ও চূড়ান্ত দলীল প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ হল, গোঁড়ামি, অহংকার ও জিদ। সহীহ দলীল পাওয়ার পরও স্বীকার না করা এবং নিজের মতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য অপব্যাখ্যা করা হল এর প্রধান কারণ। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে উক্ত বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
যেমন-
‘আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর শুধু পারস্পরিক বিদ্বেষবশত তারা নিজেদের মধ্যে ফের্কাবাজি সৃষ্টি করেছে’ (সূরা আশ-শূরা : ১৪)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে ইলম আসার পর বিদ্বেষবশত তারা পরস্পর ইখতিলাফ করেছে’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘আর আমরা তাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ দান করেছিলাম। তাদের কাছে ইলম আসার পর তারা শুধু বিদ্বেষবশত মতভেদ করেছিল। তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করত, অবশ্যই আপনার পালনকর্তা ক্বিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সে বিষয়ে ফায়ছালা করে দিবেন’ (সূরা আল-জাছিয়াহ : ১৭)।
অন্য আয়াতে এসেছে,
‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের নিকট প্রকাশ্য দলীল আসার পরও বিভক্ত হয়েছে ও মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)।
অন্য আয়াতে বলেন,
‘মানবজাতি একই উম্মতভুক্ত ছিল। অতঃপর সুসংবাদ বাহক ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে আল্লাহ নবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং তিনি তাঁদের সাথে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করলেন- যেন তাদের মতভেদের বিষয়গুলো মীমাংসা করে দেন। অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ সমাগত হওয়ার পরও তারা পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষবশত সে কিতাবকে নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করে বসল। অতঃপর আল্লাহ তাঁর ইচ্ছায় ঈমানদারদেরকে সে বিষয়ে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করলেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের দিকে পরিচালিত করেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৩)।
উক্ত আলোচনা প্রমাণ করে যে, ফের্কাবাজির মূল কারণ গোঁড়ামি, বিদ্বেষ, অহঙ্কার ও স্বেচ্ছারিতা। শরী‘আতের স্পষ্ট দলীল থাকার পরও যারা বিদ্বেষবশত উপেক্ষা করে এবং অপব্যাখ্যা করে তারাই ফের্কাবাজির মূল হোতা। সাহাবায়ে কেরামের মত যদি আমরাও উদারতা প্রদর্শন করে দলীলের প্রতি আত্মসমর্পণ করতাম, তাহলে দলাদলির অবসান হত।
(২) বিভ্রান্তিকর আক্বীদা
পারস্পরিক গোঁড়ামি, অহংকার ও বিদ্বেষ মজ্জাগত হওয়ার কারণে বিভিন্ন ভ্রান্ত আক্বীদার জন্ম নিয়েছে। আর সেই আক্বীদার আলোকে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ফের্কা। যার ফলে মুসলিম সমাজ ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। যেমন খারেজী, শী‘আ, মুরজিয়া, ক্বাদারিয়া, জাহমিয়াহ প্রভৃতি ভ্রান্ত ফের্কা নিজ নিজ আক্বীদা নিয়ে বিভক্ত হয়েছে। এক ফের্কার আক্বীদার সাথে অন্য ফের্কার কোন মিল নেই।
যেমন খারেজী আক্বীদা হল,
(ক) হৃদয়ে বিশ্বাস মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন তিনটিই ঈমানের মূল ও অবিচ্ছিন্ন অংশ। এজন্য তারা কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তিকে ঈমানহীন কাফের মনে করে।[৩]
(খ) তাদের মতে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি নেই।[৪]
(গ) কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের হওয়ায় হত্যাযোগ্য অপরাধী এবং তওবা না করে মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।[৫]
(ঘ) খারেজীদের মতে- ওছমান ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সহ তাঁদের হাতে বায়‘আতকারী সকল সাহাবী কাফের। ছিফফীনের যুদ্ধে আলী ও মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) উভয়ের পক্ষে যারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন, যারা তাদের সন্ধিতে সন্তুষ্ট ছিলেন বা আজও আছেন তারা সকলেই কাফের, তাদের রক্তও হালাল।[৬]
(ঙ) খারেজী চরমপন্থীরা গোনাহগার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, সশস্ত্র সংগ্রাম করা ওয়াজিব মনে করে এবং শাসকসহ তার সমর্থক প্রজা সাধারণের রক্ত হালাল মনে করে।[৭]
(চ) চরমপন্থীরা নিজস্ব জ্ঞান দ্বারা কুরআন-হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা করে। তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম, সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যার প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে না। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ বিদ্বান উক্ত মত ব্যক্ত করেছেন।[৮]
অনুরূপ শী‘আ আক্বীদা হল, তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ইমাম বা নেতা নিযুক্তির ব্যাপারে বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করে। অতি ভক্তির কারণে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে তারা ভ্রান্ত আক্বীদার পোষণ করে। তাদের আক্বীদা মতে ইমাম নির্বাচনের অধিকার শুধু আল্লাহ প্রেরিত নবীর। তিনি যাকে অছী নিযুক্ত করে যাবেন তিনিই ইমাম বা খলীফা হবেন। প্রত্যেকেই এভাবে অছী নির্বাচন করে যাবেন। তাদের উদ্ভট ধারণা হল, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অছী। আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর পরিবার থেকেই খলীফা নির্বাচিত হবে। তাই শী‘আ-রা আবুবকর, ওমর এবং ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে খলীফা বলে স্বীকার করে না; বরং আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বাদ দিয়ে যে সমস্ত সাহাবী তাঁদের হাতে বায়‘আত করেছেন তারা সকলেই কাফের। এ ধরনের অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা তাদের মধ্যে রয়েছে।[৯] তবে শী‘আ-রা বহু ফের্কায় বিভক্ত। তাদের আক্বীদাও ভিন্ন ভিন্ন।
মুরজিয়াদের আক্বীদাহ হল,
(ক) তারা বলে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়।[১০]
(খ) ঈমান হল মৌখিক স্বীকৃতি এবং অন্তরের বিশ্বাসের নাম।[১১]
(গ) পাপ কাজ ঈমানের কোন ক্ষতি করে না।[১২]
(ঘ) আল্লাহ তা‘আলাকে তার কোন সৃষ্টিজীব দেখতে পাবে না।[১৩]
(ঙ) কাবীরাগুনাহ করলেও সে পূর্ণ মুমিন। আর এ কারণে তার শাস্তি হবে না।[১৪]
ক্বাদারিয়াদের আক্বীদা হল,
(ক) তারা তাক্বদীরকে অস্বীকার করে।
(খ) আল্লাহর ক্ষমতা ছাড়াই যেকোন জিনিষ সংঘঠিত হয়। আল্লাহ্র পূর্ব ক্ষমতা এবং পূর্ব জ্ঞান ছাড়াই বান্দা নিজেই কোন কিছু সৃষ্টি করে।[১৫]
(গ) আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কর্ম পূর্ব থেকে নির্ধারণ করেননি। তিনি তা অবগতও নন এবং সেটা লাওহে মাহফূযেও লিপিবদ্ধ নেই। আর কোন বিষয় আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত নয় বরং নতুনভাবে আরম্ভ।[১৬]
(ঘ) কোন জিনিষ সংঘঠিত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার সে বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। বরং প্রত্যেক বিষয়ই নতুনভাবে শুরু হয়।[১৭]
জাহমিয়াদের আক্বীদা হল,
(ক) তারা আল্লাহর নাম সমূহ এবং গুণাবলীকে অস্বীকার করে।
(খ) তারা বলে, কুরআন সৃষ্ট।
(গ) তারা আল্লাহর সাক্ষাৎ ও দর্শনকে অস্বীকার করে।
(ঘ) তারা বিশ্বাস করে যে, জান্নাত-জাহান্নাম অস্তিত্বহীন।
(ঙ) তারা শুধু স্বীকৃতি দেয়াকে ঈমান বলা হয়।
(চ) তারা আল্লাহর ভালবাসা এবং কথা বলা দু’টিকেই অস্বীকার করে। যেমন তারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)-কে খলীল হিসাবে গ্রহণ করেননি এবং মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে কথা বলেননি।[১৮]
(ছ) তারা বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরও অবস্থান করেন না, আবার আসমানেও অবস্থান করেন না।[১৯]
(জ) আল্লাহর জ্ঞান হল নতুন বা সৃষ্ট।[২০]
জাবরিইয়াদের আক্বীদা হল, এরা ক্বাদারিইয়াহ মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের মতে, মানুষ ইচ্ছাশক্তিহীন বাধ্যগত জীব। সে তার কাজ-কর্মে জড়পদার্থের ন্যায়। সে বায়ূপ্রবাহে ভাসমান পালকের ন্যায়। গাছ-গাছালির নড়াচড়া, পানির স্রোতধারা এবং নক্ষত্ররাজির আবর্তনকে যেমনিভাবে রূপক অর্থে সেগুলোর দিকে সম্বন্ধিত করা হয়, ঠিক একইভাবে বান্দার কাজ-কর্মকেও রূপক অর্থে তার দিকে সম্বন্ধিত করা হয়; প্রকৃত অর্থে নয়। যেমন রূপক অর্থে বলা হয়, সূর্যোদয় হয়েছে, বাতাস প্রবাহিত হয়েছে, বৃষ্টি হয়েছে; বান্দার ক্ষেত্রেও ঠিক ঐ একই অর্থে বলা হয়, সে সালাত আদায় করেছে, সিয়াম পালন করেছে, হত্যা করেছে, চুরি করেছে ইত্যাদি।[২১]
সুধী পাঠক! এ ধরনের আরো অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা সৃষ্টি হয়েছে। এক ফের্কার আক্বীদার সাথে অন্য ফের্কার আক্বীদার কোন সম্পর্ক নেই। বরং পরস্পর বিরোধী। এ সব বিষয়ে আহলেহাদীস বা সালাফী আক্বীদাকে গ্রহণ করতে হবে। অন্য সব ভ্রান্ত আক্বীদাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। উপমহাদেশে ফের্কাবন্দীর কুপ্রভাবটা অনেক বেশী। এ অঞ্চলে অসংখ্য পীর ও মাযার রয়েছে। এছাড়া দেওবন্দী ও ব্রেলভী নামে পৃথক মতবাদ চালু আছে। এগুলোর আবার অসংখ্য শাখা রয়েছে। এভাবে মুসলিম উম্মাহ অসংখ্য ফের্কায় বিভক্ত হয়েছে।
(৩) জাল ও যঈফ হাদীস
মুসলিম বিভক্তির আরেকটি অন্যতম কারণ হল, যঈফ ও জাল হাদীসের কুপ্রভাব। প্রত্যেকটি ফের্কা নিজের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য জাল হাদীস রচনা করেছে এবং দলীল হিসাবে উম্মতের সামনে পেশ করেছে। তারা জাল ও যঈফ হাদীস ভিত্তিক আক্বীদা ও আমল বিস্তার করে বিভক্তির দরজা খুলে দিয়েছে। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বহু পূর্বেই প্রভাবিত ফক্বীহদের সম্পর্কে বলে গেছেন,
‘মাশাআল্লাহ দু’একজন ব্যতীত মাযহাবী গোঁড়ামি প্রদর্শনকারীদের কেউই কুরআন-সুন্নাহ বুঝেন না; বরং তারা আঁকড়ে ধরেন যঈফ হাদীসের ভাণ্ডার, বিভ্রান্তিকর রায়-এর বোঝা এবং কতক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও কথিত আলেমদের কল্প-কাহিনীর সমাহার’।[২২]
যেমন আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সহীহ আক্বীদা হল, তিনি একক সত্তা, তিনি মহান আরশে সমুন্নত, সেখান থেকেই সবকিছু পরিচালনা করছেন। তাঁর ক্ষমতা ও দৃষ্টি সর্বব্যাপী। তাঁর আকার আছে। তাঁর হাত আছে, পা আছে, চোখ আছে। তবে তিনি কেমন তা কেউ জানে না (সূরা আশ-শূরা : ১১)।[২৩]
তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১৪২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩২৪১; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬; সুনানুদ দারোমী, হা/২০২; মিশকাত, হা/১৬৬, সনদ হাসান।
[২]. সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/১১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৩১২, সনদ সহীহ।
[৩]. ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব ইবনু মানদাহ (৩১০-৩৯৫ হিঃ), কিতাবুল ঈমান, তাহক্বীক্ব : আলী বিন মুহাম্মাদ আল-ফক্বীহী (মদীনা : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮১ খৃ./১৪০১ হি.), ১ম খ-, পৃ. ৩৩১; ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫০।
[৪]. আল্লামা নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান ভূপালী, কাৎফুছ ছামার (রিয়ায : ওয়াযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়া, ১৪২১ হি.), পৃ. ৬৭-এর টীকা দ্র.।
[৫]. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৩; আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৪।
[৬]. আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক্ব, পৃ. ৬১; আল-মিলাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৭; ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯০।
[৭]. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৪-৭৬ ও ২৮৫-২৯১।
[৮]. দ্র. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৮-২৭৯ يؤلون النصوص تأويلا يوافق أهوائهم وقد اغلطوا حين ظنوا أن تأويلهم هو ماتهدف إليه النصوص।
[৯]. আল-ফাছল ফিল মিলাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৩৭।
[১০]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৩৬।
[১১]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৮৬।
[১২]. আবূ সানাদ ফাতহুল্লাহ, আলাফ ফাতাওয়া লি-শাইখিল আলবানী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩০।
[১৩]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৩৫।
[১৪]. মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ও রাসাইল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩০৪।
[১৫]. ছালেহ ইবনু ফাওযান ইবনু ফাওযান, ই‘আনাতুল মুসতাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩১৯।
[১৬]. কামিলাতুল কাওয়ারী, শারহাতু নূনিয়্যাতুল ক্বারনী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৫।
[১৭]. ই‘আনাতুল মুসতাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৮।
[১৮]. আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান জিবরীন, শারহুল আক্বিদাতুত তাহাবিয়াহ, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৭৬।
[১৯]. খালিদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মুছলিহ, শারহুল ফাতাওয়া আল-হামাবিয়্যাহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৫।
[২০]. আলী ইবনু আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু হাযম, আল-ফিছাল ফিল মিলাল (কায়রো : মাকতাবাতুল খানিজী), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৫৫।
[২১]. ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন, আর-রদ্দু আলাল মুজবিরাতিল-ক্বাদারিয়াহ, পৃ. ৩৪।
[২২]. ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২২তম খণ্ড, পৃ. ২৫৪-২৫৫।
[২৩]. সূরা ছোয়াদ : ৭৫; সূরা আল-মায়েদাহ : ৬৪; সূরা আলে ইমরান : ২৬, ৭৩; সূরা আল-ফাত্হ : ১০; সূরা আর-রহমান : ২৭; সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৫, ২৭২; সূরা ত্বা-হা : ৫; সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৪; সূরা আন-নিসা : ১৬৪; সহীহ বুখারী, হা/১১৪৫; ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৩; মিশকাতুল মাছাবীহ, হা/১২২৩, পৃ. ১০৯; সহীহ বুখারী, হা/৪৮৫০, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭১৯; সহীহ মুসলিম, হা/১২৩০, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮২; মিশকাত, হা/৫৬৯৫, পৃ. ৫০৫, ‘জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি’ অনুচ্ছেদ; সহীহ বুখারী, হা/৪৯১৯, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৩১; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৭২-১৭৭৫, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৮; মিশকাত, হা/৫৫৪২, পৃ. ৪৮৪, ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ; সহীহ মুসলিম, হা/১১৯৯, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৩-২০৪; মিশকাত, হা/৩৩০৩, পৃ. ২৮৫।
ফের্কাবাজির পরিণাম
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ ও মূলনীতি থেকে যারা বিচ্যুত হবে, তারাই ফের্কাবন্দী ও দলাদলির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাদের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَوۡ شَآءَ رَبُّکَ لَجَعَلَ النَّاسَ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً وَّ لَا یَزَالُوۡنَ مُخۡتَلِفِیۡنَ اِلَّا مَنۡ رَّحِمَ رَبُّکَ وَ لِذٰلِکَ خَلَقَہُمۡ وَ تَمَّتۡ کَلِمَۃُ رَبِّکَ لَاَمۡلَـَٔنَّ جَہَنَّمَ مِنَ الۡجِنَّۃِ وَ النَّاسِ اَجۡمَعِیۡنَ
‘আর আপনার পালনকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই সব মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন, কিন্তু তারা পরস্পর ইখতিলাফকারী হিসাবেই থেকে গেল। তবে তারা নয়, যাদেরকে আপনার রব দয়া করেছেন এবং তিনি তাদেরকে এজন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আপনার আল্লাহর কথাই পূর্ণ হল যে, আমি জিন ও মানুষ উভয়ের দ্বারা জাহান্নামকে পূর্ণ করব’ (সূরা হূদ : ১১৮-১১৯)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡبَیِّنٰتُؕ وَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের নিকট প্রকাশ্য দলীল আসার পরও বিভক্ত হয়েছে ও মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)।
অন্যত্র বলেন,
وَ مَا کَانَ النَّاسُ اِلَّاۤ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً فَاخۡتَلَفُوۡا ؕ وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃٌ سَبَقَتۡ مِنۡ رَّبِّکَ لَقُضِیَ بَیۡنَہُمۡ فِیۡمَا فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ
‘আর সমস্ত মানুষ একই উম্মতভুক্ত ছিল, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। আর রবের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তার মীমাংসাতো হয়েই যেত’ (সূরা ইউনুস : ১৯)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ
‘যারা তাদের দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৯)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র এরশাদ করেন,
فَتَقَطَّعُوْا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُوْنَ فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّى حِيْنٍ
‘তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে। আর প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে খুশী। অতএব কিছুকাল তাদেরকে তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে থাকতে দিন’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৫৩-৫৪)।
উক্ত আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় যে, শারঈ বিধান থাকা সত্ত্বেও যারা মতভেদ ও বিভক্তি সৃষ্টি করবে, তাদের জন্য করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। কারণ আল্লাহ প্রদত্ত অভ্রান্ত দলীলের অনুসরণ না করলে কেউই জান্নাতের পথ তথা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের পথিক হতে পারবে না। বরং অসংখ্য ভ্রষ্ট পথে ঢুকে পড়বে, যেগুলো জাহান্নামের পথ। এগুলো থেকে সতর্ক করার জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাই বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ خَطَّ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيْلُ اللهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوْطاً عَنْ يَمِيْنِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ هَذِهِ سُبُلٌ قَالَ يَزِيْدُ مُتَفَرِّقَةٌ عَلَى كُلِّ سَبِيْلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُوْ إِلَيْهِ ثُمَّ قَرَأَ وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِىْ مُسْتَقِيْماً فَاتَّبِعُوْهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা একটি সরল রেখা টানলেন এবং বললেন, এটা আল্লাহর পথ। এরপর তিনি এই রেখার ডানে ও বামে আরো কয়েকটি রেখা টানলেন এবং বললেন, এগুলোও পথ। বিভক্ত এই প্রত্যেক পথেই শয়তান রয়েছে। সে তার পথের দিকে ডাকছে। অতঃপর তিনি তাঁর কথার প্রমাণ স্বরূপ কুরআনের আয়াত পাঠ করলেন, ‘নিশ্চয় এটাই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য পথের অনুসরণ করবে না। অন্যথা তা তোমাদেরকে ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬৩)।[১]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَخَطَّ خَطًّا وَخَطَّ خَطَّيْنِ عَنْ يَمِيْنِهِ وَخَطَّ خَطَّيْنِ عَنْ يَسَارِهِ ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ فِى الْخَطِّ الْأَوْسَطِ فَقَالَ هَذَا سَبِيْلُ اللهِ ثُمَّ تَلَا هَذِهِ الْآيَةَ وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِىْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি একটি সরল রেখা টানলেন এবং তার ডান দিকে দু’টি রেখা টানলেন এবং বাম দিকেও দু’টি রেখা টানালেন। অতঃপর তিনি মধ্যবর্তী রেখার উপর তাঁর হাত রেখে বলেন, এটা আল্লাহর রাস্তা। অতঃপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘আর এ সরল পথটিই আমার পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ করবে এবং অন্যান্য পথের অনুসরণ করবে না, অন্যথা তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৫৩)।[২]
বিভক্তির কারণ সমূহ
(১) গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে সৃষ্টির সাথে সাথে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে অভ্রান্ত জীবন বিধান নাযিল করেছেন। সেই সাথে উক্ত বিধানের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জাতির মাঝে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত উক্ত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলে বিভক্তি ও মতভেদ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দম্ভ ও অহংকারের দাপটে সেই বিধান ও চূড়ান্ত দলীল প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ হল, গোঁড়ামি, অহংকার ও জিদ। সহীহ দলীল পাওয়ার পরও স্বীকার না করা এবং নিজের মতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য অপব্যাখ্যা করা হল এর প্রধান কারণ। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে উক্ত বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
যেমন-
وَ مَا تَفَرَّقُوۡۤا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ
‘আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর শুধু পারস্পরিক বিদ্বেষবশত তারা নিজেদের মধ্যে ফের্কাবাজি সৃষ্টি করেছে’ (সূরা আশ-শূরা : ১৪)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ مَا اخۡتَلَفَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ
‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে ইলম আসার পর বিদ্বেষবশত তারা পরস্পর ইখতিলাফ করেছে’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَ اٰتَیۡنٰہُمۡ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡاَمۡرِ ۚ فَمَا اخۡتَلَفُوۡۤا اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡعِلۡمُ ۙ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ ؕ اِنَّ رَبَّکَ یَقۡضِیۡ بَیۡنَہُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ فِیۡمَا کَانُوۡا فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ
‘আর আমরা তাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ দান করেছিলাম। তাদের কাছে ইলম আসার পর তারা শুধু বিদ্বেষবশত মতভেদ করেছিল। তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করত, অবশ্যই আপনার পালনকর্তা ক্বিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সে বিষয়ে ফায়ছালা করে দিবেন’ (সূরা আল-জাছিয়াহ : ১৭)।
অন্য আয়াতে এসেছে,
وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡبَیِّنٰتُؕ وَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যাদের নিকট প্রকাশ্য দলীল আসার পরও বিভক্ত হয়েছে ও মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)।
অন্য আয়াতে বলেন,
کَانَ النَّاسُ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً۟ فَبَعَثَ اللّٰہُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ وَ اَنۡزَلَ مَعَہُمُ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ فِیۡمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡہِ وَ مَا اخۡتَلَفَ فِیۡہِ اِلَّا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡہُ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡہُمُ الۡبَیِّنٰتُ بَغۡیًۢا بَیۡنَہُمۡ ۚ فَہَدَی اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡہِ مِنَ الۡحَقِّ بِاِذۡنِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
‘মানবজাতি একই উম্মতভুক্ত ছিল। অতঃপর সুসংবাদ বাহক ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে আল্লাহ নবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং তিনি তাঁদের সাথে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করলেন- যেন তাদের মতভেদের বিষয়গুলো মীমাংসা করে দেন। অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ সমাগত হওয়ার পরও তারা পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষবশত সে কিতাবকে নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করে বসল। অতঃপর আল্লাহ তাঁর ইচ্ছায় ঈমানদারদেরকে সে বিষয়ে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করলেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ছিরাতে মুস্তাক্বীমের দিকে পরিচালিত করেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৩)।
উক্ত আলোচনা প্রমাণ করে যে, ফের্কাবাজির মূল কারণ গোঁড়ামি, বিদ্বেষ, অহঙ্কার ও স্বেচ্ছারিতা। শরী‘আতের স্পষ্ট দলীল থাকার পরও যারা বিদ্বেষবশত উপেক্ষা করে এবং অপব্যাখ্যা করে তারাই ফের্কাবাজির মূল হোতা। সাহাবায়ে কেরামের মত যদি আমরাও উদারতা প্রদর্শন করে দলীলের প্রতি আত্মসমর্পণ করতাম, তাহলে দলাদলির অবসান হত।
(২) বিভ্রান্তিকর আক্বীদা
পারস্পরিক গোঁড়ামি, অহংকার ও বিদ্বেষ মজ্জাগত হওয়ার কারণে বিভিন্ন ভ্রান্ত আক্বীদার জন্ম নিয়েছে। আর সেই আক্বীদার আলোকে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ফের্কা। যার ফলে মুসলিম সমাজ ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। যেমন খারেজী, শী‘আ, মুরজিয়া, ক্বাদারিয়া, জাহমিয়াহ প্রভৃতি ভ্রান্ত ফের্কা নিজ নিজ আক্বীদা নিয়ে বিভক্ত হয়েছে। এক ফের্কার আক্বীদার সাথে অন্য ফের্কার কোন মিল নেই।
যেমন খারেজী আক্বীদা হল,
(ক) হৃদয়ে বিশ্বাস মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন তিনটিই ঈমানের মূল ও অবিচ্ছিন্ন অংশ। এজন্য তারা কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তিকে ঈমানহীন কাফের মনে করে।[৩]
(খ) তাদের মতে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি নেই।[৪]
(গ) কাবীরা গোনাহগার ব্যক্তি কাফের হওয়ায় হত্যাযোগ্য অপরাধী এবং তওবা না করে মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।[৫]
(ঘ) খারেজীদের মতে- ওছমান ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সহ তাঁদের হাতে বায়‘আতকারী সকল সাহাবী কাফের। ছিফফীনের যুদ্ধে আলী ও মু‘আবিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) উভয়ের পক্ষে যারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন, যারা তাদের সন্ধিতে সন্তুষ্ট ছিলেন বা আজও আছেন তারা সকলেই কাফের, তাদের রক্তও হালাল।[৬]
(ঙ) খারেজী চরমপন্থীরা গোনাহগার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, সশস্ত্র সংগ্রাম করা ওয়াজিব মনে করে এবং শাসকসহ তার সমর্থক প্রজা সাধারণের রক্ত হালাল মনে করে।[৭]
(চ) চরমপন্থীরা নিজস্ব জ্ঞান দ্বারা কুরআন-হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা করে। তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম, সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যার প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করে না। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ বিদ্বান উক্ত মত ব্যক্ত করেছেন।[৮]
অনুরূপ শী‘আ আক্বীদা হল, তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ইমাম বা নেতা নিযুক্তির ব্যাপারে বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করে। অতি ভক্তির কারণে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে তারা ভ্রান্ত আক্বীদার পোষণ করে। তাদের আক্বীদা মতে ইমাম নির্বাচনের অধিকার শুধু আল্লাহ প্রেরিত নবীর। তিনি যাকে অছী নিযুক্ত করে যাবেন তিনিই ইমাম বা খলীফা হবেন। প্রত্যেকেই এভাবে অছী নির্বাচন করে যাবেন। তাদের উদ্ভট ধারণা হল, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অছী। আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর পরিবার থেকেই খলীফা নির্বাচিত হবে। তাই শী‘আ-রা আবুবকর, ওমর এবং ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে খলীফা বলে স্বীকার করে না; বরং আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বাদ দিয়ে যে সমস্ত সাহাবী তাঁদের হাতে বায়‘আত করেছেন তারা সকলেই কাফের। এ ধরনের অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা তাদের মধ্যে রয়েছে।[৯] তবে শী‘আ-রা বহু ফের্কায় বিভক্ত। তাদের আক্বীদাও ভিন্ন ভিন্ন।
মুরজিয়াদের আক্বীদাহ হল,
(ক) তারা বলে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত নয়।[১০]
(খ) ঈমান হল মৌখিক স্বীকৃতি এবং অন্তরের বিশ্বাসের নাম।[১১]
(গ) পাপ কাজ ঈমানের কোন ক্ষতি করে না।[১২]
(ঘ) আল্লাহ তা‘আলাকে তার কোন সৃষ্টিজীব দেখতে পাবে না।[১৩]
(ঙ) কাবীরাগুনাহ করলেও সে পূর্ণ মুমিন। আর এ কারণে তার শাস্তি হবে না।[১৪]
ক্বাদারিয়াদের আক্বীদা হল,
(ক) তারা তাক্বদীরকে অস্বীকার করে।
(খ) আল্লাহর ক্ষমতা ছাড়াই যেকোন জিনিষ সংঘঠিত হয়। আল্লাহ্র পূর্ব ক্ষমতা এবং পূর্ব জ্ঞান ছাড়াই বান্দা নিজেই কোন কিছু সৃষ্টি করে।[১৫]
(গ) আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কর্ম পূর্ব থেকে নির্ধারণ করেননি। তিনি তা অবগতও নন এবং সেটা লাওহে মাহফূযেও লিপিবদ্ধ নেই। আর কোন বিষয় আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত নয় বরং নতুনভাবে আরম্ভ।[১৬]
(ঘ) কোন জিনিষ সংঘঠিত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার সে বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। বরং প্রত্যেক বিষয়ই নতুনভাবে শুরু হয়।[১৭]
জাহমিয়াদের আক্বীদা হল,
(ক) তারা আল্লাহর নাম সমূহ এবং গুণাবলীকে অস্বীকার করে।
(খ) তারা বলে, কুরআন সৃষ্ট।
(গ) তারা আল্লাহর সাক্ষাৎ ও দর্শনকে অস্বীকার করে।
(ঘ) তারা বিশ্বাস করে যে, জান্নাত-জাহান্নাম অস্তিত্বহীন।
(ঙ) তারা শুধু স্বীকৃতি দেয়াকে ঈমান বলা হয়।
(চ) তারা আল্লাহর ভালবাসা এবং কথা বলা দু’টিকেই অস্বীকার করে। যেমন তারা বলে, আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ)-কে খলীল হিসাবে গ্রহণ করেননি এবং মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে কথা বলেননি।[১৮]
(ছ) তারা বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরও অবস্থান করেন না, আবার আসমানেও অবস্থান করেন না।[১৯]
(জ) আল্লাহর জ্ঞান হল নতুন বা সৃষ্ট।[২০]
জাবরিইয়াদের আক্বীদা হল, এরা ক্বাদারিইয়াহ মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের মতে, মানুষ ইচ্ছাশক্তিহীন বাধ্যগত জীব। সে তার কাজ-কর্মে জড়পদার্থের ন্যায়। সে বায়ূপ্রবাহে ভাসমান পালকের ন্যায়। গাছ-গাছালির নড়াচড়া, পানির স্রোতধারা এবং নক্ষত্ররাজির আবর্তনকে যেমনিভাবে রূপক অর্থে সেগুলোর দিকে সম্বন্ধিত করা হয়, ঠিক একইভাবে বান্দার কাজ-কর্মকেও রূপক অর্থে তার দিকে সম্বন্ধিত করা হয়; প্রকৃত অর্থে নয়। যেমন রূপক অর্থে বলা হয়, সূর্যোদয় হয়েছে, বাতাস প্রবাহিত হয়েছে, বৃষ্টি হয়েছে; বান্দার ক্ষেত্রেও ঠিক ঐ একই অর্থে বলা হয়, সে সালাত আদায় করেছে, সিয়াম পালন করেছে, হত্যা করেছে, চুরি করেছে ইত্যাদি।[২১]
সুধী পাঠক! এ ধরনের আরো অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা সৃষ্টি হয়েছে। এক ফের্কার আক্বীদার সাথে অন্য ফের্কার আক্বীদার কোন সম্পর্ক নেই। বরং পরস্পর বিরোধী। এ সব বিষয়ে আহলেহাদীস বা সালাফী আক্বীদাকে গ্রহণ করতে হবে। অন্য সব ভ্রান্ত আক্বীদাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। উপমহাদেশে ফের্কাবন্দীর কুপ্রভাবটা অনেক বেশী। এ অঞ্চলে অসংখ্য পীর ও মাযার রয়েছে। এছাড়া দেওবন্দী ও ব্রেলভী নামে পৃথক মতবাদ চালু আছে। এগুলোর আবার অসংখ্য শাখা রয়েছে। এভাবে মুসলিম উম্মাহ অসংখ্য ফের্কায় বিভক্ত হয়েছে।
(৩) জাল ও যঈফ হাদীস
মুসলিম বিভক্তির আরেকটি অন্যতম কারণ হল, যঈফ ও জাল হাদীসের কুপ্রভাব। প্রত্যেকটি ফের্কা নিজের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য জাল হাদীস রচনা করেছে এবং দলীল হিসাবে উম্মতের সামনে পেশ করেছে। তারা জাল ও যঈফ হাদীস ভিত্তিক আক্বীদা ও আমল বিস্তার করে বিভক্তির দরজা খুলে দিয়েছে। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি.) বহু পূর্বেই প্রভাবিত ফক্বীহদের সম্পর্কে বলে গেছেন,
وَجَمْهُوْرُ الْمُتَعَصِّبِيْنَ لاَيَعْرِفُوْنَ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ إِلاَّمَاشَاءَ اللهُ بَلْ يَتَمَسَّكُوْنَ بِأَحَادِيْثَ ضَعِيْفَةٍ وَآرَاءٍ فَاسِدَةٍ أَوْ حِكَايَاتٍ عَنْ بَعْضِ الْعُلَمَاءِ والشُّيُوْخِ
‘মাশাআল্লাহ দু’একজন ব্যতীত মাযহাবী গোঁড়ামি প্রদর্শনকারীদের কেউই কুরআন-সুন্নাহ বুঝেন না; বরং তারা আঁকড়ে ধরেন যঈফ হাদীসের ভাণ্ডার, বিভ্রান্তিকর রায়-এর বোঝা এবং কতক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও কথিত আলেমদের কল্প-কাহিনীর সমাহার’।[২২]
যেমন আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সহীহ আক্বীদা হল, তিনি একক সত্তা, তিনি মহান আরশে সমুন্নত, সেখান থেকেই সবকিছু পরিচালনা করছেন। তাঁর ক্ষমতা ও দৃষ্টি সর্বব্যাপী। তাঁর আকার আছে। তাঁর হাত আছে, পা আছে, চোখ আছে। তবে তিনি কেমন তা কেউ জানে না (সূরা আশ-শূরা : ১১)।[২৩]
তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৪১৪২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩২৪১; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬; সুনানুদ দারোমী, হা/২০২; মিশকাত, হা/১৬৬, সনদ হাসান।
[২]. সুনানু ইবনে মাজাহ, হা/১১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৩১২, সনদ সহীহ।
[৩]. ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব ইবনু মানদাহ (৩১০-৩৯৫ হিঃ), কিতাবুল ঈমান, তাহক্বীক্ব : আলী বিন মুহাম্মাদ আল-ফক্বীহী (মদীনা : মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮১ খৃ./১৪০১ হি.), ১ম খ-, পৃ. ৩৩১; ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী, আল-ফিছাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫০।
[৪]. আল্লামা নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান ভূপালী, কাৎফুছ ছামার (রিয়ায : ওয়াযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়া, ১৪২১ হি.), পৃ. ৬৭-এর টীকা দ্র.।
[৫]. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৩; আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৪।
[৬]. আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক্ব, পৃ. ৬১; আল-মিলাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৭; ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯০।
[৭]. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৪-৭৬ ও ২৮৫-২৯১।
[৮]. দ্র. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৮-২৭৯ يؤلون النصوص تأويلا يوافق أهوائهم وقد اغلطوا حين ظنوا أن تأويلهم هو ماتهدف إليه النصوص।
[৯]. আল-ফাছল ফিল মিলাল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৩৭।
[১০]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭৩৬।
[১১]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৮৬।
[১২]. আবূ সানাদ ফাতহুল্লাহ, আলাফ ফাতাওয়া লি-শাইখিল আলবানী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩০।
[১৩]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়াহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৩৫।
[১৪]. মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ও রাসাইল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩০৪।
[১৫]. ছালেহ ইবনু ফাওযান ইবনু ফাওযান, ই‘আনাতুল মুসতাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩১৯।
[১৬]. কামিলাতুল কাওয়ারী, শারহাতু নূনিয়্যাতুল ক্বারনী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৪৫।
[১৭]. ই‘আনাতুল মুসতাফীদ বিশারহি কিতাবিত তাওহীদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৮।
[১৮]. আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান জিবরীন, শারহুল আক্বিদাতুত তাহাবিয়াহ, ৪র্থ খ-, পৃ. ২৭৬।
[১৯]. খালিদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মুছলিহ, শারহুল ফাতাওয়া আল-হামাবিয়্যাহ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৫।
[২০]. আলী ইবনু আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু হাযম, আল-ফিছাল ফিল মিলাল (কায়রো : মাকতাবাতুল খানিজী), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৫৫।
[২১]. ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন, আর-রদ্দু আলাল মুজবিরাতিল-ক্বাদারিয়াহ, পৃ. ৩৪।
[২২]. ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউল ফাতাওয়া ২২তম খণ্ড, পৃ. ২৫৪-২৫৫।
[২৩]. সূরা ছোয়াদ : ৭৫; সূরা আল-মায়েদাহ : ৬৪; সূরা আলে ইমরান : ২৬, ৭৩; সূরা আল-ফাত্হ : ১০; সূরা আর-রহমান : ২৭; সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৫, ২৭২; সূরা ত্বা-হা : ৫; সূরা আল-আ‘রাফ : ৫৪; সূরা আন-নিসা : ১৬৪; সহীহ বুখারী, হা/১১৪৫; ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৩; মিশকাতুল মাছাবীহ, হা/১২২৩, পৃ. ১০৯; সহীহ বুখারী, হা/৪৮৫০, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭১৯; সহীহ মুসলিম, হা/১২৩০, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৮২; মিশকাত, হা/৫৬৯৫, পৃ. ৫০৫, ‘জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি’ অনুচ্ছেদ; সহীহ বুখারী, হা/৪৯১৯, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৩১; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৭২-১৭৭৫, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৮; মিশকাত, হা/৫৫৪২, পৃ. ৪৮৪, ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ; সহীহ মুসলিম, হা/১১৯৯, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৩-২০৪; মিশকাত, হা/৩৩০৩, পৃ. ২৮৫।
-ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
Last edited: