ফাযায়েলে আমল কেন মুসলিমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ হওয়া সত্ত্বেও ই‘তিকাফ ছেড়ে দিয়েছে? আর ই‘তিকাফের মূল লক্ষ্যই বা কী?

Habib Bin TofajjalVerified member

If you're in doubt ask الله.
Forum Staff
Moderator
Generous
ilm Seeker
Uploader
Exposer
HistoryLover
Q&A Master
Salafi User
Joined
Nov 25, 2022
Threads
664
Comments
1,232
Solutions
17
Reactions
7,302
উত্তর: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য

প্রথমত: ই‘তিকাফ হলো মুআক্কদা সুন্নাহ, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত পালন করতেন।

আর এই সুন্নাহ তো মুসলিমদের জীবন থেকে হারিয়েই গেছে (সে ব্যতীত যাকে আমার রব দয়া করেছেন) এর অবস্থা সে সুন্নাহগুলোর মতই যা মুসলিমরা একেবারেই ত্যাগ করেছে বা একেবারে ত্যাগ করার পথে।

আর এর কিছু কারণ রয়েছে। যেমন,

১. অনেকের মনে ঈমানের দুর্বলতা।

২. দুনিয়ার জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ বিলাসের প্রতি অত্যধিক মাত্রায় ঝুঁকে পড়া। যার কারণে তারা অল্প সময়ের জন্য হলেও এসব থেকে দূরে থাকতে অক্ষম।

৩. অনেক মানুষের মনে জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষার অভাব এবং আরাম-আয়েশের দিকে তাদের ঝুঁকে পড়া, তাই তারা ই‘তিকাফের সামান্য কষ্টও সহ্য করতে চায় না যদিও তা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য হোক না কেন।

যে জান্নাতের মহান মর্যাদা ও তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে জানে, সে তার জন্য তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কুরবান করে হলেও তা লাভের চেষ্টা করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَلا إِنَّ سِلْعَةَ اللَّهِ غَالِيَةٌ، أَلا إِنَّ سِلْعَةَ اللَّهِ الْجَنَّةُ»
“নিশ্চয় আল্লাহর পণ্য অত্যন্ত মূল্যবান, আর নিশ্চয় আল্লাহর পণ্য হচ্ছে জান্নাত।”[1]

৪. অনেকের মনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ভালোবাসা শুধু মৌখিকভাবে সীমাবদ্ধ থাকা, বাস্তব তথা কর্মগত দিকে তার কোনো প্রয়োগ না থাকা। অথচ এ ভালোবাসার বাস্তব চিত্র হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বিভিন্ন দিক বাস্তবায়ণ করা। আর সে সুন্নাতসমূহের একটি হলো ই‘তিকাফ। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب: ٢١]
“নিশ্চয় রাসূলুল্লাহর মাঝে আছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ, তার জন্য, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]

ইবন কাসীর রহ. বলেছেন,

“এই সম্মানিত আয়াতটি রাসূলুল্লাহর সকল কথা, কাজ ও অবস্থা (সুন্নাহ) সর্বাবস্থায় অনুসরণের ব্যাপারে একটি মহান নীতি।”[2]

পূর্ববর্তী সাহাবী, তাবি‘ঈ ও আতবা‘উত তাবি‘ঈগণের অনেকে মানুষদের ই‘তিকাফ ছেড়ে দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিয়মিত করেছেন।

ইবনু শিহাব আয-যুহরী বলেছেন,

“এটি খুবই আশ্চর্যজনক যে, মুসলিমরা ই‘তিকাফ ত্যাগ করেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাতে প্রবেশ করার পর থেকে আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করা পর্যন্ত তিনি ই‘তিকাফ ত্যাগ করেন নি।”

দ্বিতীয়ত: যে ই‘তিকাফ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিতভাবে পালন করেছেন, তা হলো রমযান মাসের শেষ দশ দিনে। এই কয়টি দিন সত্যিকার অর্থে একটি ইনটেনসিভ শিক্ষামূলক কোর্সের ন্যায় যার ইতিবাচক তড়িৎ ফসল একজন মানুষের জীবনে ই‘তিকাফের দিন ও রাতগুলোতেই পরিলক্ষিত হয়। আর এর আরও ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে একজন মানুষের জীবনে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত, তার আগামী দিনগুলোতে।

তাই আমাদের মুসলিম সমাজে কতই না প্রয়োজন এই সুন্নাহকে উজ্জীবিত করা এবং সঠিক পন্থায় তা প্রতিষ্ঠা করা, যার ওপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন।

মানুষের এই গাফিলতি ও উম্মাতের এই ফাসাদের সময় যারা সুন্নাহকে আকঁড়ে ধরে আছে, তাদের পুরষ্কার কতই না মহান হবে!

তৃতীয়ত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ই‘তিকাফের মূল লক্ষ্য ছিল, লাইলাতুল কদরের খোঁজ করা।

ইমাম মুসলিম আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন,
«إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوَّلَ مِنْ رَمَضَانَ ، ثُمَّ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ فِي قُبَّةٍ تُرْكِيَّةٍ (أي: خيمة صغيرة) عَلَى سُدَّتِهَا (أي: بابها) حَصِيرٌ . قَالَ: فَأَخَذَ الْحَصِيرَ بِيَدِهِ فَنَحَّاهَا فِي نَاحِيَةِ الْقُبَّةِ ، ثُمَّ أَطْلَعَ رَأْسَهُ فَكَلَّمَ النَّاسَ ، فَدَنَوْا مِنْهُ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম দশ দিন ই‘তিকাফ করেছিলেন। এরপর তিনি মাঝের দশ দিন তুর্কী ক্বুব্বাহ-তে (এক ধরণের ছোট তাঁবুতে) ই‘তিকাফ করেছিলেন যার দরজায় একটি কার্পেট ছিল। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি (রাসূলুল্লাহ) তাঁর হাত দিয়ে কার্পেটটিকে ক্বুব্বাহর এক পাশে সরিয়ে দিলেন। এরপর তাঁর মাথা বের করে লোকদের সাথে কথা বললেন, তারা (উপস্থিত লোকেরা) তাঁর (রাসূলের) কাছে আসলেন। অতঃপর তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন,
«إِنِّي اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ، ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ، ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِي: إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ»، فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ «
“আমি প্রথম দশ দিন ই‘তিকাফ করেছি, এই রাতের (লাইলাতুল কদরের) খোঁজে, এরপর মাঝের দশ দিন ই‘তিকাফ করেছি, এরপর আমার কাছে এসে বলা হলো: ‘এটি শেষ দশকে’। সুতরাং আপনাদের মাঝে যে ই‘তিকাফ করতে পছন্দ করে/চায়, সে যাতে ই‘তিকাফ করে।” এরপর লোকেরা তাঁর সাথে ই‘তিকাফ করলেন।[3]

এই হাদীসে কিছু শিক্ষণীয় দিক রয়েছে:

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ই‘তিকাফের মূল লক্ষ্য ছিল লাইলাতুল কদরের খোঁজ করা, আর সেই রাতে কিয়াম করা ও তা উজ্জীবিত করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। আর তা হলো এই রাতের মহান ফযীলতের কারণে। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ ﴾ [القدر: ٣]
“লাইলাতুল কদর হাজার মাস থেকেও উত্তম।” [সূরা আল-কদর, আয়াত: ৩]

২. এর (এই রাতের) সময়সীমা জানার আগে তা খোঁজার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কঠোর পরিশ্রমে লিপ্ত হওয়া। তিনি শুরু করেন প্রথম দশ দিনে, এরপর মাঝের দশ দিনে, এরপর মাসের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যান যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁকে জানানো হয় যে, তা (লাইলাতুল কদর) শেষ দশকে। আর এ হলো লাইলাতুল কদরের খোঁজে এক সর্বাত্মক সাধনা।

৩. সাহাবীগণের রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা কারণ, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ই‘তিকাফ শুরু করে মাসের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত রেখেছিলেন, আর তা হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের পূর্ণাংগভাবে অনুসরণের কারণে।

৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের, তাঁর সাহাবীগণের প্রতি ভালোবাসা ও দয়া। ই‘তিকাফের কষ্টের কথা তাঁর জানা ছিল বলে তিনি তাদের (সাহাবীদের) তাঁর সাথে ই‘তিকাফ চালিয়ে যাওয়া অথবা বের হয়ে যাওয়ার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন, বলেছিলেন:
« فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ»
“তরাং আপনাদের মাঝে যে ই‘তিকাফ করতে পছন্দ করে/চায়, সে যেন ই‘তিকাফ করে।”

এছাড়াও ই‘তিকাফের অন্যান্য উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন,

১। মানুষের থেকে যথাসম্ভব আলাদা হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে একা হয়ে যাওয়া।

২. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সর্বাত্মকভাবে মনোনিবেশ করে আত্মশুদ্ধিকরণ।

৩. সালাত আদায়, দো‘আ করা, যিকির পাঠ, কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে ইবাদাত করার জন্য সম্পূর্ণভাবে লেগে যাওয়া।

৪. নাফসের কু-প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনা যা সাওমের ওপর প্রভাব ফেলে তা থেকে সাওমকে রক্ষা করা।

৫. দুনিয়াবী মুবাহ বিষয়সমূহ ভোগ কমিয়ে দেওয়া এবং তার অধিকাংশের ব্যাপারে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ভোগ করার ক্ষেত্রে যুহদ বা কৃচ্ছতা অবলম্বন করা।

দেখুন, আব্দুল লাত্বীফ বালতুব-এর ই‘তিকাফ শিক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গিগ্রন্থটি।


[1] তিরমিযী এবং আল-আলবানী একে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন (২৪৫০)।
[2] ইবন কাসীর (৩/৭৫৬)।
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৭।
 
Back
Top