- Joined
- Jul 24, 2023
- Threads
- 520
- Comments
- 533
- Reactions
- 5,571
- Thread Author
- #1
ভূমিকা :
পেরেনিয়ালিজম (perennialism) বা সর্বধর্ম সমন্বয় মতবাদটি পশ্চিমা একাডেমিয়ার ‘ইসলামিক স্টাডিজ’-এর মুসলিম স্কলারদের লেখনী ও বক্তব্যে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রকাশ পাচ্ছে এবং তার দ্বারা মুসলিম জনসাধারণ প্রভাবিত হচ্ছে। পেরেনিয়ালিজমের মূল কথা হ’ল পৃথিবীর সব প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর অন্তর্নিহিত সার্বজনীন সত্য (Universal truth) একই এবং প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় জ্ঞান ও মতবাদের ভিত্তি হচ্ছে সেই একক সার্বজনীন সত্য। এছাড়াও প্রতিটি বিশ্বধর্ম এই সার্বজনীন সত্যের এক একটি ব্যাখ্যা। ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রদত্ত সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাখ্যাগুলো আবির্ভূত হয়েছে। সরল কথায়, সকল প্রধান বিশ্বধর্মই পবিত্র এবং সব ধর্মই সঠিক পথ-নির্দেশনার দ্বারা চূড়ান্ত পরিত্রাণের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। এই মতবাদের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে এমনকি ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কুরআন থেকেও প্রমাণ দেয়া হয়ে থাকে।
পেরেনিয়ালিস্টরা বিভিন্ন বিশ্বধর্মের অতীন্দ্রিয়বাদ বা মরমীবাদ (mysticism)-এর মধ্যেও পেরেনিয়ালিজমের শিক্ষা খুঁজে পান। এমনকি তারা পেরেনিয়ালিজমকে ইসলামের প্রকৃত ঐতিহ্য বলে প্রচার করে থাকেন। এই মতবাদকে ধর্মীয় বিভিন্নতার কারণে উদ্ভূত সহিংসতা, শত্রুতা, ঈর্ষা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্তরিতকরণ প্রচেষ্টাজনিত দ্বন্দ্ব, বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, পারস্পরিক ঘৃণা, নিজ ধর্মের বাইরের সকলকে জাহান্নামী সাব্যস্ত করার প্রবণতা, মানবজাতিকে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী দুইভাগে বিভক্ত করা জনিত অনৈক্য ইত্যাদির একটি ফলপ্রসূ সমাধান হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। উপরন্তু এটা মানবতা, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সহাবস্থান, শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য সহায়ক বলে ধারণা করা হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে পেরেনিয়ালিজম মতবাদ এবং এই মতবাদ যে কুরআনী শিক্ষা ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষার সাথে তথা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।-
পেরেনিয়ালিজম-এর উৎপত্তি :
যতদূর জানা যায় পেরেনিয়ালিজম শব্দটি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক এবং দার্শনিক অল্ডাস হ্যাক্সলি (Aldous Hexley, 1864-1963)-এর লেখা ‘দ্যা পেরেনিয়াল ফিলোসফী’ (The Perennial Philosophy) বইটিতে (১৯৪৫)। সেখানে হ্যাক্সলি পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ থেকে নেওয়া বিভিন্ন স্টেটমেন্ট এবং একশ্রেণীর মরমী (mystic) দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছেন যে, এইসব ধর্মতত্ত্ব এসেছে একটি একক সাধারণ নির্ধারক থেকে। তাই সব ধর্মতত্ত্ব একই পথে মানুষকে আহবান করে, যাকে তিনি ‘পেরেনিয়াল ফিলোসফী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও হ্যাক্সলি আনুষ্ঠানিকভাবে পেরেনিয়ালিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন, তবে এর ধারণাটি ইউরোপীয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বা আলোকিত (১৪-১৭ শতাব্দী) সময়কালের কিছু কিছু রেনেসাঁস স্কলারদের লেখায় প্রকাশ পেয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মার্সিলিও ফিসিনো (Marsilio Ficino, 1433-1499) এবং জিওভান্নি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা (Giovanni Pico della Mirandola, 1463-1494)। এরা প্রিস্কা থিওলজিয়া বা প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব নামে একটি ধর্মতত্ত্ব উপস্থাপন করেন এবং সেটিকে ঐতিহ্যবাহী (traditional) ধর্মতত্ত্ব হিসাবে সাব্যস্ত করেন। যার সারকথা হ’ল, একটি একক সত্য ধর্মতত্ত্ব বিদ্যমান, যা সমস্ত ধর্মের অন্তর্নিহিত কথা এবং যা প্রাচীনভাবে ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, আলোকিত (enlightened) যুগ সকল ধর্মকে একটি সাধারণ নৃতাত্ত্বিক থিমের উপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হিসাবে দেখেছে। যদিও আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি মূলতঃ ঈশ্বরের প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে। কেননা আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মতত্ত্বসমূহকে মানবতাবাদ ও বাস্তববাদের পরিপন্থী মনে করেছে।
উপরন্তু প্রিস্কা থিওলজিয়ার প্রবর্তকরা মূলতঃ আরও পূর্বেকার দার্শনিক মতামত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যেমন নিও প্লেটোনিজম (Neoplatonism, ৩য়-৬ষ্ঠ শতাব্দী)-এর ‘একক’ ধারণা। এই ধারণা মতে, একটি একক থেকে সমস্ত অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। অনুরূপভাবে হেলেনিসটিক পিরিয়ডের হারমেটিসিজম (Hermeticism, ৩২৩-৩১ খ্রিষ্টপূর্ব) দর্শন যা হার্মিস ট্রিসমেগিস্টাস (Hermes Trismegistus) একটি দার্শনিক ব্যবস্থা হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এই দর্শনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে- (১) সবই মন এবং সকল বাস্তবতা হচ্ছে মনের বহিঃপ্রকাশ, (২) আমরা আমাদের চিন্তা ও মনের মধ্যে যা ধারণ করি তা আমাদের বাস্তবতায় পরিণত হয়, (৩) ঈশ্বর হচ্ছে চেতনা এবং মহাবিশ্ব ঈশ্বরের মনের উদ্ভাস এবং (৪) আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত জিনিসগুলি আসলে এক এবং একই রকম, বিভিন্ন মাত্রায়। এছাড়াও রয়েছে ক্যালডিয়ান ওরাকলস (Chaldean Oracles, ৩য়-৬ষ্ঠ শতাব্দী), যা নিওপ্লাটোনিস্ট দার্শনিকদের লেখা আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক গ্রন্থসামগ্রী। এর আধ্যাত্ম তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, একেবারে অতীত এক দেবতার ক্ষমতা থেকে বুদ্ধি নির্গত হয়। এই বুদ্ধি একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করে, অন্যদিকে বস্ত্তগত সকল অস্তিত্ব সৃষ্টি ও পরিচালনা করে এবং এই দ্বিতীয় ক্ষমতাবলে বুদ্ধি হচ্ছে স্রষ্টা। এই সমস্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ও এগুলিকে সমন্বয় করে রেনেসাঁস স্কলাররা উপরোক্ত প্রিস্কা থিওলজিয়া বা প্রাচীন ধর্মতত্তব উদ্ভাবন করেছিলেন।
আধুনিক কালের পেরেনিয়ালিজম :
বর্তমান সময়ে প্রধানত ওয়েস্টার্ন একাডেমিয়ার ‘ইসলামিক স্টাডিজ’-এর অধিকাংশ স্কলার আধুনিক সংস্কারক হিসাবে আবির্ভূত হয়ে পেরেনিয়ালিজম মতবাদকে শুধুমাত্র নতুনভাবে প্রমোট করছেন তা নয়, তারা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ বা তাফসীরকে ব্যবহার করে পেরেনিয়ালিজমকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা বা ইসলামের সাধারণ শিক্ষা হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করছেন। এজন্য তারা প্রবন্ধ, বই-পুস্তক, সভা-সম্মেলন, লেকচার সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকেন। যেমন :
(১) তারা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন কোথাও কোথাও ইহূদী ও নাছারাদের তিরষ্কার করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই বহু (ইহূদী) আলেম ও (নাছারা) দরবেশ মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে এবং লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। বস্ত্ততঃ যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে, অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে তুমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিভোগের সুসংবাদ দাও’ (তওবা ৯/৩৪)।
আবার তাদের প্রশংসায় বলেন,
‘তুমি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সর্বাধিক শত্রু পাবে ইহূদী ও মুশরিকদের। পক্ষান্তরে বন্ধুত্বের সর্বাধিক নিকটবর্তী পাবে ঐ লোকদের যারা নিজেদেরকে বলে নাছারা। কারণ তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছে পন্ডিত ও সংসার বিরাগী এবং তারা নিরহংকার’ (মায়েদাহ ৫/৮২)।
এমনকি কোন কোন আয়াতে তিনি ইহূদী-নাছারাদেরকে বৈধতা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,
‘নিশ্চয়ই মুমিন, ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৬২)।
(২) বিশ্বাস ও আমলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামী দলের মধ্যকার ব্যাপক বৈপরীত্য নির্দেশ করে যে, খাঁটি বিশ্বাস এবং আমলে উপনীত হওয়াটা চ্যালেঞ্জিং এবং কম-বেশি ত্রুটিসম্পন্ন বিশ্বাস ও আমল নিয়েই সবাই চলছে। আর সেটা মানুষের সীমাবদ্ধতা। যদি মানুষ আন্তরিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য অর্জনের চেষ্টায় থাকে তবে আল্লাহর কাছে বিশ্বাস ও আমলের ত্রুটিগুলি মার্জনীয় হবে। একই ধারায় ইসলাম বহির্ভূত অন্যান্য ধর্মের বিশ্বাস ও আমলেও যে ত্রুটি আছে, হয়তো সেসব ত্রুটি আরও বড় ত্রুটি যেগুলি তাদের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের আলোকে উদ্ভূত হয়েছে। তাই তারাও যদি তাদের নিজ নিজ ধর্মের পথ অবলম্বন করে আন্তরিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য করার চেষ্টায় থাকে তবে তারাও আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে।
(৩) তারা নিজেদেরকে ইসলামের প্রকৃত মধ্যপন্থী দল হিসাবে মনে করে, যারা সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে নিয়ে যেতে চায় এবং এটাকেই তারা ইসলামের মূল শিক্ষা বা সূচনাকালের অবস্থান বলে মনে করে। যারা শুধু নিজেদের বিশ্বাসের ধরণ ও আমলকেই চূড়ান্ত ও সঠিক মনে করে এবং অন্য সবাইকে অবিশ্বাসী, বিভ্রান্ত বা পথচ্যুত মনে করে। পেরেনিয়ালিস্টরা তাদেরকে খারেজী বা বর্জনকারী (exclusivists) বলে থাকে এবং এদেরকে প্রান্তিক বা চরমপন্থী মনে করে। আর যারা প্রধান বিশ্ব ধর্মের বাইরেও অন্য সব ধরনের মতবাদকে গ্রহণযোগ্য মনে করে, কোন মতবাদকেই পরিত্যাগ করে না, তাদেরকে পেরেনিয়ালিস্টরা অন্তর্ভুক্তিবাদী (inclusivists) বলে এবং তাদেরকেও চরমপন্থী মনে করে। (৪) পেরেনিয়ালিস্টরা অতীতের বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে থাকেন যে, তারাও পেরেনিয়ালিজমের প্রবক্তা ছিলেন। যেমন ইমাম মুহাম্মাদ আল-গাযালী (১০৫৮-১১১১ খৃ., ইরান), ইবনু ‘আরাবী (১১৬৫-১২৪০ খৃ., স্পেন), এবং জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ রূমী (১২০৭-১২৭৩ খৃ., ইরান)।
(৫) পেরেনিয়ালিস্টদের বক্তব্য, ইসলাম হ’ল আনুগত্য বা নতি স্বীকার (submission)। যেকোন প্রধান বিশ্বধর্মের পথ ধরে আল্লাহর আনুগত্য বা নতি স্বীকার অর্জনের চেষ্টা করলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
(৬) তারা মনে করে পেরেনিয়ালিজম ইসলামের মূল ধারায় ফিরে আসলে ইসলামোফোবিয়ার (ইসলামের প্রতি আতঙ্ক) যে জোয়ার পৃথিবীতে বইছে সেটা দূরীভূত হবে।
(৭) নিওকনজারভেটিভস (Neoconservatives), জায়নিস্ট (Zionist) ইহূদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী বা অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদী, উগ্র বর্ণবাদী গ্রুপ প্রমুখ যেভাবে ইসলামকে আধুনিকতা বিরোধী, ধর্মান্ধতা, জঙ্গীবাদ, বর্ণবাদ, মৌলবাদ, শান্তির প্রতি হুমকি ইত্যাদি অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত করছে, তা থেকে পেরেনিয়ালিজম ইসলামকে মুক্ত করবে এবং আধুনিক মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে (যা প্রধানত ইউরোপিয়ান আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত এবং যেখানে ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা হয়েছে) ইসলাম অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অল্প কথায় পেরেনিয়ালিজম মতবাদের প্রবক্তাদের প্রচেষ্টা কেবলমাত্র ইউনিভার্সিটির ছাত্র, শিক্ষক এবং সুশীল সমাজকে নয়, বরং সাধারণ মুসলমান ও অমুসলিমদেরকেও প্রভাবিত করছে। এক্ষণে পেরেনিয়ালিজম কেন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সে বিষয়ে আলোচিত হ’ল।-
পেরেনিয়ালিজম বনাম ইসলাম :
পেরেনিয়ালিস্টরা পবিত্র কুরআনের যে আয়াতটিকে পেরেনিয়ালিজমের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করে সেটি হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিন হয়েছে এবং ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রভুর নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৬২)।
এছাড়াও পেরেনিয়ালিস্টরা আরও কিছু আয়াত প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘যারা তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত হয়েছে এজন্য যে, তারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে (খৃষ্টানদের) উপাসনা কক্ষ, বড় গীর্জা সমূহ, (ইহূদীদের) উপাসনালয় ও (মুসলমানদের) মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত; যেখানে আল্লাহর নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহা পরাক্রান্ত’ (হজ্জ ২২/৪০)।
এই আয়াতগুলিকে একক বা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে এর ব্যাখ্যায় বলা হয় যে-
(১) প্রত্যেক প্রধান বিশ্বধর্ম এক একটি সত্য ধর্ম এবং প্রতিটি বিশ্বধর্ম তার অনুসারীদের সৎপথে পরিচালিত করে।
(২) কেবলমাত্র মুসলিমরা নয়, প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা বিচার দিবসে পরিত্রাণ পাবে।
(৩) প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাসী (believers)।
(৪) বিশ্বাসগত এবং আমলগত ত্রুটি কম-বেশী সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই আছে এবং সেসব ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।
(৫) আল্লাহই বিভিন্ন ধর্ম সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে অনন্তকালের জন্য জাহান্নামে দিতে পারেন না। আর সেটা আল্লাহর মর্যাদার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
(৬) প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে।
পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহ এককভাবে ব্যাখ্যা করে তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাই আয়াতগুলির সঠিক অর্থ তারা করতে পারেননি। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, কুরআনের একটি আয়াতকে ব্যাখ্যা করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে সেই আয়াতের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত দ্বারা ব্যাখ্যা করা। তা না হলে, আয়াতটির সাথে সংশ্লিষ্ট সহীহ হাদীস দ্বারা ব্যাখ্যা করা। সাথে সাথে আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছিল, সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া (ঐ, মুক্বাদ্দামা)। বিদ্বানদের অভিমত হ’ল, কুরআনের মূল বিষয়বস্ত্ত একটি এবং তা হ’ল মানবজাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে পরিচালিত করা। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)।
এই মূল বিষয়বস্ত্তকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন হুকুম-আহকাম, সুসংবাদ, শাস্তি ও বিভিন্ন কাহিনী ইত্যাদির অবতারণা করা হয়েছে। তাই কুরআনের আয়াতসমূহ পরস্পর সম্পর্কিত। কোন একটি আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে তার সঠিক অর্থ বোধগম্য নাও হ’তে পারে বা বিভ্রান্তিকর অর্থ উঠে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ নিওকনজারভেটিভস, জায়নিস্ট ইহূদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী প্রমুখরা ইসলামকে জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি প্রমাণ করার জন্য কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করে। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহূদী-নাছারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। এছাড়াও আল্লাহর বলেন, ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর ওটা হ’ল নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (তওবা ৯/৭৩)।
একজন সাধারণ নিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী মানুষ যদি উপরের দু’টি আয়াত এককভাবে পড়ে, তবে তার মনে হ’তেই পারে যে, সমালোচকদের কথা সঠিক। অর্থাৎ কুরআন জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষকতা করে। কিন্তু যখন কুরআনের তাফসীর করার মূলনীতি অনুসরণ করে এই আয়াতগুলির সাথে সংশিলষ্ট অন্য আয়াতের আলোকে উপরের দু’টি আয়াতকে বিশ্লেষণ করা হবে, তখন নিন্দুকদের অভিযোগগুলি ভুল প্রমাণিত হবে। যেমন এর সংশ্লিষ্ট একটি আয়াত হচ্ছে ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা দ্বীনের কারণে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে ও তোমাদের বহিষ্কারে সাহায্য করেছে। বস্ত্ততঃ তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে, তারাই যালেম’ (মুমতাহিনা ৬০/৮-৯)।
এখন এই আয়াতের আলোকে যখন উপরের দু’টি আয়াত (মায়েদাহ ৫/৫১; তওবা ৯/৭৩) ব্যাখ্যা করা হবে, তখন সেগুলিকে আর জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার সমর্থক বলার কোন সুযোগ থাকবে না। পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের যেসব আয়াতকে পেরেনিয়ালিজমের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করে তা সব বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া এবং কুরআনের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যাকৃত নয়, নিম্নের আলোচনায় তা বুঝা যাবে ইনশাআল্লাহ।-
প্রথমতঃ পেরেনিয়ালিস্টদের উত্থাপিত সূরা বাক্বারাহর ৬২ আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর থেকে জানা যায়, নাজাত পাওয়ার কারণ মুসলমান, ইহূদী, নাছারা বা ছাবেঈ হওয়া নয়। মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনা এবং সৎকর্ম করা। এখন প্রশ্ন হ’ল, আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এবং সৎকাজের ধরণ বা স্বরূপ কেমন হবে?
ব্যাপারটা কি এমন যে, যে যার ইচ্ছামত ঠিক করে নিবে- কিভাবে সে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং কোনটি সৎকর্ম সেটা ঠিক করে নিবে? তাহ’লে তো ব্যাপারটা হবে নৈরাজ্যকর। আল্লাহ মানবজাতিকে এরকম অরাজক অবস্থায় ফেলে দিতে পারেন না। তাই আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাঁদের মাধ্যমে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ তাঁদের কিতাবের মাধ্যমে ও তাঁদের সুন্নাতের মাধ্যমে নিজ নিজ উম্মতকে দেখিয়েছেন বা শিখিয়েছেন যে, কিভাবে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং কোন কাজ সৎ কাজ হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু রাসূল (ﷺ) হ’লেন শেষ নবী এবং কুরআন হ’ল রাসূল (ﷺ)-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহর শেষ কিতাব, তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উম্মত অর্থাৎ ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমন করবে তারা সবাই কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎ কর্ম করবে, যার আর কোন বিকল্প আল্লাহ দেননি।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাঁর প্রতি এবং ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি কিভাবে ঈমান আনতে হবে তা বর্ণনা করেছেন। সাথে সাথে বলে দিয়েছেন, কোন কোন কাজ সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর পরিচয়, সত্তা, নাম ও গুণাবলী কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও সূরায় বিবৃত হয়েছে। যেমন সূরা ইখলাছ, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি। একইভাবে ক্বিয়ামত দিবস ও সৎকাজের বর্ণনা পুরো কুরআনব্যাপী ছড়িয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস। কারণ আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এবং যাবতীয় সৎকাজের বিবরণ মানবজাতির কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাধ্যমেই এসেছে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার বিষয়টাকে আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে ব্যাখ্যা করেছেন যেমন- ‘তোমরা বল যে, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি আল্লাহর উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি তার উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের বংশধরগণের প্রতি এবং যা দেওয়া হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা দেওয়া হয়েছে নবীগণকে তাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে, সে সবের উপর। আমরা তাদের কারু মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা সকলে তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’। ‘অতএব যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা নিশ্চয়ই যিদের মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। ‘তোমরা আল্লাহর রং (অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন) কবুল কর। আর আল্লাহর রং-য়ের চাইতে উত্তম রং কার হ’তে পারে? আর আমরা তাঁরই ইবাদতকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৩৬-১৩৮)।
এই আয়াতগুলি থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য রাসূল (ﷺ) ও তার প্রতি প্রেরিত অহী এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূল ও তাদের কাছে প্রেরিত সকল অহীর প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব এবং আবশ্যকতা আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন-
‘আর যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত যা দান করেছি, এরপরে যদি কোন রাসূল আসেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবের সত্যায়ন করবেন, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং তোমাদের স্বীকৃতির উপর আমার অঙ্গীকার নিচ্ছ? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে অন্যতম সাক্ষী রইলাম। অতঃপর যারা উক্ত অঙ্গীকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা হ’ল নাফরমান’ (আলে-ইমরান ৩/৮১-৮২)।
এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী নবীদের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার ও তাকে সাহায্য করার অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং যারা তা করবে না তাদেরকে নাফরমান বলেছেন। কুরআনের বিভিন্ন তাফসীর অনুযায়ী এই অঙ্গীকারের ঘটনা রূহের জগতে সংঘটিত হয়েছিল। এই অঙ্গীকার রক্ষার্থে পূর্ববর্তী নবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন, স্ব স্ব উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জানিয়েছিলেন এবং তাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাব বা অহীর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জানিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহর বাণী,
‘(স্মরণ কর,) যখন মারিয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিল, হে ইস্রাঈল বংশীয়গণ! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্বে প্রেরিত তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম ‘আহমাদ’। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, এটি প্রকাশ্য জাদু’ (ছফ ৬১/৬)।
এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে ঈসা (আঃ) তাঁর উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জানিয়ে ছিলেন এবং ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীগণ তাদের স্ব স্ব নবীদের কাছ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জেনেছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সূরা বাক্বারাহর ৬২ আয়াতে যেসব ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের কথা বলা হয়েছে, তারা তাদের স্ব স্ব নবীদের প্রতি এবং নবীদের কাছে প্রেরিত অহীর প্রতি ঈমান এনেছিল এবং সেই সূত্র ধরে আল্লাহর প্রতি ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং সৎকর্ম করেছিল। এমনকি তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতিও ঈমান এনেছিল। কেননা প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা জানিয়েছিলেন। সেজন্য তারা নাজাতপ্রাপ্ত হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। তারা ইহূদী, নাছারা বা ছাবেঈ নামে পরিচিত ছিল বলে নাজাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সেটা নয়। অর্থাৎ উক্ত আয়াত দ্বারা ইহূদী, নাছারা, ছাবেঈ বা এ জাতীয় অন্য কোন বিশ্বধর্মকে বৈধতা দেওয়া সঠিক নয়।
দ্বিতীয়তঃ কুরআনের কোন আয়াতের তাফসীর করার আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে, আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছিল সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া। সূরা বাক্বারাহর উক্ত আয়াত সম্পর্কে ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃ. ১৫০৫ খৃ.) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ আদ-দুর্রুল মানছূর ফিত তাফসীর বিল-মা‘ছূর-এ উল্লেখ করেন যে, উক্ত আয়াতটি সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর লোকদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের পূর্বে সালমান ফারেসী (রাঃ) বিভিন্ন ধর্মীয় যেমন ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈ আলেমদের সান্নিধ্যে থেকেছেন এবং তারা সালমান (রাঃ)-কে রাসূল (ﷺ)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন তাদের স্ব স্ব গ্রন্থ অনুযায়ী। বুঝা গেল যে, ঐ সমস্ত ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈগণ যাদের কথা সালমান (রাঃ) উল্লেখ করেছেন, তারা তাদের স্ব স্ব নবীদের প্রতি ঈমান এনেছিলেন এবং সেই সূত্রে রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন ও তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তারা আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতিও ঈমান এনেছিলেন এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছিলেন। তাই সালমান (রাঃ) যখন রাসূল (ﷺ)-এর কাছে ঐ সমস্ত ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের বিশ্বাস ও উপাসনার ধরণ সম্বন্ধে জানালেন এবং জানতে চাইলেন তাদের পরিণতি সম্পর্কে, তখন আল্লাহ সূরা বাক্বারাহর ৬২ আয়াতটি নাযিল করলেন’।
সুতরাং উক্ত আয়াতটিকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে পেরেনিয়ালিস্টরা যে ইহূদী, নাছারা, ছাবেঈ বা অন্যান্য বিশ্বধর্মকে বৈধতা দিয়ে থাকে তা বিভ্রান্তিকর। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, নাজাত পাওয়ার কারণ ইহূদী, নাছারা বা ছাবেঈ হওয়া নয়, বরং সঠিক বিশ্বাসে উপনীত হওয়া যথা নবীগণ ও তাঁদের কাছে প্রেরিত অহীর প্রতি বিশ্বাস, রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস এবং তদনুযায়ী আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন এবং সৎকাজ করা।
তৃতীয়তঃ উপরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের পূর্বে ইহূদী, নাছারা, ছাবেঈ বা অন্যান্য বিশ্বধর্মের অনুসারীদের মধ্য থেকে কারা বিশ্বাসী বলে পরিগণিত হবে সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। এবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের পর হ’তে অদ্যাবধি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কারা বিশ্বাসী বলে গণ্য হবে তা খতিয়ে দেখা হবে। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় আলেম মাওলানা বুলন্দশাহরীর (১৯২৫-২০০২ খৃ.) লিখিত বই ‘মরণ কে বাদ কিয়া হো গা’-তে বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি হল, ভারতের এক মুসলিম আলেম বলতেন যে, ইসলামের সব বিধি-বিধান যৌক্তিক। কেবলমাত্র স্ত্রী মিলনের পর গোসল করার বিধান ছাড়া। কেননা বাথরুম করার পর যেভাবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঙ্গ ধৌত করলেই হয়, অনুরূপভাবে স্ত্রী মিলনের পর কেবলমাত্র ব্যবহৃত অঙ্গ ধৌত করতে পারলেই উত্তম হ’ত। সেই আলেম মারা যাওয়ার পর তাঁকে দাফন করা হ’ল। ভুলবশতঃ কোন মূল্যবান বস্ত্ত কবরে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। তাই কবরটা আবার খুঁড়তে হ’ল। কবর খুঁড়ে সকলেই বিস্মিত। কেননা সেখানে সেই আলেমের লাশের পরিবর্তে এক খ্রিষ্টান মহিলার লাশ। অতঃপর সেই মহিলাকে যে খ্রিষ্টান কবরে দাফন করা হয়েছিল, সেই কবরটি খোঁড়া হ’ল এবং সেখানে উক্ত আলেমের লাশ পাওয়া গেল। অনুসন্ধান করে জানা গেল যে, সেই খৃষ্টান মহিলাটি বলতেন যে, কুরআন সত্য এবং ইসলামের সব বিধি-বিধান যৌক্তিক’।
এই ঘটনাটি ইঙ্গিত করে যে মহিলাটি বাহ্যিকভাবে খ্রিষ্টান হ’লেও কুরআন এবং ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি বিশ্বাসী ছিল, তাই হয়ত সে বিশ্বাসী হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে মুসলিম আলেমটি বাহ্যিকভাবে ঈমানদার হ’লেও ইসলামের একটি বিধানকে (যা কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত) অস্বীকার করার কারণে হয়ত অবিশ্বাসী হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
প্রফেসর (অবঃ), লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা; কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অফ পেট্রোলিয়াম এ্যান্ড মিনারেলস্, সঊদীআরব; সুলতান ক্বাবূস ইউনিভার্সিটি, ওমান।
পেরেনিয়ালিজম (perennialism) বা সর্বধর্ম সমন্বয় মতবাদটি পশ্চিমা একাডেমিয়ার ‘ইসলামিক স্টাডিজ’-এর মুসলিম স্কলারদের লেখনী ও বক্তব্যে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রকাশ পাচ্ছে এবং তার দ্বারা মুসলিম জনসাধারণ প্রভাবিত হচ্ছে। পেরেনিয়ালিজমের মূল কথা হ’ল পৃথিবীর সব প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর অন্তর্নিহিত সার্বজনীন সত্য (Universal truth) একই এবং প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় জ্ঞান ও মতবাদের ভিত্তি হচ্ছে সেই একক সার্বজনীন সত্য। এছাড়াও প্রতিটি বিশ্বধর্ম এই সার্বজনীন সত্যের এক একটি ব্যাখ্যা। ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রদত্ত সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাখ্যাগুলো আবির্ভূত হয়েছে। সরল কথায়, সকল প্রধান বিশ্বধর্মই পবিত্র এবং সব ধর্মই সঠিক পথ-নির্দেশনার দ্বারা চূড়ান্ত পরিত্রাণের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। এই মতবাদের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে এমনকি ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কুরআন থেকেও প্রমাণ দেয়া হয়ে থাকে।
পেরেনিয়ালিস্টরা বিভিন্ন বিশ্বধর্মের অতীন্দ্রিয়বাদ বা মরমীবাদ (mysticism)-এর মধ্যেও পেরেনিয়ালিজমের শিক্ষা খুঁজে পান। এমনকি তারা পেরেনিয়ালিজমকে ইসলামের প্রকৃত ঐতিহ্য বলে প্রচার করে থাকেন। এই মতবাদকে ধর্মীয় বিভিন্নতার কারণে উদ্ভূত সহিংসতা, শত্রুতা, ঈর্ষা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্তরিতকরণ প্রচেষ্টাজনিত দ্বন্দ্ব, বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, পারস্পরিক ঘৃণা, নিজ ধর্মের বাইরের সকলকে জাহান্নামী সাব্যস্ত করার প্রবণতা, মানবজাতিকে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী দুইভাগে বিভক্ত করা জনিত অনৈক্য ইত্যাদির একটি ফলপ্রসূ সমাধান হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। উপরন্তু এটা মানবতা, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সহাবস্থান, শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য সহায়ক বলে ধারণা করা হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে পেরেনিয়ালিজম মতবাদ এবং এই মতবাদ যে কুরআনী শিক্ষা ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষার সাথে তথা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।-
পেরেনিয়ালিজম-এর উৎপত্তি :
যতদূর জানা যায় পেরেনিয়ালিজম শব্দটি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক এবং দার্শনিক অল্ডাস হ্যাক্সলি (Aldous Hexley, 1864-1963)-এর লেখা ‘দ্যা পেরেনিয়াল ফিলোসফী’ (The Perennial Philosophy) বইটিতে (১৯৪৫)। সেখানে হ্যাক্সলি পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ থেকে নেওয়া বিভিন্ন স্টেটমেন্ট এবং একশ্রেণীর মরমী (mystic) দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছেন যে, এইসব ধর্মতত্ত্ব এসেছে একটি একক সাধারণ নির্ধারক থেকে। তাই সব ধর্মতত্ত্ব একই পথে মানুষকে আহবান করে, যাকে তিনি ‘পেরেনিয়াল ফিলোসফী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও হ্যাক্সলি আনুষ্ঠানিকভাবে পেরেনিয়ালিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন, তবে এর ধারণাটি ইউরোপীয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বা আলোকিত (১৪-১৭ শতাব্দী) সময়কালের কিছু কিছু রেনেসাঁস স্কলারদের লেখায় প্রকাশ পেয়েছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মার্সিলিও ফিসিনো (Marsilio Ficino, 1433-1499) এবং জিওভান্নি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা (Giovanni Pico della Mirandola, 1463-1494)। এরা প্রিস্কা থিওলজিয়া বা প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব নামে একটি ধর্মতত্ত্ব উপস্থাপন করেন এবং সেটিকে ঐতিহ্যবাহী (traditional) ধর্মতত্ত্ব হিসাবে সাব্যস্ত করেন। যার সারকথা হ’ল, একটি একক সত্য ধর্মতত্ত্ব বিদ্যমান, যা সমস্ত ধর্মের অন্তর্নিহিত কথা এবং যা প্রাচীনভাবে ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, আলোকিত (enlightened) যুগ সকল ধর্মকে একটি সাধারণ নৃতাত্ত্বিক থিমের উপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হিসাবে দেখেছে। যদিও আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি মূলতঃ ঈশ্বরের প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে। কেননা আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মতত্ত্বসমূহকে মানবতাবাদ ও বাস্তববাদের পরিপন্থী মনে করেছে।
উপরন্তু প্রিস্কা থিওলজিয়ার প্রবর্তকরা মূলতঃ আরও পূর্বেকার দার্শনিক মতামত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যেমন নিও প্লেটোনিজম (Neoplatonism, ৩য়-৬ষ্ঠ শতাব্দী)-এর ‘একক’ ধারণা। এই ধারণা মতে, একটি একক থেকে সমস্ত অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। অনুরূপভাবে হেলেনিসটিক পিরিয়ডের হারমেটিসিজম (Hermeticism, ৩২৩-৩১ খ্রিষ্টপূর্ব) দর্শন যা হার্মিস ট্রিসমেগিস্টাস (Hermes Trismegistus) একটি দার্শনিক ব্যবস্থা হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এই দর্শনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে- (১) সবই মন এবং সকল বাস্তবতা হচ্ছে মনের বহিঃপ্রকাশ, (২) আমরা আমাদের চিন্তা ও মনের মধ্যে যা ধারণ করি তা আমাদের বাস্তবতায় পরিণত হয়, (৩) ঈশ্বর হচ্ছে চেতনা এবং মহাবিশ্ব ঈশ্বরের মনের উদ্ভাস এবং (৪) আপাতদৃষ্টিতে বিপরীত জিনিসগুলি আসলে এক এবং একই রকম, বিভিন্ন মাত্রায়। এছাড়াও রয়েছে ক্যালডিয়ান ওরাকলস (Chaldean Oracles, ৩য়-৬ষ্ঠ শতাব্দী), যা নিওপ্লাটোনিস্ট দার্শনিকদের লেখা আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক গ্রন্থসামগ্রী। এর আধ্যাত্ম তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, একেবারে অতীত এক দেবতার ক্ষমতা থেকে বুদ্ধি নির্গত হয়। এই বুদ্ধি একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করে, অন্যদিকে বস্ত্তগত সকল অস্তিত্ব সৃষ্টি ও পরিচালনা করে এবং এই দ্বিতীয় ক্ষমতাবলে বুদ্ধি হচ্ছে স্রষ্টা। এই সমস্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ও এগুলিকে সমন্বয় করে রেনেসাঁস স্কলাররা উপরোক্ত প্রিস্কা থিওলজিয়া বা প্রাচীন ধর্মতত্তব উদ্ভাবন করেছিলেন।
আধুনিক কালের পেরেনিয়ালিজম :
বর্তমান সময়ে প্রধানত ওয়েস্টার্ন একাডেমিয়ার ‘ইসলামিক স্টাডিজ’-এর অধিকাংশ স্কলার আধুনিক সংস্কারক হিসাবে আবির্ভূত হয়ে পেরেনিয়ালিজম মতবাদকে শুধুমাত্র নতুনভাবে প্রমোট করছেন তা নয়, তারা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ বা তাফসীরকে ব্যবহার করে পেরেনিয়ালিজমকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা বা ইসলামের সাধারণ শিক্ষা হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করছেন। এজন্য তারা প্রবন্ধ, বই-পুস্তক, সভা-সম্মেলন, লেকচার সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকেন। যেমন :
(১) তারা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন কোথাও কোথাও ইহূদী ও নাছারাদের তিরষ্কার করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই বহু (ইহূদী) আলেম ও (নাছারা) দরবেশ মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে এবং লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। বস্ত্ততঃ যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে, অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে তুমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিভোগের সুসংবাদ দাও’ (তওবা ৯/৩৪)।
আবার তাদের প্রশংসায় বলেন,
لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِلَّذِينَ آمَنُوا الْيَهُودَ وَالَّذِينَ أَشْرَكُوا وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُمْ مَوَدَّةً لِلَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَى ذَلِكَ بِأَنَّ مِنْهُمْ قِسِّيسِينَ وَرُهْبَانًا وَأَنَّهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ
‘তুমি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সর্বাধিক শত্রু পাবে ইহূদী ও মুশরিকদের। পক্ষান্তরে বন্ধুত্বের সর্বাধিক নিকটবর্তী পাবে ঐ লোকদের যারা নিজেদেরকে বলে নাছারা। কারণ তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছে পন্ডিত ও সংসার বিরাগী এবং তারা নিরহংকার’ (মায়েদাহ ৫/৮২)।
এমনকি কোন কোন আয়াতে তিনি ইহূদী-নাছারাদেরকে বৈধতা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
‘নিশ্চয়ই মুমিন, ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৬২)।
(২) বিশ্বাস ও আমলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামী দলের মধ্যকার ব্যাপক বৈপরীত্য নির্দেশ করে যে, খাঁটি বিশ্বাস এবং আমলে উপনীত হওয়াটা চ্যালেঞ্জিং এবং কম-বেশি ত্রুটিসম্পন্ন বিশ্বাস ও আমল নিয়েই সবাই চলছে। আর সেটা মানুষের সীমাবদ্ধতা। যদি মানুষ আন্তরিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য অর্জনের চেষ্টায় থাকে তবে আল্লাহর কাছে বিশ্বাস ও আমলের ত্রুটিগুলি মার্জনীয় হবে। একই ধারায় ইসলাম বহির্ভূত অন্যান্য ধর্মের বিশ্বাস ও আমলেও যে ত্রুটি আছে, হয়তো সেসব ত্রুটি আরও বড় ত্রুটি যেগুলি তাদের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের আলোকে উদ্ভূত হয়েছে। তাই তারাও যদি তাদের নিজ নিজ ধর্মের পথ অবলম্বন করে আন্তরিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য করার চেষ্টায় থাকে তবে তারাও আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে।
(৩) তারা নিজেদেরকে ইসলামের প্রকৃত মধ্যপন্থী দল হিসাবে মনে করে, যারা সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে নিয়ে যেতে চায় এবং এটাকেই তারা ইসলামের মূল শিক্ষা বা সূচনাকালের অবস্থান বলে মনে করে। যারা শুধু নিজেদের বিশ্বাসের ধরণ ও আমলকেই চূড়ান্ত ও সঠিক মনে করে এবং অন্য সবাইকে অবিশ্বাসী, বিভ্রান্ত বা পথচ্যুত মনে করে। পেরেনিয়ালিস্টরা তাদেরকে খারেজী বা বর্জনকারী (exclusivists) বলে থাকে এবং এদেরকে প্রান্তিক বা চরমপন্থী মনে করে। আর যারা প্রধান বিশ্ব ধর্মের বাইরেও অন্য সব ধরনের মতবাদকে গ্রহণযোগ্য মনে করে, কোন মতবাদকেই পরিত্যাগ করে না, তাদেরকে পেরেনিয়ালিস্টরা অন্তর্ভুক্তিবাদী (inclusivists) বলে এবং তাদেরকেও চরমপন্থী মনে করে। (৪) পেরেনিয়ালিস্টরা অতীতের বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে থাকেন যে, তারাও পেরেনিয়ালিজমের প্রবক্তা ছিলেন। যেমন ইমাম মুহাম্মাদ আল-গাযালী (১০৫৮-১১১১ খৃ., ইরান), ইবনু ‘আরাবী (১১৬৫-১২৪০ খৃ., স্পেন), এবং জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ রূমী (১২০৭-১২৭৩ খৃ., ইরান)।
(৫) পেরেনিয়ালিস্টদের বক্তব্য, ইসলাম হ’ল আনুগত্য বা নতি স্বীকার (submission)। যেকোন প্রধান বিশ্বধর্মের পথ ধরে আল্লাহর আনুগত্য বা নতি স্বীকার অর্জনের চেষ্টা করলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
(৬) তারা মনে করে পেরেনিয়ালিজম ইসলামের মূল ধারায় ফিরে আসলে ইসলামোফোবিয়ার (ইসলামের প্রতি আতঙ্ক) যে জোয়ার পৃথিবীতে বইছে সেটা দূরীভূত হবে।
(৭) নিওকনজারভেটিভস (Neoconservatives), জায়নিস্ট (Zionist) ইহূদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী বা অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদী, উগ্র বর্ণবাদী গ্রুপ প্রমুখ যেভাবে ইসলামকে আধুনিকতা বিরোধী, ধর্মান্ধতা, জঙ্গীবাদ, বর্ণবাদ, মৌলবাদ, শান্তির প্রতি হুমকি ইত্যাদি অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত করছে, তা থেকে পেরেনিয়ালিজম ইসলামকে মুক্ত করবে এবং আধুনিক মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে (যা প্রধানত ইউরোপিয়ান আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত এবং যেখানে ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা হয়েছে) ইসলাম অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অল্প কথায় পেরেনিয়ালিজম মতবাদের প্রবক্তাদের প্রচেষ্টা কেবলমাত্র ইউনিভার্সিটির ছাত্র, শিক্ষক এবং সুশীল সমাজকে নয়, বরং সাধারণ মুসলমান ও অমুসলিমদেরকেও প্রভাবিত করছে। এক্ষণে পেরেনিয়ালিজম কেন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সে বিষয়ে আলোচিত হ’ল।-
পেরেনিয়ালিজম বনাম ইসলাম :
পেরেনিয়ালিস্টরা পবিত্র কুরআনের যে আয়াতটিকে পেরেনিয়ালিজমের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করে সেটি হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিন হয়েছে এবং ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রভুর নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৬২)।
এছাড়াও পেরেনিয়ালিস্টরা আরও কিছু আয়াত প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘যারা তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত হয়েছে এজন্য যে, তারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে (খৃষ্টানদের) উপাসনা কক্ষ, বড় গীর্জা সমূহ, (ইহূদীদের) উপাসনালয় ও (মুসলমানদের) মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত; যেখানে আল্লাহর নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহা পরাক্রান্ত’ (হজ্জ ২২/৪০)।
এই আয়াতগুলিকে একক বা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে এর ব্যাখ্যায় বলা হয় যে-
(১) প্রত্যেক প্রধান বিশ্বধর্ম এক একটি সত্য ধর্ম এবং প্রতিটি বিশ্বধর্ম তার অনুসারীদের সৎপথে পরিচালিত করে।
(২) কেবলমাত্র মুসলিমরা নয়, প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা বিচার দিবসে পরিত্রাণ পাবে।
(৩) প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাসী (believers)।
(৪) বিশ্বাসগত এবং আমলগত ত্রুটি কম-বেশী সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই আছে এবং সেসব ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।
(৫) আল্লাহই বিভিন্ন ধর্ম সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে অনন্তকালের জন্য জাহান্নামে দিতে পারেন না। আর সেটা আল্লাহর মর্যাদার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
(৬) প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীরা একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে।
পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহ এককভাবে ব্যাখ্যা করে তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাই আয়াতগুলির সঠিক অর্থ তারা করতে পারেননি। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, কুরআনের একটি আয়াতকে ব্যাখ্যা করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে সেই আয়াতের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত দ্বারা ব্যাখ্যা করা। তা না হলে, আয়াতটির সাথে সংশ্লিষ্ট সহীহ হাদীস দ্বারা ব্যাখ্যা করা। সাথে সাথে আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছিল, সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া (ঐ, মুক্বাদ্দামা)। বিদ্বানদের অভিমত হ’ল, কুরআনের মূল বিষয়বস্ত্ত একটি এবং তা হ’ল মানবজাতিকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে পরিচালিত করা। কেননা আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি জিন ও ইনসানকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)।
এই মূল বিষয়বস্ত্তকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন হুকুম-আহকাম, সুসংবাদ, শাস্তি ও বিভিন্ন কাহিনী ইত্যাদির অবতারণা করা হয়েছে। তাই কুরআনের আয়াতসমূহ পরস্পর সম্পর্কিত। কোন একটি আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে তার সঠিক অর্থ বোধগম্য নাও হ’তে পারে বা বিভ্রান্তিকর অর্থ উঠে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ নিওকনজারভেটিভস, জায়নিস্ট ইহূদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী প্রমুখরা ইসলামকে জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি প্রমাণ করার জন্য কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করে। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহূদী-নাছারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)। এছাড়াও আল্লাহর বলেন, ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর ওটা হ’ল নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (তওবা ৯/৭৩)।
একজন সাধারণ নিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী মানুষ যদি উপরের দু’টি আয়াত এককভাবে পড়ে, তবে তার মনে হ’তেই পারে যে, সমালোচকদের কথা সঠিক। অর্থাৎ কুরআন জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষকতা করে। কিন্তু যখন কুরআনের তাফসীর করার মূলনীতি অনুসরণ করে এই আয়াতগুলির সাথে সংশিলষ্ট অন্য আয়াতের আলোকে উপরের দু’টি আয়াতকে বিশ্লেষণ করা হবে, তখন নিন্দুকদের অভিযোগগুলি ভুল প্রমাণিত হবে। যেমন এর সংশ্লিষ্ট একটি আয়াত হচ্ছে ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা দ্বীনের কারণে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে ও তোমাদের বহিষ্কারে সাহায্য করেছে। বস্ত্ততঃ তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে, তারাই যালেম’ (মুমতাহিনা ৬০/৮-৯)।
এখন এই আয়াতের আলোকে যখন উপরের দু’টি আয়াত (মায়েদাহ ৫/৫১; তওবা ৯/৭৩) ব্যাখ্যা করা হবে, তখন সেগুলিকে আর জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার সমর্থক বলার কোন সুযোগ থাকবে না। পেরেনিয়ালিস্টরা কুরআনের যেসব আয়াতকে পেরেনিয়ালিজমের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করে তা সব বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া এবং কুরআনের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যাকৃত নয়, নিম্নের আলোচনায় তা বুঝা যাবে ইনশাআল্লাহ।-
প্রথমতঃ পেরেনিয়ালিস্টদের উত্থাপিত সূরা বাক্বারাহর ৬২ আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর থেকে জানা যায়, নাজাত পাওয়ার কারণ মুসলমান, ইহূদী, নাছারা বা ছাবেঈ হওয়া নয়। মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনা এবং সৎকর্ম করা। এখন প্রশ্ন হ’ল, আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এবং সৎকাজের ধরণ বা স্বরূপ কেমন হবে?
ব্যাপারটা কি এমন যে, যে যার ইচ্ছামত ঠিক করে নিবে- কিভাবে সে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং কোনটি সৎকর্ম সেটা ঠিক করে নিবে? তাহ’লে তো ব্যাপারটা হবে নৈরাজ্যকর। আল্লাহ মানবজাতিকে এরকম অরাজক অবস্থায় ফেলে দিতে পারেন না। তাই আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাঁদের মাধ্যমে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ তাঁদের কিতাবের মাধ্যমে ও তাঁদের সুন্নাতের মাধ্যমে নিজ নিজ উম্মতকে দেখিয়েছেন বা শিখিয়েছেন যে, কিভাবে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং কোন কাজ সৎ কাজ হিসাবে গণ্য হবে। যেহেতু রাসূল (ﷺ) হ’লেন শেষ নবী এবং কুরআন হ’ল রাসূল (ﷺ)-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহর শেষ কিতাব, তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উম্মত অর্থাৎ ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমন করবে তারা সবাই কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনবে এবং সৎ কর্ম করবে, যার আর কোন বিকল্প আল্লাহ দেননি।
কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাঁর প্রতি এবং ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি কিভাবে ঈমান আনতে হবে তা বর্ণনা করেছেন। সাথে সাথে বলে দিয়েছেন, কোন কোন কাজ সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর পরিচয়, সত্তা, নাম ও গুণাবলী কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ও সূরায় বিবৃত হয়েছে। যেমন সূরা ইখলাছ, আয়াতুল কুরসী ইত্যাদি। একইভাবে ক্বিয়ামত দিবস ও সৎকাজের বর্ণনা পুরো কুরআনব্যাপী ছড়িয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস। কারণ আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এবং যাবতীয় সৎকাজের বিবরণ মানবজাতির কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাধ্যমেই এসেছে। তাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার বিষয়টাকে আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে ব্যাখ্যা করেছেন যেমন- ‘তোমরা বল যে, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি আল্লাহর উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি তার উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের বংশধরগণের প্রতি এবং যা দেওয়া হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা দেওয়া হয়েছে নবীগণকে তাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে, সে সবের উপর। আমরা তাদের কারু মধ্যে পার্থক্য করি না। আর আমরা সকলে তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’। ‘অতএব যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা নিশ্চয়ই যিদের মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। ‘তোমরা আল্লাহর রং (অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীন) কবুল কর। আর আল্লাহর রং-য়ের চাইতে উত্তম রং কার হ’তে পারে? আর আমরা তাঁরই ইবাদতকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৩৬-১৩৮)।
এই আয়াতগুলি থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য রাসূল (ﷺ) ও তার প্রতি প্রেরিত অহী এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূল ও তাদের কাছে প্রেরিত সকল অহীর প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব এবং আবশ্যকতা আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন-
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ- فَمَنْ تَوَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘আর যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত যা দান করেছি, এরপরে যদি কোন রাসূল আসেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবের সত্যায়ন করবেন, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং তোমাদের স্বীকৃতির উপর আমার অঙ্গীকার নিচ্ছ? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে অন্যতম সাক্ষী রইলাম। অতঃপর যারা উক্ত অঙ্গীকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা হ’ল নাফরমান’ (আলে-ইমরান ৩/৮১-৮২)।
এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী নবীদের নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার ও তাকে সাহায্য করার অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং যারা তা করবে না তাদেরকে নাফরমান বলেছেন। কুরআনের বিভিন্ন তাফসীর অনুযায়ী এই অঙ্গীকারের ঘটনা রূহের জগতে সংঘটিত হয়েছিল। এই অঙ্গীকার রক্ষার্থে পূর্ববর্তী নবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন, স্ব স্ব উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জানিয়েছিলেন এবং তাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাব বা অহীর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জানিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহর বাণী,
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَابَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ
‘(স্মরণ কর,) যখন মারিয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিল, হে ইস্রাঈল বংশীয়গণ! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্বে প্রেরিত তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম ‘আহমাদ’। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, এটি প্রকাশ্য জাদু’ (ছফ ৬১/৬)।
এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে ঈসা (আঃ) তাঁর উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জানিয়ে ছিলেন এবং ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীগণ তাদের স্ব স্ব নবীদের কাছ থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খবর জেনেছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সূরা বাক্বারাহর ৬২ আয়াতে যেসব ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের কথা বলা হয়েছে, তারা তাদের স্ব স্ব নবীদের প্রতি এবং নবীদের কাছে প্রেরিত অহীর প্রতি ঈমান এনেছিল এবং সেই সূত্র ধরে আল্লাহর প্রতি ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং সৎকর্ম করেছিল। এমনকি তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতিও ঈমান এনেছিল। কেননা প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা জানিয়েছিলেন। সেজন্য তারা নাজাতপ্রাপ্ত হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। তারা ইহূদী, নাছারা বা ছাবেঈ নামে পরিচিত ছিল বলে নাজাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সেটা নয়। অর্থাৎ উক্ত আয়াত দ্বারা ইহূদী, নাছারা, ছাবেঈ বা এ জাতীয় অন্য কোন বিশ্বধর্মকে বৈধতা দেওয়া সঠিক নয়।
দ্বিতীয়তঃ কুরআনের কোন আয়াতের তাফসীর করার আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে, আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছিল সে বিষয়ে সাহাবীগণের বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া। সূরা বাক্বারাহর উক্ত আয়াত সম্পর্কে ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃ. ১৫০৫ খৃ.) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ আদ-দুর্রুল মানছূর ফিত তাফসীর বিল-মা‘ছূর-এ উল্লেখ করেন যে, উক্ত আয়াতটি সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর লোকদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের পূর্বে সালমান ফারেসী (রাঃ) বিভিন্ন ধর্মীয় যেমন ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈ আলেমদের সান্নিধ্যে থেকেছেন এবং তারা সালমান (রাঃ)-কে রাসূল (ﷺ)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন তাদের স্ব স্ব গ্রন্থ অনুযায়ী। বুঝা গেল যে, ঐ সমস্ত ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈগণ যাদের কথা সালমান (রাঃ) উল্লেখ করেছেন, তারা তাদের স্ব স্ব নবীদের প্রতি ঈমান এনেছিলেন এবং সেই সূত্রে রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন ও তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তারা আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতিও ঈমান এনেছিলেন এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছিলেন। তাই সালমান (রাঃ) যখন রাসূল (ﷺ)-এর কাছে ঐ সমস্ত ইহূদী, নাছারা ও ছাবেঈদের বিশ্বাস ও উপাসনার ধরণ সম্বন্ধে জানালেন এবং জানতে চাইলেন তাদের পরিণতি সম্পর্কে, তখন আল্লাহ সূরা বাক্বারাহর ৬২ আয়াতটি নাযিল করলেন’।
সুতরাং উক্ত আয়াতটিকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে পেরেনিয়ালিস্টরা যে ইহূদী, নাছারা, ছাবেঈ বা অন্যান্য বিশ্বধর্মকে বৈধতা দিয়ে থাকে তা বিভ্রান্তিকর। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, নাজাত পাওয়ার কারণ ইহূদী, নাছারা বা ছাবেঈ হওয়া নয়, বরং সঠিক বিশ্বাসে উপনীত হওয়া যথা নবীগণ ও তাঁদের কাছে প্রেরিত অহীর প্রতি বিশ্বাস, রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস এবং তদনুযায়ী আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন এবং সৎকাজ করা।
তৃতীয়তঃ উপরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের পূর্বে ইহূদী, নাছারা, ছাবেঈ বা অন্যান্য বিশ্বধর্মের অনুসারীদের মধ্য থেকে কারা বিশ্বাসী বলে পরিগণিত হবে সে ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। এবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের পর হ’তে অদ্যাবধি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কারা বিশ্বাসী বলে গণ্য হবে তা খতিয়ে দেখা হবে। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় আলেম মাওলানা বুলন্দশাহরীর (১৯২৫-২০০২ খৃ.) লিখিত বই ‘মরণ কে বাদ কিয়া হো গা’-তে বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি হল, ভারতের এক মুসলিম আলেম বলতেন যে, ইসলামের সব বিধি-বিধান যৌক্তিক। কেবলমাত্র স্ত্রী মিলনের পর গোসল করার বিধান ছাড়া। কেননা বাথরুম করার পর যেভাবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঙ্গ ধৌত করলেই হয়, অনুরূপভাবে স্ত্রী মিলনের পর কেবলমাত্র ব্যবহৃত অঙ্গ ধৌত করতে পারলেই উত্তম হ’ত। সেই আলেম মারা যাওয়ার পর তাঁকে দাফন করা হ’ল। ভুলবশতঃ কোন মূল্যবান বস্ত্ত কবরে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। তাই কবরটা আবার খুঁড়তে হ’ল। কবর খুঁড়ে সকলেই বিস্মিত। কেননা সেখানে সেই আলেমের লাশের পরিবর্তে এক খ্রিষ্টান মহিলার লাশ। অতঃপর সেই মহিলাকে যে খ্রিষ্টান কবরে দাফন করা হয়েছিল, সেই কবরটি খোঁড়া হ’ল এবং সেখানে উক্ত আলেমের লাশ পাওয়া গেল। অনুসন্ধান করে জানা গেল যে, সেই খৃষ্টান মহিলাটি বলতেন যে, কুরআন সত্য এবং ইসলামের সব বিধি-বিধান যৌক্তিক’।
এই ঘটনাটি ইঙ্গিত করে যে মহিলাটি বাহ্যিকভাবে খ্রিষ্টান হ’লেও কুরআন এবং ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি বিশ্বাসী ছিল, তাই হয়ত সে বিশ্বাসী হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যদিকে মুসলিম আলেমটি বাহ্যিকভাবে ঈমানদার হ’লেও ইসলামের একটি বিধানকে (যা কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত) অস্বীকার করার কারণে হয়ত অবিশ্বাসী হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
প্রফেসর (অবঃ), লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা; কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি অফ পেট্রোলিয়াম এ্যান্ড মিনারেলস্, সঊদীআরব; সুলতান ক্বাবূস ইউনিভার্সিটি, ওমান।
Last edited: