আর-রহমান ও আর-রাহীম নামদ্বয় প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা পরম দয়াময়, অতি দয়ালু, প্রশস্ত রহমতের অধিকারী; যার রহমত সব কিছুকে বেষ্টন করে রেখেছে এবং সমস্ত সৃষ্টির উপর তাঁর রহমত ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত। তাঁর নবী ও রাসূলগণের অনুসারী মুত্তাকীনদের জন্য তিনি তাঁর রহমত লিখে রেখেছেন। তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির স্থানে অবস্থানের নিমিত্তে সর্বময় রহমত। তারা ব্যতীত অন্যরা চিরস্থায়ী পূর্ণ এ রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। কেননা তিনি তাদের কাছে এ রহমত প্রেরণ করেছিলেন; কিন্তু তারা এ সংবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তাই তারা নিজেরা শুধু নিজেদেরকেই দোষারোপ করবে।আর-রাহীম (অতি দয়ালু)
কুরআন ও সুন্নাহ-এর প্রমাণাদির ভিত্তিতে উম্মাতের সকলের কাছে ঐক্যমত্য মূলনীতি যে, আল্লাহর সমস্ত নাম, তাঁর সকল সিফাত ও সিফাতের যাবতীয় আহকামের উপর ঈমান আনা ফরয। অত:এব, মুমিনরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ রহমান ও রাহীম, তিনি অসীম রহমতের অধিকারী, যা রহমত প্রাপ্তদের রহমত সম্পৃক্ত গুণাবলীতে তাঁকে গুণান্বিত করে। অত:এব, বিশ্বের যাবতীয় নি‘আমত তাঁর রহমতেরই প্রভাবে হয়ে থাকে। এমনিভাবে আল্লাহর অন্যান্য সুন্দর নামের ব্যাপারে বলা হবে।
যেমন বলা হবে, তিনি আল-‘আলীম তথা সর্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী: তিনি বিশাল ইলমের অধিকারী, সব কিছুই তিনি অবগত।
তিনি আল-কাদীর তথা মহা ক্ষমতাধর। সব কিছুর উপরে তাঁর রয়েছে পূর্ণ ক্ষমতা।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেই নিজের জন্য এসব আসমাউল হুসনা (সুন্দর গুণবাচক নামসমূহ), সুউচ্চ সিফাতসমূহ ও সেসব সিফাত থেকে উৎসারিত আহকামসমূহ সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি এগুলোর কোন একটি সাব্যস্ত করল; কিন্তু অন্যটি নেতিবাচক করল তাহলে সে কুরআন ও সুন্নাহের বিরোধিতা করল এবং তার কাজটি বিরোধপূর্ণ হলো ও তা বাতিল বলে গণ্য হবে।[2]
আল্লাহর যাত (সত্ত্বা) ও সিফাতের উপর এসব নামের দালালাত (নির্দেশনা) মুতাবাকা, তাদামুন ও ইলতিযাম অনুযায়ী হয়ে থাকে। কেননা কোন শব্দ তার অর্থের প্রতি দুভাবে নির্দেশ করে। একটি হলো লাফযিয়্যাহ তথা শব্দগত এবং আরেকটি মা‘নুবিয়্যাহ আক্বলিয়্যাহ তথা বিবেক-প্রসন্ন অর্থগত। শব্দ যদি তার মধ্যকার সমস্ত অর্থ বুঝায় তাহলে তাকে দালালাতুল মুতাবিকাহ বলে অর্থাৎ শব্দটি যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে সেটি পুরোপুরি ভাবে সে অর্থ প্রকাশ করেছে। কেননা শব্দটি বাড়তি বা কমতি ছাড়াই হুবহু অর্থের অনুগত হয়েছে। শব্দটি যদি আংশিক অর্থ বুঝায় তাহলে তাকে দালালাতু তাদামুন বলে। কেননা উল্লিখিত আংশিক অর্থ শব্দের কিছু অংশের অর্থ এবং এটি উক্ত শব্দেরই অন্তর্গত। অন্যদিকে দালালাতুল মা‘আনাবিয়্যাহতুল আক্বলিয়্যাহ হলো সুস্থ আক্বল ও চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত। কেননা শুধু শব্দটিই কাঙ্খিত অর্থ প্রমাণ করে না; বরং বান্দা শব্দের অত্যাবশ্যকীয় অর্থের প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করে ও চিন্তা-গবেষণা করে, যে অর্থ ধর্তব্য বতীত শব্দটি পূর্ণ অর্থ বুঝায় না এবং যে শব্দটিতে যে শর্তসমূহ রয়েছে তা পূর্ণ হয় না। এ নিয়ম আসমাউল হুসনার সমস্ত নামের ব্যাপারেই প্রযোজ্য হবে। প্রতিটি নামই আল্লাহর যাত ও তাঁর সিফাতের উপর প্রমাণ করে। এটি শব্দটি তার অর্থের অনুমাগী। আবার নামটি শুধু তাঁর যাত অথবা শুধু সিফাতের উপর প্রমাণ করলে তা দালালাতু তাদামুন। অন্যদিকে নামটি সরাসরি তাঁর বা সিফাতের উপর প্রমাণ না করে অন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় সিফাতের উপর প্রমাণ করলে তা দালালাতু ইলতিযাম। যেমন, আর-রহমান নামটি শুধু আল্লাহর যাতের উপর ও শুধু তাঁর রহমতের উপর প্রমাণ করলে তা দালালাতু তাদামুন। কিন্তু একত্রে যাত রহমত সিফাতের উপর প্রমাণ করলে তা দালালাতু মুতাবিক। অন্যদিকে নামটি পূর্ণাঙ্গ জীবন, সর্ব-পরিবেষ্টিত ইলম ও পূর্ণ কুদরত ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় সিফাতের উপর প্রমাণ করলে তা দালালাতু ইলতিযাম। কেননা রহমাত দানকারীর জীবন, রহমত প্রাপ্তদের কাছে রহমত পৌঁছানোর ক্ষমতা, তাদের সম্পর্কে জ্ঞান ও তাদের অভাব না বুঝলে তিনি রহমত দান করতে পারবে না।[3] কেউ আল্লাহর রহমান নামটি নিয়ে গভীর চিন্তা-গবেষণা করলে দেখতে পাবে যে, তিনি ব্যাপক ও পরিপূর্ণ রহমতের অধিকারী। তাঁর রহমত ঊর্ধ্বজগত, নিম্নজগত, সমস্ত সৃষ্টিজগত, দুনিয়া ও আখিরাতে সর্বত্রই পরিপূর্ণ। উপরোক্ত অর্থের প্রতি প্রমাণকারী নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
“তিনি বললেন, ‘আমি যাকে চাই তাকে আমার আযাব দেই। আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
“অত:এব, আপনি আল্লাহর রহমতের চিহ্নসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিন। কিভাবে তিনি জমিনের মৃত্যুর পর তা জীবিত করেন। নিশ্চয় এভাবেই তিনি মৃতকে জীবিত করেন।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ৫০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
“তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে। আর তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নি‘আমত ব্যাপক করে দিয়েছেন।” [সূরা লুকমান, আয়াত: ২০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
“আর তোমাদের কাছ যে সব নি‘আমত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। অতঃপর দুঃখ-দুর্দশা যখন তোমাদের স্পর্শ করে তখন তোমরা শুধু তার কাছেই ফরিয়াদ কর।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৫৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
“আর যদি তোমরা আল্লাহর নি‘আমত গণনা কর, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ১৮]
আল্লাহর নি‘আমতের উসূল তথা মূলনীতি ও ফুরু‘ তথা শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত সূরা নাহাল তিলাওয়াত করুন। এতে আল্লাহর নি‘আমতের অপরিসীম দান ও প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই তিনি সূরার শেষে বলেছেন,
“এভাবেই তিনি তোমাদের উপর তার নি‘আমতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৮১]
অত:পর সূরা আর-রহমান আদ্যোপান্ত গভীর চিন্তা-গবেষণাসহ তিলাওয়াত করুন। এ সূরাতে তাঁর নি‘আমতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। এতে রয়েছে রহমানের রহমতের যাবতীয় উদাহরণ ও নানা ধরণের নি‘আমতের বিস্তারিত বিবরণ। এ কারণেই তিনি তাঁর অনুগত মুমিনদের জন্য জান্নাতে পূর্ণ ও চিরস্থায়ী নি‘আমতের কথা স্মরণ করে দিয়ে সূরাটি শেষ করেন। আর জান্নাতের এ চিরস্থায়ী নি‘আমত আল্লাহর নি‘আমতের অন্যতম প্রভাব। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতকে রহমত বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
“আর যাদের চেহারা সাদা হবে, তারা তো আল্লাহর রহমতে থাকবে। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৭]
হাদীসে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতকে বলবেন,
“তুমি আমার রহমত, তোমার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের থেকে যাকে ইচ্ছা রহমত করব।”[4] আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
“এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৬৩]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“মা তার সন্তানের উপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তার বান্দার উপর তদাপেক্ষা অধিক দয়ালু।”[5]
“আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করার পূর্বে একটি লেখা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তা হলো “আমার ক্রোধের উপর আমার রহমত অগ্রগামী রয়েছে।”[6]
এককথায়, আল্লাহ তাঁর রহমতে সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অপরিসীম দয়ায় তিনি তাদের কাছে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁর রহমতের কারণেই তিনি তাদেরকে আদেশ-নিষেধ করেছেন এবং তাদের জন্য শরী‘আত বিধিবদ্ধ করেছেন। তিনি তাদের প্রতি তাঁর বাহ্যিক ও গোপনীয় নি‘আমতে পরিপূর্ণ করেছেন এবং তাদেরকে সুন্দর সূক্ষ্ম পরিচালনায় পরিচালিত করছেন। তাঁর রহমতেই তিনি তাদেরকে বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন করেন। তাঁর রহমত দুনিয়া ও আখিরাতে ভরপুর। অত:এব, তাঁর রহমত ব্যতীত কোন কিছুই শুভ-সুন্দর হয় না; কোন কাজই তাঁর রহমত ব্যতীত সহজ হয় না; কোন উদ্দেশ্য তাঁর রহমত ব্যতীত অর্জিত হয় না। তাঁর রহমত সব কিছু ঊর্ধ্বে, সবচেয়ে মহান ও সুউচ্চ। মুহসিন মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে তাঁর রহমতের পূর্ণ অংশ এবং অপরিসীম কল্যাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
“নিশ্চয় আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।” [সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ৫৫][7]
[1] এ নামদ্বয়ের দলিল হলো নিম্নোক্ত আল্লাহর বাণী,
﴿ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ٣﴾ [الفاتحة: ٣]
“দয়াময়, পরম দয়ালু, পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।” [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৩]
[2] আল-খুলাসা দিমনাল মাজমূ‘আতিল কামিলা লি মুয়াল্লাফাতিস সা‘দী, ১/১৭৯; আত-তাফসীর, ১/৩৩।
[3] আল-হাক্বকুল ওয়াদিহ আল-মুবীন, পৃ. ১০৬-১০৭।
[4] সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর, বাব, কাওলুহু ‘ওয়াতাকূলু হাল মিম মাযীদ’ ৬/৪৮, হাদীস নং ৪৮৫০; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জান্নাহ, বাব, আন-নারু ইয়াদখুলুহাল জাব্বারূন ওয়াল জান্নাতু ইয়াদখুলুহাদ দু‘আফা, ৪/২১৮৬, হাদীস নং ২৮৪৬, এটি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসের অংশ বিশেষ।
[5] সহীহ বুখারী, ৭/৭৫, কিতাবুল আদাব, বাব, রহমাতুল ওয়ালাদি ওয়াতাকবীলিহি ওয়া মু‘আনাকাতিহি, হাদীস নং ৫৯৯৯; সহীহ মুসলিম, ৪/২১০৯, কিতাবুত তাওবা, বাব, ফি সি‘আতি রহমাতিল্লাহি তা‘আলা, হাদীস নং ২৭৫৪। হাদীসটি উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত।
[6] সহীহ বুখারী, ৮/১৭৬, কিতাবুত তাওহীদ, বাব, ওয়াকানা ‘আরশুহু ‘আলাল মাই, হাদীস নং ৭৫৫৪; সহীহ মুসলিম, ৪/২১০৭, কিতাবুত তাওবা, বাব, ফি সি‘আতি রহমাতিল্লাহি তা‘আলা, হাদীস নং ২৭৫১।
[7] আল-মাওয়াহিবুর রাব্বানিয়্যাহ মিনাল আয়াতিল কুরআনিয়্যাহ, পৃ. ৬৪।