উত্তর : আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে লোকেরা বলতে লাগল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য বেঁধে দিন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলাই মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন, তিনিই নিয়ন্ত্রণকারী, অপ্রশস্তকারী, প্রশস্তকারী ও রিযিক্ব দানকারী। আমি আমার প্রতিপালকের সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হতে চাই যে, তোমাদের কোন লোক যেন এ দাবি করতে না পারে (আমার বিরুদ্ধে) যে, তার জান-মালের উপর আমি হস্তক্ষেপ করেছি (তিরমিযী, হা/১৩১৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৪৫১, সনদ ছহীহ)। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি এসে রাসূল (ﷺ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিন। উত্তরে তিনি বললেন, بَلِ اللهُ يَخْفِضُ وَيَرْفَعُ وَإِنِّىْ لأَرْجُوْ أَنْ أَلْقَى اللهَ وَلَيْسَ لِأَحَدٍ عِنْدِىْ مَظْلَمَة ‘বরং আল্লাহই সঙ্কোচন এবং সম্প্রসারণ করেন। আমি অবশ্যই এমতাবস্থায় আল্লাহর সাথে মিলিত হতে চাই যে, আমার পক্ষ থেকে কারো প্রতি সামান্যতম যুলমও থাকবে না’ (আবূ দাঊদ, হা/৩৪৫০; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামি‘, হা/২৮৩৬)।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যহ্রাস এ দু’টি ঐ সকল ঘটনার অন্যতম, যার স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নন। তাঁর ইচ্ছা ও ক্ষমতা ছাড়া এর কিছুই সংঘটিত হয় না। তবে আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো কতিপয় বান্দার কর্মকে কিছু ঘটনা ঘটার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যেমন হত্যাকারীর হত্যাকে নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ করেছেন। বান্দাদের যুলমের কারণে তিনি কখনো মূল্যবৃদ্ধি করেন এবং কখনো কিছু মানুষের ইহসানের কারণে মূল্যহ্রাস করেন’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৮/৫২০ পৃ.)।
তাই বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ইসলামের সাধারণ নীতি হল, পণ্য উৎপাদকই পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। সাধারণ অবস্থায় রাষ্ট্র পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে না। কারণ পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে উৎপাদক পণ্যের মান কমিয়ে দিতে পারে। নিশ্চয় মূল্য নির্ধারণ এক প্রকারের যুলম। কারণ মানুষেরা তাদের সম্পদের ভিত্তিতে ব্যয় করে। অর্থাৎ উৎপাদন বেশি হলে আমদানী বেশি হবে এবং মূল্য কমে যাবে, আর উৎপাদন কম হলে আমদানী কম হবে এবং মূল্য বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মূল্যের গতি নির্ধারণকারী বলতে প্রকৃতপক্ষে এটিই বুঝানো হয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ করলে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, হা/২৮৯৪-এর ব্যাখ্যা দ্র.)।
ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘কিতাবুল উম্ম’ নামক গ্রন্থে উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন, তিনি একদা বাজারে হাতিব ইবনু আবী বালতার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, তার কাছে ছিল কিসমিস ভর্তি দু’টি বস্তা। তখন উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার দাম জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে হাতিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এক দিরহাম। উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ত্বায়িফ থেকে কিসমিস নিয়ে আসা একটি কাফেলার ব্যাপারে অবগত হলাম, তারা তোমাকে মূল্যে ঠকাচ্ছে। অর্থাৎ তারা এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। অতএব তুমি দাম বাড়িয়ে দাও অথবা বাড়ীতে গিয়ে যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি কর। এ কথা শুনে হাতিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বাড়ী চলে গেলেন। অতঃপর উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বিষয়টি চিন্তা করে হাতিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়ীতে আসলেন এবং তাকে বললেন, আমি তোমাকে যেটা বলেছিলাম সেটা শাসক হিসাবে, যা অবশ্য পালনীয় নয়, বরং এর মাধ্যমে আমি দেশবাসীর কল্যাণ চেয়েছিলাম। সুতরাং তুমি যেভাবে এবং যে দামে ইচ্ছা বিক্রি কর (কিতাবুল উম্ম, ২/২০৯ পৃ.; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/১৪৯০৬, ৮/২০৭)। ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উপরিউক্ত হাদীছ দ্বারা মূল্য নির্ধারণ হারাম ও যুলম হওয়ার পক্ষে দলীল পেশ করা হয়েছে। এর কারণ হল, মানুষ তাদের মালের উপর কর্তৃত্বশীল। অথচ সরকার বা তার প্রতিনিধি তাদের জন্য প্রতিবন্ধক। আর রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণে আদিষ্ট। বর্ধিত মূল্যে বিক্রির ব্যাপারে বিক্রেতার স্বার্থ দেখার চেয়ে সস্তা দামে ক্রয়ের ব্যাপারে ক্রেতার স্বার্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য উত্তম নয়। আর পণ্যের মালিককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা আল্লাহর বাণী ‘তবে ব্যবসা যদি হয় ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে তবে ভিন্ন কথা’ (সূরা আন-নিসা : ২৯)-এর বিরোধী। অধিকাংশ বিদ্বানই এ মতের প্রবক্তা’ (নাইলুল আওত্বার, ৩/৬০২-৬০৩ পৃ.)। তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের কল্যাণ হেতু দ্রব্যমূল্য কম রাখার ও উৎপাদন বৃদ্ধির যাবতীয় ব্যবস্থা করবে, এটাই তার বড় দায়িত্ব’ (নাইলুল আওত্বার, ৫/৩৩৫ পৃ.)।
ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদীছের আলোকে দু’টি কারণে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ বৈধ না হওয়ার দলীল সাব্যস্ত হয়। ১- লোকেরা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের আহ্বান জানালেও তা তিনি করেননি। যদি সেটি জায়েয হত, তাহলে তিনি তাদের আহ্বানে সাড়া দিতেন। ২- দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ না করার কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, এটি যুল্ম। আর যুল্ম হারাম। তাছাড়া তা বিক্রেতার মাল। সুতরাং ক্রেতা-বিক্রেতা ঐকমত্য পোষণ করলে বিক্রেতাকে তার মাল বিক্রি করা থেকে নিষেধ করা জায়েয নয়’ (আল-মুগনী, ৬/৪১২ পৃ.)। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলিমগণ বলেন, ‘যখন বিক্রেতারা ও অন্যরা তাদের পণ্যের দাম তাদের ইচ্ছামত বৃদ্ধি করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করবে, তখন ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাঝে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা এবং জনসাধারণের কল্যাণ করা ও ফিতনা-ফাসাদ দূর করার উদ্দেশ্যে সাধারণ নিয়মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান বিক্রেয় দ্রব্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করবেন। আর যদি তাদের মধ্যে ঐকমত্য না হয়, বরং কোন প্রকার প্রতারণা ছাড়াই পর্যাপ্ত চাহিদা ও পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ কম হওয়ার কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য মূল্য নির্ধারণ করা উচিত নয়। বরং তিনি প্রজাদেরকে এমনভাবে ছেড়ে দেবেন যে, আল্লাহ তাদের কারো দ্বারা কাউকে রিযিক্ব দিবেন’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৩/১৮৬ পৃ.)।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘মূল্য নির্ধারণ ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না’ (কিতাবুল মাজমূঊ, ১২/১২১; আত-তুরুকুল হুকুমিইয়াহ ফিস সিয়াসাতিশ শারঈয়্যাহ, ১/২২২ পৃ.)। শায়খ ছালিহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘কোন মানুষ যদি বিশ্বাস করে যে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একমাত্র সরকারের হাতে, তাহলে সে যেন নিজের আক্বীদাকে সংশোধন করে এবং তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করে’। তিনি আরো বলেছেন, ‘পণ্যের স্বল্পতা ও সরবরাহ কম হওয়ার কারণে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে এতে কারো কিছুই করার নেই। তবে ব্যবসায়ীদেরকে বলা হবে, মানুষেরা যে দামে বিক্রি করছে সে বাজার মূল্যে তোমরা বিক্রি কর। মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। পক্ষান্তরে মাল গুদামজাত করার কারণে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে পণ্যের কৃত্রিম ঘাটতি করে যদি তারা বেশি দামে মাল বিক্রি করে, তাহলে শাসক এতে হস্তক্ষেপ করবেন। মানুষেরা যে দামে বিক্রি করছে সে দামে বিক্রি করতে তিনি তাদেরকে বাধ্য করবেন। এটাই আদল বা ন্যায়-নীতি’ (af.org.sa/en/node/14702)।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দু’টি বিষয় পরিলক্ষিত হয়, প্রথমতঃ একথা পরিষ্কার যে, ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর হুকুমেই ঘটে থাকে। কারণ দ্রব্যমূল্যে নির্ভর করে উৎপাদনের উপরে। আর উৎপাদন কমবেশি করার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলাই। তবে আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো কতিপয় বান্দার কর্মকে কিছু ঘটনা ঘটার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। বান্দাদের যুলমের কারণে তিনি কখনো মূল্যবৃদ্ধি করেন এবং কখনো কিছু মানুষের ইহসানের কারণে মূল্যহ্রাস করেন। দ্বিতীয়তঃ এটিও পরিষ্কার যে, স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্রের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা বৈধ নয়। তবে যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি হতে পারে। তাই সিন্ডিকেট ছাড়াই হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে বান্দার উচিত সকল প্রকার পাপকর্ম বর্জন করে তাওবাহ-ইস্তিগফার করা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা ও আল্লাহর উপর ভরসা করা।
- মাসিক আল ইখলাস, নভেম্বর ২০২২
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যহ্রাস এ দু’টি ঐ সকল ঘটনার অন্যতম, যার স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নন। তাঁর ইচ্ছা ও ক্ষমতা ছাড়া এর কিছুই সংঘটিত হয় না। তবে আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো কতিপয় বান্দার কর্মকে কিছু ঘটনা ঘটার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যেমন হত্যাকারীর হত্যাকে নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ করেছেন। বান্দাদের যুলমের কারণে তিনি কখনো মূল্যবৃদ্ধি করেন এবং কখনো কিছু মানুষের ইহসানের কারণে মূল্যহ্রাস করেন’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৮/৫২০ পৃ.)।
তাই বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ইসলামের সাধারণ নীতি হল, পণ্য উৎপাদকই পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। সাধারণ অবস্থায় রাষ্ট্র পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে না। কারণ পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে উৎপাদক পণ্যের মান কমিয়ে দিতে পারে। নিশ্চয় মূল্য নির্ধারণ এক প্রকারের যুলম। কারণ মানুষেরা তাদের সম্পদের ভিত্তিতে ব্যয় করে। অর্থাৎ উৎপাদন বেশি হলে আমদানী বেশি হবে এবং মূল্য কমে যাবে, আর উৎপাদন কম হলে আমদানী কম হবে এবং মূল্য বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মূল্যের গতি নির্ধারণকারী বলতে প্রকৃতপক্ষে এটিই বুঝানো হয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ করলে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, হা/২৮৯৪-এর ব্যাখ্যা দ্র.)।
ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘কিতাবুল উম্ম’ নামক গ্রন্থে উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন, তিনি একদা বাজারে হাতিব ইবনু আবী বালতার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, তার কাছে ছিল কিসমিস ভর্তি দু’টি বস্তা। তখন উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার দাম জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে হাতিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এক দিরহাম। উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ত্বায়িফ থেকে কিসমিস নিয়ে আসা একটি কাফেলার ব্যাপারে অবগত হলাম, তারা তোমাকে মূল্যে ঠকাচ্ছে। অর্থাৎ তারা এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। অতএব তুমি দাম বাড়িয়ে দাও অথবা বাড়ীতে গিয়ে যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি কর। এ কথা শুনে হাতিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বাড়ী চলে গেলেন। অতঃপর উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বিষয়টি চিন্তা করে হাতিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়ীতে আসলেন এবং তাকে বললেন, আমি তোমাকে যেটা বলেছিলাম সেটা শাসক হিসাবে, যা অবশ্য পালনীয় নয়, বরং এর মাধ্যমে আমি দেশবাসীর কল্যাণ চেয়েছিলাম। সুতরাং তুমি যেভাবে এবং যে দামে ইচ্ছা বিক্রি কর (কিতাবুল উম্ম, ২/২০৯ পৃ.; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হা/১৪৯০৬, ৮/২০৭)। ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উপরিউক্ত হাদীছ দ্বারা মূল্য নির্ধারণ হারাম ও যুলম হওয়ার পক্ষে দলীল পেশ করা হয়েছে। এর কারণ হল, মানুষ তাদের মালের উপর কর্তৃত্বশীল। অথচ সরকার বা তার প্রতিনিধি তাদের জন্য প্রতিবন্ধক। আর রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণে আদিষ্ট। বর্ধিত মূল্যে বিক্রির ব্যাপারে বিক্রেতার স্বার্থ দেখার চেয়ে সস্তা দামে ক্রয়ের ব্যাপারে ক্রেতার স্বার্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য উত্তম নয়। আর পণ্যের মালিককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা আল্লাহর বাণী ‘তবে ব্যবসা যদি হয় ক্রেতা-বিক্রেতার পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে তবে ভিন্ন কথা’ (সূরা আন-নিসা : ২৯)-এর বিরোধী। অধিকাংশ বিদ্বানই এ মতের প্রবক্তা’ (নাইলুল আওত্বার, ৩/৬০২-৬০৩ পৃ.)। তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের কল্যাণ হেতু দ্রব্যমূল্য কম রাখার ও উৎপাদন বৃদ্ধির যাবতীয় ব্যবস্থা করবে, এটাই তার বড় দায়িত্ব’ (নাইলুল আওত্বার, ৫/৩৩৫ পৃ.)।
ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদীছের আলোকে দু’টি কারণে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ বৈধ না হওয়ার দলীল সাব্যস্ত হয়। ১- লোকেরা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের আহ্বান জানালেও তা তিনি করেননি। যদি সেটি জায়েয হত, তাহলে তিনি তাদের আহ্বানে সাড়া দিতেন। ২- দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ না করার কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, এটি যুল্ম। আর যুল্ম হারাম। তাছাড়া তা বিক্রেতার মাল। সুতরাং ক্রেতা-বিক্রেতা ঐকমত্য পোষণ করলে বিক্রেতাকে তার মাল বিক্রি করা থেকে নিষেধ করা জায়েয নয়’ (আল-মুগনী, ৬/৪১২ পৃ.)। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলিমগণ বলেন, ‘যখন বিক্রেতারা ও অন্যরা তাদের পণ্যের দাম তাদের ইচ্ছামত বৃদ্ধি করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করবে, তখন ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাঝে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা এবং জনসাধারণের কল্যাণ করা ও ফিতনা-ফাসাদ দূর করার উদ্দেশ্যে সাধারণ নিয়মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান বিক্রেয় দ্রব্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করবেন। আর যদি তাদের মধ্যে ঐকমত্য না হয়, বরং কোন প্রকার প্রতারণা ছাড়াই পর্যাপ্ত চাহিদা ও পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ কম হওয়ার কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য মূল্য নির্ধারণ করা উচিত নয়। বরং তিনি প্রজাদেরকে এমনভাবে ছেড়ে দেবেন যে, আল্লাহ তাদের কারো দ্বারা কাউকে রিযিক্ব দিবেন’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১৩/১৮৬ পৃ.)।
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘মূল্য নির্ধারণ ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না’ (কিতাবুল মাজমূঊ, ১২/১২১; আত-তুরুকুল হুকুমিইয়াহ ফিস সিয়াসাতিশ শারঈয়্যাহ, ১/২২২ পৃ.)। শায়খ ছালিহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘কোন মানুষ যদি বিশ্বাস করে যে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা একমাত্র সরকারের হাতে, তাহলে সে যেন নিজের আক্বীদাকে সংশোধন করে এবং তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করে’। তিনি আরো বলেছেন, ‘পণ্যের স্বল্পতা ও সরবরাহ কম হওয়ার কারণে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে এতে কারো কিছুই করার নেই। তবে ব্যবসায়ীদেরকে বলা হবে, মানুষেরা যে দামে বিক্রি করছে সে বাজার মূল্যে তোমরা বিক্রি কর। মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। পক্ষান্তরে মাল গুদামজাত করার কারণে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে যদি মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে পণ্যের কৃত্রিম ঘাটতি করে যদি তারা বেশি দামে মাল বিক্রি করে, তাহলে শাসক এতে হস্তক্ষেপ করবেন। মানুষেরা যে দামে বিক্রি করছে সে দামে বিক্রি করতে তিনি তাদেরকে বাধ্য করবেন। এটাই আদল বা ন্যায়-নীতি’ (af.org.sa/en/node/14702)।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দু’টি বিষয় পরিলক্ষিত হয়, প্রথমতঃ একথা পরিষ্কার যে, ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর হুকুমেই ঘটে থাকে। কারণ দ্রব্যমূল্যে নির্ভর করে উৎপাদনের উপরে। আর উৎপাদন কমবেশি করার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলাই। তবে আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো কতিপয় বান্দার কর্মকে কিছু ঘটনা ঘটার কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। বান্দাদের যুলমের কারণে তিনি কখনো মূল্যবৃদ্ধি করেন এবং কখনো কিছু মানুষের ইহসানের কারণে মূল্যহ্রাস করেন। দ্বিতীয়তঃ এটিও পরিষ্কার যে, স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্রের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা বৈধ নয়। তবে যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি হতে পারে। তাই সিন্ডিকেট ছাড়াই হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে বান্দার উচিত সকল প্রকার পাপকর্ম বর্জন করে তাওবাহ-ইস্তিগফার করা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা ও আল্লাহর উপর ভরসা করা।
- মাসিক আল ইখলাস, নভেম্বর ২০২২