তাহকীক-তাখরীজসহ ও সম্পাদিত ‘ফাযায়েলে আমাল’ নামক কিতাবের ভূমিকাতেই ধোঁকাবাজি

  • Thread Author
ভূমিকা: সম্প্রতি ‘দারুল ফিকর’ নামক একটি প্রকাশনী থেকে তাবলীগ জামা’আতের মূল পাঠ্যপুস্তক ‘ফাযায়েলে আমাল’-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মূল লেখক হচ্ছেন, মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি। এটি উর্দু ভাষায় রচিত।

আমাদের জানা মতে, বইটি ইতঃপূর্বে বাংলা ভাষায় ‘তাবলীগী কুতুবখানা’ ও ‘দারুল কিতাব’ নামক দুটি প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল। আর সর্বশেষ ‘দারুল ফিকর’ নামক প্রকাশনী থেকে বইটি তাহকীক-তাখরীজসহ সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদে একদল আলেম অংশগ্রহণ করেছেন আর তাহকীক, তাখরীজ ও সার্বিক সম্পাদনা করেছেন মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী।

সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন যে, মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি রচিত তাবলীগ জামা’আতের মূল পাঠ্যপুস্তক ‘ফাযায়েলে আমাল’ একটি ব্যাপক বিতর্কিত কিতাব। এই বইতে বহু জাল ও যঈফ বর্ণনার পাশাপাশি অসংখ্য আজগুবি ও ঈমান বিধ্বংসী কিসসা-কাহিনী বিদ্যমান। আলিমগণ এসবের বহু সমালোচনা করেছেন।

এতদসত্ত্বেও তাবলীগ জামা’আতের দায়িত্বশীলরা এসব ভুলত্রুটি কখনোই সংশোধন করেননি। মারাত্মক ভুলত্রুটিসহকারে দীর্ঘদিন যাবৎ মসজিদে মসজিদে এই কিতাবের তালিম দেওয়া হচ্ছে।

অবশেষে ‘দারুল ফিকর’ নামক প্রকাশনী থেকে ‘ফাযায়েল আমাল’ বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হলো। বইটি বের হওয়ার আগে তাহকীক ও তাখরীজের নাম দিয়ে বহু ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিল। যাই হোক, নতুন প্রকাশিত বইটি আমাদের হাতে এসেছে। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪৭। এই স্বল্প সময়ে পুরো বইটির পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়।

তবে আমরা সামান্য কিছু পৃষ্ঠা উলটিয়ে বেশ কয়েকটি খেয়ানত, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা দেখতে পেয়েছি। পুরো বইটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে এরূপ প্রতারণার সংখ্যা যে কত হতে পারে তার সঠিক হিসাব আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। আমরা ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে সেই ভুলসমূহের ব্যাপারে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

আজকে কেবল শুরুর একটি ভুল নিয়ে আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করছি। আর সেটা কি কেবলই ভুল নাকি খেয়ানত সেটা বিজ্ঞ পাঠকগণই বিবেচনা করবেন।
মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি তার উর্দু কিতাবের ভূমিকায় লিখেছেন:
حمد وصلوٰۃ کے بعد، مجد دین اسلام کے ایک درخشندہ جوہر اور علماء و مشائخ عصر کے ایک آبدار گوہر کا ارشاد ہے کہ تبلیغ دین کی ضرورت کے متعلق مختصر طور پر چند آیات واحادیث لکھ کر پیش کروں، چونکہ مجھ جیسے سیہ کار کے لئے ایسے ہی حضرات کی رضا و خوشنودی وسیلہ نجات اور کفارہ سیئات ہو سکتی ہے
দ্রষ্টব্য: ফাযায়েলে আমাল, ফাযায়েলে তাবলীগ, মাকতাবায়ে যিকরা, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৭১০

তাবলীগী কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত ‘ফাযায়েলে আমাল’-এর ভূমিকায় উপরিউক্ত অংশের যে অনুবাদ করা হয়েছে:
‘’আল্লাহ তায়ালার তারীফ ও প্রশংসা বা’দ ওলামায়ে কেরাম ছুফীকুল শিরোমণি, মোজাদ্দেদে দ্বীন, হজরত মাওলানা ইলিয়াছ (রহঃ) আমাকে আদেশ করেন যে, তাবলীগে দ্বীনের প্রয়োজন অনুসারে কোরআন ও হাদীছ অবলম্বনে যেন একটি সংক্ষিপ্ত বই লিখি। এত বড় বুজুর্গের সন্তুষ্টি বিধান আমার পরকালের নাজাতের উছিলা হইবে মনে করিয়া আমি উক্ত কাজে সচেষ্ট হই।‘’

দ্রষ্টব্য: ফাজায়েলে আ’মাল; অনুবাদ: মাওলানা মোঃ ছাখাওয়াত উল্লাহ (যাকারিয়া সাহারানপুরি কর্তৃক সরাসরি দোয়া ও এজাজত প্রাপ্ত এবং দিল্লী ও কাকরাইলের মুরুব্বিয়ানে কেরামের এজাজতে লিখিত); পৃষ্ঠা নং ৫; প্রকাশক: তাবলীগী ফাউন্ডেশন; পরিবেশক: তাবলীগী কুতুবখানা; প্রকাশকাল: সংশোধিত সংস্করণ, মার্চ ১৯৮৯

দারুল কিতাব থেকে প্রকাশিত ‘ফাযায়েলে আমাল’-এর ভূমিকায় উপরিউক্ত অংশের যে অনুবাদ করা হয়েছে:
‘’হামদ ও সালাতের পর। মুজাদ্দেদীনে ইসলাম ও যমানার ওলামা-মাশায়েখের উজ্জ্বল রত্ন (হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহঃ) আমাকে তবলীগে দ্বীনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আয়াত ও হাদীস লিখিয়া পেশ করিতে আদেশ করেন।

এইরূপ বুযুর্গগণের সন্তুষ্টি হাসিল করা আমার মতো গোনাহগারের জন্য গোনাহ-মাফী ও নাজাতের ওসীলা- এই আশায় দ্রুত রচনা করতঃ এই উপকারী কিতাবখানি খেদমতে পেশ করিতেছি।‘’

দ্রষ্টব্য: ফাযায়েলে আমাল; অনুবাদ: মুফতী মুহাম্মাদ উবাইদুল্লাহ; নজরে ছানী ও সম্পাদনা: হাফেজ মাওলানা যুবায়ের; মাওলানা রবিউল হক; পৃষ্ঠা নং ৭; প্রকাশক: দারুল কিতাব; প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০০১

এরপর এখন পর্যন্ত সর্বশেষ অনুবাদ- যেটা ‘দারুল ফিকর’ থেকে বের হয়েছে। এর ভূমিকা ও ফাজায়েলে তাবলীগ অংশের অনুবাদ করেছেন মাওলানা আমিরুল ইসলাম লোকমান। আর এই অংশের তাহকীক-তাখরীজ করেছেন মাওলানা আহমাদ ইউসুফ শরীফ ও মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী। আর পুরো বইটির সম্পাদক হিসাবে রয়েছেন মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী। আসুন এখন আমরা তাদের অনুবাদে নজর দেই:

‘’হামদ ও সানার পর। মুজাদ্দিদে দ্বীন ও সমকালীন উলামা-মাশায়েখের মাথার মুকুট (হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রহ.) ইসলাম প্রচারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু আয়াত ও হাদীস একত্রিত করে উপস্থাপন করার আদেশ করেন।

যেহেতু আমার মতো গুনাহগারের জন্য এমন মহামনীষী ও আল্লাহওয়ালাদের আদেশ পালন নাজাতের মাধ্যম ও গুনাহ থেকে মুক্তির উসিলা হতে পারে…।‘’

দ্রষ্টব্য: ফাযায়েলে আমাল; অনুবাদ: মাওলানা আমিরুল ইসলাম লোকমান; তাহকীক-তাখরীজ সম্পাদনা: মাওলানা ইউসুফ ওবায়দী; মাওলানা আহমাদ ইউসুফ শরীফ; পৃষ্ঠা নং ১০; প্রকাশক: দারুল ফিকর; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সম্মানিত পাঠক! আপনারা মূল উর্দু কিতাবের লিখিত অংশ পড়েছেন। আপনাদের সুবিধার জন্য মূল অংশটুকু আবারো উল্লেখ করছি:
چونکہ مجھ جیسے سیہ کار کے لئے ایسے ہی حضرات کی رضا و خوشنودی وسیلہ نجات اور کفارہ سیئات ہو سکتی ہے
(চুকেঁ মুঝ জেয়সে সিয়া কার কে লিয়ে এয়সে হি হাযরাত কি রাযা ও খুশনূদী ওয়াসিলায়ে নাজাত অর কাফফারায়ে সাইয়েয়াত হো সাকতি হে)
সরল তরজমা: ‘’কারণ আমার মতো গুনাহগারের জন্য এমন হযরতদের সন্তুষ্টি ও খুশি নাজাতের উসিলা এবং গুনাহসমূহের কাফফারা হতে পারে।’’

সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা:

তিন তিনটি প্রকাশনীর কেউই অনুবাদের যথাযথ হক আদায় করেননি। বরং দারুল ফিকর থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ সংস্করণে বড় ধরনের আমানতের খেয়ানত করা হয়েছে। পূর্বের তাবলীগী কুতুবখানা ও দারুল কিতাব- উভয় প্রকাশনী ‘রাযা' ও 'খুশনূদী’ শব্দ দুটির যথাযথ অনুবাদ করলেও সর্বশেষ জালিয়াত প্রকাশনী এই শব্দ দুটি গায়েব করে দিয়েছে। ‘সন্তুষ্টি’ ও ‘খুশি’ শব্দ দুটির বদলে ‘আদেশ’ শব্দ আবিষ্কার করেছে। অথচ মূল উর্দু বইতে আদেশ শব্দের 'আ'-ও নেই। যা একটি স্পষ্ট ধোঁকাবাজি। জগতের কোন ডিকশনারিতে ‘রাযা’ বা ‘খুশনূদী’-এর অর্থ ‘আদেশ পালন’ করা হয়েছে তা আমরা ওই সকল অনুবাদক, তাহকীক-তাখরীজকারী ও সম্পাদকের নিকট জানতে চাই। আমাদের জানামতে, সম্পাদক সাহেব মাওলানা আব্দুল মালেকের দী---র্ঘদিনের শাগরেদ। এই কি যোগ্য শাগরেদের নমুনা! আর এটাই কি গুরুর খেয়ানতের শিক্ষা!

মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব তার উর্দু কিতাবের ভূমিকাতে স্পষ্টভাবেই বইটি লেখার উদ্দেশ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধলভী তাকে ফাজায়েল সম্পর্কে একটি বই লেখার নির্দেশ দেন। আর যাকারিয়া সাহারানপুরি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর সন্তুষ্টি ও খুশনূদী পাওয়ার আশায় বই সংকলন করেন।

যদিও কোনো ব্যক্তির সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় কোনোকিছু করা সম্পর্কে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। ইতঃপূর্বে সালাফী আলিমগণ এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন। আর উলামায়ে দেওবন্দ সেসবের জবাব দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উলামায়ে দেওবন্দের কেউই সন্তুষ্টি অর্জনের বর্ণনাকে অস্বীকার করেননি। 'সন্তুষ্টি অর্জনের' বর্ণনাটি সালাফী ও দেওবন্দী সকলের নিকটেই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

'দারুল ফিকর' থেকে প্রকাশিত 'ফাযায়েলে আমাল'-এর অনুবাদক, সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মাওলানা যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেব যে উদ্দেশ্যে কিতাব লিখেছেন সেই মূল উদ্দেশ্যকে বেমালুম গায়েব করে দেওয়ার মাধ্যমে কিতাব লেখার মূল উদ্দেশ্যই পালটে দিয়েছেন। সম্ভবত! 'সন্তুষ্টি অর্জনের' আপত্তি থেকে যাকারিয়া সাহারানপুরি সাহেবকে বাঁচানোর জন্যই তারা এই কাজটি করেছেন।

আর এটা জালিয়াতি, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও কিতাবের সুস্পষ্ট বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন কথা হচ্ছে, এত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশিত তাহকীক-তাখরীজ ও সম্পাদিত 'ফাযায়েলে আমালের' ভূমিকাতেই যদি এত বড় জালিয়াতি থেকে থাকে তাহলে পুরো বইয়ে কী পরিমাণ জালিয়াতি করেছে সেটা সহজেই অনুমেয়।



লেখক: আনিসুর রহমান
কৃতজ্ঞতা: মুহাম্মাদ ওমর ফারুক মিল্কি
সম্পাদনা: মুহাম্মাদ মাহিন আলম​
 

Attachments

  • তাহকীক-তাখরীজ.webp
    তাহকীক-তাখরীজ.webp
    66.3 KB · Views: 588
Back
Top