সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।
Mahmud ibn Shahidullah

প্রবন্ধ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
LV
10
 
Awards
18
Credit
3,455
১ম আলোচ্য বিষয়: জিহাদের পরিচয়*

শাব্দিক অর্থ হল: সাধ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী কথা অথবা কর্মের দ্বারা জিহাদ করা।[১]
পরিভাষায়: কাফের, সীমালংকারী এবং ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সাধ্য অনুযায়ী লড়াই (যুদ্ধ) করা।

২য় আলোচ্য বিষয়: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার হুকুম

আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ফরযে কিফায়া। যখন মুসলিমদের মধ্যে থেকে কেউ এই দায়িত্ব পালন করবে তখন অবশিষ্ট ব্যক্তিরা পাপমুক্ত হবে।[২] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَا کَانَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لِیَنۡفِرُوۡا کَآفَّۃً ؕ فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡہُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّہُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَہُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡہِمۡ لَعَلَّہُمۡ یَحۡذَرُوۡنَ.​

‘আর মুমিনদের এটাও সমীচীন নয় যে, (জিহাদের জন্য) সবাই একত্রে বের হয়ে পড়ে; সুতরাং এমন কেন করা হয় না যে, তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল বহির্গত হয়, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে পারে, আর যাতে তারা নিজ কওমকে (নাফারমানী হতে) ভয় প্রদর্শন করে যখন তারা ওদের নিকট প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা সতর্ক হয়’ (সূরা আত-তাওবাহ: ১২২)। তবে তিন অবস্থায় জিহাদ করা ফরযে আইন হবে। যথা:

প্রথমতঃ যখন মুসলিম ব্যক্তি যুদ্ধে উপস্থিত হয় এবং উভয় দল ও উভয় কাতার সামনাসামনি মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ​

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর এবং অবিচল থাকবে যখন কোন দলের সম্মুখীন হও, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে’ (সূরা আল-আনফাল: ৪৫)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে যে,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا زَحۡفًا فَلَا تُوَلُّوۡہُمُ الۡاَدۡبَارَ - وَ مَنۡ یُّوَلِّہِمۡ یَوۡمَئِذٍ دُبُرَہٗۤ اِلَّا مُتَحَرِّفًا لِّقِتَالٍ اَوۡ مُتَحَیِّزًا اِلٰی فِئَۃٍ فَقَدۡ بَآءَ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ مَاۡوٰىہُ جَہَنَّمُ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ.​

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কাফির বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন তাদের মুকাবিলা করা হতে কখনোই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। আর সেদিন যুদ্ধ কৌশল বা স্বীয় বাহিনীর কেন্দ্রস্থলে স্থান নেয়া ব্যতীত কেঊ তাদের থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে অর্থাৎ পালিয়ে গেলে সে আল্লাহর গযবে পরিবেষ্টিত হবে, তার আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম, আর জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট স্থান’ (সূরা আল-আনফাল: ১৫-১৬)। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উল্লেখ করেছেন যে, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তুর একটি। হাদীসটি নি¤œরূপ:

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ اجْتَنِبُوْا السَّبْعَ الْمُوْبِقَاتِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ وَالتَّوَلِّيْ يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ.​

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সেগুলো কী? তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা (২) যাদু (৩) আল্লাহ তা‘আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, শরী‘আতসম্মত কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করা (৪) সূদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের মাল গ্রাস করা (৬) রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরল স্বভাবা নেককার মুমিনাদের অপবাদ দেয়া।[৩]

দ্বিতীয়তঃ যখন শত্রুদল মুসলিমদের কোন শহরে উপস্থিত হয় তখন ঐ শহরবাসীর উপর ফরযে আইন হয়ে যায় যে, তারা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে এবং তাদেরকে ঐ শহর থেকে তাড়িয়ে দিবে। তবে ঐ শহরবাসী যদি তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে অক্ষম হয় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা অনন্যা মুসলিমদের উপর আবশ্যক হয়ে যায়। এই ওয়াজিব বিধানের ধারাবাহিকতা নিকটতম এলাকা তারপর নিকটতমভাবে চলমান থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قَاتِلُوا الَّذِیۡنَ یَلُوۡنَکُمۡ مِّنَ الۡکُفَّارِ وَ لۡیَجِدُوۡا فِیۡکُمۡ غِلۡظَۃً ؕ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ.​

‘হে মুমিনগণ! ঐ কাফিরদের সাথে যুদ্ধ কর যারা তোমাদের আশেপাশে অবস্থান করছে, যেন তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা খুঁজে পায়; আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ পরহেযগারদের সাথে রয়েছেন’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১২৩)।

তৃতীয়তঃ যখন মুসলিমদের ইমাম মানুষদেরকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানাবে এবং তাদের থেকে উপস্থিতি কামনা করবে (তখন তাদের জন্য যুদ্ধে অংশ নেয়া ফরযে আইন)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنۡفِرُوۡا خِفَافًا وَّ ثِقَالًا وَّ جَاہِدُوۡا بِاَمۡوَالِکُمۡ وَ اَنۡفُسِکُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ.​

‘অভিযানে বের হও স্বল্প সরঞ্জামের সাথেই হোক, অথবা প্রচুর সরঞ্জামের সাথেই হোক এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও প্রাণ দ্বারা যুদ্ধ কর। এটাই তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৪১)।

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَا هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوْا.​

ইবনু ‘আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘(মক্কা) বিজয়ের পর আর হিজরত নেই। বরং রয়েছে কেবল জিহাদ ও নিয়ত। যখন তোমাদের জিহাদের ডাক দেয়া হয়, তখন বেরিয়ে পড়...।[৪] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَا لَکُمۡ اِذَا قِیۡلَ لَکُمُ انۡفِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اثَّاقَلۡتُمۡ اِلَی الۡاَرۡضِ ؕ اَرَضِیۡتُمۡ بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا قَلِیۡلٌ .​

‘হে মুমিনগণ! তোমাদের কী হল যে, যখন তোমাদেরকে বলা হয়, বের হও আল্লাহর পথে, তখন তোমরা মাটিতে লেগে থাক (অলসভাবে বসে থাক)। তাহলে কি তোমরা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনের উপর পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? বস্তুত পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাসিতা আখিরাতের তুলনায় কিছুই নয়, অতি সামান্য’ (সূরা আত-তাওবাহ : ৩৮)।

মূলত জিহাদ হল ফরযে আইন: সেটা হতে পারে অন্তর দিয়ে, হতে পারে মুখ দিয়ে, হতে পারে সম্পদ দিয়ে কিংবা হাত দিয়ে। সুতরাং মুসলিমদের উপর আবশ্যক হল, সে তার ক্ষমতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এ সকল প্রকারের কোন একটির মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। জান ও মাল তথা সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার নির্দেশ আল-কুরআন ও হাদীসে অনেক বর্ণিত হয়েছে। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِيْنَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্পদ, জীবন ও কথার দ্বারা জিহাদ কর’।[৫]

৩য় আলোচ্য বিষয়: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের স্তরসমূহ

জিহাদের স্তর চারটি। যথা : ১- নিজ নফস তথা আত্মার বিরুদ্ধে জিহাদ করা। ২- শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। ৩- কাফের এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং ৪- যালিম, বিদ‘আতী ও খারাপ কাজকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

প্রথমতঃ নিজ নফস তথা নিজের সাথে জিহাদের চারটি স্তর। যথা:

১- যে দ্বীন ও হেদায়াত ছাড়া অন্তরের সফলতা নেই এবং জীবন-যাপনে কোন সুখ-শান্তি নেই, সে দ্বীন এবং হেদায়াতের যাবতীয় বিষয়াবলী জানার ক্ষেত্রে অন্তরের সাথে জিহাদ করা।

২- ইলম অর্জনের পর তথা দ্বীন এবং হেদায়াতের যাবতীয় বিষয়াবলী জানার পরে তদনুযায়ী আমল করার জন্য অন্তরের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। অন্যথা আমল ছাড়া ইলমের ক্ষতি না থাকলেও কোন উপকার নেই।

৩- বিচক্ষণতার সাথে দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া এবং যে জানে না তাকে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। অন্যথা সে ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত হবে যারা আল্লাহর প্রেরিত হেদায়াত এবং সুস্পষ্ট বিষয়াবলীকে গোপন করে। সুতরাং তার ইলম তাকে উপকার করতে পারবে না এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষাও করতে পারবে না।

৪- আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার কষ্টে এবং সৃষ্টি জীবের দেয়া কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করার ক্ষেত্রে এবং সমস্ত কিছু আল্লাহর নিমিত্তে করতে অন্তরের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

দ্বিতীয়তঃ শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করার দু’টি স্তর

১- শয়তান ঈমানের ক্ষেত্রে বান্দার দিকে যে সমস্ত নিকৃষ্ট সংশয়-সন্দেহ নিক্ষেপ করে। তা প্রতিহত করতে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

২- শয়তান যে সমস্ত খারাপ আকাক্সক্ষা এবং প্রবৃত্তি বান্দার দিকে নিক্ষেপ করে তা প্রতিহত করতে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা।

সুতরাং প্রথম জিহাদটি দৃড় বিশ্বাসের পরে হবে। আর দ্বিতীয় জিহাটি ধৈর্যধারণের পর হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ جَعَلۡنَا مِنۡہُمۡ اَئِمَّۃً یَّہۡدُوۡنَ بِاَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُوۡا ۟ؕ وَ کَانُوۡا بِاٰیٰتِنَا یُوۡقِنُوۡنَ​

‘আর আমরা তাদের মধ্য হতে নেতা মনোনীত করেছিলাম যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত। যখন তারা ধৈর্যধারণ করত তখন তারা ছিল আমার নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী’ (সূরা আস-সাজদাহ : ২৪)। আর শয়তান সকল শত্রুর চেয়ে বেশি অনিষ্টকর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡہُ عَدُوًّا ؕ اِنَّمَا یَدۡعُوۡا حِزۡبَہٗ لِیَکُوۡنُوۡا مِنۡ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ.​

‘শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তোমরা তাকে শত্রু হিসাবে গ্রহণ কর। সে তো তার দলবলকে আহ্বান করে শুধু এ জন্য যে, তারা যেন উত্তপ্ত জাহান্নামের সাথী হয়’ (সূরা আল-ফাত্বির : ৬)।

তৃতীয়তঃ কাফের এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার চারটি স্তর : ক- অন্তর দিয়ে। খ- জিহ্বা দিয়ে। গ- মাল বা সম্পদ দিয়ে এবং ঘ- হাত দিয়ে। কাফেরদের সাথে হাত দিয়ে এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহ্বা দিয়ে জিহাদ করতে হবে।

চতুর্থতঃ জালিম, বিদ‘আতী, সীমালঙ্গনকারী ও খারাপ কাজকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার তিনটি স্তর। যথা:

ক. হাত দিয়ে, যদি জিহাদকারী সক্ষম হয়

খ. মুখ দিয়ে, যদি জিহাদকারী হাত দিয়ে জিহাদ করতে সক্ষম না হয়।

গ- অন্তর দিয়ে, জিহাদকারী যদি উপরের দু’টিতে অক্ষম হয়। আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,

مَنْ رَأى مِنْكُمْ مُنْكَراً فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أضْعَفُ الإيْمَانِ.​

‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন শরী‘আত বিরোধী কার্যকলাপ হতে দেখে, সেটাকে যেন নিজ হাতে পরিবর্তন করে দেয়। যদি নিজ হাতে সেগুলো পরিবর্তন করতে সক্ষম না হয়, তাহলে মুখ দিয়ে নিষেধ (করার মাধ্যমে পরিবর্তন) করবে। আর যদি মুখ দিয়ে (নিষেধ করার মাধ্যমে) সেগুলো পরিবর্তন করতে সক্ষম না হয়, তাহলে অন্তরে সেটা ঘৃণা করবে। আর এটাই হল সবচেয়ে দুর্বল ঈমান’।[৬]

এই হল জিহাদের মোট ১৩ টি স্তর। আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ মুমিন ঐ ব্যক্তি, যে জিহাদের এ সকল প্রকারকে নিজের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে। জিহাদের স্তরগুলো পালনের ক্ষেত্রে তারতম্য করার কারণে আল্লাহর নিকট মানুষেরও মর্যাদার তারতম্য হবে। এই কারণেই সৃষ্টি জগতের পরিপূর্ণ মুমিন এবং আল্লাহর নিকট সম্মানিত ব্যক্তি হলেন সর্বশেষ নবী এবং রাসূল মুহাম্মদ (ﷺ)। কেননা তিনি নিজের মাঝে সকল প্রকারের জিহাদ অন্তর্ভুক্ত করেছেন (সব রকমের জিহাদ তিনি করেছেন) এবং তিনি আল্লাহর পথে উপযুক্তভাবে জিহাদ করেছেন। সুতরাং যতদিন দিনরাত আবর্তিত হবে ততদিন তার ওপর সালাত এবং সালাম বর্ষিত হোক।

কখনো কখনো আল্লাহর বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বান্দার নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করার শাখা হিসাবে গণ্য হয়।

عَنْ فَضَالَةَ بن عُبَيْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فِيْ حَجَّةِ الْوَدَاعِ أَلا أُخْبِرُكُمْ بِالْمُؤْمِنِ؟ مَنْ أَمِنَهُ النَّاسُ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَالْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُوْنَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ فِيْ طَاعَةِ اللهِ وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ الْخَطَايَا وَالذُّنُوْبَ.​

ফাযালাহ ইবনু উবাইদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বিদায় হজ্জে বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব না যে, মুমিন কে? (প্রকৃত মুমিন হল সেই), যার (অত্যাচার) থেকে লোকেরা নিজেদের জান-মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করতে পারে। (প্রকৃত) মুসলিম হল সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত হতে লোকেরা শান্তি লাভ করতে পারে। (প্রকৃত) মুজাহিদ হল সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর আনুগত্য করতে নিজের মনের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। আর (প্রকৃত) মুহাজির (হিজরতকারী) হল সেই ব্যক্তি, যে সমস্ত পাপাচারকে ত্যাগ করে’।[৭] এমতাবস্থায় আল্লাহর বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার চেয়ে নিজ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অধিক উপযুক্ত হবে। সুতরাং যতক্ষণ না সে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালনার্থে এবং যা নিষেধ করেছেন তা বর্জনার্থে নিজ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মার বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সক্ষম হবে না। (প্রশ্ন হতে পারে) কিভাবে সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে সক্ষম হবে? তার দু’পাঁজরের মাঝে যে শত্রু রয়েছে (নফস) সে তো তার ওপর ক্ষমতাবান ও বিজয়ী হয়েই আছে। যতক্ষণ না সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য নিজ নফসের বিরুদ্ধে আগে জিহাদ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে বহিরাগত শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে বের হাতে সক্ষম হবে না। এই হল দুই শত্রু (নফস ও অমুসলিম মানুষ)-এর মাঝে তৃতীয় আরো এক শত্রু রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা ছাড়া কোন বান্দা এই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারবে না। সে উভয়ের মাঝে অবস্থান করে বান্দাকে উভয়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে বাধা প্রদান করে, ভয় দেখায় এবং নিরাশ করে। সে বান্দাকে সর্বদাই ভয় দেখায় এভাবে যে, উভয়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে অনেক কষ্ট, আনন্দহীনতা এবং প্রবৃত্তিহীনতা রয়েছে। তাই কোন বান্দা এই তৃতীয় প্রকারের শত্রুর বিরুদ্ধে আগে জিহাদ করা ছাড়া আগের দুই প্রকারের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সক্ষম হয় না। আর এই তৃতীয় প্রকারের শত্রু হল শয়তান।

৪র্থ আলোচ্য বিষয়: জিহাদ শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত

আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তিনি স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

وَ قَاتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّ یَکُوۡنَ الدِّیۡنُ کُلُّہٗ لِلّٰہِ ۚ فَاِنِ انۡتَہَوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ.​

‘তোমরা সদা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তারা যদি ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হতে বিরত থাকে তাহলে তারা কী করেছে তা আল্লাহই দেখবেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৩৯)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ قٰتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّ یَکُوۡنَ الدِّیۡنُ لِلّٰہِ ؕ فَاِنِ انۡتَہَوۡا فَلَا عُدۡوَانَ اِلَّا عَلَی الظّٰلِمِیۡنَ.​

‘ফিতনা দূর হয়ে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর; অতঃপর যদি তারা নিবৃত্ত হয় তাহলে অত্যাচারীদের উপর ব্যতীত শত্রুতা নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৩)।

উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, নি¤েœর বিষয়ই হল জিহাদ ফী সাবিলিল্লার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যথা:

১- আল্লাহ তা‘আলার বাণীকে সমুন্নত ও উঁচু করা

হাদীসে এসেছে, আবূ মূসা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ، الرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلْمَغْنَمِ وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلذِّكْرِ وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِيُرَى مَكَانُهُ فَمَنْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ قَالَ مَنْ قَاتَلَ لِتَكُوْنَ كَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ.​

‘জনৈক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এক ব্যক্তি গনীমতের জন্য, এক ব্যক্তি প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য এবং এক ব্যক্তি বীরত্ব দেখানোর জন্য জিহাদে শরীক হলো। তাদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করল? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কালিমা সুউচ্চ থাকার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করল, সেই আল্লাহর পথে জিহাদ করল।[৮]

২- মাযলূম বা অত্যাচারিত ও নিপীড়িতদের সাহায্য করা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَا لَکُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ ہٰذِہِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَہۡلُہَا ۚ وَ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ وَلِیًّا ۚۙ وَّ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ نَصِیۡرًا .​

‘তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছ না? অথচ নারী, পুরুষ এবং শিশুদের মধ্যে যারা দুর্বল তারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে অত্যাচারী এই নগর হতে নিষ্কৃতি দিন এবং স্বীয় সন্নিধান হতে আমাদের পৃষ্ঠপোষক ও নিজের নিকট হতে আমাদের জন্য সাহায্যকারী প্রেরণ করুন’ (সূরা আন-নিসা : ৭৫)।

৩- ইসলামের শত্রুদের প্রতিহত করা এবং ইসলাম রক্ষা করা

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلشَّہۡرُ الۡحَرَامُ بِالشَّہۡرِ الۡحَرَامِ وَ الۡحُرُمٰتُ قِصَاصٌ ؕ فَمَنِ اعۡتَدٰی عَلَیۡکُمۡ فَاعۡتَدُوۡا عَلَیۡہِ بِمِثۡلِ مَا اعۡتَدٰی عَلَیۡکُمۡ ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ.​

‘নিষিদ্ধ মাসের পরিবর্তে নিষিদ্ধ মাস ও সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় পরস্পর সমান; অতঃপর যে কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করে, তাহলে সে তোমাদের প্রতি যেরূপ অত্যাচার করবে তোমরাও তার প্রতি সেরূপ অত্যাচার কর এবং আল্লাহকে ভয় কর ও জেনে রেখ যে, আল্লাহ সংযমশীলদের সঙ্গী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,

الَّذِیۡنَ اُخۡرِجُوۡا مِنۡ دِیَارِہِمۡ بِغَیۡرِ حَقٍّ اِلَّاۤ اَنۡ یَّقُوۡلُوۡا رَبُّنَا اللّٰہُ ؕ وَ لَوۡ لَا دَفۡعُ اللّٰہِ النَّاسَ بَعۡضَہُمۡ بِبَعۡضٍ لَّہُدِّمَتۡ صَوَامِعُ وَ بِیَعٌ وَّ صَلَوٰتٌ وَّ مَسٰجِدُ یُذۡکَرُ فِیۡہَا اسۡمُ اللّٰہِ کَثِیۡرًا ؕ وَ لَیَنۡصُرَنَّ اللّٰہُ مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ.​

‘তাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী হতে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ! আল্লাহ যদি মানব জাতির একদলকে অন্যদল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খিস্টান, সংসার বিরাগীদের উপাসনা স্থল, গীর্জা, ইয়াহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ, যাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম; নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে নিজকে সাহায্য করে; নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (সূরা আল-হজ্জ : ৪০)।


[১]. আন-নিহায়াতু ফী গারীবিল হাদীস নিইবনি আছীর, ১ম খ-, পৃ. ৩১৯।
[২]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ১৩।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/২৭৬৬; মিশকাত, হা/৫২।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৩৪; সহীহ মুসলিম, হা/১৩৫৩; মিশকাত, হা/২৭১৫।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/২৫০৪; মিশকাত, হা/৩৮২১, সনদ সহীহ।
[৬]. সহীহ মুসলিম, হা/৪৯; ইবনু মাজাহ, হা/৪০১৩; মিশকাত, হা/৫১৩৭।
[৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪০০৪; মিশকাত, হা/৩৩-৩৪, সনদ সহীহ।
[৮]. সহীহ বুখারী, হা/২৮১০; সহীহ মুসলিম, হা/১৯০৪; মিশকাত, হা/৩৮১৪।



- মূল: ড. সাঈদ ইবনু আলী ইবনু ওয়াহহাফ আল-ক্বাহতানী

- অনুবাদ : মুহাম্মদ ইমরান বিন ইদরিস*

 
Last edited:

Create an account or login to comment

You must be a member in order to leave a comment

Create account

Create an account on our community. It's easy!

Log in

Already have an account? Log in here.

Total Threads
13,348Threads
Total Messages
17,188Comments
Total Members
3,677Members
Latest Messages
Tanvir Bin MofirulLatest member
Top