ইতিপূর্বে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, সাত আসমান এবং পৃথিবীর সাত স্তর সম্পর্কে কুরআনের নিদর্শন এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণায় কি আছে তা আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচ্য নিবন্ধে আমরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব তা হ’ল আল্লাহ তা‘আলা আসমানকে কিভাবে পৃথিবীর ছাদ হিসাবে স্থাপন করেছেন, নিদ্রাকে কেন বিশ্রামের জন্য নির্ধারণ করেছেন, অন্ধকার কেন ঘুমানোর জন্য প্রয়োজনীয়, রাত দ্বারা কিভাবে পৃথিবীর নিরাপত্তা প্রদান করেছেন, পৃথিবীই কেন একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ এবং পৃথিবীর বাইরে প্রাণী থাকা সম্ভব কি-না? এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা কুরআনের বক্তব্য এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য পেশ করব ইনশাআল্লাহ।
আসমান হ’ল সুরক্ষিত ছাদ :
আল্লাহ বলেন,
‘আর আমরা আকাশকে সুরক্ষিত ছাদে পরিণত করেছি’ (আম্বিয়া ২১/৩২)।
যেকোন ভবনের একটা ছাদ থাকে, যা ঐ ভবনকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক বস্ত্ত এবং ক্ষতি হ’তে রক্ষা করে। যেমন রোদের তাপ, বৃষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হ’তে রক্ষা করে। ছাদ ভবনের নিরাপত্তা প্রদান করে।
আমাদের ভূমির উপরের অংশকে বলা হয় বায়ুমন্ডল। এই বায়ুমন্ডলে রয়েছে ৭৮% নাইট্রোজেন, ২১% অক্সিজেন আরোও অন্যান্য গ্যাস এবং সামান্য পরিমাণ জলীয় বাষ্প। আমাদের এই বায়ুমন্ডলের ভর প্রায় ৫.১৫×১০১৮ কেজি।[1]
এই বায়ুমন্ডলের রয়েছে ৫টি স্তর। যথাঃ এক্সোস্ফেয়ার, থার্মোস্ফেয়ার, মেসোস্ফেয়ার, স্ট্রেটোস্ফেয়ার, ট্রপোস্ফেয়ার।
১ম স্তর হ’ল ট্রপোস্ফেয়ার, যা উপরের দিকে ৮-১৬ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে ৪ঃ১ আয়তন অনুপাতে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন অণু, জলীয় বাষ্প, কার্বনডাই অক্সাইড, ধুলিকণা এবং অন্যান্য কিছু গ্যাস। এই স্তর মূলতঃ ভূ-পৃষ্ঠের তাপ রক্ষায় কম্বলের মত কাজ করে। যদি এই স্তর না থাকতো তবে রাতের বেলা পৃথিবী হ’তে সকল তাপ বের হয়ে যেত। ফলে পৃথিবী অত্যধিক ঠান্ডা হয়ে যেত এবং বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ত। ট্রপোস্ফেয়ারের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘গ্রীণ হাউস ইফেক্ট’।
এই স্তরের উপরের স্তরের নাম হ’ল স্ট্রেটোস্ফেয়ার, যা উপরের দিকে ৭০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের রয়েছে ওজোন নামের একটি পদার্থ, যা তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর দ্বারা গঠিত। এটা সূর্য হ’তে আগত অতিবেগুনী রশ্মি এবং এক্স-রেকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়। ফলে সম্পূর্ণ জীবজগত এই রশ্মির ক্ষতি হ’তে রক্ষা পায়।
এই স্তরের উপরের স্তরের নাম হ’ল মেসোস্ফেয়ার, যা উপরের দিকে ৫০ কি.মি. থেকে ৮০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশের তাপমাত্রা -৮৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পৃথিবীর মেঘমালা এই স্তরে বিদ্যমান থাকে, যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। এই অংশ পৃথিবীতে কোন উল্কা প্রবেশের চেষ্টা করলে তা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে রক্ষা করে।
এর উপরে রয়েছে থার্মোস্ফেয়ার, যা ৮০ কি.মি. থেকে ৭০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের নীচের অংশে রয়েছে আয়োনোস্ফেয়ার। এই অংশে কোন ধরনের মেঘ বা জলীয় বাষ্প থাকে না।
এর উপরে রয়েছে এক্সোস্ফেয়ার, যা ৭০০ কি.মি. থেকে ১০,০০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তর হ’ল বায়ুমন্ডলের সর্বশেষ স্তর, যা অতিক্রম করলেই যেকোন বস্ত্ত মহাশূন্যে চলে যায়।[2]
উপরের NASA প্রদত্ত তথ্যের আলোকে বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা যদি ছাদ হিসাবে আসমানে এই বায়ুমন্ডল তৈরী না করতেন, তবে পৃথিবীর সকল প্রাণী এবং গাছপালার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হ’ত না। দিনের বেলা সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মিসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক রশ্মির প্রভাব এবং রাতের বেলা অত্যধিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় বসবাসের জন্য এই পৃথিবী অযোগ্য হয়ে যেত। যদি এই বায়ুমন্ডল না থাকত তবে পাখির আকাশে উড়া সম্ভব হ’ত না, সমুদ্রের পানি ফুলেফেপে উঠতো। আল্লাহ প্রদত্ত এই ছাদ পুরো পৃথিবীকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হ’তে রক্ষা করছে। তাই আমাদের এই সৃষ্টির রহস্য জানার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বেশী বেশী ইবাদত করতে হবে।
নিদ্রা দ্বারা বিশ্রামের বৈজ্ঞানিক তথ্য :
১৯৫০ সালের পূর্বে মানুষ ধারণা করত যে, ঘুম হ’ল একটি নিষ্ক্রিয় কার্যকলাপ। এই সময় মানুষের শরীর এবং মস্তিষ্ক কোন কাজ করে না বরং সুপ্ত থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষকগণ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন যে, ঘুমন্ত অবস্থায় মস্তিষ্ক বিভিন্ন ধরনের কার্য সম্পাদন করে, যা জীবনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় (Johns Hopkins medicine)।
আল্লাহ বলেন,
‘এবং তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী’ (নাবা ৭৮/৯)।
নিদ্রা ব্যতীতও মানুষ কোন স্থানে শীতলতায় বসে বিশ্রাম নিতে পারে। এতেও শরীরের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হয়। আল্লাহ তা‘আলা সুনির্দিষ্টভাবে নিদ্রাকে বিশ্রাম বা ক্লান্তি দূর করার মাধ্যম বলার কারণ কি?
মানুষ ঘুমালে তার শরীরে নিম্নোক্ত কার্যক্রম সংঘটিত হয় :
১. যখন মানুষ ঘুমায়, তখন শরীরের Immune cell এবং প্রোটিন বিভিন্ন রোগবালাই যেমন ঠান্ডা, সর্দি ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিশ্রাম পায়।
২. পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোর ফলে শরীরে Ghrelin নামক হরমোনের বৃদ্ধি ঘটে যা ক্ষুধা বৃদ্ধি করে।
৩. পর্যাপ্ত ঘুম না হ’লে উচ্চ রক্তচাপ বা হার্ট অ্যাটাকের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা হ’তে পারে। অল্প ঘুমের কারণে Cortisol নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় যা হার্টের ক্রিয়া জটিল করে দেয়।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম মানুষের স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করে (OASH, Healthy Living)।
ঘুমের মাধ্যমে যখন আমরা বিশ্রাম গ্রহণ করি তখন আমাদের শরীরে উপরোক্ত কার্যাদি সম্পাদিত হওয়ার মাধ্যমে শরীর সুস্থ থাকে। জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘ঘুমানোর সময় তোমরা বাতি নিভিয়ে দাও’।[3]
ঘুমানোর জন্য অন্ধকার অতীব যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘুমানোর সময় বাতি নিভিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যেন অন্ধকার তৈরী হয়। এখন প্রশ্ন ঘুমানোর জন্য অন্ধকার কেন যরূরী?
মানুষের মস্তিষ্ক খুবই সংবেদনশীল। মস্তিষ্ক খুব সামান্য পরিমাণ আলোও বুঝতে পারে। যদি ঘুমানোর সময় অন্ধকার না থাকে, তবে মস্তিষ্ক মেলাটনিন নামক হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই মেলাটনিন হরমোন শরীরের Circadian rhythms (২৪ ঘণ্টার বায়োলজিকাল ঘড়ি) নিয়ন্ত্রণ করে।[4]
উপরোক্ত আলোচনা হ’তে বলা যায় যে, বিশ্রামের জন্য ঘুম অপরিহার্য এবং ঘুমের জন্য অন্ধকার অপরিহার্য। আমাদের অনেকে রাতের বেলা ডিমলাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে থাকে, যা পরিত্যাগ করা উচিত। যেহেতু মস্তিষ্ক সামান্য আলোতেই হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তাই ডিমলাইটের সামান্য আলোও পরিহার করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যে কাজ যখন যেভাবে করার নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যদি সে কাজ সেভাবে করি তবে আমরা দুনিয়াতেও উপকৃত হব এবং পরকালেও উত্তম প্রতিদান পাব।
রাত পৃথিবীতে বৈষয়িক নিরাপত্তা প্রদান করে :
আল্লাহ বলেন,
আমরা রাত্রিকে করেছি আবরণ’ (নাবা ৭৮/১০)।
لِبَاسًا -এর অর্থ বস্ত্র। আমরা পোষাক পরিধান করি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বা ঢেকে রাখার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাবার ১০নং আয়াতে রাতকে বস্ত্র বলার মাধ্যমে এটা বুঝিয়েছেন যে, রাত এই পৃথিবীকে নিরাপত্তা দেয় বা ঢেকে রাখে। এখন জানতে হবে রাত কিসের নিরাপত্তা দেয় বা কি ঢেকে রাখে?
বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছে যে, পৃথিবীর জন্য অন্ধকার যরূরী।
আমরা অনেক ধরনের দূষণের নাম শুনেছি। যেমন শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ ঠিক তেমনি একটা দূষণ হ’ল আলোর দূষণ।
আলোর দূষণ : আলো দ্বারা রাতের অন্ধকার নষ্ট হওয়াকে আলোর দূষণ বলে। মানুষের তৈরী আলোক উৎস আলোক দূষণের প্রধান কারণ। এটা বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে, পরিবেশে কার্বনডাই অক্সাইড বৃদ্ধি করে, মানুষের ঘুমকে ব্যাহত করে এবং আকাশের তারা অস্পষ্ট করে ফেলে।[5]
যে সকল কারণে পৃথিবীর অন্ধকার প্রয়োজন :
১. প্রাকৃতিক বাস্ত্ততন্ত্রের (Ecosystems) সঠিক কার্যকারিতার জন্য রাতের অন্ধকার গুরুত্বপূর্ণ।
২. Species migration অর্থাৎ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর Ecosystems এর কারণে এক স্থান হ’তে অন্য স্থানে গমন রাতের বেলা ঘটে।
৩. বিভিন্ন প্রাণীর Circadian rhythms (শারীরিক, মানসিক এবং আচরণগত পরিবর্তন) এর জন্য অন্ধকার প্রয়োজন।
৪. পৃথিবীতে যদি সবসময় সূর্যের আলো থাকত তবে পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্নিং বেড়ে যেত এবং পৃথিবী বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে যেত। রাতের অন্ধকার পৃথিবীর তাপমাত্রার মধ্যে সমতা আনে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীকে অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দেন যাতে পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রাণীরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারে।
অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি? বা অন্য গ্রহ মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য কি?
কুরআন হচ্ছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর। কুরআনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি, পরিচালনা এবং অবস্থার যে তথ্য দেওয়া আছে তা মানুষ এখনো সবগুলো বের করতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য খুঁজে বের করে এবং আমরা তা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাহায্যে যাচাই করে গ্রহণ করি। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা চিন্তাশীলদের নিকট নিদর্শন তুলে ধরেন মানুষকে তাওহীদ এবং পরকালের দিকে নিয়ে আসার জন্য। আললাহ বলেন,
‘নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টিতে, রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে এবং নৌযানসমূহে যা সাগরে চলাচল করে, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং বৃষ্টির মধ্যে, যা আল্লাহ আকাশ থেকে বর্ষণ করেন; অতঃপর তার মাধ্যমে মৃত যমীনকে পুনর্জীবিত করেন ও সেখানে সকল প্রকার জীব-জন্তুর বিস্তার ঘটান এবং বায়ু প্রবাহের উত্থান-পতনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে সঞ্চালিত মেঘমালার মধ্যে অবশ্যই জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহ রয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৬৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘আসমান ও যমীনে যত প্রাণী আছে, সবই আল্লাহকে সিজদা করে এবং ফেরেশতাগণ। আর তারা অহংকার করে না’ (নাহল ১৬/৪৯)।
আল্লাহ আরো বলেন,
‘তিনি কোন স্তম্ভ ছাড়াই আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন, যা তোমরা দেখছ। আর পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা যাতে তা তোমাদের নিয়ে হেলে না পড়ে এবং এর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জীব-জন্তু। আর আমরা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি। অতঃপর এতে উৎপন্ন করি সকল প্রকার সুন্দর উদ্ভিদ জোড়া’ (লোকমান ৩১/১০)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
‘আর ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিক আল্লাহর যিম্মায় নেই। আর তিনি জানেন তার বসবাস ও মৃত্যুর স্থান। সবকিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে (লওহে মাহফূযে) লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (হূদ ১১/৬)।
উপরের আয়াতগুলোতে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় : (১) الْأَرْضِ শব্দ দ্বারা সুনির্দিষ্ট যমীন উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সুনির্দিষ্ট যমীন হ’ল পৃথিবী। (২) এই যমীনে সকল প্রকার প্রাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন,
‘আমরা কি যমীনকে বিছানাস্বরূপ করিনি?’ (নাবা ৭৮/৬)।
উক্ত আয়াতে مهاد শব্দের অর্থ বিছানা, শয্যা, বিশ্রামের স্থান। আমরা বিছানা বা বিশ্রামের স্থান বলতে এমন স্থানকে বুঝি যে স্থানে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব, কেউ কোন প্রকার বিরক্ত করবে না। যেমন হাট-বাজার, যানবাহন, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কোনটিই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু এরপরও এ সকল স্থানে আমরা গমন করি আমাদের প্রয়োজনে। ঠিক তেমনিভাবে এই পৃথিবী হ’ল আমাদের জন্য একমাত্র শান্তিতে থাকার স্থান অর্থাৎ বসবাসের জন্য উপযোগী। এই পৃথিবীর বাইরে যত গ্রহ আছে তা মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী নয়। বিজ্ঞানীরা খুঁজে যাচ্ছেন মানুষের জন্য বাসযোগ্য গ্রহ পাওয়া যায় কি-না। যদিও অনেক বিজ্ঞানী এরূপ সম্ভব নয় বলে উক্ত কাজ থেকে বিরত রয়েছেন। ১৬শ’ শতাব্দীতে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রদান করেন যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে সকল কিছু ঘুরছে। এরপর থেকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে, এরূপ আরোও গ্রহ রয়েছে যাদের নিজস্ব সূর্য রয়েছে। এই গ্রহগুলোকে বলা হয় Exoplanets। এই এক্সোপ্লানেট সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৫ সালে। কিন্তু তা মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এবং বিজ্ঞানীরা যে নীতির মাধ্যমে বাসযোগ্য গ্রহ সন্ধান করেন তা ‘Goldilocks’ নামে পরিচিত। এটি এমন একটি পদ্ধতি যার মানে হ’ল এমন গ্রহের সন্ধান করা যেখানে উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য পানি বিদ্যমান এবং এই পানি অধিক ঠান্ডাও নয়, অধিক গরমও নয়। (Exoplanet, NASA) একটি বাসযোগ্য গ্রহের সঠিক তাপমাত্রা, বায়ুমন্ডল এবং নক্ষত্রের চারপাশে ঘুর্ণনের জন্য কক্ষপথ থাকতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণে এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু কোনটিই মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। উদাহরণস্বরূপ কেপলার ১০বি, অন্য সৌরজগতের একটি এক্সোপ্ল্যানেট যা পৃথিবীর আকারের কাছাকাছি। কিন্তু এটি এর নক্ষত্রের বা সূর্যের খুব কাছাকাছি হওয়াতে তা বসবাসের উপযোগী নয়।
২০১৫ সালে বিজ্ঞানীরা কেপলার-৪৫২বি আবিষ্কার করেছিলেন, পৃথিবীর কাছাকাছি আকারের আরেকটি গ্রহ যা আমাদের মতো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং এই গ্রহে ২০দিনে এক বছর হয়। যদিও এর তাপমাত্রা পৃথিবীর চেয়ে সামান্য বেশী। তবে গ্রহটি সম্পূর্ণরূপে আগ্নেয়গিরিতে আচ্ছাদিত বলে মনে করা হয়।
সম্প্রতি নাসা একটি এক্সোপ্লানেটের সন্ধান পেয়েছে, যার নাম TOI 700 e। তাদের দাবী এই এক্সোপ্লানেটের সাইজ পৃথিবীর প্রায় ৯৫% এবং এটি একটি পাথুরে এক্সোপ্লানেট। তাদের ধারণা এটি পৃথিবীর মত একটি বাসযোগ্য গ্রহ। যদিও এর কোন বাস্তবিক প্রমাণ এখনো তারা পেশ করতে পারেনি।
কুরআনের উপরোক্ত আয়াত এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণার আলোকে বলা যায় যে, পৃথিবীই হচ্ছে একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ এবং সকল ধরনের প্রাণী এই পৃথিবীতেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যা সূরা লোকমানের ১০নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তাই বলা যায়, পৃথিবী ব্যতীত অন্য কোথাও প্রাণের অস্ত্বিত্ব নেই। সর্বোপরি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টি পরিচালনায় যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন তা কুরআন ও সহীহ হাদীসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বিজ্ঞানের দ্বারা আমাদের নিকট কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত নিদর্শন জানা সহজ করে দিয়েছেন। এগুলো জানার মাধ্যমে আমাদের ঈমান আরোও দৃঢ় হবে এবং যারা কুরআনকে এই যুগের জন্য অচল বলে সাব্যস্ত করতে চায় তাদের জন্য উৎকৃষ্ট জবাব হবে।
[1]. Lide, David R. Handbook of Chemistry and Physics.
[2]. The Atmosphere : Earth's Security Blanket by Alan Buis, october 2, 2019.
[3]. বুখারী হা/৩৩১৬।
[4]. Myisense, Marie Ysais, March 21, 2021.
[5]. education.nationalgeographic.org, july 15, 2022.
আসমান হ’ল সুরক্ষিত ছাদ :
আল্লাহ বলেন,
وَجَعَلْنَا السَّمَاءَ سَقْفًا مَحْفُوظًا
‘আর আমরা আকাশকে সুরক্ষিত ছাদে পরিণত করেছি’ (আম্বিয়া ২১/৩২)।
যেকোন ভবনের একটা ছাদ থাকে, যা ঐ ভবনকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক বস্ত্ত এবং ক্ষতি হ’তে রক্ষা করে। যেমন রোদের তাপ, বৃষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হ’তে রক্ষা করে। ছাদ ভবনের নিরাপত্তা প্রদান করে।
আমাদের ভূমির উপরের অংশকে বলা হয় বায়ুমন্ডল। এই বায়ুমন্ডলে রয়েছে ৭৮% নাইট্রোজেন, ২১% অক্সিজেন আরোও অন্যান্য গ্যাস এবং সামান্য পরিমাণ জলীয় বাষ্প। আমাদের এই বায়ুমন্ডলের ভর প্রায় ৫.১৫×১০১৮ কেজি।[1]
এই বায়ুমন্ডলের রয়েছে ৫টি স্তর। যথাঃ এক্সোস্ফেয়ার, থার্মোস্ফেয়ার, মেসোস্ফেয়ার, স্ট্রেটোস্ফেয়ার, ট্রপোস্ফেয়ার।
১ম স্তর হ’ল ট্রপোস্ফেয়ার, যা উপরের দিকে ৮-১৬ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে ৪ঃ১ আয়তন অনুপাতে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন অণু, জলীয় বাষ্প, কার্বনডাই অক্সাইড, ধুলিকণা এবং অন্যান্য কিছু গ্যাস। এই স্তর মূলতঃ ভূ-পৃষ্ঠের তাপ রক্ষায় কম্বলের মত কাজ করে। যদি এই স্তর না থাকতো তবে রাতের বেলা পৃথিবী হ’তে সকল তাপ বের হয়ে যেত। ফলে পৃথিবী অত্যধিক ঠান্ডা হয়ে যেত এবং বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ত। ট্রপোস্ফেয়ারের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘গ্রীণ হাউস ইফেক্ট’।
এই স্তরের উপরের স্তরের নাম হ’ল স্ট্রেটোস্ফেয়ার, যা উপরের দিকে ৭০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের রয়েছে ওজোন নামের একটি পদার্থ, যা তিনটি অক্সিজেন পরমাণুর দ্বারা গঠিত। এটা সূর্য হ’তে আগত অতিবেগুনী রশ্মি এবং এক্স-রেকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়। ফলে সম্পূর্ণ জীবজগত এই রশ্মির ক্ষতি হ’তে রক্ষা পায়।
এই স্তরের উপরের স্তরের নাম হ’ল মেসোস্ফেয়ার, যা উপরের দিকে ৫০ কি.মি. থেকে ৮০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশের তাপমাত্রা -৮৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পৃথিবীর মেঘমালা এই স্তরে বিদ্যমান থাকে, যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। এই অংশ পৃথিবীতে কোন উল্কা প্রবেশের চেষ্টা করলে তা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে রক্ষা করে।
এর উপরে রয়েছে থার্মোস্ফেয়ার, যা ৮০ কি.মি. থেকে ৭০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের নীচের অংশে রয়েছে আয়োনোস্ফেয়ার। এই অংশে কোন ধরনের মেঘ বা জলীয় বাষ্প থাকে না।
এর উপরে রয়েছে এক্সোস্ফেয়ার, যা ৭০০ কি.মি. থেকে ১০,০০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তর হ’ল বায়ুমন্ডলের সর্বশেষ স্তর, যা অতিক্রম করলেই যেকোন বস্ত্ত মহাশূন্যে চলে যায়।[2]
উপরের NASA প্রদত্ত তথ্যের আলোকে বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা যদি ছাদ হিসাবে আসমানে এই বায়ুমন্ডল তৈরী না করতেন, তবে পৃথিবীর সকল প্রাণী এবং গাছপালার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হ’ত না। দিনের বেলা সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মিসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক রশ্মির প্রভাব এবং রাতের বেলা অত্যধিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় বসবাসের জন্য এই পৃথিবী অযোগ্য হয়ে যেত। যদি এই বায়ুমন্ডল না থাকত তবে পাখির আকাশে উড়া সম্ভব হ’ত না, সমুদ্রের পানি ফুলেফেপে উঠতো। আল্লাহ প্রদত্ত এই ছাদ পুরো পৃথিবীকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হ’তে রক্ষা করছে। তাই আমাদের এই সৃষ্টির রহস্য জানার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বেশী বেশী ইবাদত করতে হবে।
নিদ্রা দ্বারা বিশ্রামের বৈজ্ঞানিক তথ্য :
১৯৫০ সালের পূর্বে মানুষ ধারণা করত যে, ঘুম হ’ল একটি নিষ্ক্রিয় কার্যকলাপ। এই সময় মানুষের শরীর এবং মস্তিষ্ক কোন কাজ করে না বরং সুপ্ত থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষকগণ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন যে, ঘুমন্ত অবস্থায় মস্তিষ্ক বিভিন্ন ধরনের কার্য সম্পাদন করে, যা জীবনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় (Johns Hopkins medicine)।
আল্লাহ বলেন,
وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا
‘এবং তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী’ (নাবা ৭৮/৯)।
নিদ্রা ব্যতীতও মানুষ কোন স্থানে শীতলতায় বসে বিশ্রাম নিতে পারে। এতেও শরীরের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হয়। আল্লাহ তা‘আলা সুনির্দিষ্টভাবে নিদ্রাকে বিশ্রাম বা ক্লান্তি দূর করার মাধ্যম বলার কারণ কি?
মানুষ ঘুমালে তার শরীরে নিম্নোক্ত কার্যক্রম সংঘটিত হয় :
১. যখন মানুষ ঘুমায়, তখন শরীরের Immune cell এবং প্রোটিন বিভিন্ন রোগবালাই যেমন ঠান্ডা, সর্দি ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিশ্রাম পায়।
২. পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানোর ফলে শরীরে Ghrelin নামক হরমোনের বৃদ্ধি ঘটে যা ক্ষুধা বৃদ্ধি করে।
৩. পর্যাপ্ত ঘুম না হ’লে উচ্চ রক্তচাপ বা হার্ট অ্যাটাকের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা হ’তে পারে। অল্প ঘুমের কারণে Cortisol নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয় যা হার্টের ক্রিয়া জটিল করে দেয়।
৪. পর্যাপ্ত ঘুম মানুষের স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করে (OASH, Healthy Living)।
ঘুমের মাধ্যমে যখন আমরা বিশ্রাম গ্রহণ করি তখন আমাদের শরীরে উপরোক্ত কার্যাদি সম্পাদিত হওয়ার মাধ্যমে শরীর সুস্থ থাকে। জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
أَطْفِئُوا الْمَصَابِيحَ عِنْدَ الرُّقَادِ،
‘ঘুমানোর সময় তোমরা বাতি নিভিয়ে দাও’।[3]
ঘুমানোর জন্য অন্ধকার অতীব যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘুমানোর সময় বাতি নিভিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যেন অন্ধকার তৈরী হয়। এখন প্রশ্ন ঘুমানোর জন্য অন্ধকার কেন যরূরী?
মানুষের মস্তিষ্ক খুবই সংবেদনশীল। মস্তিষ্ক খুব সামান্য পরিমাণ আলোও বুঝতে পারে। যদি ঘুমানোর সময় অন্ধকার না থাকে, তবে মস্তিষ্ক মেলাটনিন নামক হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই মেলাটনিন হরমোন শরীরের Circadian rhythms (২৪ ঘণ্টার বায়োলজিকাল ঘড়ি) নিয়ন্ত্রণ করে।[4]
উপরোক্ত আলোচনা হ’তে বলা যায় যে, বিশ্রামের জন্য ঘুম অপরিহার্য এবং ঘুমের জন্য অন্ধকার অপরিহার্য। আমাদের অনেকে রাতের বেলা ডিমলাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে থাকে, যা পরিত্যাগ করা উচিত। যেহেতু মস্তিষ্ক সামান্য আলোতেই হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তাই ডিমলাইটের সামান্য আলোও পরিহার করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যে কাজ যখন যেভাবে করার নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যদি সে কাজ সেভাবে করি তবে আমরা দুনিয়াতেও উপকৃত হব এবং পরকালেও উত্তম প্রতিদান পাব।
রাত পৃথিবীতে বৈষয়িক নিরাপত্তা প্রদান করে :
আল্লাহ বলেন,
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا ‘
আমরা রাত্রিকে করেছি আবরণ’ (নাবা ৭৮/১০)।
لِبَاسًا -এর অর্থ বস্ত্র। আমরা পোষাক পরিধান করি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বা ঢেকে রাখার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাবার ১০নং আয়াতে রাতকে বস্ত্র বলার মাধ্যমে এটা বুঝিয়েছেন যে, রাত এই পৃথিবীকে নিরাপত্তা দেয় বা ঢেকে রাখে। এখন জানতে হবে রাত কিসের নিরাপত্তা দেয় বা কি ঢেকে রাখে?
বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছে যে, পৃথিবীর জন্য অন্ধকার যরূরী।
আমরা অনেক ধরনের দূষণের নাম শুনেছি। যেমন শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ ঠিক তেমনি একটা দূষণ হ’ল আলোর দূষণ।
আলোর দূষণ : আলো দ্বারা রাতের অন্ধকার নষ্ট হওয়াকে আলোর দূষণ বলে। মানুষের তৈরী আলোক উৎস আলোক দূষণের প্রধান কারণ। এটা বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে, পরিবেশে কার্বনডাই অক্সাইড বৃদ্ধি করে, মানুষের ঘুমকে ব্যাহত করে এবং আকাশের তারা অস্পষ্ট করে ফেলে।[5]
যে সকল কারণে পৃথিবীর অন্ধকার প্রয়োজন :
১. প্রাকৃতিক বাস্ত্ততন্ত্রের (Ecosystems) সঠিক কার্যকারিতার জন্য রাতের অন্ধকার গুরুত্বপূর্ণ।
২. Species migration অর্থাৎ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর Ecosystems এর কারণে এক স্থান হ’তে অন্য স্থানে গমন রাতের বেলা ঘটে।
৩. বিভিন্ন প্রাণীর Circadian rhythms (শারীরিক, মানসিক এবং আচরণগত পরিবর্তন) এর জন্য অন্ধকার প্রয়োজন।
৪. পৃথিবীতে যদি সবসময় সূর্যের আলো থাকত তবে পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ার্নিং বেড়ে যেত এবং পৃথিবী বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে যেত। রাতের অন্ধকার পৃথিবীর তাপমাত্রার মধ্যে সমতা আনে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীকে অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দেন যাতে পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রাণীরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারে।
অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি? বা অন্য গ্রহ মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য কি?
কুরআন হচ্ছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর। কুরআনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি, পরিচালনা এবং অবস্থার যে তথ্য দেওয়া আছে তা মানুষ এখনো সবগুলো বের করতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য খুঁজে বের করে এবং আমরা তা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাহায্যে যাচাই করে গ্রহণ করি। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা চিন্তাশীলদের নিকট নিদর্শন তুলে ধরেন মানুষকে তাওহীদ এবং পরকালের দিকে নিয়ে আসার জন্য। আললাহ বলেন,
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ،
‘নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টিতে, রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে এবং নৌযানসমূহে যা সাগরে চলাচল করে, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং বৃষ্টির মধ্যে, যা আল্লাহ আকাশ থেকে বর্ষণ করেন; অতঃপর তার মাধ্যমে মৃত যমীনকে পুনর্জীবিত করেন ও সেখানে সকল প্রকার জীব-জন্তুর বিস্তার ঘটান এবং বায়ু প্রবাহের উত্থান-পতনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে সঞ্চালিত মেঘমালার মধ্যে অবশ্যই জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহ রয়েছে’ (বাক্বারাহ ২/১৬৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ
‘আসমান ও যমীনে যত প্রাণী আছে, সবই আল্লাহকে সিজদা করে এবং ফেরেশতাগণ। আর তারা অহংকার করে না’ (নাহল ১৬/৪৯)।
আল্লাহ আরো বলেন,
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ،
‘তিনি কোন স্তম্ভ ছাড়াই আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন, যা তোমরা দেখছ। আর পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা যাতে তা তোমাদের নিয়ে হেলে না পড়ে এবং এর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জীব-জন্তু। আর আমরা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি। অতঃপর এতে উৎপন্ন করি সকল প্রকার সুন্দর উদ্ভিদ জোড়া’ (লোকমান ৩১/১০)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ،
‘আর ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিক আল্লাহর যিম্মায় নেই। আর তিনি জানেন তার বসবাস ও মৃত্যুর স্থান। সবকিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে (লওহে মাহফূযে) লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (হূদ ১১/৬)।
উপরের আয়াতগুলোতে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় : (১) الْأَرْضِ শব্দ দ্বারা সুনির্দিষ্ট যমীন উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সুনির্দিষ্ট যমীন হ’ল পৃথিবী। (২) এই যমীনে সকল প্রকার প্রাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন,
أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا
‘আমরা কি যমীনকে বিছানাস্বরূপ করিনি?’ (নাবা ৭৮/৬)।
উক্ত আয়াতে مهاد শব্দের অর্থ বিছানা, শয্যা, বিশ্রামের স্থান। আমরা বিছানা বা বিশ্রামের স্থান বলতে এমন স্থানকে বুঝি যে স্থানে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব, কেউ কোন প্রকার বিরক্ত করবে না। যেমন হাট-বাজার, যানবাহন, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কোনটিই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু এরপরও এ সকল স্থানে আমরা গমন করি আমাদের প্রয়োজনে। ঠিক তেমনিভাবে এই পৃথিবী হ’ল আমাদের জন্য একমাত্র শান্তিতে থাকার স্থান অর্থাৎ বসবাসের জন্য উপযোগী। এই পৃথিবীর বাইরে যত গ্রহ আছে তা মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী নয়। বিজ্ঞানীরা খুঁজে যাচ্ছেন মানুষের জন্য বাসযোগ্য গ্রহ পাওয়া যায় কি-না। যদিও অনেক বিজ্ঞানী এরূপ সম্ভব নয় বলে উক্ত কাজ থেকে বিরত রয়েছেন। ১৬শ’ শতাব্দীতে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রদান করেন যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে সকল কিছু ঘুরছে। এরপর থেকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে, এরূপ আরোও গ্রহ রয়েছে যাদের নিজস্ব সূর্য রয়েছে। এই গ্রহগুলোকে বলা হয় Exoplanets। এই এক্সোপ্লানেট সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৫ সালে। কিন্তু তা মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এবং বিজ্ঞানীরা যে নীতির মাধ্যমে বাসযোগ্য গ্রহ সন্ধান করেন তা ‘Goldilocks’ নামে পরিচিত। এটি এমন একটি পদ্ধতি যার মানে হ’ল এমন গ্রহের সন্ধান করা যেখানে উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য পানি বিদ্যমান এবং এই পানি অধিক ঠান্ডাও নয়, অধিক গরমও নয়। (Exoplanet, NASA) একটি বাসযোগ্য গ্রহের সঠিক তাপমাত্রা, বায়ুমন্ডল এবং নক্ষত্রের চারপাশে ঘুর্ণনের জন্য কক্ষপথ থাকতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিজ্ঞানীরা প্রচুর পরিমাণে এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু কোনটিই মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। উদাহরণস্বরূপ কেপলার ১০বি, অন্য সৌরজগতের একটি এক্সোপ্ল্যানেট যা পৃথিবীর আকারের কাছাকাছি। কিন্তু এটি এর নক্ষত্রের বা সূর্যের খুব কাছাকাছি হওয়াতে তা বসবাসের উপযোগী নয়।
২০১৫ সালে বিজ্ঞানীরা কেপলার-৪৫২বি আবিষ্কার করেছিলেন, পৃথিবীর কাছাকাছি আকারের আরেকটি গ্রহ যা আমাদের মতো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে এবং এই গ্রহে ২০দিনে এক বছর হয়। যদিও এর তাপমাত্রা পৃথিবীর চেয়ে সামান্য বেশী। তবে গ্রহটি সম্পূর্ণরূপে আগ্নেয়গিরিতে আচ্ছাদিত বলে মনে করা হয়।
সম্প্রতি নাসা একটি এক্সোপ্লানেটের সন্ধান পেয়েছে, যার নাম TOI 700 e। তাদের দাবী এই এক্সোপ্লানেটের সাইজ পৃথিবীর প্রায় ৯৫% এবং এটি একটি পাথুরে এক্সোপ্লানেট। তাদের ধারণা এটি পৃথিবীর মত একটি বাসযোগ্য গ্রহ। যদিও এর কোন বাস্তবিক প্রমাণ এখনো তারা পেশ করতে পারেনি।
কুরআনের উপরোক্ত আয়াত এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণার আলোকে বলা যায় যে, পৃথিবীই হচ্ছে একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ এবং সকল ধরনের প্রাণী এই পৃথিবীতেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যা সূরা লোকমানের ১০নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তাই বলা যায়, পৃথিবী ব্যতীত অন্য কোথাও প্রাণের অস্ত্বিত্ব নেই। সর্বোপরি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টি পরিচালনায় যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন তা কুরআন ও সহীহ হাদীসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বিজ্ঞানের দ্বারা আমাদের নিকট কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত নিদর্শন জানা সহজ করে দিয়েছেন। এগুলো জানার মাধ্যমে আমাদের ঈমান আরোও দৃঢ় হবে এবং যারা কুরআনকে এই যুগের জন্য অচল বলে সাব্যস্ত করতে চায় তাদের জন্য উৎকৃষ্ট জবাব হবে।
[1]. Lide, David R. Handbook of Chemistry and Physics.
[2]. The Atmosphere : Earth's Security Blanket by Alan Buis, october 2, 2019.
[3]. বুখারী হা/৩৩১৬।
[4]. Myisense, Marie Ysais, March 21, 2021.
[5]. education.nationalgeographic.org, july 15, 2022.
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: