সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।
Mahmud ibn Shahidullah

প্রবন্ধ আল-কুরআনে বর্ণিত জাহেলি সমাজের দশটি চিত্র

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,445
Credits
2,602
জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত তৎকালীন আরব সমাজ। শহর গ্রাম সর্বত্রই জাহেলিয়াতের চিহ্ন। স্রষ্টাবিমুখ অবিশ্বাসীদের পদচারণা সেখানে। মূর্খতা, ধূর্ততা, শঠতার কুহেলিকায় আকুন্ঠ ডুবে ছিল সে সমাজ। ছিল না নারী অধিকার, পরিবার ব্যবস্থার স্থায়ী আইন, সম্পদের সুষম বণ্টন, অর্থনৈতিক মুক্তির কোন নির্দেশনা, জাতীয় সংকট উত্তরণের স্থায়ী সমাধান, জীবনের পরম উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। স্রষ্টা সম্পর্কে নানাবিধ কুসংস্কারে বিশ্বাস, উপাসনায় স্রস্টার সাথে একাধিক মিথ্যা উপাস্যের পার্টনারশীপ গ্রহণ, বাইতুল্লাহর মত পবিত্রতম জায়গায় শুধু কৌলিন্য রক্ষার জন্য কুরাইশ ছাড়া অন্য গোত্রের লোকদের উলঙ্গ করে ত্বাওয়াফ করা, পবিত্র কা‘বাগৃহের চতুষ্পার্শ্বে তিনশ’ ষাটটি মূর্তি স্থাপন- এসবই ছিল তাদের ইবাদত-উপাসনার ধরন প্রকৃতি। সূদ, লটারী, জুয়া, বাজি এসব ছিল জাহেলী যুগের লোকদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। অনেকে এসব করেই আয় রোজগার করত। ইহুদীরা সূদের প্রচলনের জন্য আগে থেকেই সকলের ঘৃণার পাত্র ছিল। অনেকে অসহায় হয়ে তাদের কাছ থেকে চড়া মূল্যের সূদ নিত। পান থেকে চুন খসলেই বেজে উঠত যুদ্ধের দামামা। খুব তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলত যুগের পর যুগ যুদ্ধ। সে সমাজে গোত্রপতিদের কথাই ছিল আইন। ইলাহী কোন আইনের সন্ধান তারা তখনও পায়নি। অহীভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কথা ছিল কল্পনাতীত। ফলে সেখানে বিরাজ করছিল অস্থিরতা, অরাজকতা, যুলুম-অত্যাচার।

আমরা আজকের লেখায় খুব সংক্ষিপ্তাকারে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত জাহেলী সমাজের দশটি চিত্র তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।

১). পরকালে অবিশ্বাসঃ

জাহেলী যুগে কাফের মুশরিকদের যতগুলো অবিশ্বাস ছিল তন্মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল পরকালে অবিশ্বাস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ قَالُوۡا مَا ہِیَ اِلَّا حَیَاتُنَا الدُّنۡیَا نَمُوۡتُ وَ نَحۡیَا وَ مَا یُہۡلِکُنَاۤ اِلَّا الدَّہۡرُ وَ مَا لَہُمۡ بِذٰلِکَ مِنۡ عِلۡمٍ اِنۡ ہُمۡ اِلَّا یَظُنُّوۡنَ​

‘এরা বলে, জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এই জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদের ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোন জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে এসব কথা বলে’ (সূরা আল-জাছিয়া : ২৪)।

এজন্যই পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন সূরায় অসংখ্যবার তাদের এই অবিশ্বাসের খ-ন করা হয়েছে যৌক্তিকভাবে। মাক্কী সূরাসমূহ অধ্যয়ন করলেই আমরা তার বাস্তবতা দেখতে পাব। এছাড়াও কুরআনের অনেক জায়গায় এই বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ ضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَّ نَسِیَ خَلۡقَہٗ قَالَ مَنۡ یُّحۡیِ الۡعِظَامَ وَ ہِیَ رَمِیۡمٌ​

‘এখন সে আমারের ওপর উপমা প্রয়োগ করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায় আর বলে, এ হাড়গুলো যখন পচে গলে গেছে এতে আবার প্রাণ সঞ্চার করবে কে?’ (সূরা ইয়াসীন : ৭৮)। আল্লাহ তা‘আলা এর জবাবে বলেন,

قُلۡ یُحۡیِیۡہَا الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَہَاۤ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَ ہُوَ بِکُلِّ خَلۡقٍ عَلِیۡمُ​

‘(হে নবী!) আপনি তাকে বলুন, এদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ জানেন’ (সূরা ইয়াসীন : ৭৯)।

২). মূর্তিপূজাঃ


মূর্তিপূজাই ছিল তৎকালীন আরবের ধর্ম পালনের চূড়ান্ত রূপ। সকলের গৃহেই শোভা পেত মূর্তি। বিপদে পড়লে, সফরে যাবার আগে, ব্যবসায়িক উন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে তারা সকলেই স্মরণাপন্ন হত পাথরের তৈরি নির্জীব মূর্তির। হোবল, লাত, মানাত, ‘উয্যা ছিল সবচেয়ে নাম করা। এমনকি পবিত্র কা‘বাগৃহের চতুষ্পার্শ্বে তারা তিনশ’ ষাটটি মূর্তি স্থাপন করেছিল। মোটকথা মূর্তিই ছিল তাদের ইলাহ, মা‘বূদ, বিপদ থেকে উদ্ধারকারী ত্রাণকর্তা সবকিছু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَفَرَءَیۡتُمُ اللّٰتَ وَ الۡعُزّٰی- وَمَنٰوۃَ الثَّالِثَۃَ الۡاُخۡرٰی - اَلَکُمُ الذَّکَرُ وَ لَہُ الۡاُنۡثٰی - تِلۡکَ اِذًا قِسۡمَۃٌ ضِیۡزٰی - اِنۡ ہِیَ اِلَّاۤ اَسۡمَآءٌ سَمَّیۡتُمُوۡہَاۤ اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمۡ مَّاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ بِہَا مِنۡ سُلۡطٰنٍ اِنۡ یَّتَّبِعُوۡنَ اِلَّا الظَّنَّ وَ مَا تَہۡوَی الۡاَنۡفُسُ وَ لَقَدۡ جَآءَہُمۡ مِّنۡ رَّبِّہِمُ الۡہُدٰی​

‘এখন একটু বলতো, তোমরা কি কখনো এ লাত, এ ‘উয্‌যা এবং তৃতীয় আরো একজন দেবতা মানাতের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছ? তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান আর কন্যা সন্তান কি আল্লাহ‌র জন্য? তাহলে এটা অত্যন্ত প্রতারণামূলক বণ্টন। প্রকৃতপক্ষে এসব তোমাদের বাপ-দাদাদের রাখা নাম ছাড়া আর কিছুই না। এজন্য আল্লাহ‌ কোন সনদপত্র নাযিল করেননি। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ শুধু ধারণা ও প্রবৃত্তির বাসনার দাস হয়ে আছে। অথচ তাদের রবের পক্ষ থেকে তাদের কাছে হেদায়াত এসেছে’ (সূরা আন-নাজম : ১৯-২৩)।

৩). গোত্রীয় শাসনব্যবস্থা, কবিলা প্রধানের কথাই আইনঃ

আমরা জানি, সে সময় আরবের লোকেরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক গোত্রেই একজন করে রঈস, শায়খ বা গোত্রপতি ছিল। তিনি যা বলতেন তাই তার গোত্রের জন্য আইন হিসাবে বিবেচিত হত। এক্ষেত্রে তিনি বিদ্রোহের শংকায় জনগণ সমর্থন করে না এমন কোন আইন পাশ করতেন না। মোটকথা জনগণের সেন্টিমেন্ট বুঝে তিনি আইন বলবৎ করতেন। যাকে আধুনিক রাজনীতিবিদগণ বলেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাদের সেই আইন বা নিয়মরীতিতে সবলদের কথাই গ্রহণযোগ্যতা পেত বেশী। কারণ মক্কার জাহেলী পার্লামেন্ট ‘দারুন নদওয়া’র সদস্যপদ লাভ করত সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই। মহান আল্লাহ বলেন,

اَفَحُکۡمَ الۡجَاہِلِیَّۃِ یَبۡغُوۡنَ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ حُکۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ​

‘(যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াতের ফায়ছালা চায়? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল ফায়ছালাকারী আর কেউ নেই’ (সূরা আল-মায়িদা : ৫০)।

এজন্যই আল্লাহর আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহপোষণকারী ব্যক্তিকে বেঈমান বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا​

‘না, (হে মুহাম্মাদ!) আপনার রবের কসম, এরা কখনো মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ এদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে এরা আপনাকে ফায়ছালাকারী হিসাবে মেনে না নেবে, তারপর আপনি যা ফায়ছালা করবেন তার ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্য যে কোন প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে’ (সূরা আন-নিসা : ৬৫)।

একজন মুমিনের উচিত হল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রদত্ত বিধান শোনামাত্রই অকুণ্ঠচিত্তে তা মেনে নেয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِہِمۡ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا​

‘যখন আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ের ফায়ছালা দিয়ে দেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়ছালা করার কোন অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)।

৪). সূদী কারবারঃ

সূদের জন্য ইহুদীরা ছিল বিখ্যাত। তারা চক্রবৃদ্ধিহারে সূদের লেনদেন করত। জাহেলি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনেকেই তাদের দেখাদেখি এই কারবারে জড়িয়ে পড়েছিল। আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সূদের কারবার করতেন। বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল প্রকার সূদী লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। সর্বপ্রথম আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূদের টাকা মওকুফ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَّذِیۡنَ یَاۡکُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا کَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُہُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا وَ اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا فَمَنۡ جَآءَہٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّہٖ فَانۡتَہٰی فَلَہٗ مَا سَلَفَ وَ اَمۡرُہٗۤ اِلَی اللّٰہِ وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ​

‘কিন্তু যারা সূদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মত যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থায় উপনীত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলে, ‘ব্যবসা তো সূদেরই মত’। অথচ আল্লাহ‌ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সূদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির কাছে তার রবের পক্ষ থেকে এই নসীহত পৌঁছে যায় এবং ভবিষ্যতে সূদখোরী থেকে সে বিরত হয়, সে ক্ষেত্রে যা কিছু সে খেয়েছে তাতো খেয়ে ফেলেছেই এবং এ ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ হয়ে গেছে। আর এই নির্দেশের পরও যে ব্যক্তি আবার এই কাজ করে, সে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে সে থাকবে চিরকাল’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)।

৫). আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতাঃ

তৎকালীন বাইজান্টাইন এবং পারস্য সা¤ জ্য ছিল আরব ভূখণ্ডের চোখের সামনে। তাদের ধন-সম্পদের প্রাচুর্যতা, বিলাসিতা, রাজকীয় চালচলন সেকালে জাহেলি সমাজের লোকদের মনেও রেখাপাত করেছিল। বিলাসিতার জন্য দেশ- বিদেশে ভ্রমণ, অপচয়, মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস এসবই ছিল বাইজান্টাইন ও পারস্য সা¤্রাজ্যের ব্যাপার। চোখ ধাঁধাঁনো প্রাসাদ, অন্দরমহলে রমণীদের বিলাসবহুল সাজসজ্জা ইত্যকার বিষয়ের খবর আবরবাসীদের অজানা ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নবীকে এসব বিলাসিতা থেকে সতর্ক করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য এসব যে কোন প্রয়োজনীয় বিষয় নয় বরং ক্ষতিকর সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

وَ لَا تَمُدَّنَّ عَیۡنَیۡکَ اِلٰی مَا مَتَّعۡنَا بِہٖۤ اَزۡوَاجًا مِّنۡہُمۡ زَہۡرَۃَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا لِنَفۡتِنَہُمۡ فِیۡہِ وَ رِزۡقُ رَبِّکَ خَیۡرٌ وَّ اَبۡقٰی​

‘আর চোখ তুলেও তাকাবেন না দুনিয়াবী জীবনের শান-শওকতের দিকে, যা আমরা এদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের লোকদেরকে দিয়ে রেখেছি। এসব তো আমরা এদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি করার জন্য দিয়েছি এবং আপনার রবের দেয়া হালাল রিযিক্বই উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী’ (সূরা ত্বো-হা : ১৩১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَا یَغُرَّنَّکَ تَقَلُّبُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فِی الۡبِلَادِ- مَتَاعٌ قَلِیۡلٌ ثُمَّ مَاۡوٰىہُمۡ جَہَنَّمُ وَ بِئۡسَ الۡمِہَادُ​

‘হে নবী! দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আল্লাহর নাফরমান লোকদের চলাফেরা যেন আপনাকে ধোঁকায় ফেলে না দেয়। এটা নিছক কয়েক দিনের জীবনের সামান্য আনন্দ-ফূর্তি মাত্র। তারপর এরা সবাই জাহান্নামে চলে যাবে, যা সবচেয়ে খারাপ স্থান’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯৬-১৯৭)।

৬). সাহিত্যমেলা/অশালীন কাব্য চর্চার প্রতিযোগিতাঃ

জাহেলি আরবের সাহিত্য আধুনিক আরবী সাহিত্যের প-িতদের নিকটে অমূল্য রতœ। তাদের সাহিত্যচর্চা, বিশেষত কাব্যপ্রতিভা সর্বজনবিদিত। তায়েফের নিকটবর্তী ওকায মেলায় প্রতিবছর সেরা প্রতিভাবান কবিদের কবিতা পাঠের প্রতিযোগিতা হত। সেখান থেকে সেরা সাতজন কবির কবিতা পবিত্র কা‘বাগৃহের দেয়ালে লটকিয়ে রাখা হত। সেগুলোকে একসাথে বলা হত ‘সাব‘আ মু‘আল্লাকা’ বা সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকা। ‘সাব‘আ মু‘আল্লাকা’ এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরবী সাহিত্যের সুখপাঠ্য। কিন্তু সেসব কবিতা অশ্লীলতায় ভরপুর ছিল, নারীদেহের সৌন্দর্য বর্ণনা সেসব কবিতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। কামোদ্দীপক সেসব কবিতার বর্ণনা মুখে আনাও লজ্জাকর। কবিদের নামে আল্লাহ তা‘আলা একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেন। তাদের ভবঘুরে অবস্থা, সব বিষয়ে কবিতা রচনার প্রচেষ্টার নিন্দা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ الشُّعَرَآءُ یَتَّبِعُہُمُ الۡغَاوٗنَ - اَلَمۡ تَرَ اَنَّہُمۡ فِیۡ کُلِّ وَادٍ یَّہِیۡمُوۡنَ - وَ اَنَّہُمۡ یَقُوۡلُوۡنَ مَا لَا یَفۡعَلُوۡنَ - اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ ذَکَرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا وَّ انۡتَصَرُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا ظُلِمُوۡا وَ سَیَعۡلَمُ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اَیَّ مُنۡقَلَبٍ یَّنۡقَلِبُوۡنَ​

‘আর কবিরা! তাদের পেছনে চলে পথভ্রান্ত যারা। আপনি কি দেখেননি তারা উপত্যকায় উপত্যকায় উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায় এবং এমনসব কথা বলে যা তারা করে না? তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে আর তাদের প্রতি যুল্ম করা হলে শুধু প্রতিশোধ নেয়। আর যুল্মকারীরা শীঘ্রই জানবে তাদের পরিণাম কী!’ (সূূূরা আশ-শু‘আরা : ২২৪-২২৭)।

৭). নারীজাতির সম্মান লুণ্ঠন, তাদেরকে ভোগের বস্তুতে পরিণতঃ

জাহেলি আরবে নারীদের অবস্থা ছিল বর্তমান সময়ের মতই শোচনীয়। তারা ছিল কেবল ভোগের বস্তু। সম্মান, ইজ্জত, অধিকার, মতামত ইত্যাদি বিষয়াদিতে তাদের মূল্যহীন মনে করা হত। সম্পত্তিতে ছিল না কোন অধিকার। মেয়ে সন্তানকে কুলক্ষণা মনে করা হত। অনেকে মেয়ে সন্তান হলে তাকে জীবন্ত কবর দিত। স্বাধীন মহিলারা নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য রাস্তায় খোলামেলা চলত। মহান আল্লাহ সেটাকে জাহেলিয়াত হিসাবে আখ্যা দিয়ে তাত্থেকে মুসলিম মহিলাদেরকে সতর্ক করে বলেন,

وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِکُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاہِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی وَ اَقِمۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ اٰتِیۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ اَطِعۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ اِنَّمَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیُذۡہِبَ عَنۡکُمُ الرِّجۡسَ اَہۡلَ الۡبَیۡتِ وَ یُطَہِّرَکُمۡ تَطۡہِیۡرًا​

‘নিজেদের গৃহের মধ্যে অবস্থান কর এবং পূর্বের জাহেলী যুগের মত সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না। সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। আল্লাহ‌ তো চান, তোমাদের নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৩)।

অন্যদিকে গানের আসরে মাতাল পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরী দাসীরা প্রস্তুত ছিল। স্বাধীনা নারীরা সাধারণত গান- বাজনা করে পুরুষের মনোরঞ্জনের বস্তু ছিল না। আধুনিক জাহেলিয়াত এক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়েছে।

৮). মদ জুয়ার আসর : নৈতিকতার ক্ষুৎপিপাসায় কাতরঃ

মদ ব্যতীত আরবের লোকদের জীবন চিন্তাও করা যেত না। নিত্য সঙ্গী ছিল তাদের এই নেশাজাত দ্রব্যটি। সারারাত গানের আসরে সুন্দরী রমণীদের কমনীয় রূপ লাবণ্যে বিভোর হয়ে নিজেদের বুদ্ধি বিবেককে নারী ও মদের হাতে সোপর্দ করে দিত তারা। আরবী সাহিত্যের কবিতায় মদ নিয়ে যে কত বর্ণনা এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। মদের নেশা এতই প্রকট ছিল যে, ইসলামী শরী‘আতে প্রায় চারটি ধাপে মদকে চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমবারেই হারাম ঘোষণা হলে অনেক মুসলিমের জন্য তা মানা কষ্টকর হত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡہُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ​

‘হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাক, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে’ (সূরা আল-মায়িদা : ৯০)।

৯). জাতীয়তাবাদঃ

জাতীয়তাবাদ ছিল আরব জাহেলিয়াতের রাজনৈতিক বিশ্বাস। আধুনিক যুগে জাতীয়তাবাদ হল একটি দেশ, অঞ্চল বা ভূখ-ের জন্য চূড়ান্ত বিশ্বাস পোষণ করা, তার জন্য লড়াই করা, যুদ্ধ করা, প্রাণ বিসর্জন দেয়া তা ন্যায় হোক বা অন্যায়। তৎকালীন জাতীয়তাবাদ ছিল গোত্রীয় জাতীয়তাবাদ। নিজ কবিলার জন্য প্রাণোৎসর্গ করা, লড়াই করা তা ন্যায় হোক বা অন্যায়। আধুনিক জাতীয়তাবাদের ব্যাপ্তি একটু বড়, দেশ বা মহাদেশ পর্যন্ত তা গড়িয়েছে। তৎকালীন জাতীয়তাবাদ ছিল গোত্র কেন্দ্রিক। তবে কখনো কখনো উদ্দেশ্যের অভিন্নতার কারণে অনেকগুলো গোত্র একই অবস্থান গ্রহণ করত। যেমন, আহযাবের যুদ্ধের সময় ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের গোত্রগুলোর সামরিক জোট। জাতীয়তাবাদের নিন্দা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِذۡ جَعَلَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فِیۡ قُلُوۡبِہِمُ الۡحَمِیَّۃَ حَمِیَّۃَ الۡجَاہِلِیَّۃِ فَاَنۡزَلَ اللّٰہُ سَکِیۡنَتَہٗ عَلٰی رَسُوۡلِہٖ وَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ اَلۡزَمَہُمۡ کَلِمَۃَ التَّقۡوٰی وَ کَانُوۡۤا اَحَقَّ بِہَا وَ اَہۡلَہَا وَ کَانَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمًا​

‘এ কারণেই যখন ঐ সব কাফেররা তাদের মনে জাহেলী সংকীর্ণতার স্থান দিল তখন আল্লাহ‌ তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে তাক্বওয়ার নীতির ওপর সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখলেন। তারাই এ জন্য বেশী উপযুক্ত ও হকদার ছিল। আল্লাহ‌ সব জিনিস সম্পর্কেই পরিজ্ঞাত’ (সূরা আল-ফাত্হ : ২৬)।

১০). পূর্বপুরুষের কর্মনীতির অন্ধ অনুসরণঃ

‘তাক্বলীদুল আ-বা ওয়াল আজদাদ’ বা বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ আরব জাহেলিয়াতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট ছিল। তাদেরকে যখন কুরআনের বাণী শোনানো হত তারা বলত, আমরা এসব কিছু বুুুঝি না, আমরা তা-ই অনুসরণ করব যা আমাদের বাপ-দাদারা রেখে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ اتَّبِعُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ قَالُوۡا بَلۡ نَتَّبِعُ مَاۤ اَلۡفَیۡنَا عَلَیۡہِ اٰبَآءَنَا اَوَ لَوۡ کَانَ اٰبَآؤُہُمۡ لَا یَعۡقِلُوۡنَ شَیۡئًا وَّ لَا یَہۡتَدُوۡنَ​

‘তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ‌ যে বিধান নাযিল করেছেন তা মেনে চলো, জবাবে তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাদের যে পথের অনুসারী পেয়েছি আমরা তো সে পথে চলব। আচ্ছা, তাদের বাপ-দাদারা যদি একটুও বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ না করে থেকে থাকে এবং সত্য-সঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থাকে, তাহলেও কি তারা তাদের অনুসরণ করে যেতে থাকবে?’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৭০)।

পূর্বপুরুষের অনুসরণ তখনই প্রশংসনীয় যখন তা সঠিক কর্মনীতি তথা ইলাহী নির্দেশনার উপরে প্রতিষ্ঠিত। ইলাহী নির্দেশনা বা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান, যুক্তি, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো যদি বাপ-দাদার কর্মপন্থায় অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সেটাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা বা সেটার দিকে ফিরে যাওয়ার নামই হল ‘জাহেলিয়াত’।

এখানে এমন দশটি জাহেলি বিশ্বাস, কর্মনীতি, কর্মপন্থা তথা ইসলামপূর্ব আরবের অবস্থান কুরআনের আলোকে তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি প্রায় সবগুলো মুসলিম দেশেই বিদ্যমান। বিজ্ঞ পাঠক তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন বলে আমি আশাবাদী। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সকল প্রকার জাহেলিয়াতের বেড়াজাল, মায়াজাল ছিন্ন করে দ্বীনে খালেছের পথে চলার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!!
 
Last edited:
Top