আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। যা মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র রামাযান মাসের লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রীতে পূর্ণ কুরআন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে দুনিয়ার আকাশে ‘বায়তুল ‘ইযযাহ’ নামক স্থানে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন।[১]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আমরা কুরআনকে ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আল-ক্বদর : ১)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আমরা তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক রবকতময় রজনীতে’ (সূরা আদ-দুখান : ৩)। বরকতময় রজনী হল রামাযান মাসের লাইলাতুল ক্বদর।[২] আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনকে বহু গুণে গুণান্বিত করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম গুণ হল এটা হেদায়াত।
হেদায়াত
কুরআনের অন্যতম বিশেষত্ব হল এটা মানুষের জন্য হেদায়াত, পথপ্রদর্শক, পথনির্দেশক, পথের দিশারী এবং গাইড বুক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এটা (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাক্বীদের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এটা মুমিনদের জন্য পথনির্দেশ ও সুসংবাদ’ (সূরা আন-নামল : ১-২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এটা সৎকর্মপরায়ণদের জন্য পথনির্দেশক ও রহমত’ (সূরা লুক্বমান : ২-৩)।
হেদায়াত শব্দের অর্থ
হেদায়াত (الهداية) শব্দটি আরবী। الهدى মাছদার থেকে উৎপত্তি। অর্থ হল এমন আলো, যার মাধ্যমে সত্য পথে পরিচালিত হওয়া যায় এবং দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এ (জ্যোতির্ময় কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে (কুফরীর) অন্ধকার হতে বের করে (ঈমানের) আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)।
সালাফগণ হেদায়াত শব্দের কয়েকটি অর্থ ব্যক্ত করেছেন। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ, আনাস সহ অনেক সাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, الهدى অর্থ আলো।[৩] শা‘আবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ভ্রষ্টতা থেকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা’।[৪]
সাঈদ ইবনু যুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিস্তারিত তথ্য’।[৫]
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘(সঠিক পথের) বর্ণনা ও (সঠিক) পথ প্রদর্শন’।[৬]
আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ভ্রষ্টতা ও সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে সঠিক পথ (হেদায়াত) লাভ করা এবং তার মাধ্যমে উপকারী পথে চলা’।[৭]
আবূ বকর আল-জাযাইরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দুনিয়া ও আখেরাতের পরিপূর্ণতার এবং সৌভাগ্যের দিকে পথ প্রদর্শনের সংযোগকারী বা পরিচালনাকারী’।[৮]
হেদায়াতের প্রকার
হেদায়াত দু’ প্রকার। (ক) অন্তরে ঈমানের স্থিতিশীলতার হেদায়াত। যেটাকে বলা হয় هداية التوفيق والانتفاع । (খ) সত্যকে প্রকাশ ও সত্য পথ প্রদর্শন করার হেদায়াত। যাকে বলা হয় هداية التبيان والإرشاد।[৯] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ‘এটা (কুরআন) মুত্তাক্বীদের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘রামাযান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং (হক্ব ও বাতিলের) প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।
উপরিউক্ত দু’টি আয়াতের প্রথম আয়াতের হেদায়াত মুত্তাক্বীদের জন্য খাছ। আর দ্বিতীয় আয়াতের হেদায়াত সাধারণ মানুষদের জন্য। প্রথম আয়াতের হেদায়াত হল (هداية التوفيق والانتفاع) এবং দ্বিতীয় আয়াতের হেদায়াত হল (هداية التبيان والإرشاد)।
(ক) অন্তরে ঈমানের স্থিতিশীলতার হেদায়াত
বান্দার অন্তরে এই হেদায়াতের উপর আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কেউ ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন’ (সূরা আল-ক্বছাছ : ৫৬)। অর্থাৎ আপনি হেদায়াত করতে সক্ষম নন। বরং আপনার দায়িত্ব হল পৌঁছে দেয়া বা প্রচার করা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করেন।[১০] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এভাবে আমরা নিজ নির্দেশে আপনার প্রতি অহী করেছি রূহ। আপনি তো জানতেন না এ গ্রন্থ কী, ঈমান কী? পক্ষান্তরে আমরা একে করেছি এমন আলো, যার দ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি। আর নিশ্চয় আপনি সরল পথ প্রদর্শন করেন’ (সূরা আশ-শূরা : ৫২)।
ইবনু মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) তার পিতা মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেন, যখন আবূ তালিবের মুমূর্ষ অবস্থা তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকট গেলেন। আবূ জাহলও তার নিকট উপবিষ্ট ছিল। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচা, (لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ) কালেমাটি একবার পড়ুন, তাহলে আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট কথা বলতে পারব। তখন আবূ জাহল ও ‘আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া বলল, হে আবূ তালিব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে ফিরে যাবে? এরা দু’জন তার সাথে একথাটি বারবার বলতে থাকল। সর্বশেষ আবূ তালিব তাদের সাথে যে কথাটি বলল, তাহল, আমি ‘আব্দুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপরেই আছি। এ কথার পর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকব, যে পর্যন্ত আপনার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা না হয়। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।
‘নবী ও মুমিনদের পক্ষে উচিত নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য যদি তারা নিকটাত্মীয়ও হয় যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামী’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১১৩)।
আরো নাযিল হল : ‘আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না’ (সূরা আল-ক্বছাছ : ৫৬)।[১১]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তাদের হেদায়াত দানের দায়িত্ব আপনার নয়; বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যাকে আল্লাহ বিপথগামী করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৮৬)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আল্লাহ যাকে সৎ পথে পরিচালিত করেন সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ১৭)।
(খ) সত্যকে প্রকাশ এবং সত্য পথ প্রদর্শন করার হেদায়াত
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সত্যকে প্রকাশ করেছেন ও সত্য পথ প্রদর্শন করেছেন এবং নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে সত্য পথের দিক-নির্দেশনা দান করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর আপনি তো অবশ্যই সরল পথের দিকে দিক-নির্দেশ করেন’ (সূরা আশ-শূরা : ৫২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আপনি তো শুধু ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে পথপ্রদর্শক’ (সূরা আর-রা‘দ : ৭)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর ছামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, আমরা তাদেরকে পথ নির্দেশ করেছিলাম, কিন্তু তারা সৎপথের পরিবর্তে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করেছিল’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ : ১৭)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ ہَدَیۡنٰہُ النَّجۡدَیۡنِ ‘আমরা তাদেরকে দু’টি পথ দেখিয়েছি’ (সূরা আল-বালাদ : ১০)।
সুধী পাঠক! মুত্তাক্বীরা উপরিউক্ত দু’টি হেদায়াতই লাভ করে। তবে মুত্তাক্বী ছাড়া কেউই هداية التوفيق লাভ করে না। আর هداية البيان শুধু আমল করারই নামান্তর। যা প্রকৃতপক্ষে হেদায়াত নয়।[১২] এ কুরআন মানুষের জন্য হেদায়াত। বিশেষ করে মুত্তাক্বীদের জন্য। হেদায়াতকে মুত্তাক্বীদের সাথে বিশিষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এটা (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাক্বীদের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, মুত্তাক্বীগণকে কেন হেদায়াতপ্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট করেছেন? এ ব্যাপারে আলেমগণ বলেন, মূলত মুত্তাক্বীরাই আল্লাহর কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারে, যারা মুত্তাক্বী নয় তারা হেদায়াত লাভ করতে পারে না। যদিও কুরআন তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এ অর্থের উপর প্রমাণবহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় এ কুরআন হেদায়াত করে সে পথের দিকে, যা আক্বওয়াম তথা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘বলুন! মুমিনদের জন্য ইহা পথ নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব। তারা এমন যে, যেন তাদেরকে আহ্বান করা হয় বহু দূর হতে’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৪৪)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আমরা অবতীর্ণ করি কুরআন, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও দয়া, কিন্তু তা সীমালঙ্ঘনকারীদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৮২)। এ বিষয়ে আরোও অনেক আয়াত রয়েছে এবং এগুলোর ভাবার্থ এই যে, যদিও কুরআনুল কারীম সকলের জন্যই হেদায়াত স্বরূপ, তথাপি শুধু সৎ লোকেরাই এর দ্বারা উপকার পেয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত এমন এক গ্রন্থ, যাতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ একই কথা নানাভাবে বার বার বলা হয়েছে। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের চামড়ার (লোম) খাড়া হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণের প্রতি নরম হয়ে যায়। এটিই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই’ (সূরা আয-যুমার : ২৩)।
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে হেদায়াত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এ (জ্যোতির্ময় কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে (কুফরীর) অন্ধকার হতে বের করে (ঈমানের) আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)।
আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হেদায়াত ও ইলম সহ পাঠিয়েছেন, তাঁর উদাহরণ মুষলধারে বৃষ্টির ন্যায়, যা কোন ভূখ-ে পতিত হয়। সে ভূখ-ের একাংশ ছিল উৎকৃষ্ট, যা বৃষ্টিকে গ্রহণ করে এবং প্রচুর ঘাস-পাতা ও তৃণলতা জন্মায়। অপর অংশ ছিল কঠিন ও গভীর। যা পানি আটকিয়ে রাখে, যার দ্বারা আল্লাহ মানুষের কল্যাণ সাধন করেন। লোকেরা তা থেকে পান করে, অন্যকে পান করায় ও কৃষিকাজ করে। পক্ষান্তরে কতক বৃষ্টি ভূমির এমন অংশে পতিত হয়, যা সমতল ও অনুর্বর। যা পানি আটকায় না বা সেখানে ঘাস-পাতাও জন্মে না। এটা ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছে এবং যা নিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, তা তাঁর উপকার সাধন করেছে। সে নিজে তা শিখেছে ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। আর ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে তাঁর দিকে মাথা তুলেও দেখেনি এবং আল্লাহর যে হেদায়াত সহকারে আমি প্রেরিত হয়েছি, তা কবুলও করেনি’।[১৩]
অতএব কুরআন হল হক্ব ও জান্নাতের পথের দিশারী। পার্থিব জীবন সুখী করার পথ-নিদের্শক। কুরআনে রয়েছে হেদায়াতের যাবতীয় উপায়-উপকরণ। কুরআনে রয়েছে আদেশ-নিষেধ-উপদেশ। হালাল ও হারাম, সঠিক ও বেঠিক, হক্ব ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য। দুনিয়া ও আখেরাতের সুখের জন্য সঠিক পথের গাইড। যারা আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, যারা সাবধানী ও তাক্বওয়াশীল হয়, কেবল তারাই এর দ্বারা হেদায়াত লাভ করে। সকালের আলো সকলের জন্য উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু কেবল সেই মানুষই সেই আলো দ্বারা উপকৃত হয়, যে ঘুম ছেড়ে জেগে ওঠে।
যদি কেউ কুরআনকে বিশ্বাসই না করে, তাহলে সে হেদায়াত পাবে কীভাবে? অন্ধ কি আলোর দিশা পেতে পারে? আলো দ্বারা উপকৃত হয় কেবল চক্ষুষ্মান লোকেরা। বলা বাহুল্য, কুরআন তাক্বওয়াশীল অর্থাৎ আল্লাহভীরুদের জন্য হেদায়াত। যেহেতু তারাই আল্লাহ ও তাঁর কুরআনকে বিশ্বাস করে। আল্লাহকে ভয় করে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করে। তারাই কুরআনী আলো লাভ করে, তারাই পায় সত্য ও সৎপথের দিশা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকারী শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় অনুগ্রহশীল’ (সূরা আল-আনফাল : ২৯)। অতএব বিশ্বাস ও ভয় হল হেদায়াত লাভের পূর্বশর্ত। আর মুত্তাক্বী তারাই যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস আনে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩) এবং আল্লাহকে ভয় করে (সূরা আন-নাযি‘আত : ৪০১)।
মুত্তাক্বী কারা
‘মুত্তাক্বীন’ শব্দটি ‘মুত্তাক্বী’-এর বহুবচন। মুত্তাক্বী শব্দের মূল ধাতু تقوي (তাক্বওয়া)। এই আরবী শব্দটি وقاية (বিকায়াহ) হতে উৎপত্তি। অর্থ হল অনিষ্টকর ও কষ্টদায়ক বস্তু হতে আত্মরক্ষা করা, সতর্কতা ও ভয়ভীতি।[১৪] আল্লাহর ভয়, আল্লাহভীতি, পরহেযগারী, দ্বীনদারী, ধার্মিকতা ইত্যাদি।[১৫] সাধারণ অর্থে আল্লাহভীতিকে ‘তাক্বওয়া’ বলা হয়। শারঈ অর্থে- আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর নির্র্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করা, জীবনের কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম যেন লংঘিত না হয়, এরকম সতর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্কতার সাথে চলার নামই তাক্বওয়া। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
‘মুত্তাক্বী তারাই, যারা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে হেদায়াতকে পরিত্যাগ করে না এবং তাঁর রহমতের আশা রেখে তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ কিতাবকে বিশ্বাস করে থাকেন’। তিনি আরো বলেন, ‘মুত্তাক্বী তারাই যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে শিরক হতে দূরে থাকেন এবং আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশাবলী মেনে চলেন’।[১৬]
হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মুত্তাক্বী তারাই, যারা আল্লাহর হারামকে পরিত্যাগ করে এবং তাদের উপর যা ফরয করা হয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করে’।[১৭]
ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বওয়া’ হল,
‘আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা’।[১৮]
অতএব তাক্বওয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকার নাম। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সকল পাপাচার, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং এ জাতীয় সকল কাজ হতে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসারে সার্বিক জীবন পরিচালনার নাম ‘তাক্বওয়া’।
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট তাক্বওয়ার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনও এমন পথ অতিক্রম করেছেন, যেটি খুবই সংকীর্ণ এবং যে পথের দুই দিকেই কাঁটাপূর্ণ গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত? তদুত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখন বললেন, এমতাবস্থায় আপনি কিভাবে পথ অতিক্রম করেছেন? জবাবে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, খুবই সতর্কতার সাথে কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে সে পথ অতিক্রম করেছি। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এটাই ‘তাক্বওয়া’।[১৯]
আর মুত্তাক্বী হল ‘যারা যাবতীয় শিরক ও মূর্তি পূজা থেকে দূরে থাকে এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করে’।[২০]
মানুষের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে তাক্বওয়ার উপর নির্ভরশীল। তাক্বওয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষে দুনিয়াতে সৎ ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ মানব মন সর্বক্ষণ অসৎ ও অনিষ্টকর কার্যাদি সম্পাদন করতে প্রলুব্ধ করে এবং আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় মানব মন সর্বদা অনিষ্টকর কাজ করার জন্য নির্দেশ দেয়’ (সূরা ইউসুফ : ৫৩)। আর এই নফসকে উদ্ধত আচরণ হতে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাক্বওয়া। কোন ব্যক্তি যখন তার নফসকে নিষ্কলুষ করার উদ্দেশ্যে তাক্বওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, তখন নফস তার মজ্জাগত স্বভাব অর্র্র্র্র্র্র্র্র্থাৎ অনিষ্টকর কাজের প্রতি নির্দেশ করার যোগ্যতা পরিত্যাগ করে মন্দ কাজের প্রতি তিরস্কার করার যোগ্যতা অর্জন করে। এমতাবস্থায় সে আর মন্দ কাজের প্রতি প্ররোচনা যোগায় না, বরং নফস মন্দ কাজ করতে উদ্যত হলে সে বিরত রাখার জন্য তিরস্কার করতে থাকে। মনের এ অবস্থাকে আল-কুরআনে ‘নফসে লাউওয়ামাহ’(نفس لوامة) অর্থাৎ ‘তিরস্কারকারী আত্মা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ ‘আরো শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ৫৩)।
যখন কোন ব্যক্তি নফসের এ অবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে তাকে আরও সঠিক এবং নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে, তখন নফস তিরস্কারের স্তর অতিক্রম করে এমন স্তরে উপনীত হয় যে, সেখানে সে প্রশান্ত ও নিরুদ্বেগ মন-মানসে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় সে শুধু সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি অনুপ্রেরণা প্রদান করতে থাকে। মনের এ অবস্থাকে আল-কুরআনে (نفس مطمئنة) ‘নফসে মুত্বমাইন্নাহ’ অর্থাৎ ‘প্রশান্ত আত্মা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও প্রিয়পাত্র হয়ে। অনন্তর তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সূরা আল-ফজর : ২৭-৩০)।
হেদায়াত লাভের অনন্য মাস রামাযান
রামাযান মর্যাদাসম্পন্ন মাস। এ মাসেই আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনকে অবতীর্ণ করেছেন। এটি বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট অনুগ্রহ। কেননা এই কুরআন সম্পূর্ণটা হেদায়াত দিয়ে পরিপূর্ণ। আর হেদায়াত ঐ ব্যক্তির জন্য, যে কুরআনের প্রতি ঈমান আনে, তার সত্যায়ন করে এবং অনুসরণ করে।[২১]
এগুলো মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য এবং হেদায়াতকে তাদের জন্যই খাছ করা হয়েছে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
রামাযানের সাথে তাক্বওয়ার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। কেননা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জন। আর যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে, সেই হেদায়াত লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)। নিশ্চয় সিয়াম তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম কারণ। সিয়ামের মাধ্যমে যেভাবে তাক্বওয়া অর্জিত হয়। যথা-
১). রামাযান মাসে সিয়ামপালনকারী আল্লাহর নির্দেশ পালন করে এবং নিষেধ বর্জন করে। আর এটাই তাক্বওয়া (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)।
২). (ছুবহে ছাদিক্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) খাওয়া, পান এবং সহবাস করা সহ আল্লাহ যা হারাম করেছেন, অন্তর ও প্রবৃত্তির ঝোঁক থাকার পরও আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নেকি অর্জন করার জন্য সিয়ামপালনকারী তা পরিত্যাগ করে; যা তাক্বওয়ার অন্তর্ভুক্ত (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)।[২২]
৩). সিয়ামপালনকারী আল্লাহর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রাণাধীনে থাকার অনুশীলন করে। অতঃপর আল্লাহর রহমতে প্রবৃত্তির চাহিদাগুলো পরিত্যাগ করে।[২৩] আর এটাই তাক্বওয়া।
৪). নিশ্চয় শয়তান মানুষের মধ্যে তার রক্তের ন্যায় বিচরণ করে থাকে।[২৪] সিয়ামপালনকারী সিয়াম অবস্থায় শয়তানের রাস্তাকে সঙ্কীর্ণ ও সংকুচিত করে, তার প্রভাব ও কর্তৃত্বকে দুর্বল করে এবং পাপাচার হ্রাস পায়। আর এটাই তাক্বওয়া।
৫). সিয়ামপালনকারী আল্লাহর আনুগত্য করে। যেমন রামাযানে ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদত বেশি বেশি করে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৪)। আর অনুগত থাকা তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের সিয়াম পালন করে তার পূর্বের (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্বের (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্ববর্তী (ছগীরা) গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়’।[২৫]
৬). গরীব-অসহায়, দুর্দশাগ্রস্ত এবং মিসকীন যখন কষ্ট, ক্লেশ এবং খাদ্য সংকটে পতিত হয়, তখন তাদের সহযোগিতা করা ধনীদের উপর অপরিহার্য হয়। আর এটা তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য।[২৬]
৭). সিয়াম যৌবনকে দমন করার মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র করে। আর এটা তাক্বওয়ার গুণ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাহলে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম’।[২৭]
৮). সিয়ামপালনকারীর মধ্যে রয়েছে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা এবং মন্দ আচরণ থেকে অন্তরের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। কেননা সিয়াম মন্দ আচরণকে প্রতিরোধ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[২৮]
৯). সিয়াম লৌকিকতামূক্ত ইবাদত। কেননা অন্য যে কোন ইবাদত যথা সালাত, হজ্জ ইত্যাদি লৌকিকতা রক্ষার খাতিরে অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকে, কিন্তু সিয়ামের ব্যাপারটি সম্পূর্ণটাই স্বতন্ত্র। সিয়াম শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্যই পালন করা হয়। যা তাক্বওয়ার চরিত্র। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘আদম সন্তানের নেক আমল বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ হতে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তবে সিয়াম ব্যতীত। কারণ সিয়াম আমারই জন্য পালন করা হয় এবং তার প্রতিদান আমিই দিব’।[২৯]
১০). সিয়াম মানুষকে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। মানুষের আহার, অসংযত আচরণ, অবাধ যৌন স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্ণ এক মাস সময়ের এ সংযম মেনে চলার ট্রেনিং বা অভ্যাস তাকে গোটা বছর সংযমী হয়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে প্রতি বছরের এক মাস ট্রেনিং তার পূর্ণ জীবনকে সংযমী করে গড়ে তোলে।[৩০]
১১). সাধারণত মানুষের চিত্ত সর্বদা চঞ্চল থাকে। তার মন সব সময় লোভনীয় জিনিস পাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। এ চাহিদা পূরণে সে বৈধ-অবৈধ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য পর্যন্ত ভুলে যায়। সে জন্য চিত্তের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। একমাত্র ছবর বা ধৈর্যের শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ ছবরের শিক্ষা লাভ করা যায়।[৩১]
অতএব বলা যায় যে, সিয়াম শুধু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। যা তাক্বওয়া অর্জনে ভূমিকা পালন করে। আর এ তাক্বওয়াই তাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে। তাই যে ব্যক্তি হেদায়াত লাভ করে, তার কোন ভয় নেই এবং চিন্তাও নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অনন্তর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যে হেদায়াত উপস্থিত হবে, অতঃপর যে আমার সেই হেদায়াত অনুসরণ করবে বস্তÍত তাদের কোনই ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩৮)।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ হাতিম আর-রাযী, তাফসীর ইবনু আবী হাতিম (ছাইদা, লেবানন : আল-মাকতাবাতুল ‘আছরিয়্যাহ, তা.বি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৬৯০।
[২]. আবূ মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনু মাসঊদ আল-বাগাবী, তাফসীরে বাগাবী (রিয়াদ : দারুত তায়্যেবাহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৭ হি.), ৭ম খণ্ড, পৃ. ২২৭; আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবূ বকর ইবনু ফারহুল আনছারী শামসুদ্দীন কুরতুবী, ‘আল-জা‘মিঊ লি-আহকামিল কুরআন (রিয়াদ : দারুল ‘আলিমিল কুতুব, তাবি), ১৬তম খণ্ড, পৃ. ১২৫; আবূল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, তাহক্বীক্ব : সামী ইবনু মুহাম্মাদ সালামাহ (রিয়াদ : দারুত ত্বায়্যেবাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি.), ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৪৫; মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর (আলেকজান্দ্রিয়া : দারুল ওফা, তা.বি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৭৪৪।
[৩]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩০; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩।
[৪]. প্রাগুক্ত।
[৫]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩।
[৬]. আল-জামিঊ লি-আহকামিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[৭]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি.), পৃ ৪০।
[৮]. আবূ বকর আল-জাযাইরী, আইসারুত তাফাসীর লি কালামিল ‘আলিয়্যুল কাবীর (মদীনা : মাকতাবাতুল ‘উলূম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯।
[৯]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ ৪০; মুহাম্মাদ ছালিহ আল-উছায়মীন, তাফসীরুল ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ আল-ওছায়মীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১।
[১০]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৬।
[১১]. সহীহ বুখারী, হা/৩৮৮৪, ‘আনছারগণের (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদা’ অধ্যায়, ‘আবূ তালিবের কিছ্ছা’ অনুচ্ছেদ; সহীহ মুসলিম, হা/২৪
[১২]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৪০।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/২২৮২।
[১৪]. ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, ১ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীস, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৬১৫।
[১৫]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, তা.বি.), পৃ. ১০৫২; ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৫ম সংস্করণ, ২০০৩), পৃ. ২১৯।
[১৬]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩।
[১৭]. প্রাগুক্ত।
[১৮]. মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া (জেদ্দা : মাজমূ‘আ যাদ, ১৪৩০ হি.), পৃ. ৭
[১৯]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪।
[২০]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪।
[২১]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫০২।
[২২]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০৩৯, ‘ই‘তিকাফ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; সহীহ মুসলিম, হা/২১৭৪।
[২৫]. সহীহ বুখারী, হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯, ২০১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৯, ৭৬০।
[২৬]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৬।
[২৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৪০০।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭।
[২৯]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[৩০]. ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, “তাক্বওয়া অর্জনে সিয়ামের ভূমিকা”, ছিরাতে মুস্তাক্বীম : পর্ব-১, ইসলামিক রিসার্চ এ্যান্ড রিফরমেশন সেন্টার, ঢাকা, মে ২০১৬, পৃ. ২০।
[৩১]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২১।
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ
‘রামাযান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। যা মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র রামাযান মাসের লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রীতে পূর্ণ কুরআন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে দুনিয়ার আকাশে ‘বায়তুল ‘ইযযাহ’ নামক স্থানে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন।[১]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ
‘আমরা কুরআনকে ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি’ (সূরা আল-ক্বদর : ১)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰہُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ
‘আমরা তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক রবকতময় রজনীতে’ (সূরা আদ-দুখান : ৩)। বরকতময় রজনী হল রামাযান মাসের লাইলাতুল ক্বদর।[২] আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনকে বহু গুণে গুণান্বিত করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম গুণ হল এটা হেদায়াত।
হেদায়াত
কুরআনের অন্যতম বিশেষত্ব হল এটা মানুষের জন্য হেদায়াত, পথপ্রদর্শক, পথনির্দেশক, পথের দিশারী এবং গাইড বুক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ
‘এটা (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাক্বীদের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ہُدًی وَّ بُشۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘এটা মুমিনদের জন্য পথনির্দেশ ও সুসংবাদ’ (সূরা আন-নামল : ১-২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ہُدًی وَّ رَحۡمَۃً لِّلۡمُحۡسِنِیۡنَ
‘এটা সৎকর্মপরায়ণদের জন্য পথনির্দেশক ও রহমত’ (সূরা লুক্বমান : ২-৩)।
হেদায়াত শব্দের অর্থ
হেদায়াত (الهداية) শব্দটি আরবী। الهدى মাছদার থেকে উৎপত্তি। অর্থ হল এমন আলো, যার মাধ্যমে সত্য পথে পরিচালিত হওয়া যায় এবং দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قَدۡ جَآءَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ - یَّہۡدِیۡ بِہِ اللّٰہُ مَنِ اتَّبَعَ رِضۡوَانَہٗ سُبُلَ السَّلٰمِ وَیُخۡرِجُہُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ بِاِذۡنِہٖ وَ یَہۡدِیۡہِمۡ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এ (জ্যোতির্ময় কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে (কুফরীর) অন্ধকার হতে বের করে (ঈমানের) আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)।
সালাফগণ হেদায়াত শব্দের কয়েকটি অর্থ ব্যক্ত করেছেন। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ, আনাস সহ অনেক সাহাবী (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) বলেন, الهدى অর্থ আলো।[৩] শা‘আবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ভ্রষ্টতা থেকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা’।[৪]
সাঈদ ইবনু যুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিস্তারিত তথ্য’।[৫]
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘(সঠিক পথের) বর্ণনা ও (সঠিক) পথ প্রদর্শন’।[৬]
আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ভ্রষ্টতা ও সন্দেহপূর্ণ বিষয় থেকে সঠিক পথ (হেদায়াত) লাভ করা এবং তার মাধ্যমে উপকারী পথে চলা’।[৭]
আবূ বকর আল-জাযাইরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘দুনিয়া ও আখেরাতের পরিপূর্ণতার এবং সৌভাগ্যের দিকে পথ প্রদর্শনের সংযোগকারী বা পরিচালনাকারী’।[৮]
হেদায়াতের প্রকার
হেদায়াত দু’ প্রকার। (ক) অন্তরে ঈমানের স্থিতিশীলতার হেদায়াত। যেটাকে বলা হয় هداية التوفيق والانتفاع । (খ) সত্যকে প্রকাশ ও সত্য পথ প্রদর্শন করার হেদায়াত। যাকে বলা হয় هداية التبيان والإرشاد।[৯] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ہُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ‘এটা (কুরআন) মুত্তাক্বীদের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ
‘রামাযান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন এবং (হক্ব ও বাতিলের) প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।
উপরিউক্ত দু’টি আয়াতের প্রথম আয়াতের হেদায়াত মুত্তাক্বীদের জন্য খাছ। আর দ্বিতীয় আয়াতের হেদায়াত সাধারণ মানুষদের জন্য। প্রথম আয়াতের হেদায়াত হল (هداية التوفيق والانتفاع) এবং দ্বিতীয় আয়াতের হেদায়াত হল (هداية التبيان والإرشاد)।
(ক) অন্তরে ঈমানের স্থিতিশীলতার হেদায়াত
বান্দার অন্তরে এই হেদায়াতের উপর আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কেউ ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّکَ لَا تَہۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ
‘আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন’ (সূরা আল-ক্বছাছ : ৫৬)। অর্থাৎ আপনি হেদায়াত করতে সক্ষম নন। বরং আপনার দায়িত্ব হল পৌঁছে দেয়া বা প্রচার করা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করেন।[১০] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ کَذٰلِکَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ رُوۡحًا مِّنۡ اَمۡرِنَا مَا کُنۡتَ تَدۡرِیۡ مَا الۡکِتٰبُ وَ لَا الۡاِیۡمَانُ وَ لٰکِنۡ جَعَلۡنٰہُ نُوۡرًا نَّہۡدِیۡ بِہٖ مَنۡ نَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِنَا وَ اِنَّکَ لَتَہۡدِیۡۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
‘এভাবে আমরা নিজ নির্দেশে আপনার প্রতি অহী করেছি রূহ। আপনি তো জানতেন না এ গ্রন্থ কী, ঈমান কী? পক্ষান্তরে আমরা একে করেছি এমন আলো, যার দ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি। আর নিশ্চয় আপনি সরল পথ প্রদর্শন করেন’ (সূরা আশ-শূরা : ৫২)।
ইবনু মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) তার পিতা মুসাইয়িব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেন, যখন আবূ তালিবের মুমূর্ষ অবস্থা তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকট গেলেন। আবূ জাহলও তার নিকট উপবিষ্ট ছিল। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচা, (لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ) কালেমাটি একবার পড়ুন, তাহলে আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট কথা বলতে পারব। তখন আবূ জাহল ও ‘আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ উমাইয়া বলল, হে আবূ তালিব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে ফিরে যাবে? এরা দু’জন তার সাথে একথাটি বারবার বলতে থাকল। সর্বশেষ আবূ তালিব তাদের সাথে যে কথাটি বলল, তাহল, আমি ‘আব্দুল মুত্তালিবের মিল্লাতের উপরেই আছি। এ কথার পর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আপনার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকব, যে পর্যন্ত আপনার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা না হয়। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।
مَا کَانَ لِلنَّبِیِّ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ یَّسۡتَغۡفِرُوۡا لِلۡمُشۡرِکِیۡنَ وَ لَوۡ کَانُوۡۤا اُولِیۡ قُرۡبٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُمۡ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ
‘নবী ও মুমিনদের পক্ষে উচিত নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য যদি তারা নিকটাত্মীয়ও হয় যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামী’ (সূরা আত-তাওবাহ : ১১৩)।
আরো নাযিল হল : ‘আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না’ (সূরা আল-ক্বছাছ : ৫৬)।[১১]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَیۡسَ عَلَیۡکَ ہُدٰىہُمۡ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ
‘তাদের হেদায়াত দানের দায়িত্ব আপনার নয়; বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَلَا ہَادِیَ لَہٗ
‘যাকে আল্লাহ বিপথগামী করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৮৬)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَنۡ یَّہۡدِ اللّٰہُ فَہُوَ الۡمُہۡتَدِ وَ مَنۡ یُّضۡلِلۡ فَلَنۡ تَجِدَ لَہٗ وَلِیًّا مُّرۡشِدًا
‘আল্লাহ যাকে সৎ পথে পরিচালিত করেন সে সৎপথ প্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনও তার কোন পথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ১৭)।
(খ) সত্যকে প্রকাশ এবং সত্য পথ প্রদর্শন করার হেদায়াত
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সত্যকে প্রকাশ করেছেন ও সত্য পথ প্রদর্শন করেছেন এবং নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে সত্য পথের দিক-নির্দেশনা দান করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اِنَّکَ لَتَہۡدِیۡۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
‘আর আপনি তো অবশ্যই সরল পথের দিকে দিক-নির্দেশ করেন’ (সূরা আশ-শূরা : ৫২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّمَاۤ اَنۡتَ مُنۡذِرٌ وَّ لِکُلِّ قَوۡمٍ ہَادٍ
‘আপনি তো শুধু ভয় প্রদর্শনকারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে পথপ্রদর্শক’ (সূরা আর-রা‘দ : ৭)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَمَّا ثَمُوۡدُ فَہَدَیۡنٰہُمۡ فَاسۡتَحَبُّوا الۡعَمٰی عَلَی الۡہُدٰی
‘আর ছামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, আমরা তাদেরকে পথ নির্দেশ করেছিলাম, কিন্তু তারা সৎপথের পরিবর্তে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করেছিল’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ : ১৭)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ ہَدَیۡنٰہُ النَّجۡدَیۡنِ ‘আমরা তাদেরকে দু’টি পথ দেখিয়েছি’ (সূরা আল-বালাদ : ১০)।
সুধী পাঠক! মুত্তাক্বীরা উপরিউক্ত দু’টি হেদায়াতই লাভ করে। তবে মুত্তাক্বী ছাড়া কেউই هداية التوفيق লাভ করে না। আর هداية البيان শুধু আমল করারই নামান্তর। যা প্রকৃতপক্ষে হেদায়াত নয়।[১২] এ কুরআন মানুষের জন্য হেদায়াত। বিশেষ করে মুত্তাক্বীদের জন্য। হেদায়াতকে মুত্তাক্বীদের সাথে বিশিষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এটা (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাক্বীদের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, মুত্তাক্বীগণকে কেন হেদায়াতপ্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট করেছেন? এ ব্যাপারে আলেমগণ বলেন, মূলত মুত্তাক্বীরাই আল্লাহর কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারে, যারা মুত্তাক্বী নয় তারা হেদায়াত লাভ করতে পারে না। যদিও কুরআন তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এ অর্থের উপর প্রমাণবহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَہۡدِیۡ لِلَّتِیۡ ہِیَ اَقۡوَمُ وَ یُبَشِّرُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ اَجۡرًا کَبِیۡرًا
‘নিশ্চয় এ কুরআন হেদায়াত করে সে পথের দিকে, যা আক্বওয়াম তথা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৯)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ ہُوَ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ہُدًی وَّ شِفَآءٌ وَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ وَقۡرٌ وَّ ہُوَ عَلَیۡہِمۡ عَمًی اُولٰٓئِکَ یُنَادَوۡنَ مِنۡ مَّکَانٍۭ بَعِیۡدٍ
‘বলুন! মুমিনদের জন্য ইহা পথ নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব। তারা এমন যে, যেন তাদেরকে আহ্বান করা হয় বহু দূর হতে’ (সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৪৪)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ نُنَزِّلُ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ مَا ہُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ لَا یَزِیۡدُ الظّٰلِمِیۡنَ اِلَّا خَسَارًا
‘আমরা অবতীর্ণ করি কুরআন, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও দয়া, কিন্তু তা সীমালঙ্ঘনকারীদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৮২)। এ বিষয়ে আরোও অনেক আয়াত রয়েছে এবং এগুলোর ভাবার্থ এই যে, যদিও কুরআনুল কারীম সকলের জন্যই হেদায়াত স্বরূপ, তথাপি শুধু সৎ লোকেরাই এর দ্বারা উপকার পেয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَللّٰہُ نَزَّلَ اَحۡسَنَ الۡحَدِیۡثِ کِتٰبًا مُّتَشَابِہًا مَّثَانِیَ تَقۡشَعِرُّ مِنۡہُ جُلُوۡدُ الَّذِیۡنَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّہُمۡ ثُمَّ تَلِیۡنُ جُلُوۡدُہُمۡ وَ قُلُوۡبُہُمۡ اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ ذٰلِکَ ہُدَی اللّٰہِ یَہۡدِیۡ بِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ
‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত এমন এক গ্রন্থ, যাতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ একই কথা নানাভাবে বার বার বলা হয়েছে। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের চামড়ার (লোম) খাড়া হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণের প্রতি নরম হয়ে যায়। এটিই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই’ (সূরা আয-যুমার : ২৩)।
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে হেদায়াত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এ (জ্যোতির্ময় কুরআন) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে (কুফরীর) অন্ধকার হতে বের করে (ঈমানের) আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)।
আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَثَلُ مَا بَعَثَنِى اللهُ بِهِ مِنَ الْهُدَى وَالْعِلْمِ كَمَثَلِ الْغَيْثِ الْكَثِيْرِ أَصَابَ أَرْضًا فَكَانَتْ مِنْهَا طَائِفَةٌ طَيِّبَةٌ فَقَبِلَتِ الْمَاءَ فَأَنْبَتَتِ الْكَلْأَ وَالْعُشْبَ الْكَثِيْرَ وَكَانَتْ مِنْهَا أَجَادِبُ أَمْسَكَتِ الْمَاءَ فَنَفَعَ اللهُ بِهَا النَّاسَ فَشَرِبُوْا وَسَقَوْا وَزَرَعُوْا وَأَصَابَ مِنْهَا طَائِفَةً أُخْرَىْ إِنَّمَا هِىَ قِيْعَانٌ لَا تُمْسِكُ مَاءً وَلَا تُنْبِتُ كَلأً فَذَلِكَ مَثَلُ مَنْ فَقِهَ فِىْ دِيْنِ اللهِ وَنَفَعَهُ مَا بَعَثَنِى اللهُ بِهِ فَعَلِمَ وَعَلَّمَ وَمَثَلُ مَنْ لَمْ يَرْفَعْ بِذَلِكَ رَأْسًا وَلَمْ يَقْبَلْ هُدَى اللهِ الَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ
‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হেদায়াত ও ইলম সহ পাঠিয়েছেন, তাঁর উদাহরণ মুষলধারে বৃষ্টির ন্যায়, যা কোন ভূখ-ে পতিত হয়। সে ভূখ-ের একাংশ ছিল উৎকৃষ্ট, যা বৃষ্টিকে গ্রহণ করে এবং প্রচুর ঘাস-পাতা ও তৃণলতা জন্মায়। অপর অংশ ছিল কঠিন ও গভীর। যা পানি আটকিয়ে রাখে, যার দ্বারা আল্লাহ মানুষের কল্যাণ সাধন করেন। লোকেরা তা থেকে পান করে, অন্যকে পান করায় ও কৃষিকাজ করে। পক্ষান্তরে কতক বৃষ্টি ভূমির এমন অংশে পতিত হয়, যা সমতল ও অনুর্বর। যা পানি আটকায় না বা সেখানে ঘাস-পাতাও জন্মে না। এটা ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছে এবং যা নিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, তা তাঁর উপকার সাধন করেছে। সে নিজে তা শিখেছে ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। আর ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে তাঁর দিকে মাথা তুলেও দেখেনি এবং আল্লাহর যে হেদায়াত সহকারে আমি প্রেরিত হয়েছি, তা কবুলও করেনি’।[১৩]
অতএব কুরআন হল হক্ব ও জান্নাতের পথের দিশারী। পার্থিব জীবন সুখী করার পথ-নিদের্শক। কুরআনে রয়েছে হেদায়াতের যাবতীয় উপায়-উপকরণ। কুরআনে রয়েছে আদেশ-নিষেধ-উপদেশ। হালাল ও হারাম, সঠিক ও বেঠিক, হক্ব ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য। দুনিয়া ও আখেরাতের সুখের জন্য সঠিক পথের গাইড। যারা আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, যারা সাবধানী ও তাক্বওয়াশীল হয়, কেবল তারাই এর দ্বারা হেদায়াত লাভ করে। সকালের আলো সকলের জন্য উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু কেবল সেই মানুষই সেই আলো দ্বারা উপকৃত হয়, যে ঘুম ছেড়ে জেগে ওঠে।
যদি কেউ কুরআনকে বিশ্বাসই না করে, তাহলে সে হেদায়াত পাবে কীভাবে? অন্ধ কি আলোর দিশা পেতে পারে? আলো দ্বারা উপকৃত হয় কেবল চক্ষুষ্মান লোকেরা। বলা বাহুল্য, কুরআন তাক্বওয়াশীল অর্থাৎ আল্লাহভীরুদের জন্য হেদায়াত। যেহেতু তারাই আল্লাহ ও তাঁর কুরআনকে বিশ্বাস করে। আল্লাহকে ভয় করে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করে। তারাই কুরআনী আলো লাভ করে, তারাই পায় সত্য ও সৎপথের দিশা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَتَّقُوا اللّٰہَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ فُرۡقَانًا وَّ یُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ وَ اللّٰہُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ
‘হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকারী শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় অনুগ্রহশীল’ (সূরা আল-আনফাল : ২৯)। অতএব বিশ্বাস ও ভয় হল হেদায়াত লাভের পূর্বশর্ত। আর মুত্তাক্বী তারাই যারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস আনে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩) এবং আল্লাহকে ভয় করে (সূরা আন-নাযি‘আত : ৪০১)।
মুত্তাক্বী কারা
‘মুত্তাক্বীন’ শব্দটি ‘মুত্তাক্বী’-এর বহুবচন। মুত্তাক্বী শব্দের মূল ধাতু تقوي (তাক্বওয়া)। এই আরবী শব্দটি وقاية (বিকায়াহ) হতে উৎপত্তি। অর্থ হল অনিষ্টকর ও কষ্টদায়ক বস্তু হতে আত্মরক্ষা করা, সতর্কতা ও ভয়ভীতি।[১৪] আল্লাহর ভয়, আল্লাহভীতি, পরহেযগারী, দ্বীনদারী, ধার্মিকতা ইত্যাদি।[১৫] সাধারণ অর্থে আল্লাহভীতিকে ‘তাক্বওয়া’ বলা হয়। শারঈ অর্থে- আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর নির্র্দেশিত ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালনা করা, জীবনের কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম যেন লংঘিত না হয়, এরকম সতর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্কতার সাথে চলার নামই তাক্বওয়া। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
الذين يحذرون من الله عقوبته في ترك ما يعرفون من الهدى ويرجون رحمته في التصديق بما جاء به
‘মুত্তাক্বী তারাই, যারা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে হেদায়াতকে পরিত্যাগ করে না এবং তাঁর রহমতের আশা রেখে তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ কিতাবকে বিশ্বাস করে থাকেন’। তিনি আরো বলেন, ‘মুত্তাক্বী তারাই যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে শিরক হতে দূরে থাকেন এবং আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশাবলী মেনে চলেন’।[১৬]
হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মুত্তাক্বী তারাই, যারা আল্লাহর হারামকে পরিত্যাগ করে এবং তাদের উপর যা ফরয করা হয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করে’।[১৭]
ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাক্বওয়া’ হল,
فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ
‘আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা প্রতিপালন করা এবং যা নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা’।[১৮]
অতএব তাক্বওয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকার নাম। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সকল পাপাচার, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং এ জাতীয় সকল কাজ হতে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসারে সার্বিক জীবন পরিচালনার নাম ‘তাক্বওয়া’।
ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট তাক্বওয়ার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনও এমন পথ অতিক্রম করেছেন, যেটি খুবই সংকীর্ণ এবং যে পথের দুই দিকেই কাঁটাপূর্ণ গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত? তদুত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখন বললেন, এমতাবস্থায় আপনি কিভাবে পথ অতিক্রম করেছেন? জবাবে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, খুবই সতর্কতার সাথে কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে সে পথ অতিক্রম করেছি। উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, এটাই ‘তাক্বওয়া’।[১৯]
আর মুত্তাক্বী হল ‘যারা যাবতীয় শিরক ও মূর্তি পূজা থেকে দূরে থাকে এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করে’।[২০]
মানুষের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে তাক্বওয়ার উপর নির্ভরশীল। তাক্বওয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষে দুনিয়াতে সৎ ও কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করা ও পরকালে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ মানব মন সর্বক্ষণ অসৎ ও অনিষ্টকর কার্যাদি সম্পাদন করতে প্রলুব্ধ করে এবং আল্লাহদ্রোহীতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ
‘নিশ্চয় মানব মন সর্বদা অনিষ্টকর কাজ করার জন্য নির্দেশ দেয়’ (সূরা ইউসুফ : ৫৩)। আর এই নফসকে উদ্ধত আচরণ হতে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাক্বওয়া। কোন ব্যক্তি যখন তার নফসকে নিষ্কলুষ করার উদ্দেশ্যে তাক্বওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, তখন নফস তার মজ্জাগত স্বভাব অর্র্র্র্র্র্র্র্র্থাৎ অনিষ্টকর কাজের প্রতি নির্দেশ করার যোগ্যতা পরিত্যাগ করে মন্দ কাজের প্রতি তিরস্কার করার যোগ্যতা অর্জন করে। এমতাবস্থায় সে আর মন্দ কাজের প্রতি প্ররোচনা যোগায় না, বরং নফস মন্দ কাজ করতে উদ্যত হলে সে বিরত রাখার জন্য তিরস্কার করতে থাকে। মনের এ অবস্থাকে আল-কুরআনে ‘নফসে লাউওয়ামাহ’(نفس لوامة) অর্থাৎ ‘তিরস্কারকারী আত্মা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ ‘আরো শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ৫৩)।
যখন কোন ব্যক্তি নফসের এ অবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে তাকে আরও সঠিক এবং নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে, তখন নফস তিরস্কারের স্তর অতিক্রম করে এমন স্তরে উপনীত হয় যে, সেখানে সে প্রশান্ত ও নিরুদ্বেগ মন-মানসে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় সে শুধু সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রতি অনুপ্রেরণা প্রদান করতে থাকে। মনের এ অবস্থাকে আল-কুরআনে (نفس مطمئنة) ‘নফসে মুত্বমাইন্নাহ’ অর্থাৎ ‘প্রশান্ত আত্মা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیَّتُہَا النَّفۡسُ الۡمُطۡمَئِنَّۃُ - ارۡجِعِیۡۤ اِلٰی رَبِّکِ رَاضِیَۃً مَّرۡضِیَّۃً - فَادۡخُلِیۡ فِیۡ عِبٰدِیۡ -وَ ادۡخُلِیۡ جَنَّتِیۡ
‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও প্রিয়পাত্র হয়ে। অনন্তর তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (সূরা আল-ফজর : ২৭-৩০)।
হেদায়াত লাভের অনন্য মাস রামাযান
রামাযান মর্যাদাসম্পন্ন মাস। এ মাসেই আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনকে অবতীর্ণ করেছেন। এটি বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট অনুগ্রহ। কেননা এই কুরআন সম্পূর্ণটা হেদায়াত দিয়ে পরিপূর্ণ। আর হেদায়াত ঐ ব্যক্তির জন্য, যে কুরআনের প্রতি ঈমান আনে, তার সত্যায়ন করে এবং অনুসরণ করে।[২১]
এগুলো মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য এবং হেদায়াতকে তাদের জন্যই খাছ করা হয়েছে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২)।
রামাযানের সাথে তাক্বওয়ার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। কেননা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জন। আর যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে, সেই হেদায়াত লাভে ধন্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)। নিশ্চয় সিয়াম তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম কারণ। সিয়ামের মাধ্যমে যেভাবে তাক্বওয়া অর্জিত হয়। যথা-
১). রামাযান মাসে সিয়ামপালনকারী আল্লাহর নির্দেশ পালন করে এবং নিষেধ বর্জন করে। আর এটাই তাক্বওয়া (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)।
২). (ছুবহে ছাদিক্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত) খাওয়া, পান এবং সহবাস করা সহ আল্লাহ যা হারাম করেছেন, অন্তর ও প্রবৃত্তির ঝোঁক থাকার পরও আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নেকি অর্জন করার জন্য সিয়ামপালনকারী তা পরিত্যাগ করে; যা তাক্বওয়ার অন্তর্ভুক্ত (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)।[২২]
৩). সিয়ামপালনকারী আল্লাহর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রাণাধীনে থাকার অনুশীলন করে। অতঃপর আল্লাহর রহমতে প্রবৃত্তির চাহিদাগুলো পরিত্যাগ করে।[২৩] আর এটাই তাক্বওয়া।
৪). নিশ্চয় শয়তান মানুষের মধ্যে তার রক্তের ন্যায় বিচরণ করে থাকে।[২৪] সিয়ামপালনকারী সিয়াম অবস্থায় শয়তানের রাস্তাকে সঙ্কীর্ণ ও সংকুচিত করে, তার প্রভাব ও কর্তৃত্বকে দুর্বল করে এবং পাপাচার হ্রাস পায়। আর এটাই তাক্বওয়া।
৫). সিয়ামপালনকারী আল্লাহর আনুগত্য করে। যেমন রামাযানে ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল ইবাদত বেশি বেশি করে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৪)। আর অনুগত থাকা তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের সিয়াম পালন করে তার পূর্বের (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্বের (ছগীরা) গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্ববর্তী (ছগীরা) গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়’।[২৫]
৬). গরীব-অসহায়, দুর্দশাগ্রস্ত এবং মিসকীন যখন কষ্ট, ক্লেশ এবং খাদ্য সংকটে পতিত হয়, তখন তাদের সহযোগিতা করা ধনীদের উপর অপরিহার্য হয়। আর এটা তাক্বওয়ার বৈশিষ্ট্য।[২৬]
৭). সিয়াম যৌবনকে দমন করার মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র করে। আর এটা তাক্বওয়ার গুণ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাহলে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম’।[২৭]
৮). সিয়ামপালনকারীর মধ্যে রয়েছে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা এবং মন্দ আচরণ থেকে অন্তরের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। কেননা সিয়াম মন্দ আচরণকে প্রতিরোধ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং কাজ ছাড়েনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[২৮]
৯). সিয়াম লৌকিকতামূক্ত ইবাদত। কেননা অন্য যে কোন ইবাদত যথা সালাত, হজ্জ ইত্যাদি লৌকিকতা রক্ষার খাতিরে অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে থাকে, কিন্তু সিয়ামের ব্যাপারটি সম্পূর্ণটাই স্বতন্ত্র। সিয়াম শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্যই পালন করা হয়। যা তাক্বওয়ার চরিত্র। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ تَعَالَى إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِيْ وَأَنَا أَجْزِي بِهِ
‘আদম সন্তানের নেক আমল বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রত্যেক নেক আমল দশগুণ হতে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তবে সিয়াম ব্যতীত। কারণ সিয়াম আমারই জন্য পালন করা হয় এবং তার প্রতিদান আমিই দিব’।[২৯]
১০). সিয়াম মানুষকে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়। মানুষের আহার, অসংযত আচরণ, অবাধ যৌন স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্ণ এক মাস সময়ের এ সংযম মেনে চলার ট্রেনিং বা অভ্যাস তাকে গোটা বছর সংযমী হয়ে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে প্রতি বছরের এক মাস ট্রেনিং তার পূর্ণ জীবনকে সংযমী করে গড়ে তোলে।[৩০]
১১). সাধারণত মানুষের চিত্ত সর্বদা চঞ্চল থাকে। তার মন সব সময় লোভনীয় জিনিস পাওয়ার জন্য অস্থির থাকে। এ চাহিদা পূরণে সে বৈধ-অবৈধ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য পর্যন্ত ভুলে যায়। সে জন্য চিত্তের চাহিদা পূরণের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। একমাত্র ছবর বা ধৈর্যের শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ ছবরের শিক্ষা লাভ করা যায়।[৩১]
অতএব বলা যায় যে, সিয়াম শুধু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। যা তাক্বওয়া অর্জনে ভূমিকা পালন করে। আর এ তাক্বওয়াই তাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে। তাই যে ব্যক্তি হেদায়াত লাভ করে, তার কোন ভয় নেই এবং চিন্তাও নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অনন্তর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট যে হেদায়াত উপস্থিত হবে, অতঃপর যে আমার সেই হেদায়াত অনুসরণ করবে বস্তÍত তাদের কোনই ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৩৮)।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ হাতিম আর-রাযী, তাফসীর ইবনু আবী হাতিম (ছাইদা, লেবানন : আল-মাকতাবাতুল ‘আছরিয়্যাহ, তা.বি.), ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৬৯০।
[২]. আবূ মুহাম্মাদ হুসাইন ইবনু মাসঊদ আল-বাগাবী, তাফসীরে বাগাবী (রিয়াদ : দারুত তায়্যেবাহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৭ হি.), ৭ম খণ্ড, পৃ. ২২৭; আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনু আবূ বকর ইবনু ফারহুল আনছারী শামসুদ্দীন কুরতুবী, ‘আল-জা‘মিঊ লি-আহকামিল কুরআন (রিয়াদ : দারুল ‘আলিমিল কুতুব, তাবি), ১৬তম খণ্ড, পৃ. ১২৫; আবূল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, তাহক্বীক্ব : সামী ইবনু মুহাম্মাদ সালামাহ (রিয়াদ : দারুত ত্বায়্যেবাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি.), ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৪৫; মুহাম্মাদ ইবনু আলী ইবনু মুহাম্মাদ শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর (আলেকজান্দ্রিয়া : দারুল ওফা, তা.বি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৭৪৪।
[৩]. জামি‘ঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩০; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩।
[৪]. প্রাগুক্ত।
[৫]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩।
[৬]. আল-জামিঊ লি-আহকামিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[৭]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছির আস-সা‘আদী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান (বৈরূত : মুওয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি.), পৃ ৪০।
[৮]. আবূ বকর আল-জাযাইরী, আইসারুত তাফাসীর লি কালামিল ‘আলিয়্যুল কাবীর (মদীনা : মাকতাবাতুল ‘উলূম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯।
[৯]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ ৪০; মুহাম্মাদ ছালিহ আল-উছায়মীন, তাফসীরুল ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ আল-ওছায়মীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১।
[১০]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৬।
[১১]. সহীহ বুখারী, হা/৩৮৮৪, ‘আনছারগণের (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদা’ অধ্যায়, ‘আবূ তালিবের কিছ্ছা’ অনুচ্ছেদ; সহীহ মুসলিম, হা/২৪
[১২]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৪০।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/৭৯; সহীহ মুসলিম, হা/২২৮২।
[১৪]. ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, ১ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীস, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৬১৫।
[১৫]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যাহ, তা.বি.), পৃ. ১০৫২; ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৫ম সংস্করণ, ২০০৩), পৃ. ২১৯।
[১৬]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৩।
[১৭]. প্রাগুক্ত।
[১৮]. মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া (জেদ্দা : মাজমূ‘আ যাদ, ১৪৩০ হি.), পৃ. ৭
[১৯]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪।
[২০]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৪।
[২১]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫০২।
[২২]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/২০৩৯, ‘ই‘তিকাফ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; সহীহ মুসলিম, হা/২১৭৪।
[২৫]. সহীহ বুখারী, হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯, ২০১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৭৫৯, ৭৬০।
[২৬]. তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৬।
[২৭]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৪০০।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৩, ৬০৫৭।
[২৯]. সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১।
[৩০]. ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, “তাক্বওয়া অর্জনে সিয়ামের ভূমিকা”, ছিরাতে মুস্তাক্বীম : পর্ব-১, ইসলামিক রিসার্চ এ্যান্ড রিফরমেশন সেন্টার, ঢাকা, মে ২০১৬, পৃ. ২০।
[৩১]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২১।
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
Last edited: