আহলে কুরআন বা হাদীহ অস্বীকারকারীদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার নিরসন।
১। তায়াম্মুমের অপর আয়াত আল্লাহ বলেন, فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর।’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৫/৬)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ পরিস্কার করে বলেননি তায়াম্মুম কি শুধু অযুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এমন সংশয়ে সাহাবীরা ও পড়েছিলেন। যখন সূরা মায়েদার উক্ত আয়াত নাযিল হলো তখন সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পারেন নি যে, এটা কেবল ওযুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না ফরয গোসলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ফলে সফর অবস্থায় আম্মার বিন ইয়াসের ও ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব(রাঃ) উভয়ের ফরয গোসলের হাজত হলে পানি না পেয়ে ওমর(রাঃ) গোসল করতে না পারায় সালাত আদায় করেন নি। কিন্তু আম্মার স্বীয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে তায়াম্মুম করেন।
ঘটনা জানতে পেরে রাসূল(ﷺ)তায়াম্মুমের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন এবং বললেন, তায়াম্মুম হলো ওযূর বিকল্প এবং ওযু ও গোসল উভয় ক্ষেত্রে একই নিয়মে প্রযোজ্য। (বুখারী হা/৩৩৮; মুসলিম হা/৩৬৮; মিশকাত হা/৫২৮)।
যদি রাসূল(ﷺ) এখানে তায়াম্মুমের সঠিক অর্থ নির্ধারণ না করে দিতেন, তাহলে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ভীষণ মতানৈক্যের সৃষ্টি হতো এবং উক্ত বিষয়াদির চূড়ান্ত কোন ফায়সালা কখনোই সম্ভব হতো না।
২। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করবে, তাহলে সালাত ক্বসর(সংক্ষিপ্ত) করলে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’(সূরা আন-নিসা: ১০১)।
উপরিউক্ত আয়াত থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, সফরে ক্বসরের সালাত ভয়-ভীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সে জন্যই কিছু সাহাবায়ে কিরাম রাসূল(ﷺ)-কে বিস্মৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যেমন-ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা(রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব(রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তা‘আলা যে বলেছেন, ‘যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফিররা তোমাদের উপর আক্রমণ করবে, তবে সালাত ক্বসর(সংক্ষিপ্ত) করলে এতে তোমাদের কোন দোষ নেই।’
আর মানুষ তো এখন নিরাপদে আছে। (অর্থাৎ তাহলে কি নিরাপদ স্থানে ক্বসর করা যাবে না?)। জবাবে তিনি বলেন, তুমি যে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো, আমিও সে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম।
তাই আমিও এ বিষয়ে রাসূল(ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি উত্তরে বলেছিলেন,‘ওটা তো একটি সাদাক্বাহ্ বিশেষ, যা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দান করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর সাদাক্বাহ্ গ্রহণ কর।’ (সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬; তিরমিযী, হা/৩০৩৪; নাসাঈ, হা/১৪৩৩; আবু দাউদ, হা/১১৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৫, ২৪৬)।
৩। জুম‘আর সালাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,إِذَا نُودِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ‘জুম‘আর দিন সালাতের জন্য আযান দেওয়া হলে আল্লাহর যিকরের দিকে দ্রুত ধাবিত হও।’(সূরা জুম‘আ: ৬২/৯)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ পরিস্কার করে বলেননি জুম'আর দিন কোন ওয়াক্তের আযানের কথা বলা হয়েছে। হাদীস বাদ দিলে এ আয়াতের অর্থ নির্ধারণে সমস্যা দেখা দিবে।
যেমন: (১) এ নির্দেশ জুম‘আর দিনের কোন সালাতের জন্য?(২) যদি সেটা পৃথক সালাত হয়, তবে তা কখন অনুষ্ঠিত হবে? হয়তোবা মুনকিরে হাদীস পন্ডিতরা বলবেন, এক্ষেত্রে হাদীসের প্রয়োজন নেই। কেননা وَذَرُوا الْبَيْعَ এবং وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ আয়াতের এই দুই অংশ একথার প্রমাণ বহন করে যে, জুম‘আর সালাত যোহরের সময় অনুষ্ঠিত হবে। কেননা বেচা-কেনা এবং রিযিক অনুসন্ধান দুপুরের সময়েই হয়ে থাকে। অথচ এই ব্যাখ্যা কতই না দুর্বল।
কেননা দুপুরের খরতাপে মূলতঃ বিশ্রামের সময়। আর বেচা-কেনা ও রিযিক অনুসন্ধান মূলত সকালে ও সন্ধ্যায় হয়ে থাকে।
যেমন:-রাসূল(ﷺ) বলেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার উম্মতের জন্য ভোরের কর্মের মধ্যে বরকত দান করো। বর্ণনাকারী বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোথাও ক্ষুদ্র সেনাদল বা বৃহৎ সৈন্যবাহিনী পাঠাতেন তখন তাদেরকে দিনের প্রথমাংশে পাঠাতেন। রাবী ছাখার আল-গামেদী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি তার ব্যবসাদলকে দিনের শুরুতেই পাঠিয়ে দিতেন। ফলে তিনি ধনী হন এবং তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। (আবু দাঊদ হা/২৬০৬; মিশকাত হা/৩৯০৮; সহীহুল জামে‘ হা/১৩০০)।
অতএব যদি এক্ষেত্রে সুন্নাহ আমাদেরকে নির্দেশনা না দিত, তাহলে আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতাম। এ কারণেই রাসূল(ﷺ) বলেন বিদায় হজ্জে ঘোষণা করে গেছেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা মযবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’(মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮)।
আর একারণেই সাহাবায়ে কেরাম কোন মাসআলা সম্পর্কে রায় প্রদান করার পর রাসূলের কোন হাদীস অবগত হলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের রায় পরিত্যগ করতেন। [এ ব্যাপারে জানার জন্য আমাদের ডক্টরেট থিসিস-এর ‘মূলনীতি’ অধ্যায়ের ১মূলনীতি (১৩৩-১৫০ পৃ.) পাঠ করুন।]।
৪। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত।’(সূরা আল-মায়িদাহ: ৩)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত মাছের বিধান কী হবে? কলিজার বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কী-না?রাসূল(ﷺ)-এর বাণীসূচক হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর মধ্যে সমস্ত প্রকারের মৃত মাছ ও মৃত টিড্ডি খাওয়া হালাল, আর রক্তের মধ্যে কলিজা বা লিভার ও প্লীহা খাওয়া হালাল।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর(রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল(ﷺ)বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য দু’প্রকারের মৃতজীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হলো, মাছ ও টিড্ডি, এবং দু’প্রকারের রক্ত হলো, কলিজা ও প্লীহা।’(ইবনু মাজাহ, হা/৩৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭২৪; সহীহুল জামি, হা/২১০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১১৮)।
এক্ষেত্রে কিন্তু কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করে না, এমনকি যারা নিজেকে আহলে কুরআন বলে দাবী করে তারাও না। তারাও নবী(ﷺ)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজা করে মৃত মাছ ও কলিজা ভক্ষণ করছে।
৫। আল্লাহ তাআলা বলেন, قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ‘বলো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব সাজসজ্জা এবং পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করেছে?’(আল-আ‘রাফ, ৭, ৩২)।
এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এটাই যে, আল্লাহ বান্দার জন্য সাজসজ্জা হালাল করেছেন, কোন কোন
সাজসজ্জা হালাল করেছেন সেটা বলেন নি। অথচ হাদীসে এসেছে যে, কিছু শোভা-সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার বস্তু আছে, যেটা হারাম।
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত যে, ‘একদা তিনি বের হলেন, তাঁর এক হাতে রেশম আর অন্য হাতে স্বর্ণ ছিল। তিনি বললেন, এ দুটি জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫০; আবূ দাঊদ, হা/৪০৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৯৫)
এই হাদীসটি ইমাম হাকেম বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটি সহীহ বলেছেন। এই বিষয়ে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।
৬। সাহাবায়ে কেরাম ভাষাবিদ ও অলংকার শাস্ত্রে পন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন আয়াতের অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে রাসূল(ﷺ)-এর শরণাপন্ন হতেন। যেমন হজ্জ ফরযের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে।’(আলে-ইমরান:, ৩/৯৭)।
উক্ত আয়াতে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের হজ্জ সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে হজ্জ করতে হয় কুরআনে কোথাও পরিপূর্ণ ভাবে বলা হয়নি।তাই তো উক্ত আয়াত নাযিল হলে সাহাবী আক্বরা বিন হাবেস(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি এ বছরের জন্য, না প্রতি বছরের জন্য? জবাবে রাসূল(ﷺ) বললেন, একজন মুমিনের জীবনে মাত্র একবার ফরয।’ (আবু দাঊদ হা/১৭২১; আহমাদ হা/২৩০৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে-ইমরান: ৯৭ আয়াত)।
হজ্জের একটি ফরজ হচ্ছে ৯ই জিলহজ্জ আরাফায় অবস্থান করা। অথচ কুরআনের কোথাও একথা আসেনি কিন্তু রাসূল(ﷺ) এর হাদীসে এসেছে। আবদুর রহমান ইবনু ইয়া‘মুর আদ্ দায়লী(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ- তিনি বলেন,
আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি আরাফাই হচ্ছে হজ্জ। যে ব্যক্তি ‘আরাফায় মুযদালিফার রাতে(৯ যিলহজ্জ শেষ রাতে) ভোর হবার আগে আরাফাতে পৌঁছতে পেরেছে সে হজ্জ পেয়ে গেছে। মিনায় অবস্থানের সময় হলো তিনদিন। যে দুই দিনে তাড়াতাড়ি মিনা হতে ফিরে আসলো তার গুনাহ হলো না।
আর যে (তিনদিন পূর্ণ করে) দেরী করবে তারও গুনাহ হলো না। (আবু দাঊদ ১৯৪৭, নাসায়ী ৩০৪৪, ৩০১৬, তিরমিযী ৮৮৯, ইবনু মাজাহ ৩০১৫, আহমাদ ১৮৭৭৪, দারিমী ১৯২৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৪৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৮৯২ মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২৭১৪)।
এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমরা আমার নিকট হতে হজ্জের হুকুম-আহকাম শিখে নাও। কারণ এ হজ্জের পর আর আমি হজ্জ করতে পারব কিনা তা জানি না। (সহীহ মুসলিম ১২৯৭, আবূ দাঊদ ১৯৭০, আহমাদ ১৪৪১৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৫৫২, মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২৬১৮)
১। তায়াম্মুমের অপর আয়াত আল্লাহ বলেন, فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا ‘অতঃপর যদি পানি না পাও, তাহ’লে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর।’ (সূরা আল-মায়েদাহ: ৫/৬)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ পরিস্কার করে বলেননি তায়াম্মুম কি শুধু অযুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এমন সংশয়ে সাহাবীরা ও পড়েছিলেন। যখন সূরা মায়েদার উক্ত আয়াত নাযিল হলো তখন সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পারেন নি যে, এটা কেবল ওযুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না ফরয গোসলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ফলে সফর অবস্থায় আম্মার বিন ইয়াসের ও ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব(রাঃ) উভয়ের ফরয গোসলের হাজত হলে পানি না পেয়ে ওমর(রাঃ) গোসল করতে না পারায় সালাত আদায় করেন নি। কিন্তু আম্মার স্বীয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে তায়াম্মুম করেন।
ঘটনা জানতে পেরে রাসূল(ﷺ)তায়াম্মুমের নিয়ম শিখিয়ে দিলেন এবং বললেন, তায়াম্মুম হলো ওযূর বিকল্প এবং ওযু ও গোসল উভয় ক্ষেত্রে একই নিয়মে প্রযোজ্য। (বুখারী হা/৩৩৮; মুসলিম হা/৩৬৮; মিশকাত হা/৫২৮)।
যদি রাসূল(ﷺ) এখানে তায়াম্মুমের সঠিক অর্থ নির্ধারণ না করে দিতেন, তাহলে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ভীষণ মতানৈক্যের সৃষ্টি হতো এবং উক্ত বিষয়াদির চূড়ান্ত কোন ফায়সালা কখনোই সম্ভব হতো না।
২। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি তোমাদের আশংকা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করবে, তাহলে সালাত ক্বসর(সংক্ষিপ্ত) করলে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’(সূরা আন-নিসা: ১০১)।
উপরিউক্ত আয়াত থেকে আপাতদৃষ্টিতে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, সফরে ক্বসরের সালাত ভয়-ভীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সে জন্যই কিছু সাহাবায়ে কিরাম রাসূল(ﷺ)-কে বিস্মৃত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যেমন-ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা(রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব(রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তা‘আলা যে বলেছেন, ‘যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফিররা তোমাদের উপর আক্রমণ করবে, তবে সালাত ক্বসর(সংক্ষিপ্ত) করলে এতে তোমাদের কোন দোষ নেই।’
আর মানুষ তো এখন নিরাপদে আছে। (অর্থাৎ তাহলে কি নিরাপদ স্থানে ক্বসর করা যাবে না?)। জবাবে তিনি বলেন, তুমি যে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো, আমিও সে বিষয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম।
তাই আমিও এ বিষয়ে রাসূল(ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি উত্তরে বলেছিলেন,‘ওটা তো একটি সাদাক্বাহ্ বিশেষ, যা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দান করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর সাদাক্বাহ্ গ্রহণ কর।’ (সহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬; তিরমিযী, হা/৩০৩৪; নাসাঈ, হা/১৪৩৩; আবু দাউদ, হা/১১৯৯; ইবনু মাজাহ, হা/১০৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৫, ২৪৬)।
৩। জুম‘আর সালাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,إِذَا نُودِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ‘জুম‘আর দিন সালাতের জন্য আযান দেওয়া হলে আল্লাহর যিকরের দিকে দ্রুত ধাবিত হও।’(সূরা জুম‘আ: ৬২/৯)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ পরিস্কার করে বলেননি জুম'আর দিন কোন ওয়াক্তের আযানের কথা বলা হয়েছে। হাদীস বাদ দিলে এ আয়াতের অর্থ নির্ধারণে সমস্যা দেখা দিবে।
যেমন: (১) এ নির্দেশ জুম‘আর দিনের কোন সালাতের জন্য?(২) যদি সেটা পৃথক সালাত হয়, তবে তা কখন অনুষ্ঠিত হবে? হয়তোবা মুনকিরে হাদীস পন্ডিতরা বলবেন, এক্ষেত্রে হাদীসের প্রয়োজন নেই। কেননা وَذَرُوا الْبَيْعَ এবং وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللهِ আয়াতের এই দুই অংশ একথার প্রমাণ বহন করে যে, জুম‘আর সালাত যোহরের সময় অনুষ্ঠিত হবে। কেননা বেচা-কেনা এবং রিযিক অনুসন্ধান দুপুরের সময়েই হয়ে থাকে। অথচ এই ব্যাখ্যা কতই না দুর্বল।
কেননা দুপুরের খরতাপে মূলতঃ বিশ্রামের সময়। আর বেচা-কেনা ও রিযিক অনুসন্ধান মূলত সকালে ও সন্ধ্যায় হয়ে থাকে।
যেমন:-রাসূল(ﷺ) বলেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার উম্মতের জন্য ভোরের কর্মের মধ্যে বরকত দান করো। বর্ণনাকারী বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোথাও ক্ষুদ্র সেনাদল বা বৃহৎ সৈন্যবাহিনী পাঠাতেন তখন তাদেরকে দিনের প্রথমাংশে পাঠাতেন। রাবী ছাখার আল-গামেদী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি তার ব্যবসাদলকে দিনের শুরুতেই পাঠিয়ে দিতেন। ফলে তিনি ধনী হন এবং তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। (আবু দাঊদ হা/২৬০৬; মিশকাত হা/৩৯০৮; সহীহুল জামে‘ হা/১৩০০)।
অতএব যদি এক্ষেত্রে সুন্নাহ আমাদেরকে নির্দেশনা না দিত, তাহলে আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতাম। এ কারণেই রাসূল(ﷺ) বলেন বিদায় হজ্জে ঘোষণা করে গেছেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা মযবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’(মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮)।
আর একারণেই সাহাবায়ে কেরাম কোন মাসআলা সম্পর্কে রায় প্রদান করার পর রাসূলের কোন হাদীস অবগত হলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের রায় পরিত্যগ করতেন। [এ ব্যাপারে জানার জন্য আমাদের ডক্টরেট থিসিস-এর ‘মূলনীতি’ অধ্যায়ের ১মূলনীতি (১৩৩-১৫০ পৃ.) পাঠ করুন।]।
৪। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত।’(সূরা আল-মায়িদাহ: ৩)।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত মাছের বিধান কী হবে? কলিজার বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কী-না?রাসূল(ﷺ)-এর বাণীসূচক হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর মধ্যে সমস্ত প্রকারের মৃত মাছ ও মৃত টিড্ডি খাওয়া হালাল, আর রক্তের মধ্যে কলিজা বা লিভার ও প্লীহা খাওয়া হালাল।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর(রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূল(ﷺ)বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য দু’প্রকারের মৃতজীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হলো, মাছ ও টিড্ডি, এবং দু’প্রকারের রক্ত হলো, কলিজা ও প্লীহা।’(ইবনু মাজাহ, হা/৩৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭২৪; সহীহুল জামি, হা/২১০; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১১৮)।
এক্ষেত্রে কিন্তু কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করে না, এমনকি যারা নিজেকে আহলে কুরআন বলে দাবী করে তারাও না। তারাও নবী(ﷺ)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজা করে মৃত মাছ ও কলিজা ভক্ষণ করছে।
৫। আল্লাহ তাআলা বলেন, قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ ‘বলো, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব সাজসজ্জা এবং পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করেছে?’(আল-আ‘রাফ, ৭, ৩২)।
এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এটাই যে, আল্লাহ বান্দার জন্য সাজসজ্জা হালাল করেছেন, কোন কোন
সাজসজ্জা হালাল করেছেন সেটা বলেন নি। অথচ হাদীসে এসেছে যে, কিছু শোভা-সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার বস্তু আছে, যেটা হারাম।
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত যে, ‘একদা তিনি বের হলেন, তাঁর এক হাতে রেশম আর অন্য হাতে স্বর্ণ ছিল। তিনি বললেন, এ দুটি জিনিস আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫০; আবূ দাঊদ, হা/৪০৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/৩৫৯৫)
এই হাদীসটি ইমাম হাকেম বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটি সহীহ বলেছেন। এই বিষয়ে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।
৬। সাহাবায়ে কেরাম ভাষাবিদ ও অলংকার শাস্ত্রে পন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন আয়াতের অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে রাসূল(ﷺ)-এর শরণাপন্ন হতেন। যেমন হজ্জ ফরযের আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে।’(আলে-ইমরান:, ৩/৯৭)।
উক্ত আয়াতে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের হজ্জ সম্পাদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কিভাবে হজ্জ করতে হয় কুরআনে কোথাও পরিপূর্ণ ভাবে বলা হয়নি।তাই তো উক্ত আয়াত নাযিল হলে সাহাবী আক্বরা বিন হাবেস(রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি এ বছরের জন্য, না প্রতি বছরের জন্য? জবাবে রাসূল(ﷺ) বললেন, একজন মুমিনের জীবনে মাত্র একবার ফরয।’ (আবু দাঊদ হা/১৭২১; আহমাদ হা/২৩০৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে-ইমরান: ৯৭ আয়াত)।
হজ্জের একটি ফরজ হচ্ছে ৯ই জিলহজ্জ আরাফায় অবস্থান করা। অথচ কুরআনের কোথাও একথা আসেনি কিন্তু রাসূল(ﷺ) এর হাদীসে এসেছে। আবদুর রহমান ইবনু ইয়া‘মুর আদ্ দায়লী(রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ- তিনি বলেন,
আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি আরাফাই হচ্ছে হজ্জ। যে ব্যক্তি ‘আরাফায় মুযদালিফার রাতে(৯ যিলহজ্জ শেষ রাতে) ভোর হবার আগে আরাফাতে পৌঁছতে পেরেছে সে হজ্জ পেয়ে গেছে। মিনায় অবস্থানের সময় হলো তিনদিন। যে দুই দিনে তাড়াতাড়ি মিনা হতে ফিরে আসলো তার গুনাহ হলো না।
আর যে (তিনদিন পূর্ণ করে) দেরী করবে তারও গুনাহ হলো না। (আবু দাঊদ ১৯৪৭, নাসায়ী ৩০৪৪, ৩০১৬, তিরমিযী ৮৮৯, ইবনু মাজাহ ৩০১৫, আহমাদ ১৮৭৭৪, দারিমী ১৯২৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৪৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৮৯২ মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২৭১৪)।
এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমরা আমার নিকট হতে হজ্জের হুকুম-আহকাম শিখে নাও। কারণ এ হজ্জের পর আর আমি হজ্জ করতে পারব কিনা তা জানি না। (সহীহ মুসলিম ১২৯৭, আবূ দাঊদ ১৯৭০, আহমাদ ১৪৪১৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৯৫৫২, মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং ২৬১৮)
সংকলিত - আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি