হাদীস কাকে বলে? - হাদীস (حَدِيْث) এর শাব্দিক অর্থ: নতুন,প্রাচীন ও পুরাতন এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যে সব কথা, কাজ ও বস্ত্ত পূর্বে ছিল না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তাই হাদীস। এর আরেক অর্থ হলো: কথা,বাণী,সংবাদ, বিষয়, অভিনব ব্যাপার ইত্যাদি।ফক্বীহগণের পরিভাষায় নবী কারীম (ﷺ) আল্লাহর রাসূল হিসেবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা হয়।
সাহাবায়ে কিরামের কথা, কাজ ও সমর্থনকেও হাদীস বলা হয়, ইমাম নববী এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন; যাতে কোন সাহাবীর কথা, কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয়-তা পর পর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হোক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনাকারীর অনুপস্থিতি ঘটুক তা ‘মওকুফ হাদীস’। অবশ্য পরে উসুলে হাদীসে তাঁদের কথা, কাজ ও সমর্থনের নাম দেয়া হয়েছে ‘আসার’ এবং হাদীসে মওকুফ।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত বিদ্যমান তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়। যেমন:
আমরা পরম্পরা রক্ষা করে সনদের সাথে সম্পৃক্ত তিনটি শর্ত প্রথম বর্ণনা করব, অতঃপর শায ও মু‘আল্ না হওয়া দু’টি শর্ত স্ব-স্ব স্থানে বর্ণনা করব।(ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬)
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাসান হাদীসের মধ্যেও উপর্যুক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ্ হাসানের সবচেয়ে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন।
তিনি বলেন: আদিল ও পরিপূর্ণ দ্বাবত সম্পন্ন রাবির মুত্তাসিল সনদে বর্ণিত, ইল্লত ও শায থেকে মুক্ত খবরে ওয়াহেদকে সহি লি-যাতিহি বলা হয়। অতঃপর তিনি বলেন: যদি দ্বাবত দুর্বল হয়, তাহলে হাসান লি-যাতিহি”(আন-নুযহাহ: ৯১) এ সংজ্ঞা মতে হাসান হাদীসে সহীহ হাদিসের শর্তগুলো থাকা জরুরি, তবে পঞ্চম শর্ত ব্যতিক্রম,
যথা:
৫. সহীহ হাদিস অপেক্ষা হাসান হাদিসের রাবির দ্বাবত দুর্বল হওয়া। পঞ্চম শর্তের ভিত্তিতে সহি ও হাসান একটি অপরটি থেকে পৃথক হয়, অন্যথায় হাসানের রাবিগণ তাকওয়া, ইবাদত ও অন্যান্য দীনি বিষয়ে সহি হাদিসের রাবি থেকে উঁচুমানের হতে পারে। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ৪৫-৬১; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৩২-৪৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৭৬-১১০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৫৩-১৭৮; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৪৫-৫০)
যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলোর কোনো একটি শর্ত অবিদ্যমান দেখা যায়, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়।
অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোনো একজন রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে সরাসরি ও স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ অথবা ‘ইল্লাত’ বিদ্যমান থাকা... ইত্যাদি যে কোনো একটি বিষয় কোনো হাদীসে মধ্যে থাকলে হাদীসটি যয়ীফ বলে গণ্য। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ৬২; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৪৯; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/১১১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৭৯; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহ, পৃ. ৬২-৬৩)
যয়ীফ’’ বা দুর্বল হাদীসের দুর্বলতার তিনটি পর্যায় রয়েছে:
(১) কিছুটা দুর্বল: বর্ণনাকারী ভুল বলেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়, কারণ তিনি যতগুলো হাদীস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। তবে তিনি ইচ্ছা করে ভুল বলতেন না বলেই প্রমাণিত। এরূপ ‘‘যয়ীফ’’ হাদীস যদি অন্য এক বা একাধিক এ পর্যায়ের ‘‘কিছুটা’’ যয়ীফ সূত্রে বর্ণিত হয় তাহলে তা ‘‘হাসান’’ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলে গণ্য হয়।
(২) অত্যন্ত দুর্বল (যায়ীফ জিদ্দান, ওয়াহী): এরূপ হাদীসের বর্ণনাকারীর সকল হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষা করে যদি প্রমাণিত হয় যে, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ বা প্রায় সকল হাদীসই অগণিত ভুলে ভরা, যে ধরনের ভুল সাধারণত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয় তার চেয়েও মারাত্মক ভুল, তবে তার বর্ণিত হাদীস ‘‘পরিত্যক্ত’’, একেবারে অগ্রহণযোগ্য বা অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করা হবে। এরূপ দুর্বল হাদীস অনুরূপ অন্য দুর্বল সুত্রে বর্ণিত হলেও তা গ্রহণযোগ্য হয় না।
(৩) মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস: যদি প্রমাণিত হয় যে এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র(সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কমবেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘‘মাওযূ’’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। বানোয়াট হাদীস জঘন্যতম দুর্বল হাদীস।(বিস্তারিত দেখুন: হাকিম নাইসাপূরী (৪০৫হি), মা’রিফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ: ১৪-১৭, ৩৬-৪০, ৫২-৬২, ১১২-১৫১, আল-ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৭-৫১, ১৩৮-১৭৮, আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈদাহ, পৃ: ২৩-৬৩, ১৩৩-১৫৭, ৪২০-৪২১, ড. মাহমূদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ: ৩৩-১২৫, ১৪৪-১৫৫)
জেনে রাখা ভাল জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে যঈফ বা দুর্বল হাদিস কখনোই আমালযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং যঈফ বা দুর্বল প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরও তার উপর আমল করা নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। এ মতের পক্ষে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইবনুল ‘আরাবী, ইবনু হাযম, ইবনু তায়মিয়াহ প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিছগণ সকল ক্ষেত্রে যঈফ হাদিস বর্জনযোগ্য বলেছেন।(দ্রঃ জামালুদ্দীন ক্বাসেমী, ক্বাওয়াইদুত তাহদীছ; আশরাফ বিন সাঈদ, হুকমুল ‘আমাল বিল হাদীসিয যঈফ)
ইসলামী শরী‘আতের প্রধান দু’টি উৎস হলো; পবিত্র কুরআন এবং রাসূল ﷺ এর সহীহ হাদীস, যা মুসলিম মিল্লাতের মূল সম্পদ। প্রত্যেক মুসলিমের জানা আবশ্যক যে, কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীস দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার ওহী। উভয়ের উপর সমানভাবে ঈমান আনয়ন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। কুরআনকে বলা হয় অহিয়ে মাতলূ, যা পাঠ করা হয়। আর হাদীসকে বলা হয় অহিয়ে গায়রে মাতলূ। দু’টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া বিধান। (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)।
তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম হাদীসকে আল্লাহ প্রেরিত ‘ওহী’ হিসাবেই বিশ্বাস করতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৭৩১০; মিশকাত, হা/১৭৫৩).
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কুরআনের মত হাদীসও অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, হাদীছকে কুরআনের মত তেলাওয়াত করা হয় না’(মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৩)
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন,হাদীস বা সুন্নাহ হ’ল ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস। এর অর্থ তা ক্রমিক গণনায় দ্বিতীয়; তারতীব বা ধারাবাহিকতায় নয়। কেননা হাদীস যদি সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয় তবে তা কুরআনেরই সমমর্যাদাসম্পন্ন।(উসাইমীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড:৮ পৃষ্ঠা:৩৯২)
হাদীসের প্রতি আমল না করে কেউ মুমিন হতে পারে না। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমকে হাদীস ও তার সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া অপরিহার্য। (সূরা আলে-ইমরান,৩/ ৩১; সূরা আন-নিসা, ৪/৬৫, ৮০; সূরা আল-হাশর,৫৯/৭)।
কারণ, কুরআনুল কারীমের পর হাদীস শরীআতের দ্বিতীয় উৎস। হাদীসের উপর আমল ব্যতীত শরী‘আতের কোন একটি বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করা সম্ভব নয়। কুরআন মান্যকারীদের উপর হাদীস মানা অপরিহার্য। হাদীসের সত্যতা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেউ মুসলিম থাকতে পারে না। কেননা পবিত্র কুরআনের মধ্যেই হাদীসের প্রামাণিকতা বিদ্যমান। (সূরা আত-তাওবাহ: ২৯; সূরা আন-নিসা: ৬৫, ১১৫; সূরা আল-হাশর: ৭; সূরা আন-নাজম: ৩-৪; সূরা আলে-ইমরান: ৩১)।
হাদীসের প্রামাণিকতায় এ রকম আরো সহস্র আয়াত বিদ্যমান। সুতরাং সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হাদীস পবিত্র কুরআনের মতই ইসলামী শরী‘আতের অকাট্য দলীল হিসাবে সমান মর্যাদা ও গুরুত্বের অধিকারী। ইসলামী শরী‘আতকে সংরক্ষণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনকে যেমন শব্দগতভাবে সংরক্ষণ করেছেন, তেমনি কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীসকে অর্থগতভাবে সংরক্ষণ করেছেন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
সাহাবায়ে কিরামের কথা, কাজ ও সমর্থনকেও হাদীস বলা হয়, ইমাম নববী এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন; যাতে কোন সাহাবীর কথা, কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয়-তা পর পর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হোক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনাকারীর অনুপস্থিতি ঘটুক তা ‘মওকুফ হাদীস’। অবশ্য পরে উসুলে হাদীসে তাঁদের কথা, কাজ ও সমর্থনের নাম দেয়া হয়েছে ‘আসার’ এবং হাদীসে মওকুফ।
হাদীস কত প্রকার ও কি কি?
মুহাদ্দিসগণ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কিত বর্ণনা ও তার গুণাবলী সম্পর্কিত বিবরণকেও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ হিসেবে হাদীসকে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। অর্থাৎ মূল বক্তব্য হিসাবে হাদীস তিন প্রকার। যেমন: -- কাওলী হাদীস: রাসূল (ﷺ) এর পবিত্র মুখের বানীই কাওলী হাদীস।
- ফিলী হাদীস: যে কাজ রাসূল (ﷺ) স্বয়ং করেছেন এবং সাহাবীগণ তা বর্ণনা করেছেন তাই ফিলী হাদীস।
- তাকরীরী হাদীস: সাহাবীদের যে সব কথাও কাজের প্রতি রাসূল (ﷺ) সমর্থন প্রদান করেছেন তাহাই তাকরীরী হাদীস।
- খবরে মুতাওয়াতির: যে হাদীস এত অধিক সংখ্যক রাবী বর্ণনা করেছেন যাদের মিথ্যার উপর একমত হওয়া অসম্ভব।
- খবরে মাশহুর: প্রত্যেক যুগে অন্তত তিনজন রাবী রেওয়ায়েত করেছেন, তাকে খবরে মাশহুর বলে। একে মুস্তাফিজ ও বলে।
- খবরে ওয়াহেদ বা খবরে আহাদ: হাদীস গরীব আজিজ এবং খবরে মাশহুর এ তিন প্রকারের হাদীসকে একত্রে খবরে আহাদ বলে। প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবে খবরে ওয়াহিদ বলে।
- মারফু হাদীস: যে হাদীসের সনদ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মারফু হাদীস বলে।
- মাওকুফ হাদীস: যে হাদীসের সনদ সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাওকুফ হাদীস বলে।
- মাকতু হাদীস: যে হাদীসের সনদ তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাকতু হাদীস বলে।
- মুত্তাসিল হাদীস: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা সর্বস্তরে ঠিক রয়েছে কোথাও কোন রাবী বাদ পড়ে না; তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।
- মুনকাতে হাদীস: যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে; তাকে মুনকাতে হাদীস বলে।
- মুরসাল হাদীস: যে হাদীসে রাবীর নাম বাদ পড়া শেষের দিকে অর্থাৎ সাহাবীর নামই বাদ পড়েছে তাকে মুরসাল হাদীস বলে।
- মুয়াল্লাক হাদীস: যে হাদীসের সনদের প্রথম দিকে রাবীর নাম বাদ পড়েছে অর্থাৎ সাহাবীর পর তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুয়াল্লাক হাদীস বলে।
- মুদাল হাদীস: যে হাদীসে দুই বা ততোধীক রাবী ক্রমান্বয়ে সনদ থেকে বিলুপ্ত হয় তাকে মুদাল হাদীস বলে।
- সহীহ হাদীস: যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের বর্ণনার ধারাবাহিকতা রয়েছে, সনদের প্রতিটি স্তরে বর্ণনাকারীর নাম, বর্ণানাকারীর বিশ্বস্ততা, আস্থাভাজন, স্বরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর, কোনস্তরে তাদের সংখ্যা একজন হয়নি তাকে সহীহ হাদীস বলে।
- হাসান হাদীস: সহীহ সবগুণই রয়েছে, তবে তাদের স্বরণ শক্তির যদি কিছুটা দুর্বলতা প্রমাণিত হয়; তাকে হাসান হাদীস বলে।
- যায়ীফ হাদীস: হাসান, সহীহ হাদীসের গুণসমূহ যে হাদীসে পাওয়া না যায় তাকে যায়ীফ হাদীস বলে।
- এছাড়াও আরো এক প্রকার হাদীস হলো হাদীসে কুদসী: "যে হাদীসের মূল বক্তব্য আল্লাহ সরাসরি রাসূল (ﷺ)-কে ইলহাম বা স্বপ্ন যোগে জানিয়ে দিয়েছেন, রাসূল (ﷺ) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন তাকে হাদীসে কুদসী বলে।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত বিদ্যমান তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়। যেমন:
- সনদ মুত্তাসিল হওয়া।
- শায না হওয়া।
- মু‘আল না হওয়া।
- রাবির আদিল হওয়া।
- রাবির দ্বাবিত হওয়া।
আমরা পরম্পরা রক্ষা করে সনদের সাথে সম্পৃক্ত তিনটি শর্ত প্রথম বর্ণনা করব, অতঃপর শায ও মু‘আল্ না হওয়া দু’টি শর্ত স্ব-স্ব স্থানে বর্ণনা করব।(ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬)
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাসান হাদীসের মধ্যেও উপর্যুক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ্ হাসানের সবচেয়ে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন।
তিনি বলেন: আদিল ও পরিপূর্ণ দ্বাবত সম্পন্ন রাবির মুত্তাসিল সনদে বর্ণিত, ইল্লত ও শায থেকে মুক্ত খবরে ওয়াহেদকে সহি লি-যাতিহি বলা হয়। অতঃপর তিনি বলেন: যদি দ্বাবত দুর্বল হয়, তাহলে হাসান লি-যাতিহি”(আন-নুযহাহ: ৯১) এ সংজ্ঞা মতে হাসান হাদীসে সহীহ হাদিসের শর্তগুলো থাকা জরুরি, তবে পঞ্চম শর্ত ব্যতিক্রম,
যথা:
১. সনদ মুত্তাসিল হওয়া।
২. শায না হওয়া।
৩. দোষণীয় ইল্লত থেকে মুক্ত হওয়া।
৪. রাবিদের আদিল হওয়া।
৫. সহীহ হাদিস অপেক্ষা হাসান হাদিসের রাবির দ্বাবত দুর্বল হওয়া। পঞ্চম শর্তের ভিত্তিতে সহি ও হাসান একটি অপরটি থেকে পৃথক হয়, অন্যথায় হাসানের রাবিগণ তাকওয়া, ইবাদত ও অন্যান্য দীনি বিষয়ে সহি হাদিসের রাবি থেকে উঁচুমানের হতে পারে। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ৪৫-৬১; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৩২-৪৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৭৬-১১০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৫৩-১৭৮; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৪৫-৫০)
যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলোর কোনো একটি শর্ত অবিদ্যমান দেখা যায়, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়।
অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোনো একজন রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে সরাসরি ও স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ অথবা ‘ইল্লাত’ বিদ্যমান থাকা... ইত্যাদি যে কোনো একটি বিষয় কোনো হাদীসে মধ্যে থাকলে হাদীসটি যয়ীফ বলে গণ্য। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ৬২; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৪৯; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/১১১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৭৯; মাহমূদ তাহ্হান, তাইসীরু মুসতালাহ, পৃ. ৬২-৬৩)
যয়ীফ’’ বা দুর্বল হাদীসের দুর্বলতার তিনটি পর্যায় রয়েছে:
(১) কিছুটা দুর্বল: বর্ণনাকারী ভুল বলেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়, কারণ তিনি যতগুলো হাদীস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। তবে তিনি ইচ্ছা করে ভুল বলতেন না বলেই প্রমাণিত। এরূপ ‘‘যয়ীফ’’ হাদীস যদি অন্য এক বা একাধিক এ পর্যায়ের ‘‘কিছুটা’’ যয়ীফ সূত্রে বর্ণিত হয় তাহলে তা ‘‘হাসান’’ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলে গণ্য হয়।
(২) অত্যন্ত দুর্বল (যায়ীফ জিদ্দান, ওয়াহী): এরূপ হাদীসের বর্ণনাকারীর সকল হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষা করে যদি প্রমাণিত হয় যে, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ বা প্রায় সকল হাদীসই অগণিত ভুলে ভরা, যে ধরনের ভুল সাধারণত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয় তার চেয়েও মারাত্মক ভুল, তবে তার বর্ণিত হাদীস ‘‘পরিত্যক্ত’’, একেবারে অগ্রহণযোগ্য বা অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করা হবে। এরূপ দুর্বল হাদীস অনুরূপ অন্য দুর্বল সুত্রে বর্ণিত হলেও তা গ্রহণযোগ্য হয় না।
(৩) মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস: যদি প্রমাণিত হয় যে এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র(সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কমবেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘‘মাওযূ’’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। বানোয়াট হাদীস জঘন্যতম দুর্বল হাদীস।(বিস্তারিত দেখুন: হাকিম নাইসাপূরী (৪০৫হি), মা’রিফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ: ১৪-১৭, ৩৬-৪০, ৫২-৬২, ১১২-১৫১, আল-ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ: ৭-৫১, ১৩৮-১৭৮, আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈদাহ, পৃ: ২৩-৬৩, ১৩৩-১৫৭, ৪২০-৪২১, ড. মাহমূদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ: ৩৩-১২৫, ১৪৪-১৫৫)
জেনে রাখা ভাল জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে যঈফ বা দুর্বল হাদিস কখনোই আমালযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং যঈফ বা দুর্বল প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরও তার উপর আমল করা নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। এ মতের পক্ষে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইবনুল ‘আরাবী, ইবনু হাযম, ইবনু তায়মিয়াহ প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিছগণ সকল ক্ষেত্রে যঈফ হাদিস বর্জনযোগ্য বলেছেন।(দ্রঃ জামালুদ্দীন ক্বাসেমী, ক্বাওয়াইদুত তাহদীছ; আশরাফ বিন সাঈদ, হুকমুল ‘আমাল বিল হাদীসিয যঈফ)
হাদীস কি শরীয়তের উৎস?
মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, রাসূল (ﷺ)-এর কথা, কর্ম ও সম্মতি হ’ল ইসলামী শরী‘আতের সকল হুকুম-আহকামের অন্যতম উৎস। বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদীছকে ইসলামী শরী‘আতের মৌলিক উৎস হিসাবে অনুসরণ করা একজন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য।ইসলামী শরী‘আতের প্রধান দু’টি উৎস হলো; পবিত্র কুরআন এবং রাসূল ﷺ এর সহীহ হাদীস, যা মুসলিম মিল্লাতের মূল সম্পদ। প্রত্যেক মুসলিমের জানা আবশ্যক যে, কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীস দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার ওহী। উভয়ের উপর সমানভাবে ঈমান আনয়ন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। কুরআনকে বলা হয় অহিয়ে মাতলূ, যা পাঠ করা হয়। আর হাদীসকে বলা হয় অহিয়ে গায়রে মাতলূ। দু’টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া বিধান। (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)।
তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম হাদীসকে আল্লাহ প্রেরিত ‘ওহী’ হিসাবেই বিশ্বাস করতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৭৩১০; মিশকাত, হা/১৭৫৩).
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কুরআনের মত হাদীসও অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে, হাদীছকে কুরআনের মত তেলাওয়াত করা হয় না’(মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ১৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬৩)
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন,হাদীস বা সুন্নাহ হ’ল ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস। এর অর্থ তা ক্রমিক গণনায় দ্বিতীয়; তারতীব বা ধারাবাহিকতায় নয়। কেননা হাদীস যদি সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয় তবে তা কুরআনেরই সমমর্যাদাসম্পন্ন।(উসাইমীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড:৮ পৃষ্ঠা:৩৯২)
হাদীসের প্রতি আমল না করে কেউ মুমিন হতে পারে না। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমকে হাদীস ও তার সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়া অপরিহার্য। (সূরা আলে-ইমরান,৩/ ৩১; সূরা আন-নিসা, ৪/৬৫, ৮০; সূরা আল-হাশর,৫৯/৭)।
কারণ, কুরআনুল কারীমের পর হাদীস শরীআতের দ্বিতীয় উৎস। হাদীসের উপর আমল ব্যতীত শরী‘আতের কোন একটি বিধান পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করা সম্ভব নয়। কুরআন মান্যকারীদের উপর হাদীস মানা অপরিহার্য। হাদীসের সত্যতা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেউ মুসলিম থাকতে পারে না। কেননা পবিত্র কুরআনের মধ্যেই হাদীসের প্রামাণিকতা বিদ্যমান। (সূরা আত-তাওবাহ: ২৯; সূরা আন-নিসা: ৬৫, ১১৫; সূরা আল-হাশর: ৭; সূরা আন-নাজম: ৩-৪; সূরা আলে-ইমরান: ৩১)।
হাদীসের প্রামাণিকতায় এ রকম আরো সহস্র আয়াত বিদ্যমান। সুতরাং সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হাদীস পবিত্র কুরআনের মতই ইসলামী শরী‘আতের অকাট্য দলীল হিসাবে সমান মর্যাদা ও গুরুত্বের অধিকারী। ইসলামী শরী‘আতকে সংরক্ষণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনকে যেমন শব্দগতভাবে সংরক্ষণ করেছেন, তেমনি কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীসকে অর্থগতভাবে সংরক্ষণ করেছেন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
উপস্থাপনায় - জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Attachments
Last edited by a moderator: