যারা মনে করে কুরআন মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর নিজের রচনা। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ নয়।তাদের এ অভিযোগ ও সন্দেহ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এর কারণগুলো নিম্নরূপ।
(ক) কুরআন যদি মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর নিজের পক্ষ থেকে লিখিত হতো, তবে তা আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার কোন যুক্তি নেই। বরং তিনি তা নিজের বলে দাবী করতে পারতেন। তৎকালীন আরবের সমস্ত পণ্ডিত ও ভাষাবিদগণ কুরআনের অনুরূপ অথবা একটি সূরা অথবা একটি আয়াত আনয়ন করতে অক্ষম ও অপারগ হয়ে পড়ে। তখন তিনি কেন এ কুরআন তার নিজের রচনা নয় বলে উল্লেখ করবেন।
(খ) নবী করীম(ﷺ) একবার অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাখতূম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কুরাইশ নেতাদের দাওয়াত দানে মনোনিবেশ করেন। মহান আল্লাহ তাঁর এ কাজটি পছন্দ করেননি। মহান আল্লাহ তাঁর সমালোচনা করে বলেন, ‘ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল, কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এসেছিল। আপনি কী জানেন সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করে না, আপনি তার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে আপনার কোন দায়িত্ব নেই, পক্ষান্তরে যে আপনার নিকট ছুটে আসল, আর সে সশংকচিত্ত (ভীত অবস্থায়) আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন! কখনও নয়, এটা তো উপদেশবাণী।’(সূরা আবাসা: ১-১১)।
(গ) মুহাম্মাদ(ﷺ) বদর যুদ্ধের বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে তাদের মুক্ত করে দেন। মহান আল্লাহর নিকট এ কাজটি অপছন্দ ছিল। ফলে তিনি এ কাজের সমালোচনা করেন এবং তাঁকে সতর্ক করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোন নবীর পক্ষে ততক্ষণ পর্যন্ত বন্দী লোক রাখা শোভা পায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠ (দেশ) হতে শত্রু বাহিনী নির্মূল না হয়, তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছ, আর আল্লাহ চান পরকালের কল্যাণ, আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর লিপি পূর্বে লিখিত না হলে তোমরা যা কিছু গ্রহণ করেছ তজ্জন্যে তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হত।’(সূরা আনফাল: ৬৭-৬৮)।
(ঘ) মুনাফিক্বরা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা(রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর প্রতি অপবাদ আরোপ করে। এতে তাঁর মান-মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়। নবী করীম(ﷺ) দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় একমাস অতিক্রান্ত হয়। পরিশেষে মহান আল্লাহ আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর পবিত্রতায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন। (সূরা আন-নূর: ১১)।
কুরআন যদি মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর রচনা হতো তবে এ ষড়যন্ত্রকারীদের অপবাদ নস্যাতের উদ্দেশ্যে কুরআন রচনায় কে তাঁকে বাধা প্রদান করেছিল!
(ঙ) তাবূক যুদ্ধের সময় নবী করীম(ﷺ)-এর নিকট কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন ওযর পেশ করে যুদ্ধে গমন থেকে বিরত থাকার অনুমতি প্রার্থনা করে। নবী করীম(ﷺ) তাদের অনুমতি প্রদান করেন। এদের মধ্যে কয়েকজন মুনাফিক্ব ছিল। তাঁর এ ভুল মতামতের কারণে মহান আল্লাহ তাঁকে সাবধান করে কুরআনের আয়াত অবতরণ করে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করলেন, (কিন্তু) আপনি তাদেরকে (এত শীঘ্র) কেন অনুমতি দিয়েছিলেন (যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকার) যে পর্যন্ত না সত্যবাদী লোকেরা আপনার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তো এবং আপনি মিথ্যাবাদীদেরকে জেনে নিতেন।’(সূরা আত-তওবাহ: ৪৩)।
কুরআন যদি তাঁর স্বরচিত হত তবে নিজের ভুল সিন্ধান্ত অবগত হওয়ার পরও তিনি খোলাখুলিভাবে নিজের এমন কঠোর সমালোচনা করতেন না।
পক্ষান্তরে হাদীসের প্রামাণিকতায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’(সূরা আন-নাজম: ৩-৪)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআনের মত সুন্নাতও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। (তাফসীরে কুরতুবী, ৭ম খ-, পৃ. ২৬৫৫)
সাইয়িদ রশীদ রেযা(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীসে বর্ণিত বিধানগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। অহী শুধু কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।’(তাফসীরুল মানার, ৮ম খ-, পৃ. ৩০৮)
দলীল হল আনাস ইবনু মালিক(রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ওযু করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন।’
(আবু দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খ-, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খ-, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খ-, পৃ. ১৩০)।
উপরিউক্ত বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে হাদীসের মধ্যে, অথচ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, আমাকে আমার প্রতিপালক এমনই করতে বলেছেন।
তার মানে বুঝা যাচ্ছে হাদীসও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। তবে হ্যাঁ, কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন,
(ক). আল-কুরআন অহী মাতলু আর হাদীস অহীয়ে গায়রে মাতলু।
(খ). আল-কুরআন মু‘জিযাসমূহের মধ্যে একটি, কিন্তু হাদীস তা নয়।
(গ). আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত। পক্ষান্তরে হাদীসের অর্থ আল্লাহর কিন্তু শব্দ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর।
(ঘ). আল-কুরআন ইসলামী শরী‘আতের প্রথম উৎস, আর সহীহ হাদীস ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস।
(ঙ). আল-কুরআন সালাতের মধ্যে তেলাওয়াত করা হয়, কিন্তু হাদীসে সালাতে তেলাওয়াত করা হয় না।
(চ). আল-কুরআন তেলাওয়াত করলে প্রতিটি অক্ষরে দশ-দশ সওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু হাদীস পাঠে কোন নির্ধারিত সওয়াব পাওয়া যায় না।
(ছ). আল-কুরআন তেলাওয়াতের জন্য পবিত্রতা একটি প্রাথমিক শর্ত, কিন্তু হাদীস পাঠের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। (ক্বাওয়াঈদুত তাহদীছ, পৃ. ৬৪; উছূলুল হাদীস, পৃ. ২৯; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৬৮৮০৫, ৭২৭৯৮; আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২১৫-২১৭)
তৃতীয় সংশয়: এই নির্বোধেরা বলে থাকে যে, রাসূল(ﷺ)-এর আদেশ মানা যাবে না, কেননা এটি শিরক। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰہِ ‘হুকুম কেবল আল্লাহর কাছেই।’(সূরা আল-আন‘আম: ৫৭)। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মান্য করা যাবে না। (আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৪২)
তাদের সংশয় নিরসন: এ কথা ঠিক যে আদেশ কেবল আল্লাহ তা‘আলারই মানতে হবে। কিন্তু সেই আল্লাহ তা‘আলাই তো রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا ‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ!
তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।’(সূরা আন-নিসা: ৬৫)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তার শপথ করে বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মেনে না নেয়া পর্যন্ত কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। অতএব প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ মানাটাই হল আল্লাহর আদেশ মানা। (আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২২০)
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখন মুমিনদেরকে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ওরাই হল সফলকাম।’ (সূরা আন-নূর: ৫১)।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান মানা যাবে না।’রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই বিধানের গন্ডির বাইরে রাখা হয়েছে। বরং এটি রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর একারণেই আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’(সূরা নিসা: ৪/৮০)
সংকলিত - আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী
(ক) কুরআন যদি মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর নিজের পক্ষ থেকে লিখিত হতো, তবে তা আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার কোন যুক্তি নেই। বরং তিনি তা নিজের বলে দাবী করতে পারতেন। তৎকালীন আরবের সমস্ত পণ্ডিত ও ভাষাবিদগণ কুরআনের অনুরূপ অথবা একটি সূরা অথবা একটি আয়াত আনয়ন করতে অক্ষম ও অপারগ হয়ে পড়ে। তখন তিনি কেন এ কুরআন তার নিজের রচনা নয় বলে উল্লেখ করবেন।
(খ) নবী করীম(ﷺ) একবার অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাখতূম (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কুরাইশ নেতাদের দাওয়াত দানে মনোনিবেশ করেন। মহান আল্লাহ তাঁর এ কাজটি পছন্দ করেননি। মহান আল্লাহ তাঁর সমালোচনা করে বলেন, ‘ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল, কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এসেছিল। আপনি কী জানেন সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করে না, আপনি তার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে আপনার কোন দায়িত্ব নেই, পক্ষান্তরে যে আপনার নিকট ছুটে আসল, আর সে সশংকচিত্ত (ভীত অবস্থায়) আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন! কখনও নয়, এটা তো উপদেশবাণী।’(সূরা আবাসা: ১-১১)।
(গ) মুহাম্মাদ(ﷺ) বদর যুদ্ধের বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে তাদের মুক্ত করে দেন। মহান আল্লাহর নিকট এ কাজটি অপছন্দ ছিল। ফলে তিনি এ কাজের সমালোচনা করেন এবং তাঁকে সতর্ক করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোন নবীর পক্ষে ততক্ষণ পর্যন্ত বন্দী লোক রাখা শোভা পায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠ (দেশ) হতে শত্রু বাহিনী নির্মূল না হয়, তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছ, আর আল্লাহ চান পরকালের কল্যাণ, আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর লিপি পূর্বে লিখিত না হলে তোমরা যা কিছু গ্রহণ করেছ তজ্জন্যে তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হত।’(সূরা আনফাল: ৬৭-৬৮)।
(ঘ) মুনাফিক্বরা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা(রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর প্রতি অপবাদ আরোপ করে। এতে তাঁর মান-মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়। নবী করীম(ﷺ) দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় একমাস অতিক্রান্ত হয়। পরিশেষে মহান আল্লাহ আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর পবিত্রতায় কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন। (সূরা আন-নূর: ১১)।
কুরআন যদি মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর রচনা হতো তবে এ ষড়যন্ত্রকারীদের অপবাদ নস্যাতের উদ্দেশ্যে কুরআন রচনায় কে তাঁকে বাধা প্রদান করেছিল!
(ঙ) তাবূক যুদ্ধের সময় নবী করীম(ﷺ)-এর নিকট কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন ওযর পেশ করে যুদ্ধে গমন থেকে বিরত থাকার অনুমতি প্রার্থনা করে। নবী করীম(ﷺ) তাদের অনুমতি প্রদান করেন। এদের মধ্যে কয়েকজন মুনাফিক্ব ছিল। তাঁর এ ভুল মতামতের কারণে মহান আল্লাহ তাঁকে সাবধান করে কুরআনের আয়াত অবতরণ করে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করলেন, (কিন্তু) আপনি তাদেরকে (এত শীঘ্র) কেন অনুমতি দিয়েছিলেন (যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকার) যে পর্যন্ত না সত্যবাদী লোকেরা আপনার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়তো এবং আপনি মিথ্যাবাদীদেরকে জেনে নিতেন।’(সূরা আত-তওবাহ: ৪৩)।
কুরআন যদি তাঁর স্বরচিত হত তবে নিজের ভুল সিন্ধান্ত অবগত হওয়ার পরও তিনি খোলাখুলিভাবে নিজের এমন কঠোর সমালোচনা করতেন না।
পক্ষান্তরে হাদীসের প্রামাণিকতায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’(সূরা আন-নাজম: ৩-৪)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআনের মত সুন্নাতও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। (তাফসীরে কুরতুবী, ৭ম খ-, পৃ. ২৬৫৫)
সাইয়িদ রশীদ রেযা(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীসে বর্ণিত বিধানগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। অহী শুধু কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।’(তাফসীরুল মানার, ৮ম খ-, পৃ. ৩০৮)
দলীল হল আনাস ইবনু মালিক(রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ওযু করার সময় হাতে এক অঞ্জলি পানি নিতেন। অতঃপর ঐ পানি থুতনির নিচে প্রবেশ করাতেন এবং তার দ্বারা নিজের দাড়ি খিলাল করতেন এবং বলতেন, هَكَذَا أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّ وَجَلَّ ‘আমার মহান প্রতিপালক আমাকে এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন।’
(আবু দাঊদ, হা/১৪৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, ১ম খ-, পৃ. ৫৪; হাকিম, ১ম খ-, পৃ. ১৪৯; ইরওয়াউল গালীল, ১ম খ-, পৃ. ১৩০)।
উপরিউক্ত বর্ণনাটি বর্ণিত হয়েছে হাদীসের মধ্যে, অথচ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, আমাকে আমার প্রতিপালক এমনই করতে বলেছেন।
তার মানে বুঝা যাচ্ছে হাদীসও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী। তবে হ্যাঁ, কুরআন ও সহীহ হাদীসের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। যেমন,
(ক). আল-কুরআন অহী মাতলু আর হাদীস অহীয়ে গায়রে মাতলু।
(খ). আল-কুরআন মু‘জিযাসমূহের মধ্যে একটি, কিন্তু হাদীস তা নয়।
(গ). আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত। পক্ষান্তরে হাদীসের অর্থ আল্লাহর কিন্তু শব্দ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর।
(ঘ). আল-কুরআন ইসলামী শরী‘আতের প্রথম উৎস, আর সহীহ হাদীস ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস।
(ঙ). আল-কুরআন সালাতের মধ্যে তেলাওয়াত করা হয়, কিন্তু হাদীসে সালাতে তেলাওয়াত করা হয় না।
(চ). আল-কুরআন তেলাওয়াত করলে প্রতিটি অক্ষরে দশ-দশ সওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু হাদীস পাঠে কোন নির্ধারিত সওয়াব পাওয়া যায় না।
(ছ). আল-কুরআন তেলাওয়াতের জন্য পবিত্রতা একটি প্রাথমিক শর্ত, কিন্তু হাদীস পাঠের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। (ক্বাওয়াঈদুত তাহদীছ, পৃ. ৬৪; উছূলুল হাদীস, পৃ. ২৯; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৬৮৮০৫, ৭২৭৯৮; আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২১৫-২১৭)
তৃতীয় সংশয়: এই নির্বোধেরা বলে থাকে যে, রাসূল(ﷺ)-এর আদেশ মানা যাবে না, কেননা এটি শিরক। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنِ الۡحُکۡمُ اِلَّا لِلّٰہِ ‘হুকুম কেবল আল্লাহর কাছেই।’(সূরা আল-আন‘আম: ৫৭)। তাই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ মান্য করা যাবে না। (আল-মুবাহাছাহ, পৃ. ৪২)
তাদের সংশয় নিরসন: এ কথা ঠিক যে আদেশ কেবল আল্লাহ তা‘আলারই মানতে হবে। কিন্তু সেই আল্লাহ তা‘আলাই তো রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মানার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, فَلَا وَ رَبِّکَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ حَتّٰی یُحَکِّمُوۡکَ فِیۡمَا شَجَرَ بَیۡنَہُمۡ ثُمَّ لَا یَجِدُوۡا فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَرَجًا مِّمَّا قَضَیۡتَ وَ یُسَلِّمُوۡا تَسۡلِیۡمًا ‘কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ!
তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের অন্তরে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।’(সূরা আন-নিসা: ৬৫)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তার শপথ করে বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ মেনে না নেয়া পর্যন্ত কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। অতএব প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ মানাটাই হল আল্লাহর আদেশ মানা। (আল-কুরআনিয়্যীন, ১ম খ-, পৃ. ২২০)
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখন মুমিনদেরকে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ওরাই হল সফলকাম।’ (সূরা আন-নূর: ৫১)।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান মানা যাবে না।’রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এই বিধানের গন্ডির বাইরে রাখা হয়েছে। বরং এটি রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর একারণেই আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’(সূরা নিসা: ৪/৮০)
সংকলিত - আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী