আহলে কুরআন বা হাদীস অস্বীকারকারীদের কিছু বিভ্রান্তিমূলক সংশয় ও তার নিরসন।
এখন যদি কোন হাদীস অস্বীকারকারী ব্যক্তি বলে যে, কুরআনের উপরে আমল করার অর্থই হলো আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের শামিল। তবে তার জবাবে বলা হবে যে, মুমিনদের উপর অনুগ্রহের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ তোমাদের নিকট কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) সহ এসেছেন।
এখন যদি কোন হাদীস অস্বীকারকারী ব্যক্তি বলে যে, কুরআনের উপরে আমল করার অর্থই হলো আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের শামিল। তবে তার জবাবে বলা হবে যে, মুমিনদের উপর অনুগ্রহের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ তোমাদের নিকট কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) সহ এসেছেন।
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ ‘
বিশ্বাসীদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন ও তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত(কুরআন ও সুন্নাহ) শিক্ষা দেন।’(সূরা আলে- ইমরান: ৩/১৬৪)।
এখানে كتاب-এর উপরে حكمة-এর عطف দ্বারা عطف بيان বুঝানো হয়নি। কেননা অলংকার শাস্ত্রবিদগণ জানেন যে, এটি عطف بيان-এর স্থানই নয়। কারণ এখানে আল্লাহর ইহসান ও তাঁর রাসূলের বিভিন্ন গুণাবলী বর্ণনা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যদি কিতাব ও হিকমত দ্বারা একই বস্ত্ত বুঝানো হয়, তাহলে রাসূলের গুণাবলীর মধ্যে একটির অভাব পরিলক্ষিত হবে।
আর যদি হিকমত দ্বারা আল্লাহর কিতাব ছাড়া অন্য কিছু বুঝানো হয়। তাহলে রাসূলের গুণাবলীর মধ্যে একটির অভাব পরিলক্ষিত হবে। আর যদি হিকমত দ্বারা আল্লাহর কিতাব ছাড়া অন্য কিছু বুঝানো হয়, তবে রাসূল (ﷺ)-এর কথা ও কর্ম ব্যতীত অন্য কি বস্ত্ত হতে পারে? অন্যত্র বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ‘
হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের।’(সূরা আন-নিসা: ৪/৫৯)।
অত্র আয়াতে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের জন্য পৃথক পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু أُولِي الْأَمْرِ-এর জন্য পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। বরং তাকে রাসূলের উপরে عطف করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ রহস্য নিহিত রয়েছে। এখানে একটি أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করে রাসূল ও উলিল আমরকে তার উপরে عطف করা যেত।
অথবা প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক তিনটি أَطِيعُوا ব্যবহার করা যেত। তা না করে আল্লাহ ও রাসূলের জন্য পৃথক দু’টি أَطِيعُوا বলার উদ্দেশ্য হলো দু’টি আইন সমষ্টির দিকে ইঙ্গিত করা। যার একটি আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে ‘কিতাবুল্লাহ’ এবং অপরটি রাসূলের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ‘সুন্নাতে রাসূলিল্লাহ’।
আর যেহেতু উলুল আমরের জন্য পৃথক কোন আইন সমষ্টি নেই, বরং তারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যশীল, সেহেতু তাদের জন্য পৃথকভাবে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য দলীল মাত্র দু’টি: কুরআন ও সুন্নাহ।
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ‘
অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়সালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়সালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে।’(সূরা আন-নিসা ৪/৬৫)।
এ আয়াতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, রাসূলের নির্দেশাবলীর উপর আমল করা ঠিক অনুরূপ অপরিহার্য, যেরূপ কুরআনের উপর আমল করা অপরিহার্য। পার্থক্য কেবল এতটুকু যে, কুরআন অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। এদিক থেকে কুরআন চূড়ান্ত দলীল হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু হাদীসের মর্যাদা অনুরূপ নয়।
কারণ অনেক কম সংখ্যক হাদীস এমন আছে যা মুতাওয়াতির বলে পরিগণিত। এ পার্থক্য কেবল সবল ও দুর্বল বর্ণনার প্রেক্ষিতে পরিদৃষ্ট হয়। অন্যথায় কোন হাদীছ যদি সহীহ প্রমাণিত হয়, তবে তা অবশ্য পালনীয় হওয়ার ব্যাপারে উক্ত হাদীস ও কুরআনের আয়াতের মধ্যে কোন পার্থক্য হবে না।
কেননা হাদীস সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى
‘রাসূল কোন মনগড়া কথা বলেন না, যা বলেন তা অহী ব্যতীত নয়।’(সূরা নাজম: ৫৩/৩-৪)।
আর একারণেই আল্লাহ বলেন,
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ
‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’(সূরা আন-নিসা: ৪/৮০)।
রাসূলুল্লাহ(ﷺ) নিজে শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং তিনি কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে মানুষকে পরিশুদ্ধ করেন। (সূরা আলে-ইমরান: ৩/১৬৪)
ইবনু আববাস(রাঃ) বলেন, রাসূল(ﷺ) আমাদেরকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন, যেভাবে তিনি আমাদেরকে কুরআনের একেকটি সূরা শিখাতেন।’(সহীহ মুসলিম হা/৪০৩)।
একবার তিনি চারজন সাহাবীর নাম করে বললেন, তোমরা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, সালেম, মু‘আয বিন জাবাল ও উবাই বিন কা‘ব-এর নিকট থেকে কুরআন গ্রহণ কর।’(বুখারী হা/৪৯৯৯)।
সালেম ছিলেন সাহাবী আবু হুযায়ফার গোলাম। (ঐ, ফাৎহুল বারী)। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বনু সুলায়েম গোত্রের রে‘ল ও যাকওয়ান শাখার আমন্ত্রণে তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ শিখানোর জন্য রাসূল(ﷺ) আনসারদের মধ্য হতে ৭০ জন শ্রেষ্ঠ ক্বারী সাহাবীকে প্রেরণ করেন। যাদেরকে তারা বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করে। (মুসলিম হা/৬৭৭, ১৪৭)।
যা বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা হিসাবে প্রসিদ্ধ। যাদের বিরুদ্ধে রাসূল(ﷺ) ফজর সালাতে মাসব্যাপী কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা/৪০৮৮)।
সাহাবী আবুদ্দারদা(রাঃ) বলেন, তুমি কখনোই আলেম হতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি ছাত্র হবে। আর তুমি কখনোই আলেম হতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি ইলম অনুযায়ী আমল করবে।’(দারেমী হা/২৯৩, সনদ হাসান)।
ইবনু আবী হাতেম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের একটি উক্তি নকল করেন। তিনি বলেন, এমন কোন বস্ত্ত নেই যার উল্লেখ কুরআনে নেই। কিন্তু আমাদের অনুভূতি তা অনুধাবনে অক্ষম। সেকারণ তা ব্যাখ্যাদানের জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন,
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
‘আর আমরা তোমার নিকটে নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে।’(সূরা নাহল ১৬/৪৪)।
ইমাম শাফেঈ বলেন, সহীহ সুন্নাহ কখনোই কুরআনের পরিপন্থী নয়।বরং তার পরিপূরক। কেননা কোন ব্যক্তিই রাসূলের ন্যায় কুরআন বুঝতে সক্ষম নয়। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর একটি বৃহৎ গ্রন্থ রয়েছে যার নামই হলো موافقه صحيح المنقول لصريح المعقول (‘বিশুদ্ধ হাদীস সর্বদা বিশুদ্ধ জ্ঞানের অনুকূল হওয়া’)। যা বৈরূত ছাপায় (১৯৮৫) দুই খন্ডে ৪৪৬+৪৮৭=৯৩৩ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত।
মাকহূল বলেন, الْقُرْآنُ أَحْوَجُ إِلَى السُّنَّةِ مِنَ السُّنَّةِ إِلَى الْقُرْآنِ- ‘সুন্নাহর জন্য কুরআনের প্রয়োজনীয়তার চাইতে কুরআনের জন্য সুন্নাহর প্রয়োজনীয়তা অধিক।’
ইয়াহইয়া ইবনে কাছীর বলেন, السُّنَّةُ قَاضِيَةٌ عَلَى الْكِتَابِ، وَلَيْسَ الْكِتَابُ بِقَاضٍ عَلَى السُّنَّةِ- ‘সুন্নাহ কুরআনের উপর ফায়সালাকারী, কিন্তু কুরআন সুন্নাহর উপর ফায়সালাকারী নয়।
’ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, مَا أَجْسُرُ عَلَى هَذَا أَنْ أَقُولَهُ، وَلَكِنِّي أَقُولُ: إِنَّ السُّنَّةَ تُفَسِّرُ الْكِتَابَ وَتُبَيِّنُهُ- ‘আমি এটা বলতে দুঃসাহস করি না। তবে আমি বলব যে, সুন্নাহ কিতাবকে ব্যাখ্যা করে ও তার মর্মকে স্পষ্ট করে।’(ইমাম কুরতুবী)। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, এর দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, সুন্নাহ আল্লাহর কিতাবের জন্য ব্যাখ্যা স্বরূপ।
ইমাম আওযাঈ (মৃ. ১৫৭ হি.) জ্যেষ্ঠ তাবেঈ হাসসান বিন আত্বিয়াহ(মৃ. ১২০ হি.) থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেছেন, كَانَ الْوَحْيُ يَنْزِلُ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَحْضُرُهُ جِبْرِيلُ بِالسُّنَّةِ الَّتِي تُفَسِّرُ ذَلِكَ- ‘রাসূলুল্লাহ(ﷺ)-এর উপরে(কুরআনের) অহি নাযিল হতো এবং তাঁর নিকটে জিব্রীল সুন্নাহ নিয়ে হাযির হতেন, যা সেটিকে ব্যাখ্যা করে দিত।’(তাফসিরে কুরতুবী)।
এক্ষণে যারা সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবাদতের সময় ও পদ্ধতি সমূহ কেবলমাত্র কুরআন থেকে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তারা এক হাস্যকর তাবীলের আশ্রয় নিবেন।
উপসংহার: পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে ইসলামী আইন প্রণয়নে এবং কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝার ক্ষেত্রে সুন্নাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সূর্যালোকের ন্যায় পরিস্ফুটিত হয়।
যদি আমরা উপরিউক্ত উদাহরণগুলো এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্ত করণের উদ্দেশ্যে যেগুলোকে আমরা এখানে উল্লেখ করিনি সেগুলোকেও একটু গভীরভাবে বিবেচনা করি, তাহলেই আমরা নিশ্চিত হয়ে যাব যে, সুন্নাতের সাহায্য ছাড়া কুরআনুল কারীমকে পূর্নাঙ্গরূপে বুঝার এবং তার উপর আমল করার কোন উপায় নেয়।(মানযিলাতুস সুন্নাহ ফিল ইসলাম, পৃ. ৪-১২)।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে সালফে-সালেহীনের মানহাজ অনুযায়ী কুরআনুল কারীমকে বুঝার ও মানার তাওফীক্ব দান করুন। আমিন!! (সংকলিত আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)