‼️ পোস্টটি সুন্দরভাবে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।‼️

হালাল - হারাম সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসা

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,544
Credits
2,602
পৃথিবীতে বসবাসের জন্য অর্থ এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জীবন ধারণে অর্থের বিকল্প নেই। ধনী-গরীব, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই অর্থের প্রয়োজন। অর্থ-সম্পদ ব্যতীত পার্থিব জীবনে সুখ-সাচ্ছন্দ্য কোনভাবেই আশা করা যায় না। জীবন পরিচালনার প্রত্যেক পদে পদে অর্থ-সম্পদের দরকার হয়। যার অর্থ-সম্পদ বেশী তার জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত। আর যার অর্থ-সম্পদ কম তার জীবনযাত্রার মানও অপেক্ষাকৃত অনুন্নত। অর্থ-সম্পদের উপরই জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে। কারণ অর্থ-সম্পদ না থাকলে, সে চাইলেও জীবনযাত্রার মান ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারবে না। পক্ষান্তরে পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ থাকলে খুব সহজেই জীবনযাত্রার মান অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরা সম্ভব।

অর্থের গুরুত্ব বিবেচনা করেই মানুষ অর্থ উপার্জনের জন্য জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে। প্রতিটি মানুষের জীবনের সবচেয়ে বেশী সময় ব্যয়িত হয় এই অর্থ-সম্পদ অর্জনের পিছনে। অনেকে অর্থ উপার্জনে মরিয়া হয়ে পড়ে। আবার অনেকে অর্থ-সম্পদের মোহে অন্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি সুস্থ বিবেক পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। এমন কোন হীন কাজ নেই যা সে করে না। যে কোন মূল্যে তার অর্থ-সম্পদ চাই। অনেক সময় এর জন্য কাউকে খুন করতেও সে দ্বিধা করে না। কারো তাজা রক্ত প্রবাহিত করতেও হাত কাঁপে না। অর্থের মোহ তাকে মায়া মমতাহীন এক পশুতে পরিণত করে।

মানুষ পার্থিব জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। যে কোন পন্থায় চাই প্রতিষ্ঠিত হতে। সে চিন্তা থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের অঘোষিত প্রতিযোগিতায়। বৈধ-অবৈধ বাছ-বিবেচনার প্রয়োজনও মনে করে না। হালাল-হারামের সীমারেখা তার কাছে হয়ে যায় নগণ্য। সমাজ যেহেতু অর্থকে মূল্যায়ন করে। বিধায় অর্থ-সম্পদই তার প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। সূদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, দুর্নীতি, আত্মসাৎ, খিয়ানত, অত্যাচার প্রভৃতি উপায়ে সে অর্থ অর্জনে লিপ্ত হয়। আর সূদ-ঘুষ ও অবৈধ ব্যবসাকে তো কোন অপরাধই মনে করে না। অথচ সূদ ও ঘুষ সমাজ শোষণের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ ধনিক শ্রেণী ও কতিপয় প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত শোষণ করে নিচ্ছে।

সূদী পদ্ধতিতে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে লোকসানের ঝুঁকি একেবারেই সীমিত। বরং নেই বললেই চলে। তাই এই প্রক্রিয়া বেছে নিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। কেউ ব্যক্তিগতভাবে ‘দাদন ব্যবসায়ী’র রূপ নিয়ে। আবার কেউ বৃহত্তর বা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে। ফলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যাংক, বীমা, জীবন বীমা, এনজিও ও সমিতি। যেগুলোর প্রায় সবই সূদ ভিত্তিক লেনদেনে সিদ্ধহস্ত। যুক্তি-তর্ক, পথ-পদ্ধতি যে যাই বলুক না কেন সকলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিন্তু একই। আবার অনেকে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জনে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ একজন মুসলিম কোনক্রমেই সূদ-ঘুষ বা অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারে না। সামান্য অর্থ উপার্জনেও সে লক্ষ্য করবে যে, এটি বৈধ না অবৈধ পন্থা। নিশ্চিত না হয়ে কোন পথে পা বাড়াবে না। সর্বাগ্রে সে ইসলামকেই প্রাধান্য দিতে সদা প্রস্তুত থাকবে। এটাই তো ঈমানের মৌলিক দাবী।

সূদের পরিচয়

সূদ অর্থ হচ্ছে, কুসীদ বা ঋণ গ্রহণ বাবদ ঋণের পরিমাণের হিসাবে যে অতিরিক্ত লাভ দেয়া হয়। আর সূদখোর অর্থ- টাকা ধার দেবার জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায়কারী বা কুসীদজীবী।[১]
সূদের আরবী হচ্ছে ‘রিবা’। আর ‘রিবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। শরী‘আতের পরিভাষায়- মূলধনের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাকে রিবা বা সূদ বলা হয়। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক ‘উমর চাপড়া’র মতে- শরী‘আতে ‘রিবা’ বলতে ঐ অর্থকে বোঝায়, যা ঋণের শর্ত হিসাবে মেয়াদ শেষে ঋণগ্রহীতা মূল অর্থসহ অতিরিক্ত অর্থ ঋণদাতাকে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।[২]

আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, مَا زَادَ فَهُوَ رِبَا ‘যা (প্রদত্ত অর্থ বা পণ্যের চেয়ে) অতিরিক্ত (নেয়া হয়) তাই সূদ’।[৩] ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে প্রদেয় অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হল রিবা’।[৪]

প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইবনু জারীর (রাহিমাহুল্লাহ) মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, ‘জাহিলী যুগে প্রচলিত ও কুরআনে নিষিদ্ধ রিবা হল- কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করা। আরবরা তাই-ই করত এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সূদ বাড়িয়ে দেয়ার শর্তে পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দিত’।[৫]

মুওয়াত্ত্বা মালেকের ভাষ্যকার বলেন, ‘বিনিময়ের ক্ষেত্রে একই জিনিসের অতিরিক্ত নেয়াই সূদ’।[৬]

হাদীসের পরিভাষায় বুঝা যায় যে, ‘একই বস্তু বিনিময়ের ক্ষেত্রে কম-বেশী করা অথবা অর্থ ঋণ দিয়ে গ্রহণের সময় গ্রহীতার নিকট থেকে বেশী পরিমাণ গ্রহণ করায় সূদ’।[৭]

সূদের সংজ্ঞায় হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে- كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ نَفْعًا فَهُوَ رِبًا অপর বর্ণনায় রয়েছে- كُلُّ قَرْضٍ جَرَّ مَنْفَعَةٍ فَهُوَ رِبًا ‘যে ঋণ কোন মুনাফা বয়ে নিয়ে আসে তাই রিবা বা সূদ’।[৮]

‘ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়্যাহ’তে সূদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট জিনিস বিনিময়ের সময় যদি অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করে তাই সূদ। যদিও তাদের উভয়ের সম্মতিতে হয় থাকে’। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘ঋণ গ্রহণের পর পরিশোধের সময় প্রদেয় অতিরিক্ত অর্থই সূদ হিসাবে গণ্য’।[৯]

শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’ গ্রন্থে বলেন, ‘এক প্রকার হচ্ছে সরাসরি ও প্রকৃত সূদ এবং অন্য এক প্রকার প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ ও নির্দেশগত। সত্যিকার সূদ ঋণ দিয়ে বেশী নেয়াকে বলা হয় এবং নির্দেশগত সূদ বলতে হাদীসে বর্ণিত সূদকে বোঝানো হয়’।[১০]

এখানে আরো একটি কথাও স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে ঁংঁৎু ও রহঃবৎবংঃ এর মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। যদিও কেউ কেউ মনে করে যে, কুরআন হাদীসে যে ‘রিবা’ হারাম করা হয়েছে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেয়া, ঋণের বিনিময়ে গৃহীত অতিরিক্ত অর্থই বুঝায়। কিন্তু ব্যবসায়ী কাজে লগ্নিকৃত টাকার নির্দিষ্ট হারের মুনাফা রহঃবৎবংঃ গ্রহণ নিষিদ্ধ নয়। এরূপ ধারণা কুরআন-হাদীসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কুরআন মাজীদে যে সূদ হারাম করা হয়েছে তা যত রকমেই হোক না কেন এবং তা লাভ করার জন্য যে পন্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন, সবই সম্পূর্ণরূপে হারাম। বিশেষতঃ যে সময় ‘রিবা’ নিষেধের আয়াত নাযিল হয়েছিল সে সময়কার আরব সমাজে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রদত্ত ঋণের উপর সূদ নেয়া হত, অনুরূপভাবে ব্যবসায়ে লগ্নিকৃত মূলধনের উপরও সূদ গ্রহণের রীতি চালু ছিল। এই উভয় প্রকার সূদকে তখন আরবী ভাষায় ‘রিবা’-ই বলা হত। আর কুরআন মাজীদে এই ‘রিবা’কেই হারাম করা হয়েছে।[১১]

মোদ্দাকথা কোন একই জাতীয় জিনিস পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করার সময় কম-বেশী করার নাম সূদ। আবার টাকা-পয়সা কাউকে ঋণ দিয়ে প্রদেয় অর্থের অতিরিক্ত গ্রহীতার নিকট থেকে গ্রহণ করাও সূদ। চাই দাতা কোন ব্যক্তি হোক অথবা কোন প্রতিষ্ঠান।

অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যে সূদ

অন্যান্য ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যেও সূদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআন নাযিলের পূর্বে যেসব ধর্মীয় গ্রন্থ নাযিল হয়েছিল সেগুলোতেও সূদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে সেসব গ্রন্থগুলো অবিকৃত অবস্থায় নেই। কোন নবী-রাসূল সূদের সমর্থনে কথা বলেননি। বরং প্রত্যেকেই সূদী কারবারের বিরোধিতা করেছেন। প্রাচীন অনেক কবি-সাহিত্যিকও এর ক্ষতিকর প্রভাব সমাজে তুলে ধরেছেন। বুঝা যায় বহুকাল পূর্ব থেকেই সূদপ্রথা ঘৃণীত ও জঘন্য হিসাবে বিবেচিত।

কুরআন নাযিলের পূর্বে অন্যান্য যেসব আসমানী গ্রন্থ নাযিল হয়েছিল, সেসবেও সূদ নিষিদ্ধ ছিল। ঐসব গ্রন্থ আজ আর অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় না। দাউদ (আলাইহিস সালাম) -এর উপর নাযিলকৃত গ্রন্থ ‘যাবূর’-এর কোন সন্ধান মেলে না। মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর উপর নাযিল হওয়া ‘তাওরাত’ ও ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর উপর নাযিল হওয়া ‘ইনজীল’-এর যে বহু বিকৃতি ঘটানো হয়েছে যুগে যুগে, একথা তো সর্বজনবিদিত। তারপরও ইনজীল বা বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বা আদিপুস্তক তাওরাতেরই অংশবিশেষ বলে ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ দাবী করেন। সেই আদিপুস্তকেই সূদ সম্বন্ধে যে ঘোষণা ও নির্দেশনা রয়েছে তা এ যুগের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন- ‘তুমি যদি আমার প্রজাদের মধ্যে তোমার স্বজাতীয় কোন দ্বীন-দুঃখীকে টাকা ধার দাও তবে তাহার কাছে সূদগ্রাহীর ন্যায় হইও না; তোমরা তাহার উপর সূদ চাপাইবে না’ (যাত্রাপুস্তক; ২২: ২৬)।[১২]

পৃথিবীর আদিকাল থেকে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ একে নিকৃষ্ট পাপ বলেছেন। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল সবাই একে নিন্দা করেছেন। যারা সূদকে সময়ের মূল্য বলে দাবী করেন, তাদের যুক্তি খ-ন করে ইতালীয় প-িত থমাস একুইনাস বলেন, ‘সময় এমন এক সাধারণ সম্পদ যার উপর ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা ও অন্যান্য সকলেরই সমান মালিকানা বা অধিকার রয়েছে। এমতাবস্থায় শুধু ঋণদাতার সময়ের মূল্য দাবী করাকে তিনি অসাধু ব্যবসা বলে অভিহিত করেছেন’।[১৩]

বিভিন্ন সাহিত্যেও কবি-সাহিত্যিকগণ সূদের কঠোর সমালোচনা করে কাব্য-সাহিত্য রচনা করেছেন। সাধারণ জনগণকে সূদী অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। পল মিলস, জন প্রিসেল, প্লুটার্ক ও ইতালীর অমর কবি দান্তে-র রচনায় যার প্রমাণ মেলে। ইংরেজী সাহিত্যের অবিসংবাদিত স¤্রাট সেক্সপীয়রের ‘দি মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের শাইলক ও মলিয়েরর ‘দি মাইজার’ নাটকের হারপাগণের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। অনুরূপই রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ শওকত ওসমানের ‘ইতা’ প্রভৃতি গল্প এবং কাজী ইমদাদুল হকের ‘আব্দুল্লা’, অদ্বৈত মল্ল বর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ প্রভৃতি উপন্যাস তার প্রমাণ।[১৪]

ব্যাংক কারবারের মূল ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাই প্রাচীন গ্রীক সমাজে যখন ব্যাংক একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ শুরু করেছিল, তখন টাকা লগ্নি করে তার বিনিময়ে সূদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। রোমান সমাজে শুরুতে তা নিষিদ্ধ থাকলেও পরে ক্রমশঃ সা¤্রাজ্যবাদ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায় সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সূদ গ্রহণ শুরু হয়। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্টে’ সূদ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ইহুদীরাই এই নিষেধ প্রকাশ্যভাবে অমান্য করে। অবশ্য রোমান ক্যাথলিকরা যতদিন শাসন কার্য চালিয়েছে, ততদিন তারা সূদের কারবার চলতে দেয়নি। দুনিয়ায় ইহুদীরাই এই সূদী কারবারের প্রবর্তক। উত্তরকালে গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাই সূদের ভিত্তিতে চলতে থাকে। ইসলাম এই সূদী কারবারকে সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিশ্বনবীর আদর্শে গঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রে সূদী কারবার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে অনুরূপ সমাজ গঠন ও সূদবিহীন ব্যাংক ব্যবস্থা কায়েম করাই মানবতার শোষণ মুক্তির একমাত্র পথ।[১৫]

ইসলাম, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি

পুঁজিবাদ ও কমিউনিজম বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পর্কেও আমাদের ধারণা থাকা দরকার। পুঁজিবাদী বা কমিউনিজম অর্থনীতি সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা থাকলে ইসলামী অর্থনীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করা সহজ হবে। বর্তমান পৃথিবীতে পুঁজিবাদ ও কমিউনজম (সমাজতন্ত্র) এই দু’প্রকারের অর্থব্যবস্থাই বাস্তবে প্রচলিত রয়েছে। অধুনা প্রায় সমগ্র পৃথিবীকে এই দু’টিই গ্রাস করে নিয়েছে। অথচ মানবতা উভয় ব্যবস্থায় মাযলূম, বঞ্চিত ও নিপীড়িত। বস্তুত এসব ব্যবস্থায় মানুষ যে কোনক্রমেই সুখী হতে পারে না, তা উভয় ব্যবস্থার আদর্শিক বিশ্লেষণ হতে সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত। যার সফলতা-ব্যর্থতা উভয়ই মানুষের নিকট পরিষ্কার। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই দিবালোকের ন্যায় ঝলমল করবে।

পুঁজিবাদ : শুরুতে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম পর্যায়ে তা মানুষের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বটে, কিন্তু এর প্রথম অধ্যায় অতিক্রান্ত হওয়ার পরই তার অভ্যন্তরীণ ত্রুটি ও ধ্বংসকারিতা লোকদের সম্মুখে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তারা দেখতে পায় যে, সমাজে ধনসম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে সত্য, কিন্তু তা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির সর্বগ্রাসী হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে আর কোটি কোটি মানুষ নিঃস্ব ও বঞ্চিত হয়ে পড়ছে। এটা ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে একেবারে পথের ভিখারী করে দিচ্ছে। সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তার ভিত্তিমূলকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। একদিকে অসংখ্য পুঁজিদার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। অপরদিকে দরিদ্র দুঃখী ও সর্বহারা মানুষের কাফেলা হামাগুড়ি দিয়ে চলে সীমাহীন সংখ্যাহীন। পুঁজিবাদী সমাজে এই আকাশ ছোঁয়া পার্থক্য দেখে পাশ্চাত্য চিন্তবিদেরাও আজ আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন। অধ্যাপক কোলিন ক্লার্ক বলেছেন, ‘বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে সর্বাপেক্ষা কম এবং সর্বাপেক্ষা বেশী আয়ের মধ্যে শতকরা বিশ লক্ষ গুণ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। এইরূপ পার্থক্য ও অসামঞ্জস্য এক একটি সমাজে যে কত বড় ভাঙ্গন ও বিপর্যয় টেনে আনতে পারে, তা দুনিয়ার বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশে ও সমাজে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে’।[১৬]

বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হবসন কেরিয়া এবং তারপর লর্ড কেইনজ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার গভীরতর অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই তত্ত্ব উদঘাটন করেছেন যে, ‘জনগণের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এরূপ অর্থব্যবস্থার গর্ভ থেকেই জন্মলাভ করে। এরূপ অর্থব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ধন-সম্পদের অসম বণ্টন। এ অসম বণ্টনই দেশের কোটি কোটি নাগরিকের ক্রয়-ক্ষমতা হরণ করে নেয়। এর ফলেই সমাজের মধ্যে সর্বধ্বংসী শ্রেণী-সংগ্রামের আগুন জ্বলে উঠে’।[১৭]

পুঁজিবাদী ও সামান্তবাদী[১৮] সামাজিক ব্যবস্থায় জনগণের হাতে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা থাকে না। সরাসরি উৎপাদনকারী চাষী ও মজুরের হাত থেকে উৎপাদিত দ্রব্য মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়- বিভিন্ন আঁকাবাঁকা জটিল অর্থনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। এর মধ্যে ব্যবসায়, ব্যাংক প্রভৃতি উপ-প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক চলাচলকে আরো জটিল করে তোলে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অসামান্য দুর্যোগের পথ তৈরি করে তোলে।[১৯]
পুঁজিদারদের যুক্তি এই যে, মূলধন বিনিয়োগ, পণ্য উৎপাদন ইত্যাদিতে সকল প্রকার ঝুঁকি ও দায়িত্ব যখন তারাই গ্রহণ করে, তখন মুনাফা হলেও তা এককভাবে তাদেরই প্রাপ্য এবং শ্রমিকদেরকে শোষণ করারও তাদের অবাধ সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। বস্তুত শ্রমিক শোষণই পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার।[২০]

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল সূদপ্রথা। সূদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইসলামে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করা হয়েছে। বিনা-সূদে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সংগঠনের বিরাট ইমারত গড়ে উঠতে পারে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমস্ত সম্পদের উপর ব্যক্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সে মনে করে, সে যে সম্পদ অর্জন করেছে, তা ভোগ করার একমাত্র অধিকার তারই। পুঁজিবাদী কারূনও তাই মনে করত। পুঁজিবাদের প্রতীক কারূনই পুঁজিবাদী মনোভাবাপন্ন বহু মুসলিমের জীবনাদর্শ।[২১]

আরো বলা যায় যে, সূদ, জুয়া প্রতারণামূলক কাজ-কারবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। বিনা সূদে কাউকেও কিছুদিনের জন্য ‘এক পয়সা’ দেয়া পুঁজিবাদীর দৃষ্টিতে চরম নির্বুদ্ধিতা এবং তার ‘বিনিময়’ অবশ্যই আদায় করতে হয় এবং তার হার পূর্ব হতেই নির্দিষ্ট করে দেয়া আবশ্যক। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হোক, অভাব-অনটন দূর করার জন্য সাময়িক ঋণ হোক কিংবা অর্থোপার্জনের উপায় স্বরূপ মূলধন ব্যবহারের জন্যই হোক, কোন প্রকারেই লেনদেন বিনাসূদে সম্পন্ন করা পুঁজিবাদী সমাজে অসম্ভব।[২২]

অবাধ ব্যক্তি মালিকানা ও সীমাহীন ভোগের অধিকার হল পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল কথা। সে যুগে ফেরাঊনী রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেভাবে ক্বারূনী অর্থনীতিকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্বল শ্রেণীর রক্ত শোষণ করেছিল। এ যুগেও তেমনি কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো স্ব স্ব দেশের পুঁজিপতি ও ধনিক শ্রেণীকে সর্বোতভাবে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দুর্বল শ্রেণীর রক্ত শোষণ করছে। শ্রমিকদের উঁচু-নীচু অবস্থার দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার বুঝা যাবে। ভোগের যথেচ্ছা অধিকার ও নিরংকুশ মালিকানা লাভের উদগ্র লালসা সমাজে হিংসা-হানাহানি, রক্তপাত, জিঘাংসা ও সংঘাতকে অনিবার্য করে তোলে।[২৩]



[১]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, পরিমার্জিত সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৯২ ইং), পৃ. ১১৫৭।
[২]. তাফসীরুল কাবীর, গৃহীত : প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, সূদ (রাজশাহী : হাদীস ফাউ-েশন বাংলাদেশ, ফেব্রুয়াবী ২০০৯ ইং), পৃ. ৫।
[৩]. ফাৎহুল বারী, ৪র্থ খ-, পৃ. ৩৮২; শারহুন নববী, ১১তম খ-, পৃ. ২৩।
[৪]. ফাৎহুল বারী, ২য় খ-, পৃ. ৫৩২; সূদ, পৃ. ৬।
[৫]. তাফসীর ইবনু জারীর, ৩য় খ-, পৃ. ৬২; তদেব, পৃ. ৬।
[৬]. শারহুয যুরক্বানী, ৩য় খ-, পৃ. ৩৯৪।
[৭]. সহীহ মুসলিম, হা/১৫৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৯৪৭; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫০১৫; মিশকাত, হা/২৮০৯।
[৮]. আল-জামে‘ আছ-ছাগীর, হা/৯৭২৮; সুবুলুস সালাম, ৩য় খ-, পৃ. ১৭; ইরওয়াউল গালীল, হা/১৩৯৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২১২। বি. দ্র. সূদের পরিচয় দিতে গিয়ে একাধিক বিদ্বান হাদীসটি দলীল হিসাবে পেশ করেছেন। কিন্তু সনদগত দিক দিয়ে হাদীসটি ত্রুটিপূর্ণ। তবে কেউ কেউ এর শাহেদ রয়েছে বলতে চেয়েছেন। আওনুল মাবুদ, ৯য় খ-, পৃ. ২৯২।
[৯]. ফাতাওয়া আশ-শাবাকাতুল ইসলামিয়্যাহ, ফাতাওয়া নং ১৩৫৩৩, ৩য় খ-, পৃ. ১৯৩১।
[১০]. মাওলানা এমামুদ্দীন মোঃ ত্বহা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সুদ-ঘুষ (ঢাকা : মাহমুদ পাবলিকেশন্স, প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ২০১৪ ইং), পৃ. ৯৯।
[১১]. মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, ইসলামের অর্থনীতি (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, অষ্টম প্রকাশ : এপ্রিল ২০০৫ ইং), পৃ. ২৬৮।
[১২]. সূদ, পৃ. ১১।
[১৩]. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, বায়‘এ মুআজ্জাল (রাজশাহী : হাদীস ফাউ-েশন বাংলাদেশ, ফেব্রুয়াবী ২০১৮ ইং), পৃ. ৩৩-৩৪।
[১৪]. সূদ, পৃ. ১১।
[১৫]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃ. ২৬৬।
[১৬]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯।
[১৭]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০।
[১৮]. সামন্তবাদী সমাজের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি জমি। জমির মালিকানার ভিত্তিতে জমির প্রভু বা সামন্তপ্রভু সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই প্রাচীন দাস সমাজের পরে সামন্ত সমাজের বিকাশ ঘটেছে। উৎপাদনের উপায়ের নতুনতর বিকাশে সামন্ত সমাজের স্থানে আধুনিক কালে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুঁজিবাদের পরবর্তী ঐতিহাসিক পর্যায় হচ্ছে সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রও পৃথিবীর একাধিক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
[১৯]. অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউ-েশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ : আগস্ট-২০০৭ ইং), পৃ. ২০৯।
[২০]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃ. ২৮।
[২১]. এ. জেড. এম. শামসুল আলম, ইসলামী প্রবন্ধমালা (ঢাকা : ইসলামিক ফাউ-েশন বাংলাদেশ, তৃতীয় সংস্করণ : এপ্রিল ২০০৪ ইং), পৃ. ৪৬৯-৪৭০।
[২২]. ইসলামের অর্থনীতি, পৃ. ২৯।
[২৩]. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, জীবন দর্শন (রাজশাহী : হাদীস ফাউ-েশন বাংলাদেশ, ফেব্রুয়ারী ২০১৩ ইং), পৃ. ৩৬।



-ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।​
 
Last edited:

Share this page