আদব ও শিষ্টাচার সন্তানের প্রতি পিতা মাতার দায়ীত্ব ও কর্তব্য।

Joined
May 20, 2024
Threads
21
Comments
26
Reactions
253
সন্তান হচ্ছে একজন মানুষের জন্য পৃথিবীর সব থেকে বড় ও মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ দ্বারা মানুষ জীবিত ও মৃত্যু উভয় অবস্থায় লাভবান ও উপকৃত হয়ে থাকেন। একজন আদর্শবান ও সুসন্তান তার পিতা-মাতার জন্য পার্থিক জীবনের সুখ-শান্তি এবং পরকালে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম। এই মর্মে হযরত আবু হুরায়রা রাজিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

إِذَا مَاتَ ابنُ آدم انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أو عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ ( رَوَاهُ مُسْلِم : 931)

অর্থাৎ মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন থেকে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমল অবশিষ্ট থাকে, ওই সব আমলের পুণ্য সে মৃত্যুর পরেও পেতে থাকে। ১) সাদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব। ২) মানবের উপকৃত জ্ঞানের পুণ্য। ৩) নেক সন্তানের দোয়া। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৯৩১)

এক কথায় সন্তান হল আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পিতা-মাতার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ ও নেয়ামত। আর বৃদ্ধকালে সন্তানই হয় পিতা-মাতার একমাত্র ভরসা।

পৃথিবীতে যত ভালবাসা রয়েছে সকল ভালোবাসার পিছনে স্বার্থ জড়িত রয়েছে, কিন্তু নিঃস্বার্থ ভালোবাসা হল মাত্র একটি, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা। এই ভালোবাসার তাগিদেই প্রতিটি মানুষ তার সন্তানের পার্থীব শান্তি, স্বস্তি ও সুখ্যাতির জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রানন্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এটাই হলো মানুষের ফিতরাত বা স্বভাব। আর ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। ইসলাম চায় মানুষের এই স্বভাব স্থায়ী হোক। তাই ইসলামের আদেশ হলো হে মানুষ সকল! তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গ বিশেষ করে সন্তান-সন্তাদিকে শুধু দুনিয়ার কষ্ট থেকে বাঁচাবার জন্য চিন্তা করো না, বরং পরলয়ের আযাব থেকেও বাঁচার চেষ্টা করো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

يا أيها الذين آمنوا قوا أنفسكم وأهليكم نارا وقودها الناس والحجارة عليها ملائكة غلاظ شداد لا يعصون الله ما أمرهم ويفعلون ما يؤمرون ( التحريم : 6)

হে মুমিন গন! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষান হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের ফেরেস্তাগন। তারা আল্লাহ তা’য়ালা যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং যা আদেশ করা হয় তাই করে। (সূরা তাহরীম আয়াত নং ৬)

উক্ত আয়াত থেকে দ্বারা বুঝা যায় মানুষ দুনিয়ার ব্যাপারে যেমন কেবল নিজে বাঁচার চিন্তা করে শেষ করে না। বরং সন্তানাদিকেও বাঁচাবার প্রানান্তর চেষ্টা করে। ঠিক তেমনিভাবে আখিরাতের ব্যাপারে ঐ একই চেষ্টা করতে হবে। যেন কোন অবস্থাতেই তাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে না পারে।

সমাজে অনেক লোক আছেন মা-শা-আল্লাহ দ্বীনদার, নামাজি, মসজিদে প্রথম কাতারে নামাজ পড়েন। তাকবীরে উলা ধরার চেষ্টা করে , তাহাজ্জুদ, নফল সবই পড়েন। কিন্তু দেখা যায় তার ছেলে নামাজ পড়ে না, মেয়ে পর্দা করে না, স্ত্রী শরিয়ত মোতাবেক চলে না। এতে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। বরং তারা জবাব দেয়, পরিবেশ খারাপ ছেলে মেয়ে কথা শুনে না। এ ধরনের বিভিন্ন রকমের কথা আমরা বলি। আসলে কোনটাই খারাপ নয়, বরং আমাদের স্বভাবই খারাপ। এক দু’বার আদেশ করেই মনে করি আমার দায়িত্ব শেষ। অনবরত ধারাবাহিকভাবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজ পরিবার আত্মীয়-স্বজন ও সন্তান -সন্তাদি কে ইসলামের হেদায়াত ও নির্দেশনার দিকে আহবান করতে হবে। এটি হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার কর্তব্য ও দায়িত্ব। একটি সুস্থ সমাজ গঠনে সুস্থ পরিবারের কোন বিকল্প নেই। আর সুস্থ ও সভ্য পরিবার গড়ে তুলতে হলে ইসলামের হেদায়াত ও নির্দেশনা অনুযায়ী ধারাবাহিক সন্তানদের তারবিয়্যত করা অপরিহার্য।

সন্তান লালন-পালনে পিতা মাতার করণীয়:

১) সন্তানের জন্য একজন দ্বীনদার ও আদর্শবান মা নির্বাচন করা:

সন্তানের মন-মানসিকতা গঠনে মাতা-পিতার মন-মানসিকতার প্রভাব অপরসীম। তাই ভালো সন্তান চাইলে তাদার জন্য একজন দ্বীনদার ও আদর্শবান মা নির্বাচন করা অপরিহার্য। এই মর্মে হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেন:

تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ : لِمَالِهَا ، وَلِحَسَبِهَا ، وَلِجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاك (الصحيح للبخاري:4802 الصحيح لمسلم:1466)

সাধারণত মানুষ নারীকে বিবাহ করে তার চারটি জিনিস দেখে: (ক) তার ধন-সম্পদ (খ) বংশমর্যাদা (গ) তার সৌন্দর্য (ঘ) তার ধর্মপরায়ণতা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেন: তোমরা দ্বীনদার মহিলাকে বিয়ে করে ধন্য হও, অন্যথা তোমার উভয় হাত ধুলায় ধূসরিত (তুমি লাঞ্ছিত ও অপমানিত)হবে। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৪৮০২,সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১৪৬৬)

২ ) স্বামী স্ত্রী উভয় এ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে দুআ পাঠ করা:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، يَبْلُغُ بِهِ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا أَتَى أَهْلَهُ قَالَ بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا‏.‏ فَقُضِيَ بَيْنَهُمَا وَلَدٌ، لَمْ يَضُرَّهُ ‏

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ তাঁর স্ত্রীর সাথে মিলনের পূর্বে যদি বলে, بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا অর্থাৎ আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে শয়তান থেকে দূরে রাখ এবং যা আমাদেরকে দান করবে তাকেও শয়তান থেকে দূরে রাখ - তারপর (এ মিলনের দ্বারা) তাদের কিসমতে কোন সন্তান থাকলে শয়তান তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৪৩)

৩) বিয়ের পর নেক সন্তানের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ধারাবাহিক প্রার্থনা করা:

আমাদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে নেক সন্তানের জন্য ধারাবাহিক প্রার্থনা ও দোয়া করেছেন।

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (الصافات:100-101)

হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। (সুরা সাফফাত আয়াত নং ১০০-১০১)

হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের দোয়া সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বর্ণনা দেন:

هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهُ قَالَ رَبِّ هَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ فَنَادَتْهُ الْمَلَائِكَةُ وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي فِي الْمِحْرَابِ أَنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكَ بِيَحْيَى مُصَدِّقًا بِكَلِمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَسَيِّدًا وَحَصُورًا وَنَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ قَالَ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَقَدْ بَلَغَنِيَ الْكِبَرُ وَامْرَأَتِي عَاقِرٌ قَالَ كَذَلِكَ اللَّهُ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ ( ال عمران : 38-40)

সেখানেই যাকারিয়া তাঁর পালনকর্তার নিকট প্রার্থনা করলেন। বললেন, হে, আমার পালনকর্তা! তোমার নিকট থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান কর-নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী। যখন তিনি কামরার ভেতরে নামাযে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন ফেরেশতারা তাঁকে ডেকে বললেন যে, আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন ইয়াহইয়া সম্পর্কে, যিনি সাক্ষ্য দেবেন আল্লাহর নির্দেশের সত্যতা সম্পর্কে, যিনি নেতা হবেন এবং নারীদের সংস্পর্শে যাবেন না, তিনি অত্যন্ত সৎকর্মশীল নবী হবেন। তিনি বললেন হে পালনকর্তা! কেমন করে আমার পুত্র সন্তান হবে, আমার যে বার্ধক্য এসে গেছে, আমার স্ত্রীও যে বন্ধ্যা। বললেন, আল্লাহ এমনি ভাবেই যা ইচ্ছা করে থাকেন। (সুরা আল ইমরান আয়াত নং ৩৮-৪০)

মোমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন সূরা আল ফুরকানের মধ্যে

وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

মোমিনেরা বলে: হে আমাদের প্রতিপালক তুমি! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে আমাদের চোখের শীতলতা করে দাও। এবং মুত্তাকীদের আমাকে ইমাম বানিয়ে দাও। (সূরা ফুরকান আয়ার নং ৭৪ )

৪- দারিদ্রতার ভয়ে সন্তান হত্যা না করা:

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হচ্ছেন রোজিদাতা। তিনি ছাড়া পৃথিবীর কোন শক্তি রুজি প্রদান করতে সক্ষম নয়। এ মর্মে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا

অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে যতগুলো প্রাণী রয়েছে সকল প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজে হাতে নিয়েছি।(সুরা হুদ আয়াত নং ১৬)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন

قُل تَعالَوا أَتلُ ما حَرَّمَ رَبُّكُم عَلَيكُم ۖ أَلّا تُشرِكوا بِهِ شَيـًٔا ۖ وَبِالوٰلِدَينِ إِحسٰنًا ۖ وَلا تَقتُلوا أَولٰدَكُم مِن إِملٰقٍ ۖ نَحنُ نَرزُقُكُم وَإِيّاهُم ۖ وَلا تَقرَبُوا الفَوٰحِشَ ما ظَهَرَ مِنها وَما بَطَنَ ۖ وَلا تَقتُلُوا النَّفسَ الَّتى حَرَّمَ اللَّهُ إِلّا بِالحَقِّ ۚ ذٰلِكُم وَصّىٰكُم بِهِ لَعَلَّكُم تَعقِلونَ

হে নবী! আপনি বলুন, এসো আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। তাএই যে, আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার করো না, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করো স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রের কারণে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই, নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করো না; কিন্তু ন্যায়ভাবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ। (সুরা আল আনয়আম আয়াত নং ১৫১)

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا

দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ। (সুরা বানী ইসরাঈল আয়াত নং ৩১)

আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَيُّ الذَّنْبِ أَكْبَرُ عِنْدَ اللهِ؟ قَالَ: أَنْ تَدْعُوَ لِلهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ، قَالَ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ خَشْيَةَ أَنْ يَّطْعَمَ مَعَكَ، قَالَ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: أَنْ تُزَانِيَ بِحَلِيْلَةِ جَارِكَ.

জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! কোন পাপটি আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মহাপাপ বলে বিবেচিত? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা; অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সে বললো: অতঃপর কি? তিনি বললেন: নিজ সন্তানকে হত্যা করা ভবিষ্যতে তোমার সঙ্গে খাবে বলে। সে বললো: অতঃপর কি? তিনি বললেন: নিজ প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করা। (সহাহ আল বুখারী:৪৪৭৭, ৪৭৬১, ৬০০১, ৬৮১১, ৬৮৬১, ৭৫২,৭৫৩২,সহীহ মুসলিম ৮৬)

সন্তানকে হত্যা করা এত বড় অপরাধ যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিয়ামতের মাঠে ঐ হত্যাকারী পিতা-মাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিহিত সন্তানকে জিজ্ঞাসা করবে, হে শিশু বল, কি অপরাধে তোমার পিতা-মাতা তোমাকে হত্যা করেছে। এই সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন:

وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ بِأَيِّ ذَنْبٍ

যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্য করা হল? (সুরা তাকভীর আয়াত নং ৮-৯)

১. শিশুর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া: সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর সাথে সাথে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দিতে হবে।

عن عبيد الله بن أبي رافع، عن أبيه، قال: رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم أذن في أذن الحسن بن علي حين ولدته فاطمة بالصلاة ( سنن أبي داؤد: 5105 سنن الترمذي: 1514 وقال الترمذي: هذا حديث حسن صحيح مسند أحمد: 23869 مسند البزار: 3879 المعجم الكبير للطبراني: 931 السنن الكبرى للبيهقي: 19303 مسند أبي داؤد الطيالسي: 1013 مصنف عبد الرزاق: 7986 وقال الألباني : حسن

উবাইদুল্লাহ ইবনু আবূ রাফি’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি পিতা আবূ রাফি (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দেখছি যখন ফাত্বিমাহ (রাঃ) আলী (রাঃ)-এর পুত্র হাসান (রাঃ)-কে প্রসব করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কানে স্বলাতের আযানের ন্যায় আযান দিয়েছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং ৫১০৫, সুনানে তিরমিযী হাদিস নং ১৫১৪ উক্ত হাদিস সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী বলেন : حديث حسن صحيح অর্থাৎ হাদিসটি হাসান সহীহ, মুসনাদে আহমদ হাদিস নং২৩৮৬৯, মুসনাদে বাযযার হাদিস নং ৩৮৭৯, আল মুজামুল কাবীর লিল তাবরাবনী হাদিস নং ৯৩১, আল সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী হাদিস নং ১৯৩০৩ মুসনাদে আবু দাউদ তিয়ালিসী হাদিস নং ২০১৩, মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক হাদিস নং ৭৯৮৬, উক্ত হাদিসের মান সম্পর্কে মুহাদ্দেসীনদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু সকল হাদিসকে সামনে রেখে আল্লামা আলবানী রহমতুল্লাহ উক্ত হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন।)

যদিও এই বিষয়ে বর্ণিত হাদিসের মান সম্পর্কে মহাদ্দিসীনদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে, এই বিষয়ে বর্ণিত হাদিসের মান নিয়ে মুহাদ্দিসীনদের মধ্যে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও এর প্রতি আমল রয়েছে। মনে রাখা দরকার যে নবজাতকের ডান কানে আযান এবং বাম কানে একামত দেওয়া একটা মুস্তাহাব আমল, কেউ যদি এই আমল না করে কোন অসুবিধা নেই। আযান ও ইকামতের মাধ্যমে মূলত শিশুর অন্তরে তাওহীদের বীজ বপন করা হয়। আর এ কথা জেনে রাখা দরকার যে, এই আযান ইকামত দেওয়ার জন্য কোন পুরুষের দরকার হয় না। যদি সন্তানের মা সুস্থ থাকে তাহলে তিনি দিবেন, না হলে যে সমস্ত মহিলারা ধাত্রী হিসেবে আশেপাশে থাকেন তারা দেবেন এটা তাদের দায়িত্ব।

তাহনিক করা: তাহনিক অর্থাৎ খেজুর চিবিয়ে সেই চর্বিত খেজুর নবজাতকের মুখে দেয়াকে তাহনীক বলে। এই মর্মে হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

وُلِدَ لِىْ غُلاَمٌ فَأَتَيْتُ بِهِ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَمَّاهُ إِبْرَاهِيْمَ فَحَنَّكَهُ بِتَمْرَةٍ وَدَعَا لَهُ بِالْبَرَكَةِ وَرَفَعَهُ إِلَىَّ

আমার একটি শিশু সন্তান জন্মগ্রহণ করলে আমি তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খেদমতে পেশ করলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহীম আর খেজুর দ্বারা তার তাহনীক করলেন এবং তার জন্য বরকতের দো‘আ করে তাকে আমার নিকট ফিরিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৫৪৬৭, সহীহ (মুসলিম : ২১৪৫)

সুন্দর নাম রাখা: মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে নামের মাধ্যমে। দুনিয়ার এ নামেই পরকালে তাকে ডাকা হবে। এবং মানুষের জীবনে নামের প্রভাব পড়ে।

عن أبي الدرداء، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «إنكم تدعون يوم القيامة بأسمائكم، وأسماء آبائكم، فأحسنوا أسماءكم

আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ক্বিয়ামাতের দিন তোমাদেরকে, তোমাদের ও তোমাদের পিতাদের নাম ধরে ডাকা হবে। তাই তোমরা তোমাদের সুন্দর নামকরণ করো। (সুনানে আবু দাউদ হাসীস নং ৪৯৪৮)।
ফলে মাতা-পিতার কর্তব্য হলো তার সন্তানের একটি অর্থবহ ও সুন্দর নাম রাখা। মহানবী (সা.) অর্থবহ নয় এমন অনেক নাম পরিবর্তন করেছেন। যেমন আবদুল ওজ্জা নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন আবদুল্লাহ, আসিয়া নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন জামিলা, বুররা নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘জয়নব’। ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহ.) বলেন, তাঁর পিতা একদা মহানবী (সা.)-এর দরবারে আসেন। রাসুল (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘হাজন’ (শক্ত)। মহানবী (সা.) এ নাম পরিবর্তন করে সাহল (সহজ) রাখতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পিতা আমার যে নাম রেখেছেন তা পরিবর্তন করবো না। মুসাইয়্যিব (রহ.) বলেন, এর পর থেকে আমাদের পরিবারে সদা কঠিন অবস্থা ও পেরেশানি লেগে থাকত (সহিহ বুখারি)। উত্তম হলো আল্লাহর গুণবাচক নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নাম রাখা। যেমন আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান ইত্যাদি। মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় নাম হলো:

আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান।

আকিকা ও সদাকাহ করা : পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে নবজাতক সন্তান লাভের শুকরিয়া হিসেবে আকিকা করা।

عَنْ سَمُرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ الْغُلاَمُ مُرْتَهَنٌ بِعَقِيقَتِهِ يُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ السَّابِعِ وَيُسَمَّى وَيُحْلَقُ رَأْسُهُ ‏"‏ ‏.

হযরত সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সঙ্গে বন্ধক থাকে। সুতরাং তার জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করবে, মাথার চুল মুন্ডন করবে ও নাম রাখবে। (জামে আত তিরমিযী হাসীস নং ১৫২২)

عَنْ أُمِّ كُرْزٍ الْكَعْبِيَّةِ، قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ عَنِ الْغُلاَمِ شَاتَانِ مُكَافِئَتَانِ وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ ‏.

উম্মু কুর্‌য আল-কা’বিয়্যাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, পুত্রের জন্য একই ধরনের দু’টি এবং কন্যার জন্য একটি বকরী ‘আক্বীক্বাহ করতে হয়।

(সুনানে আবু দাউদ হাসীস নং ২৮৩৪ হাদীসের মান সহীহ)
খাতনা করানো: মাতা-পিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো যথাসময়ে পুত্রসন্তানের খাতনার ব্যবস্থা করা। এটি সুন্নতে ইবরাহিমি এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এর অনেক উপকারিতা রয়েছে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ "‏ الْفِطْرَةُ خَمْسٌ الْخِتَانُ، وَالاِسْتِحْدَادُ، وَقَصُّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمُ الأَظْفَارِ، وَنَتْفُ الآبَاطِ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে বলতে শুনেছি- ফিত্‌রাত পাঁচটিঃ খাত্‌না করা, (নাভীর নীচে) ক্ষুর ব্যবহার করা, গোঁফ ছোট করা, নখ কাটা ও বগলের পশম উপড়ে ফেলা। (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং ৫৮৯১)। উল্লেখ্য যে, খাতনা উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদি করার কোনো অনুমতি হাদিসে পাওয়া যায় না।

আদর-স্নেহ ও ভালবাসার সহিত লালন পালন করা: সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত।

عَنْ عَائِشَةَ رضى الله عنها قَالَتْ جَاءَ أَعْرَابِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ تُقَبِّلُونَ الصِّبْيَانَ فَمَا نُقَبِّلُهُمْ‏.‏ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ أَوَ أَمْلِكُ لَكَ أَنْ نَزَعَ اللَّهُ مِنْ قَلْبِكَ الرَّحْمَةَ

আয়িশা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললো। আপনারা শিশুদের চুম্বন করেন? কিন্তু আমরা ওদের চুম্বন করি না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ যদি তোমার হৃদয় হতে দয়া উঠিয়ে নেন, তবে আমি কি তোমার উপর (তা ফিরিয়ে দেওয়ার) অধিকার রাখি? (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং ৫৯৯৮)

পৃথিবীতে অনেক বাবা-মা রয়েছেন যারা তাদের সন্তান সন্তাদি কে আদর স্নেহ ও ভালোবাসার সহিত লালন পালন করেন না, কথায় মারধর করেন, বকা দেন। এটা একেবারে ভুল সন্তান সন্তাদি কে আদর স্নেহ ও ভালোবাসার সহিত লালন পালন করা উচিত। কথায় কথায় ক্রমে ক্রমে তাদেরকে বকা দেওয়া উচিত হবে না। আদরের সময় আদর এবং বকার সময় বকা দিতে হবে। নচিত সন্তান সন্তাদি আদর্শবান হয়ে উঠতে ব্যর্থ হবে।

তাওহীদ ও রিসালতের শিক্ষা দেয়া: শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর একত্ববাদ ও নবীর রিসালত শিক্ষা দিতে হবে। আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, বৃষ্টিতে যে মহান শক্তির হাত তা শুনিয়ে সুকৌশলে তিলে তিলে তার কোমল হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভীতির বীজ বপন করা একান্ত প্রয়োজন।

وَوَصّىٰ بِها إِبرٰهۦمُ بَنيهِ وَيَعقوبُ يٰبَنِىَّ إِنَّ اللَّهَ اصطَفىٰ لَكُمُ الدّينَ فَلا تَموتُنَّ إِلّا وَأَنتُم مُسلِمونَ أَم كُنتُم شُهَداءَ إِذ حَضَرَ يَعقوبَ المَوتُ إِذ قالَ لِبَنيهِ ما تَعبُدونَ مِن بَعدى قالوا نَعبُدُ إِلٰهَكَ وَإِلٰهَ ءابائِكَ إِبرٰهۦمَ وَإِسمٰعيلَ وَإِسحٰقَ إِلٰهًا وٰحِدًا وَنَحنُ لَهُ مُسلِمونَ

এরই ওসিয়ত করেছে ইব্রাহীম তার সন্তানদের এবং ইয়াকুবও যে, হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনও মৃত্যুবরণ করো না। তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন সে সন্তানদের বলল, আমার পর তোমরা কার এবাদত করবে? তারা বললো, আমরা তোমার পিতৃ-পুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের এবাদত করব। তিনি একক উপাস্য। (সুরা আল বাকারাহ আয়াত নং ১৩২-১৩৩)

আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে কী বলে? ছেলে নবী জানার পরও কি তাকে তাওহীদের শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন আছে? অথচ, তাঁরা তাদের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও ছেলেদেরকে তাওহীদের উপর অটল থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ তাঁরা জানতেন, আখেরাতের জীবনই আসল জীবন এবং একমাত্র তাওহীদের পথই হচ্ছে সফলকামদের একমাত্র পথ। সন্তান যতই বড় হোক আর যতই ভালো হোক, খেয়াল রাখতে হবে সে যেন পথভ্রষ্ট না হয়। যদি সে পথভ্রষ্ট হয় তাহলে তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি মারা যান বা সে মারা যায়।

হযরত লোকমান হাকিম সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন যে, তিনি নিজস্ব সন্তান সন্তাদিকে আল্লাহর একত্ববাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই মর্মে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

وَإِذ قالَ لُقمٰنُ لِابنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يٰبُنَىَّ لا تُشرِك بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّركَ لَظُلمٌ عَظيمٌ

লোকমান হাকিমের কথা স্মরণ কর, লোকমান হাকিম উপদেশ আকারে তার পুত্রকে বলল, হে আমার স্নেহের পুত্র! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। (সুরা লুকমান আয়াত নং ১৩)
কুরআনুল কারীম শিক্ষা দেয়া: মাতা-পিতার প্রধান দায়িত্ব হলো স্বীয় সন্তানকে শিক্ষায় শিক্ষিত করা। ইসলাম ধর্মে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা ব্যাতিত কোন মানুষ সৃষ্টিকর্তা কে সঠিক আকারে চিনতে পারে না। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

إِنَّما يَخشَى اللَّهَ مِن عِبادِهِ العُلَماء

আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। (সুরা ফাতির আয়াত নং ২৮(

ইসলাম ধর্মে প্রথম ওহী অবতীর্ণ হয় শিক্ষা সম্পর্কে, আল্লাহ বলেন:

اقرَأ بِاسمِ رَبِّكَ الَّذى خَلَق، خَلَقَ الإِنسٰنَ مِن عَلَق اقرَأ وَرَبُّكَ الأَكرَمُ الَّذى عَلَّمَ بِالقَلَمِ عَلَّمَ الإِنسٰنَ ما لَم يَعلَم

পড় পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে, পড়ো আপনার পালনকর্তা মহান দয়ালুর নামে, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা মানুষ জানত না। (সুরা আলাক আয়াত নং ১-৫)

সূরা আলাকের ১ থেকে ৫ নম্বর আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শিক্ষার প্রতি গুরুত্বের সাথে সাথে মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তার (তৌহিদের) দিকে আহবান করেছেন। এখানে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে ওই শিক্ষাকেই সঠিক অর্থে শিক্ষা বলা হয়, যে শিক্ষা মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে অবগত করে দেয়। পবিত্র আল কুরআনের শিক্ষা ছাড়া এখানে আর কোন শিক্ষা এই অবস্থান নিতে পারে? তাই একজন পিতা-মাতার প্রধান দায়িত্ব হলো স্বীয় সন্তানকে পবিত্র আল কোরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। এটি হচ্ছে পিতা-মাতার প্রতি সন্তান সন্তাদির অধিকার।

শিষ্টাচার শিক্ষা দান : সন্তানকে নম্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া মাতা-পিতার প্রধান দায়িত্ব। শৈশবেই শিশুকে আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া আবশ্যক, যেন শিশু প্রশংসনীয় ও সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হয়ে গড়ে উঠতে পারে। মহানবী (সা.) বলেছেন

مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدًا مِنْ نَحْلٍ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ ‏(المستدرك للحاكم:7888 صحيح الإسناد،الجامع الصغير للسيوطي: 8099 صحيح)

কোন পিতা তার সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে বেশী উত্তম কোন জিনিস দিতে পারে না।(আল মুস্তাদরক লিল হাকিম হাদিস নং ৭৮৮৮ হাদিসের মান: সহীহুল ইসনাদ, আল জামে উস্ সাগীর লিল সুউতী হাদিস নং ৮০৯৯, হাদিসের মান: সহীহ)

ইবাদতে অভ্যস্ত করা: মাতা-পিতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বলাত, সিয়াম, তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ইত্যাদি ইবাদতে অভ্যস্ত করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:

وَأمُر أَهلَكَ بِالصَّلوٰةِ وَاصطَبِر عَلَيها

আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাযের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন।(সুরা ত্বহা আয়াত নং ১৩২)

عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ ( سنن أبي داؤد: 495)

আমর ইবনু শু‘আইব (রহঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছর হয়, তখন নামাজ পড়ার তাগিদ দাও এবং যখন ১০ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন নামাজ পড়ার জন্য শাসন করো। আর তখন তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। (সুনানে আবু দাউদ হাসীস নং ৪৯৫, হাদীসের মান হাসান সহীহ)

হারাম খাদ্য থেকে দুরে রাখা: সন্তান লালন-পালনে জরুরী বিষয় হলো সন্তানকে হারাম খাবার হতে দূরে রাখা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:


يٰأَيُّهَا الَّذينَ ءامَنوا كُلوا مِن طَيِّبٰتِ ما رَزَقنٰكُم وَاشكُروا لِلَّهِ إِن كُنتُم إِيّاهُ تَعبُدونَ

হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। (সুরা আল বাকারাহ আয়াত নং ১৭২)

عن أَبَي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ أَخَذَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ ـ رضى الله عنهما ـ تَمْرَةً مِنْ تَمْرِ الصَّدَقَةِ، فَجَعَلَهَا فِي فِيهِ، فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ كِخٍ كِخٍ ـ لِيَطْرَحَهَا ثُمَّ قَالَ ـ أَمَا شَعَرْتَ أَنَّا لاَ نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ ‏‏.‏

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, হাসান ইব্‌নু ‘আলী (রাঃ) সদকার একটি খেজুর নিয়ে মুখে দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ফেলে দেয়ার জন্য ওয়াক ওয়াক (বমির পূর্বের আওয়াজের মত) বললেন। অতঃপর বললেন, তুমি কি জান না যে, আমরা সদকা ভক্ষণ করি না। (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং ১৪৯১)।

সক্ষম করে তোলা: সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ، عَنْ أَبِيهِ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَعُودُنِي عَامَ حَجَّةِ الْوَدَاعِ مِنْ وَجَعٍ اشْتَدَّ بِي فَقُلْتُ إِنِّي قَدْ بَلَغَ بِي مِنَ الْوَجَعِ وَأَنَا ذُو مَالٍ، وَلاَ يَرِثُنِي إِلاَّ ابْنَةٌ، أَفَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثَىْ مَالِي قَالَ ‏"‏ لاَ ‏"‏‏.‏ فَقُلْتُ بِالشَّطْرِ فَقَالَ ‏"‏ لاَ ‏"‏ ثُمَّ قَالَ ‏"‏ الثُّلُثُ وَالثُّلْثُ كَبِيرٌ ـ أَوْ كَثِيرٌ ـ إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ.... (صحيح البخاري: 1295)

সা‘দ ইব্‌নু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, বিদায় হাজ্জে একটি কঠিন রোগে আমি আক্রান্ত হলে, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য আসতেন। একদা আমি তাঁর কাছে নিবেদন করলাম, আমার রোগ চরমে পৌঁছেছে আর আমি সম্পদশালী। একমাত্র কন্যা ছাড়া কেউ আমার উত্তরাধিকারী নেই। তবে আমি কি আমার সম্পদের দু’ তৃতীয়াংশ সদকা করতে পারি? তিনি বললেন, না। আমি আবার নিবেদন করলাম, তাহলে অর্ধেক। তিনি বললেন, না। অতঃপর তিনি বললেন, এক তৃতীয়াংশ আর এক তৃতীয়াংশও বিরাট পরিমাণ অথবা অধিক। তোমরা ওয়ারিসদের অভাবমুক্ত রেখে যাওয়া, তাদের খালি হাতে পরমুখাপেক্ষী অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং ১২৯৫)

প্রাপ্ত বয়স হলে সন্তান-সন্তাদির বিবাহ দেওয়া।

সন্তানের প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হলে পিতা-মাতার দায়িত্ব তার বিবাহ দেয়া:

عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَهُ ‏ "‏ يَا عَلِيُّ ثَلاَثٌ لاَ تُؤَخِّرْهَا الصَّلاَةُ إِذَا آنَتْ وَالْجَنَازَةُ إِذَا حَضَرَتْ وَالأَيِّمُ إِذَا وَجَدْتَ لَهَا كُفْؤًا ‏"‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَمَا أَرَى إِسْنَادَهُ بِمُتَّصِلٍ ‏.‏

আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেনঃ হে আলী! তিনটি কাজে দেরি করবে না। নামায- যখন ওয়াক্ত হয়ে যায়; জানাযা- যখন উপস্থিত হয় এবং ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে- যখন তার যোগ্য পাত্র পাওয়া যায়। (জামে' আত-তিরমিজি হাদিস নং ১০৭৫ আবূ ঈসা আত-তিরমিজি বলেন, এ হাদীসটি গারীব। আমরা এর সনদ পরস্পর সংযুক্ত আছে বলে মনে করি না। হাদিসের মান: দুর্বল হাদিস)

সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা : সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা পিতা-মাতার দায়িত্ব।

عَنْ عَامِرٍ، قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ ـ رضى الله عنهما ـ وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُولُ أَعْطَانِي أَبِي عَطِيَّةً، فَقَالَتْ عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ لاَ أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم‏.‏ فَأَتَى رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنِّي أَعْطَيْتُ ابْنِي مِنْ عَمْرَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ عَطِيَّةً، فَأَمَرَتْنِي أَنْ أُشْهِدَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ‏.‏ قَالَ ‏"‏ أَعْطَيْتَ سَائِرَ وَلَدِكَ مِثْلَ هَذَا ‏"‏‏.‏ قَالَ لاَ‏.‏ قَالَ ‏"‏ فَاتَّقُوا اللَّهَ، وَاعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلاَدِكُمْ ‏"‏‏.‏ قَالَ فَرَجَعَ فَرَدَّ عَطِيَّتَهُ‏.‏

আমির (রহঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) -কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আম্‌রা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত সম্মত নই। তখন তিনি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আম্‌রা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন: না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। [নু‘মান (রাঃ)] বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। (সহিহ আল বুখারী, হাদিস নং ২৫৮৭)

অবশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করি, হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে তৌফিক দাও আমরা যেন সঠিক আকারে সন্তানদের হক আদায় করতে পারি। আমাদেরকে নেক ও আদর্শবান সন্তান দান করো। আমাদের জন্য আমাদের সন্তানদেরকে ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানে সুখ-শান্তি ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের মাধ্যম বানিয়ে দাও। আমীন।
 
Similar threads Most view View more
Back
Top