রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসায় সাহাবায়ে কেরামের অনন্য দৃষ্টান্ত
(১) হিজরতের সময়কার ঘটনা : মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের প্রাক্কালে আবুবকর (রাঃ) সঙ্গী হওয়ার আবেদন করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘ব্যস্ত হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ তোমার সঙ্গী জুটিয়ে দিবেন’।[1] অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতিপ্রাপ্ত হ’লে রাসূল (ﷺ) বিষয়টি আবুবকর (রাঃ)-কে জানান। তখন খুশীতে বাগবাগ হয়ে আবুবকর জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আপনার সঙ্গী হ’তে পারব? তিনি বললেন, হ্যাঁ’। রাবী আয়েশা (রাঃ) বলেন,
‘আল্লাহর কসম! ঐ দিনের পূর্বে আমি জানতামই না যে, আনন্দের আতিশয্যে কেউ কাঁদতে পারে। কারণ আমি আবুবকর (রাঃ)-কে সেদিন কান্নারত দেখেছি’।[2]
(২) আল্লাহর পথে ব্যয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত : আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) হিজরত করে মদীনায় এসে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরীর নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন,
‘হে বনু নাজ্জার! তোমরা প্রাচীরবেষ্টিত এই বাগানটির মূল্য নির্ধারণ করে আমার কাছে সেটি বিক্রয় কর’। তারা বলল, আল্লাহর কসম! না। আমরা একমাত্র আল্লাহর কাছেই এর বিনিময় কামনা করি। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) ১০ হাযার দীনারে সেটি ক্রয় করেন এবং আবুবকর (রাঃ) তার মূল্য পরিশোধ করেন।[3] রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তোমাদের বলছি, সেখানে মুশরিকদের কবর এবং পুরাতন ধ্বংসস্তূপ ছিল। আর ছিল খেজুরের গাছ। নবী করীম (ﷺ)-এর নির্দেশে মুশরিকদের কবরগুলো খুড়ে হাড়গোড় অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হ’ল। তারপর ভগ্নাবশেষ সমতল করা হ’ল। কর্তিত খেজুর গাছের কান্ডগুলো মসজিদের সামনে সারিবদ্ধভাবে পুতে দেওয়া হ’ল এবং কিছু পাথর দুই পাশে দিয়ে দরজার চৌকাঠ নির্মাণ করা হ’ল। তখন সাহাবীগণ পাথরগুলি স্থানান্তরের সময় ছন্দোবদ্ধভাবে কবিতা আবৃত্তি করছিলেন এবং নবী করীম (ﷺ)ও তাঁদের সাথে সুর মিলিয়ে বলছিলেন,
‘হে আল্লাহ! আখেরাতের কল্যাণ ব্যতীত প্রকৃতপক্ষে কোনই কল্যাণ নেই। অতএব আপনি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দিন’।[4]
(৩) বদর যুদ্ধপূর্ব ভালবাসার ঐতিহাসিক ঘটনা : সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ﷺ)-কে প্রাণাধিক ভালবাসতেন। তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাসূল (ﷺ)-কে ভালবেসে তাঁদের জান-মাল রাহে লিল্লাহ কুরবানী করেছিলেন। যেমন-
(ক) সা‘দ বিন মু‘আয আনছারী (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-কে বললেন, আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনাকে বিশ্বাস করেছি এবং আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা অবশ্যই সত্য। আমরা আপনার সাথে দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যে, আমরা আপনার কথা শুনব ও আনুগত্য করব। হে আল্লাহর রাসূল! এই যে আমাদের ধন-সম্পদ আপনার সামনে উপস্থাপন করলাম। আপনি ইচ্ছামত নিন অথবা রেখে দিন। আর আপনি রেখে দেওয়ার চাইতে গ্রহণ করাটাই আমাদের নিকট অধিকতর প্রিয়। হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)!, আপনি যেভাবে চান যুদ্ধে এগিয়ে যান, আমরা আপনার সাথে আছি। অতঃপর তিনি বলেন,
‘অতএব সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে টেনে সমুদ্রে নিয়ে যান, তবে আমাদের মধ্যে একজন ব্যক্তিও পিছনে পড়বে না’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) বললেন, ...বরং আমরা আপনার ডানে-বামে ও সম্মুখে-পিছনে সর্বদিক থেকে যুদ্ধ করব’। রাবী বলেন,
‘অতঃপর আমি দেখলাম, নবী করীম (ﷺ)-এর মুখমন্ডল হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তিনি খুবই আনন্দিত হ’লেন’ (বুখারী হা/৩৯৫২)।
(খ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদরের ময়দানে সাহাবায়ে কেরামকে সারিবদ্ধ করছিলেন এবং তাঁর হাতে একটি তীর ছিল। যখন তিনি সাওয়াদ বিন গাযিইয়া আনছারীর নিকটবর্তী হ’লেন, তখন তিনি তাকে কাতার থেকে অগ্রবর্তী দেখতে পেয়ে বললেন,اِسْتَوِ يَا سَوَادُ! ‘সোজা হয়ে দাঁড়াও হে সাওয়াদ! তখন সাওয়াদ (রাঃ) বললেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি আমাকে কষ্টে নিপতিত করেছেন। আর আল্লাহ আপনাকে সত্য ও ন্যাপরায়ণতার সাথে প্রেরণ করেছেন। অতএব আপনি আমাকে বদলা নিতে দিন’। তখন রাসূল (ﷺ) পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললেন, اِسْتَقِدْ، ‘তুমি বদলা নাও’। অতঃপর সাওয়াদ রাসূল (ﷺ)-এর সাথে কোলাকুলি করলেন এবং তাঁর পেটে চুমু দিলেন। রাসূল (ﷺ) বললেন,
‘তোমার হ’ল কি হে সাওয়াদ?’ তিনি বললেন,
‘যা হয়েছে আপনি তো দেখতেই পেলেন। আর আমি ইচ্ছা পোষণ করলাম যে, আমার জীবনের শেষ সময়টা যেন আপনার সাথেই অতিবাহিত হয়। তাই আমি আপনার চামড়ার সাথে আমার চামড়া মিলিত করলাম’। তখন রাসূল (ﷺ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন।[6]
অতঃপর সাওয়াদ বিন গাযিয়া (রাঃ) বদর যুদ্ধে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন।[7]
(৪) আমার বক্ষ আপনার জন্য ঢাল স্বরূপ : আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন বিপর্যয়ের পর কয়েকজন সাহাবী নবী করীম (ﷺ)-কে শত্রুদের হামলা থেকে আড়াল করে রেখেছিল। আবু ত্বালহা (রাঃ) ঢাল হাতে নিয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে প্রাচীরের সদৃশ দৃঢ় হয়ে দাঁড়ালেন। আর আবু ত্বালহা (রাঃ) ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দায। যুদ্ধ চলাকালীন মুশরিকদের হামলা করে তিনি দুই বা তিনটি ধনুক ভেঙ্গে ফেলেন। রাবী বলেন, যখন কোন ব্যক্তি তীর নিয়ে অতিক্রম করত, তখনই রাসূল (ﷺ) বলতেন, এগুলি আবু ত্বালহার জন্য রেখে যাও। আর যখন নবী করীম (ﷺ) মাথা উঁচু করে শত্রুদের অবস্থা দেখতেন, তখন আবু ত্বালহা (রাঃ) বলতেন,
‘হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হৌক! আপনি মাথা উঠাবেন না। কেননা এতে শত্রুপক্ষের তীর এসে আপনার গায়ে বিদ্ধ হ’তে পারে। তবে আপনাকে রক্ষা করার জন্য আমার বক্ষই আপনার জন্য ঢাল স্বরূপ’।[8]
(৫) তীরের আঘাতেও অনড় : ওহোদের দিন আবু দুজানা (রাঃ) আল্লাহর রাসূলের পিঠ রক্ষা করেন। শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত তীরগুলো তাঁর শরীরে বিঁধতে লাগল অথচ তিনি সামান্যতম নড়াচড়াও করেননি। যুবায়ের বিন ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন নবী করীম (ﷺ)-এর দেহে দু’টি লৌহবর্ম ছিল। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিনি একটি বড় পাথরের উপর উঠতে চাইলেন, কিন্তু তিনি সক্ষম হ’লেন না। অতঃপর ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) নীচে বসে গেলেন। তাঁর কাঁধে চড়ে রাসূল (ﷺ) পাহাড়ের উপর উঠে গেলেন। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, أَوْجَبَ طَلْحَةُ- ‘ত্বালহা জান্নাত আবশ্যক করে নিল’।[9]
(৬) আমার সমস্ত বিপদ হালকা হয়ে গেল! সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু দীনার গোত্রের জনৈকা মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যার স্বামী, ভাই ও পিতা রাসূল (ﷺ)-এর সাথে ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইতিমধ্যেই শহীদ হয়েছেন। স্বজনদের মৃত্যু সংবাদ জানানো হ’লে এই মহিলা বললেন,
‘রাসূল (ﷺ)-এর কি অবস্থা?’ তারা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভাল আছেন। মহিলা বললেন, আমাকে দেখতে দাও। রাসূল (ﷺ)-এর দিকে ইশারা করা হ’লে মহিলা তাঁকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনাকে দেখে আমার সমস্ত বিপদ হালকা হয়ে গেল’।[10]
(৭) মৃত্যুর পূর্বেখুবায়েব ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা : চতুর্থ হিজরীতে প্রখ্যাত সাহাবী খুবায়েব বিন ‘আদীকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার পূর্বে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান বলল,
‘তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি জীবিত থাক?’ জবাবে তিনি বলেন,
‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমার পরিবর্তে তাঁর পায়ে একটি কাঁটাও বিদ্ধ হোক, এটা আমি পসন্দ করি না’।[11]
সুবহানাল্লাহ! এত বড় পরীক্ষার পরেও সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের জীবনের চাইতেও রাসূল (ﷺ)-কে অনেক বেশী ভালবেসেছিলেন।
(৮) হোদায়বিয়া সন্ধির সময় : উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সাহাবীগণের আচরণ সচক্ষে দেখেছিলেন। অতঃপর উরওয়া তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, হে আমার গোত্র, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা-বাদশাহর নিকটে কুরায়েশদের প্রতিনিধিত্ব করেছি। রোম সম্রাট ক্বায়ছার, পারস্য সম্রাট কিসরা ও আবিসিনিয়া সম্রাট নাজাশীর নিকটে আমি দূত হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু ‘আল্লাহর কসম করে বলছি, কোন রাজা-বাদশাহকেই তার অনুসারীরা এত বেশী সম্মান করে না, যেমন মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাঁকে সম্মান করে থাকে। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যদি থুথু ফেলেন, যা কোন সাহাবীর হাতে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের গায়ে-মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা সাথে সাথে তা পালন করেন। তিনি ওযূ করলে তাঁর ওযূর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তিনি কথা বললে সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এমনকি সম্মানার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না’।[12]
(৯) সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভালবাসা : আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
...‘যখন আল্লাহ আমার অন্তরে ইসলাম গ্রহণের প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট আসলাম। ...‘এক পর্যায়ে আমার অন্তরে লোকদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় আর কেউ ছিল না। আমার দৃষ্টিতে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ-ই এত শ্রদ্ধাভাজন নন। সীমাহীন সম্মান ও ভালবাসার কারণে আমি তাঁর দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারতাম না। যদি আমাকে তাঁর দৈহিক অবয়বের বর্ণনা দিতে বলা হয়, তবে আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ আমি কখনোই তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। আর ঐ অবস্থায় আমার মৃত্যু হ’লে আমি অবশ্যই আশাবাদী জান্নাতী হ’তাম’।[13]
(১০) নবীজীর সন্নিকটে : আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘আমি নাপিতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চুল ছাঁটতে দেখেছি এমতাবস্থায় যে, সাহাবীগণ তার সন্নিকটে চারপাশ ঘিরে রেখেছেন। তারা এই কামনা করতেন যে, তাদের যেকোন একজনের হাতে যেন চুল পড়ে’।[14]
(১১) আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই : রাবী‘আ বিন কা‘ব আসলামী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে কখনো রাত্রিযাপন করতাম। একদা তাঁর ওযূ ও ইস্তেঞ্জার পানি উপস্থিত করলাম। তিনি আমাকে বললেন,
‘কিছু চাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। রাসূল (ﷺ) বললেন, এছাড়া অন্য কিছু চাও। আমি বললাম, এটাই চাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তাহ’লে বেশী বেশী সিজদা করে আমাকে এ বিষয়ে সাহায্য কর’।[15]
(১২) মুশরিকদের আক্রমণ থেকে রাসূল (ﷺ)-কে নিরাপদ রাখা : আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সপ্তম হিজরীতে ওমরাতুল ক্বাযা সম্পন্ন করলেন, আমরাও তাঁর সাথে ওমরা করলাম। তিনি মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ করলেন, আমরাও তাঁর সাথে ত্বাওয়াফ করলাম। এরপর তিনি ছাফা ও মারওয়ায় সাঈ করলেন, আমরাও তাঁর সাথে সাঈ করলাম। আর আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মক্কার মুশরিকদের আক্রমণ থেকে সুদৃঢ় প্রাচীরের ন্যায় নিরাপদে রাখছিলাম। যেন তাঁর প্রতি কেউ কোন কিছু নিক্ষেপ করতে না পারে’।[16] উপরোল্লিখিত আলোচনায় স্পষ্ট যে, বিপদের সময় রাসূল (ﷺ)-কে নিরাপদে রাখার জন্য সাহাবায়ে কেরাম সর্বোচ্চ ভালবাসার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন।
(১৩) আল্লাহর রাসূলকে পেয়ে সন্তুষ্ট হ’লাম : আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আছেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, অষ্টম হিজরীতে হুনায়নের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহ বিপুল গণীমত প্রদান করলেন। তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সেগুলি বণ্টন করে দিলেন এবং আনছারগণকে কিছুই দিলেন না। ফলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হ’লেন। অতঃপর তিনি আনছারদেরকে সম্বোধন করে বললেন,
‘হে আনছারগণ! আমি কি তোমাদেরকে ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত পাইনি? অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছেন। তোমরা ছিলে শতধাবিভক্ত, অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের অন্তরগুলিকে পারস্পরিক ভালবাসার মেলবন্ধনে একত্রিত করে দিয়েছেন। তোমরা ছিলে অভাবী, অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের অভাবমুক্ত করেছেন। এভাবে তিনি যখনই কোন অনুগ্রহের কথা বলেন, জবাবে আনছারগণ বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক অনুগ্রহকারী!
অতঃপর রাসূল (ﷺ) বলেন, ...তোমরা কি সন্তুষ্ট নও যে, লোকেরা বকরী ও উট নিয়ে যাবে, আর তোমরা আল্লাহর নবীকে তোমাদের সাথে নিয়ে বাড়ী ফিরবে? যদি হিজরত না হ’ত, তবে আমি আনছারদের সাথেই থাকতাম। আর যদি লোকেরা কোন উপত্যকা ও গিরিপথে চলে, তবে আমি অবশ্যই আনছারদের যাতায়াতের উপত্যকা ও গিরিপথেই চলব। কেননা নৈকট্য বিবেচনায় আনছারদের মর্যাদা সর্বাধিক এবং অন্য লোকজন তাদেরই অনুগামী। সত্বর আমার পর তোমরা অন্যদের অগ্রাধিকার দেখতে পাবে। তখন তোমরা ধৈর্যধারণ করবে। আর এভাবে তোমরা হাউযে কাওছারে আমার সাথে সাক্ষাৎ লাভ করবে’।[17]
অতঃপর আনছারগণ অঝোরে কান্না করতে লাগল, যাতে তাদের দাড়িগুলি সিক্ত হয়ে গেল এবং তারা বলতে লাগল,
‘আমরা সন্তুষ্ট হ’লাম বণ্টনে পরিপূর্ণ অংশ হিসাবে আল্লাহর রাসূলকে পেয়ে’।[18] কবি বলেন,
‘তিনি আমার নিকট নিজের চাইতে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রাপ্ত; আমার পরিবার, প্রিয়জন এবং বন্ধুদের চাইতেও’।
(১৪) আমাদের পিতা-মাতাকে উৎসর্গ করলাম! : আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরে বসে বললেন,
‘আল্লাহ তাঁর বান্দাকে দু’টি বিষয়ের যেকোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, দুনিয়ার ভোগ-বিলাস অথবা আল্লাহর নিকট যা সংরক্ষিত রয়েছে (জান্নাত)। তখন সে বান্দা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তাই পসন্দ করল। একথা শুনে আবুবকর (রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম! রাবী বলেন, তাঁর এই আবেগাপ্লুত অবস্থা দেখে আমরা বিস্মিত হ’লাম। লোকেরা বলতে লাগল যে, এ বৃদ্ধ লোকের আবেগ দেখ। রাসূল (ﷺ) এক ব্যক্তি সম্পর্কে সংবাদ দিলেন যে, তাকে আল্লাহ পার্থিব ভোগ-বিলাস অথবা আল্লাহর নিকট যা সংরক্ষিত রয়েছে, এ দু’য়ের মধ্যে যেকোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দিলেন। আর এই বৃদ্ধ লোকটি বলছে, আপনার জন্য আমাদের পিতা-মাতাকে উৎসর্গ করলাম’।
বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ই হ’লেন সেই ইখতিয়ার প্রাপ্ত ব্যক্তি। আর আমাদের মধ্যে আবুবকর (রাঃ)-ই হ’লেন সবচাইতে বিচক্ষণ ব্যক্তি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘নিশ্চয়ই যিনি তার সাহচর্য ও ধন-সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক সাহায্য করেছেন, তিনি হ’লেন আবুবকর। আমি যদি আমার উম্মতের মধ্যে কোন ব্যক্তিকে খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে অবশ্যই আবুবকরকে গ্রহণ করতাম। তবে তার সাথে আমার ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অতএব মসজিদের দিকে আবুবকরের দরজা ছাড়া অন্য কারু দরজা যেন বাকী না থাকে’।[19]
(১৫) রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসায় সাহাবীগণের প্রতিযোগিতা :
উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আলী, জা‘ফর ও যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ) একত্রিত হ’লেন। তখন জা‘ফর (রাঃ) বললেন, আমি তোমাদের চাইতে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট অধিক প্রিয়। তখন আলী ও যায়েদ (রাঃ) একই দাবী করলেন। অতঃপর তারা বললেন, চলো! আমরা রাসূল (ﷺ)-এর নিকটে যাই। সেখানে গিয়ে বাড়ী প্রবেশের অনুমতি চাইলে রাসূল (ﷺ) তাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট সর্বাধিক প্রিয় কে? তিনি বললেন, ফাতেমা। তারা বললেন, পুরুষদের মধ্যে? তখন রাসূল (ﷺ) বললেন,
‘হে জা‘ফর! তোমার শারীরিক গঠন আমার ন্যায় এবং আমার শারীরিক গঠন তোমার ন্যায়। তুমি আমার মূল বংশধর। অতঃপর হে আলী! তুমি আমার কন্যা ফতেমার জামাতা এবং আমার চাচাতো ভাই। তুমি আমার বংশধর এবং আমিও তোমার বংশধর। অতঃপর হে যায়েদ! তুমি তো আমারই অতি প্রিয়ভাজন মুক্তদাস এবং মানুষের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি’।[20]
উল্লেখিত হাদীসে রাসূল (ﷺ)-এর ভালবাসা অর্জনে সাহাবীগণের প্রতিযোগিতা ও আন্তরিকতার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। তাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর রাসূলের ভালবাসায় পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আত্মনিয়োগ করেছেন এবং তাঁর ভালবাসা অর্জন করতেও সদা উদগ্রীব ছিলেন।
(১৬) আগামীকাল প্রিয়তম রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করব : বেলাল বিন রাবাহ (রাঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বে যন্ত্রণায় ছটফট করলে তাঁর স্ত্রী শোকে মূহ্যমান হয়ে বললেন, হায় আফসোস! কি যন্ত্রণা! অতঃপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে স্বীয় স্ত্রীকে এমন এক কথা বললেন, যাতে মৃত্যু যন্ত্রণার সাথে মাধুর্যও মিশানো ছিল। কেননা মৃত্যু হয়ে গেলেই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের রাস্তা খোলাছা হয়ে যাবে। তিনি বললেন, غَدًا نَلْقَى الْأَحِبَّة مُحَمَّدًا وَصَحْبَه- ‘এইতো আমাগীকালই প্রিয়তম রাসূল (ﷺ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করব’।[21]
(১৭) তৃষ্ণায় শীতল পানীয়ের চাইতেও রাসূল (ﷺ) অধিক প্রিয় : আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, রাসূল (ﷺ)-কে আপনারা কেমন ভালবাসতেন? জবাবে তিনি বলেন,
‘আল্লাহর কসম! তিনি আমাদের নিকট আমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতৃ ও মাতৃকুল এবং প্রচন্ড তৃষ্ণার সময় ঠান্ডা পানি যেমন প্রিয়, তার চাইতেও রাসূল (ﷺ) অধিক প্রিয় ছিলেন’।[22]
(১৮) অনুকরণের অনন্য দৃষ্টান্ত : নাফে‘ বলেন,
‘আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবেসে তাঁর পদচিহ্ন অনুকরণ করতেন। রাসূল (ﷺ) যেসব অবতরণস্থলে নামতেন, তিনিও সেখানে নামতেন। একদা রাসূল (ﷺ) একটি বাবলা গাছের নীচে নেমেছিলেন। আর তাই ইবনু ওমর (রাঃ) পানি এনে ঐ বাবলা গাছে দিতেন। যেন গাছটি শুকিয়ে না যায়’।[23] আর এই কাজগুলি তিনি রাসূল (ﷺ)-কে ভালবেসে করেছিলেন। বিশেষ কোন নিয়ত বা বরকতের জন্য নয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবাসার ফলাফল
রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসার বৃহৎ ও মহান ফলাফল রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল-
(১) ঈমানী যিন্দেগী প্রাপ্তি : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান প্রতিটি মানুষকে কুফরীর আবিলতা থেকে মুক্ত করে ঈমানী যিন্দেগী প্রদান করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দাও। যখন তিনি তোমাদের আহবান করেন ঐ বিষয়ের দিকে, যা তোমাদেরকে জীবন দান করে’ (আনফাল ৮/২৪)।
(২) আল্লাহর ভালবাসা অর্জন ও পাপ মোচন : যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবেসে যথাযথভাবে তাঁর অনুসরণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে ভালবাসবেন এবং তার সমস্ত পাপ মোচন করে দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহ সমূহ মাফ করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসার কি মহা প্রতিদান! তাতে আল্লাহর ভালবাসা অর্জন, সেই সাথে জীবনের পাপ মোচনের মত বড় সৌভাগ্য অর্জিত হ’লে মুমিন জীবনে অন্য তেমন কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না।
অতএব মুমিনগণের কর্তব্য হবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বোচ্চ ভালবাসা। সেই সাথে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা ও রাসূলের সুন্নাতের বিপরীতে বিদ‘আত করা থেকে সর্বদা দূরে থাকা।
(৩) ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ অর্জন : হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেন,
‘তিনটি গুণ যার মধ্যে রয়েছে, সে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ পেয়েছে। (ক) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যার নিকট সকল কিছুর চাইতে প্রিয়তম। (খ) যে ব্যক্তি কাউকে ভালবাসে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই এবং (গ) আল্লাহ যাকে কুফরী থেকে মুক্তি দিয়েছেন, অতঃপর সে পুনরায় কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে অপসন্দ করে, যেমন সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে’।[24] এর অর্থ হ’ল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ অর্জিত হয়। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হয়। বিশেষ করে রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ-নিষেধ পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ অর্জিত হয়’ (ফাৎহুল বারী; মিরক্বাত)।
(৪) সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ : মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কয়েকটি বিশেষ গুণ উল্লেখের পর রাসূল (ﷺ)-এর উপর ঈমান আনয়নকারীদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
‘অতএব যারা তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাকে শত্রু থেকে প্রতিরোধ করেছে ও সাহায্য করেছে এবং সেই জ্যোতির (কুরআনের) অনুসরণ করেছে যা তার সাথে নাযিল হয়েছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)।
(৫) জান্নাতে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে থাকার সৌভাগ্য :
(ক) আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,
‘হে আল্লাহর রাসূল! ক্বিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?’ তিনি বললেন,
‘আফসোস! তুমি এর জন্য কি প্রস্ত্ততি নিয়েছ?’ সে বলল,
‘আমি সেজন্য তেমন কোন প্রস্ত্ততি নেইনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনেক ভালবাসি’। তিনি বললেন,
‘তুমি তার সাথেই থাকবে, যাকে তুমি ভালবাস’। রাবী বলেন, তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের জন্যও কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ’। আনাস (রাঃ) বলেন,
‘এতে ইসলাম গ্রহণের পর থেকে সেদিন মুসলিমগণ যত বেশী আনন্দিত হয়েছে, আর কোন দিন আমি তাদেরকে এত বেশী আনন্দিত হ’তে দেখিনি’।[25]
(খ) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করল যে,
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার মতামত কি? যে ব্যক্তি কোন একটি দলকে ভালোবাসে, কিন্তু সে তাদের সমকক্ষ নয়। তখন তিনি বলেন,
‘যার সাথে যার মহববত, তার সাথে তার ক্বিয়ামত’।[26]
(গ) আনাস (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে সর্বাধিক ভালবাসি।
‘অতএব আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, জান্নাতে তাঁদের সাথেই আমি থাকব। যদিও আমলে আমি তাঁদের সমকক্ষ নই’।[27]
(ঘ) রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য ও ভালবাসার ফলাফল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’ল সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।
(ঙ) রাসূল (ﷺ)-এর মুক্তদাস ছাওবান (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-কে অত্যধিক ভালবাসতেন। তাঁকে না দেখতে পেলে অস্থির হয়ে যেতেন। একদা তিনি রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসলেন, যখন তার রঙ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ ফুটে উঠেছিল। তখন রাসূল (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘হে ছাওবান! কে তোমাকে বিবর্ণ করে দিল?’ জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমার কোন ব্যথা-বেদনা বা অসুখ-বিসুখ নেই। আমি যদি আপনাকে না দেখি, তবে আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত আমি খুবই একাকিত্ব বোধ করি। অতঃপর আমি পরকালের কথা স্মরণ করি এবং আশঙ্কা করি যে, আমি আপনাকে জান্নাতে দেখতে পাব না। কারণ আপনি তো নবীদের সাথে থাকবেন। কিন্তু আমি যদি জান্নাতে প্রবেশ করি বা আপনার থেকে নিম্নস্তরে থাকি অথবা আমি যদি জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারি, তবে তো আমি কখনোই আপনাকে দেখতে পাব না। অতঃপর উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়।[28]
উপসংহার : ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দার ও রাসূল’।[29] এই হাদীসের আলোকে আমাদের উচিত রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনে যথাযথভাবে তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁকে ভালবাসা এবং ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান সহীহ হাদীস অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করা। তাহ’লে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ লাভ, আল্লাহর ভালবাসা অর্জন, জান্নাতে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে থাকার মহা সৌভাগ্য অর্জন, হাওযে কাওছারের পানি পান ও রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আত লাভ সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি প্রকৃত ভালবাসা পোষণ তথা তাঁর সুন্নাতের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৪৬২।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৩/১৭৮ পৃ.; তাক্বিউদ্দীন মাক্বরীযী মিসরী (৭৬৪-৭৪৫ হি.) ইমতা‘উল আসমা‘ ৯/১৯৭; মুহাম্মাদ গাযালী মিসরী (১৯১৭-১৯৯৬ খৃ.) ফিক্বহুস সীরাহ ১৭২ পৃ.।
[3]. মুসলিম, শরহ নববী হা/৫২৪-এর আলোচনা, ৫/৭ পৃ.।
[4]. বুখারী হা/৪২৮; মুসলিম হা/৫২৪ প্রভৃতি।
[5]. ইবনু কাছীর, আস-সীরাহ আন-নববীইয়াহ ২/৩৯২ পৃ.।
[6]. সীরাতু ইবনে হিশাম ১/৬২৬; আল-বিদায়াহ ৩/২৭১; সহীহাহ হা/২৮৩৫।
[7]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/৩৯১; ইবনুল আছীর, উসদুল গাবাহ ২/৩৩২ পৃ.; ইবনু হাজার আসক্বালানী আল-ইছাবাহ ৩/১৮০ পৃ.।
[8]. বুখারী হা/৩৮১১; মুসলিম হা/১৮১১; আল-ইছাবাহ ২/৫০২ পৃ.।
[9]. তিরমিযী হা/১৬৯২; মিশকাত হা/৬১১২; সহীহাহ হা/৯৪৫।
[10]. আল-বিদায়াহ ৪/৪৭; ইবনু হিশাম ২/৯৯, সনদ ‘মুরসাল’ ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১১৮০।
[11]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৫২৮৪; হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১০৩৩৯; সীরাতুর রাসূল (ﷺ) ৩য় মুদ্রণ ৩৯১-৯৪ পৃ.।
[12]. বুখারী হা/১৮৯, ২৭৩১-৩২; সহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২।
[13]. মুসলিম হা/১২১; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৭১০।
[14]. মুসলিম হা/২৩২৫; আহমাদ হা/১২৪২৩; বায়হাক্বী হা/১৩৭৯৩।
[15]. মুসলিম হা/৪৮৯; মিশকাত হা/৮৯৬।
[16]. বুখারী হা/১৭৯১; সহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৭৭৫; আহমাদ হা/১৯৪২৬।
[17]. বুখারী হা/৪৩৩০; মুসলিম হা/১০৬১।
[18]. আহমাদ হা/১১৭৪৮ সনদ ‘হাসান’; হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৬৪৭৫।
[19]. বুখারী হা/৩৯০৪; মুসলিম হা/৩২৮২; মিশকাত হা/৬০১০।
[20]. হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৫১০; সহীহাহ হা/১৫৫০।
[21]. শারহুয যুরক্বানী ‘আলাল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিইয়া ১/৪৯৯; ক্বাযী ইয়ায, আশ-শিফা ২/৫৮ পৃ.।
[22]. ক্বাযী ইয়ায (মৃ. ৫৪৪ হি.), আশ-শিফা বি তা‘রীফি হুকূক্বিল মুছত্বফা ২/৫২ পৃ.।
[23]. সহীহ ইবনু হিববান হা/৭০৭৪ সনদ সহীহ; ইবনু বাত্ত্বাহ, আল-ইবানাতুল কুবরা হা/৭৩, ১/২৪২ পৃ.।
[24]. বুখারী হা/২১; মুসলিম হা/৪৩; মিশকাত হা/৮।
[25]. বুখারী হা/৬১৬৭; মুসলিম হা/২৬৩৯; মিশকাত হা/৫০০৯।
[26]. বুখারী হা/৬১৬৯; মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮।
[27]. মুসলিম হা/২৬৩৯; বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৪২৫; উছায়মীন, শরহ রিয়াযুছ ছালেহীন ১/১১৪ পৃ.।
[28]. কুরতুবী, বাগাভী, নীসাপুরী, মাযহারী প্রভৃতি, সূরা নিসা ৬৯ আয়াতের তাফসীর।
[29]. বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৪।
(১) হিজরতের সময়কার ঘটনা : মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের প্রাক্কালে আবুবকর (রাঃ) সঙ্গী হওয়ার আবেদন করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
لاَ تَعْجَلْ، لَعَلَّ اللهَ يَجْعَلُ لَكَ صَاحِبًا-
‘ব্যস্ত হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ তোমার সঙ্গী জুটিয়ে দিবেন’।[1] অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতিপ্রাপ্ত হ’লে রাসূল (ﷺ) বিষয়টি আবুবকর (রাঃ)-কে জানান। তখন খুশীতে বাগবাগ হয়ে আবুবকর জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আপনার সঙ্গী হ’তে পারব? তিনি বললেন, হ্যাঁ’। রাবী আয়েশা (রাঃ) বলেন,
فَوَاللهِ! مَا شَعَرْتُ قَطُّ قَبْلَ ذَلِكَ الْيَوْمِ أَنَّ أَحَدًا يَبْكِي مِنَ الْفَرَحِ حَتَّى رَأَيْتُ أَبَا بَكْرٍ يَوْمَئِذٍ يَبْكِي-
‘আল্লাহর কসম! ঐ দিনের পূর্বে আমি জানতামই না যে, আনন্দের আতিশয্যে কেউ কাঁদতে পারে। কারণ আমি আবুবকর (রাঃ)-কে সেদিন কান্নারত দেখেছি’।[2]
(২) আল্লাহর পথে ব্যয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত : আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) হিজরত করে মদীনায় এসে সর্বপ্রথম মসজিদ তৈরীর নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন,
يَا بَنِى النَّجَّارِ! ثَامِنُونِى بِحَائِطِكُمْ هَذَا-
‘হে বনু নাজ্জার! তোমরা প্রাচীরবেষ্টিত এই বাগানটির মূল্য নির্ধারণ করে আমার কাছে সেটি বিক্রয় কর’। তারা বলল, আল্লাহর কসম! না। আমরা একমাত্র আল্লাহর কাছেই এর বিনিময় কামনা করি। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) ১০ হাযার দীনারে সেটি ক্রয় করেন এবং আবুবকর (রাঃ) তার মূল্য পরিশোধ করেন।[3] রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তোমাদের বলছি, সেখানে মুশরিকদের কবর এবং পুরাতন ধ্বংসস্তূপ ছিল। আর ছিল খেজুরের গাছ। নবী করীম (ﷺ)-এর নির্দেশে মুশরিকদের কবরগুলো খুড়ে হাড়গোড় অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হ’ল। তারপর ভগ্নাবশেষ সমতল করা হ’ল। কর্তিত খেজুর গাছের কান্ডগুলো মসজিদের সামনে সারিবদ্ধভাবে পুতে দেওয়া হ’ল এবং কিছু পাথর দুই পাশে দিয়ে দরজার চৌকাঠ নির্মাণ করা হ’ল। তখন সাহাবীগণ পাথরগুলি স্থানান্তরের সময় ছন্দোবদ্ধভাবে কবিতা আবৃত্তি করছিলেন এবং নবী করীম (ﷺ)ও তাঁদের সাথে সুর মিলিয়ে বলছিলেন,
اَللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُ الآخِرَهْ + فَاغْفِرْ لِلأَنْصَارِ وَالْمُهَاجِرَهْ،
‘হে আল্লাহ! আখেরাতের কল্যাণ ব্যতীত প্রকৃতপক্ষে কোনই কল্যাণ নেই। অতএব আপনি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দিন’।[4]
(৩) বদর যুদ্ধপূর্ব ভালবাসার ঐতিহাসিক ঘটনা : সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ﷺ)-কে প্রাণাধিক ভালবাসতেন। তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাসূল (ﷺ)-কে ভালবেসে তাঁদের জান-মাল রাহে লিল্লাহ কুরবানী করেছিলেন। যেমন-
(ক) সা‘দ বিন মু‘আয আনছারী (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-কে বললেন, আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনাকে বিশ্বাস করেছি এবং আমরা সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা অবশ্যই সত্য। আমরা আপনার সাথে দৃঢ় অঙ্গীকার করেছে যে, আমরা আপনার কথা শুনব ও আনুগত্য করব। হে আল্লাহর রাসূল! এই যে আমাদের ধন-সম্পদ আপনার সামনে উপস্থাপন করলাম। আপনি ইচ্ছামত নিন অথবা রেখে দিন। আর আপনি রেখে দেওয়ার চাইতে গ্রহণ করাটাই আমাদের নিকট অধিকতর প্রিয়। হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)!, আপনি যেভাবে চান যুদ্ধে এগিয়ে যান, আমরা আপনার সাথে আছি। অতঃপর তিনি বলেন,
فَوَ الَّذِى بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَوِ اسْتَعْرَضْتَ بِنَا الْبَحْرَ فَخُضْتَهُ لَخُضْنَاهُ مَعَكَ مَا تَخَلَّفَ مِنَّا رَجُلٌ وَاحِدٌ،
‘অতএব সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে টেনে সমুদ্রে নিয়ে যান, তবে আমাদের মধ্যে একজন ব্যক্তিও পিছনে পড়বে না’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) বললেন, ...বরং আমরা আপনার ডানে-বামে ও সম্মুখে-পিছনে সর্বদিক থেকে যুদ্ধ করব’। রাবী বলেন,
فَرَأَيْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَشْرَقَ وَجْهُهُ وَسَرَّهُ-
‘অতঃপর আমি দেখলাম, নবী করীম (ﷺ)-এর মুখমন্ডল হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তিনি খুবই আনন্দিত হ’লেন’ (বুখারী হা/৩৯৫২)।
(খ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদরের ময়দানে সাহাবায়ে কেরামকে সারিবদ্ধ করছিলেন এবং তাঁর হাতে একটি তীর ছিল। যখন তিনি সাওয়াদ বিন গাযিইয়া আনছারীর নিকটবর্তী হ’লেন, তখন তিনি তাকে কাতার থেকে অগ্রবর্তী দেখতে পেয়ে বললেন,اِسْتَوِ يَا سَوَادُ! ‘সোজা হয়ে দাঁড়াও হে সাওয়াদ! তখন সাওয়াদ (রাঃ) বললেন,
يَا رَسُولَ اللهِ أَوْجَعْتَنِي، وَقَدْ بَعَثَكَ اللهُ بِالْحَقِّ وَالْعَدْلِ فَأَقِدْنِي-
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি আমাকে কষ্টে নিপতিত করেছেন। আর আল্লাহ আপনাকে সত্য ও ন্যাপরায়ণতার সাথে প্রেরণ করেছেন। অতএব আপনি আমাকে বদলা নিতে দিন’। তখন রাসূল (ﷺ) পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললেন, اِسْتَقِدْ، ‘তুমি বদলা নাও’। অতঃপর সাওয়াদ রাসূল (ﷺ)-এর সাথে কোলাকুলি করলেন এবং তাঁর পেটে চুমু দিলেন। রাসূল (ﷺ) বললেন,
مَا حَمَلَكَ عَلَى هَذَا يَا سَوادُ؟
‘তোমার হ’ল কি হে সাওয়াদ?’ তিনি বললেন,
حَضَرَ مَا تَرَى، فَأَرَدْتُ أَنْ يَّكُونَ آخرُ الْعَهْدِ بِكَ أَنْ يَّمَسَّ جِلْدِي جِلْدَكَ-
‘যা হয়েছে আপনি তো দেখতেই পেলেন। আর আমি ইচ্ছা পোষণ করলাম যে, আমার জীবনের শেষ সময়টা যেন আপনার সাথেই অতিবাহিত হয়। তাই আমি আপনার চামড়ার সাথে আমার চামড়া মিলিত করলাম’। তখন রাসূল (ﷺ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন।[6]
অতঃপর সাওয়াদ বিন গাযিয়া (রাঃ) বদর যুদ্ধে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন।[7]
(৪) আমার বক্ষ আপনার জন্য ঢাল স্বরূপ : আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন বিপর্যয়ের পর কয়েকজন সাহাবী নবী করীম (ﷺ)-কে শত্রুদের হামলা থেকে আড়াল করে রেখেছিল। আবু ত্বালহা (রাঃ) ঢাল হাতে নিয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর সামনে প্রাচীরের সদৃশ দৃঢ় হয়ে দাঁড়ালেন। আর আবু ত্বালহা (রাঃ) ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দায। যুদ্ধ চলাকালীন মুশরিকদের হামলা করে তিনি দুই বা তিনটি ধনুক ভেঙ্গে ফেলেন। রাবী বলেন, যখন কোন ব্যক্তি তীর নিয়ে অতিক্রম করত, তখনই রাসূল (ﷺ) বলতেন, এগুলি আবু ত্বালহার জন্য রেখে যাও। আর যখন নবী করীম (ﷺ) মাথা উঁচু করে শত্রুদের অবস্থা দেখতেন, তখন আবু ত্বালহা (রাঃ) বলতেন,
يَا نَبِىَّ اللهِ بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى! لاَ تُشْرِفْ، يُصِيبُكَ سَهْمٌ مِّنْ سِهَامِ الْقَوْمِ، نَحْرِى دُونَ نَحْرِكَ،
‘হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হৌক! আপনি মাথা উঠাবেন না। কেননা এতে শত্রুপক্ষের তীর এসে আপনার গায়ে বিদ্ধ হ’তে পারে। তবে আপনাকে রক্ষা করার জন্য আমার বক্ষই আপনার জন্য ঢাল স্বরূপ’।[8]
(৫) তীরের আঘাতেও অনড় : ওহোদের দিন আবু দুজানা (রাঃ) আল্লাহর রাসূলের পিঠ রক্ষা করেন। শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত তীরগুলো তাঁর শরীরে বিঁধতে লাগল অথচ তিনি সামান্যতম নড়াচড়াও করেননি। যুবায়ের বিন ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন নবী করীম (ﷺ)-এর দেহে দু’টি লৌহবর্ম ছিল। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিনি একটি বড় পাথরের উপর উঠতে চাইলেন, কিন্তু তিনি সক্ষম হ’লেন না। অতঃপর ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ) নীচে বসে গেলেন। তাঁর কাঁধে চড়ে রাসূল (ﷺ) পাহাড়ের উপর উঠে গেলেন। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, أَوْجَبَ طَلْحَةُ- ‘ত্বালহা জান্নাত আবশ্যক করে নিল’।[9]
(৬) আমার সমস্ত বিপদ হালকা হয়ে গেল! সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু দীনার গোত্রের জনৈকা মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যার স্বামী, ভাই ও পিতা রাসূল (ﷺ)-এর সাথে ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ইতিমধ্যেই শহীদ হয়েছেন। স্বজনদের মৃত্যু সংবাদ জানানো হ’লে এই মহিলা বললেন,
مَا فَعَلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟
‘রাসূল (ﷺ)-এর কি অবস্থা?’ তারা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভাল আছেন। মহিলা বললেন, আমাকে দেখতে দাও। রাসূল (ﷺ)-এর দিকে ইশারা করা হ’লে মহিলা তাঁকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
كلُّ مصيبةٍ بَعدَكَ جَلَلٌ!
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনাকে দেখে আমার সমস্ত বিপদ হালকা হয়ে গেল’।[10]
(৭) মৃত্যুর পূর্বেখুবায়েব ও রাসূলের প্রতি ভালবাসা : চতুর্থ হিজরীতে প্রখ্যাত সাহাবী খুবায়েব বিন ‘আদীকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার পূর্বে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান বলল,
أَتُحِبُّ مُحَمَّدًا مَكَانَكَ؟
‘তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি জীবিত থাক?’ জবাবে তিনি বলেন,
لاَ وَاللهِ الْعَظِيمِ! مَا أُحِبُّ أَنْ يَّفْدِيَنِي بِشَوْكَةٍ يُشَاكَهَا فِي قَدَمِهِ-
‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমার পরিবর্তে তাঁর পায়ে একটি কাঁটাও বিদ্ধ হোক, এটা আমি পসন্দ করি না’।[11]
সুবহানাল্লাহ! এত বড় পরীক্ষার পরেও সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের জীবনের চাইতেও রাসূল (ﷺ)-কে অনেক বেশী ভালবেসেছিলেন।
(৮) হোদায়বিয়া সন্ধির সময় : উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সাহাবীগণের আচরণ সচক্ষে দেখেছিলেন। অতঃপর উরওয়া তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, হে আমার গোত্র, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা-বাদশাহর নিকটে কুরায়েশদের প্রতিনিধিত্ব করেছি। রোম সম্রাট ক্বায়ছার, পারস্য সম্রাট কিসরা ও আবিসিনিয়া সম্রাট নাজাশীর নিকটে আমি দূত হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু ‘আল্লাহর কসম করে বলছি, কোন রাজা-বাদশাহকেই তার অনুসারীরা এত বেশী সম্মান করে না, যেমন মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাঁকে সম্মান করে থাকে। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যদি থুথু ফেলেন, যা কোন সাহাবীর হাতে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের গায়ে-মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা সাথে সাথে তা পালন করেন। তিনি ওযূ করলে তাঁর ওযূর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তিনি কথা বললে সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এমনকি সম্মানার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না’।[12]
(৯) সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভালবাসা : আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
...فَلَمَّا جَعَلَ اللهُ الْإِسْلاَمَ فِي قَلْبِي أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ... وَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبَّ إِلَيَّ مِنْ رَّسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلاَ أَجَلَّ فِي عَيْنِي مِنْهُ، وَمَا كُنْتُ أُطِيقُ أَنْ أَمْلَأَ عَيْنَيَّ مِنْهُ إِجْلاَلاً لَهُ، وَلَوْ سُئِلْتُ أَنْ أَصِفَهُ مَا أَطَقْتُ؛ لِأَنِّي لَمْ أَكُنْ أَمْلَأُ عَيْنَيَّ مِنْهُ، وَلَوْ مُتُّ عَلَى تِلْكَ الْحَالِ لَرَجَوْتُ أَنْ أَكُونَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ،
...‘যখন আল্লাহ আমার অন্তরে ইসলাম গ্রহণের প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট আসলাম। ...‘এক পর্যায়ে আমার অন্তরে লোকদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় আর কেউ ছিল না। আমার দৃষ্টিতে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ-ই এত শ্রদ্ধাভাজন নন। সীমাহীন সম্মান ও ভালবাসার কারণে আমি তাঁর দিকে চোখ তুলেও তাকাতে পারতাম না। যদি আমাকে তাঁর দৈহিক অবয়বের বর্ণনা দিতে বলা হয়, তবে আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ আমি কখনোই তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। আর ঐ অবস্থায় আমার মৃত্যু হ’লে আমি অবশ্যই আশাবাদী জান্নাতী হ’তাম’।[13]
(১০) নবীজীর সন্নিকটে : আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْحَلاَّقُ يَحْلِقُهُ، وَأَطَافَ بِهِ أَصْحَابُهُ، فَمَا يُرِيدُونَ أَنْ تَقَعَ شَعْرَةٌ إِلاَّ فِي يَدِ رَجُلٍ-
‘আমি নাপিতকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চুল ছাঁটতে দেখেছি এমতাবস্থায় যে, সাহাবীগণ তার সন্নিকটে চারপাশ ঘিরে রেখেছেন। তারা এই কামনা করতেন যে, তাদের যেকোন একজনের হাতে যেন চুল পড়ে’।[14]
(১১) আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই : রাবী‘আ বিন কা‘ব আসলামী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে কখনো রাত্রিযাপন করতাম। একদা তাঁর ওযূ ও ইস্তেঞ্জার পানি উপস্থিত করলাম। তিনি আমাকে বললেন,
سَلْ، فَقُلْتُ أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الْجَنَّةِ، قَالَ : أَو غير ذَالِكَ؟ قُلْتُ هُوَ ذَاكَ، قَالَ : فَأَعِنِّي عَلَى نَفسك بِكَثْرَةِ السُّجُود-
‘কিছু চাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। রাসূল (ﷺ) বললেন, এছাড়া অন্য কিছু চাও। আমি বললাম, এটাই চাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তাহ’লে বেশী বেশী সিজদা করে আমাকে এ বিষয়ে সাহায্য কর’।[15]
(১২) মুশরিকদের আক্রমণ থেকে রাসূল (ﷺ)-কে নিরাপদ রাখা : আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اِعْتَمَرَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَاعْتَمَرْنَا مَعَهُ فَلَمَّا دَخَلَ مَكَّةَ طَافَ وَطُفْنَا مَعَهُ، وَأَتَى الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ وَأَتَيْنَاهَا مَعَهُ، وَكُنَّا نَسْتُرُهُ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ أَنْ يَّرْمِيَهُ أَحَدٌ،...
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সপ্তম হিজরীতে ওমরাতুল ক্বাযা সম্পন্ন করলেন, আমরাও তাঁর সাথে ওমরা করলাম। তিনি মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ করলেন, আমরাও তাঁর সাথে ত্বাওয়াফ করলাম। এরপর তিনি ছাফা ও মারওয়ায় সাঈ করলেন, আমরাও তাঁর সাথে সাঈ করলাম। আর আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মক্কার মুশরিকদের আক্রমণ থেকে সুদৃঢ় প্রাচীরের ন্যায় নিরাপদে রাখছিলাম। যেন তাঁর প্রতি কেউ কোন কিছু নিক্ষেপ করতে না পারে’।[16] উপরোল্লিখিত আলোচনায় স্পষ্ট যে, বিপদের সময় রাসূল (ﷺ)-কে নিরাপদে রাখার জন্য সাহাবায়ে কেরাম সর্বোচ্চ ভালবাসার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন।
(১৩) আল্লাহর রাসূলকে পেয়ে সন্তুষ্ট হ’লাম : আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আছেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, অষ্টম হিজরীতে হুনায়নের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহ বিপুল গণীমত প্রদান করলেন। তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সেগুলি বণ্টন করে দিলেন এবং আনছারগণকে কিছুই দিলেন না। ফলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হ’লেন। অতঃপর তিনি আনছারদেরকে সম্বোধন করে বললেন,
يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ! أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلاَّلاً؟ فَهَدَاكُمُ اللهُ بِى، وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِينَ فَأَلَّفَكُمُ اللهُ بِى، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللهُ بِى، كُلَّمَا قَالَ شَيْئًا قَالُوا : اللهُ وَرَسُولُهُ أَمَنُّ! ...أَتَرْضَوْنَ أَنْ يَّذْهَبَ النَّاسُ بِالشَّاةِ وَالْبَعِيرِ وَتَذْهَبُونَ بِالنَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى رِحَالِكُمْ؟ لَوْلاَ الْهِجْرَةُ لَكُنْتُ امْرَأً مِّنَ الأَنْصَارِ، وَلَوْ سَلَكَ النَّاسُ وَادِيًا وَّشِعْبًا لَسَلَكْتُ وَادِىَ الأَنْصَارِ وَشِعْبَهَا، الأَنْصَارُ شِعَارٌ وَالنَّاسُ دِثَارٌ، إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِى أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِى عَلَى الْحَوْضِ-
‘হে আনছারগণ! আমি কি তোমাদেরকে ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত পাইনি? অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়াত দিয়েছেন। তোমরা ছিলে শতধাবিভক্ত, অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের অন্তরগুলিকে পারস্পরিক ভালবাসার মেলবন্ধনে একত্রিত করে দিয়েছেন। তোমরা ছিলে অভাবী, অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের অভাবমুক্ত করেছেন। এভাবে তিনি যখনই কোন অনুগ্রহের কথা বলেন, জবাবে আনছারগণ বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক অনুগ্রহকারী!
অতঃপর রাসূল (ﷺ) বলেন, ...তোমরা কি সন্তুষ্ট নও যে, লোকেরা বকরী ও উট নিয়ে যাবে, আর তোমরা আল্লাহর নবীকে তোমাদের সাথে নিয়ে বাড়ী ফিরবে? যদি হিজরত না হ’ত, তবে আমি আনছারদের সাথেই থাকতাম। আর যদি লোকেরা কোন উপত্যকা ও গিরিপথে চলে, তবে আমি অবশ্যই আনছারদের যাতায়াতের উপত্যকা ও গিরিপথেই চলব। কেননা নৈকট্য বিবেচনায় আনছারদের মর্যাদা সর্বাধিক এবং অন্য লোকজন তাদেরই অনুগামী। সত্বর আমার পর তোমরা অন্যদের অগ্রাধিকার দেখতে পাবে। তখন তোমরা ধৈর্যধারণ করবে। আর এভাবে তোমরা হাউযে কাওছারে আমার সাথে সাক্ষাৎ লাভ করবে’।[17]
অতঃপর আনছারগণ অঝোরে কান্না করতে লাগল, যাতে তাদের দাড়িগুলি সিক্ত হয়ে গেল এবং তারা বলতে লাগল,
رَضِينَا بِرَسُولِ اللهِ قِسْماً وَّحَظًّا-
‘আমরা সন্তুষ্ট হ’লাম বণ্টনে পরিপূর্ণ অংশ হিসাবে আল্লাহর রাসূলকে পেয়ে’।[18] কবি বলেন,
هُو المُقَدَّمُ فِي نَفْسِي عَلَى نَفْسِي + وَأَهْلِ بَيْتِـي وَأَحْبَابِـي وَخُلاَّنِـي
‘তিনি আমার নিকট নিজের চাইতে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রাপ্ত; আমার পরিবার, প্রিয়জন এবং বন্ধুদের চাইতেও’।
(১৪) আমাদের পিতা-মাতাকে উৎসর্গ করলাম! : আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বরে বসে বললেন,
إِنَّ عَبْدًا خَيَّرَهُ اللهُ بَيْنَ أَنْ يُّؤْتِيَهُ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا مَا شَاءَ وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ، فَاخْتَارَ مَا عِنْدَهُ،
‘আল্লাহ তাঁর বান্দাকে দু’টি বিষয়ের যেকোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, দুনিয়ার ভোগ-বিলাস অথবা আল্লাহর নিকট যা সংরক্ষিত রয়েছে (জান্নাত)। তখন সে বান্দা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তাই পসন্দ করল। একথা শুনে আবুবকর (রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম! রাবী বলেন, তাঁর এই আবেগাপ্লুত অবস্থা দেখে আমরা বিস্মিত হ’লাম। লোকেরা বলতে লাগল যে, এ বৃদ্ধ লোকের আবেগ দেখ। রাসূল (ﷺ) এক ব্যক্তি সম্পর্কে সংবাদ দিলেন যে, তাকে আল্লাহ পার্থিব ভোগ-বিলাস অথবা আল্লাহর নিকট যা সংরক্ষিত রয়েছে, এ দু’য়ের মধ্যে যেকোন একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দিলেন। আর এই বৃদ্ধ লোকটি বলছে, আপনার জন্য আমাদের পিতা-মাতাকে উৎসর্গ করলাম’।
বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ই হ’লেন সেই ইখতিয়ার প্রাপ্ত ব্যক্তি। আর আমাদের মধ্যে আবুবকর (রাঃ)-ই হ’লেন সবচাইতে বিচক্ষণ ব্যক্তি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنَّ مِنْ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَىَّ فِى صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبَا بَكْرٍ، وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيْلاً مِّنْ أُمَّتِى لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ إِلاَّ خُلَّةَ الإِسْلاَمِ، لاَ يَبْقَيَنَّ فِى الْمَسْجِدِ خَوْخَةٌ إِلاَّ خَوْخَةُ أَبِىْ بَكْرٍ-
‘নিশ্চয়ই যিনি তার সাহচর্য ও ধন-সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক সাহায্য করেছেন, তিনি হ’লেন আবুবকর। আমি যদি আমার উম্মতের মধ্যে কোন ব্যক্তিকে খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে অবশ্যই আবুবকরকে গ্রহণ করতাম। তবে তার সাথে আমার ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অতএব মসজিদের দিকে আবুবকরের দরজা ছাড়া অন্য কারু দরজা যেন বাকী না থাকে’।[19]
(১৫) রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসায় সাহাবীগণের প্রতিযোগিতা :
উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আলী, জা‘ফর ও যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ) একত্রিত হ’লেন। তখন জা‘ফর (রাঃ) বললেন, আমি তোমাদের চাইতে রাসূল (ﷺ)-এর নিকট অধিক প্রিয়। তখন আলী ও যায়েদ (রাঃ) একই দাবী করলেন। অতঃপর তারা বললেন, চলো! আমরা রাসূল (ﷺ)-এর নিকটে যাই। সেখানে গিয়ে বাড়ী প্রবেশের অনুমতি চাইলে রাসূল (ﷺ) তাদেরকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন,
يَا رَسُولَ اللهِ مَنْ أَحَبُّ إِلَيْكَ؟
‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট সর্বাধিক প্রিয় কে? তিনি বললেন, ফাতেমা। তারা বললেন, পুরুষদের মধ্যে? তখন রাসূল (ﷺ) বললেন,
أَمَّا أَنْتَ يَا جَعْفَرُ فَأَشْبَهَ خَلْقُكَ خَلْقِى وَأَشْبَهَ خَلْقِى خَلْقَكَ وَأَنْتَ مِنِّى وَشَجَرَتِى، وَأَمَّا أَنْتَ يَا عَلِىُّ فَخَتَنِى وَأَبُو وَلَدِىْ وَأَنَا مِنْكَ وَأَنْتَ مِنِّى، وَأَمَّا أَنْتَ يَا زَيْدُ فَمَوْلاَىَ وَمِنِّى وَإِلَىَّ وَأَحَبُّ الْقَوْمِ إِلَىَّ-
‘হে জা‘ফর! তোমার শারীরিক গঠন আমার ন্যায় এবং আমার শারীরিক গঠন তোমার ন্যায়। তুমি আমার মূল বংশধর। অতঃপর হে আলী! তুমি আমার কন্যা ফতেমার জামাতা এবং আমার চাচাতো ভাই। তুমি আমার বংশধর এবং আমিও তোমার বংশধর। অতঃপর হে যায়েদ! তুমি তো আমারই অতি প্রিয়ভাজন মুক্তদাস এবং মানুষের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি’।[20]
উল্লেখিত হাদীসে রাসূল (ﷺ)-এর ভালবাসা অর্জনে সাহাবীগণের প্রতিযোগিতা ও আন্তরিকতার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। তাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর রাসূলের ভালবাসায় পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আত্মনিয়োগ করেছেন এবং তাঁর ভালবাসা অর্জন করতেও সদা উদগ্রীব ছিলেন।
(১৬) আগামীকাল প্রিয়তম রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করব : বেলাল বিন রাবাহ (রাঃ)-এর মৃত্যুর পূর্বে যন্ত্রণায় ছটফট করলে তাঁর স্ত্রী শোকে মূহ্যমান হয়ে বললেন, হায় আফসোস! কি যন্ত্রণা! অতঃপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে স্বীয় স্ত্রীকে এমন এক কথা বললেন, যাতে মৃত্যু যন্ত্রণার সাথে মাধুর্যও মিশানো ছিল। কেননা মৃত্যু হয়ে গেলেই রাসূল (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের রাস্তা খোলাছা হয়ে যাবে। তিনি বললেন, غَدًا نَلْقَى الْأَحِبَّة مُحَمَّدًا وَصَحْبَه- ‘এইতো আমাগীকালই প্রিয়তম রাসূল (ﷺ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করব’।[21]
(১৭) তৃষ্ণায় শীতল পানীয়ের চাইতেও রাসূল (ﷺ) অধিক প্রিয় : আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, রাসূল (ﷺ)-কে আপনারা কেমন ভালবাসতেন? জবাবে তিনি বলেন,
كَانَ وَاَللهِ أَحَبُّ إلَيْنَا مِنْ أَمْوَالِنَا وَأَوْلادَنَا، وآبائِنَا وأُمَّهَاتِنا، وَمِنَ الْمَاءِ الْبَارِدِ عَلَى الظَّمَإِ-
‘আল্লাহর কসম! তিনি আমাদের নিকট আমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতৃ ও মাতৃকুল এবং প্রচন্ড তৃষ্ণার সময় ঠান্ডা পানি যেমন প্রিয়, তার চাইতেও রাসূল (ﷺ) অধিক প্রিয় ছিলেন’।[22]
(১৮) অনুকরণের অনন্য দৃষ্টান্ত : নাফে‘ বলেন,
كَانَ ابْنُ عُمَرَ يَتَتَبَّعُ آثَارَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكُلُّ مَنْزِلٍ نَزَلَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْزِلُ فِيهِ، فَنَزَلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَحْتَ سَمُرَةٍ، فَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يَجِيءُ بِالْمَاءِ، فَيَصُبُّهُ فِي أَصْلِ السَّمُرَةِ كَيْ لاَ تَيْبَسَ-
‘আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবেসে তাঁর পদচিহ্ন অনুকরণ করতেন। রাসূল (ﷺ) যেসব অবতরণস্থলে নামতেন, তিনিও সেখানে নামতেন। একদা রাসূল (ﷺ) একটি বাবলা গাছের নীচে নেমেছিলেন। আর তাই ইবনু ওমর (রাঃ) পানি এনে ঐ বাবলা গাছে দিতেন। যেন গাছটি শুকিয়ে না যায়’।[23] আর এই কাজগুলি তিনি রাসূল (ﷺ)-কে ভালবেসে করেছিলেন। বিশেষ কোন নিয়ত বা বরকতের জন্য নয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবাসার ফলাফল
রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসার বৃহৎ ও মহান ফলাফল রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল-
(১) ঈমানী যিন্দেগী প্রাপ্তি : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান প্রতিটি মানুষকে কুফরীর আবিলতা থেকে মুক্ত করে ঈমানী যিন্দেগী প্রদান করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ،
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দাও। যখন তিনি তোমাদের আহবান করেন ঐ বিষয়ের দিকে, যা তোমাদেরকে জীবন দান করে’ (আনফাল ৮/২৪)।
(২) আল্লাহর ভালবাসা অর্জন ও পাপ মোচন : যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবেসে যথাযথভাবে তাঁর অনুসরণ করবে, মহান আল্লাহ তাকে ভালবাসবেন এবং তার সমস্ত পাপ মোচন করে দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ-
‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহ সমূহ মাফ করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
রাসূল (ﷺ)-কে ভালবাসার কি মহা প্রতিদান! তাতে আল্লাহর ভালবাসা অর্জন, সেই সাথে জীবনের পাপ মোচনের মত বড় সৌভাগ্য অর্জিত হ’লে মুমিন জীবনে অন্য তেমন কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না।
অতএব মুমিনগণের কর্তব্য হবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বোচ্চ ভালবাসা। সেই সাথে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করা ও রাসূলের সুন্নাতের বিপরীতে বিদ‘আত করা থেকে সর্বদা দূরে থাকা।
(৩) ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ অর্জন : হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেন,
ثَلاَثٌ مَّنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاَوَةَ الْإِيمَانِ : مَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَمَنْ أَحَبَّ عَبْدًا لاَّ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ وَمَنْ يَّكْرَهُ أَنْ يَّعُودَ فِي الْكُفْرِ بَعْدَ أَنْ أَنْقَذَهُ اللهُ مِنْهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُّلْقَى فِي النَّارِ-
‘তিনটি গুণ যার মধ্যে রয়েছে, সে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ পেয়েছে। (ক) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যার নিকট সকল কিছুর চাইতে প্রিয়তম। (খ) যে ব্যক্তি কাউকে ভালবাসে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই এবং (গ) আল্লাহ যাকে কুফরী থেকে মুক্তি দিয়েছেন, অতঃপর সে পুনরায় কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে অপসন্দ করে, যেমন সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে’।[24] এর অর্থ হ’ল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে ইবাদতের পূর্ণ স্বাদ অর্জিত হয়। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হয়। বিশেষ করে রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ-নিষেধ পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ অর্জিত হয়’ (ফাৎহুল বারী; মিরক্বাত)।
(৪) সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ : মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কয়েকটি বিশেষ গুণ উল্লেখের পর রাসূল (ﷺ)-এর উপর ঈমান আনয়নকারীদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘অতএব যারা তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাকে শত্রু থেকে প্রতিরোধ করেছে ও সাহায্য করেছে এবং সেই জ্যোতির (কুরআনের) অনুসরণ করেছে যা তার সাথে নাযিল হয়েছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)।
(৫) জান্নাতে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে থাকার সৌভাগ্য :
(ক) আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল,
يَا رَسُولَ اللهِ مَتَى السَّاعَةُ؟
‘হে আল্লাহর রাসূল! ক্বিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?’ তিনি বললেন,
وَيْلَكَ! وَمَا أَعْدَدْتَ لَهَا؟
‘আফসোস! তুমি এর জন্য কি প্রস্ত্ততি নিয়েছ?’ সে বলল,
مَا أَعْدَدْتُ لَهَا إِلاَّ أَنِّي أُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ،
‘আমি সেজন্য তেমন কোন প্রস্ত্ততি নেইনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনেক ভালবাসি’। তিনি বললেন,
أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ،
‘তুমি তার সাথেই থাকবে, যাকে তুমি ভালবাস’। রাবী বলেন, তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের জন্যও কি এরূপ হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ’। আনাস (রাঃ) বলেন,
فَمَا رَأَيْتُ الْمُسْلِمِينَ فَرِحُوا بِشَيْءٍ بَعْدَ الْإِسْلاَمِ فَرَحَهُمْ بِهَا-
‘এতে ইসলাম গ্রহণের পর থেকে সেদিন মুসলিমগণ যত বেশী আনন্দিত হয়েছে, আর কোন দিন আমি তাদেরকে এত বেশী আনন্দিত হ’তে দেখিনি’।[25]
(খ) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করল যে,
يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ تَقُولُ فِى رَجُلٍ أَحَبَّ قَوْمًا وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ؟
‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার মতামত কি? যে ব্যক্তি কোন একটি দলকে ভালোবাসে, কিন্তু সে তাদের সমকক্ষ নয়। তখন তিনি বলেন,
الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ-
‘যার সাথে যার মহববত, তার সাথে তার ক্বিয়ামত’।[26]
(গ) আনাস (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে সর্বাধিক ভালবাসি।
فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ مَعَهُمْ، وَإِنْ لَّمْ أَعْمَلْ بِأَعْمَالِهِمْ-
‘অতএব আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, জান্নাতে তাঁদের সাথেই আমি থাকব। যদিও আমলে আমি তাঁদের সমকক্ষ নই’।[27]
(ঘ) রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য ও ভালবাসার ফলাফল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَآئِكَ رَفِيقًا-
‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’ল সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।
(ঙ) রাসূল (ﷺ)-এর মুক্তদাস ছাওবান (রাঃ) রাসূল (ﷺ)-কে অত্যধিক ভালবাসতেন। তাঁকে না দেখতে পেলে অস্থির হয়ে যেতেন। একদা তিনি রাসূল (ﷺ)-এর কাছে আসলেন, যখন তার রঙ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ ফুটে উঠেছিল। তখন রাসূল (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
يَا ثَوْبَانُ! مَا غَيَّرَ لَوْنَكَ؟
‘হে ছাওবান! কে তোমাকে বিবর্ণ করে দিল?’ জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমার কোন ব্যথা-বেদনা বা অসুখ-বিসুখ নেই। আমি যদি আপনাকে না দেখি, তবে আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত আমি খুবই একাকিত্ব বোধ করি। অতঃপর আমি পরকালের কথা স্মরণ করি এবং আশঙ্কা করি যে, আমি আপনাকে জান্নাতে দেখতে পাব না। কারণ আপনি তো নবীদের সাথে থাকবেন। কিন্তু আমি যদি জান্নাতে প্রবেশ করি বা আপনার থেকে নিম্নস্তরে থাকি অথবা আমি যদি জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারি, তবে তো আমি কখনোই আপনাকে দেখতে পাব না। অতঃপর উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়।[28]
উপসংহার : ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দার ও রাসূল’।[29] এই হাদীসের আলোকে আমাদের উচিত রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান এনে যথাযথভাবে তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁকে ভালবাসা এবং ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান সহীহ হাদীস অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করা। তাহ’লে ঈমানের পরিপূর্ণ স্বাদ লাভ, আল্লাহর ভালবাসা অর্জন, জান্নাতে রাসূল (ﷺ)-এর সাথে থাকার মহা সৌভাগ্য অর্জন, হাওযে কাওছারের পানি পান ও রাসূল (ﷺ)-এর শাফা‘আত লাভ সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি প্রকৃত ভালবাসা পোষণ তথা তাঁর সুন্নাতের পূর্ণাঙ্গ অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৪৬২।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৩/১৭৮ পৃ.; তাক্বিউদ্দীন মাক্বরীযী মিসরী (৭৬৪-৭৪৫ হি.) ইমতা‘উল আসমা‘ ৯/১৯৭; মুহাম্মাদ গাযালী মিসরী (১৯১৭-১৯৯৬ খৃ.) ফিক্বহুস সীরাহ ১৭২ পৃ.।
[3]. মুসলিম, শরহ নববী হা/৫২৪-এর আলোচনা, ৫/৭ পৃ.।
[4]. বুখারী হা/৪২৮; মুসলিম হা/৫২৪ প্রভৃতি।
[5]. ইবনু কাছীর, আস-সীরাহ আন-নববীইয়াহ ২/৩৯২ পৃ.।
[6]. সীরাতু ইবনে হিশাম ১/৬২৬; আল-বিদায়াহ ৩/২৭১; সহীহাহ হা/২৮৩৫।
[7]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/৩৯১; ইবনুল আছীর, উসদুল গাবাহ ২/৩৩২ পৃ.; ইবনু হাজার আসক্বালানী আল-ইছাবাহ ৩/১৮০ পৃ.।
[8]. বুখারী হা/৩৮১১; মুসলিম হা/১৮১১; আল-ইছাবাহ ২/৫০২ পৃ.।
[9]. তিরমিযী হা/১৬৯২; মিশকাত হা/৬১১২; সহীহাহ হা/৯৪৫।
[10]. আল-বিদায়াহ ৪/৪৭; ইবনু হিশাম ২/৯৯, সনদ ‘মুরসাল’ ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১১৮০।
[11]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৫২৮৪; হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১০৩৩৯; সীরাতুর রাসূল (ﷺ) ৩য় মুদ্রণ ৩৯১-৯৪ পৃ.।
[12]. বুখারী হা/১৮৯, ২৭৩১-৩২; সহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২।
[13]. মুসলিম হা/১২১; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৭১০।
[14]. মুসলিম হা/২৩২৫; আহমাদ হা/১২৪২৩; বায়হাক্বী হা/১৩৭৯৩।
[15]. মুসলিম হা/৪৮৯; মিশকাত হা/৮৯৬।
[16]. বুখারী হা/১৭৯১; সহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৭৭৫; আহমাদ হা/১৯৪২৬।
[17]. বুখারী হা/৪৩৩০; মুসলিম হা/১০৬১।
[18]. আহমাদ হা/১১৭৪৮ সনদ ‘হাসান’; হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৬৪৭৫।
[19]. বুখারী হা/৩৯০৪; মুসলিম হা/৩২৮২; মিশকাত হা/৬০১০।
[20]. হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৫১০; সহীহাহ হা/১৫৫০।
[21]. শারহুয যুরক্বানী ‘আলাল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিইয়া ১/৪৯৯; ক্বাযী ইয়ায, আশ-শিফা ২/৫৮ পৃ.।
[22]. ক্বাযী ইয়ায (মৃ. ৫৪৪ হি.), আশ-শিফা বি তা‘রীফি হুকূক্বিল মুছত্বফা ২/৫২ পৃ.।
[23]. সহীহ ইবনু হিববান হা/৭০৭৪ সনদ সহীহ; ইবনু বাত্ত্বাহ, আল-ইবানাতুল কুবরা হা/৭৩, ১/২৪২ পৃ.।
[24]. বুখারী হা/২১; মুসলিম হা/৪৩; মিশকাত হা/৮।
[25]. বুখারী হা/৬১৬৭; মুসলিম হা/২৬৩৯; মিশকাত হা/৫০০৯।
[26]. বুখারী হা/৬১৬৯; মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮।
[27]. মুসলিম হা/২৬৩৯; বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৪২৫; উছায়মীন, শরহ রিয়াযুছ ছালেহীন ১/১১৪ পৃ.।
[28]. কুরতুবী, বাগাভী, নীসাপুরী, মাযহারী প্রভৃতি, সূরা নিসা ৬৯ আয়াতের তাফসীর।
[29]. বুখারী হা/৮; মুসলিম হা/১৬; মিশকাত হা/৪।
ইহসান ইলাহী যহীর
পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Last edited: