১- রামাযানের সিয়াম রাখা আবশ্যক
রামাযান মাস আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত বিশ্ব মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠতম উপহার। এ মাস সম্পূর্ণটাই রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও ছওয়াবে পরিপূর্ণ। মানবতার চূড়ান্ত সংবিধান আল-কুরআন এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী ‘লায়লাতুল ক্বদর’ এ মাসেই হয়ে থাকে। তাক্বওয়া অর্জন, আত্মসংযম, আত্মসংশোধন ও কৃচ্ছতাসাধন এ মাসের অন্যতম প্রাপ্তি। অধিক বিলাসিতা, প্রাচুর্য, লোভ-লালসা, গীবত-তোহমত, মিথ্যা কথা, চোগলখোরী, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, অপচয়-অপব্যয়, গান-বাজনা, সূদ-ঘুষ ও হারাম ব্যবসা, অবৈধ সম্পর্ক, পরকীয়া ইত্যাদি প্রতিরোধে রামাযান মাসের রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। তাই তাক্বওয়াপূর্ণ সমাজ তৈরির লক্ষ্যে এ মাসে সিয়াম পালন করা সকলের কর্তব্য। ইসলামী শরী‘আতে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞান সম্পন্ন মুসলিম নর ও নারীর উপর সিয়াম পালন করাকে ফরয বা আবশ্যক করা হয়েছে। এটি ইসলামের পঞ্চ-স্তম্ভেরও অন্যতম।
মহান আল্লাহ বলেন,
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘রামাযান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষদের জন্য হেদায়াত, হেদায়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। অতএব যে এই মাস পাবে, সে যেন সিয়াম রাখে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যথা: ১- এই মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, ২- সালাত আদায় করা, ৩- যাকাত প্রদান করা, ৪- হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫- রামাযান মাসের সিয়াম পালন করা’।[১] ত্বালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
‘জনৈক এলোমেলো চুল বিশিষ্ট বেদুইন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আসল। অতঃপর বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর কোন্ সালাত ফরয করেছেন? তিনি বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত; তবে তুমি যদি কিছু নফল আদায় কর তা স্বতন্ত্র কথা। এরপর তিনি বললেন, আমাকে সংবাদ দিন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর কোন্ সিয়াম ফরয করেছেন? আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, রামাযান মাসের সিয়াম; তবে তুমি যদি কিছু নফল সিয়াম আদায় কর তা হল স্বতন্ত্র কথা ...’।[২] এছাড়া রামাযানের সিয়াম ফরয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা সাব্যস্ত হয়েছে। এর অস্বীকারকারী কাফের ও মুরতাদ।[৩]
২- রামাযানের সিয়াম না রাখার পরিণাম
অসুস্থ, অতি বার্ধক্য, মুসাফির, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীর উপর রামাযানের সিয়াম ছেড়ে দেয়া বৈধ। যদিও শারঈ নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তীতে তার ক্বাযা আদায় করবে কিংবা ফিদইয়া দিবে। এছাড়া সিয়াম পরিত্যাগ করার ইখতিয়ার কারো নেই। কেউ যদি বিনা ওজরে রামাযানের সিয়াম না রাখে, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রামাযানে ফযীলত যেমন বেশি, তেমনি এ মাসে গুনাহ করলে এর শাস্তিও বেশি। মূলত ফরয সিয়াম পরিত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশের অমান্য করা হয়। যা মারাত্মক অপরাধ। মূলত সিয়াম না রাখা কাবীরা গুনাহ।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
‘যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রামাযানের একটি সিয়াম ভঙ্গ করে, সে আজীবন সিয়াম রাখলেও ঐ সিয়ামের হক্ব আদায় হবে না’।[৪] আবূ উমামা বাহেলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, একবার আমি ঘুমিয়েছিলাম। এ সময় দু’জন মানুষ এসে আমার দু’বাহু ধরে আমাকে দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেল। সেখানে নিয়ে তারা আমাকে বলল, পাহাড়ে উঠুন। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা বলল, আমরা আপনার জন্য সহজ করে দিচ্ছি। তাদের আশ্বাস পেয়ে আমি উঠতে লাগলাম এবং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত উঠে গেলাম। সেখানে প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের শব্দ? তারা বলল, এটা জাহান্নামী লোকদের চিৎকার। এরপর তারা আমাকে এমন কিছু লোকদের কাছে নিয়ে এল, যাদেরকে পায়ের টাখনুতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের গাল ছিন্নভিন্ন, তা হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হচ্ছে এমন সিয়াম পালনকারী, যারা সিয়াম পূর্ণের আগে ইফতার করত’ অর্থাৎ সিয়াম রাখত না’।[৫]
৩- রামাযানের পবিত্রতা রক্ষা করুন!
প্রত্যেক মুসলিমকে রামাযানের পবিত্রতা রক্ষা করা দ্বীনি কর্তব্য। কেননা এ মাসে জান্নাত এবং রহমতের দরজা সমূহ উন্মুক্ত করা হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়, যাতে করে সে মানব জাতিকে বিপথগামী করতে না পারে।[৬] সিয়াম বান্দার জন্য সুপারিশকারী।[৭] সব ধরনের পাপাচার থেকে বিরত রাখে।[৮] সিয়াম দুনিয়াতে যেমন বান্দাকে যাবতীয় পাপ হতে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি আখেরাতে জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুন হতে তাকে হেফাযত করবে।[৯] এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা রাতে ও দিনে অসংখ্য মানুষকে উন্মুক্ত ক্ষমা ঘোষণা করেন।[১০] এ মাসেই আল্লাহ তা‘আলা চূড়ান্ত সংবিধান আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন।[১১] এ ছাড়া এ মাস আগমন করলেই আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করতে থাকেন যে, ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী! এগিয়ে চলো। হে অকল্যাণের অভিসারী! বিরত হও’।[১২] অতএব রামাযানের পবিত্রতা রক্ষার্থে প্রত্যেককে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা উচিত। যেমন,
১. নিজে ও পরিবারের সকলকে নিয়ে রামাযানের সিয়াম পালন করুন। পরিবারের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যথাসময়ে ও সহীহ পদ্ধতিতে আদায় করুন।
২. ইসলাম পরিপন্থী সকল কর্মকাণ্ড ও হারাম জিনিস থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকুন। সাথে সাথে ইসলামের সহীহ জ্ঞান চর্চা করুন।
৩. ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সট্রাগ্রাম, টুইটার, ওয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদি থেকে সাধ্যমত দূরে থাকুন।
৪. যাবতীয় গান-বাজনা, ভিডিও গেমস ও টিভি সিরিয়াল দর্শন থেকে বিরত থাকুন।
৫. দিনের বেলায় সকল প্রকার খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও চা-স্টল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখুন।
৬. ব্যবসায়ীগণ সীমিত লাভ করুন। প্রতারণা ও সিন্টিকেট ছেড়ে দিন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখুন। ভেজাল মিশানো থেকে দূরে থাকুন। সর্বদা আল্লাহর নিকট বরকতের দু‘আ করুন।
৭. গীবত-তোহমত, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, মারামারি-কাটাকাটি ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে সর্বদা দূরে থাকুন।
৮. বিড়ি, সিগারেট, গুল, জর্দা, হিরোইন, ইয়াবা, বাবা, ফেন্সিডিল ইত্যাদি নেশাদার দ্রব্য স্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করুন।
৯. তাক্বওয়া অর্জনে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার, দান-ছাদাক্বাহ, উমরাহ পালন এবং অভ্যান্তরীণ ও প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজে শরীক হোন।
১০. ইয়াতীম-সিমকীন ও দুস্থ মানুষের সহযোগিতা করুন এবং অসুস্থ ও পীড়িত মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন।
১১. সর্বোপরি আল্লাহর ক্ষমা লাভে আত্মনিয়োগ করুন এবং জান্নাত লাভের প্রচেষ্টায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখুন।
আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৬; তিরমিযী, হা/২৬০৯; নাসাঈ, হা/৫০০১; মিশকাত, হা/৪।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯১, ৬৯৫৬; নাসাঈ, হা/২০৯০।
[৩]. কিতাবুল ফিক্বহিল মুওয়াসসার, পৃ. ১৩২।
[৪]. মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হা/৯৮০০; শব্দগত মাওকূফ এবং হুকুমগত মারফু‘।
[৫]. সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৯৮৬; সনদ সহীহ, সহীহ মাওয়ারিদ আয-যামআন, হা/১৫০৯।
[৬]. সহীহ বুখারী হা/১৮৯৯, ১৮৯৮, ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।
[৭]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/১৮৩৯, সনদ সহীহ।
[৮]. সহীহ বুখারী হা/১৯০৩, ৬০৫৭।
[৯]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ হা/৭৪৪৩; সহীহুল জামে‘ হা/২১৬৯।
[১১]. সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫।
[১২]. তিরমিযী, হা/৬৮২, সনদ সহীহ।
রামাযান মাস আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত বিশ্ব মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠতম উপহার। এ মাস সম্পূর্ণটাই রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও ছওয়াবে পরিপূর্ণ। মানবতার চূড়ান্ত সংবিধান আল-কুরআন এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী ‘লায়লাতুল ক্বদর’ এ মাসেই হয়ে থাকে। তাক্বওয়া অর্জন, আত্মসংযম, আত্মসংশোধন ও কৃচ্ছতাসাধন এ মাসের অন্যতম প্রাপ্তি। অধিক বিলাসিতা, প্রাচুর্য, লোভ-লালসা, গীবত-তোহমত, মিথ্যা কথা, চোগলখোরী, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, অপচয়-অপব্যয়, গান-বাজনা, সূদ-ঘুষ ও হারাম ব্যবসা, অবৈধ সম্পর্ক, পরকীয়া ইত্যাদি প্রতিরোধে রামাযান মাসের রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। তাই তাক্বওয়াপূর্ণ সমাজ তৈরির লক্ষ্যে এ মাসে সিয়াম পালন করা সকলের কর্তব্য। ইসলামী শরী‘আতে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞান সম্পন্ন মুসলিম নর ও নারীর উপর সিয়াম পালন করাকে ফরয বা আবশ্যক করা হয়েছে। এটি ইসলামের পঞ্চ-স্তম্ভেরও অন্যতম।
মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরয করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৩)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ
‘রামাযান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষদের জন্য হেদায়াত, হেদায়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। অতএব যে এই মাস পাবে, সে যেন সিয়াম রাখে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
بُنِىَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ
‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যথা: ১- এই মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, ২- সালাত আদায় করা, ৩- যাকাত প্রদান করা, ৪- হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫- রামাযান মাসের সিয়াম পালন করা’।[১] ত্বালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত,
أَنَّ أَعْرَابِيًّا جَاءَ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ ثَائِرَ الرَّأْسِ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَخْبِرْنِىْ مَاذَا فَرَضَ اللهُ عَلَىَّ مِنَ الصَّلَاةِ فَقَالَ «الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ، إِلَّا أَنْ تَطَّوَّعَ شَيْئًا». فَقَالَ أَخْبِرْنِىْ مَا فَرَضَ اللهُ عَلَىَّ مِنَ الصِّيَامِ فَقَالَ «شَهْرَ رَمَضَانَ، إِلَّا أَنْ تَطَّوَّعَ شَيْئًا»...
‘জনৈক এলোমেলো চুল বিশিষ্ট বেদুইন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আসল। অতঃপর বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর কোন্ সালাত ফরয করেছেন? তিনি বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত; তবে তুমি যদি কিছু নফল আদায় কর তা স্বতন্ত্র কথা। এরপর তিনি বললেন, আমাকে সংবাদ দিন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর কোন্ সিয়াম ফরয করেছেন? আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, রামাযান মাসের সিয়াম; তবে তুমি যদি কিছু নফল সিয়াম আদায় কর তা হল স্বতন্ত্র কথা ...’।[২] এছাড়া রামাযানের সিয়াম ফরয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা সাব্যস্ত হয়েছে। এর অস্বীকারকারী কাফের ও মুরতাদ।[৩]
২- রামাযানের সিয়াম না রাখার পরিণাম
অসুস্থ, অতি বার্ধক্য, মুসাফির, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীর উপর রামাযানের সিয়াম ছেড়ে দেয়া বৈধ। যদিও শারঈ নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তীতে তার ক্বাযা আদায় করবে কিংবা ফিদইয়া দিবে। এছাড়া সিয়াম পরিত্যাগ করার ইখতিয়ার কারো নেই। কেউ যদি বিনা ওজরে রামাযানের সিয়াম না রাখে, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রামাযানে ফযীলত যেমন বেশি, তেমনি এ মাসে গুনাহ করলে এর শাস্তিও বেশি। মূলত ফরয সিয়াম পরিত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশের অমান্য করা হয়। যা মারাত্মক অপরাধ। মূলত সিয়াম না রাখা কাবীরা গুনাহ।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
مَنْ أَفْطَرَ يَوْمًا مِنْ رَمَضَانَ مُتَعَمِّدًا مِنْ غَيْرِ سَفَرٍ وَلَا مَرَضٍ لَمْ يَقْضِهِ أَبَدًا، وَإِنْ صَامَ الدَّهْرَ كُلَّهُ
‘যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রামাযানের একটি সিয়াম ভঙ্গ করে, সে আজীবন সিয়াম রাখলেও ঐ সিয়ামের হক্ব আদায় হবে না’।[৪] আবূ উমামা বাহেলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ إِذْ أَتَانِي رَجُلَانِ فَأَخَذَا بِضَبْعَيَّ فَأَتَيَا بِيْ جَبَلًا وَعْرًا فَقَالَا اصْعَدْ فَقُلْتُ إِنِّيْ لَا أُطِيْقُهُ فَقَالَا إِنَّا سَنُسَهِّلُهُ لَكَ فَصَعِدْتُ حَتَّى إِذَا كُنْتُ فِيْ سَوَاءِ الْجَبَلِ إِذَا بِأَصْوَاتٍ شَدِيْدَةٍ قُلْتُ مَا هَذِهِ الْأَصْوَاتُ؟ قَالُوْا هَذَا عُوَاءُ أَهْلِ النَّارِ ثُمَّ انْطُلِقَ بِيْ فَإِذَا أَنَا بِقَوْمٍ مُعَلَّقِيْنَ بِعَرَاقِيْبِهِمْ مُشَقَّقَةٍ أَشْدَاقُهُمْ تَسِيْلُ أَشْدَاقُهُمْ دَمًا قَالَ قُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ؟ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِيْنَ يُفْطِرُوْنَ قَبْلَ تَحِلَّةِ صَوْمِهِمْ.
‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, একবার আমি ঘুমিয়েছিলাম। এ সময় দু’জন মানুষ এসে আমার দু’বাহু ধরে আমাকে দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেল। সেখানে নিয়ে তারা আমাকে বলল, পাহাড়ে উঠুন। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা বলল, আমরা আপনার জন্য সহজ করে দিচ্ছি। তাদের আশ্বাস পেয়ে আমি উঠতে লাগলাম এবং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত উঠে গেলাম। সেখানে প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের শব্দ? তারা বলল, এটা জাহান্নামী লোকদের চিৎকার। এরপর তারা আমাকে এমন কিছু লোকদের কাছে নিয়ে এল, যাদেরকে পায়ের টাখনুতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের গাল ছিন্নভিন্ন, তা হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হচ্ছে এমন সিয়াম পালনকারী, যারা সিয়াম পূর্ণের আগে ইফতার করত’ অর্থাৎ সিয়াম রাখত না’।[৫]
৩- রামাযানের পবিত্রতা রক্ষা করুন!
প্রত্যেক মুসলিমকে রামাযানের পবিত্রতা রক্ষা করা দ্বীনি কর্তব্য। কেননা এ মাসে জান্নাত এবং রহমতের দরজা সমূহ উন্মুক্ত করা হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়, যাতে করে সে মানব জাতিকে বিপথগামী করতে না পারে।[৬] সিয়াম বান্দার জন্য সুপারিশকারী।[৭] সব ধরনের পাপাচার থেকে বিরত রাখে।[৮] সিয়াম দুনিয়াতে যেমন বান্দাকে যাবতীয় পাপ হতে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি আখেরাতে জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুন হতে তাকে হেফাযত করবে।[৯] এ মাসে আল্লাহ তা‘আলা রাতে ও দিনে অসংখ্য মানুষকে উন্মুক্ত ক্ষমা ঘোষণা করেন।[১০] এ মাসেই আল্লাহ তা‘আলা চূড়ান্ত সংবিধান আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছেন।[১১] এ ছাড়া এ মাস আগমন করলেই আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করতে থাকেন যে, ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী! এগিয়ে চলো। হে অকল্যাণের অভিসারী! বিরত হও’।[১২] অতএব রামাযানের পবিত্রতা রক্ষার্থে প্রত্যেককে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা উচিত। যেমন,
১. নিজে ও পরিবারের সকলকে নিয়ে রামাযানের সিয়াম পালন করুন। পরিবারের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যথাসময়ে ও সহীহ পদ্ধতিতে আদায় করুন।
২. ইসলাম পরিপন্থী সকল কর্মকাণ্ড ও হারাম জিনিস থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকুন। সাথে সাথে ইসলামের সহীহ জ্ঞান চর্চা করুন।
৩. ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সট্রাগ্রাম, টুইটার, ওয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদি থেকে সাধ্যমত দূরে থাকুন।
৪. যাবতীয় গান-বাজনা, ভিডিও গেমস ও টিভি সিরিয়াল দর্শন থেকে বিরত থাকুন।
৫. দিনের বেলায় সকল প্রকার খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও চা-স্টল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখুন।
৬. ব্যবসায়ীগণ সীমিত লাভ করুন। প্রতারণা ও সিন্টিকেট ছেড়ে দিন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখুন। ভেজাল মিশানো থেকে দূরে থাকুন। সর্বদা আল্লাহর নিকট বরকতের দু‘আ করুন।
৭. গীবত-তোহমত, হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা, মারামারি-কাটাকাটি ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে সর্বদা দূরে থাকুন।
৮. বিড়ি, সিগারেট, গুল, জর্দা, হিরোইন, ইয়াবা, বাবা, ফেন্সিডিল ইত্যাদি নেশাদার দ্রব্য স্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করুন।
৯. তাক্বওয়া অর্জনে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল, যিকির-আযকার, দান-ছাদাক্বাহ, উমরাহ পালন এবং অভ্যান্তরীণ ও প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজে শরীক হোন।
১০. ইয়াতীম-সিমকীন ও দুস্থ মানুষের সহযোগিতা করুন এবং অসুস্থ ও পীড়িত মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন।
১১. সর্বোপরি আল্লাহর ক্ষমা লাভে আত্মনিয়োগ করুন এবং জান্নাত লাভের প্রচেষ্টায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখুন।
আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৬; তিরমিযী, হা/২৬০৯; নাসাঈ, হা/৫০০১; মিশকাত, হা/৪।
[২]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯১, ৬৯৫৬; নাসাঈ, হা/২০৯০।
[৩]. কিতাবুল ফিক্বহিল মুওয়াসসার, পৃ. ১৩২।
[৪]. মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হা/৯৮০০; শব্দগত মাওকূফ এবং হুকুমগত মারফু‘।
[৫]. সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৯৮৬; সনদ সহীহ, সহীহ মাওয়ারিদ আয-যামআন, হা/১৫০৯।
[৬]. সহীহ বুখারী হা/১৮৯৯, ১৮৯৮, ৩২৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/১০৭৯।
[৭]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/১৮৩৯, সনদ সহীহ।
[৮]. সহীহ বুখারী হা/১৯০৩, ৬০৫৭।
[৯]. সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ হা/৭৪৪৩; সহীহুল জামে‘ হা/২১৬৯।
[১১]. সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫।
[১২]. তিরমিযী, হা/৬৮২, সনদ সহীহ।
সূত্র: আল-ইখলাছ।
Last edited: