রামাযান মাস অফুন্ত বরকত অর্জনের মাস। এ মাসে দাওয়াতী কাজের সুযোগ যেমন বেশী থাকে, তেমনি ব্যক্তি, সমাজ ও সার্বিক জীবনে এক স্বতন্ত্র প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
দাওয়াত পরিচিতি :
দাওয়াহ (دعوة) আরবী শব্দ। অর্থ আহ্বান করা বা ডাকা। আর যিনি আহ্বান করেন বা ডাকেন তাকে আরবীতে داعى তথা আহ্বায়ক বলা হয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেন,
অর্থাৎ ‘আল্লাহ্র পথে দাওয়াতের অর্থ হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণ যা আনয়ন করেছেন তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন, তাঁরা যে সব বিষয়ের সংবাদ প্রদান করেছেন সেগুলোর সত্যতা নিরূপন, তাঁরা যেসব বিষয়ের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের আহ্বান জানানো’।[১]
ইমাম ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেছেন, ‘ইসলামের প্রতি আহ্বান করার অর্থ হচ্ছে- لا اله الا الله এর প্রতি আহ্বান করা। কাজেই لا اله الا الله এর প্রতি আহ্বান করাকেই দাওয়াত বলা হয়’।[২]
রামাযানে দাওয়াতী কাজের প্রভাব :
অহির বিধানের আলোকেই রামাযান মাসের সিয়াম পালন করা হয়। সিয়াম এক মাস ফরয। কিন্তু ইসলামী দাওয়াত রামাযানের ভিতর-বাইরে বার মাস ফরয। অপরাধমূলক কার্যাবলী সমাজে বার মাস সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে রামাযানে তুলনামূলকভাবে কম সংঘটিত হয়ে থাকে। সার্বিক অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য সমাজ সংস্কার করা এবং মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য রামাযানের সিয়াম সাধনার সাথে সাথে ইসলামী দাওয়াতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘একজন আহ্বানকারী ঘোষণা দিতে থাকে হে পুণ্যের অন্বেষণকারী! সম্মুখে অগ্রসর হও, হে মন্দের অন্বেষণকারী! থেমে যাও। আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে বহু মানুষকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন আর ইহা প্রত্যেক রাত্রেই সংঘটিত হয়’।[৩] অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের জন্য দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত ছওয়াব নির্ধারিত হয়। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেন, সিয়াম এর ব্যতিক্রম। কেননা এটা একমাত্র আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। সে আমার জন্যই যৌন বাসনা ও খানা-পিনা ত্যাগ করে। সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে। একটা হচ্ছে ইফতারের সময় এবং অন্যটি হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের সময়। আল্লাহ্র কাছে ছায়েমের মুখের গন্ধ মিশক-আম্বরের সুঘ্রাণের চাইতেও উত্তম’।[৪]
সুধী পাঠক! দাওয়াতী কাজ একটি ইবাদত। রামযানে সিয়াম সাধনার পাশাপাশি আল্লাহর পথে দাওয়াতী কাজ করতে পারলে অধিকহারে ছওয়াব অর্জন করা যায়, যা আমরা উল্লেখিত আলোচনায় অবগত হয়েছি। রামাযানে দাওয়াতী কাজে প্রভাব অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। রামাযানে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে মানুষ তার আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে আত্মনিয়োগ করে। নিম্নে দাওয়াতের প্রভাব পেশ করা হল-
রামাযান মাস ব্যক্তির মধ্যে পুঞ্জীভূত খারাপ অভ্যাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। ফলে মানুষের ঈমান তাজা হয়। এক্ষেত্রে এ মাসে দাওয়াতী কাজের প্রভাব সবার শীর্ষে। তাই এ মাসে বেশী বেশী দাওয়াতী কাজ করা প্রয়োজন। পবিত্র কুরআনে সূরা আল-আনফাল : ২-৪, সূরা আত-তাওবাহ : ১২৪-১২৫, সূরা আলে ইমরান : ১৭৩, সূরা আল-আহযাব : ২২ এবং সূরা আল-ফাত্হ : ৪ প্রভৃতি আয়াতে ঈমান বৃদ্ধির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
রামাযানে দাওয়াতী কাজের প্রভাবে মানুষ অধিকহারে মসজিদমুখী হয় এবং মসজিদের সাথে সুগভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। সাথে সাথে মসজিদে জুম‘আর খুৎবা, বিভিন্ন বিষয়ের উপর দারস, তা‘লীম গ্রহণ, পরিবার গঠন, সন্তানাদি প্রতিপালন, শিক্ষা প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়। এছাড়া এ মাস আগমন করলে জনসাধারণের মসজিদে গমনাগমন বেশি হয়। পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত সহ রামাযানে তারাবীহর সালাত মসজিদে আদায় করে থাকে। ফলে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। আল্লাহ বলেন, وَ اسۡجُدۡ وَ اقۡتَرِبۡ ‘সিজদা কর আল্লাহর নিকটবর্তী হও’ (সূরা আল-আ‘লাক্ব : ১৯)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
‘অবশ্যই তোমাদের মধ্যে যখন কেউ সালাত পড়ে, তখন সে তার প্রভুর সাথে কথা বলে’।[৫] অন্যত্র তিনি বলেন,
‘বান্দা যখন সিজদায় থাকে, তখন সে তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়’।[৬] তিনি আরও বলেন,
‘সে ব্যক্তি, যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর তথায় ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত (তিনি ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না)’।[৭]
রামাযানে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে পাপে ডুবে থাকা মানুষকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসাবে গড়ে তুলা সম্ভব হয়। কেননা পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবে থাকা মানুষগুলো রামাযানের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। একটানা পুরা রামাযান অর্থাৎ ৩০ দিন সিয়াম সাধনা করার ফলে তার মধ্যকার কুপ্রবৃত্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলো পর্যায়ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠে। এভাবে সাধারণ মানুষ আল্লাহর ভয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমস্ত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার অঙ্গীকার করে। ফলে তারা প্রকৃত মুত্তাক্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয় আল্লাহ তাক্বওয়াশীলদের সাথে থাকেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াশীল ব্যক্তিদের ভালবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬)। আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাক্বী ব্যক্তিকেই সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান বলে উল্লেখ করেছেন (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।
রামাযানে ইসলামী দাওয়াতী কাজের আরও একটি প্রভাব হল, দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষ যখন হক্ব চিনতে পারে, সহীহ আমল সম্পাদন করতে পারে এবং রামাযানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। ফলে পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের প্রত্যাশায় রামাযানে সিয়াম পালন করবে, তার পূর্বেকার সকল (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের প্রত্যাশায় রাত্রি ইবাদতে (তারাবীহর ছালাক) অতিবাহিত করবে, তার পূর্বেকৃত সমুদয় (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের প্রত্যাশায় ক্বদরের রাত্রিতে ইবাদত করবে, তার পূর্বের সকল (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[৮]
মানবজাতির জন্য ক্বিয়ামত এক ভয়ঙ্কর বিষয়। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এ সময়ে সকল মানুষকে এক জায়গায় সমবেত করা হবে। সূর্য মানুষের অত্যন্ত নিকটবর্তী হবে। সিয়াম ও কুরআন সেদিন তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে। কারণ রামাযানে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে সে সিয়াম পালনের নছীহত করেছে এবং আল-কুরআনের সাথে জনগণকে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘সিয়াম ও কুরআন ক্বিয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে, হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলায় তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে’।[৯]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের সময়টা ছিল মানব ইতিহাসের একটি জঘন্যতম সময়, যাকে ঐতিহাসিকরা ‘জাহেলী যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমন কোন অপরাধ ছিল না, যা সেই সমাজে চালু ছিল না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, যেনা-ব্যভিচার সহ সকল প্রকার অপরাধ তখন সমাজে প্রচলিত ছিল। মানুষ হাটে-বাজারে পশুর মত বেচা-কেনা হত, দাস হিসাবে জীবন-যাপন করত এবং নারী জাতির অবস্থা ছিল আরও করুণ। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি তাদেরকে নৈতিক শক্তিতে গড়ে তুললেন। তাদের দাওয়াতের ফলাফল সম্পর্কে তারা ছিলেন পরিপূর্ণ আস্থাবান। আজকের দিনেও যদি দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে বিশেষ করে রামাযানে মিথ্যাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া, অশ্লীলতা, পরনিন্দা প্রভৃতি পাপাচারমুক্ত সহানুভূতিশীল, পারস্পরিক ভালবাসা, সহযোগিতা, তাক্বওয়াবান একদল আদর্শ লোক গড়ে উঠে, তাহলে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে রামাযানে দাওয়াতী কাজ আদর্শ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনায় দেখা যায় রামাযান মাস আসার অর্ধমাস আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য আকাশ ছোঁয়া। নিত্যপণ্য ক্রয় করতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্টিগেটের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেকে ব্যবসায় মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে, ওযনে কম দেয় ও ভেজালযুক্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রামাযানে ইসলামী দাওয়াতের বিরাট প্রভাব আছে। রামাযানে দাওয়াতের বরকতে আল্লাহ চাহেতো অনেক ব্যবসায়ীর মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে। তারা যদি সিয়াম সাধনার পাশাপাশি অহি-র বিধান মেনে বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে, তাহলে বাজার কেন্দ্রিক যে সমস্ত দুর্নীতি হয়, সেগুলো পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাবে ইনশাআল্লাহ।
রামাযানে ইসলামী দাওয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তিকে তার সার্বিক কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার অভ্যাসে পরিণত করে সিয়াম। কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী কখন সে সাহারী করবে, কখন ইফতার করবে সবই ঠিক করে নেয়। ঠিক করে নেয় আওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করার সময়, কুরআন তেলাওয়াতের সময়, ইসলামী সাহিত্য পাঠের সময়, দাওয়াতী কাজের সময়, ইসলামী বৈঠকাদিতে যোগদানের সময়, খাওয়া, ঘুমানো প্রভৃতি সব কিছুতেই পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল করে তোলে। এই এক মাসের সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা বাকী ১১টি মাসে তার জীবন পরিচালনার জন্য সঠিক পন্থা তৈরি করতে সহায়তা প্রদান করে।
রাযামানে ইসলামী দাওয়াতে সাড়া দিয়ে প্রশিক্ষণ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যখন কেউ জীবন পরিচালনা করতে শুরু করে, তখন নিজের মধ্য বিভিন্ন প্রকার বদ অভ্যাস, কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে সিয়ামের মাধ্যমে সে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। সহজেই মাদকদ্রব্যের ন্যায় মরণব্যাধি নেশা পরিত্যাগ করে। শক্তি ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি পানাহার বা যৌনাচারে লিপ্ত না হয়ে সুন্দরতম সংযমের অনুশীলন করে। তার মধ্যে ছবর বা ধৈর্যশীলতার দুর্লভ গুণ স্থান করে নেয়। সিয়ামলব্ধ তাক্বওয়া তাকে হিংসা, পরনিন্দা ও পাপাাচরের বিপরীতে কুরআন তেলাওয়াত, দানশীলতা ও ইবাদতে অভ্যস্ত করে তোলে। ফলে ব্যক্তি সুদৃঢ় ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়।
উদাত্ত আহ্বান!
হে ছাত্র ও যুব সমাজ! তোমার রয়েছে প্রখর মেধা, ব্যাপক সময় ও শক্তিমত্তা। এর প্রত্যেকটি আল্লাহর দেয়া আমানত। এসো তা ব্যয় করি আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র উৎস পবিত্র অহি প্রতিষ্ঠার কাজে। আমার বিশ্বাস তোমার প্রচেষ্টায় সত্যের পথ খুঁজে পাবে নর্দমায় পড়ে থাকা অসংখ্য ছাত্র ও যুবক।
হে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও ব্যবসায়ীগণ! আপনাদের রয়েছে সীমাহীন ব্যস্ততা। ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে ফরয ইবাদত সমূহ আদায় করতে হয়। দ্বীনী হক্বের দাওয়াত বর্তমান সময়ে ফরয। এ ফরয ইবাদতটি আমরা যে যেখানে থাকি সেখানেই আমলযোগ্য। আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে থেকে গোটা বিশ্বব্যাপী দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। তাই লেখকদের লেখনী, অর্থ-বিত্তশীলদের অর্থ প্রয়োগ, যান্ত্রিক সভ্যতা ব্যবহারে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ারগণ এবং ডাক্তারী সেবাই নিয়োজিত চিকিৎসকগণ রোগীর প্রতি সৎ উপদেশ দানের মাধ্যমে দ্বীনকে এগিয়ে নিয়ে চলুন। জান্নাত আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ ‘দ্বীন হচ্ছে উপদেশ’।[১০]
হে সম্মানিতা মা ও বোন! বিশ্ব মানচিত্রে নারীদের অবস্থা নিশ্চয় আপনার জানা আছে। বিভিন্ন নারী প্রগতিশীল সংগঠন নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়ন, এন.জি.ও তে আর্থিক সুবিধার নাম করে আধুনিকতার নামে আপনাকে উলঙ্গ করছে, ধর্ষণ করছে, নির্যাতিত হচ্ছে অহরহ। এ অবস্থায় আপনার কী কোন করণীয় নেই? আসুন! আদর্শ নারী, আদর্শ মা ও আদর্শ স্ত্রী হিসাবে গড়ে উঠুন। রামাযান মাসকে প্রশিক্ষণের মাস হিসাবে কাজে লাগান। আপনার পরিবারে ইসলামী দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি আপনার সমাজে পর্দার সীমারেখা রক্ষা করে দাওয়াতী কাজ করুন। দেখবেন সমাজে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসবে এবং সমাজ সংস্কারে প্রভূত কল্যাণ রাখবে ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে বলব, আমাদের উচিত সঠিক দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধন প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা। আর এ জন্য রামাযানে রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[২]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৪র্থ খণ্ড, ৪২২; ছালিহ ইবনু আব্দুল আযীয আলে শায়েখ, আল-বাছীরাতু ফিদ দাওয়াতী ইলাল্লাহ, পৃ. ১ ভূমিকা দ্র.।
[৩]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২; তিরমিযী, হা/৬৮২; মিশকাত, হা/১৯৬০।
[৪]. সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৮; মিশকাত, হা/১৯৫৯।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/৫৩১।
[৬]. মুসলিম হা/১১১১; আবুদাঊদ হা/৮৭৫; নাসাঈ হা/১১৩৭; মিশকাত হা/৮৯৪।
[৭]. মুসলিম হা/২৪২৮; সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৭৩৩৮; মুত্তাফাক্ব আলাহই, মিশকাত হা/৭০১।
[৮]. সহীহ বুখারী হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯, ২০১৪; সহীহ মুসলিম; হা/৭৫৯, ৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[৯]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/১৯৬৩, সনদ সহীহ।
[১০]. সহীহ মুসলিম, হা/৫৫; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৪; মিশকাত, হা/৪৯৬৬।
দাওয়াত পরিচিতি :
দাওয়াহ (دعوة) আরবী শব্দ। অর্থ আহ্বান করা বা ডাকা। আর যিনি আহ্বান করেন বা ডাকেন তাকে আরবীতে داعى তথা আহ্বায়ক বলা হয়। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেন,
اَلدَّعْوَةُ إلَى اللهِ هِيَ الدَّعْوَةُ إلَى الْإِيمَانِ بِهِ وَبِمَا جَاءَتْ بِهِ رُسُلُهُ بِتَصْدِيقِهِمْ فِيمَا أَخْبَرُوا بِهِ وَطَاعَتِهِمْ فِيمَا أَمَرُوا
অর্থাৎ ‘আল্লাহ্র পথে দাওয়াতের অর্থ হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণ যা আনয়ন করেছেন তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন, তাঁরা যে সব বিষয়ের সংবাদ প্রদান করেছেন সেগুলোর সত্যতা নিরূপন, তাঁরা যেসব বিষয়ের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের আহ্বান জানানো’।[১]
ইমাম ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেছেন, ‘ইসলামের প্রতি আহ্বান করার অর্থ হচ্ছে- لا اله الا الله এর প্রতি আহ্বান করা। কাজেই لا اله الا الله এর প্রতি আহ্বান করাকেই দাওয়াত বলা হয়’।[২]
রামাযানে দাওয়াতী কাজের প্রভাব :
অহির বিধানের আলোকেই রামাযান মাসের সিয়াম পালন করা হয়। সিয়াম এক মাস ফরয। কিন্তু ইসলামী দাওয়াত রামাযানের ভিতর-বাইরে বার মাস ফরয। অপরাধমূলক কার্যাবলী সমাজে বার মাস সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে রামাযানে তুলনামূলকভাবে কম সংঘটিত হয়ে থাকে। সার্বিক অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য সমাজ সংস্কার করা এবং মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য রামাযানের সিয়াম সাধনার সাথে সাথে ইসলামী দাওয়াতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
وَنَادَى مُنَادٍ يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ
‘একজন আহ্বানকারী ঘোষণা দিতে থাকে হে পুণ্যের অন্বেষণকারী! সম্মুখে অগ্রসর হও, হে মন্দের অন্বেষণকারী! থেমে যাও। আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে বহু মানুষকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন আর ইহা প্রত্যেক রাত্রেই সংঘটিত হয়’।[৩] অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِىْ وَأَنَا أَجْزِى بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِى لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ وَلَخُلُوْفُ فِيْهِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيْحِ الْمِسْكِ
‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের জন্য দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত ছওয়াব নির্ধারিত হয়। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেন, সিয়াম এর ব্যতিক্রম। কেননা এটা একমাত্র আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। সে আমার জন্যই যৌন বাসনা ও খানা-পিনা ত্যাগ করে। সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে। একটা হচ্ছে ইফতারের সময় এবং অন্যটি হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের সময়। আল্লাহ্র কাছে ছায়েমের মুখের গন্ধ মিশক-আম্বরের সুঘ্রাণের চাইতেও উত্তম’।[৪]
সুধী পাঠক! দাওয়াতী কাজ একটি ইবাদত। রামযানে সিয়াম সাধনার পাশাপাশি আল্লাহর পথে দাওয়াতী কাজ করতে পারলে অধিকহারে ছওয়াব অর্জন করা যায়, যা আমরা উল্লেখিত আলোচনায় অবগত হয়েছি। রামাযানে দাওয়াতী কাজে প্রভাব অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। রামাযানে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে মানুষ তার আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে আত্মনিয়োগ করে। নিম্নে দাওয়াতের প্রভাব পেশ করা হল-
ঈমান তাজাকরণে সহায়তা
রামাযান মাস ব্যক্তির মধ্যে পুঞ্জীভূত খারাপ অভ্যাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। ফলে মানুষের ঈমান তাজা হয়। এক্ষেত্রে এ মাসে দাওয়াতী কাজের প্রভাব সবার শীর্ষে। তাই এ মাসে বেশী বেশী দাওয়াতী কাজ করা প্রয়োজন। পবিত্র কুরআনে সূরা আল-আনফাল : ২-৪, সূরা আত-তাওবাহ : ১২৪-১২৫, সূরা আলে ইমরান : ১৭৩, সূরা আল-আহযাব : ২২ এবং সূরা আল-ফাত্হ : ৪ প্রভৃতি আয়াতে ঈমান বৃদ্ধির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
মসজিদের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়
রামাযানে দাওয়াতী কাজের প্রভাবে মানুষ অধিকহারে মসজিদমুখী হয় এবং মসজিদের সাথে সুগভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। সাথে সাথে মসজিদে জুম‘আর খুৎবা, বিভিন্ন বিষয়ের উপর দারস, তা‘লীম গ্রহণ, পরিবার গঠন, সন্তানাদি প্রতিপালন, শিক্ষা প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়। এছাড়া এ মাস আগমন করলে জনসাধারণের মসজিদে গমনাগমন বেশি হয়। পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত সহ রামাযানে তারাবীহর সালাত মসজিদে আদায় করে থাকে। ফলে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। আল্লাহ বলেন, وَ اسۡجُدۡ وَ اقۡتَرِبۡ ‘সিজদা কর আল্লাহর নিকটবর্তী হও’ (সূরা আল-আ‘লাক্ব : ১৯)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا صَلَّى يُنَاجِى رَبَّهُ
‘অবশ্যই তোমাদের মধ্যে যখন কেউ সালাত পড়ে, তখন সে তার প্রভুর সাথে কথা বলে’।[৫] অন্যত্র তিনি বলেন,
أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ
‘বান্দা যখন সিজদায় থাকে, তখন সে তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়’।[৬] তিনি আরও বলেন,
وَرَجُلٌ مُعَلَّقٌ بِالْمَسْجِدِ إِذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُودَ إِلَيْهِ
‘সে ব্যক্তি, যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর তথায় ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত (তিনি ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না)’।[৭]
মুত্তাক্বী তৈরিতে ভূমিকা রাখে
রামাযানে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে পাপে ডুবে থাকা মানুষকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসাবে গড়ে তুলা সম্ভব হয়। কেননা পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবে থাকা মানুষগুলো রামাযানের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে দীর্ঘ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। একটানা পুরা রামাযান অর্থাৎ ৩০ দিন সিয়াম সাধনা করার ফলে তার মধ্যকার কুপ্রবৃত্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সুপ্রবৃত্তিগুলো পর্যায়ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠে। এভাবে সাধারণ মানুষ আল্লাহর ভয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমস্ত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার অঙ্গীকার করে। ফলে তারা প্রকৃত মুত্তাক্বী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ مَعَ الۡمُتَّقِیۡنَ
‘আর তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয় আল্লাহ তাক্বওয়াশীলদের সাথে থাকেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৪)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
فَاِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُتَّقِیۡنَ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াশীল ব্যক্তিদের ভালবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান : ৭৬)। আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাক্বী ব্যক্তিকেই সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান বলে উল্লেখ করেছেন (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।
গুনাহ মাফের মাধ্যম
রামাযানে ইসলামী দাওয়াতী কাজের আরও একটি প্রভাব হল, দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষ যখন হক্ব চিনতে পারে, সহীহ আমল সম্পাদন করতে পারে এবং রামাযানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। ফলে পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের প্রত্যাশায় রামাযানে সিয়াম পালন করবে, তার পূর্বেকার সকল (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের প্রত্যাশায় রাত্রি ইবাদতে (তারাবীহর ছালাক) অতিবাহিত করবে, তার পূর্বেকৃত সমুদয় (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের প্রত্যাশায় ক্বদরের রাত্রিতে ইবাদত করবে, তার পূর্বের সকল (ছগীরা) গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[৮]
সিয়াম ও কুরআনের সুপারিশ লাভ
মানবজাতির জন্য ক্বিয়ামত এক ভয়ঙ্কর বিষয়। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এ সময়ে সকল মানুষকে এক জায়গায় সমবেত করা হবে। সূর্য মানুষের অত্যন্ত নিকটবর্তী হবে। সিয়াম ও কুরআন সেদিন তাদের মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে। কারণ রামাযানে দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে সে সিয়াম পালনের নছীহত করেছে এবং আল-কুরআনের সাথে জনগণকে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآَنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَقُوْلُ الصِّيَامُ أَي رَبِّ إِنِّي مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهْوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفَّعْنِي فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآَنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفَّعْنِي فِيْهِ فَيُشَفَّعَانِ
‘সিয়াম ও কুরআন ক্বিয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে, হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলায় তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে’।[৯]
আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের সময়টা ছিল মানব ইতিহাসের একটি জঘন্যতম সময়, যাকে ঐতিহাসিকরা ‘জাহেলী যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমন কোন অপরাধ ছিল না, যা সেই সমাজে চালু ছিল না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, যেনা-ব্যভিচার সহ সকল প্রকার অপরাধ তখন সমাজে প্রচলিত ছিল। মানুষ হাটে-বাজারে পশুর মত বেচা-কেনা হত, দাস হিসাবে জীবন-যাপন করত এবং নারী জাতির অবস্থা ছিল আরও করুণ। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি তাদেরকে নৈতিক শক্তিতে গড়ে তুললেন। তাদের দাওয়াতের ফলাফল সম্পর্কে তারা ছিলেন পরিপূর্ণ আস্থাবান। আজকের দিনেও যদি দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে বিশেষ করে রামাযানে মিথ্যাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া, অশ্লীলতা, পরনিন্দা প্রভৃতি পাপাচারমুক্ত সহানুভূতিশীল, পারস্পরিক ভালবাসা, সহযোগিতা, তাক্বওয়াবান একদল আদর্শ লোক গড়ে উঠে, তাহলে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে রামাযানে দাওয়াতী কাজ আদর্শ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনায় দেখা যায় রামাযান মাস আসার অর্ধমাস আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য আকাশ ছোঁয়া। নিত্যপণ্য ক্রয় করতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্টিগেটের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেকে ব্যবসায় মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে, ওযনে কম দেয় ও ভেজালযুক্ত পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রামাযানে ইসলামী দাওয়াতের বিরাট প্রভাব আছে। রামাযানে দাওয়াতের বরকতে আল্লাহ চাহেতো অনেক ব্যবসায়ীর মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে। তারা যদি সিয়াম সাধনার পাশাপাশি অহি-র বিধান মেনে বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে, তাহলে বাজার কেন্দ্রিক যে সমস্ত দুর্নীতি হয়, সেগুলো পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাবে ইনশাআল্লাহ।
সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার সহায়ক
রামাযানে ইসলামী দাওয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তিকে তার সার্বিক কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার অভ্যাসে পরিণত করে সিয়াম। কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী কখন সে সাহারী করবে, কখন ইফতার করবে সবই ঠিক করে নেয়। ঠিক করে নেয় আওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করার সময়, কুরআন তেলাওয়াতের সময়, ইসলামী সাহিত্য পাঠের সময়, দাওয়াতী কাজের সময়, ইসলামী বৈঠকাদিতে যোগদানের সময়, খাওয়া, ঘুমানো প্রভৃতি সব কিছুতেই পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল করে তোলে। এই এক মাসের সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা বাকী ১১টি মাসে তার জীবন পরিচালনার জন্য সঠিক পন্থা তৈরি করতে সহায়তা প্রদান করে।
উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়ক
রাযামানে ইসলামী দাওয়াতে সাড়া দিয়ে প্রশিক্ষণ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যখন কেউ জীবন পরিচালনা করতে শুরু করে, তখন নিজের মধ্য বিভিন্ন প্রকার বদ অভ্যাস, কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে সিয়ামের মাধ্যমে সে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। সহজেই মাদকদ্রব্যের ন্যায় মরণব্যাধি নেশা পরিত্যাগ করে। শক্তি ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি পানাহার বা যৌনাচারে লিপ্ত না হয়ে সুন্দরতম সংযমের অনুশীলন করে। তার মধ্যে ছবর বা ধৈর্যশীলতার দুর্লভ গুণ স্থান করে নেয়। সিয়ামলব্ধ তাক্বওয়া তাকে হিংসা, পরনিন্দা ও পাপাাচরের বিপরীতে কুরআন তেলাওয়াত, দানশীলতা ও ইবাদতে অভ্যস্ত করে তোলে। ফলে ব্যক্তি সুদৃঢ় ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়।
উদাত্ত আহ্বান!
হে ছাত্র ও যুব সমাজ! তোমার রয়েছে প্রখর মেধা, ব্যাপক সময় ও শক্তিমত্তা। এর প্রত্যেকটি আল্লাহর দেয়া আমানত। এসো তা ব্যয় করি আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের একমাত্র উৎস পবিত্র অহি প্রতিষ্ঠার কাজে। আমার বিশ্বাস তোমার প্রচেষ্টায় সত্যের পথ খুঁজে পাবে নর্দমায় পড়ে থাকা অসংখ্য ছাত্র ও যুবক।
হে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও ব্যবসায়ীগণ! আপনাদের রয়েছে সীমাহীন ব্যস্ততা। ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে ফরয ইবাদত সমূহ আদায় করতে হয়। দ্বীনী হক্বের দাওয়াত বর্তমান সময়ে ফরয। এ ফরয ইবাদতটি আমরা যে যেখানে থাকি সেখানেই আমলযোগ্য। আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে থেকে গোটা বিশ্বব্যাপী দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। তাই লেখকদের লেখনী, অর্থ-বিত্তশীলদের অর্থ প্রয়োগ, যান্ত্রিক সভ্যতা ব্যবহারে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ারগণ এবং ডাক্তারী সেবাই নিয়োজিত চিকিৎসকগণ রোগীর প্রতি সৎ উপদেশ দানের মাধ্যমে দ্বীনকে এগিয়ে নিয়ে চলুন। জান্নাত আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ ‘দ্বীন হচ্ছে উপদেশ’।[১০]
হে সম্মানিতা মা ও বোন! বিশ্ব মানচিত্রে নারীদের অবস্থা নিশ্চয় আপনার জানা আছে। বিভিন্ন নারী প্রগতিশীল সংগঠন নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়ন, এন.জি.ও তে আর্থিক সুবিধার নাম করে আধুনিকতার নামে আপনাকে উলঙ্গ করছে, ধর্ষণ করছে, নির্যাতিত হচ্ছে অহরহ। এ অবস্থায় আপনার কী কোন করণীয় নেই? আসুন! আদর্শ নারী, আদর্শ মা ও আদর্শ স্ত্রী হিসাবে গড়ে উঠুন। রামাযান মাসকে প্রশিক্ষণের মাস হিসাবে কাজে লাগান। আপনার পরিবারে ইসলামী দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি আপনার সমাজে পর্দার সীমারেখা রক্ষা করে দাওয়াতী কাজ করুন। দেখবেন সমাজে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসবে এবং সমাজ সংস্কারে প্রভূত কল্যাণ রাখবে ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে বলব, আমাদের উচিত সঠিক দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধন প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা। আর এ জন্য রামাযানে রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭।
[২]. তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৪র্থ খণ্ড, ৪২২; ছালিহ ইবনু আব্দুল আযীয আলে শায়েখ, আল-বাছীরাতু ফিদ দাওয়াতী ইলাল্লাহ, পৃ. ১ ভূমিকা দ্র.।
[৩]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২; তিরমিযী, হা/৬৮২; মিশকাত, হা/১৯৬০।
[৪]. সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৮; মিশকাত, হা/১৯৫৯।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/৫৩১।
[৬]. মুসলিম হা/১১১১; আবুদাঊদ হা/৮৭৫; নাসাঈ হা/১১৩৭; মিশকাত হা/৮৯৪।
[৭]. মুসলিম হা/২৪২৮; সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৭৩৩৮; মুত্তাফাক্ব আলাহই, মিশকাত হা/৭০১।
[৮]. সহীহ বুখারী হা/৩৭, ৩৮, ২০০৯, ২০১৪; সহীহ মুসলিম; হা/৭৫৯, ৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[৯]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/১৯৬৩, সনদ সহীহ।
[১০]. সহীহ মুসলিম, হা/৫৫; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৪৪; মিশকাত, হা/৪৯৬৬।
অধ্যাপক মুহাম্মাদ আকবার হোসাইন
Last edited: