عَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَجُلاً سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَرَأَيْتَ إِذَا صَلَّيْتُ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَاتِ وَصُمْتُ رَمَضَانَ وَأَحْلَلْتُ الْحَلاَلَ وَحَرَّمْتُ الْحَرَامَ وَلَمْ أَزِدْ عَلَى ذَلِكَ شَيْئًا أَأَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَالَ نَعَمْ.
সরল অনুবাদ : জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি বলুন, আমি যদি ছালাত আদায় করি, রামাযানের ছিয়াম পালন করি, হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করি এবং আমি তাতে কোনো কিছু যোগ না করি, তবে কি আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’।[1]
হাদীছটির মর্যাদাগত অবস্থান : অবস্থানগতভাবে হাদীছটি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী এবং এর উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। কারণ আমল দুই ধরনের হয়ে থাকে— (ক) আন্তরিক ও (খ) শারীরিক। আমলগুলো যদি শরীআত অনুমোদিত হয় তবে হালাল, আর যদি নিষিদ্ধ হয় তবে হারাম। সুতরাং যদি কোনো ব্যক্তি হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম হিসেবে গ্রহণ করে, তবে সে ধর্মের সমস্ত কার্য সম্পাদন করল এবং নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশকারীর মর্যাদায় সমাসীন হলো।[2] ইবনে হাজার আল-হাইতামী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হাদীছটি ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলি ও শাখাসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে’।[3] কাযী ঈয়ায রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করি’ অংশটি ঈমান ও সুন্নাতের কার্যাবলিকে অন্তর্ভুক্ত করে।[4]
বর্ণনাকারীর পরিচয় : জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম ইবনে ছা‘লাবা আল-আনছারী আল-খাযরাজী রযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন শ্রেষ্ঠ ছাহাবীগণের একজন। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘হে জাবের! কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! পরিবারের সদস্য এবং ঋণ রেখে আমার পিতা বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তিনি জাবের রযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললেন, ‘হে বৎস! আমি কি তোমাকে তোমার পিতার শুভ সংবাদ দিব না? মহান আল্লাহ তাঁকে জীবিত করে সরাসরি কথা বলেছেন, যা অন্য কারও ক্ষেত্রে করেননি। তিনি বললেন, হে আমার বান্দা! তুমি আমার নিকট তোমার প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করো। তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় জীবিত করুন, আমি আবার শহীদ হতে চাই। আল্লাহ বললেন, আমার ফয়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে, তারা এই পৃথিবীতে আর ফিরে আসবে না’।[5]
তার পিতার ঋণ ছিল, তাই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিতার ঋণের ব্যাপারে এক রাতে আল্লাহর কাছে ২৭ বার ক্ষমা প্রার্থনা করেন। শেষ জীবনে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।[6] ৭৩ বছর বয়সে তিনি মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।[7]
আলোচ্য হাদীছে প্রশ্নকারী ছাহাবীর পরিচয় : তিনি আল-নু‘মান ইবনু ক্বাউক্বাল ইবনু আছরাম রযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আল্লামা বাগাবী রহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, নু‘মান বলেছিলেন, হে রব! আমি আপনার নিকট শপথ করেছি যে, জান্নাতের সবুজ ভূমিতে পা না রাখা পর্যন্ত সূর্য যেন অস্ত না যায়। আর আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি তাকে জান্নাতের সবুজ ভূমিতে বিচরণ করতে দেখেছি’।[8]
হাদীছটির শিক্ষণীয় দিকসমূহ :
(১) ছাহাবীগণ হেদায়াত সম্পর্কে জানার এবং হেদায়াতের সাথে থাকার জন্য আগ্রহী ছিলেন। কোন্ বস্তু মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে, তা জানার জন্য তারা আগ্রহী ছিলেন।[9]
(২) পার্থিব জীবনে মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরাক্রমশালী আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর জান্নাত লাভের জন্য ভালো কাজ করা।[10]
(৩) জান্নাতে প্রবেশের একমাত্র মাধ্যম হলো আমল। ঈমানের পর অন্য সকল আমলের উপর ছালাতের স্থান। তবে ছালাতের হাদীছে উল্লিখিত অন্যান্য বিষয়ও জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।[11]
(৪) রামাযানের ছিয়ামের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রশ্নকারীর জিজ্ঞাসা করার সময় সম্ভবত অন্যান্য বিষয়ের বিধান অবতীর্ণ হয়নি। তাই সেসব সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয়নি।[12]
(৫) ইসলাম যেসব বিষয় পালনের আদেশ দিয়েছে, তা পালন করা এবং যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেছে, তা বর্জন করা জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিষয় হালাল করেছেন, সেগুলোকে হালাল হিসেবে গ্রহণ করা এবং যেসব বিষয় হারাম করেছেন, তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করা একজন প্রকৃত মুমিনের কাজ।[13]
হাদীছটির ব্যাখ্যা : আল্লামা নববী রহিমাহুল্লাহ ইবনু ছালাহ রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করে বলেন, এর (হারামকে হারাম মনে করা) অর্থ এই বিশ্বাস করা যে, এটি হারাম এবং তা থেকে বিরত থাকা। তিনি এর মাধ্যমে দু’টি বিষয়কে বুঝাতে চেয়েছেন। একটি হারাম মনে করা এবং অপরটি তা না করা। তবে হালালকে হালাল মনে করার অর্থ এমন নয়। কেননা এখানে কোনো বস্তুকে হালাল মনে করাই যথেষ্ট। তার সাথে বিশ্বাসকে সংযুক্ত করার প্রয়োজন নেই।[14] (আর এর উপর কোনো বিষয় বৃদ্ধি না করা) বলতে বোঝানো হয়েছে, তিনি খুব নিকটবর্তী সময়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন, তাই তিনি এতটুকুকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারেন, সৎ আমল ও কল্যাণের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং ফরয আমল আদায় তার জন্য সহজতর হয়। কিংবা হতে পারে তিনি জিহাদ বা অন্যান্য সৎকর্মে ব্যস্ত আছেন। নফল ইবাদতে আত্মনিয়োগ করা এখনই তার জন্য সহজ নয়।[15]
(আমি কি জান্নাতে প্রবেশ করব?) অর্থাৎ পূর্ববর্তী শাস্তি ছাড়াই। (তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ) কারণ ইসলাম গ্রহণ না করায় তাঁর যা করার প্রয়োজন ছিল তা তিনি করতে পারেননি।
আল্লাহ যখন তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেন, তখন তাঁকে মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল করে প্রেরণ করেছেন। প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য সবচেয়ে সরল পথের পরিদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেন, যা নিম্নের আয়াতে লক্ষণীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত করে পাঠিয়েছি’ (আল-আম্বিয়া, ২১/১০৭)। এই অর্থকে নিশ্চিত করে এমন অনেক চিত্র আমাদের মনে উদীয়মান, কেননা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে হেদায়াত প্রদান এবং পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করার জন্য সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষের ক্ষমতা ও শক্তির বৈচিত্র্য সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ আল্লাহর অমোঘ সৃষ্টিকৌশলের বড় নিদর্শন হলো, সকল মানুষ একই স্তরের নয়, বরং তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। তাইতো আছ-ছিদ্দীক্ব এবং আল-ফারূক, যারা জাতির নেতৃত্ব প্রদান ও মর্যাদার বিচারে পাহাড়ের চূড়া এবং মেঘের উচ্চতা অতিক্রম করেছিলেন, তাদের মতো মহান ব্যক্তিত্বরা যেমন ছাহাবীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তেমনি তাদের বিপরীতে মরুভূমির বেদুঈন, দুর্বল মহিলা, বয়স্ক পুরুষ এবং অন্যান্য সাধারণ ব্যক্তিও ছাহাবীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা দৃঢ়তায় সর্বনিম্ন এবং কম উচ্চাভিলাষী।
এই হাদীছে একজন ছাহাবী অনুসন্ধিৎসু মনে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন কোন্ আমল তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি জান্নাতে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এটি জান্নাতের সুখের প্রতি যত্ন ও আগ্রহের পরিপূর্ণতার নিদর্শন, পরকালীন জীবনের প্রতি আসক্তির লক্ষণ, শুভ পরিণাম এবং চূড়ান্ত ফলাফল লাভের পরম আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। মুমিনের হৃদয়ে এর উপস্থিতি তার ঈমান ও আন্তরিকতার প্রমাণ, আল্লাহর প্রতি তার আসক্তি এবং নশ্বর জগতের উপর অবিনশ্বর জগতকে প্রাধান্য প্রদানের দলীল।[16] দুনিয়াবিমুখ, জান্নাত লাভে আসক্ত, পরপারের যাত্রী সালাফ তথা পূর্বসূরিদের অবস্থা এমনই ছিল। এ ক্ষেত্রে সবার অগ্রবর্তী ছিলেন আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেন, ‘আমার ও দুনিয়ার কী হয়েছে? আমার ও দুনিয়ার দৃষ্টান্ত একজন পথিকের ন্যায়, যিনি একটি গাছের নিচে বিশ্রাম গ্রহণ করেন, অতঃপর তা ছেড়ে চলে যান’।[17]
এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থা ছিল খুবই বিস্ময়কর। উক্ববা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিকেলে মদীনায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে ছালাত পড়লাম, অতঃপর তিনি দ্রুত উঠে লোকদের ঘাড় অতিক্রম করে তাঁর কোনো স্ত্রীর নিকটে গেলেন। অতঃপর লোকেরা তার গতি দেখে ভয় পেয়ে গেল। অতঃপর তিনি তাদের নিকট বের হয়ে আসলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের নিকট যাকাতের যে স্বর্ণ ছিল তা আমার স্মরণে এসে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই হয়তো আল্লাহর নিকট এর জবাবদিহি করতে হবে’। অতঃপর তিনি তা মানুষের মধ্যে বণ্টন করে দিতে বললেন।[18]
আর যে কেউ আমাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করে সে দেখতে পায়, আমাদের মধ্যে অনেকেই তার হৃদয়কে দুনিয়ার সাথে সংযুক্ত করে, এর সাজসজ্জায় মুগ্ধ হয়, এর ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করে তার হৃদয় পরকালকে ভুলে যায়, এর জন্য কাজ করার চেষ্টা করে না এবং এর প্রতিদান অর্জনের চেষ্টা করে না।
তিনি বলেন, আমি ফরয ছালাত আদায় করি, রামাযানের ছিয়াম রাখি, হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করি এবং এর চেয়ে বেশি আর কোনো আমল করতে চাই না, তবে কি আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব?
এ প্রশ্ন বেশ কয়েকজন ছাহাবী রযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বিভিন্নরূপে এবং বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ত্বলহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নাজদের অধিবাসী এলোমেলো চুলবিশিষ্ট একজন লোক নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলেন। তাঁর গুনগুন শব্দ শুনা যাচ্ছিল, তবে তিনি কী বলছিলেন বুঝা যায়নি। তিনি ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করবে’। তিনি বললেন, এ ছাড়া আর কোনো ছালাত? তিনি বললেন, ‘না, তবে নফল ছালাত পড়তে পারবে’। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাকে রামাযানের এক মাস ছিয়াম রাখতে হবে’। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ ছাড়া আর কোনো ছিয়াম? তিনি বললেন, ‘না, তবে নফল ছিয়াম আদায় করতে পার’। তিনি তাঁকে যাকাত আদায়ের কথা বললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ ছাড়া আর কোনো যাকাত? তিনি বললেন, ‘না, তবে নফল ছাদাক্বা করতে পার’। বর্ণনাকারী বলছেন, তিনি চলে যাওয়ার সময় বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি এতে কোনো বেশি ও কম করব না। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তিনি সত্য বলে থাকলে তিনি পরিত্রাণ পেয়ে গেছেন’।[19]
আবূ আইয়ূব আনছারী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, আমাকে এমন কিছু আমলের কথা বলুন, যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কোনো কিছু শরীক করো না, ছালাত ক্বায়েম করো, যাকাত দাও এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো’।[20]
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যে প্রশ্নকারী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এই হাদীছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যার আলোচনায় এখন আমরা আছি, তিনি নিজের জন্য যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তা বেছে নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। কারণ তিনি ফরয ছালাতের কথা উল্লেখ করেছেন, যা আল্লাহকে এক হিসেবে বিশ্বাস এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাতে বিশ্বাসের পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান। এমনকি এর বর্জনকারী সম্পূর্ণরূপে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। ছহীহ হাদীছে বলা হয়েছে, ‘আমাদের এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, তা হলো ছালাত, যে ছালাত বর্জন করব সে কাফের’।[21]
ছালাতের পর তিনি রামাযানের ছিয়ামের কথা উল্লেখ করেছেন, যা ইসলামের অন্যতম বড় স্তম্ভ, যার উপর মুসলিমরা একমত পোষণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা এর জন্য মহান ছওয়াবের ব্যবস্থা করেছেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম রাখবে, তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’।[22]
অতঃপর তিনি ইসলামী শরীআত ও বিধানের সীমায় দাঁড়িয়ে আল্লাহ তাআলার কিতাবে যা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতে যা বর্ণিত হয়েছে তা অনুসরণ এবং উক্ত উৎসদ্বয়ে যা নিষেধ করা হয়েছে তা পরিহারের পূর্ণ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ফযীলত ও পছন্দনীয় আমলের কোনোরূপ সংযোজন-বিয়োজন না করে।
এই হাদীছে যাকাত ও হজ্জের কথা উল্লেখ করা হয়নি। যদিও উভয় ইবাদতের গুরুত্ব অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে কম নয়। কারণ হজ্জ, যাকাত এবং অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য আছে। মুকাল্লাফ তথা যাদের উপর শারঈ বিধান আরোপ করা হয়েছে, হজ্জ ও যাকাতের আবশ্যকতা তাদের সকলকে শামিল করে না। কেননা হজ্জ কেবল সক্ষম ব্যক্তির উপর আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا ‘আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে মানুষের মধ্যে তাদের উপর হজ্জ করা ফরয, যারা সেখানে পৌঁছাতে সক্ষম’ (আলে ইমরান, ৩/৯৭)। তাছাড়া যারা নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়, তাদের উপর যাকাত ফরয নয়। আবার হতে পারে যাকাত বা হজ্জ ফরয হওয়ার পূর্বে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। কারণ হজ্জ অষ্টম হিজরীতে ফরয হয়েছিল আর যাকাত যদিও মক্কায় ফরয হয়েছিল কিন্তু নিছাবের পরিমাণ তখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট ছিল না। নিছাবের বিধান মদীনায় কার্যকর হয়েছিল। অথবা যাকাত ও হজ্জ হালালকে হালাল মনে করা এবং হারামকে হারাম মনে করার বিধানের অন্তর্ভুক্ত।[23]
এখানে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ হলো, জান্নাতে প্রবেশের জন্য উক্ত সুস্পষ্ট পন্থা মেনে চলাই যথেষ্ট। এতে ইসলামের সহজতা ও সহনশীলতা প্রতিফলিত হয় আর কষ্ট ও কাঠিন্য থেকে মুক্তির পথ প্রতীয়মান হয়। ঈমান বৃদ্ধির আমল সহজতর হয়, ইবাদতে আত্মনিয়োগ ও শারঈ বিধান পালন আনন্দদায়ক হয়। মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যের সীমানার মধ্যে থাকা স্বাভাবিক হয়। এটি এই উম্মতের বিশেষ বিশেষত্ব, যা তাকে মর্যাদায় অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করেছে।[24]
কিন্তু এমন একটি বিষয় আছে, যা উল্লেখ না করে পারা যায় না। তা হলো বান্দার আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী আনুগত্যের অঙ্গীকার করা এবং হারাম বিষয়গুলো পরিহার ও পরিত্যাগ করার জন্য আন্তরিক সংকল্প করা। আত্মার পবিত্রতার জন্য সত্যিকারের সংগ্রাম করতে হবে।
জান্নাত অত্যন্ত মূল্যবান বিষয় আর এর মূল্য পাওয়া যায় সৎকর্মের মাধ্যমে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ‘এই হলো জান্নাত তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করা হয়েছে, কারণ তোমরা (সৎ) আমল করেছিলে’ (আয-যখরুফ, ৪৩/৭২)।
আর যদি বান্দার উদ্দেশ্য সত্য হয়, তবে সে আবশ্যকভাবে জান্নাতের উত্তরাধিকারী হবে।
যা-ই হোক না কেন, যারা আল্লাহর পথের প্রচারক, তাদের অবশ্যই এই ধর্মের প্রকৃতি বুঝতে হবে, যাতে তারা মানুষকে এর মূলনীতি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে পারে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করেন এবং বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর প্রশংসা করার তাওফীক্ব দেন।
হারামকে হারাম মনে করার অর্থ হলো, এ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা এবং হালালকে হালাল মনে করার অর্থ এই বিশ্বাস পোষণ করা, যে কাজটি করা জায়েয।
ইমাম কুরতূবী রহিমাহুল্লাহ তার আল-মুফহিম গ্রন্থে বলেন, এই হাদীছে প্রশ্নকারীর নিকট রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নফল ইবাদত সম্পর্কে কোনো কথা উল্লেখ না করা এ কথার ইঙ্গিত বহন করে যে, নফল ইবাদত আদায়ে শরীআত কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি; তবে সে নিজেকে একটি মহান মুনাফা ও বিশাল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেছে। তবে যে ব্যক্তি অব্যাহতভাবে সুন্নাহর আমল বাদ দিতে থাকবে, সে দ্বীনী বিষয়ে অভাববোধ করবে এবং তার ন্যায়ভিত্তিক আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর যদি সে অবজ্ঞা প্রদর্শনপূর্বক কিংবা অনাগ্রহবশত বর্জন করে, তবে তা পাপাচার হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য সে নিন্দিত হবে। জ্ঞানীগণ বলেন, যদি কোনো জনপদবাসী কোনো সুন্নাত ত্যাগ করার ব্যাপারে একমত পোষণ করে, তবে তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদেরকে হত্যা করা হতো। প্রথম শ্রেণি থেকে সাধারণ শ্রেণি পর্যন্ত সকল ছাহাবী সুন্নাহ ও ফযীলতের আমল পালনে অবিচল থাকতেন, ফরয ইবাদত আদায়ে অটল থাকতেন এবং এর ছওয়াব লাভে ধন্য হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না।[25]
সংক্ষিপ্ত অথচ স্থায়ী আমল কম করেও জান্নাতে যাওয়া যায়। তবে নিখাদ আন্তরিকতা, গভীর ভালোবাসা এবং চূড়ান্ত শ্রদ্ধা দিয়ে আমলে ছালেহ করার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু আমরা অনেক সময় পরম আন্তরিকতার সাথে ফরয ইবাদতসমূহ সম্পাদন করতে পারি না; ফলে তাতে ঘাটতি পড়ে যায়। যেহেতু নফল ইবাদতের মাধ্যমে ফরযের ঘাটতি পূরণ করা হবে, সেহেতু নফল ইবাদতের প্রতি অনাগ্রহ প্রদর্শন নিঃসন্দেহে চরম নির্বুদ্ধিতার কাজ। তাই নফল ইবাদতের প্রতি অনাগ্রহ নয়; বরং ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নিখাদ আন্তরিকতা ও পরম শ্রদ্ধার সাথে নফল ইবাদত সম্পাদন করাও উচিত। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন- আমীন!
- মাসিক আল-ইতিছাম
মুহাম্মদ মুস্তফা কামাল
প্রভাষক (আরবী), বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বরিশাল।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫।
[2]. মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-জুরদানী, আল-জাওয়াহিরুল লু’লু’ইয়াহ শারহুল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যাহ, পৃ. ২১৩।
[3]. আল-ফাতহুল মুবীন, পৃ. ১৬২।
[4]. ইবনু খিলফাহ আল-উব্বী, ইকমালু ইকমালিল মু‘লিম ফী শারহি ছহীহি মুসলিম, ১/১৪২।
[5]. ইবনে কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/১৮৫।
[6]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তিআব ফী মা‘রেফাতিছ ছাহাবা, ১/২২০।
[7]. প্রাগুক্ত।
[8]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আল-ইছাবা ফী তাময়ীযিছ ছাহাবা, ৩/৫৬৪।
[9]. আল-উছায়মীন, শারহুল আরবাঈন আন-নাবাবিয়্যা, পৃ. ২১৫।
[10]. আরবাঊন আন-নাবাবিয়্যা, পৃ. ৭৫।
[11]. প্রাগুক্ত।
[12]. আল-আব্বাদ, ফাতহুল ক্বয়ী আল-মাতীন, পৃ. ৭৭।
[13]. প্রাগুক্ত।
[14]. ইমাম নববী, শারহু মুসলিম, ১/১৭৫।
[15]. ইমাম নববী, শারহু মুসলিম, ১/১৬৭; মূসা শাহীন লাশীন, ফাতহুল মুনঈম শারহু ছহীহ মুসলিম, ১/৫২।
[16]. ফাতহুল মুনঈম শারহু ছহীহ মুসলিম, ১/৫০।
[17]. তিরমিযী, হা/২৩৭৭; ইবনু মাজাহ, হা/৪১০৯; আহমাদ, হা/৩৭০৯।
[18]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৫১।
[19]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯১।
[20]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৯৬।
[21]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮২।
[22]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮।
[23]. ফাতহুল মুনঈম শারহু ছহীহ মুসলিম, ১/৫২।
[24]. প্রাগুক্ত, ১/৫১।
[25]. কুরতুবী, আল-মুফহিম শারহু মুসলিম, ১/১৬৬।
Last edited: