ভূমিকা
পৃথিবীতে যত খারাপ চরিত্র রয়েছে যুলম বা অত্যাচার তার অন্যতম। এটি একটি জঘন্য স্বভাব। দুর্বলের উপর সবলের প্রভাব বিস্তারের অন্যায় রীতি পৃথিবীর আদিকাল থেকে চলমান। অত্যাচারিত ব্যক্তিরা দুর্বল হওয়ায় এর প্রতিরোধও করা সম্ভব হয় না। অথচ এই অত্যাচার একদিন ঐ ব্যক্তির জীবনে অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনবে। কিন্তু সে দিন অত্যাচারী কোন সুহৃদয় সুপাররিশকারীও পাবে না, পাবে না সাহায্যকারীও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যালিমদের জন্য পরকালে কোন দরদী বন্ধু থাকবে না এবং তাদের জন্য কোন সুপারিশকারীও হবে না, যার কথা মান্য করা হবে’ (সূরা আল-মুমিন : ১৮)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭১)।
যুলমের পরিচয়
যুলম (الظلم) শব্দটি আরবী। এটি নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন, উৎপীড়ন, অন্যায় আচরণ ও অপাত্রে স্থাপন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে যুলমের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অর্থ হল-
‘শাব্দিক অর্থ হল- কোন কিছুকে তার উপযুক্ত স্থানে না রেখে অন্যস্থানে রাখা’। আর শারঈ অর্থ হল- ‘অন্যের অধিকারের ব্যাপারে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করা বা সীমালঙ্ঘন করা’।[১]
আল-কাফাভী (রাহিমাহুল্লাহ) যুলমের সংজ্ঞায় ‘শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন’-এর কথা বলেছেন’।[২] অর্থাৎ কেউ যদি শরী‘আতের নির্দেশনার বাইরে চলে, তাহলে সে মূলত নিজের উপরই যুলম করে থাকে।
আল-কুরআনে ‘যুলম’ শব্দটি ‘শিরক’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘প্রকৃতপক্ষে তারাই শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী। যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে যুলমের সাথে সংমিশ্রিত করেনি, তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-আন‘আম : ৮২)।
উক্ত আয়াতে بِظُلۡمٍ শব্দ দ্বারা শিরককে বুঝানো হয়েছে। হাদীসে এসেছে,
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল ‘ঐ সমস্ত লোক যারা ঈমান এনেছে এবং যুলম তথা অত্যাচারের সাথে তাদের ঈমানকে মিশ্রিত করেনি’ শেষ পর্যন্ত, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদের নিকট এই বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন মনে হল এবং তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে নিজের উপরে অত্যাচার করেনি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এর অর্থ তা নয়, বরং এখানে অত্যাচার দ্বারা শিরককে বুঝানো হয়েছে। তোমরা কি লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, হে বৎস! তুমি আল্লাহর সাথে শরীক কর না। নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় যুলম। অপর এক বর্ণনায় আছে, প্রকৃতপক্ষে তা নয় যা তোমরা ধারণা করেছ, বরং তা হল অনুরূপ, যা লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন।[৩]
অতএব মৌলিকভাবে কাউকে প্রাপ্য অধিকার না দেয়াই হল যুলম। সাধারণ অর্থে কাউকে অন্যায়ভাবে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোন পন্থায় অবিচার বা নির্যাতন করাকে যুলম বলে। তবে যুলমের সবচেয়ে ব্যাপক অর্থবহ সংজ্ঞা হল- ‘কোন কিছু নিজ স্থান বাদ দিয়ে অন্য কোন স্থানে প্রয়োগ করা বা রাখা’। কেননা সব ধরনের যুলম এ সংজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, যুলম আল্লাহর ক্ষেত্রে হতে পারে। যেমন, শিরক করা, আল্লাহর অবাধ্য হওয়া ইত্যাদি। আবার বান্দার ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন কারো অধিকার নষ্ট করা। অনুরূপভাবে নিজের ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন, নানাবিধ পাপাচারে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
যুলমের প্রকারসমূহ
বিশেষজ্ঞগণ যুলম বা অত্যাচারকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা :
প্রথম প্রকার : মানুষ ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যুলম
যুলমের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় যুলম। অর্থাৎ কুফর, শিরক, নিফাক্ব এবং আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপের মাধ্যমে আল্লাহর উপর যুলম করা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় যুলম’ (সূরা লুক্বমান : ১৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? এরূপ লোকদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে পেশ করা হবে এবং সাক্ষীগণ (ফিরিশতাগণ) বলবেন, এরা ঐ লোক যারা নিজেদের প্রতিপালকের সম্বন্ধে মিথ্যা কথা আরোপ করেছিল, জেনে রেখ! এমন অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ’ (সূরা হূদ : ১৮)।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করাও আল্লাহর প্রতি যুলম করার শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا ‘আর ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী কে হতে পারে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করেছে?’ (সূরা আল-আন‘আম : ৯৩)। এমনকি সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি যুলম করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বলে এবং যখন তার নিকট সত্য আসলে প্রত্যাখান করে, তার অপেক্ষা অধিক যালিম আর কে’? (সূরা আয-যুমার : ৩২)।
দ্বিতীয় প্রকার : মানুষ ও অন্যান্য মানুষের মাঝে যুলম
এতদুদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয়, তার বিনিময় আল্লাহর নিকট আছে। নিশ্চয় আল্লাহ যালিমদেরকে পসন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিশোধ নেয়, তাদের বিরুদ্ধে দোষারোপের কোন সুযোগ নেই। শুধু তাদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা হবে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে’ (সূরা আশ-শূরা : ৪০-৪২)।
সুধী পাঠক! এই প্রকার যুলম আবার দুই প্রকার। যথা : ১. কথার মাধ্যমে যুলম এবং ২. কাজ বা কর্মের মাধ্যমে যুলম। যেমন,
১. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা কর না; কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি; কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে; সে তো সাহায্য পাপ্ত হয়েছেই’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৩)।
২. দ্বীনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরার কারণে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা।
৩. অন্যায়ভাবে কারো কোন জমি বা অন্যকিছু দখল করা : এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি অত্যাচার করে অর্ধহাত যমীন দখল করেছে, নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন অনুরূপ সাতটি যমীন তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে’।[৪]
৪. পরিবারের সদস্যদের প্রতি যুলম করা। এ ব্যাপারে নিম্নের কয়েকটি বিষয় দৃষ্টি আর্কষণ করছি :
৫. কর্মচারীদের প্রতি যুলম করা : এক্ষেত্রে নিম্নোক্তভাবে যুল্ম করা হয়। যেমন,
৬. অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণ করা : কারো মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা অন্যতম একটি যুলম বা অত্যাচার। এটিও কয়েক প্রকার হতে পারে। যেমন,
তৃতীয় প্রকার : মানুষ ও তার নিজের মাঝে যুলম
মানুষ প্রথমেই তার নিজের প্রতিই যুলম বা অত্যাচার করে থাকে। এটিই যুলমের প্রকৃতি।[১৩]
এতদুদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আল্লাহ তাদের প্রতি কোন যুলম করেননি, কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলম করত’ (সূরা আন-নাহল : ৩৩)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
‘তারা আমার কোন অনিষ্ট করেনি, বরং তারা নিজেদেরই অনিষ্ট করেছিল’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৫৭)। তিনি আরো বলেন, فَمِنۡہُمۡ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِہٖ ‘তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী’ (সূরা আল-ফাত্বির : ৩২)।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যুলমের অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। তন্মধ্যে মানুষ নিজের নফসের প্রতি যে যুলম করে সেটা কয়েকভাবে হতে পারে। উল্লেখ্য, এই প্রকার যুলম বা অত্যাচার বান্দার নিজের সাথে হলে সবটাই আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সংঘটিত হওয়া যুলম। যেমন,
‘এবং যে কেউ আল্লাহর মসজিদসমূহের মধ্যে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে নিষেধ করেছে এবং তা ধ্বংস করতে প্রয়াস চালিয়েছে- তার অপেক্ষা কে অধিক অত্যাচারী? এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে শঙ্কিত অবস্থায়ই তন্মধ্যে প্রবেশ করা উচিত; তাদের জন্য ইহলোকের দুর্গতি এবং পরলোকে কঠোর শাস্তি রয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৪)।
‘তোমরা কি বলছো যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের বংশধর ইয়াহুদী কিংবা খ্রিষ্টান ছিলেন? তুমি বল, তোমরাই সঠিক জ্ঞানী না আল্লাহ? আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য যে ব্যক্তি গোপন করছে সে অপেক্ষা কে বেশি অত্যাচারী? এবং তোমরা যা করছো তা হতে আল্লাহ অমনোযোগী নন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪০)।
‘কোন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর সে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়, তবে তার অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী আর কে? আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদেরকে বধির করেছি; তুমি তাদেরকে সৎপথে আহ্বান করলেও তারা কখনও সৎপথে আসবে না’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৫৭)।
‘যে ব্যক্তি বিনা প্রমাণে না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে এরূপ মিথ্যা আরোপ করে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৪৪)।
তথ্যসুত্র :
[১]. দালীলুল ফালিহীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৫।
[২]. আবুল বাক্বা আইয়ূব ইবন মূসা আল-হাসীনী আল-কাফাভী, কিতাবুল কুল্লিয়াত (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪১৯ হি./১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ৫৯৪।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/৩৪২৯; সহীহ মুসলিম, হা/১২৪; মিশকাত, হা/৫১৩১।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/৩১৯৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৬১০; মিশকাত, হা/২৯৩৮।
[৫] সহীহ বুখারী, হা/২৬৫০।
[৬] সহীহ বুখারী, হা/২২২৭, ২২৭০; মিশকাত, হা/২৯৮৪।
[৭] সহীহ বুখারী, হা/৩০, ২৫৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৪৬৯।
[৮] জাবির ইবনু মূসা ইবনু আব্দিল কাদির ইবনু জাবির আবূ বকর আল-জাযাইরী, আইসাসীরুত তাফাসীর লিকালামিল ‘আলিয়্যিল কাবীর (মদীনা মুনাওয়ারা : মাকতাবাতুল ঊলূম ওয়াল হিকাম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৬।
[৯] আবূ দাঊদ, হা/৩৫৪১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৪৬৫; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৬২৪; মিশকাত, হা/৩৭৫৭, সনদ হাসান ।
[১০] আবূ দাউদ, হা/৩৫৮০; তিরমিযী, হা/১৩৩৭; ইবনু মাজাহ, হা/২৩১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৩২; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২২১১; মিশকাত, হা/৩৭৫৩, সনদ সহীহ ।
[১১] সহীহ মুসলিম, হা/১০২; মিশকাত, হা/২৮৬০।
[১২] সহীহ বুখারী, হা/৬৬৩৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৩২; মিশকাত, হা/১৭৭৯।
[১৩] আবুল কাসেম আল-হুসাইন ইবনু মুহাম্মাদ রাগিব আল-ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন (দামেস্ক : দারুল কলম, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি.), পৃ. ৫৩৮।
[১৪] তাক্বীউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, জামিঊল মাসাইল (দারু ‘আলিমিল ফাওয়ায়েদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২২ হি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৩৪।
[১৫] সহীহ বুখারী, হা/৩৪২৯; সহীহ মুসলিম, হা/১২৪; মিশকাত, হা/৫১৩১।
[১৬] জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৮৪।
[১৭] তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৬৯।
পৃথিবীতে যত খারাপ চরিত্র রয়েছে যুলম বা অত্যাচার তার অন্যতম। এটি একটি জঘন্য স্বভাব। দুর্বলের উপর সবলের প্রভাব বিস্তারের অন্যায় রীতি পৃথিবীর আদিকাল থেকে চলমান। অত্যাচারিত ব্যক্তিরা দুর্বল হওয়ায় এর প্রতিরোধও করা সম্ভব হয় না। অথচ এই অত্যাচার একদিন ঐ ব্যক্তির জীবনে অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনবে। কিন্তু সে দিন অত্যাচারী কোন সুহৃদয় সুপাররিশকারীও পাবে না, পাবে না সাহায্যকারীও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ حَمِیۡمٍ وَّ لَا شَفِیۡعٍ یُّطَاعُ
‘যালিমদের জন্য পরকালে কোন দরদী বন্ধু থাকবে না এবং তাদের জন্য কোন সুপারিশকারীও হবে না, যার কথা মান্য করা হবে’ (সূরা আল-মুমিন : ১৮)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ نَّصِیۡرٍ
‘যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না’ (সূরা আল-হজ্জ : ৭১)।
যুলমের পরিচয়
যুলম (الظلم) শব্দটি আরবী। এটি নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন, উৎপীড়ন, অন্যায় আচরণ ও অপাত্রে স্থাপন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে যুলমের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অর্থ হল-
هو لغة: وضع الشيء في غير محله. وشرعاً: التصرف في حق الغير بغير حق، أو مجاوزة الحد
‘শাব্দিক অর্থ হল- কোন কিছুকে তার উপযুক্ত স্থানে না রেখে অন্যস্থানে রাখা’। আর শারঈ অর্থ হল- ‘অন্যের অধিকারের ব্যাপারে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করা বা সীমালঙ্ঘন করা’।[১]
আল-কাফাভী (রাহিমাহুল্লাহ) যুলমের সংজ্ঞায় ‘শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন’-এর কথা বলেছেন’।[২] অর্থাৎ কেউ যদি শরী‘আতের নির্দেশনার বাইরে চলে, তাহলে সে মূলত নিজের উপরই যুলম করে থাকে।
আল-কুরআনে ‘যুলম’ শব্দটি ‘শিরক’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَہُمۡ بِظُلۡمٍ اُولٰٓئِکَ لَہُمُ الۡاَمۡنُ وَ ہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ
‘প্রকৃতপক্ষে তারাই শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী। যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে যুলমের সাথে সংমিশ্রিত করেনি, তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আল-আন‘আম : ৮২)।
উক্ত আয়াতে بِظُلۡمٍ শব্দ দ্বারা শিরককে বুঝানো হয়েছে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ ابْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ لَمَّا نَزَلَتْ اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَہُمۡ بِظُلۡمٍ شَقَّ ذَلِكَ عَلَى أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ وَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أَيُّنَا لَمْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ لَيْسَ ذَاكَ إِنَّمَا هُوَ الشِّرْكُ أَلَمْ تَسْمَعُوْا قَوْلَ لُقْمَانَ لِاِبْنِهِ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِکۡ بِاللّٰہِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ ؟ وَفِيْ رِوَايَةٍ لَيْسَ هُوَ كَمَا تَظُنُّوْنَ إِنَّمَا هُوَ كَمَا قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল ‘ঐ সমস্ত লোক যারা ঈমান এনেছে এবং যুলম তথা অত্যাচারের সাথে তাদের ঈমানকে মিশ্রিত করেনি’ শেষ পর্যন্ত, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদের নিকট এই বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন মনে হল এবং তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে নিজের উপরে অত্যাচার করেনি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এর অর্থ তা নয়, বরং এখানে অত্যাচার দ্বারা শিরককে বুঝানো হয়েছে। তোমরা কি লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, হে বৎস! তুমি আল্লাহর সাথে শরীক কর না। নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় যুলম। অপর এক বর্ণনায় আছে, প্রকৃতপক্ষে তা নয় যা তোমরা ধারণা করেছ, বরং তা হল অনুরূপ, যা লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন।[৩]
অতএব মৌলিকভাবে কাউকে প্রাপ্য অধিকার না দেয়াই হল যুলম। সাধারণ অর্থে কাউকে অন্যায়ভাবে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোন পন্থায় অবিচার বা নির্যাতন করাকে যুলম বলে। তবে যুলমের সবচেয়ে ব্যাপক অর্থবহ সংজ্ঞা হল- ‘কোন কিছু নিজ স্থান বাদ দিয়ে অন্য কোন স্থানে প্রয়োগ করা বা রাখা’। কেননা সব ধরনের যুলম এ সংজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, যুলম আল্লাহর ক্ষেত্রে হতে পারে। যেমন, শিরক করা, আল্লাহর অবাধ্য হওয়া ইত্যাদি। আবার বান্দার ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন কারো অধিকার নষ্ট করা। অনুরূপভাবে নিজের ক্ষেত্রেও হতে পারে। যেমন, নানাবিধ পাপাচারে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
যুলমের প্রকারসমূহ
বিশেষজ্ঞগণ যুলম বা অত্যাচারকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা :
প্রথম প্রকার : মানুষ ও আল্লাহ তা‘আলার মাঝে যুলম
যুলমের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় যুলম। অর্থাৎ কুফর, শিরক, নিফাক্ব এবং আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপের মাধ্যমে আল্লাহর উপর যুলম করা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ
‘নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় যুলম’ (সূরা লুক্বমান : ১৩)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا ؕ اُولٰٓئِکَ یُعۡرَضُوۡنَ عَلٰی رَبِّہِمۡ وَ یَقُوۡلُ الۡاَشۡہَادُ ہٰۤؤُلَآءِ الَّذِیۡنَ کَذَبُوۡا عَلٰی رَبِّہِمۡ ۚ اَلَا لَعۡنَۃُ اللّٰہِ عَلَی الظّٰلِمِیۡنَ
‘আর ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? এরূপ লোকদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে পেশ করা হবে এবং সাক্ষীগণ (ফিরিশতাগণ) বলবেন, এরা ঐ লোক যারা নিজেদের প্রতিপালকের সম্বন্ধে মিথ্যা কথা আরোপ করেছিল, জেনে রেখ! এমন অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ’ (সূরা হূদ : ১৮)।
আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করাও আল্লাহর প্রতি যুলম করার শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا ‘আর ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী কে হতে পারে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করেছে?’ (সূরা আল-আন‘আম : ৯৩)। এমনকি সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি যুলম করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَذَبَ عَلَی اللّٰہِ وَ کَذَّبَ بِالصِّدۡقِ اِذۡ جَآءَہٗ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বলে এবং যখন তার নিকট সত্য আসলে প্রত্যাখান করে, তার অপেক্ষা অধিক যালিম আর কে’? (সূরা আয-যুমার : ৩২)।
দ্বিতীয় প্রকার : মানুষ ও অন্যান্য মানুষের মাঝে যুলম
এতদুদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ جَزٰٓؤُا سَیِّئَۃٍ سَیِّئَۃٌ مِّثۡلُہَا ۚ فَمَنۡ عَفَا وَ اَصۡلَحَ فَاَجۡرُہٗ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیۡنَ- وَ لَمَنِ انۡتَصَرَ بَعۡدَ ظُلۡمِہٖ فَاُولٰٓئِکَ مَا عَلَیۡہِمۡ مِّنۡ سَبِیۡلٍ- اِنَّمَا السَّبِیۡلُ عَلَی الَّذِیۡنَ یَظۡلِمُوۡنَ النَّاسَ
‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধন করে নেয়, তার বিনিময় আল্লাহর নিকট আছে। নিশ্চয় আল্লাহ যালিমদেরকে পসন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিশোধ নেয়, তাদের বিরুদ্ধে দোষারোপের কোন সুযোগ নেই। শুধু তাদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা হবে, যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে’ (সূরা আশ-শূরা : ৪০-৪২)।
সুধী পাঠক! এই প্রকার যুলম আবার দুই প্রকার। যথা : ১. কথার মাধ্যমে যুলম এবং ২. কাজ বা কর্মের মাধ্যমে যুলম। যেমন,
- কথার মাধ্যমে যুলম হল- মানুষের নামে গীবত করা, চোগলখোরী করা, গালিগালাজ করা, অন্যকে তিরস্কার বা ভর্ৎসনা করা, তুচ্ছজ্ঞান করা, মন্দনামে আহ্বান করা, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা, পরিহাস করা, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদি।
- কাজ বা কর্মের মাধ্যমে যুলমের কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ وَ مَنۡ قُتِلَ مَظۡلُوۡمًافَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِیِّہٖ سُلۡطٰنًا فَلَا یُسۡرِفۡ فِّی الۡقَتۡلِ ؕ اِنَّہٗ کَانَ مَنۡصُوۡرًا
‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা কর না; কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি; কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে; সে তো সাহায্য পাপ্ত হয়েছেই’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৩)।
২. দ্বীনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরার কারণে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা।
৩. অন্যায়ভাবে কারো কোন জমি বা অন্যকিছু দখল করা : এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ أَخَذَ شِبْرًا مِّنَ الْأَرْضِ ظُلْمًا فَإِنَّهُ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرْضِيْنَ
‘যে ব্যক্তি অত্যাচার করে অর্ধহাত যমীন দখল করেছে, নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন অনুরূপ সাতটি যমীন তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে’।[৪]
৪. পরিবারের সদস্যদের প্রতি যুলম করা। এ ব্যাপারে নিম্নের কয়েকটি বিষয় দৃষ্টি আর্কষণ করছি :
- সন্তান-সন্ততি কর্তৃক পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।
- স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মোহর, ভরণপোষণ ও পোশাক-পরিচ্ছদ প্রদান না করা।
- স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর অধিকারে কমতি করা ও তার অনুগ্রহের অস্বীকার করা।
- কন্যা সন্তানের প্রতি যুলম করা অর্থাৎ তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন কঠোরতা আরোপ করা। যেমন তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
- সন্তানদের জন্য দু‘আ না করা এবং বৈষয়িক ক্ষেত্রসমূহে নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করা।
- এক সন্তানকে অপর সন্তান থেকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা। অথচ এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। যেমন, নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মা আমার পিতাকে তার মালের কিছু আমাকে দান করতে বললেন। পরে তা দেয়া ভাল মনে করলে আমাকে তা দান করেন। তিনি (আমার মা) তখন বললেন, নবী (ﷺ)-কে সাক্ষী মানা ব্যতীত আমি রাযী নই। অতঃপর তিনি (আমার পিতা) আমার হাত ধরে আমাকে নবী (ﷺ)-এর নিকট নিয়ে গেলেন, আমি তখন বালক মাত্র। তিনি বললেন, এর মা বিনতে রাওয়াহা একে কিছু দান করার জন্য আমার নিকট আবেদন জানিয়েছে। তিনি (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, সে ব্যতীত তোমার আর কোন ছেলে আছে? তিনি বললেন, আছে। নু‘মান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমার মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন, আমাকে অন্যায় কাজে সাক্ষী করবেন না। আর আবূ হারীয (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম শা‘বী (রাহিমাহুল্লাহ) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আমি অন্যায় কাজে সাক্ষী হতে পারি না।[৫]
৫. কর্মচারীদের প্রতি যুলম করা : এক্ষেত্রে নিম্নোক্তভাবে যুল্ম করা হয়। যেমন,
- কর্মচারীদের কাজের যথাযথ বিনিময় প্রদান না করা করা যুলম। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
- ثَلَاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أَعْطَى بِيْ ثُمَّ غَدَرَ وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيْرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ أَجْرَهُ
- . ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। (ক) যে ব্যক্তি আমার নামে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে তা ভঙ্গ করেছে (খ) যে ব্যক্তি স্বাধীন মানুষকে বিক্রয় করে তার মূল্য খেয়েছে এবং (গ) যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে পূর্ণ কাজ করে নিয়েছে কিন্তু তার প্রাপ্য মজুরী প্রদান করেনি’।[৬]
- কর্মচারীদের অধিকার প্রদানে হ্রাস করা এবং সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করে নেয়া।
- কর্মচারীর সামর্থ্যরে বাইরে তার উপর কাজ চাপিয়ে দিয়ে এবং এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য না করে কষ্ট প্রদান করা। নিম্নের হাদীসটি খেয়াল করুন! মা‘রূর ইবনু সুওয়াইদ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি আবূ যার গিফারী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দেখা পেলাম। তার গায়ে তখন এক জোড়া কাপড় আর তার ক্রীতদাসের গায়েও (অনুরূপ) এক জোড়া কাপড় ছিল। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, একবার এক ব্যক্তিকে আমি গালি দিয়েছিলাম। সে নবী (ﷺ)-এর কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তখন নবী (ﷺ) আমাকে বললেন, তুমি তার মার প্রতি কটাক্ষ করে তাকে লজ্জা দিলে? তারপর তিনি বললেন, তোমাদের গোলামরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্ত করেছেন, কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে তবে সে যা খায়, তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে, তা হতে যেন পরিধান করায় এবং তাদের সাধ্যাতীত কোন কাজে বাধ্য না করে। তোমরা যদি তাদের শক্তির ঊর্ধ্বে কোন কাজ তাদের দাও তবে তাদের সহযোগিতা কর।[৭]
৬. অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণ করা : কারো মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা অন্যতম একটি যুলম বা অত্যাচার। এটিও কয়েক প্রকার হতে পারে। যেমন,
- বাতিল পন্থায় মানুষের সম্পদ গ্রাস করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পত্তি গ্রাস কর না এবং তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর না; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল। আর সীমা অতিক্রম করে ও অত্যাচার করে যে এ কাজ করে, নিশ্চয় আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব এবং এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ’ (সূরা আন-নিসা : ২৯-৩০)।
- দুর্বলশ্রেণীর সম্পদ গ্রাস করা যেমন ইয়াতীমের সম্পদ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের ধন-সম্পত্তি গ্রাস করে, নিশ্চয় তারা স্বীয় উদরে অগ্নি ব্যতীত কিছুই ভক্ষণ করে না এবং সত্বরই তারা অগ্নি শিখায় উপনীত হবে’ (সূরা আন-নিসা : ১০)।
- সূদ : অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ গ্রাস করার মধ্যে সূদও অন্তর্ভুক্ত।[৮] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি ইহুদীদের যুলমের কারণে তাদের জন্য যে সমস্ত পবিত্র বস্তু বৈধ ছিল তা তাদের প্রতি অবৈধ করেছি এবং যেহেতু তারা অনেককে আল্লাহর পথ হতে প্রতিরোধ করত। এবং তারা সূদ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করত এবং তারা অন্যায়ভাবে লোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করত এবং আমি তাদের মধ্যস্থিত অবিশ্বাসীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি’ (সূরা আন-নিসা : ১৬০-১৬১)।
- ঘুষ : সূদপ্রথা যেমন হারাম এবং যুলম বা অত্যাচার, তেমনি ঘুষ আদান-প্রদানও হারাম এবং যুলম বা অত্যাচার। কেননা ঘুষও সূদেরই অন্তর্ভুক্ত।[৯]
- কেননা যোগ্য ব্যক্তির স্বীয় অধিকার হরণের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল ঘুষ। অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। এছাড়া অসৎ উপায়ে কারো সম্পদ ভোগ করার জন্য কোন ধরণের কৌশল বা কুটচালও ইসলামে নিষেধ। কোন চক্রান্তের ফাঁদে ফেলে কেউ কারো সম্পদ ভোগ করতে পারবে না। এটাও এক প্রকার যুলুম। ইসলামে ঘুষ দাতা-গ্রহীতা অভিশপ্ত হিসাবে গণ্য। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
- لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الرَاشِيَ وَالْمُرْتَشِيْ
- ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারীর উপর অভিশাপ করেছেন’।[১০]
- বৈষয়িক ক্ষেত্রে প্রতারণা করা : যুলমের এটি একটি অন্যতম প্রকার। আর এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কঠোর হুঁশিয়ারী করেছেন। যেমন, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা খাদ্যবস্তুর একটি স্তূপের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি স্তূপের ভিতরে তাঁর হাতে ভিজা অনুভব করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! এটা কী? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ভিজাগুলোকে স্তূপের উপরে কেন রাখলে না, যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়? (অতঃপর তিনি বলেন,)مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّيْ ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই’।[১১]
- জুয়া : এটিও স্পষ্ট যুলম। জুয়ার মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরস্পর শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত হতে বিরত রাখে। তাইতো ইসলামে জুয়া খেলাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, মূর্তির বেদী এবং শুভ-অশুভ নির্ণয়ের তীর, এসব গর্হিত বিষয়, শয়তানী কাজ। সুতরাং এ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাক, যেন তোমাদের কল্যাণ হয়। শয়তান তো এটাই চায় যে, মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত হতে তোমাদের বিরত রাখে, সুতরাং এখনও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ৯০-৯১)।
- আত্মসাৎ : মানুষের কোন সম্পদ গোপন করা কিংবা খিয়ানত করাকে আত্মসাৎ বলে। এটি যুলম এবং কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
- وَ مَا کَانَ لِنَبِیٍّ اَنۡ یَّغُلَّ ؕ وَ مَنۡ یَّغۡلُلۡ یَاۡتِ بِمَا غَلَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ۚ ثُمَّ تُوَفّٰی کُلُّ نَفۡسٍ مَّا کَسَبَتۡ وَ ہُمۡ لَا یُظۡلَمُوۡنَ
- ‘আর কোন নবীর পক্ষে আত্মসাৎকরণ শোভনীয় নয় এবং কেউ আত্মসাৎ করলে, যা সে আত্মসাৎ করেছে তা ক্বিয়ামত দিবসে আনয়ন করা হবে; অনন্তর প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করেছে তা পূর্ণরূপে দেয়া হবে এবং তারা অত্যাচারিত হবে না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৬১)।
- বেতনভুক্ত দায়িত্বশীল কর্তৃক অন্যের নিকট থেকে অতিরিক্ত হাদিয়া গ্রহণ করা : এটিও এক প্রকার যুলম বা অত্যাচার। ক্বিয়ামতের দিন ঐ অতিরিক্ত হাদিয়া নিজ কাঁধে বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে। আবূ হুমাইদ আস-সাঈদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয্দ গোত্রের ইবনু লুতবিয়্যাহ নামক এক ব্যক্তিকে যাকাত আদায় করার কাজে কর্মচারী নিয়োগ করলেন। সে ব্যক্তি (আদায়কৃত মালসহ) ফিরে এসে বলল, এটা আপনাদের (বায়তুল মালের), আর এটা আমাকে উপহার স্বরূপ দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিম্বারে উঠে দণ্ডায়মান হয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করে বললেন, অতঃপর বলি যে, আল্লাহ আমাকে যে সকল কর্মের অধিকারী করেছেন তার মধ্য হতে কোনও কর্মের তোমাদের কাউকে কর্মচারী নিয়োগ করলে সে ফিরে এসে বলে কি, না, এটা আপনাদের, আর এটা উপহার স্বরূপ আমাকে দেয়া হয়েছে। যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে তার বাপ-মায়ের ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন, তাকে কোন উপহার দেয়া হচ্ছে কি-না। আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন জিনিস অনধিকার গ্রহণ করবে, সে ক্বিয়ামতের দিন তা নিজ ঘাড়ে বহন করা অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করবে। অতএব আমি যেন অবশ্যই চিনতে না পারি যে, তোমাদের মধ্য হতে কেউ নিজ ঘাড়ে চিঁহি- রববিশিষ্ট উট, অথবা হাম্বা-রববিশিষ্ট গাই, অথবা ম্যাঁ-ম্যাঁ রববিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছ’।[১২]
তৃতীয় প্রকার : মানুষ ও তার নিজের মাঝে যুলম
মানুষ প্রথমেই তার নিজের প্রতিই যুলম বা অত্যাচার করে থাকে। এটিই যুলমের প্রকৃতি।[১৩]
এতদুদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَا ظَلَمَہُمُ اللّٰہُ وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ
আল্লাহ তাদের প্রতি কোন যুলম করেননি, কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলম করত’ (সূরা আন-নাহল : ৩৩)।
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ مَا ظَلَمُوۡنَا وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ
‘তারা আমার কোন অনিষ্ট করেনি, বরং তারা নিজেদেরই অনিষ্ট করেছিল’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৫৭)। তিনি আরো বলেন, فَمِنۡہُمۡ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِہٖ ‘তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী’ (সূরা আল-ফাত্বির : ৩২)।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যুলমের অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। তন্মধ্যে মানুষ নিজের নফসের প্রতি যে যুলম করে সেটা কয়েকভাবে হতে পারে। উল্লেখ্য, এই প্রকার যুলম বা অত্যাচার বান্দার নিজের সাথে হলে সবটাই আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সংঘটিত হওয়া যুলম। যেমন,
শিরক করা : সবচেয়ে বড় যুলম হল- আল্লাহর সাথে শিরক করা। যদিও আল-কুরআন ও সুন্নাহর ইত্তিবা‘ ও তাক্বলীদ এবং ইজমা‘ সম্পর্কে বুঝ থাকলেও এ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিমাণ একেবারে শূন্যের কোঠায়। যেমনটি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেছেন।[১৪]
এ প্রসঙ্গে হাদীসে খুবই চমৎকার ব্যাখ্যা এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল-
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَہُمۡ بِظُلۡمٍ
‘ঐ সমস্ত লোক যারা ঈমান এনেছে এবং যুলম তথা অত্যাচারের সাথে তাদের ঈমানকে মিশ্রিত করেনি’ শেষ পর্যন্ত, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীদের নিকট এই বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন মনে হল এবং তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে নিজের উপরে অত্যাচার করেনি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এর অর্থ তা নয়, বরং এখানে অত্যাচার দ্বারা শিরককে বুঝানো হয়েছে। তোমরা কি লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন,
یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِکۡ بِاللّٰہِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ
হে বৎস! তুমি আল্লাহর সাথে শরীক কর না। নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় যুলম। অপর এক বর্ণনায় আছে, প্রকৃতপক্ষে তা নয় যা তোমরা ধারণা করেছ, বরং তা হল অনুরূপ, যা লুক্বমান (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন।[১৫]
আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রম করা : অর্থাৎ বান্দার জন্য আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তাকে হারাম করা এবং যা হারাম করেছেন, তাকে হালাল করা। আর এই সীমারেখা অতিক্রম করাকে যুলম বলা হয়েছে।[১৬]
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰہِ فَلَا تَعۡتَدُوۡہَا ۚ وَ مَنۡ یَّتَعَدَّ حُدُوۡدَ اللّٰہِ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
‘এগুলোই হচ্ছে আল্লাহর সীমাসমূহ অতএব তা অতিক্রম করো না এবং যারা আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে, বস্তুত তারাই যালেম বা অত্যাচারী’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২২৯)।
মসজিদ ও সেখানে আল্লাহকে স্মরণ করা থেকে বাধা প্রদান করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰہِ اَنۡ یُّذۡکَرَ فِیۡہَا اسۡمُہٗ وَ سَعٰی فِیۡ خَرَابِہَا ؕ اُولٰٓئِکَ مَا کَانَ لَہُمۡ اَنۡ یَّدۡخُلُوۡہَاۤ اِلَّا خَآئِفِیۡنَ ۬ؕ لَہُمۡ فِی الدُّنۡیَا خِزۡیٌ وَّ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
‘এবং যে কেউ আল্লাহর মসজিদসমূহের মধ্যে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে নিষেধ করেছে এবং তা ধ্বংস করতে প্রয়াস চালিয়েছে- তার অপেক্ষা কে অধিক অত্যাচারী? এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে শঙ্কিত অবস্থায়ই তন্মধ্যে প্রবেশ করা উচিত; তাদের জন্য ইহলোকের দুর্গতি এবং পরলোকে কঠোর শাস্তি রয়েছে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১১৪)।
সাক্ষ্য গোপন করা : আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য যারা গোপন করা ও তার বিপরীত কিছু প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, সম্মিলিতভাবে হক্বকে গোপন করে ও সে ব্যাপারে প্রচেষ্টা করে এবং বাতিলকে প্রকাশ করে ও তার দিকে দা‘ওয়াত দেয়া। এটা সবচেয়ে বড় যুলম নয় তো কি? আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন।[১৭] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَمۡ تَقُوۡلُوۡنَ اِنَّ اِبۡرٰہٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ وَ الۡاَسۡبَاطَ کَانُوۡا ہُوۡدًا اَوۡ نَصٰرٰی ؕ قُلۡ ءَاَنۡتُمۡ اَعۡلَمُ اَمِ اللّٰہُ ؕ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَتَمَ شَہَادَۃً عِنۡدَہٗ مِنَ اللّٰہِ ؕ وَ مَا اللّٰہُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
‘তোমরা কি বলছো যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের বংশধর ইয়াহুদী কিংবা খ্রিষ্টান ছিলেন? তুমি বল, তোমরাই সঠিক জ্ঞানী না আল্লাহ? আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য যে ব্যক্তি গোপন করছে সে অপেক্ষা কে বেশি অত্যাচারী? এবং তোমরা যা করছো তা হতে আল্লাহ অমনোযোগী নন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪০)।
বিধানসমূহের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে আল্লাহর নির্দশনসমূহকে উপেক্ষা করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ ذُکِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّہٖ فَاَعۡرَضَ عَنۡہَا وَ نَسِیَ مَا قَدَّمَتۡ یَدٰہُ ؕ اِنَّا جَعَلۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ اَکِنَّۃً اَنۡ یَّفۡقَہُوۡہُ وَ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ وَقۡرًا ؕ وَ اِنۡ تَدۡعُہُمۡ اِلَی الۡہُدٰی فَلَنۡ یَّہۡتَدُوۡۤا اِذًا اَبَدًا
‘কোন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর সে তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়, তবে তার অপেক্ষা অধিক অত্যাচারী আর কে? আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদেরকে বধির করেছি; তুমি তাদেরকে সৎপথে আহ্বান করলেও তারা কখনও সৎপথে আসবে না’ (সূরা আল-কাহ্ফ : ৫৭)।
আল্লাহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা : নিজের প্রতি সবেচেয় বেশি যুলম বা অত্যচার করে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তার নিকট থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ যা হারাম করেননি তাকে হারাম হিসাবে এবং যা হালাল করেননি তাকে হালাল হিসাবে মনে করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا لِّیُضِلَّ النَّاسَ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ
‘যে ব্যক্তি বিনা প্রমাণে না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে এরূপ মিথ্যা আরোপ করে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৪৪)।
তথ্যসুত্র :
[১]. দালীলুল ফালিহীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৫।
[২]. আবুল বাক্বা আইয়ূব ইবন মূসা আল-হাসীনী আল-কাফাভী, কিতাবুল কুল্লিয়াত (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪১৯ হি./১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ৫৯৪।
[৩]. সহীহ বুখারী, হা/৩৪২৯; সহীহ মুসলিম, হা/১২৪; মিশকাত, হা/৫১৩১।
[৪]. সহীহ বুখারী, হা/৩১৯৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৬১০; মিশকাত, হা/২৯৩৮।
[৫] সহীহ বুখারী, হা/২৬৫০।
[৬] সহীহ বুখারী, হা/২২২৭, ২২৭০; মিশকাত, হা/২৯৮৪।
[৭] সহীহ বুখারী, হা/৩০, ২৫৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৪৬৯।
[৮] জাবির ইবনু মূসা ইবনু আব্দিল কাদির ইবনু জাবির আবূ বকর আল-জাযাইরী, আইসাসীরুত তাফাসীর লিকালামিল ‘আলিয়্যিল কাবীর (মদীনা মুনাওয়ারা : মাকতাবাতুল ঊলূম ওয়াল হিকাম, ৫ম সংস্করণ, ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৬।
[৯] আবূ দাঊদ, হা/৩৫৪১; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৪৬৫; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৬২৪; মিশকাত, হা/৩৭৫৭, সনদ হাসান ।
[১০] আবূ দাউদ, হা/৩৫৮০; তিরমিযী, হা/১৩৩৭; ইবনু মাজাহ, হা/২৩১৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৫৩২; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২২১১; মিশকাত, হা/৩৭৫৩, সনদ সহীহ ।
[১১] সহীহ মুসলিম, হা/১০২; মিশকাত, হা/২৮৬০।
[১২] সহীহ বুখারী, হা/৬৬৩৬; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৩২; মিশকাত, হা/১৭৭৯।
[১৩] আবুল কাসেম আল-হুসাইন ইবনু মুহাম্মাদ রাগিব আল-ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন (দামেস্ক : দারুল কলম, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি.), পৃ. ৫৩৮।
[১৪] তাক্বীউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, জামিঊল মাসাইল (দারু ‘আলিমিল ফাওয়ায়েদ, ১ম সংস্করণ, ১৪২২ হি.), ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৩৪।
[১৫] সহীহ বুখারী, হা/৩৪২৯; সহীহ মুসলিম, হা/১২৪; মিশকাত, হা/৫১৩১।
[১৬] জামিঊল বায়ান ফী তা’বীলিল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫৮৪।
[১৭] তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৬৯।
-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান
Last edited: