প্রশ্ন: মাসের শুরু ও শেষ জানার জন্য জ্যোতির্বিদ্যার উপর নির্ভর করা কি বৈধ? রমাদ্বনের চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কি বৈধ? নাকি খালি চোখে চাঁদ দেখা জরুরি?
ভূমিকা: ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মাসের প্রবেশ প্রমাণ করার জন্য শরী‘আত সম্মত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। যথা:- (১). রমাযানের চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করা (২). চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করে নেওয়া।
(১). রমাযানের চাঁদ দেখে সিয়াম পালন: এই মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে। (সূরা বাকারা হা/ ২/১৮৫)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, 'চাঁদ না দেখে তোমরা সিয়াম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার বন্ধ করবে না। যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে তার সময় (ত্রিশ দিন) পরিমাণ পূর্ণ করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০০-১৯০৬; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮০)। অন্যত্র তিনি বলেন, صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوْا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِيْنَ ‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শা‘বানের গণনা ত্রিশদিন পূর্ণ করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮১)। উপরিউক্ত হাদীসগুলোতে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রমাযানের ফরয হওয়া তথা তা শুরু করার ব্যাপারটা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। আর এর মানেই হলো, চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সিয়াম রাখা নিষিদ্ধ।
সাক্ষ্য দ্বারা মাস প্রমাণ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
ওরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, তা হলো মানুষ ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক। (সূরা বাকারহ; ২/১৮৯)। মহান আল্লাহ চাঁদকে মানুষের জন্য সময়-নির্দেশক হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা মানুষ নিজেদের ইবাদত ও পার্থিব জীবনের সময় ও তারিখ নির্ধারণ করতে পারে। সুতরাং বান্দার প্রতি তাঁর খাস রহমত এই যে, তিনি ফরয রোযা শুরু হওয়ার বিষয়টা একটি এমন স্পষ্ট জিনিস ও প্রকট চিহ্নের উপর নির্ভরশীল করেছেন, যা সকল মানুষই জানে। তবে
সিয়াম ওয়াজিব হওয়ার জন্য এ শর্ত নয় যে, প্রত্যেক মুসলিমকেই চাঁদ দেখতে হবে। বরং কিছু সংখ্যক লোক দেখলে, বরং - সঠিক মতে- একজন দেখলেই; যদি সে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হয়, তাহলে তার দেখা মতে সকলের জন্য রোযা রাখা জরুরী হয়ে যাবে। অবশ্য তাদের সকলের চন্দ্রের উদয়-স্থল এক হয় তবে।(ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান পৃষ্ঠা: ২৮)। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, একদা লোকেরা নতুন চাঁদ দেখতে জমায়েত হলো। আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে খবর দিলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। তিনি আমার এ খবরে রোযা রাখলেন এবং লোকেদেরকে রোযা রাখতে আদেশ করলেন। (আবু দাঊদ হা/২৩৪২, সহীহ ইবনে হিব্বান হা/৮৭১)
(২). রমাযান প্রবেশ হওয়ার কথা প্রমাণ করার দ্বিতীয় উপায় হলো, (চাঁদ দেখা না গেলে) শা’বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করে নেওয়া। (অবশ্য এর জন্য শর্ত হল শা’বান মাসের শুরুর হিসাব রাখা।) এ ব্যাপারে পূর্বে উল্লেখিত দুটি হাদীস আমাদেরকে পথনির্দেশ করে। দ্বিতীয় হাদীসটিতে বলা হয়েছে صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوْا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِيْنَ ‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শা‘বানের গণনা ত্রিশদিন পূর্ণ করবে।’(সহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮১)।
জ্যোতিষ-গণনার উপর নির্ভর করা যাবে না:
উপর্যুক্ত দুটি উপায় ছাড়া অন্য উপায়ে মাস প্রবেশ হওয়ার কথা প্রমাণ করা যাবে না। সুতরাং, জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকা মতে রমাযান মাস ধরে নিয়ে রোযা ফরয হবে না। বলা বাহুল্য, যদি জ্যোতিষীদের হিসাব মতে আজকের রাত রমাযানের প্রথম তারিখ হয়, কিন্তু সন্ধ্যায় কেউই চাঁদ না দেখে থাকে, তাহলে রোযা রাখা যাবে না। যেহেতু শরীয়ত রোযা রাখার বিধানকে একটি বাহ্যিকভাবে উপলব্ধ জিনিসের উপর নির্ভরশীল করে দিয়েছে। আর তা হলো চাঁদ দেখা। (আশ শারহুল মুমতে; ৬/৩১৪)। তা ছাড়া পঞ্জিকার হিসাব নির্ভুল নয়। এক এলাকায় সচল হলেও অন্য এলাকায় অচল। অতএব, তার উপর ভরসা করে চোখ বুঁজে রোযা রাখা বৈধ নয়। পঞ্জিকার হিসাবের উপর নির্ভর করার কথা শরীয়ত ও বিবেকে স্বীকৃত নয়। কেননা, মুসলিম উম্মাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুঅত কাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তও চাঁদ দেখার উপরই নির্ভর করে; হিসাবের উপর ভরসা না করে, কেবল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর অনুসরণে রোযা রেখে আসছে। যে সম্মানিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমরা হলাম নিরক্ষর জাতি। আমরা লেখাপড়া জানি না এবং হিসাবও জানি না। মাস কখনো এই রকম হয়, কখনো এই রকম হয়। অর্থাৎ, কখনো ২৯ দিনে হয় এবং কখনো ৩০ দিনে।’ (সহীহ বুখারী হা/১৯১৩)। হাফেয ইবনে হাজার উক্ত হাদীসের টীকায় বলেন, এখানে ‘হিসাব’ বলতে ‘জ্যোতিষী হিসাব’কে বুঝানো হয়েছে। আর তখন এ হিসাব খুবই কম সংখ্যক লোক ছাড়া কেউই জানত না। তাই সিয়াম রাখা এবং অন্যান্য ব্যাপার চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছে। যাতে এ বিষয়ে লোকেরা অসুবিধা তথা জ্যেতিষী গণনার কষ্ট থেকে রেহাই পায়। পরবর্তী কালে কিছু লোক এ হিসাব শিখলেও সিয়াম রাখা-না রাখার বিষয়টা এইভাবেই চলতে থাকল। বরং হাদীসের প্রকাশ্য উক্তি মূলতঃ হিসাবের উপর নির্ভর না করতেই ইঙ্গিত করে। আর এ কথা আরো স্পষ্ট করে দেয় পূর্বোক্ত হাদীস। যাতে বলা হয়েছে, ‘‘যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে শা’বানের গুনতি ৩০ পূর্ণ করে নাও।’’ এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে জ্যোতিষীদেরকে জিজ্ঞাসা করে নাও।’’এই বিধানের পশ্চাতে যুক্তি এই যে, আকাশ অপরিষ্কার থাকার সময় সংখ্যা পূরণ করে নিলে তাতে সকল আজ্ঞাপ্রাপ্ত মুসলিম সমান হয়ে যাবে এবং এর ফলে তাদের মধ্যে কোন প্রকার মতভেদ ও ঝগড়া অবশিষ্ট থাকবে না। (বুখারী, ফাতহুল বারী, খন্ড:৪, পৃষ্ঠা:১৫১)
রমাদ্বনের চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কি বৈধ:
রমাদানের চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা অবৈধ বা নাজায়েজ নয়। আবার চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করাও ওয়াজিব নয়। কারণ, হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করা, অন্য কিছুর ওপর নয়। তবুও যদি নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যক্তি তা ব্যবহার করে এবং তার মাধ্যমে অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাঁদ দেখে, তবে তার দেখার ওপর আমল করা বৈধ। আদি যুগে মানুষ রমাযান ও শাবানের ত্রিশ তারিখে মিনারায় উঠে যন্ত্র ব্যবহার করে চাঁদ দেখত। সারকথা, যেভাবেই হোক, যখন চাঁদ দেখা প্রমাণ হতে হবে, তখন সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। কারণ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন তোমরা চাঁদ দেখবে সাওম পালন করবে, আর যখন চাঁদ দেখবে তখন (সাওম) ভঙ্গ করবে।’’(সহীহ বুখারী হা/১৯০০; সহীহ মুসলিম হা/২৫৫৬; সুআলান ফিস-সিয়াম পৃষ্ঠা: ৩১)
আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চাঁদ দেখা সম্পর্কে সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতার)আলোমগন, বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] এবং সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] ও শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘দূরবীন, টেলিস্কোপ বা অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাঁদ দেখা জায়েয। এটি কোনভাবেই ধর্মীয় মূলনীতির বিরোধী নয়। কেননা পূর্বের লোকেরাও তাঁদের সুবিধার্থে মিনারে, বাড়ির ছাদে অথবা অন্য কোন উঁচু জায়গায় উঠে চাঁদ দেখার চেষ্টা করতেন। তবে জ্যোতিষ্কলোক বা পঞ্জিকার উপর নির্ভরশীল হওয়া বা এর মাধ্যমে অনুমান করা জায়েয নয়। (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৯/৯৯, প্রশ্নোত্তর নং-১২৪৫; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব লিইবনি বায, ১৬/৮১-৮৩; ফাতাওয়া উলামায়িল বালাদিল হারাম, পৃ. ১৯২-১৯৩)।
দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমান যুগের কিছু ভ্রান্ত মস্তিষ্কের আলিম আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাঁদ দেখার বিষয়ে
দ্বিমত পোষণ করলেও কিন্তু অধিকাংশ আলিমের মতে, উপায় যায়ই হোক না কেন চাঁদ দেখাই হচ্ছে বড় কথা। সঊদী আরবের উচ্চ উলামা পরিষদ 'মাজলিসু হাইআতি কিবারিল ওলামা’ও এই মত প্রদান করেছেন। ১৬/৫/১৪০৩ হিজরীতে পরিষদের সকল সদস্য নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তসমূহে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। যথা: (১). চাঁদ দেখার কাজে সহযোগী হিসাবে মিনার নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে শারঈ কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। (২). এর মাধ্যমে চাঁদ দেখা না গেলেও, শুধু খালি চোখে চাঁদ দেখা গেলে তাই গ্রহণযোগ্য হবে। (৩). অনুরূপভাবে টেলিস্কোপের মাধ্যমে যদি সত্যি সত্যি চাঁদ দেখা সম্ভব হয়, তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে, যদিও খালি চোখে তা দেখা না যায়। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন, চাঁদ না দেখে তোমরা সিয়াম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার বন্ধ করবে না। যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে তার সময় (ত্রিশ দিন) পরিমাণ পূর্ণ করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০০-১৯০৬; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮০)। উপরোক্ত হাদীসে খালি চোখ, টেলিস্কোপ বা অন্য কোন মাধ্যমে দেখা বা না দেখার কোন শর্তারোপ করা হয়নি। তাছাড়া হ্যাঁ-সূচক (المثبت) দলীল না-সূচক (النافي) দলীলের ওপর অগ্রাধিকারযোগ্য। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থণা, হে আল্লাহ আমাদের হককে হক করে দেখাও ও তার অনুসরণ করার তাওফীক দান কর। আর বাতিলকে বাতিল করে দেখাও এবং তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করো। বাতিল যেন আমাদের নিকট অস্পষ্ট না হয়, তাহলে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাবো। হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম বানাও।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
❛মহিমান্বিত মাস রমাদ্বন❞ ধারাবাহিক ৪০ পর্বের আজ একাদশ তম পর্ব। পূর্বের পর্বগুলো কমেন্টে দেখুন।
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি
ভূমিকা: ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মাসের প্রবেশ প্রমাণ করার জন্য শরী‘আত সম্মত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। যথা:- (১). রমাযানের চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করা (২). চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করে নেওয়া।
(১). রমাযানের চাঁদ দেখে সিয়াম পালন: এই মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে। (সূরা বাকারা হা/ ২/১৮৫)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, 'চাঁদ না দেখে তোমরা সিয়াম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার বন্ধ করবে না। যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে তার সময় (ত্রিশ দিন) পরিমাণ পূর্ণ করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০০-১৯০৬; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮০)। অন্যত্র তিনি বলেন, صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوْا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِيْنَ ‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শা‘বানের গণনা ত্রিশদিন পূর্ণ করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮১)। উপরিউক্ত হাদীসগুলোতে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রমাযানের ফরয হওয়া তথা তা শুরু করার ব্যাপারটা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। আর এর মানেই হলো, চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সিয়াম রাখা নিষিদ্ধ।
সাক্ষ্য দ্বারা মাস প্রমাণ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
ওরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, তা হলো মানুষ ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক। (সূরা বাকারহ; ২/১৮৯)। মহান আল্লাহ চাঁদকে মানুষের জন্য সময়-নির্দেশক হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা মানুষ নিজেদের ইবাদত ও পার্থিব জীবনের সময় ও তারিখ নির্ধারণ করতে পারে। সুতরাং বান্দার প্রতি তাঁর খাস রহমত এই যে, তিনি ফরয রোযা শুরু হওয়ার বিষয়টা একটি এমন স্পষ্ট জিনিস ও প্রকট চিহ্নের উপর নির্ভরশীল করেছেন, যা সকল মানুষই জানে। তবে
সিয়াম ওয়াজিব হওয়ার জন্য এ শর্ত নয় যে, প্রত্যেক মুসলিমকেই চাঁদ দেখতে হবে। বরং কিছু সংখ্যক লোক দেখলে, বরং - সঠিক মতে- একজন দেখলেই; যদি সে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হয়, তাহলে তার দেখা মতে সকলের জন্য রোযা রাখা জরুরী হয়ে যাবে। অবশ্য তাদের সকলের চন্দ্রের উদয়-স্থল এক হয় তবে।(ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান পৃষ্ঠা: ২৮)। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, একদা লোকেরা নতুন চাঁদ দেখতে জমায়েত হলো। আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে খবর দিলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। তিনি আমার এ খবরে রোযা রাখলেন এবং লোকেদেরকে রোযা রাখতে আদেশ করলেন। (আবু দাঊদ হা/২৩৪২, সহীহ ইবনে হিব্বান হা/৮৭১)
(২). রমাযান প্রবেশ হওয়ার কথা প্রমাণ করার দ্বিতীয় উপায় হলো, (চাঁদ দেখা না গেলে) শা’বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করে নেওয়া। (অবশ্য এর জন্য শর্ত হল শা’বান মাসের শুরুর হিসাব রাখা।) এ ব্যাপারে পূর্বে উল্লেখিত দুটি হাদীস আমাদেরকে পথনির্দেশ করে। দ্বিতীয় হাদীসটিতে বলা হয়েছে صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوْا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِيْنَ ‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম আরম্ভ করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শা‘বানের গণনা ত্রিশদিন পূর্ণ করবে।’(সহীহ বুখারী, হা/১৯০৯; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮১)।
জ্যোতিষ-গণনার উপর নির্ভর করা যাবে না:
উপর্যুক্ত দুটি উপায় ছাড়া অন্য উপায়ে মাস প্রবেশ হওয়ার কথা প্রমাণ করা যাবে না। সুতরাং, জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকা মতে রমাযান মাস ধরে নিয়ে রোযা ফরয হবে না। বলা বাহুল্য, যদি জ্যোতিষীদের হিসাব মতে আজকের রাত রমাযানের প্রথম তারিখ হয়, কিন্তু সন্ধ্যায় কেউই চাঁদ না দেখে থাকে, তাহলে রোযা রাখা যাবে না। যেহেতু শরীয়ত রোযা রাখার বিধানকে একটি বাহ্যিকভাবে উপলব্ধ জিনিসের উপর নির্ভরশীল করে দিয়েছে। আর তা হলো চাঁদ দেখা। (আশ শারহুল মুমতে; ৬/৩১৪)। তা ছাড়া পঞ্জিকার হিসাব নির্ভুল নয়। এক এলাকায় সচল হলেও অন্য এলাকায় অচল। অতএব, তার উপর ভরসা করে চোখ বুঁজে রোযা রাখা বৈধ নয়। পঞ্জিকার হিসাবের উপর নির্ভর করার কথা শরীয়ত ও বিবেকে স্বীকৃত নয়। কেননা, মুসলিম উম্মাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুঅত কাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্তও চাঁদ দেখার উপরই নির্ভর করে; হিসাবের উপর ভরসা না করে, কেবল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর অনুসরণে রোযা রেখে আসছে। যে সম্মানিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমরা হলাম নিরক্ষর জাতি। আমরা লেখাপড়া জানি না এবং হিসাবও জানি না। মাস কখনো এই রকম হয়, কখনো এই রকম হয়। অর্থাৎ, কখনো ২৯ দিনে হয় এবং কখনো ৩০ দিনে।’ (সহীহ বুখারী হা/১৯১৩)। হাফেয ইবনে হাজার উক্ত হাদীসের টীকায় বলেন, এখানে ‘হিসাব’ বলতে ‘জ্যোতিষী হিসাব’কে বুঝানো হয়েছে। আর তখন এ হিসাব খুবই কম সংখ্যক লোক ছাড়া কেউই জানত না। তাই সিয়াম রাখা এবং অন্যান্য ব্যাপার চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছে। যাতে এ বিষয়ে লোকেরা অসুবিধা তথা জ্যেতিষী গণনার কষ্ট থেকে রেহাই পায়। পরবর্তী কালে কিছু লোক এ হিসাব শিখলেও সিয়াম রাখা-না রাখার বিষয়টা এইভাবেই চলতে থাকল। বরং হাদীসের প্রকাশ্য উক্তি মূলতঃ হিসাবের উপর নির্ভর না করতেই ইঙ্গিত করে। আর এ কথা আরো স্পষ্ট করে দেয় পূর্বোক্ত হাদীস। যাতে বলা হয়েছে, ‘‘যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে শা’বানের গুনতি ৩০ পূর্ণ করে নাও।’’ এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে জ্যোতিষীদেরকে জিজ্ঞাসা করে নাও।’’এই বিধানের পশ্চাতে যুক্তি এই যে, আকাশ অপরিষ্কার থাকার সময় সংখ্যা পূরণ করে নিলে তাতে সকল আজ্ঞাপ্রাপ্ত মুসলিম সমান হয়ে যাবে এবং এর ফলে তাদের মধ্যে কোন প্রকার মতভেদ ও ঝগড়া অবশিষ্ট থাকবে না। (বুখারী, ফাতহুল বারী, খন্ড:৪, পৃষ্ঠা:১৫১)
রমাদ্বনের চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কি বৈধ:
রমাদানের চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা অবৈধ বা নাজায়েজ নয়। আবার চাঁদ দেখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করাও ওয়াজিব নয়। কারণ, হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করা, অন্য কিছুর ওপর নয়। তবুও যদি নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যক্তি তা ব্যবহার করে এবং তার মাধ্যমে অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাঁদ দেখে, তবে তার দেখার ওপর আমল করা বৈধ। আদি যুগে মানুষ রমাযান ও শাবানের ত্রিশ তারিখে মিনারায় উঠে যন্ত্র ব্যবহার করে চাঁদ দেখত। সারকথা, যেভাবেই হোক, যখন চাঁদ দেখা প্রমাণ হতে হবে, তখন সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। কারণ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন তোমরা চাঁদ দেখবে সাওম পালন করবে, আর যখন চাঁদ দেখবে তখন (সাওম) ভঙ্গ করবে।’’(সহীহ বুখারী হা/১৯০০; সহীহ মুসলিম হা/২৫৫৬; সুআলান ফিস-সিয়াম পৃষ্ঠা: ৩১)
আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে চাঁদ দেখা সম্পর্কে সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতার)আলোমগন, বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] এবং সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] ও শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘দূরবীন, টেলিস্কোপ বা অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাঁদ দেখা জায়েয। এটি কোনভাবেই ধর্মীয় মূলনীতির বিরোধী নয়। কেননা পূর্বের লোকেরাও তাঁদের সুবিধার্থে মিনারে, বাড়ির ছাদে অথবা অন্য কোন উঁচু জায়গায় উঠে চাঁদ দেখার চেষ্টা করতেন। তবে জ্যোতিষ্কলোক বা পঞ্জিকার উপর নির্ভরশীল হওয়া বা এর মাধ্যমে অনুমান করা জায়েয নয়। (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, ৯/৯৯, প্রশ্নোত্তর নং-১২৪৫; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব লিইবনি বায, ১৬/৮১-৮৩; ফাতাওয়া উলামায়িল বালাদিল হারাম, পৃ. ১৯২-১৯৩)।
দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমান যুগের কিছু ভ্রান্ত মস্তিষ্কের আলিম আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাঁদ দেখার বিষয়ে
দ্বিমত পোষণ করলেও কিন্তু অধিকাংশ আলিমের মতে, উপায় যায়ই হোক না কেন চাঁদ দেখাই হচ্ছে বড় কথা। সঊদী আরবের উচ্চ উলামা পরিষদ 'মাজলিসু হাইআতি কিবারিল ওলামা’ও এই মত প্রদান করেছেন। ১৬/৫/১৪০৩ হিজরীতে পরিষদের সকল সদস্য নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তসমূহে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। যথা: (১). চাঁদ দেখার কাজে সহযোগী হিসাবে মিনার নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে শারঈ কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। (২). এর মাধ্যমে চাঁদ দেখা না গেলেও, শুধু খালি চোখে চাঁদ দেখা গেলে তাই গ্রহণযোগ্য হবে। (৩). অনুরূপভাবে টেলিস্কোপের মাধ্যমে যদি সত্যি সত্যি চাঁদ দেখা সম্ভব হয়, তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে, যদিও খালি চোখে তা দেখা না যায়। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন, চাঁদ না দেখে তোমরা সিয়াম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার বন্ধ করবে না। যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে তার সময় (ত্রিশ দিন) পরিমাণ পূর্ণ করবে।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০০-১৯০৬; সহীহ মুসলিম, হা/১০৮০)। উপরোক্ত হাদীসে খালি চোখ, টেলিস্কোপ বা অন্য কোন মাধ্যমে দেখা বা না দেখার কোন শর্তারোপ করা হয়নি। তাছাড়া হ্যাঁ-সূচক (المثبت) দলীল না-সূচক (النافي) দলীলের ওপর অগ্রাধিকারযোগ্য। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থণা, হে আল্লাহ আমাদের হককে হক করে দেখাও ও তার অনুসরণ করার তাওফীক দান কর। আর বাতিলকে বাতিল করে দেখাও এবং তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করো। বাতিল যেন আমাদের নিকট অস্পষ্ট না হয়, তাহলে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাবো। হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম বানাও।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
❛মহিমান্বিত মাস রমাদ্বন❞ ধারাবাহিক ৪০ পর্বের আজ একাদশ তম পর্ব। পূর্বের পর্বগুলো কমেন্টে দেখুন।
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি