রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্কের দিকে নিয়ে যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এ সকল পথ থেকে উম্মাতকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। এসবের মধ্যে প্রথম হলো কবরের বিষয়টি। তাই তিনি কবর যিয়ারতের এমন নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, যাতে লোকজন কবরপূজা ও কবরবাসীদের ব্যাপারে যে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকতে পারে। তন্মধ্যে:
১. তিনি আওলিয়া ও পূণ্যবান লোকদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে নিষেধ করেছেন। কেননা এ ধরনের বাড়াবাড়ি করতে করতে মানুষ তাঁদের ইবাদাতে ও উপাসনায় লিপ্ত হয়। তিনি বলেন,
“বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাক। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার ফলে ধ্বংস ও বিনাশ হয়ে গিয়েছে”।[1]
তিনি আরো বলেন,
“আমার ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না, যে ভাবে নাসারাগণ মরিয়ম পুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছিলো। কেননা আমি শুধু একজন বান্দা। অতএব, আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলুল্লাহ হিসেবে অভিহিত করো”।[2]
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর সৌধ স্থাপন করা থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন, আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: আলী ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আমাকে বলেন যে,
“আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হলো যেখানেই প্রতিমা ও ভাস্কার্য দেখবে ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই সুউচ্চ কবর দেখবে সমান করে দেবে”।[3]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে চুনকাম করা ও সৌধ তৈরী করা থেকে নিষেধ করেছেন। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর চুনকাম করা, তার উপর বসা ও সৌধ তৈরি করা থেকে নিষেধ করেছেন”।[4]
৩. কবরের পাশে সালাত পড়া থেকেও তিনি সতর্ক করেছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত্যুকালীন রোগশয্যায় চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে নিতেন। যখন এতে কষ্ট লাগতো তখন মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিতেন। এমতাবস্থায় তিনি বলেছিলেন,
‘‘ইয়াহুদী ও নাসারাদের ওপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হোক। কারণ, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ তথা সাজদাহর স্থান বানিয়ে নিয়েছে”। তাদের এসব কাজ-কর্ম থেকে তিনি স্বীয় উম্মাতকে সতর্ক করে দিয়েছেন। লোকেরা তাঁর কবরকে সিজদাগাহ বানাবে এ আশংকা যদি না থাকতো তাহলে তাঁর কবর উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো”।[5]
“জেনে রাখ, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা নিজেদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিত। সাবধান, তোমরা কবরসমূহকে মসজিদ তথা সাজদাহর স্থান বানাবে না। আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি”।[6]
কবরকে মসজিদ বানানোর অর্থ হলো কবরের পাশে সালাত পড়া, যদিও কবরের উপর কোনো মসজিদ তৈরি না করা হয়। সুতরাং যে কোনো স্থানকেই নামাযের জন্য নির্দিষ্ট করা হবে তাই মসজিদ বলে গণ্য হবে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“সকল যমীনকে আমার জন্য সাজদাহর স্থান ও পবিত্র বানিয়ে দেওয়া হয়েছে”।[7]
আর যদি কবরের উপর মসজিদ বানানো হয় সেটা আরো ভয়াবহ ব্যাপার।
অধিকাংশ লোকই এসব ব্যাপারে শরী‘আতের খিলাফ করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তারা শির্কে আকবার তথা বড় শির্কী কাজে ব্যাপৃত হয়ে গেছে। আর কবরের উপরে মসজিদ, মাযার ও মাকাম বানিয়ে নিয়েছে, যাতে শির্কে আকবারের সকল প্রকার কাজ-কর্মের চর্চা করা হচ্ছে। যেমন, কবরের উদ্দেশ্যে যবেহ করা হচ্ছে, কবরবাসীদের কাছে দো‘আ চাওয়া হচ্ছে ও তাদের সাহায্য ও মদদ প্রার্থনা করা হচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্যে মান্নত প্রভৃতি করা হচ্ছে।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: যে ব্যক্তি কবরসমূহের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত, তাঁর আদেশ-নিষেধ ও তাঁর সাহাবীগণের আদর্শ এবং আজকাল মানুষ যেসব কাজ করে থাকে এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়, সে মূলতঃ এর একটিকে অন্যটির বিপরীত ও প্রতিকূল দেখতে পাবে এমনভাবে যে, এ দু‘টি বিষয়ে কখনো সামঞ্জস্য বিধান করা যেতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে সালাত পড়া থেকে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কবরের পাশে সালাত পড়ে। তিনি কবরকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কররের উপর মসজিদ বানাচ্ছে এবং আল্লাহর ঘরের অনুকরণে তার নাম দিচ্ছে দরগাহ। তিনি কবরে প্রদীপ জ্বালাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কবরে প্রদীপ জ্বালানোর উদ্দেশ্যে জায়গা পর্যন্ত ওয়াকফ করে থাকে। তিনি কবরকে ঈদ উৎসবের স্থান বানাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এসব লোক কবরস্থানকে ঈদ উৎসব ও কুরবানীর স্থানে পরিণত করেছে এবং ঈদে যেমন তারা একত্রিত হয় তেমন, বরং তার চেয়েও বেশি তারা কবরের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়।
তিনি কবরসমূহকে সমান করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বলেন,
“আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হলো যেখানেই প্রতিমা ও ভাস্কর্য দেখবে ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই সুউচ্চ কবর দেখবে সমান করে দেবে”।[8]
সহীহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় সুমামাহ বইন শুফাই বলেন,
“আমরা রোম দেশের বুরুদেস নামক স্থানে ফাদালাহ বিন উবায়েদ এর সাথে ছিলাম। সেখানে আমাদের এক সাথী মারা গেলেন। তার দাফন কার্যের সময় ফাদালাহ তার কবর সমান করে দেওয়ার হুকুম দিলেন। অতঃপর বললেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, তিনি কবরকে সমান করে দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন”।[9]
কবরের ভক্ত এসব লোকেরা প্রচণ্ডভাবে এ দু‘টি হাদীসের বিরোধীতা করছে এবং বসতগৃহের মতোই কবরকে উঁচু করছে ও এর উপর গম্বুজ তৈরি করছে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. আরো বলেন: দেখুন, কবরের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু অনুমোদন করেছেন ও ইতিঃপূর্বে উল্লিখিত যে সব কিছু থেকে নিষেধ করেছেন এবং এসব লোকেরা যা কিছু আইনসিদ্ধ করছে- এতদুভয়ের মধ্যে কী বিরাট পার্থক্য। নিঃসন্দেহে এতে অনেক বিপর্যয় রয়েছে যা গুণে শেষ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
এরপর তিনি এসব বিপর্যয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পরিশেষে বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে এ ব্যাপারে যে নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করেছেন, তা শুধু আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং কবরবাসীর জন্য দো‘আ, রহমত কামনা, ইস্তেগফার ও তার মুক্তির জন্য প্রার্থনার মাধ্যমে তার উপকার করার উদ্দেশ্যেই করেছেন। এর ফলে যিয়ারতকারী নিজের ও মৃতের উভয়েরই কল্যাণ সাধন করছে। পক্ষান্তরে কবরপন্থী এ মুশরিকগণ পুরো ব্যাপারটাকেই পাল্টে দিয়েছে এবং দীনকে বদলে দিয়েছে। মৃতের সাথে আল্লাহর শরীক করা, মৃতের কাছে ও মৃতের অসীলায় দো‘আ করা, তার কাছে স্বীয় হাজাত পূরণের প্রার্থনা করা, তার কাছে বরকত চাওয়া, ও শত্রুর বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্যের আবেদন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে তারা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বানিয়ে নিয়েছে। এসবের মধ্যে যদি কোনো ক্ষতি নেই বলে ধরে নেওয়াও হয়, তা সত্বেও শরী‘আত প্রণীত দো‘আ রহমত কামনা, ও ইস্তেগফার ইত্যাদি কাজের বরকত থেকে তো তারা বঞ্চিত হয়।
এদ্বারা এটাই প্রতিভাত হয় যে, মাযারের উদ্দেশ্যে মান্নত ও কুরবানী করা বড় শির্ক। কবরের উপর কোনো ইমারত তৈরি না করা ও মসজিদ না বানানোর যে আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছিল তার পরিপন্থী আমল করাই হলো এর মূল কারণ। কেননা যখনই কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা হয় এবং পাশে মসজিদ ও মাযার তৈরি করা হয় তখনই জাহেল ও অজ্ঞ লোকেরা ভাবতে শুরু করে যে, কবরবাসীগণ উপকার ও ক্ষতি দুই-ই করতে পারেন। আর যে তাদের কাছে সাহায্য চায় তারা তাকে সাহায্য করেত পারেন এবং তাদের কাছে গেলে তারা হাজাত ও প্রয়োজন পুরা করেন। এজন্যই তারা কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে মান্নত ও কুরবানী পেশ করে। যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমারূপে এসব কবরের আজ উপাসনা করা হচ্ছে। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রার্থনা করেছিলেন,
“হে আল্লাহ! আমার কবরকে এমন প্রতিমায় পরিণত করো না, যার উপাসনা করা হয়”।[10]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এজন্যেই এ দো‘আ করেছিলেন যে তাঁর কবর ছাড়া অনেক কবরেই এ ধরনের অবস্থা দেখা দিতে পারে। প্রকৃত পক্ষে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই এ ব্যাপারটি ঘটেছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দো‘আ করেছিলেন সে দো‘আর বরকতেই আল্লাহ তাঁর কবরকে শির্কের পঙ্কিলতা থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও কিছু সংখ্যক জাহেল ও কুসংস্কারচ্ছন্ন লোক তাঁর মসজিদে কখনো কখনো তার হিদায়াতের খিলাপ কাজ করে ফেলে; কিন্তু তারা তার কবর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না কেননা তাঁর কবর তাঁর ঘরের অভ্যন্তরে, মসজিদের অন্তর্গত নয় এবং সেটি চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যেমন, ইবনুল কাইয়্যেম তার ‘নুনিয়া’ কাব্যগ্রন্থে বলেন,
“তাঁর দো‘আ রাব্বুল আলামীন করেছেন কবুল তিনটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরেছেন নির্ভুল”।
[1] সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৯; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৩২৪৯
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৪৫
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৯
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৭০
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২৯
[6] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩২
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২২
[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৯
[9] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৮
[10] মুআত্তা মালিক, হাদীস নং ৫৯৩; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৭৩৫৮
১. তিনি আওলিয়া ও পূণ্যবান লোকদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে নিষেধ করেছেন। কেননা এ ধরনের বাড়াবাড়ি করতে করতে মানুষ তাঁদের ইবাদাতে ও উপাসনায় লিপ্ত হয়। তিনি বলেন,
«إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ؛ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِالْغُلُوِّ فِي الدِّينِ»
“বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাক। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার ফলে ধ্বংস ও বিনাশ হয়ে গিয়েছে”।[1]
তিনি আরো বলেন,
«لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ، وَرَسُولُهُ»
“আমার ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না, যে ভাবে নাসারাগণ মরিয়ম পুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছিলো। কেননা আমি শুধু একজন বান্দা। অতএব, আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলুল্লাহ হিসেবে অভিহিত করো”।[2]
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর সৌধ স্থাপন করা থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন, আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: আলী ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আমাকে বলেন যে,
«أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ»
“আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হলো যেখানেই প্রতিমা ও ভাস্কার্য দেখবে ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই সুউচ্চ কবর দেখবে সমান করে দেবে”।[3]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে চুনকাম করা ও সৌধ তৈরী করা থেকে নিষেধ করেছেন। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ، وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ، وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর চুনকাম করা, তার উপর বসা ও সৌধ তৈরি করা থেকে নিষেধ করেছেন”।[4]
৩. কবরের পাশে সালাত পড়া থেকেও তিনি সতর্ক করেছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত্যুকালীন রোগশয্যায় চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে নিতেন। যখন এতে কষ্ট লাগতো তখন মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিতেন। এমতাবস্থায় তিনি বলেছিলেন,
«لَعَنَةُ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» قَالَتْ: «فَلَوْلَا ذَاكَ أُبْرِزَ قَبْرُهُ، غَيْرَ أَنَّهُ خُشِيَ أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدًا»
‘‘ইয়াহুদী ও নাসারাদের ওপর আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হোক। কারণ, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ তথা সাজদাহর স্থান বানিয়ে নিয়েছে”। তাদের এসব কাজ-কর্ম থেকে তিনি স্বীয় উম্মাতকে সতর্ক করে দিয়েছেন। লোকেরা তাঁর কবরকে সিজদাগাহ বানাবে এ আশংকা যদি না থাকতো তাহলে তাঁর কবর উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো”।[5]
«أَلَا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ، أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ، إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ»
“জেনে রাখ, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা নিজেদের নবীদের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিত। সাবধান, তোমরা কবরসমূহকে মসজিদ তথা সাজদাহর স্থান বানাবে না। আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি”।[6]
কবরকে মসজিদ বানানোর অর্থ হলো কবরের পাশে সালাত পড়া, যদিও কবরের উপর কোনো মসজিদ তৈরি না করা হয়। সুতরাং যে কোনো স্থানকেই নামাযের জন্য নির্দিষ্ট করা হবে তাই মসজিদ বলে গণ্য হবে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«جُعِلَتْ لِيَ الأرْضُ مَسْجِداً وَطُهُوْرا»
“সকল যমীনকে আমার জন্য সাজদাহর স্থান ও পবিত্র বানিয়ে দেওয়া হয়েছে”।[7]
আর যদি কবরের উপর মসজিদ বানানো হয় সেটা আরো ভয়াবহ ব্যাপার।
অধিকাংশ লোকই এসব ব্যাপারে শরী‘আতের খিলাফ করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তারা শির্কে আকবার তথা বড় শির্কী কাজে ব্যাপৃত হয়ে গেছে। আর কবরের উপরে মসজিদ, মাযার ও মাকাম বানিয়ে নিয়েছে, যাতে শির্কে আকবারের সকল প্রকার কাজ-কর্মের চর্চা করা হচ্ছে। যেমন, কবরের উদ্দেশ্যে যবেহ করা হচ্ছে, কবরবাসীদের কাছে দো‘আ চাওয়া হচ্ছে ও তাদের সাহায্য ও মদদ প্রার্থনা করা হচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্যে মান্নত প্রভৃতি করা হচ্ছে।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: যে ব্যক্তি কবরসমূহের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত, তাঁর আদেশ-নিষেধ ও তাঁর সাহাবীগণের আদর্শ এবং আজকাল মানুষ যেসব কাজ করে থাকে এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়, সে মূলতঃ এর একটিকে অন্যটির বিপরীত ও প্রতিকূল দেখতে পাবে এমনভাবে যে, এ দু‘টি বিষয়ে কখনো সামঞ্জস্য বিধান করা যেতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে সালাত পড়া থেকে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কবরের পাশে সালাত পড়ে। তিনি কবরকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কররের উপর মসজিদ বানাচ্ছে এবং আল্লাহর ঘরের অনুকরণে তার নাম দিচ্ছে দরগাহ। তিনি কবরে প্রদীপ জ্বালাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কবরে প্রদীপ জ্বালানোর উদ্দেশ্যে জায়গা পর্যন্ত ওয়াকফ করে থাকে। তিনি কবরকে ঈদ উৎসবের স্থান বানাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এসব লোক কবরস্থানকে ঈদ উৎসব ও কুরবানীর স্থানে পরিণত করেছে এবং ঈদে যেমন তারা একত্রিত হয় তেমন, বরং তার চেয়েও বেশি তারা কবরের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়।
তিনি কবরসমূহকে সমান করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বলেন,
«أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ «أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ»
“আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হলো যেখানেই প্রতিমা ও ভাস্কর্য দেখবে ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই সুউচ্চ কবর দেখবে সমান করে দেবে”।[8]
সহীহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় সুমামাহ বইন শুফাই বলেন,
«كُنَّا مَعَ فَضَالَةَ بْنِ عُبَيْدٍ بِأَرْضِ الرُّومِ بِرُودِسَ، فَتُوُفِّيَ صَاحِبٌ لَنَا، فَأَمَرَ فَضَالَةُ بْنُ عُبَيْدٍ بِقَبْرِهِ فَسُوِّيَ»، ثُمَّ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَأْمُرُ بِتَسْوِيَتِهَا»
“আমরা রোম দেশের বুরুদেস নামক স্থানে ফাদালাহ বিন উবায়েদ এর সাথে ছিলাম। সেখানে আমাদের এক সাথী মারা গেলেন। তার দাফন কার্যের সময় ফাদালাহ তার কবর সমান করে দেওয়ার হুকুম দিলেন। অতঃপর বললেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, তিনি কবরকে সমান করে দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন”।[9]
কবরের ভক্ত এসব লোকেরা প্রচণ্ডভাবে এ দু‘টি হাদীসের বিরোধীতা করছে এবং বসতগৃহের মতোই কবরকে উঁচু করছে ও এর উপর গম্বুজ তৈরি করছে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. আরো বলেন: দেখুন, কবরের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু অনুমোদন করেছেন ও ইতিঃপূর্বে উল্লিখিত যে সব কিছু থেকে নিষেধ করেছেন এবং এসব লোকেরা যা কিছু আইনসিদ্ধ করছে- এতদুভয়ের মধ্যে কী বিরাট পার্থক্য। নিঃসন্দেহে এতে অনেক বিপর্যয় রয়েছে যা গুণে শেষ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
এরপর তিনি এসব বিপর্যয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পরিশেষে বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে এ ব্যাপারে যে নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করেছেন, তা শুধু আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং কবরবাসীর জন্য দো‘আ, রহমত কামনা, ইস্তেগফার ও তার মুক্তির জন্য প্রার্থনার মাধ্যমে তার উপকার করার উদ্দেশ্যেই করেছেন। এর ফলে যিয়ারতকারী নিজের ও মৃতের উভয়েরই কল্যাণ সাধন করছে। পক্ষান্তরে কবরপন্থী এ মুশরিকগণ পুরো ব্যাপারটাকেই পাল্টে দিয়েছে এবং দীনকে বদলে দিয়েছে। মৃতের সাথে আল্লাহর শরীক করা, মৃতের কাছে ও মৃতের অসীলায় দো‘আ করা, তার কাছে স্বীয় হাজাত পূরণের প্রার্থনা করা, তার কাছে বরকত চাওয়া, ও শত্রুর বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্যের আবেদন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে তারা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বানিয়ে নিয়েছে। এসবের মধ্যে যদি কোনো ক্ষতি নেই বলে ধরে নেওয়াও হয়, তা সত্বেও শরী‘আত প্রণীত দো‘আ রহমত কামনা, ও ইস্তেগফার ইত্যাদি কাজের বরকত থেকে তো তারা বঞ্চিত হয়।
এদ্বারা এটাই প্রতিভাত হয় যে, মাযারের উদ্দেশ্যে মান্নত ও কুরবানী করা বড় শির্ক। কবরের উপর কোনো ইমারত তৈরি না করা ও মসজিদ না বানানোর যে আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছিল তার পরিপন্থী আমল করাই হলো এর মূল কারণ। কেননা যখনই কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা হয় এবং পাশে মসজিদ ও মাযার তৈরি করা হয় তখনই জাহেল ও অজ্ঞ লোকেরা ভাবতে শুরু করে যে, কবরবাসীগণ উপকার ও ক্ষতি দুই-ই করতে পারেন। আর যে তাদের কাছে সাহায্য চায় তারা তাকে সাহায্য করেত পারেন এবং তাদের কাছে গেলে তারা হাজাত ও প্রয়োজন পুরা করেন। এজন্যই তারা কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে মান্নত ও কুরবানী পেশ করে। যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমারূপে এসব কবরের আজ উপাসনা করা হচ্ছে। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রার্থনা করেছিলেন,
«اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَناً يَعْبُدُ»
“হে আল্লাহ! আমার কবরকে এমন প্রতিমায় পরিণত করো না, যার উপাসনা করা হয়”।[10]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এজন্যেই এ দো‘আ করেছিলেন যে তাঁর কবর ছাড়া অনেক কবরেই এ ধরনের অবস্থা দেখা দিতে পারে। প্রকৃত পক্ষে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই এ ব্যাপারটি ঘটেছে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দো‘আ করেছিলেন সে দো‘আর বরকতেই আল্লাহ তাঁর কবরকে শির্কের পঙ্কিলতা থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও কিছু সংখ্যক জাহেল ও কুসংস্কারচ্ছন্ন লোক তাঁর মসজিদে কখনো কখনো তার হিদায়াতের খিলাপ কাজ করে ফেলে; কিন্তু তারা তার কবর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না কেননা তাঁর কবর তাঁর ঘরের অভ্যন্তরে, মসজিদের অন্তর্গত নয় এবং সেটি চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যেমন, ইবনুল কাইয়্যেম তার ‘নুনিয়া’ কাব্যগ্রন্থে বলেন,
فأجاب رب العالمين دعاءه :: وأحاطه بثلاثة الجدران
“তাঁর দো‘আ রাব্বুল আলামীন করেছেন কবুল তিনটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরেছেন নির্ভুল”।
[1] সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৯; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৩২৪৯
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৪৪৫
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৯
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৭০
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২৯
[6] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩২
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২২
[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৯
[9] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৮
[10] মুআত্তা মালিক, হাদীস নং ৫৯৩; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৭৩৫৮