(১৪) সরাসরি ভুলকারীর নাম না বলে আমভাবে বলা :
আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘লোকদের কি হ’ল যে তারা তাদের সালাতে আকাশ পানে চোখ তুলে তাকায়। এ ক্ষেত্রে তাঁর কথা এতটা চড়া হয়ে দাঁড়ায় যে, তিনি বলেন, হয় তারা এরূপ করা থেকে বিরত হবে, নয় তাদের চোখ উপড়ে ফেলা হবে’।[1]
আয়েশা (রাঃ) যখন বারীরা নামক দাসীকে কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন তার মালিক পক্ষ মৃত্যুর পর বারীরার সম্পত্তি তারা পাবে- এতদশর্ত জুড়ে দিয়ে বেচতে রাযী হয়েছিল। নবী করীম (ﷺ) এ কথা জানতে পেরে জনতার মধ্যে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে যান। তিনি প্রথমে আল্লাহর গুণাবলী ও প্রশংসা বর্ণনা করেন। তারপর বলেন, কিছু লোকের কি হ’ল যে, তারা এমন সব শর্ত আরোপ করে যা আল্লাহর কিতাবে নেই? যে শর্ত আল্লাহর কিতাবে নেই তা সর্বতোভাবে বাতিল, চাই তার সংখ্যা একশ’ পর্যন্ত হোক না কেন। আল্লাহর ফায়ছালাই চূড়ান্তভাবে ন্যায্য এবং আল্লাহর শর্তই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। দাসের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি সেই পাবে যে তাকে মুক্ত করে দিয়েছে।[2]
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘নবী করীম (ﷺ) একটা কিছু বানালেন এবং অন্যদেরও তা করার অবকাশ দিলেন। কিন্তু কিছু লোক তা করা থেকে দূরে থাকল। নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এ খবর যখন পৌঁছল তখন তিনি ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি আল্লাহর প্রশংসার পর বললেন, কিছু লোকের হ’ল কি? তারা এমন জিনিস থেকে বিরত থাকে, যা আমি করেছি। আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তাদের থেকে বেশী জানি এবং তাদের থেকে অনেক বেশী তাকে ভয় করি’।[3]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদে কিবলার দিকে কফ জড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলেন। তিনি লোকদের সামনে মুখোমুখি হয়ে বললেন, তোমাদের কোন একজনের কি হ’ল যে, সে তার মালিককে সামনে করে দাঁড়ায় এবং তার সামনে কফ ফেলে। তোমাদের কাউকে সামনে দাঁড় করিয়ে তার মুখে কফ ফেললে সে কি তা ভাল মনে করবে? তোমরা কেউ যখন কফ ফেলবে তখন যেন সে তার বাম দিকে অথবা তার পায়ের তলায় ফেলে। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহ’লে এমনটা করবে। বর্ণনাকারী কাসেম হাতে-কলমে তা দেখিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি তার কাপড়ে থুথু ফেললেন। তারপর কাপড়ের একাংশ দ্বারা অন্য অংশ মর্দন করলেন’।[4]
নাসাঈ তার সুনানে নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন,
‘একদিন তিনি ফজর সালাত আদায় করছিলেন। সালাতে সূরা রূম পড়তে গিয়ে পড়া এলোমেলো হয়ে যায়। সালাত শেষ করে তিনি বলেন, লোকদের কি হ’ল যে, তারা আমাদের সাথে সালাতে শরীক হয় অথচ ভাল করে পবিত্রতা অর্জন (ওযূ-গোসল) করে না। ফলে তার কারণে কুরআন পড়তে আমাদের গোলমাল হয়ে যায়’।[5]
এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। তবে আব্দুল মালেক বিন উমায়ের সম্পর্কে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, তিনি নির্ভরযোগ্য বিদ্বান নন। তার স্মৃতি বিকৃতি ঘটেছিল, কখনো কখনো তিনি তাদলীস করতেন। (স্বীয় শিক্ষকের নাম গোপন করে অন্যের নাম বলতেন)। এ হাদীস ইমাম আহমাদ আবু রাওহ আল-কিলাঈ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক সালাতে আমাদের ইমামতি করেন। তাতে তিনি সূরা রূম পড়েন। কিন্তু কিছু জায়গায় তাঁর পড়া এলোমেলো বা বাধাগ্রস্ত হয়। (সালাত শেষে) তিনি বলেন, শয়তানই আমাদের কিরা’আত পাঠে বাধা সৃষ্টি করেছে। এর কারণ- কিছু লোক ভালমত ওযূ না করে সালাতে আসে। সুতরাং তোমরা যখন সালাতে আসবে তখন ভালভাবে ওযূ করে আসবে।
অনুরূপভাবে তিনি শু‘বার বরাতে আব্দুল মালেক বিন উমায়ের থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আবু রাওহ শাবীবকে বলতে শুনেছি, তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ফজর সালাত আদায় করছিলেন, তাতে তিনি সূরা রূম পড়েন। কিন্তু সূরা পড়তে তাঁর উলটপালট হয়ে যায়।
এছাড়াও ইমাম আহমাদ (রহঃ) যায়েদা ও সুফিয়ানের সনদে আব্দুল মালেক থেকে এটি বর্ণনা করেছেন।[6]
এরূপ উদাহরণ আরো অনেক আছে। এখানে ভুলের শিকার লোকদের অপমান না করার উদ্দেশ্যে এভাবে বলা হয়েছে। আসলে ভুলকারীর নাম সরাসরি না বলে পরোক্ষভাবে বলায় কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন-
(ক) ভুলকারীকে নাম ধরে নিষেধ করলে তার মনে ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ইচ্ছা জেগে ওঠে, কিন্তু নাম না নেওয়ায় তা হয় না। ভুলকারী নেতিবাচক কাজের পুনরাবৃত্তি থেকে দূরে থাকবে।
(খ) এভাবে বলায় মানব মনে গাঢ় প্রভাব পড়ে এবং সে কথা মেনে নিতে বেশী তৎপর হয়।
(গ) লোক সমাজে ভুলকারীর নাম গোপন থাকে।
(ঘ) প্রশিক্ষণদাতার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং ভুলকারীর সঙ্গে হিতাকাঙ্ক্ষী প্রশিক্ষকের মুহাববত গভীর হয়।
নামোল্লেখ না করে পরোক্ষভাবে বলার ক্ষেত্রে একটা সতর্কতার ব্যাপারও রয়েছে। ভুলকারীকে নামোল্লেখের মাধ্যমে অপমান-অপদস্থ না করে পরোক্ষভাবে শারঈ হুকুম তখনই কার্যকরী হবে, যখন তার ভুলের বিষয়টি অধিকাংশ মানুষের কাছে গোপন থাকবে। কিন্তু যখন তার ভুল বা অপরাধ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ জ্ঞাত এবং সেও তা জানে সেক্ষেত্রে জনগণের সামনে পরোক্ষভাবে বললেও তা তার জন্য আরও বেশী লজ্জাকর ও ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি তার জীবনের গন্ডিও সংকীর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় এমন কামনাও হ’তে পারে যে, তাকে পরোক্ষভাবে না বলে যদি সামনাসামনি একান্তে বলা হ’ত তাহ’লে তা কতই না ভাল হ’ত। আসলে প্রভাবক সমূহের মাঝে তারতম্য থাকে। যেমন- (১) কে কথা বলছে? (২) কাদের সামনে কথা বলা হচ্ছে? (৩) কথাগুলো কি জোশ ও ভীতির সুরে বলা হচ্ছে, না উপদেশের সুরে বলা হচ্ছে?
অতএব পরোক্ষ পদ্ধতি ভুলকারী ও অন্যদের জন্য তখনই উপকারী হবে, যখন তা কৌশল ও প্রজ্ঞার সাথে প্রয়োগ করা হবে।
(১৫) জনসাধারণকে ভুলকারীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা :
এ পদক্ষেপ কেবলই নির্দিষ্ট অবস্থা ও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খুব সূক্ষ্মভাবে মেপেজোখে এরূপ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে কোন রকম কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখা দেয়। নিচে এ পন্থা সংক্রান্ত নবী করীম (ﷺ)-এর উদাহরণ তুলে ধরা হ’ল।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল। তিনি তাকে বললেন, যাও, ছবর কর। এভাবে সে দু’বার কিংবা তিনবার এল। পরের বার তিনি বললেন, তোমার মাল রাস্তার উপর ফেলে রাখ। ফলে সে তার মালপত্র রাস্তার উপর ফেলে রাখল। লোকেরা এ দেখে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল। তখন সে তাদেরকে তার দূরবস্থার কথা জানিয়ে দিল। ফলে লোকেরা ঐ প্রতিবেশীকে অভিশাপ দিতে লাগল- আল্লাহ তার এ করুক, তা করুক ইত্যাদি। তখন তার প্রতিবেশী তার কাছে এসে বলল, তুমি ফিরে যাও, এখন থেকে তুমি আমার থেকে অশোভন কোন আচরণ দেখতে পাবে না’।[7]
(১৬) ভুলকারীর বিরুদ্ধে শয়তানকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকা :
ওমর বিনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘নবী করীম (ﷺ)-এর যুগে আব্দুল্লাহ নামে এক লোক ছিল। তার উপাধি ছিল হিমার বা গাধা। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হাসাত। মদ পানের অভিযোগে রাসূল (ﷺ) তাকে চাবুক মেরেছিলেন। (মদ পানের জন্য) একদিন তাকে তাঁর নিকটে ধরে আনা হয়। তিনি তাকে শাস্তি দানের নির্দেশ দেন। তাকে চাবুক মারা হ’ল। অতঃপর উপস্থিত একজন বলল, হে আল্লাহ! তার পক্ষে যতটা সম্ভব তার থেকেও বেশী অভিশাপ তুমি তার উপর বর্ষণ কর। নবী করীম (ﷺ) তখন বললেন, তোমরা তাকে অভিশাপ দিও না। আল্লাহর কসম! আমার জানা মতে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে’।[8]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট একজন নেশাগ্রস্তকে হাযির করা হ’ল। তিনি তাকে আঘাত করতে নির্দেশ দিলেন। তখন আমাদের কেউ তাকে হাত দিয়ে মারল, কেউ চটি দিয়ে মারল, কেউবা তার কাপড় দিয়ে মারল। মার খেয়ে লোকটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন একজন লোক বলে উঠল, তার কি হয়েছে? আল্লাহ তাকে অপদস্থ করুন। তার কথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের বিরুদ্ধে শয়তানের সহযোগী হয়ো না’।[9] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
‘নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এক ব্যক্তিকে হাযির করা হ’ল। সে মদ পান করেছিল। তিনি বললেন, তোমরা তাকে মারো। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, তখন আমাদের কেউ তার হাত দিয়ে তাকে মারল, কেউ তার চটি দিয়ে মারল, কেউবা তার কাপড় দিয়ে মারল। মার খেয়ে লোকটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন উপস্থিত জনতার একজন বলল, আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করুন। তার কথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা এমনভাবে বল না। তার বিরুদ্ধে তোমরা শয়তানকে সাহায্য করো না’।[10]
অন্য বর্ণনায় আছে,
‘তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের বললেন, তোমরা তাকে তিরষ্কার করো। তখন সাহাবীগণ তাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, ‘তুমি আল্লাহকে ভয় করনি’, ‘তোমার আল্লাহর ভয় নেই’ ‘আল্লাহর রাসূলের প্রতি তোমার শরম নেই’। তারপর তারা তাকে ছেড়ে দিল। বর্ণনার শেষে তিনি বলছিলেন, তোমরা বরং বল ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, তুমি তার উপর দয়া করো। বর্ণনাকারীদের কেউ কেউ এমনতর কিছু শব্দ বেশীও বলেছেন’।[11]
অন্য বর্ণনায় আছে,
‘লোকটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন একজন লোক বলে উঠল, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এভাবে বলো না! তার বিরুদ্ধে শয়তানকে সহযোগিতা করো না; বরং তোমরা বলবে, আল্লাহ তোমার উপর দয়া করুন’।[12]
উক্ত বর্ণনাগুলোর সমষ্টিগত অর্থ থেকে বুঝা যায়, মুসলমান যতই পাপ করুক তার মধ্যে ইসলামের শিকড় থেকে যায় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসার শিকড়ও থেকে যায়। সুতরাং তাকে ইসলাম থেকে খারিজ বলা যাবে না, তার বিরুদ্ধে এমন কোন দো‘আ করা যাবে না যাতে শয়তানের সহযোগিতা করা হয়। বরং তার জন্য হেদায়াত, মাগফিরাত ও রহমতের দো‘আ করতে হবে।
(১৭) ভুল কাজ বন্ধ করতে বলা :
ভুলকারী যাতে বারবার ভুল কাজ না করতে থাকে, সেজন্য তাকে ভুল কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতে মন্দের পরিসর যেমন বাড়বে না, তেমনি কালবিলম্ব না করে মন্দের নিষেধ করাও হবে।
ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একবার তিনি শপথ করতে গিয়ে বলেন,
‘আমার পিতার কসম! এটা হবার নয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, (ওমর) থামো। যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে শপথ করে, সে নিশ্চিত শিরক করে’।[13] আবুদাঊদ তাঁর সুনান গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
‘জুম‘আর দিনে এক লোক (মসজিদের মধ্যে) মানুষের ঘাড়ের উপর দিয়ে পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছিল। নবী করীম (ﷺ) তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি বসে পড়। কেননা তুমি ইতিমধ্যে লোকদের কষ্ট দিয়ে ফেলেছ’।[14]
ইমাম তিরমিযী ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর সন্নিকটে (খেয়ে-দেয়ে) ঢেকুর তুলছিল। তখন তিনি তাকে বললেন, আমাদের থেকে তোমার ঢেকুর তোলা থামাও। কেননা দুনিয়াতে যারা যত বেশী পেট পুরে খাবে ক্বিয়ামতের দিন তাদের তত বেশী ক্ষুধার্ত থাকতে হবে’।[15] এই হাদীসগুলোতে ভুলকারীকে তার ভুল কাজ থেকে বিরত থাকতে সরাসরি বলা হয়েছে।
(১৮) ভুলকারীকে তার ভুল সংশোধন করতে বলার নির্দেশ দেওয়া :
নবী করীম (ﷺ) নানাভাবে এ কাজ করেছেন। যেমন-
(ক) ভুলকারীর দৃষ্টি তার ভুলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে সে নিজেই তার ভুল শুধরে নিতে পারে। এর উদাহরণ আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীস। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে ছিলেন,
‘এমন সময় নবী করীম (ﷺ) মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন, এক ব্যক্তি মসজিদের মাঝ বরাবর বসে আছে। সে তার দু’হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের মধ্যে ঢুকিয়ে আপন মনে কথা বলছে। নবী করীম (ﷺ) তার এ কাজের প্রতি ইশারা করলেন। কিন্তু সে বুঝতে পারল না। তখন তিনি আবু সাঈদের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন, তোমাদের কেউ যখন সালাত আদায় করবে তখন যেন সে তার আঙ্গুলগুলোর মধ্যে কখনই আঙ্গুল না ঢুকায়। কেননা আঙ্গুলের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকানো শয়তানের কাজ। অবশ্যই তোমাদের যে কোন লোক যতক্ষণ মসজিদে থাকবে ততক্ষণ সে সালাতে রত বলে গণ্য হবে, যে পর্যন্ত না সে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবে’।[16]
(খ) সম্ভব হ’লে কাজটিকে পুনরায় সঠিক পদ্ধতিতে করতে বলা : আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদের এক কোণে বসা ছিলেন। এমন সময় এক লোক মসজিদে ঢুকে সালাত আদায় করল। তারপর সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিল। তিনি বললেন, তুমি (তোমার জায়গায়) ফিরে গিয়ে পুনরায় সালাত আদায় কর। কেননা তোমার সালাত আদায় হয়নি। সে ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করল। আবার এসে সে সালাম দিল। তিনি বললেন, তোমার উপরও সালাম, তুমি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কেননা তোমার সালাত হয়নি। সে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বারে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, যখন তুমি সালাতে দাঁড়াবে তখন (তার আগে) ভালমত ওযূ করবে। তারপর কিবলামুখী হয়ে তাকবীর বলবে, তারপর তোমার পক্ষে কুরআন থেকে যতটুকু সহজ হয় ততটুকু পড়বে, তারপর রুকূ করবে, রুকূতে ধীরস্থির ও প্রশান্ত অবস্থায় থাকবে। তারপর মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে; তারপর সিজদা করবে এবং ধীরস্থির ও প্রশান্ত অবস্থায় থাকবে। অতঃপর মাথা তুলে স্থির হয়ে বসবে, পরে স্থির হয়ে আরেকটি সিজদা করবে, তারপর মাথা তুলে স্থির হয়ে বসবে। তোমার সমস্ত সালাতে তুমি এভাবে করবে’।[17]
লক্ষ্যণীয় :
নবী করীম (ﷺ) তাঁর আশপাশের লোকদের কার্যাবলী ভালভাবে লক্ষ্য করতেন। তাদেরকে শিক্ষা দান ও ভুল শুধরে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এসব করতেন। এ সম্পর্কে নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে,
‘এক ব্যক্তি মসজিদে ঢুকে সালাত আদায় শুরু করল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে লক্ষ্য করছিলেন, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনি। লোকটার যখন সালাত শেষ হ’ল তখন সে এগিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিল। তিনি তাকে বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কেননা তোমার সালাত আদায় হয়নি’...।[18]
আসলে সঙ্গী-সাথীদের কাজের তদারকি বা দেখভাল করা অভিভাবকের অন্যতম গুণ।
ভুলকারীর কাজ পুনরায় করতে বলা শিক্ষাদানের একটি কৌশল। হয়তো সে তার ভুল ধরতে পেরে নিজ থেকে ভুল শুধরে নিবে। বিশেষ করে যখন ভুলটা হবে স্পষ্ট- যা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য অনেক সময় স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে পারে, ফলে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হ’তে পারে।
ভুলকারী যখন নিজের ভুল না ধরতে পারে তখন বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা আবশ্যিক।
যখন কোন ব্যক্তি জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন জানায় এবং গভীরভাবে মনোনিবেশ করে, তখন তাকে শিক্ষাদান প্রথম থেকে কোন আগ্রহ প্রকাশ ও আবেদন জানানো ছাড়াই শিক্ষাদানের তুলনায় তার মস্তিষ্কে অনেক বেশী ক্রিয়া করে এবং দীর্ঘ দিন তা মনে থাকে।
শিক্ষাদান পদ্ধতি আসলে অনেক রকম। স্থান-কাল-পাত্র বুঝে শিক্ষক তা প্রয়োগ করবেন।
ভুল কাজকে সঠিক পন্থায় পুনরায় করতে বলার আরেকটি উদাহরণ সহীহ মুসলিমে জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস। তিনি বলেন,
‘ওমর বিনুল খাত্ত্বাব আমাকে জানিয়েছেন যে, এক লোক ওযূ করতে গিয়ে তার এক পায়ে নখ পরিমাণ জায়গা ধোয়া বাদ রেখে দেয়। নবী করীম (ﷺ)-এর নযরে তা ধরা পড়ে। তিনি তা দেখে বললেন, তুমি পুনরায় ভাল করে ওযূ কর। লোকটা পুনরায় ওযূ করে এসে সালাত আদায় করল’।[19]
উল্লিখিত ধারার তৃতীয় উদাহরণ তিরমিযী কর্তৃক তাঁর সুনানে বর্ণিত হাদীস। কালদা বিন হাম্বল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘ছাফওয়ান বিন উমাইয়া তাকে দিয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট দুধ, পাইয়োসি (উর্দু ييوس ) ও শশা পাঠান। নবী করীম (ﷺ) তখন মক্কার উঁচু অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁকে সালাম না দিয়ে এবং অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ফলে নবী করীম (ﷺ) বললেন, ফিরে যাও এবং বল, আস-সালামু আলাইকুম আ-আদখুল। (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি কি ভিতরে ঢুকতে পারি)’।[20]
কাজের অনিয়মতান্ত্রিক ধারাকে যথাসম্ভব নিয়মতান্ত্রিক করতে বলা :
ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বরাতে নবী করীম (ﷺ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,
‘কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে মাহরাম (বিবাহ হারাম এমন পুরুষদের সাথে রাখা) ব্যতীত নির্জনে দেখা-সাক্ষাৎ না করে। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো অমুক অমুক যুদ্ধের জন্য আমার নাম লিখিয়েছি, অথচ এ দিকে আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তিনি বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ কর’।[21]
ভুলের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সংশোধন :
নাসাঈ তার সুনানে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন,
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার কাছে হিজরতের শর্তে বায়‘আত করতে এসেছি। কিন্তু আমি যখন আমার মাতা-পিতাকে ছেড়ে আসি তখন তারা কাঁদছিলেন। তিনি বললেন, তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও এবং যেভাবে তাদের কাঁদিয়েছিলে সেভাবে তাদের হাসাও’।[22]
ভুলের কাফফারা প্রদান :
যখন ভুল সংশোধনের উল্লিখিত বা অন্য কোন উপায় পাওয়া না যায়, তখন তা থেকে উদ্ধারের জন্য শরী‘আতে কাফফারার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে পাপের চিহ্ন মুছে যায়। যেমন শপথের কাফফারা, যিহারের কাফফারা, ভুলক্রমে হত্যার কাফফারা, রামাযানে দিবসে স্ত্রী সহবাসের কাফফারা ইত্যাদি।
(১৯) কেবল ভুলের স্থান/ক্ষেত্রটুকু বর্জন এবং বাকীটুকু গ্রহণ :
কখনো কখনো পুরো কথা কিংবা কাজ ভুল হয় না। তখন পুরো কাজ কিংবা কথাকে ভুল গণ্য না করে শুধুমাত্র ভুলটুকু নিষেধ করা হবে বুদ্ধিদীপ্ত। এর দৃষ্টান্ত ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। রুবাই বিনতু মুয়াওবিয (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘আমার স্বামী গৃহে যাত্রাকালে নবী করীম (ﷺ) আমাদের ঘরে আসেন। তুমি এখন যেমন আমার কাছে বসে আছ তেমনি তিনি এসে আমার বিছানার উপর বসেন। তখন কিছু ছোট ছোট কিশোরী দফ বাজাতে থাকে এবং বদর যুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে রচিত শোক গাথা গাইতে থাকে। তাদেরই মধ্যে একজন হঠাৎ করে বলে ওঠে, ‘মোদের মাঝে একজন নবী আছেন, যিনি কাল কি হবে তা জানেন’। তখন তিনি বললেন, তুমি এ কথা বলা বাদ দাও; আগে যা বলছিলে তাই বল’।[23]
তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন,
‘এটা বলা থেকে চুপ থাক; আগে যা বলছিলে তা বল’। আবু ঈসা বলেন, এটি হাসান সহীহ হাদীস।[24]
ইবনু মাজার বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন,
‘এই যে কথা বললে তোমরা তা আর বল না। আগামী দিন কি হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না’।[25]
সন্দেহ নেই যে, এমন ধারার নিষেধ ভুলকারীকে ন্যায় ও ইনছাফের সাথে বিষয়টি বিবেচনা করতে অনুপ্রাণিত করে। তাকে শুধরানোও এভাবে সহজ হয় এবং তার জন্য নিষেধকারীর নিষেধ মেনে নিতে প্রস্ত্তত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে অনেক নিষেধকারী ভুলকারীর উপর চরম রেগে যায়, ফলে সে ভুল-নির্ভুল, হক-বাতিল সবটাই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাতে ভুলকারী তার কথা যেমন মেনে নিতে চায় না তেমনি সে নিজকে শুধরাতে ও আগ্রহী হয় না।
কিছু ভুলকারী আছে যাদের উচ্চারিত মূল কথাটি সঠিক; কিন্তু যে উপলক্ষে তারা কথাটি বলছে তা সঠিক নয়। যেমন সূরা ফাতিহা পাঠ এমনিতে সঠিক। কিন্তু একজনের মৃত্যু উপলক্ষে কেউ সূরা ফাতিহা পড়তে বলল, আর অমনি উপস্থিত জনতা তা পড়তে শুরু করল। তারা দলীল হিসাবে বলে, তারা তো কুরআন পড়ছে কোন কুফরী কালাম পড়ছে না। এক্ষেত্রে তাদের নিকট বলা আবশ্যক যে, তাদের ভুল এতটুকুই যে, তারা মৃত ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে ইবাদত মনে করে সূরা ফাতিহা পড়ার রেওয়াজ চালু করেছে। অথচ এ উপলক্ষে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে কোনই দলীল নেই। এভাবে দলীল ছাড়া ইবাদত বানানোই সরাসরি বিদ‘আত। এতদর্থেই ইবনে ওমর (রাঃ) এক ব্যক্তির মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ঐ ব্যক্তি তার পাশে হাঁচি দিয়ে বলেছিল, আলহামদুলিল্লাহ ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ (সকল প্রশংসা আল্লাহর এবং সালাম আল্লাহর রাসূলের উপর) তার উত্তরে ইবনু ওমর বলেন, আমিও বলছি ‘আলহামদুলিল্লাহ ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ’। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের এমনভাবে বলতে শিখাননি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ‘আল হামদুলিল্লাহি আলা-কুল্লি হাল’ (সর্বাবস্থায় আল্লাহর সকল প্রশংসা)।[26]
[1]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭৫০।
[2]. ইমাম বুখারী তাঁর সহীহের একাধিক স্থানে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ফাৎহ হা/৫৬৩৬।
[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬১০১।
[4]. মুসলিম হা/৫৫০।
[5]. নাসাঈ হা/৯৪৭; মিশকাত হা/২৯৫, সনদ যঈফ।
[6]. মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৭৩।
[7]. আবুদাঊদ, হা/৫১৫৩; ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘প্রতিবেশীর অধিকার’ অনুচ্ছেদ, সহীহ আবুদাঊদ হা/৪২৯২।
[8]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৭৮০।
[9]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৭৮১।
[10]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৭৭৭।
[11]. আবুদাঊদ, হা/৪৪৭৮, ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়, ‘মদ পানের দন্ড’ অনুচ্ছেদ; আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহ আবুদাঊদ হা/৩৭৫৯।
[12]. আহমাদ হা/৭৯৭৩, আহমাদ শাকের বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।
[13]. আহমাদ হা/৩২৯, আহমাদ শাকের বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।
[14]. আবুদাঊদ হা/১১১৮, সনদ সহীহ।
[15]. তিরমিযী হা/২৪৭৮, সনদ হাসান; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৪৩।
[16]. আহমাদ হা/১১৫৩০, সনদ যঈফ।
[17]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬২৫১।
[18]. নাসাঈ হা/১৩১৩, হাসান সহীহ।
[19]. মুসলিম হা/২৪৩।
[20]. তিরমিযী হা/২৭১০; সহীহ সুনান তিরমিযী হা/২১৮০।
[21]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫২৩৩।
[22]. নাসাঈ হা/৪১৬৩, সহীহ।
[23]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫১৪৭।
[24]. সুনান তিরমিযী প্রকাশক শাকের হা/১০৯০।
[25]. প্রকাশক আব্দুল বাকী, নং ১৮৭৯; আলবানী এটিকে সহীহ সুনান ইবনু মাজাহতে সহীহ বলেছেন, হা/১৫৩৯)। (ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৭, সহীহ।
[26]. সুনানু তিরমিযী হা/২৭৩৮।
আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَرْفَعُوْنَ أَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِىْ صَلاَتِهِمْ. فَاشْتَدَّ قَوْلُهُ فِىْ ذَلِكَ حَتَّى قَالَ : لَيَنْتَهُنَّ عَنْ ذَلِكَ أَوْ لَتُخْطَفَنَّ أَبْصَارُهُمْ-
‘লোকদের কি হ’ল যে তারা তাদের সালাতে আকাশ পানে চোখ তুলে তাকায়। এ ক্ষেত্রে তাঁর কথা এতটা চড়া হয়ে দাঁড়ায় যে, তিনি বলেন, হয় তারা এরূপ করা থেকে বিরত হবে, নয় তাদের চোখ উপড়ে ফেলা হবে’।[1]
আয়েশা (রাঃ) যখন বারীরা নামক দাসীকে কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন তার মালিক পক্ষ মৃত্যুর পর বারীরার সম্পত্তি তারা পাবে- এতদশর্ত জুড়ে দিয়ে বেচতে রাযী হয়েছিল। নবী করীম (ﷺ) এ কথা জানতে পেরে জনতার মধ্যে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে যান। তিনি প্রথমে আল্লাহর গুণাবলী ও প্রশংসা বর্ণনা করেন। তারপর বলেন, কিছু লোকের কি হ’ল যে, তারা এমন সব শর্ত আরোপ করে যা আল্লাহর কিতাবে নেই? যে শর্ত আল্লাহর কিতাবে নেই তা সর্বতোভাবে বাতিল, চাই তার সংখ্যা একশ’ পর্যন্ত হোক না কেন। আল্লাহর ফায়ছালাই চূড়ান্তভাবে ন্যায্য এবং আল্লাহর শর্তই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। দাসের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি সেই পাবে যে তাকে মুক্ত করে দিয়েছে।[2]
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
صَنَعَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم شَيْئًا فَرَخَّصَ فِيْهِ فَتَنَزَّهَ عَنْهُ قَوْمٌ فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَخَطَبَ فَحَمِدَ اللهَ ثُمَّ قَالَ : مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَتَنَزَّهُوْنَ عَنِ الشَّىْءِ أَصْنَعُهُ، فَوَاللهِ إِنِّىْ لأَعْلَمُهُمْ بِاللهِ وَأَشَدُّهُمْ لَهُ خَشْيَةً-
‘নবী করীম (ﷺ) একটা কিছু বানালেন এবং অন্যদেরও তা করার অবকাশ দিলেন। কিন্তু কিছু লোক তা করা থেকে দূরে থাকল। নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এ খবর যখন পৌঁছল তখন তিনি ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি আল্লাহর প্রশংসার পর বললেন, কিছু লোকের হ’ল কি? তারা এমন জিনিস থেকে বিরত থাকে, যা আমি করেছি। আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তাদের থেকে বেশী জানি এবং তাদের থেকে অনেক বেশী তাকে ভয় করি’।[3]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم رَأَى نُخَامَةً فِىْ قِبْلَةِ الْمَسْجِدِ فَأَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَقَالَ : مَا بَالُ أَحَدِكُمْ يَقُوْمُ مُسْتَقْبِلَ رَبِّهِ فَيَتَنَخَّعُ أَمَامَهُ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يُسْتَقْبَلَ فَيُتَنَخَّعَ فِىْ وَجْهِهِ فَإِذَا تَنَخَّعَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَنَخَّعْ عَنْ يَسَارِهِ تَحْتَ قَدَمِهِ فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيَقُلْ هَكَذَا. وَوَصَفَ الْقَاسِمُ فَتَفَلَ فِىْ ثَوْبِهِ ثُمَّ مَسَحَ بَعْضَهُ عَلَى بَعْضٍ-
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদে কিবলার দিকে কফ জড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলেন। তিনি লোকদের সামনে মুখোমুখি হয়ে বললেন, তোমাদের কোন একজনের কি হ’ল যে, সে তার মালিককে সামনে করে দাঁড়ায় এবং তার সামনে কফ ফেলে। তোমাদের কাউকে সামনে দাঁড় করিয়ে তার মুখে কফ ফেললে সে কি তা ভাল মনে করবে? তোমরা কেউ যখন কফ ফেলবে তখন যেন সে তার বাম দিকে অথবা তার পায়ের তলায় ফেলে। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহ’লে এমনটা করবে। বর্ণনাকারী কাসেম হাতে-কলমে তা দেখিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি তার কাপড়ে থুথু ফেললেন। তারপর কাপড়ের একাংশ দ্বারা অন্য অংশ মর্দন করলেন’।[4]
নাসাঈ তার সুনানে নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন,
أَنَّهُ صَلَّى صَلاَةَ الصُّبْحِ فَقَرَأَ الرُّوْمَ فَالْتَبَسَ عَلَيْهِ فَلَمَّا صَلَّى قَالَ : مَا بَالُ أَقْوَامٍ يُصَلُّوْنَ مَعَنَا لاَ يُحْسِنُوْنَ الطُّهُوْرَ فَإِنَّمَا يَلْبِسُ عَلَيْنَا الْقُرْآنَ أُوْلَئِكَ-
‘একদিন তিনি ফজর সালাত আদায় করছিলেন। সালাতে সূরা রূম পড়তে গিয়ে পড়া এলোমেলো হয়ে যায়। সালাত শেষ করে তিনি বলেন, লোকদের কি হ’ল যে, তারা আমাদের সাথে সালাতে শরীক হয় অথচ ভাল করে পবিত্রতা অর্জন (ওযূ-গোসল) করে না। ফলে তার কারণে কুরআন পড়তে আমাদের গোলমাল হয়ে যায়’।[5]
এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। তবে আব্দুল মালেক বিন উমায়ের সম্পর্কে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেছেন, তিনি নির্ভরযোগ্য বিদ্বান নন। তার স্মৃতি বিকৃতি ঘটেছিল, কখনো কখনো তিনি তাদলীস করতেন। (স্বীয় শিক্ষকের নাম গোপন করে অন্যের নাম বলতেন)। এ হাদীস ইমাম আহমাদ আবু রাওহ আল-কিলাঈ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক সালাতে আমাদের ইমামতি করেন। তাতে তিনি সূরা রূম পড়েন। কিন্তু কিছু জায়গায় তাঁর পড়া এলোমেলো বা বাধাগ্রস্ত হয়। (সালাত শেষে) তিনি বলেন, শয়তানই আমাদের কিরা’আত পাঠে বাধা সৃষ্টি করেছে। এর কারণ- কিছু লোক ভালমত ওযূ না করে সালাতে আসে। সুতরাং তোমরা যখন সালাতে আসবে তখন ভালভাবে ওযূ করে আসবে।
অনুরূপভাবে তিনি শু‘বার বরাতে আব্দুল মালেক বিন উমায়ের থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আবু রাওহ শাবীবকে বলতে শুনেছি, তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ফজর সালাত আদায় করছিলেন, তাতে তিনি সূরা রূম পড়েন। কিন্তু সূরা পড়তে তাঁর উলটপালট হয়ে যায়।
এছাড়াও ইমাম আহমাদ (রহঃ) যায়েদা ও সুফিয়ানের সনদে আব্দুল মালেক থেকে এটি বর্ণনা করেছেন।[6]
এরূপ উদাহরণ আরো অনেক আছে। এখানে ভুলের শিকার লোকদের অপমান না করার উদ্দেশ্যে এভাবে বলা হয়েছে। আসলে ভুলকারীর নাম সরাসরি না বলে পরোক্ষভাবে বলায় কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন-
(ক) ভুলকারীকে নাম ধরে নিষেধ করলে তার মনে ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ইচ্ছা জেগে ওঠে, কিন্তু নাম না নেওয়ায় তা হয় না। ভুলকারী নেতিবাচক কাজের পুনরাবৃত্তি থেকে দূরে থাকবে।
(খ) এভাবে বলায় মানব মনে গাঢ় প্রভাব পড়ে এবং সে কথা মেনে নিতে বেশী তৎপর হয়।
(গ) লোক সমাজে ভুলকারীর নাম গোপন থাকে।
(ঘ) প্রশিক্ষণদাতার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং ভুলকারীর সঙ্গে হিতাকাঙ্ক্ষী প্রশিক্ষকের মুহাববত গভীর হয়।
নামোল্লেখ না করে পরোক্ষভাবে বলার ক্ষেত্রে একটা সতর্কতার ব্যাপারও রয়েছে। ভুলকারীকে নামোল্লেখের মাধ্যমে অপমান-অপদস্থ না করে পরোক্ষভাবে শারঈ হুকুম তখনই কার্যকরী হবে, যখন তার ভুলের বিষয়টি অধিকাংশ মানুষের কাছে গোপন থাকবে। কিন্তু যখন তার ভুল বা অপরাধ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ জ্ঞাত এবং সেও তা জানে সেক্ষেত্রে জনগণের সামনে পরোক্ষভাবে বললেও তা তার জন্য আরও বেশী লজ্জাকর ও ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি তার জীবনের গন্ডিও সংকীর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় এমন কামনাও হ’তে পারে যে, তাকে পরোক্ষভাবে না বলে যদি সামনাসামনি একান্তে বলা হ’ত তাহ’লে তা কতই না ভাল হ’ত। আসলে প্রভাবক সমূহের মাঝে তারতম্য থাকে। যেমন- (১) কে কথা বলছে? (২) কাদের সামনে কথা বলা হচ্ছে? (৩) কথাগুলো কি জোশ ও ভীতির সুরে বলা হচ্ছে, না উপদেশের সুরে বলা হচ্ছে?
অতএব পরোক্ষ পদ্ধতি ভুলকারী ও অন্যদের জন্য তখনই উপকারী হবে, যখন তা কৌশল ও প্রজ্ঞার সাথে প্রয়োগ করা হবে।
(১৫) জনসাধারণকে ভুলকারীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা :
এ পদক্ষেপ কেবলই নির্দিষ্ট অবস্থা ও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খুব সূক্ষ্মভাবে মেপেজোখে এরূপ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে কোন রকম কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখা দেয়। নিচে এ পন্থা সংক্রান্ত নবী করীম (ﷺ)-এর উদাহরণ তুলে ধরা হ’ল।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَشْكُو جَارَهُ فَقَالَ اذْهَبْ فَاصْبِرْ. فَأَتَاهُ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا فَقَالَ : اذْهَبْ فَاطْرَحْ مَتَاعَكَ فِى الطَّرِيْقِ. فَطَرَحَ مَتَاعَهُ فِى الطَّرِيْقِ فَجَعَلَ النَّاسُ يَسْأَلُوْنَهُ فَيُخْبِرُهُمْ خَبَرَهُ فَجَعَلَ النَّاسُ يَلْعَنُوْنَهُ فَعَلَ اللهُ بِهِ وَفَعَلَ وَفَعَلَ فَجَاءَ إِلَيْهِ جَارُهُ فَقَالَ لَهُ ارْجِعْ لاَ تَرَى مِنِّى شَيْئًا تَكْرَهُهُ-
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল। তিনি তাকে বললেন, যাও, ছবর কর। এভাবে সে দু’বার কিংবা তিনবার এল। পরের বার তিনি বললেন, তোমার মাল রাস্তার উপর ফেলে রাখ। ফলে সে তার মালপত্র রাস্তার উপর ফেলে রাখল। লোকেরা এ দেখে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল। তখন সে তাদেরকে তার দূরবস্থার কথা জানিয়ে দিল। ফলে লোকেরা ঐ প্রতিবেশীকে অভিশাপ দিতে লাগল- আল্লাহ তার এ করুক, তা করুক ইত্যাদি। তখন তার প্রতিবেশী তার কাছে এসে বলল, তুমি ফিরে যাও, এখন থেকে তুমি আমার থেকে অশোভন কোন আচরণ দেখতে পাবে না’।[7]
(১৬) ভুলকারীর বিরুদ্ধে শয়তানকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকা :
ওমর বিনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَجُلاً عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم كَانَ اسْمُهُ عَبْدَ اللهِ، وَكَانَ يُلَقَّبُ حِمَارًا، وَكَانَ يُضْحِكُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم، وَكَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم قَدْ جَلَدَهُ فِى الشَّرَابِ، فَأُتِىَ بِهِ يَوْمًا فَأَمَرَ بِهِ فَجُلِدَ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ اللَّهُمَّ الْعَنْهُ مَا أَكْثَرَ مَا يُؤْتَى بِهِ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ تَلْعَنُوهُ، فَوَاللَّهِ مَا عَلِمْتُ أَنَّهُ يُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ-
‘নবী করীম (ﷺ)-এর যুগে আব্দুল্লাহ নামে এক লোক ছিল। তার উপাধি ছিল হিমার বা গাধা। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হাসাত। মদ পানের অভিযোগে রাসূল (ﷺ) তাকে চাবুক মেরেছিলেন। (মদ পানের জন্য) একদিন তাকে তাঁর নিকটে ধরে আনা হয়। তিনি তাকে শাস্তি দানের নির্দেশ দেন। তাকে চাবুক মারা হ’ল। অতঃপর উপস্থিত একজন বলল, হে আল্লাহ! তার পক্ষে যতটা সম্ভব তার থেকেও বেশী অভিশাপ তুমি তার উপর বর্ষণ কর। নবী করীম (ﷺ) তখন বললেন, তোমরা তাকে অভিশাপ দিও না। আল্লাহর কসম! আমার জানা মতে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে’।[8]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِسَكْرَانَ، فَأَمَرَ بِضَرْبِهِ، فَمِنَّا مَنْ يَضْرِبُهُ بِيَدِهِ، وَمِنَّا مَنْ يَضْرِبُهُ بِنَعْلِهِ، وَمِنَّا مَنْ يَضْرِبُهُ بِثَوْبِهِ، فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ رَجُلٌ مَالَهُ أَخْزَاهُ اللهُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَكُوْنُوْا عَوْنَ الشَّيْطَانِ عَلَى أَخِيْكُمْ-
‘নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট একজন নেশাগ্রস্তকে হাযির করা হ’ল। তিনি তাকে আঘাত করতে নির্দেশ দিলেন। তখন আমাদের কেউ তাকে হাত দিয়ে মারল, কেউ চটি দিয়ে মারল, কেউবা তার কাপড় দিয়ে মারল। মার খেয়ে লোকটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন একজন লোক বলে উঠল, তার কি হয়েছে? আল্লাহ তাকে অপদস্থ করুন। তার কথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের বিরুদ্ধে শয়তানের সহযোগী হয়ো না’।[9] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
أُتِىَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِرَجُلٍ قَدْ شَرِبَ قَالَ : اضْرِبُوْهُ. قَالَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ فَمِنَّا الضَّارِبُ بِيَدِهِ، وَالضَّارِبُ بِنَعْلِهِ، وَالضَّارِبُ بِثَوْبِهِ، فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ أَخْزَاكَ اللهُ. قَالَ : لاَ تَقُوْلُوْا هَكَذَا لاَ تُعِينُوْا عَلَيْهِ الشَّيْطَانَ-
‘নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এক ব্যক্তিকে হাযির করা হ’ল। সে মদ পান করেছিল। তিনি বললেন, তোমরা তাকে মারো। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, তখন আমাদের কেউ তার হাত দিয়ে তাকে মারল, কেউ তার চটি দিয়ে মারল, কেউবা তার কাপড় দিয়ে মারল। মার খেয়ে লোকটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন উপস্থিত জনতার একজন বলল, আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করুন। তার কথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমরা এমনভাবে বল না। তার বিরুদ্ধে তোমরা শয়তানকে সাহায্য করো না’।[10]
অন্য বর্ণনায় আছে,
ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لأَصْحَابِهِ بَكِّتُوْهُ. فَأَقْبَلُوا عَلَيْهِ يَقُولُونَ مَا اتَّقَيْتَ اللهَ مَا خَشِيتَ اللهَ وَمَا اسْتَحَيْتَ مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ أَرْسَلُوهُ وَقَالَ فِى آخِرِهِ وَلَكِنْ قُولُوا اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ. وَبَعْضُهُمْ يَزِيدُ الْكَلِمَةَ وَنَحْوَهَا-
‘তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের বললেন, তোমরা তাকে তিরষ্কার করো। তখন সাহাবীগণ তাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, ‘তুমি আল্লাহকে ভয় করনি’, ‘তোমার আল্লাহর ভয় নেই’ ‘আল্লাহর রাসূলের প্রতি তোমার শরম নেই’। তারপর তারা তাকে ছেড়ে দিল। বর্ণনার শেষে তিনি বলছিলেন, তোমরা বরং বল ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, তুমি তার উপর দয়া করো। বর্ণনাকারীদের কেউ কেউ এমনতর কিছু শব্দ বেশীও বলেছেন’।[11]
অন্য বর্ণনায় আছে,
فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ أَخْزَاكَ اللهُ. قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَقُوْلُوْا هَكَذَا لاَ تُعِيْنُوْا عَلَيْهِ الشَّيْطَانَ وَلَكِنْ قُوْلُوْا رَحِمَكَ اللهُ
‘লোকটা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন একজন লোক বলে উঠল, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এভাবে বলো না! তার বিরুদ্ধে শয়তানকে সহযোগিতা করো না; বরং তোমরা বলবে, আল্লাহ তোমার উপর দয়া করুন’।[12]
উক্ত বর্ণনাগুলোর সমষ্টিগত অর্থ থেকে বুঝা যায়, মুসলমান যতই পাপ করুক তার মধ্যে ইসলামের শিকড় থেকে যায় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসার শিকড়ও থেকে যায়। সুতরাং তাকে ইসলাম থেকে খারিজ বলা যাবে না, তার বিরুদ্ধে এমন কোন দো‘আ করা যাবে না যাতে শয়তানের সহযোগিতা করা হয়। বরং তার জন্য হেদায়াত, মাগফিরাত ও রহমতের দো‘আ করতে হবে।
(১৭) ভুল কাজ বন্ধ করতে বলা :
ভুলকারী যাতে বারবার ভুল কাজ না করতে থাকে, সেজন্য তাকে ভুল কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতে মন্দের পরিসর যেমন বাড়বে না, তেমনি কালবিলম্ব না করে মন্দের নিষেধ করাও হবে।
ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একবার তিনি শপথ করতে গিয়ে বলেন,
لاَ وَأَبِى فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَهْ إِنَّهُ مَنْ حَلَفَ بِشَىْءٍ دُوْنَ اللهِ فَقَدْ أَشْرَكَ-
‘আমার পিতার কসম! এটা হবার নয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, (ওমর) থামো। যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে শপথ করে, সে নিশ্চিত শিরক করে’।[13] আবুদাঊদ তাঁর সুনান গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
جَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَخْطُبُ فَقَالَ لَهُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اجْلِسْ فَقَدْ آذَيْتَ-
‘জুম‘আর দিনে এক লোক (মসজিদের মধ্যে) মানুষের ঘাড়ের উপর দিয়ে পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছিল। নবী করীম (ﷺ) তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি বসে পড়। কেননা তুমি ইতিমধ্যে লোকদের কষ্ট দিয়ে ফেলেছ’।[14]
ইমাম তিরমিযী ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
تَجَشَّأَ رَجُلٌ عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ كُفَّ عَنَّا جُشَاءَكَ فَإِنَّ أَكْثَرَهُمْ شِبَعًا فِى الدُّنْيَا أَطْوَلُهُمْ جُوعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ-
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর সন্নিকটে (খেয়ে-দেয়ে) ঢেকুর তুলছিল। তখন তিনি তাকে বললেন, আমাদের থেকে তোমার ঢেকুর তোলা থামাও। কেননা দুনিয়াতে যারা যত বেশী পেট পুরে খাবে ক্বিয়ামতের দিন তাদের তত বেশী ক্ষুধার্ত থাকতে হবে’।[15] এই হাদীসগুলোতে ভুলকারীকে তার ভুল কাজ থেকে বিরত থাকতে সরাসরি বলা হয়েছে।
(১৮) ভুলকারীকে তার ভুল সংশোধন করতে বলার নির্দেশ দেওয়া :
নবী করীম (ﷺ) নানাভাবে এ কাজ করেছেন। যেমন-
(ক) ভুলকারীর দৃষ্টি তার ভুলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে সে নিজেই তার ভুল শুধরে নিতে পারে। এর উদাহরণ আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীস। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে ছিলেন,
فَدَخَلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَرَأَى رَجُلاً جَالِساً وَسَطَ الْمَسْجِدِ مُشَبِّكاً بَيْنَ أَصَابِعِهِ يُحَدِّثُ نَفْسَهُ فَأَوْمَأَ إِلَيْهِ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَلَمْ يَفْطِنْ قَالَ : فَالْتَفَتَ إِلَى أَبِىْ سَعِيدٍ فَقَالَ : إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلاَ يُشَبِّكَنَّ بَيْنَ أَصَابِعِهِ فَإِنَّ التَّشْبِيكَ مِنَ الشَّيْطَانِ فَإِنَّ أَحَدَكُمْ لاَ يَزَالُ فِىْ صَلاَةٍ مَا دَامَ فِى الْمَسْجِدِ حَتَّى يَخْرُجَ مِنْهُ-
‘এমন সময় নবী করীম (ﷺ) মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন, এক ব্যক্তি মসজিদের মাঝ বরাবর বসে আছে। সে তার দু’হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের মধ্যে ঢুকিয়ে আপন মনে কথা বলছে। নবী করীম (ﷺ) তার এ কাজের প্রতি ইশারা করলেন। কিন্তু সে বুঝতে পারল না। তখন তিনি আবু সাঈদের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন, তোমাদের কেউ যখন সালাত আদায় করবে তখন যেন সে তার আঙ্গুলগুলোর মধ্যে কখনই আঙ্গুল না ঢুকায়। কেননা আঙ্গুলের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকানো শয়তানের কাজ। অবশ্যই তোমাদের যে কোন লোক যতক্ষণ মসজিদে থাকবে ততক্ষণ সে সালাতে রত বলে গণ্য হবে, যে পর্যন্ত না সে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবে’।[16]
(খ) সম্ভব হ’লে কাজটিকে পুনরায় সঠিক পদ্ধতিতে করতে বলা : আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদের এক কোণে বসা ছিলেন। এমন সময় এক লোক মসজিদে ঢুকে সালাত আদায় করল। তারপর সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিল। তিনি বললেন, তুমি (তোমার জায়গায়) ফিরে গিয়ে পুনরায় সালাত আদায় কর। কেননা তোমার সালাত আদায় হয়নি। সে ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করল। আবার এসে সে সালাম দিল। তিনি বললেন, তোমার উপরও সালাম, তুমি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কেননা তোমার সালাত হয়নি। সে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বারে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, যখন তুমি সালাতে দাঁড়াবে তখন (তার আগে) ভালমত ওযূ করবে। তারপর কিবলামুখী হয়ে তাকবীর বলবে, তারপর তোমার পক্ষে কুরআন থেকে যতটুকু সহজ হয় ততটুকু পড়বে, তারপর রুকূ করবে, রুকূতে ধীরস্থির ও প্রশান্ত অবস্থায় থাকবে। তারপর মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে; তারপর সিজদা করবে এবং ধীরস্থির ও প্রশান্ত অবস্থায় থাকবে। অতঃপর মাথা তুলে স্থির হয়ে বসবে, পরে স্থির হয়ে আরেকটি সিজদা করবে, তারপর মাথা তুলে স্থির হয়ে বসবে। তোমার সমস্ত সালাতে তুমি এভাবে করবে’।[17]
লক্ষ্যণীয় :
নবী করীম (ﷺ) তাঁর আশপাশের লোকদের কার্যাবলী ভালভাবে লক্ষ্য করতেন। তাদেরকে শিক্ষা দান ও ভুল শুধরে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এসব করতেন। এ সম্পর্কে নাসাঈর বর্ণনায় এসেছে,
أَنَّ رَجُلاً دَخَلَ الْمَسْجِدَ فَصَلَّى وَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَرْمُقُهُ وَنَحْنُ لاَ نَشْعُرُ فَلَمَّا فَرَغَ أَقْبَلَ فَسَلَّمَ عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : ارْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ-
‘এক ব্যক্তি মসজিদে ঢুকে সালাত আদায় শুরু করল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে লক্ষ্য করছিলেন, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনি। লোকটার যখন সালাত শেষ হ’ল তখন সে এগিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিল। তিনি তাকে বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কেননা তোমার সালাত আদায় হয়নি’...।[18]
আসলে সঙ্গী-সাথীদের কাজের তদারকি বা দেখভাল করা অভিভাবকের অন্যতম গুণ।
ভুলকারীর কাজ পুনরায় করতে বলা শিক্ষাদানের একটি কৌশল। হয়তো সে তার ভুল ধরতে পেরে নিজ থেকে ভুল শুধরে নিবে। বিশেষ করে যখন ভুলটা হবে স্পষ্ট- যা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য অনেক সময় স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে পারে, ফলে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হ’তে পারে।
ভুলকারী যখন নিজের ভুল না ধরতে পারে তখন বিস্তারিত বর্ণনার মাধ্যমে সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা আবশ্যিক।
যখন কোন ব্যক্তি জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন জানায় এবং গভীরভাবে মনোনিবেশ করে, তখন তাকে শিক্ষাদান প্রথম থেকে কোন আগ্রহ প্রকাশ ও আবেদন জানানো ছাড়াই শিক্ষাদানের তুলনায় তার মস্তিষ্কে অনেক বেশী ক্রিয়া করে এবং দীর্ঘ দিন তা মনে থাকে।
শিক্ষাদান পদ্ধতি আসলে অনেক রকম। স্থান-কাল-পাত্র বুঝে শিক্ষক তা প্রয়োগ করবেন।
ভুল কাজকে সঠিক পন্থায় পুনরায় করতে বলার আরেকটি উদাহরণ সহীহ মুসলিমে জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস। তিনি বলেন,
أَخْبَرَنِيْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أَنَّ رَجُلاً تَوَضَّأَ فَتَرَكَ مَوْضِعَ ظُفُرٍ عَلَى قَدَمِهِ فَأَبْصَرَهُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : ارْجِعْ فَأَحْسِنْ وُضُوْءَكَ. فَرَجَعَ ثُمَّ صَلَّى-
‘ওমর বিনুল খাত্ত্বাব আমাকে জানিয়েছেন যে, এক লোক ওযূ করতে গিয়ে তার এক পায়ে নখ পরিমাণ জায়গা ধোয়া বাদ রেখে দেয়। নবী করীম (ﷺ)-এর নযরে তা ধরা পড়ে। তিনি তা দেখে বললেন, তুমি পুনরায় ভাল করে ওযূ কর। লোকটা পুনরায় ওযূ করে এসে সালাত আদায় করল’।[19]
উল্লিখিত ধারার তৃতীয় উদাহরণ তিরমিযী কর্তৃক তাঁর সুনানে বর্ণিত হাদীস। কালদা বিন হাম্বল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ صَفْوَانَ بْنَ أُمَيَّةَ بَعَثَهُ بِلَبَنٍ وَلِبَإٍ وَضَغَابِيسَ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَالنَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بِأَعْلَى الْوَادِى قَالَ فَدَخَلْتُ عَلَيْهِ وَلَمْ أُسَلِّمْ وَلَمْ أَسْتَأْذِنْ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم ارْجِعْ فَقُلِ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَأَدْخُلُ-
‘ছাফওয়ান বিন উমাইয়া তাকে দিয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট দুধ, পাইয়োসি (উর্দু ييوس ) ও শশা পাঠান। নবী করীম (ﷺ) তখন মক্কার উঁচু অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁকে সালাম না দিয়ে এবং অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ফলে নবী করীম (ﷺ) বললেন, ফিরে যাও এবং বল, আস-সালামু আলাইকুম আ-আদখুল। (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি কি ভিতরে ঢুকতে পারি)’।[20]
কাজের অনিয়মতান্ত্রিক ধারাকে যথাসম্ভব নিয়মতান্ত্রিক করতে বলা :
ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বরাতে নবী করীম (ﷺ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,
لاَ يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلاَّ مَعَ ذِى مَحْرَمٍ. فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ امْرَأَتِى خَرَجَتْ حَاجَّةً وَاكْتُتِبْتُ فِى غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا. قَالَ : ارْجِعْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ-
‘কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে মাহরাম (বিবাহ হারাম এমন পুরুষদের সাথে রাখা) ব্যতীত নির্জনে দেখা-সাক্ষাৎ না করে। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো অমুক অমুক যুদ্ধের জন্য আমার নাম লিখিয়েছি, অথচ এ দিকে আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। তিনি বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ কর’।[21]
ভুলের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সংশোধন :
নাসাঈ তার সুনানে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন,
أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنِّى جِئْتُ أُبَايِعُكَ عَلَى الْهِجْرَةِ وَلَقَدْ تَرَكْتُ أَبَوَىَّ يَبْكِيَانِ. قَالَ : ارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا-
‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার কাছে হিজরতের শর্তে বায়‘আত করতে এসেছি। কিন্তু আমি যখন আমার মাতা-পিতাকে ছেড়ে আসি তখন তারা কাঁদছিলেন। তিনি বললেন, তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও এবং যেভাবে তাদের কাঁদিয়েছিলে সেভাবে তাদের হাসাও’।[22]
ভুলের কাফফারা প্রদান :
যখন ভুল সংশোধনের উল্লিখিত বা অন্য কোন উপায় পাওয়া না যায়, তখন তা থেকে উদ্ধারের জন্য শরী‘আতে কাফফারার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যার মাধ্যমে পাপের চিহ্ন মুছে যায়। যেমন শপথের কাফফারা, যিহারের কাফফারা, ভুলক্রমে হত্যার কাফফারা, রামাযানে দিবসে স্ত্রী সহবাসের কাফফারা ইত্যাদি।
(১৯) কেবল ভুলের স্থান/ক্ষেত্রটুকু বর্জন এবং বাকীটুকু গ্রহণ :
কখনো কখনো পুরো কথা কিংবা কাজ ভুল হয় না। তখন পুরো কাজ কিংবা কথাকে ভুল গণ্য না করে শুধুমাত্র ভুলটুকু নিষেধ করা হবে বুদ্ধিদীপ্ত। এর দৃষ্টান্ত ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। রুবাই বিনতু মুয়াওবিয (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
جَاءَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَدَخَلَ حِيْنَ بُنِىَ عَلَىَّ، فَجَلَسَ عَلَى فِرَاشِى كَمَجْلِسِكَ مِنِّى، فَجَعَلَتْ جُوَيْرِيَاتٌ لَنَا يَضْرِبْنَ بِالدُّفِّ وَيَنْدُبْنَ مَنْ قُتِلَ مِنْ آبَائِى يَوْمَ بَدْرٍ، إِذْ قَالَتْ إِحْدَاهُنَّ وَفِينَا نَبِىٌّ يَعْلَمُ مَا فِى غَدٍ. فَقَالَ : دَعِى هَذِهِ، وَقُولِى بِالَّذِى كُنْتِ تَقُولِينَ-
‘আমার স্বামী গৃহে যাত্রাকালে নবী করীম (ﷺ) আমাদের ঘরে আসেন। তুমি এখন যেমন আমার কাছে বসে আছ তেমনি তিনি এসে আমার বিছানার উপর বসেন। তখন কিছু ছোট ছোট কিশোরী দফ বাজাতে থাকে এবং বদর যুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে রচিত শোক গাথা গাইতে থাকে। তাদেরই মধ্যে একজন হঠাৎ করে বলে ওঠে, ‘মোদের মাঝে একজন নবী আছেন, যিনি কাল কি হবে তা জানেন’। তখন তিনি বললেন, তুমি এ কথা বলা বাদ দাও; আগে যা বলছিলে তাই বল’।[23]
তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে বললেন,
اسْكُتِى عَنْ هَذِهِ وَقُوْلِى الَّذِىْ كُنْتِ تَقُوْلِيْنَ قَبْلَهَا
‘এটা বলা থেকে চুপ থাক; আগে যা বলছিলে তা বল’। আবু ঈসা বলেন, এটি হাসান সহীহ হাদীস।[24]
ইবনু মাজার বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন,
أَمَّا هَذَا فَلاَ تَقُوْلُوْهُ مَا يَعْلَمُ مَا فِىْ غَدٍ إِلاَّ اللهُ
‘এই যে কথা বললে তোমরা তা আর বল না। আগামী দিন কি হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না’।[25]
সন্দেহ নেই যে, এমন ধারার নিষেধ ভুলকারীকে ন্যায় ও ইনছাফের সাথে বিষয়টি বিবেচনা করতে অনুপ্রাণিত করে। তাকে শুধরানোও এভাবে সহজ হয় এবং তার জন্য নিষেধকারীর নিষেধ মেনে নিতে প্রস্ত্তত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে অনেক নিষেধকারী ভুলকারীর উপর চরম রেগে যায়, ফলে সে ভুল-নির্ভুল, হক-বাতিল সবটাই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাতে ভুলকারী তার কথা যেমন মেনে নিতে চায় না তেমনি সে নিজকে শুধরাতে ও আগ্রহী হয় না।
কিছু ভুলকারী আছে যাদের উচ্চারিত মূল কথাটি সঠিক; কিন্তু যে উপলক্ষে তারা কথাটি বলছে তা সঠিক নয়। যেমন সূরা ফাতিহা পাঠ এমনিতে সঠিক। কিন্তু একজনের মৃত্যু উপলক্ষে কেউ সূরা ফাতিহা পড়তে বলল, আর অমনি উপস্থিত জনতা তা পড়তে শুরু করল। তারা দলীল হিসাবে বলে, তারা তো কুরআন পড়ছে কোন কুফরী কালাম পড়ছে না। এক্ষেত্রে তাদের নিকট বলা আবশ্যক যে, তাদের ভুল এতটুকুই যে, তারা মৃত ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে ইবাদত মনে করে সূরা ফাতিহা পড়ার রেওয়াজ চালু করেছে। অথচ এ উপলক্ষে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে কোনই দলীল নেই। এভাবে দলীল ছাড়া ইবাদত বানানোই সরাসরি বিদ‘আত। এতদর্থেই ইবনে ওমর (রাঃ) এক ব্যক্তির মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ঐ ব্যক্তি তার পাশে হাঁচি দিয়ে বলেছিল, আলহামদুলিল্লাহ ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ (সকল প্রশংসা আল্লাহর এবং সালাম আল্লাহর রাসূলের উপর) তার উত্তরে ইবনু ওমর বলেন, আমিও বলছি ‘আলহামদুলিল্লাহ ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ’। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের এমনভাবে বলতে শিখাননি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ‘আল হামদুলিল্লাহি আলা-কুল্লি হাল’ (সর্বাবস্থায় আল্লাহর সকল প্রশংসা)।[26]
[1]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭৫০।
[2]. ইমাম বুখারী তাঁর সহীহের একাধিক স্থানে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ফাৎহ হা/৫৬৩৬।
[3]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬১০১।
[4]. মুসলিম হা/৫৫০।
[5]. নাসাঈ হা/৯৪৭; মিশকাত হা/২৯৫, সনদ যঈফ।
[6]. মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৭৩।
[7]. আবুদাঊদ, হা/৫১৫৩; ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘প্রতিবেশীর অধিকার’ অনুচ্ছেদ, সহীহ আবুদাঊদ হা/৪২৯২।
[8]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৭৮০।
[9]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৭৮১।
[10]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৭৭৭।
[11]. আবুদাঊদ, হা/৪৪৭৮, ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়, ‘মদ পানের দন্ড’ অনুচ্ছেদ; আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহ আবুদাঊদ হা/৩৭৫৯।
[12]. আহমাদ হা/৭৯৭৩, আহমাদ শাকের বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।
[13]. আহমাদ হা/৩২৯, আহমাদ শাকের বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ।
[14]. আবুদাঊদ হা/১১১৮, সনদ সহীহ।
[15]. তিরমিযী হা/২৪৭৮, সনদ হাসান; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৪৩।
[16]. আহমাদ হা/১১৫৩০, সনদ যঈফ।
[17]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬২৫১।
[18]. নাসাঈ হা/১৩১৩, হাসান সহীহ।
[19]. মুসলিম হা/২৪৩।
[20]. তিরমিযী হা/২৭১০; সহীহ সুনান তিরমিযী হা/২১৮০।
[21]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫২৩৩।
[22]. নাসাঈ হা/৪১৬৩, সহীহ।
[23]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৫১৪৭।
[24]. সুনান তিরমিযী প্রকাশক শাকের হা/১০৯০।
[25]. প্রকাশক আব্দুল বাকী, নং ১৮৭৯; আলবানী এটিকে সহীহ সুনান ইবনু মাজাহতে সহীহ বলেছেন, হা/১৫৩৯)। (ইবনু মাজাহ হা/১৮৯৭, সহীহ।
[26]. সুনানু তিরমিযী হা/২৭৩৮।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: