ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিভূমি :
ইসলামের প্রথম যুগেই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। সেসময় রাসূল (ﷺ) সাহাবীদের নিকটে কুরআনী নির্দেশনা ব্যাখ্যা করতেন, যেন তারা দ্বীনের আলোয় আলোকিত হ’তে পারে। রাসূল (ﷺ)-এর এসব মজলিসই পরবর্তী যুগে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মডেল হিসাবে কাজ করেছে। মসজিদে নববীতে নিয়মিত দ্বীনী মজলিস অনুষ্ঠিত হ’ত এবং এটা ইসলামের ইতিহাসে কেবল প্রথম শিক্ষাকেন্দ্রই ছিল না, বরং পরবর্তীতে এটা রীতি হয়ে দাঁড়াল যে, মসজিদগুলি শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবেও ব্যবহৃত হবে। ফলে শত শত বছর ধরে যেসব স্থানকে ঘিরে শিক্ষা-কার্যক্রম আবর্তিত হয়েছে, সেগুলির মধ্যে মসজিদই প্রথম স্থান দখল করে রেখেছিল। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ﷺ) যেরূপ মৌখিকভাবে সাহাবীদের মাঝে দ্বীনের কথা ব্যাখ্যা করতেন, বা সহজ ভাষায় বললে যে পদ্ধতিতে সাহাবীগণ তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী আত্মস্থ করতেন, সেটাই পরবর্তীকালে ইলম চর্চার প্রধান মূলনীতি হিসাবে গৃহীত হয়। যেমন ছাত্রদেরকে শিক্ষকের মুখনিঃসৃত বাণী স্বয়ং শিক্ষকের মুখ থেকে শুনতে হ’ত। এভাবে ‘শ্রবণনীতি’ (সামা‘) আত্মপ্রকাশ করল, যার উপর ভর করে সকল ইলমী কার্যক্রম এগিয়ে চলল। স্পষ্ট করে বললে, শ্রবণনীতির দাবী হ’ল যদি কোন নারী বা পুরুষ কোন কথা সরাসরি শিক্ষকের নিকট থেকে না শুনে থাকে, তাহ’লে তা উক্ত শিক্ষকের বরাতে অন্যের নিকট প্রচার করা যাবে না।[1]
হাদীস নিঃসন্দেহে দ্বীনী ইলমের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল এবং এটাই শ্রবণনীতির (সামা‘) আত্মপ্রকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এটার মূল বক্তব্য হ’ল রাসূল (ﷺ)-এর বাণী নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে শ্রবণ করতে হবে। যেটা অনেকটা স্বয়ং রাসূল (ﷺ)-এর মজলিসে হাযির হওয়ার শামিল। প্রথম যুগে হাদীসের ছাত্ররা নিয়মিত ক্লাসে হাযির হয়ে হাদীস ‘শেখার’ চেয়ে বিভিন্ন শায়খের নিকট থেকে হাদীস ‘সংগ্রহ করাকে’ প্রাধান্য দিতেন। ‘সংগ্রহের’ বিষয়টি পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় হাদীসের মজলিসগুলি যতটা না ইলমী উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল দ্বীনী প্রেরণায়। অবশ্য এরই মধ্য দিয়ে ইলমে হাদীস ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে।
ইসলামের প্রথম যুগের শিক্ষা-কার্যক্রম :
ইসলামের প্রথম যুগের শিক্ষা-কার্যক্রম সম্পর্কে, বিশেষ করে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। খুব সম্ভবত কুরআনের পঠন-পাঠনই ছিল সব ধরনের শিক্ষা উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। সে সময় বহু মুসলিম কুরআন হিফয করতেন। সম্ভবত বহুল পরিচিত ‘দারুল কুররা’ই হ’ল প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে বদর যুদ্ধের পর মদীনায় হিজরতকালে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম ও মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়।[2] এটাও জানা যায় যে, ছুফফাহ, যেটা হ’ল মসজিদে নববীর মধ্যে বারান্দা বিশেষ, তাহ’ল প্রকৃতপক্ষে প্রথম আনুষ্ঠানিক আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে স্বয়ং রাসূল (ﷺ)-এর তত্ত্বাবধানে পঠন, লিখন, ফিক্বহ, তাজবীদসহ (কুরআন শুদ্ধরূপে পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি) অন্যান্য ইসলামী শাস্ত্রের অধ্যয়ন চলত।[3] ছুফ্ফাহ কোন সুবিন্যস্ত আবাসিক প্রতিষ্ঠান ছিল কি-না, সে প্রশ্ন আপাতত মুলতবী রেখে, রাসূল (ﷺ) যে তাদের পাঠন কার্যে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতেন, এই দাবী অন্তত বেশ জোরের সাথে করা যায়। সালাত পরবর্তী হালাকা সমূহ, যেগুলি কম-বেশী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল, সেগুলি ছাড়াও সাহাবীগণ নবী করীম (ﷺ)-কে মসজিদের ভিতরে এবং বাইরে ঈমান ও আখলাক সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করতেন।[4]
আলোচনার সময় রাসূল (ﷺ) তাঁর চারপাশে উপবিষ্ট শ্রোতাদেরকে একটি বিষয় তিন বার করে বলতেন।[5] রাসূল (ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন গোত্রের নিকট কুরআনের প্রশিক্ষক পাঠিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে খলীফা ওমর (রাঃ)ও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন।[6] যাহোক, ইসলামী শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নকল্পে মদীনায় একটি বিশেষ মজলিস গঠিত হয়েছিল বলে দাবী করা হয়।[7] আরো বলা হয়, হাদীস প্রচারের উদ্দেশ্যে আহলে ইলমের একটি দল গঠন করা হয়েছিল।[8]
শিক্ষাকেন্দ্র সমূহ :
মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের জীবন আবর্তিত হ’ত। কারণ মসজিদ ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক তথা সকল কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র। ইবাদতগাহ হওয়া ছাড়াও মসজিদগুলি শত শত বছর ধরে সামাজিক পরিষদের ভূমিকাও পালন করে এসেছে। যেমন বিচারকরা (ক্বাযী) মসজিদের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। কখনো কখনো মসজিদে মুসাফিরদের থাকার ব্যবস্থা করা হ’ত। আবু যাকারিয়া তাবরীযী দামেশকের জামে মসজিদের মিনার সংলগ্ন একটি ছোট্ট কক্ষে থাকতেন।[9]
মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মসজিদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষাকেন্দ্র হওয়ায় মসজিদে নিয়মিত দরস অনুষ্ঠিত হ’ত। আর এভাবে মসজিদ থেকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ত।
একথা সত্য যে, কেবলমাত্র মসজিদই শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না; বরং মসজিদ ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় পাঠদান সম্পন্ন হ’ত। পঠন-পাঠনের নিমিত্তে বিশেষ ভবন নির্মাণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আবুবকর মুহাম্মাদ বিন বাশশার বছরী আল-বুনদার (মৃ. ২৫২ হিঃ) তার ছাত্র ইবনে খাররাশ (মৃ. ২৮৩ হিঃ)-এর নিকট হাদীস বর্ণনার নিমিত্তে একটি কক্ষ নির্মাণের জন্য ২০০০ দিরহাম গচ্ছিত রেখেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কক্ষ নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[10]
আলী বিন মুহাম্মাদ আল-বাযযায (মৃ. ৩৩০ হিঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, পড়াশোনার জন্য তার একটি বিশেষ গৃহ ছিল (বায়তুল ইলম)।[11] এমনিভাবে আবু হাতেম বুসতী (জন্ম ২৭৭ হিঃ)-এর বিশেষ অবদান হ’ল, তিনি লাইব্রেরী সমৃদ্ধ একটি ‘দারুল ইলম’ গড়ে তোলেন এবং বহিরাগত ছাত্রদের জন্য বেশ কিছু কক্ষ নির্মাণ করেন। তিনি তাদেরকে নিজ উদ্যোগে ভাতাও দিতেন।[12] নিশাপুরের প্রথমদিকের মাদ্রাসাগুলি শায়খদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[13]
(১) বাসগৃহ :
অনেক সময় শিক্ষকদের নিজস্ব বাসভবন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবু মুহাম্মাদ সুলায়মান বিন মিহরান আল-আ‘মাশের (মৃ. ১৪৮ হিঃ) বাসভবন কূফার অন্যতম বিদ্যাপীঠ ছিল।[14] একজন দরিদ্র ছাত্রকে নিয়ে একটি মজার গল্প চালু আছে। ছাত্রটি টিউশন ফি দিতে না পারায় তার শিক্ষক ইবনে লুলূ (মৃ. ৩৭৭ হিঃ) তাকে দরস থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। দরস অনুষ্ঠিত হচ্ছিল শিক্ষকের গৃহে। নিরূপায় হয়ে ছেলেটি ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেও গৃহ সংলগ্ন একটি করিডোরে চুপচাপ বসে পড়ল। এবার যে ছাত্রটি উক্ত দরসে উস্তাযকে কিতাব পড়ে শোনাচিছল, সে তার অসহায় বন্ধুকে সাহায্য করতে চাইল। সে উচ্চৈঃস্বরে পড়তে লাগল যাতে করিডোরে বসা বন্ধুটিও শুনতে পায়।[15]
বাগদাদের একটি বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র ছিল ‘মজলিসে মাহামিলী’। এটি ২৭০ হিজরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে মূলতঃ ফিক্বহ ও ধর্মতত্ত্বের উপর আলোচনা হ’ত। মজলিসটি অনুষ্ঠিত হ’ত আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন বিন ইসমাঈল যাববী মাহামিলীর বাসভবনে। প্রতি বুধবার এখানে সভা বসত এবং ৩৩০ হিজরীতে ক্বাযী মাহামিলীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন।[16] শায়খদের কাছে বুধবার সম্ভবত পাঠদানের জন্য বিশেষ পসন্দের দিন ছিল।[17] হিজরী ৫ম শতকে বাগদাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিতর্কসভা ছিল ক্বাযী সিমনানীর (মৃ. ৪৪৪ হিঃ) বিতর্কসভা। এটি সিমনানীর গৃহে অনুষ্ঠিত হ’ত।[18] বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আবুল আববাস ছা‘লাব (মৃ. ২৯১ হিঃ) বর্ণনা করেন, তিনি ৫০ বছর যাবৎ তার শিক্ষক ইবরাহীম হারবীর (মৃ. ২৮৫ হিঃ) গৃহে অভিধান-সংকলন বিদ্যার ক্লাসে হাযির হয়েছেন।[19] ব্যাকরণবিদ ফার্রা নিজ গৃহে পাঠদান করতেন।[20] আবুবকর বিন সিরাজ নাহবী (মৃ. ৩১৬ হিঃ) সম্পর্কেও এমন কথা বর্ণিত আছে।[21]
(২) দোকান :
যেহেতু অনেক শায়খ ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই তাদের দোকানগুলিতে মাঝে-মধ্যে পাঠদান সম্পন্ন হ’ত। ইলমে ফারায়েযের একজন শিক্ষক সম্পর্কে শোনা যায়, তিনি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে নিজ দোকানে দরস প্রদান করতেন।[22] খত্বীব বাগদাদী (মৃ. ৪৬৩ হিঃ) ইবনে ইসহাকের দোকানে জনৈক শিক্ষকের নিকট পাঠ গ্রহণ করেছেন।[23] আহমাদ বিন হাম্বল (মৃ. ২৪০ হিঃ) জনৈক তাঁতীর দোকানে হাদীস বর্ণনা করেছেন।[24] বিভিন্ন যুগে এভাবে পাঠদানের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
(৩) মসজিদ :
স্বাভাবিকভাবে পঠন-পাঠনের জন্য মসজিদ ছিল সবচেয়ে পসন্দের জায়গা। মুখাওয়াল বর্ণনা করেন, একদা রাসূল (ﷺ) তাঁর দশজন সাহাবীকে মসজিদে ক্বোবায় জ্ঞান আহরণে নিয়োজিত দেখতে পেলেন এবং তিনি তাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন।[25] তবে মসজিদ কেন্দ্রিক পঠন-পাঠনের বিষয়টি কমবেশী বড় শহরগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষায়তন খুঁজে পাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। বাগদাদ, দামেশক বা কায়রোর মতো বড় শহরগুলিতে শিক্ষাকেন্দ্র ছিল অগণিত। তাই শহরের ছোট-বড় অসংখ্য মসজিদে পাঠদান চলত।
বড় শহরগুলিতে মসজিদ ছিল দুই ধরনের। একটা হ’ল সাধারণ মসজিদ, যেখানে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অনুষ্ঠিত হ’ত। অপরটি হ’ল জামে মসজিদ, যেখানে শুক্রবার জুম‘আর সালাতও অনুষ্ঠিত হ’ত। একটি মধ্যম মানের শহরে একাধিক জামে মসজিদ থাকত। উদাহরণস্বরূপ বাগদাদের কথা বলা যায়। হিজরী ৫ম শতকে বাগদাদে ৬টি জামে মসজিদ ছিল এবং বলা হয়ে থাকে, সেসময় পুরো বাগদাদ শহরে মোট মসজিদ ছিল তিন হাযার।[26]
এক একটি মসজিদে সম্ভবত এক বা একাধিক বিষয়ে এক বা একাধিক ক্লাস অনুষ্ঠিত হ’ত। মসজিদের মুতাওয়াল্লীর নিকট থেকে পঠন-পাঠনের অনুমতি লাভের ক্ষেত্রে শক্ত কোন নিয়ম ছিল বলে মনে হয় না। কারণ অধিকাংশ মসজিদের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ চলত ওয়াকফের মাধ্যমে বা মসজিদের বিষয়াবলী দেখার জন্য একদল কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান থাকত। তবে জামে মসজিদের ক্ষেত্রে এমন বিধিনিষেধের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন খত্বীব বাগদাদী খলীফা কাইয়ূম বিল্লাহর নিকট ‘জামে মানছূরে’ হাদীস বর্ণনার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। ‘জামে মানছূর’ ছিল সেসময় রাজধানীর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এবং একই সাথে এটা সবচেয়ে স্বনামধন্য বিদ্যায়তনও ছিল। খলীফা একবার নাক্বীবে নুক্বাবার নিকট এই মর্মে সুফারিশপত্র লিখলেন যে, তিনি যেন খত্বীব বাগদাদীর পাঠদানে সহযোগিতা করেন। নাক্বীবে নুক্বাবা ছিলেন হাশেমীদের প্রধান রাজকর্মচারী এবং রাসূল (ﷺ)-এর বংশধর তথা শরীফদের প্রধান নিবন্ধক। নাক্বীবে নুক্বাবার হয় সেসময় উক্ত মসজিদের তদারকির দায়িত্ব ছিল, নতুবা তিনি উক্ত মসজিদে সুষ্ঠুভাবে পাঠদানের বিষয় দেখাশোনা করতেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, জামে মানছূর ছিল হাম্বলীদের শক্ত ঘাঁটি। অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি-না দেখার জন্য খত্বীব বাগদাদীর প্রথম দরসে স্বয়ং নাক্বীবে নুক্বাবা হাযির হয়েছিলেন।
প্রায়ই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মসজিদে এক বা একাধিক বিষয় চর্চার ক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করতেন। আবার কখনো কখনো একটি মসজিদ বিশেষ কোন ইলম অধ্যয়নের জন্য পরিচিতি লাভ করত। এটা হ’ত সেখানে দরস প্রদানকারী শায়খদের খ্যাতির কারণে। এসব ক্ষেত্রে কখনো আবার পাঠদানকারী শায়খদের নামে মসজিদের নামকরণ হয়ে যেত। যেমন কুরআনের বিখ্যাত ক্বারী রুওয়াইম বিন ইয়াযীদের (মৃ. ২১১ হিঃ) নামে একটি মসজিদের নামকরণ করা হয়েছিল। মসজিদটি বাগদাদের দারবে কাল্লাঈন এলাকায় অবস্থিত ছিল।[27] ৩৭৪ হিজরীতে যখন আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ আত-তাম্মার সেখানে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তখনও মসজিদটি উক্ত নামে পরিচিত ছিল।[28]
বাগদাদের আরেকটি মসজিদের নামকরণ করা হয়েছিল আব্দুল্লাহ বিন মুবারকের (মৃ. ১৮১ হিঃ) নামে। তিনি যদিও বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন না, তবে তিনি হয়ত তার বিভিন্ন সময় বাগদাদ সফরে সেখানে দরস প্রদান করেছেন। হিজরী ৫ম শতকে যখন শাফেঈ মাযহাবের বিখ্যাত ফক্বীহ আবু হামেদ ইসফারায়ীনী (মৃ. ৪০৬ হিঃ) সেখানে দরস প্রদান করছিলেন, তখনও মসজিদটি উক্ত নামেই পরিচিত ছিল। ততদিনে মসজিদটি একটি বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং সাথে সাথে এটি বাগদাদের একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসাবেও গণ্য হ’ত। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থান হ’তে আগত শিক্ষার্থীবৃন্দ ইসফারায়ীনীর দরসে অংশগ্রহণ করার জন্য ভিড় জমাত। খত্বীব বাগদাদীর নিকট খবর পৌঁছেছে যে, সেখানে ৭০০ ছাত্র দরস গ্রহণ করত।[29] এভাবে মসজিদগুলি শত শত বছর ধরে বিদ্যাপীঠের ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি আলাদা ভবনসমৃদ্ধ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পরও। অবশ্য প্রতিটি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে একটি করে মসজিদ থাকত।
ইলমী সমাবেশ, মজলিস এবং হালাকা :
ইলমী বৈঠকগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য যে পরিভাষাটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হ’ত, তাহ’ল ‘মজলিস’। অবশ্য শব্দটি আরো বেশ কিছু অর্থে ব্যবহৃত হ’তে পারে। যেমন পাঠদানের হল, দরস, শিক্ষকের আসন, পিলার বা চেয়ার সংলগ্ন স্থান বা ভবনের যেকোন জায়গা। পরিপূরক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ যোগ করার মাধ্যমে একটি মজলিসের উদ্দেশ্য নির্ণীত হ’ত। যেমন ‘মজলিসে তাদরীস’ তথা পাঠদানের সভা, ‘মজলিসে শু‘আরা’ তথা কবিদের সভা ইত্যাদি।
যে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটি মজলিস অনুষ্ঠিত হ’ত, হয়ত তার নামেই মজলিসের নামকরণ করা হ’ত। উদাহরণস্বরূপ ‘মজলিসে মাহামিলীর’ কথা বলা যায়। এটি মাহামিলীর বাসগৃহে অনুষ্ঠিত হ’ত এবং এখানে মূলত ফিক্বহ ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হ’ত। মজলিসে শাফেঈ বাগদাদের জামে মানছূরে অনুষ্ঠিত হ’ত।[30]
উপরোল্লেখিত দু’টি মজলিসই শায়খদ্বয়ের মৃত্যুর বহু পরেও স্ব স্ব নামে পরিচিত ছিল। আসলে মজলিসগুলি প্রতিষ্ঠাতাদের নামে একাডেমিক চেয়ার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের স্মৃতি জাগরুক রাখত। সেসব চেয়ারে পরবর্তীতে বিখ্যাত শায়খদের নিয়োগ দেয়া হ’ত। যাহোক, খত্বীব বাগদাদীর জীবদ্দশায়ও মজলিসে মাহামিলী বিদ্যমান ছিল এবং তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলেও উল্লেখ করেছেন।[31]
ইলমী বৈঠকগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য দ্বিতীয় যে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হ’ত, সেটি হ’ল ‘হালাকা’ (পাঠচক্র)। দরসে সুবিন্যস্তভাবে বসার ধারণা হ’তে সম্ভবত শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ছাত্ররা চারদিকে গোল হয়ে বসত, তবে শিক্ষকের সম্মুখভাগে বসা পসন্দনীয় ছিল। যদিও মজলিসের মতো সব ধরনের ইলমী বৈঠক বুঝাতে ‘হালাকা’র প্রয়োগ করা যায়। তবুও এটার ব্যবহার বোধহয় সীমিত সংখ্যক ছাত্র নিয়ে নিয়মিতভাবে ক্লাস করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। এটি বিশেষত ভাষাবিজ্ঞান ও অন্য বেশকিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেগুলিতে ছাত্রদেরকে মোটামুটি লম্বা সময় ধরে একজন শিক্ষকের অধীনে পড়াশোনা করতে হ’ত। ‘হালাকায়ে খলীল নাহবী’ (মৃ. ১৭৪ হিঃ) এ ধরনের হালাকার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। খলীলের মৃত্যুর পর তার ছাত্র ইউনুস নাহবী এই হালাকার হাল ধরেন।[32]
মনে করা হয়, জামে মসজিদে যে দরস অনুষ্ঠিত হ’ত, তাকে হালাকা বলা হ’ত এবং একটি জামে মসজিদে অনেকগুলি করে হালাকা বসত। প্রত্যেকটি হালাকায় একজন করে শিক্ষক থাকতেন।[33] ইমাম শাফেঈ যখন বাগদাদ সফর করেন, তখন জামে মানছূরে ৪০-৫০টির মত হালাকা ছিল বলে উল্লেখিত হয়েছে।[34] ৩২৬ হিজরীতে কায়রোর জামে আমরে মালেকী মাযহাবের ১৫টি, শাফেঈ মাযহাবের ১৪টি এবং হানাফী মাযহাবের ৩টি করে হালাকা ছিল।[35] কায়রো ও দামেশকে নিয়মিত বৈঠকগুলিকে ‘আয-যাবিয়া’ বলা হ’ত। যাবিয়াতে শাফেঈ‘, যেখানে তিনি সশরীরে দরস দিয়েছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উক্ত নামে পরিচিত ছিল। কায়রোর মসজিদে আযহার এবং জামে মামূর, যেটাকে দামেশকের গ্র্যান্ড মসজিদও বলা হয়, উভয়টিতে আটটি করে ‘যাবিয়া’ ছিল।
হাম্বলী মাযহাবের বিখ্যাত ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছ আবুবকর নাজ্জাদ (মৃ. ৩৪৮ হিঃ) জামে মানছূরে দু’টি হালাকার আয়োজন করতেন। শুক্রবার জুম‘আর সালাতের পূর্বে ফিক্বহী মাসআলার জন্য একটি, আর অপরটি জুম‘আর পর হাদীস বর্ণনার জন্য।[36] একই শহরের জামে রুসাফাতে হাদীসের ছাত্রদের আরেকটি হালাকা বসত।[37] আবু ইসহাক ইবরাহীম বিন আহমাদ মারওয়াযীও (মৃ. ৩৪০ হিঃ) জামে মানছূরে একটি হালাকার আয়োজন করতেন। বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক আবুল হাসান আলী বিন ইসমাঈল আশ‘আরী (মৃ. ৩৩০ হিঃ) এখানে প্রতি শুক্রবার দরস দিতেন।[38] আসলে একটি হালাকাতে কয়েকজন উস্তায দরস দিতেন, আবার এটাও সম্ভব যে কয়েকজন উস্তায কয়েকটি আলাদা আলাদা হালাকায় অংশগ্রহণ করতেন। মজলিস ও হালাকার মধ্যে পার্থক্য ছিল বটে, তবে উভয়েরই মৃত শিক্ষকের নামে চেয়ার ছিল।
ছাত্রদের জন্য সাধারণত সব দরস উন্মুক্ত ছিল। তবে ব্যতিক্রম হ’ত সেসব বিষয়ে যেগুলি শিখতে দীর্ঘ সময় লাগত। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক নিজে কিছু ছাত্রকে বাছাই করতেন এবং তাদেরকে দরসে বসার অনুমতি দিতেন। আর যে বিষয় শেখানো হচ্ছে, সে অনুযায়ী ক্লাসের আকার ছোট বড় হ’ত। ফলে ফিক্বহ বা ব্যাকরণের ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা ছিল খুব সীমিত। কিন্তু হাদীসের ক্লাসগুলিতে উপস্থিতির সংখ্যা মাঝে-মধ্যে এত বেশী হ’ত যে, হাদীস বর্ণনার জন্য শিক্ষককে বর্ণনা-সহকারী (মুসতামলী) নিয়োগ করতে হ’ত। যিনি শিক্ষকের বলা কথা একদম পেছনের সারিগুলির উদ্দেশ্য আবার বলতেন, যেখান থেকে হয়ত শিক্ষকের কথা ঠিকমতো শোনা যায়নি। কায়রোর জামে আমরে আবুবকর নি‘আলীর (মৃ. ৩৮০ হিঃ) হালাকা এত বড় ছিল যে, মসজিদের সতেরোটি স্তম্ভ জুড়ে ছাত্ররা বসত।[39] মুসতামলীর কাজ ছিল উস্তায বর্ণিত অংশটুকু পুনরায় বলা যাতে উপস্থিত প্রত্যেকে তা লিখে নিতে পারে।[40]
মুসতামলীর দায়িত্ব ছিল শিক্ষকের বলা অংশটুকু কোন ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াই পুনরাবৃত্তি করা। একজন মুসতামলীর ব্যাপারে জানা যায়, পুনরাবৃত্তির সময় ভুল করার কারণে উস্তায তাকে তিরস্কার করেন এবং নির্ভুলভাবে বর্ণনার জন্য নছীহত করেন।[41] প্রখ্যাত ব্যাকরণবিদ সিবাওয়াইহ (মৃ. ১৯৪ হিঃ) সম্পর্কেও এমন কথা শোনা যায়। তিনি প্রথম জীবনে একজন মুসতামলী ছিলেন। একবার একটি হাদীসের ক্লাসে পুনরাবৃত্তির সময় ব্যাকরণগত ভুল করায় পরবর্তীতে তিনি তার গবেষণার ক্ষেত্র বদলে ফেলেন।[42]
এমন আরেকটি ঘটনা হ’ল, একবার একটি বড় দরসে তিনজন মুসতামলী নিযুক্ত করার পরও ছাত্ররা ঠিকমতো পড়া শুনতে পাচ্ছিল না। ফলে প্রখ্যাত মুসতামলী হারূন বিন সুফিয়ান আদ-দীককে ডাকা হয়। তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠের অধিকারী এবং তিনি কাজটি পুরোপুরি একাই করতেন।[43] এমনও প্রমাণ পাওয়া যায়, মুসতামলীর কাজটি একটি উল্লেখযোগ্য পেশায় পরিণত হয়েছিল।[44] কতিপয় শিক্ষক বহু বছর যাবৎ ব্যক্তিগত মুসতামলী রাখার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।[45]
মুসতামলী সাধারণত ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়াতেন বা উঁচু আসনে বসতেন। যাতে প্রত্যেকে তাকে দেখতে ও শুনতে পায়। উস্তাযকে দরস শুরু করতে বলার পূর্বে মুসতামলী শিক্ষকের নাম, উপনাম ও বংশপদবী বলে নিতেন। মুসতামলীরা সম্ভবত আগেভাগে কিছু বিষয় নোট করে রাখতেন। কারণ ক্লাস শেষ হওয়ার পূর্বেই সম্পূর্ণ পাঠ তাদেরকে পুনরায় বলতে হ’ত।[46]
একইভাবে একেকটি শাস্ত্র শেষ করতে একেক রকম সময় লাগত। উদাহরণস্বরূপ হাদীসের কথা বলা যায়। হাদীসের ছাত্ররা বছরের পর বছর ধরে এক জায়গা হ’তে আরেক জায়গায়,[47]
এক শিক্ষক হ’তে আরেক শিক্ষকের নিকট যাতায়াত করত। এভাবে হাদীস সংগ্রহ করে সেগুলি যাচাই-বাছাই করার পর একত্রে সংকলন করত।[48] একজন শিক্ষক একবার আফসোস করে বললেন যে, তার ছাত্ররা মাত্র চার পাঁচ মাসের দরসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অথচ তার সংকলনটি সম্পূর্ণ করতে চল্লিশ বছর লেগেছে।[49]
হাদীসের পাঠ সম্পন্ন করার নির্ধারিত কোন বয়স ছিল না। ছাত্ররা দীর্ঘ সময় ধরে সংকলনকার্য চালিয়ে যাবে নাকি আগেভাগে বন্ধ করে দেবে, তা নির্ভর করত তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর। এক ছাত্রকে নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। একবার যখন সে একটি বাজারের মধ্য দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিল, তখন একটি লোক তার গতিরোধ করল। লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি হাদীসের ছাত্র? ছাত্রটি অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি হাদীসের ছাত্র। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘আহমাদ বিন হাম্বল বলতেন, তুমি যদি কাউকে রাস্তা দিয়ে ছুটতে দেখো, তাহ’লে নিশ্চিত জানবে সে হয় পাগল, না হয় হাদীসের ছাত্র’।[50]
আহমাদ বিন হাম্বল নিজেও একদিন এক লোকের সামনে পড়েছিলেন, যখন তিনি পরবর্তী ক্লাসে সময়মত শরীক হওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছিলেন। লোকটি তাকে বলল, ‘এভাবে ছুটতে কি তোমার লজ্জা লাগে না? আর কতদিন তুমি এভাবে বাচ্চাদের সাথে দৌড়াবে বলে নিয়ত করেছ?’ ইবনু হাম্বল উত্তর দিলেন, ‘মৃত্যু পর্যন্ত’।[51]
তবে কতিপয় শাস্ত্রের ক্ষেত্রে ভিন্নতর চিত্র দেখা যেত। ভাষাবিজ্ঞান ও ফিক্বহের ছাত্ররা একজন নির্দিষ্ট শিক্ষকের অধীনে বেশ লম্বা সময় ধরে পাঠগ্রহণ করত। কথিত আছে, আহমাদ বিন ইয়াহইয়া ছা‘লাবের (মৃ. ২৯১ হিঃ) অন্যতম শিষ্য আবু মূসা আল-হামেয তাঁর নিকট ৪০ বছর ধরে ইলম অর্জন করেছিলেন।[52] তাফসীরের একজন শিক্ষক ছয় বছর ধরে তার কিতাবের দরস দিতেন।[53]
প্রখ্যাত হানাফী ফক্বীহ আবু ইউসুফ (মৃ. ১৮২ হিঃ) সতেরো বছর ধরে তার উস্তায আবু হানীফার দরসে বসেছেন।[54] আবু হানীফা নিজেও দশ বছর যাবৎ তার উস্তায হাম্মাদ বিন আবু সুলায়মানের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।[55] অবশেষে যেসময় বাগদাদ ও অন্যান্য জায়গায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হ’ল, ততদিনে ফিক্বহ শাস্ত্র চার বছরের একটি মানসম্মত কোর্সের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
মাদ্রাসা-পূর্ব যুগের শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে, সেখানে ছাত্র শিক্ষক কারো জন্য কোন বয়সসীমা ছিল না। একজন যতদিন চাইত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত। আবার যখন সে নিজেকে যোগ্য বলে মনে করত এবং ছাত্ররা তাকে উস্তায হিসাবে গ্রহণ করত, তখন সে দরস দেয়া শুরু করত। ১৭ বছরের এক তরুণ হাদীস বর্ণনার জন্য মজলিসের আয়োজন করেছিল।[56] আরেকজনের বয়স ছিল ১৮, যখন হাদীসের ছাত্ররা তাকে দরস প্রদানের জন্য অনুরোধ করেছিল।[57] তবে এটা সাধারণ চিত্র ছিল না। ওয়াক্বী‘ ইবনুল জার্রাহ (মৃ. ১৯৮ হিঃ) ৩৩ বছর বয়সে হাদীস বর্ণনা করা শুরু করেন। এমনিভাবে ইবনে মাহদী যখন প্রথমবার পাঠদান করেন, তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশও হয়নি।[58] [ক্রমশঃ]
[1]. বিস্তারিত দেখুন: Gregor Schoeler, "Die Frage Der schriftlichen oder Mündlichen Überlieferung der Wissenschaften im frühen Islam;" Der Islam, Vol. LXII (1985). pp. 201-230.
[2]. তাকিউদ্দীন আহমাদ বিন আলী মাকরীযী, আল-মাওয়ায়েয ওয়াল ই‘তিবার ফিয যিকরি ওয়াল আছার (কায়রো : ১২৭০ হিঃ/১৮৫৪ খ্রি.), ৬/১৯২; আব্দুর রহমান বিন আবুবকর জালালুদ্দীন সুয়ূতী, হুসনুল মুহাযারা ফী আখবারি মিছর ওয়াল কাহিরা (কায়রো : ১৩২৭ হিঃ/১৯০৯ খ্রি.), ২/১৪২।
[3]. এম. হামীদুল্লাহ, ‘এজুকেশনাল সিস্টেম ইন দ্যা টাইম অব দ্যা প্রফেট’ ইসলামিক কালচার, হায়দ্রাবাদ, ১৩ই (জানুয়ারী ১৯৩৯, নং. ১. পৃ. ৫৪।
[4]. বুখারী হা/৫৯, ৮৩, ৮৪, ৯০।
[5]. বুখারী হা/৯৪-৯৫।
[6]. বুখারী, ইলম অধ্যায়, ২৫ অনুচ্ছেদ।
[7]. আবুল ফারাজ ইছফাহানী, কিতাবুল আগানী (কায়রো : ১৩৪৫ হিঃ/১৯২৭ খ্রি.), ১/৪৮; ৪/১৬২-৩; সুয়ূত্বী. হুসনুল মুহাযারা, ১/১৩১।
[8]. বুখারী, ইলম অধ্যায়, ২৫ অনুচ্ছেদ।
[9]. বুরহানুদ্দীন আবু ইসহাক ইবরাহীম বিন সা‘দুল্লাহ বিন জামা‘আহ. তাযকিরাতুস সা-মি‘ ওয়াল মুতাকাল্লিম ফী আদাবিল আলিম ওয়াল মুতা‘আল্লিম (হায়দ্রাবাদ : ১৩৫৩হি./১৯৩৪খ্রি.), পৃ. ২১২।
[10]. খত্বীব আল-বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ (কায়রো ও বাগদাদ : ১৩৪৯হি./ ১৯৩১খ্রি.), ৫/২৮১।
[11]. প্রাগুক্ত, ১২/৭৪।
[12]. Heinrich Ferdinand Wüstenfeld. Der Imam el-Schafi'i, seine Schüler und Anhänger bis zum Jahre 300 D.H., (Göttingen, 1890-91), p. 163.
[13]. Heinz Halm. "Die Anfänge der Madrasa," ZDM Supplement III, 1. XIX. Deutscher Orientalistentag vom 28. September bis 4. Oktober 1975 in Freiburg im Breisgau. 1977. p. 439.
[14]. তারীখু বাগদাদ, ৪/৩-১৩।
[15]. প্রাগুক্ত, ১২/৮৯-৯০; আবুল ফারাজ আব্দুর রহমান বিন আলী বিন জাওযী বাগদাদী, আল-মুনতাযাম ফি তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম, (হায়দ্রাবাদ : ১৩৫৭ হিঃ/১৯৩৮ খ্রি.), ৭/১৪০।
[16]. তারীখু বাগদাদ, ৮/১৯-২৩।
[17]. আরো দেখুন, বুরহানুদ্দীন যারনূজী, তা‘লীমুল মুতা‘আল্লিম, তরীকাতুত তা‘আল্লুম, ‘ইনট্রোডাকশন টু স্টুডেন্ট : দি মেথডস অব লার্নিং’-শিরোনামে Gustav E. von Grunebaum Ges Theodora M. Abelকর্তৃক অনূদিত (নিউইয়র্ক : ১৯৪৭), পৃ. ৪৮।
[18]. তারীখু বাগদাদ, ১/৩৫৫।
[19]. প্রাগুক্ত, ৬/৩৩।
[20]. প্রাগুক্ত, ১৪/১৫৩।
[21]. প্রাগুক্ত, ৫/২১৯-২০।
[22]. প্রাগুক্ত, ১১/১৩৭।
[23]. প্রাগুক্ত, ২/৭৯।
[24]. প্রাগুক্ত ২/৩৯।
[25]. আবু হামেদ মুহাম্মাদ আল-গাযালী, ফাতিহাতুল উলূম (কায়রো : ১৩২২ হিঃ/১৯০৪ খ্রি.), পৃ. ১৯।
[26]. তারীখু বাগদাদ, ১/৩৯৯; আবু আব্দুল্লাহ ইয়াকূত আল-হামাবী, মু‘জামুল উদাবা, সম্পাদক : এ এফ রিফাঈ (কায়রো : ১৯৩৬-৮খ্রি.), ৪/১৬।
[27]. জি. লে. স্ট্রেঞ্জ, বাগদাদ আন্ডার দ্য আববাসীড ক্যালিফেট, (অক্সফোর্ড) পৃ. ৮১-৮৩।
[28]. তারীখু বাগদাদ, ৯/৩৯৪।
[29]. প্রাগুক্ত, ৪/৩৭০।
[30]. প্রাগুক্ত, ২/৫৬-৫৭।
[31]. প্রাগুক্ত, ১০/৩৯।
[32]. প্রাগুক্ত, ১১/৪০৪।
[33]. জর্জ মাকদেসী, দি রাইজ অব কলেজেস : ইনস্টিটিউশনস অব লার্নিং ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট (এডিনবার্গ : ১৯৮১), পৃ. ১৭-১৮।
[34]. তারীখু বাগদাদ, ২/৬৮-৬৯।
[35]. ইবনু সাঈদ আলী বিন মূসা আল-মাগরিবী, আল-মুগরিব ফী হুলাল মাগরিব (লাইডেন : ১৮৯৮), পৃ. ২৪।
[36]. তারীখু বাগদাদ, ৪/১৯০।
[37]. প্রাগুক্ত, ৪/৩৮।
[38]. প্রাগুক্ত, ১১/৩৪৬-৭।
[39]. সুয়ূতী, হুসনুল মুহাযারা, ২/৯১।
[40]. Max Weisweiler, "Das Amt des Mustamli in der arabischen Wissenschaft", Oriens, 4 (1951. pp. 27-56; 'Abd al-Karim b. Muhammad al-Sam'ani, Adab al-Imla' wa 'li-istimla' (Die Methodik des Diktierens). Edited by Max Weisweiler. (Leiden, 1952).
[41]. তারীখু বাগদাদ, ১২/৩৮।
[42]. প্রাগুক্ত, ১২/১৯৫, ১৯৭।
[43]. প্রাগুক্ত, ৯/৩৩।
[44]. প্রাগুক্ত, ৭/৪৬৮।
[45]. প্রাগুক্ত, ৮/১০২-৩; ১২/৩৪।
[46]. Max Weisweiler, "Das Amt des Mustamli in der arabischen Wissenschaft" p.47.
[47]. মুনীরুদ্দীন আহমাদ, মুসলিম এজুকেশন অ্যান্ড দ্য স্কলারস, সোশ্যাল স্ট্যাটাস আপটু দ্য ফিফথ সেঞ্চুরি মুসলিম এরা (ইলেভেনথ সেঞ্চুরি ক্রিশ্চিয়ান এরা) ইন দ্যা লাইট অফ তারীখ বাগদাদ (জুরিখ : ১৯৬৮) পৃ. ৪৩-৪৪।
[48]. তারীখু বাগদাদ, ১১/২৬৫-৬৬।
[49]. প্রাগুক্ত, ১২/৪০৭।
[50]. প্রাগুক্ত, ১৪/৩২৬।
[51]. প্রাগুক্ত, ৬/২৭৪।
[52]. প্রাগুক্ত, ৯/৬১।
[53]. প্রাগুক্ত, ২/১৬৪।
[54]. প্রাগুক্ত, ১৪/২৫২।
[55]. প্রাগুক্ত, ১৩/৩৩৩।
[56]. প্রাগুক্ত, ২/১৫।
[57]. প্রাগুক্ত, ২/১০২।
[58]. প্রাগুক্ত, ১৩/৪৬৮।
ইসলামের প্রথম যুগেই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। সেসময় রাসূল (ﷺ) সাহাবীদের নিকটে কুরআনী নির্দেশনা ব্যাখ্যা করতেন, যেন তারা দ্বীনের আলোয় আলোকিত হ’তে পারে। রাসূল (ﷺ)-এর এসব মজলিসই পরবর্তী যুগে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার মডেল হিসাবে কাজ করেছে। মসজিদে নববীতে নিয়মিত দ্বীনী মজলিস অনুষ্ঠিত হ’ত এবং এটা ইসলামের ইতিহাসে কেবল প্রথম শিক্ষাকেন্দ্রই ছিল না, বরং পরবর্তীতে এটা রীতি হয়ে দাঁড়াল যে, মসজিদগুলি শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবেও ব্যবহৃত হবে। ফলে শত শত বছর ধরে যেসব স্থানকে ঘিরে শিক্ষা-কার্যক্রম আবর্তিত হয়েছে, সেগুলির মধ্যে মসজিদই প্রথম স্থান দখল করে রেখেছিল। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ﷺ) যেরূপ মৌখিকভাবে সাহাবীদের মাঝে দ্বীনের কথা ব্যাখ্যা করতেন, বা সহজ ভাষায় বললে যে পদ্ধতিতে সাহাবীগণ তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী আত্মস্থ করতেন, সেটাই পরবর্তীকালে ইলম চর্চার প্রধান মূলনীতি হিসাবে গৃহীত হয়। যেমন ছাত্রদেরকে শিক্ষকের মুখনিঃসৃত বাণী স্বয়ং শিক্ষকের মুখ থেকে শুনতে হ’ত। এভাবে ‘শ্রবণনীতি’ (সামা‘) আত্মপ্রকাশ করল, যার উপর ভর করে সকল ইলমী কার্যক্রম এগিয়ে চলল। স্পষ্ট করে বললে, শ্রবণনীতির দাবী হ’ল যদি কোন নারী বা পুরুষ কোন কথা সরাসরি শিক্ষকের নিকট থেকে না শুনে থাকে, তাহ’লে তা উক্ত শিক্ষকের বরাতে অন্যের নিকট প্রচার করা যাবে না।[1]
হাদীস নিঃসন্দেহে দ্বীনী ইলমের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল এবং এটাই শ্রবণনীতির (সামা‘) আত্মপ্রকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এটার মূল বক্তব্য হ’ল রাসূল (ﷺ)-এর বাণী নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে শ্রবণ করতে হবে। যেটা অনেকটা স্বয়ং রাসূল (ﷺ)-এর মজলিসে হাযির হওয়ার শামিল। প্রথম যুগে হাদীসের ছাত্ররা নিয়মিত ক্লাসে হাযির হয়ে হাদীস ‘শেখার’ চেয়ে বিভিন্ন শায়খের নিকট থেকে হাদীস ‘সংগ্রহ করাকে’ প্রাধান্য দিতেন। ‘সংগ্রহের’ বিষয়টি পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় হাদীসের মজলিসগুলি যতটা না ইলমী উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল দ্বীনী প্রেরণায়। অবশ্য এরই মধ্য দিয়ে ইলমে হাদীস ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে।
ইসলামের প্রথম যুগের শিক্ষা-কার্যক্রম :
ইসলামের প্রথম যুগের শিক্ষা-কার্যক্রম সম্পর্কে, বিশেষ করে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। খুব সম্ভবত কুরআনের পঠন-পাঠনই ছিল সব ধরনের শিক্ষা উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। সে সময় বহু মুসলিম কুরআন হিফয করতেন। সম্ভবত বহুল পরিচিত ‘দারুল কুররা’ই হ’ল প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে বদর যুদ্ধের পর মদীনায় হিজরতকালে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম ও মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ) অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়।[2] এটাও জানা যায় যে, ছুফফাহ, যেটা হ’ল মসজিদে নববীর মধ্যে বারান্দা বিশেষ, তাহ’ল প্রকৃতপক্ষে প্রথম আনুষ্ঠানিক আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে স্বয়ং রাসূল (ﷺ)-এর তত্ত্বাবধানে পঠন, লিখন, ফিক্বহ, তাজবীদসহ (কুরআন শুদ্ধরূপে পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি) অন্যান্য ইসলামী শাস্ত্রের অধ্যয়ন চলত।[3] ছুফ্ফাহ কোন সুবিন্যস্ত আবাসিক প্রতিষ্ঠান ছিল কি-না, সে প্রশ্ন আপাতত মুলতবী রেখে, রাসূল (ﷺ) যে তাদের পাঠন কার্যে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতেন, এই দাবী অন্তত বেশ জোরের সাথে করা যায়। সালাত পরবর্তী হালাকা সমূহ, যেগুলি কম-বেশী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল, সেগুলি ছাড়াও সাহাবীগণ নবী করীম (ﷺ)-কে মসজিদের ভিতরে এবং বাইরে ঈমান ও আখলাক সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করতেন।[4]
আলোচনার সময় রাসূল (ﷺ) তাঁর চারপাশে উপবিষ্ট শ্রোতাদেরকে একটি বিষয় তিন বার করে বলতেন।[5] রাসূল (ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন গোত্রের নিকট কুরআনের প্রশিক্ষক পাঠিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে খলীফা ওমর (রাঃ)ও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন।[6] যাহোক, ইসলামী শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নকল্পে মদীনায় একটি বিশেষ মজলিস গঠিত হয়েছিল বলে দাবী করা হয়।[7] আরো বলা হয়, হাদীস প্রচারের উদ্দেশ্যে আহলে ইলমের একটি দল গঠন করা হয়েছিল।[8]
শিক্ষাকেন্দ্র সমূহ :
মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের জীবন আবর্তিত হ’ত। কারণ মসজিদ ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক তথা সকল কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র। ইবাদতগাহ হওয়া ছাড়াও মসজিদগুলি শত শত বছর ধরে সামাজিক পরিষদের ভূমিকাও পালন করে এসেছে। যেমন বিচারকরা (ক্বাযী) মসজিদের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। কখনো কখনো মসজিদে মুসাফিরদের থাকার ব্যবস্থা করা হ’ত। আবু যাকারিয়া তাবরীযী দামেশকের জামে মসজিদের মিনার সংলগ্ন একটি ছোট্ট কক্ষে থাকতেন।[9]
মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মসজিদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষাকেন্দ্র হওয়ায় মসজিদে নিয়মিত দরস অনুষ্ঠিত হ’ত। আর এভাবে মসজিদ থেকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ত।
একথা সত্য যে, কেবলমাত্র মসজিদই শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না; বরং মসজিদ ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় পাঠদান সম্পন্ন হ’ত। পঠন-পাঠনের নিমিত্তে বিশেষ ভবন নির্মাণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আবুবকর মুহাম্মাদ বিন বাশশার বছরী আল-বুনদার (মৃ. ২৫২ হিঃ) তার ছাত্র ইবনে খাররাশ (মৃ. ২৮৩ হিঃ)-এর নিকট হাদীস বর্ণনার নিমিত্তে একটি কক্ষ নির্মাণের জন্য ২০০০ দিরহাম গচ্ছিত রেখেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কক্ষ নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[10]
আলী বিন মুহাম্মাদ আল-বাযযায (মৃ. ৩৩০ হিঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, পড়াশোনার জন্য তার একটি বিশেষ গৃহ ছিল (বায়তুল ইলম)।[11] এমনিভাবে আবু হাতেম বুসতী (জন্ম ২৭৭ হিঃ)-এর বিশেষ অবদান হ’ল, তিনি লাইব্রেরী সমৃদ্ধ একটি ‘দারুল ইলম’ গড়ে তোলেন এবং বহিরাগত ছাত্রদের জন্য বেশ কিছু কক্ষ নির্মাণ করেন। তিনি তাদেরকে নিজ উদ্যোগে ভাতাও দিতেন।[12] নিশাপুরের প্রথমদিকের মাদ্রাসাগুলি শায়খদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[13]
(১) বাসগৃহ :
অনেক সময় শিক্ষকদের নিজস্ব বাসভবন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবু মুহাম্মাদ সুলায়মান বিন মিহরান আল-আ‘মাশের (মৃ. ১৪৮ হিঃ) বাসভবন কূফার অন্যতম বিদ্যাপীঠ ছিল।[14] একজন দরিদ্র ছাত্রকে নিয়ে একটি মজার গল্প চালু আছে। ছাত্রটি টিউশন ফি দিতে না পারায় তার শিক্ষক ইবনে লুলূ (মৃ. ৩৭৭ হিঃ) তাকে দরস থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। দরস অনুষ্ঠিত হচ্ছিল শিক্ষকের গৃহে। নিরূপায় হয়ে ছেলেটি ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেও গৃহ সংলগ্ন একটি করিডোরে চুপচাপ বসে পড়ল। এবার যে ছাত্রটি উক্ত দরসে উস্তাযকে কিতাব পড়ে শোনাচিছল, সে তার অসহায় বন্ধুকে সাহায্য করতে চাইল। সে উচ্চৈঃস্বরে পড়তে লাগল যাতে করিডোরে বসা বন্ধুটিও শুনতে পায়।[15]
বাগদাদের একটি বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র ছিল ‘মজলিসে মাহামিলী’। এটি ২৭০ হিজরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে মূলতঃ ফিক্বহ ও ধর্মতত্ত্বের উপর আলোচনা হ’ত। মজলিসটি অনুষ্ঠিত হ’ত আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন বিন ইসমাঈল যাববী মাহামিলীর বাসভবনে। প্রতি বুধবার এখানে সভা বসত এবং ৩৩০ হিজরীতে ক্বাযী মাহামিলীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন।[16] শায়খদের কাছে বুধবার সম্ভবত পাঠদানের জন্য বিশেষ পসন্দের দিন ছিল।[17] হিজরী ৫ম শতকে বাগদাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিতর্কসভা ছিল ক্বাযী সিমনানীর (মৃ. ৪৪৪ হিঃ) বিতর্কসভা। এটি সিমনানীর গৃহে অনুষ্ঠিত হ’ত।[18] বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আবুল আববাস ছা‘লাব (মৃ. ২৯১ হিঃ) বর্ণনা করেন, তিনি ৫০ বছর যাবৎ তার শিক্ষক ইবরাহীম হারবীর (মৃ. ২৮৫ হিঃ) গৃহে অভিধান-সংকলন বিদ্যার ক্লাসে হাযির হয়েছেন।[19] ব্যাকরণবিদ ফার্রা নিজ গৃহে পাঠদান করতেন।[20] আবুবকর বিন সিরাজ নাহবী (মৃ. ৩১৬ হিঃ) সম্পর্কেও এমন কথা বর্ণিত আছে।[21]
(২) দোকান :
যেহেতু অনেক শায়খ ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই তাদের দোকানগুলিতে মাঝে-মধ্যে পাঠদান সম্পন্ন হ’ত। ইলমে ফারায়েযের একজন শিক্ষক সম্পর্কে শোনা যায়, তিনি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে নিজ দোকানে দরস প্রদান করতেন।[22] খত্বীব বাগদাদী (মৃ. ৪৬৩ হিঃ) ইবনে ইসহাকের দোকানে জনৈক শিক্ষকের নিকট পাঠ গ্রহণ করেছেন।[23] আহমাদ বিন হাম্বল (মৃ. ২৪০ হিঃ) জনৈক তাঁতীর দোকানে হাদীস বর্ণনা করেছেন।[24] বিভিন্ন যুগে এভাবে পাঠদানের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
(৩) মসজিদ :
স্বাভাবিকভাবে পঠন-পাঠনের জন্য মসজিদ ছিল সবচেয়ে পসন্দের জায়গা। মুখাওয়াল বর্ণনা করেন, একদা রাসূল (ﷺ) তাঁর দশজন সাহাবীকে মসজিদে ক্বোবায় জ্ঞান আহরণে নিয়োজিত দেখতে পেলেন এবং তিনি তাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন।[25] তবে মসজিদ কেন্দ্রিক পঠন-পাঠনের বিষয়টি কমবেশী বড় শহরগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষায়তন খুঁজে পাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। বাগদাদ, দামেশক বা কায়রোর মতো বড় শহরগুলিতে শিক্ষাকেন্দ্র ছিল অগণিত। তাই শহরের ছোট-বড় অসংখ্য মসজিদে পাঠদান চলত।
বড় শহরগুলিতে মসজিদ ছিল দুই ধরনের। একটা হ’ল সাধারণ মসজিদ, যেখানে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অনুষ্ঠিত হ’ত। অপরটি হ’ল জামে মসজিদ, যেখানে শুক্রবার জুম‘আর সালাতও অনুষ্ঠিত হ’ত। একটি মধ্যম মানের শহরে একাধিক জামে মসজিদ থাকত। উদাহরণস্বরূপ বাগদাদের কথা বলা যায়। হিজরী ৫ম শতকে বাগদাদে ৬টি জামে মসজিদ ছিল এবং বলা হয়ে থাকে, সেসময় পুরো বাগদাদ শহরে মোট মসজিদ ছিল তিন হাযার।[26]
এক একটি মসজিদে সম্ভবত এক বা একাধিক বিষয়ে এক বা একাধিক ক্লাস অনুষ্ঠিত হ’ত। মসজিদের মুতাওয়াল্লীর নিকট থেকে পঠন-পাঠনের অনুমতি লাভের ক্ষেত্রে শক্ত কোন নিয়ম ছিল বলে মনে হয় না। কারণ অধিকাংশ মসজিদের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ চলত ওয়াকফের মাধ্যমে বা মসজিদের বিষয়াবলী দেখার জন্য একদল কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান থাকত। তবে জামে মসজিদের ক্ষেত্রে এমন বিধিনিষেধের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন খত্বীব বাগদাদী খলীফা কাইয়ূম বিল্লাহর নিকট ‘জামে মানছূরে’ হাদীস বর্ণনার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। ‘জামে মানছূর’ ছিল সেসময় রাজধানীর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এবং একই সাথে এটা সবচেয়ে স্বনামধন্য বিদ্যায়তনও ছিল। খলীফা একবার নাক্বীবে নুক্বাবার নিকট এই মর্মে সুফারিশপত্র লিখলেন যে, তিনি যেন খত্বীব বাগদাদীর পাঠদানে সহযোগিতা করেন। নাক্বীবে নুক্বাবা ছিলেন হাশেমীদের প্রধান রাজকর্মচারী এবং রাসূল (ﷺ)-এর বংশধর তথা শরীফদের প্রধান নিবন্ধক। নাক্বীবে নুক্বাবার হয় সেসময় উক্ত মসজিদের তদারকির দায়িত্ব ছিল, নতুবা তিনি উক্ত মসজিদে সুষ্ঠুভাবে পাঠদানের বিষয় দেখাশোনা করতেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, জামে মানছূর ছিল হাম্বলীদের শক্ত ঘাঁটি। অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি-না দেখার জন্য খত্বীব বাগদাদীর প্রথম দরসে স্বয়ং নাক্বীবে নুক্বাবা হাযির হয়েছিলেন।
প্রায়ই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মসজিদে এক বা একাধিক বিষয় চর্চার ক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করতেন। আবার কখনো কখনো একটি মসজিদ বিশেষ কোন ইলম অধ্যয়নের জন্য পরিচিতি লাভ করত। এটা হ’ত সেখানে দরস প্রদানকারী শায়খদের খ্যাতির কারণে। এসব ক্ষেত্রে কখনো আবার পাঠদানকারী শায়খদের নামে মসজিদের নামকরণ হয়ে যেত। যেমন কুরআনের বিখ্যাত ক্বারী রুওয়াইম বিন ইয়াযীদের (মৃ. ২১১ হিঃ) নামে একটি মসজিদের নামকরণ করা হয়েছিল। মসজিদটি বাগদাদের দারবে কাল্লাঈন এলাকায় অবস্থিত ছিল।[27] ৩৭৪ হিজরীতে যখন আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ আত-তাম্মার সেখানে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তখনও মসজিদটি উক্ত নামে পরিচিত ছিল।[28]
বাগদাদের আরেকটি মসজিদের নামকরণ করা হয়েছিল আব্দুল্লাহ বিন মুবারকের (মৃ. ১৮১ হিঃ) নামে। তিনি যদিও বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন না, তবে তিনি হয়ত তার বিভিন্ন সময় বাগদাদ সফরে সেখানে দরস প্রদান করেছেন। হিজরী ৫ম শতকে যখন শাফেঈ মাযহাবের বিখ্যাত ফক্বীহ আবু হামেদ ইসফারায়ীনী (মৃ. ৪০৬ হিঃ) সেখানে দরস প্রদান করছিলেন, তখনও মসজিদটি উক্ত নামেই পরিচিত ছিল। ততদিনে মসজিদটি একটি বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং সাথে সাথে এটি বাগদাদের একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসাবেও গণ্য হ’ত। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থান হ’তে আগত শিক্ষার্থীবৃন্দ ইসফারায়ীনীর দরসে অংশগ্রহণ করার জন্য ভিড় জমাত। খত্বীব বাগদাদীর নিকট খবর পৌঁছেছে যে, সেখানে ৭০০ ছাত্র দরস গ্রহণ করত।[29] এভাবে মসজিদগুলি শত শত বছর ধরে বিদ্যাপীঠের ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি আলাদা ভবনসমৃদ্ধ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পরও। অবশ্য প্রতিটি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে একটি করে মসজিদ থাকত।
ইলমী সমাবেশ, মজলিস এবং হালাকা :
ইলমী বৈঠকগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য যে পরিভাষাটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হ’ত, তাহ’ল ‘মজলিস’। অবশ্য শব্দটি আরো বেশ কিছু অর্থে ব্যবহৃত হ’তে পারে। যেমন পাঠদানের হল, দরস, শিক্ষকের আসন, পিলার বা চেয়ার সংলগ্ন স্থান বা ভবনের যেকোন জায়গা। পরিপূরক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ যোগ করার মাধ্যমে একটি মজলিসের উদ্দেশ্য নির্ণীত হ’ত। যেমন ‘মজলিসে তাদরীস’ তথা পাঠদানের সভা, ‘মজলিসে শু‘আরা’ তথা কবিদের সভা ইত্যাদি।
যে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটি মজলিস অনুষ্ঠিত হ’ত, হয়ত তার নামেই মজলিসের নামকরণ করা হ’ত। উদাহরণস্বরূপ ‘মজলিসে মাহামিলীর’ কথা বলা যায়। এটি মাহামিলীর বাসগৃহে অনুষ্ঠিত হ’ত এবং এখানে মূলত ফিক্বহ ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হ’ত। মজলিসে শাফেঈ বাগদাদের জামে মানছূরে অনুষ্ঠিত হ’ত।[30]
উপরোল্লেখিত দু’টি মজলিসই শায়খদ্বয়ের মৃত্যুর বহু পরেও স্ব স্ব নামে পরিচিত ছিল। আসলে মজলিসগুলি প্রতিষ্ঠাতাদের নামে একাডেমিক চেয়ার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের স্মৃতি জাগরুক রাখত। সেসব চেয়ারে পরবর্তীতে বিখ্যাত শায়খদের নিয়োগ দেয়া হ’ত। যাহোক, খত্বীব বাগদাদীর জীবদ্দশায়ও মজলিসে মাহামিলী বিদ্যমান ছিল এবং তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলেও উল্লেখ করেছেন।[31]
ইলমী বৈঠকগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য দ্বিতীয় যে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হ’ত, সেটি হ’ল ‘হালাকা’ (পাঠচক্র)। দরসে সুবিন্যস্তভাবে বসার ধারণা হ’তে সম্ভবত শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ছাত্ররা চারদিকে গোল হয়ে বসত, তবে শিক্ষকের সম্মুখভাগে বসা পসন্দনীয় ছিল। যদিও মজলিসের মতো সব ধরনের ইলমী বৈঠক বুঝাতে ‘হালাকা’র প্রয়োগ করা যায়। তবুও এটার ব্যবহার বোধহয় সীমিত সংখ্যক ছাত্র নিয়ে নিয়মিতভাবে ক্লাস করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। এটি বিশেষত ভাষাবিজ্ঞান ও অন্য বেশকিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেগুলিতে ছাত্রদেরকে মোটামুটি লম্বা সময় ধরে একজন শিক্ষকের অধীনে পড়াশোনা করতে হ’ত। ‘হালাকায়ে খলীল নাহবী’ (মৃ. ১৭৪ হিঃ) এ ধরনের হালাকার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। খলীলের মৃত্যুর পর তার ছাত্র ইউনুস নাহবী এই হালাকার হাল ধরেন।[32]
মনে করা হয়, জামে মসজিদে যে দরস অনুষ্ঠিত হ’ত, তাকে হালাকা বলা হ’ত এবং একটি জামে মসজিদে অনেকগুলি করে হালাকা বসত। প্রত্যেকটি হালাকায় একজন করে শিক্ষক থাকতেন।[33] ইমাম শাফেঈ যখন বাগদাদ সফর করেন, তখন জামে মানছূরে ৪০-৫০টির মত হালাকা ছিল বলে উল্লেখিত হয়েছে।[34] ৩২৬ হিজরীতে কায়রোর জামে আমরে মালেকী মাযহাবের ১৫টি, শাফেঈ মাযহাবের ১৪টি এবং হানাফী মাযহাবের ৩টি করে হালাকা ছিল।[35] কায়রো ও দামেশকে নিয়মিত বৈঠকগুলিকে ‘আয-যাবিয়া’ বলা হ’ত। যাবিয়াতে শাফেঈ‘, যেখানে তিনি সশরীরে দরস দিয়েছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উক্ত নামে পরিচিত ছিল। কায়রোর মসজিদে আযহার এবং জামে মামূর, যেটাকে দামেশকের গ্র্যান্ড মসজিদও বলা হয়, উভয়টিতে আটটি করে ‘যাবিয়া’ ছিল।
হাম্বলী মাযহাবের বিখ্যাত ফক্বীহ ও মুহাদ্দিছ আবুবকর নাজ্জাদ (মৃ. ৩৪৮ হিঃ) জামে মানছূরে দু’টি হালাকার আয়োজন করতেন। শুক্রবার জুম‘আর সালাতের পূর্বে ফিক্বহী মাসআলার জন্য একটি, আর অপরটি জুম‘আর পর হাদীস বর্ণনার জন্য।[36] একই শহরের জামে রুসাফাতে হাদীসের ছাত্রদের আরেকটি হালাকা বসত।[37] আবু ইসহাক ইবরাহীম বিন আহমাদ মারওয়াযীও (মৃ. ৩৪০ হিঃ) জামে মানছূরে একটি হালাকার আয়োজন করতেন। বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক আবুল হাসান আলী বিন ইসমাঈল আশ‘আরী (মৃ. ৩৩০ হিঃ) এখানে প্রতি শুক্রবার দরস দিতেন।[38] আসলে একটি হালাকাতে কয়েকজন উস্তায দরস দিতেন, আবার এটাও সম্ভব যে কয়েকজন উস্তায কয়েকটি আলাদা আলাদা হালাকায় অংশগ্রহণ করতেন। মজলিস ও হালাকার মধ্যে পার্থক্য ছিল বটে, তবে উভয়েরই মৃত শিক্ষকের নামে চেয়ার ছিল।
ছাত্রদের জন্য সাধারণত সব দরস উন্মুক্ত ছিল। তবে ব্যতিক্রম হ’ত সেসব বিষয়ে যেগুলি শিখতে দীর্ঘ সময় লাগত। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক নিজে কিছু ছাত্রকে বাছাই করতেন এবং তাদেরকে দরসে বসার অনুমতি দিতেন। আর যে বিষয় শেখানো হচ্ছে, সে অনুযায়ী ক্লাসের আকার ছোট বড় হ’ত। ফলে ফিক্বহ বা ব্যাকরণের ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা ছিল খুব সীমিত। কিন্তু হাদীসের ক্লাসগুলিতে উপস্থিতির সংখ্যা মাঝে-মধ্যে এত বেশী হ’ত যে, হাদীস বর্ণনার জন্য শিক্ষককে বর্ণনা-সহকারী (মুসতামলী) নিয়োগ করতে হ’ত। যিনি শিক্ষকের বলা কথা একদম পেছনের সারিগুলির উদ্দেশ্য আবার বলতেন, যেখান থেকে হয়ত শিক্ষকের কথা ঠিকমতো শোনা যায়নি। কায়রোর জামে আমরে আবুবকর নি‘আলীর (মৃ. ৩৮০ হিঃ) হালাকা এত বড় ছিল যে, মসজিদের সতেরোটি স্তম্ভ জুড়ে ছাত্ররা বসত।[39] মুসতামলীর কাজ ছিল উস্তায বর্ণিত অংশটুকু পুনরায় বলা যাতে উপস্থিত প্রত্যেকে তা লিখে নিতে পারে।[40]
মুসতামলীর দায়িত্ব ছিল শিক্ষকের বলা অংশটুকু কোন ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াই পুনরাবৃত্তি করা। একজন মুসতামলীর ব্যাপারে জানা যায়, পুনরাবৃত্তির সময় ভুল করার কারণে উস্তায তাকে তিরস্কার করেন এবং নির্ভুলভাবে বর্ণনার জন্য নছীহত করেন।[41] প্রখ্যাত ব্যাকরণবিদ সিবাওয়াইহ (মৃ. ১৯৪ হিঃ) সম্পর্কেও এমন কথা শোনা যায়। তিনি প্রথম জীবনে একজন মুসতামলী ছিলেন। একবার একটি হাদীসের ক্লাসে পুনরাবৃত্তির সময় ব্যাকরণগত ভুল করায় পরবর্তীতে তিনি তার গবেষণার ক্ষেত্র বদলে ফেলেন।[42]
এমন আরেকটি ঘটনা হ’ল, একবার একটি বড় দরসে তিনজন মুসতামলী নিযুক্ত করার পরও ছাত্ররা ঠিকমতো পড়া শুনতে পাচ্ছিল না। ফলে প্রখ্যাত মুসতামলী হারূন বিন সুফিয়ান আদ-দীককে ডাকা হয়। তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠের অধিকারী এবং তিনি কাজটি পুরোপুরি একাই করতেন।[43] এমনও প্রমাণ পাওয়া যায়, মুসতামলীর কাজটি একটি উল্লেখযোগ্য পেশায় পরিণত হয়েছিল।[44] কতিপয় শিক্ষক বহু বছর যাবৎ ব্যক্তিগত মুসতামলী রাখার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন।[45]
মুসতামলী সাধারণত ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়াতেন বা উঁচু আসনে বসতেন। যাতে প্রত্যেকে তাকে দেখতে ও শুনতে পায়। উস্তাযকে দরস শুরু করতে বলার পূর্বে মুসতামলী শিক্ষকের নাম, উপনাম ও বংশপদবী বলে নিতেন। মুসতামলীরা সম্ভবত আগেভাগে কিছু বিষয় নোট করে রাখতেন। কারণ ক্লাস শেষ হওয়ার পূর্বেই সম্পূর্ণ পাঠ তাদেরকে পুনরায় বলতে হ’ত।[46]
একইভাবে একেকটি শাস্ত্র শেষ করতে একেক রকম সময় লাগত। উদাহরণস্বরূপ হাদীসের কথা বলা যায়। হাদীসের ছাত্ররা বছরের পর বছর ধরে এক জায়গা হ’তে আরেক জায়গায়,[47]
এক শিক্ষক হ’তে আরেক শিক্ষকের নিকট যাতায়াত করত। এভাবে হাদীস সংগ্রহ করে সেগুলি যাচাই-বাছাই করার পর একত্রে সংকলন করত।[48] একজন শিক্ষক একবার আফসোস করে বললেন যে, তার ছাত্ররা মাত্র চার পাঁচ মাসের দরসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অথচ তার সংকলনটি সম্পূর্ণ করতে চল্লিশ বছর লেগেছে।[49]
হাদীসের পাঠ সম্পন্ন করার নির্ধারিত কোন বয়স ছিল না। ছাত্ররা দীর্ঘ সময় ধরে সংকলনকার্য চালিয়ে যাবে নাকি আগেভাগে বন্ধ করে দেবে, তা নির্ভর করত তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর। এক ছাত্রকে নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। একবার যখন সে একটি বাজারের মধ্য দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিল, তখন একটি লোক তার গতিরোধ করল। লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি হাদীসের ছাত্র? ছাত্রটি অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি হাদীসের ছাত্র। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘আহমাদ বিন হাম্বল বলতেন, তুমি যদি কাউকে রাস্তা দিয়ে ছুটতে দেখো, তাহ’লে নিশ্চিত জানবে সে হয় পাগল, না হয় হাদীসের ছাত্র’।[50]
আহমাদ বিন হাম্বল নিজেও একদিন এক লোকের সামনে পড়েছিলেন, যখন তিনি পরবর্তী ক্লাসে সময়মত শরীক হওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছিলেন। লোকটি তাকে বলল, ‘এভাবে ছুটতে কি তোমার লজ্জা লাগে না? আর কতদিন তুমি এভাবে বাচ্চাদের সাথে দৌড়াবে বলে নিয়ত করেছ?’ ইবনু হাম্বল উত্তর দিলেন, ‘মৃত্যু পর্যন্ত’।[51]
তবে কতিপয় শাস্ত্রের ক্ষেত্রে ভিন্নতর চিত্র দেখা যেত। ভাষাবিজ্ঞান ও ফিক্বহের ছাত্ররা একজন নির্দিষ্ট শিক্ষকের অধীনে বেশ লম্বা সময় ধরে পাঠগ্রহণ করত। কথিত আছে, আহমাদ বিন ইয়াহইয়া ছা‘লাবের (মৃ. ২৯১ হিঃ) অন্যতম শিষ্য আবু মূসা আল-হামেয তাঁর নিকট ৪০ বছর ধরে ইলম অর্জন করেছিলেন।[52] তাফসীরের একজন শিক্ষক ছয় বছর ধরে তার কিতাবের দরস দিতেন।[53]
প্রখ্যাত হানাফী ফক্বীহ আবু ইউসুফ (মৃ. ১৮২ হিঃ) সতেরো বছর ধরে তার উস্তায আবু হানীফার দরসে বসেছেন।[54] আবু হানীফা নিজেও দশ বছর যাবৎ তার উস্তায হাম্মাদ বিন আবু সুলায়মানের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।[55] অবশেষে যেসময় বাগদাদ ও অন্যান্য জায়গায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হ’ল, ততদিনে ফিক্বহ শাস্ত্র চার বছরের একটি মানসম্মত কোর্সের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
মাদ্রাসা-পূর্ব যুগের শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে, সেখানে ছাত্র শিক্ষক কারো জন্য কোন বয়সসীমা ছিল না। একজন যতদিন চাইত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারত। আবার যখন সে নিজেকে যোগ্য বলে মনে করত এবং ছাত্ররা তাকে উস্তায হিসাবে গ্রহণ করত, তখন সে দরস দেয়া শুরু করত। ১৭ বছরের এক তরুণ হাদীস বর্ণনার জন্য মজলিসের আয়োজন করেছিল।[56] আরেকজনের বয়স ছিল ১৮, যখন হাদীসের ছাত্ররা তাকে দরস প্রদানের জন্য অনুরোধ করেছিল।[57] তবে এটা সাধারণ চিত্র ছিল না। ওয়াক্বী‘ ইবনুল জার্রাহ (মৃ. ১৯৮ হিঃ) ৩৩ বছর বয়সে হাদীস বর্ণনা করা শুরু করেন। এমনিভাবে ইবনে মাহদী যখন প্রথমবার পাঠদান করেন, তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশও হয়নি।[58] [ক্রমশঃ]
[1]. বিস্তারিত দেখুন: Gregor Schoeler, "Die Frage Der schriftlichen oder Mündlichen Überlieferung der Wissenschaften im frühen Islam;" Der Islam, Vol. LXII (1985). pp. 201-230.
[2]. তাকিউদ্দীন আহমাদ বিন আলী মাকরীযী, আল-মাওয়ায়েয ওয়াল ই‘তিবার ফিয যিকরি ওয়াল আছার (কায়রো : ১২৭০ হিঃ/১৮৫৪ খ্রি.), ৬/১৯২; আব্দুর রহমান বিন আবুবকর জালালুদ্দীন সুয়ূতী, হুসনুল মুহাযারা ফী আখবারি মিছর ওয়াল কাহিরা (কায়রো : ১৩২৭ হিঃ/১৯০৯ খ্রি.), ২/১৪২।
[3]. এম. হামীদুল্লাহ, ‘এজুকেশনাল সিস্টেম ইন দ্যা টাইম অব দ্যা প্রফেট’ ইসলামিক কালচার, হায়দ্রাবাদ, ১৩ই (জানুয়ারী ১৯৩৯, নং. ১. পৃ. ৫৪।
[4]. বুখারী হা/৫৯, ৮৩, ৮৪, ৯০।
[5]. বুখারী হা/৯৪-৯৫।
[6]. বুখারী, ইলম অধ্যায়, ২৫ অনুচ্ছেদ।
[7]. আবুল ফারাজ ইছফাহানী, কিতাবুল আগানী (কায়রো : ১৩৪৫ হিঃ/১৯২৭ খ্রি.), ১/৪৮; ৪/১৬২-৩; সুয়ূত্বী. হুসনুল মুহাযারা, ১/১৩১।
[8]. বুখারী, ইলম অধ্যায়, ২৫ অনুচ্ছেদ।
[9]. বুরহানুদ্দীন আবু ইসহাক ইবরাহীম বিন সা‘দুল্লাহ বিন জামা‘আহ. তাযকিরাতুস সা-মি‘ ওয়াল মুতাকাল্লিম ফী আদাবিল আলিম ওয়াল মুতা‘আল্লিম (হায়দ্রাবাদ : ১৩৫৩হি./১৯৩৪খ্রি.), পৃ. ২১২।
[10]. খত্বীব আল-বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ (কায়রো ও বাগদাদ : ১৩৪৯হি./ ১৯৩১খ্রি.), ৫/২৮১।
[11]. প্রাগুক্ত, ১২/৭৪।
[12]. Heinrich Ferdinand Wüstenfeld. Der Imam el-Schafi'i, seine Schüler und Anhänger bis zum Jahre 300 D.H., (Göttingen, 1890-91), p. 163.
[13]. Heinz Halm. "Die Anfänge der Madrasa," ZDM Supplement III, 1. XIX. Deutscher Orientalistentag vom 28. September bis 4. Oktober 1975 in Freiburg im Breisgau. 1977. p. 439.
[14]. তারীখু বাগদাদ, ৪/৩-১৩।
[15]. প্রাগুক্ত, ১২/৮৯-৯০; আবুল ফারাজ আব্দুর রহমান বিন আলী বিন জাওযী বাগদাদী, আল-মুনতাযাম ফি তারীখিল মুলূক ওয়াল উমাম, (হায়দ্রাবাদ : ১৩৫৭ হিঃ/১৯৩৮ খ্রি.), ৭/১৪০।
[16]. তারীখু বাগদাদ, ৮/১৯-২৩।
[17]. আরো দেখুন, বুরহানুদ্দীন যারনূজী, তা‘লীমুল মুতা‘আল্লিম, তরীকাতুত তা‘আল্লুম, ‘ইনট্রোডাকশন টু স্টুডেন্ট : দি মেথডস অব লার্নিং’-শিরোনামে Gustav E. von Grunebaum Ges Theodora M. Abelকর্তৃক অনূদিত (নিউইয়র্ক : ১৯৪৭), পৃ. ৪৮।
[18]. তারীখু বাগদাদ, ১/৩৫৫।
[19]. প্রাগুক্ত, ৬/৩৩।
[20]. প্রাগুক্ত, ১৪/১৫৩।
[21]. প্রাগুক্ত, ৫/২১৯-২০।
[22]. প্রাগুক্ত, ১১/১৩৭।
[23]. প্রাগুক্ত, ২/৭৯।
[24]. প্রাগুক্ত ২/৩৯।
[25]. আবু হামেদ মুহাম্মাদ আল-গাযালী, ফাতিহাতুল উলূম (কায়রো : ১৩২২ হিঃ/১৯০৪ খ্রি.), পৃ. ১৯।
[26]. তারীখু বাগদাদ, ১/৩৯৯; আবু আব্দুল্লাহ ইয়াকূত আল-হামাবী, মু‘জামুল উদাবা, সম্পাদক : এ এফ রিফাঈ (কায়রো : ১৯৩৬-৮খ্রি.), ৪/১৬।
[27]. জি. লে. স্ট্রেঞ্জ, বাগদাদ আন্ডার দ্য আববাসীড ক্যালিফেট, (অক্সফোর্ড) পৃ. ৮১-৮৩।
[28]. তারীখু বাগদাদ, ৯/৩৯৪।
[29]. প্রাগুক্ত, ৪/৩৭০।
[30]. প্রাগুক্ত, ২/৫৬-৫৭।
[31]. প্রাগুক্ত, ১০/৩৯।
[32]. প্রাগুক্ত, ১১/৪০৪।
[33]. জর্জ মাকদেসী, দি রাইজ অব কলেজেস : ইনস্টিটিউশনস অব লার্নিং ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট (এডিনবার্গ : ১৯৮১), পৃ. ১৭-১৮।
[34]. তারীখু বাগদাদ, ২/৬৮-৬৯।
[35]. ইবনু সাঈদ আলী বিন মূসা আল-মাগরিবী, আল-মুগরিব ফী হুলাল মাগরিব (লাইডেন : ১৮৯৮), পৃ. ২৪।
[36]. তারীখু বাগদাদ, ৪/১৯০।
[37]. প্রাগুক্ত, ৪/৩৮।
[38]. প্রাগুক্ত, ১১/৩৪৬-৭।
[39]. সুয়ূতী, হুসনুল মুহাযারা, ২/৯১।
[40]. Max Weisweiler, "Das Amt des Mustamli in der arabischen Wissenschaft", Oriens, 4 (1951. pp. 27-56; 'Abd al-Karim b. Muhammad al-Sam'ani, Adab al-Imla' wa 'li-istimla' (Die Methodik des Diktierens). Edited by Max Weisweiler. (Leiden, 1952).
[41]. তারীখু বাগদাদ, ১২/৩৮।
[42]. প্রাগুক্ত, ১২/১৯৫, ১৯৭।
[43]. প্রাগুক্ত, ৯/৩৩।
[44]. প্রাগুক্ত, ৭/৪৬৮।
[45]. প্রাগুক্ত, ৮/১০২-৩; ১২/৩৪।
[46]. Max Weisweiler, "Das Amt des Mustamli in der arabischen Wissenschaft" p.47.
[47]. মুনীরুদ্দীন আহমাদ, মুসলিম এজুকেশন অ্যান্ড দ্য স্কলারস, সোশ্যাল স্ট্যাটাস আপটু দ্য ফিফথ সেঞ্চুরি মুসলিম এরা (ইলেভেনথ সেঞ্চুরি ক্রিশ্চিয়ান এরা) ইন দ্যা লাইট অফ তারীখ বাগদাদ (জুরিখ : ১৯৬৮) পৃ. ৪৩-৪৪।
[48]. তারীখু বাগদাদ, ১১/২৬৫-৬৬।
[49]. প্রাগুক্ত, ১২/৪০৭।
[50]. প্রাগুক্ত, ১৪/৩২৬।
[51]. প্রাগুক্ত, ৬/২৭৪।
[52]. প্রাগুক্ত, ৯/৬১।
[53]. প্রাগুক্ত, ২/১৬৪।
[54]. প্রাগুক্ত, ১৪/২৫২।
[55]. প্রাগুক্ত, ১৩/৩৩৩।
[56]. প্রাগুক্ত, ২/১৫।
[57]. প্রাগুক্ত, ২/১০২।
[58]. প্রাগুক্ত, ১৩/৪৬৮।
মূল (ইংরেজী): মুনীরুদ্দীন আহমাদ
অনুবাদ : আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অনুবাদ : আসাদুল্লাহ আল-গালিব
Last edited: