ভূমিকা: বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপট অনুযায়ী প্রশ্নটি অতি গুরুত্বপূর্ণ; যা জানা সবার জন্য অপরিহার্য। কারণ আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি যেখানে অধিকাংশ মানুষের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে পরকালীন চিন্তা না করে চারদিকে সুদ-ঘুষ হারাম, ধোকা, প্রতারণা ইত্যাদিতে লিপ্ত থেকে দুনিয়ার ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার জন্য অধিকহারে সম্পদ অর্জন করা। কিন্তু এ অর্জন হালাল পন্থায় হলো নাকি হারাম পন্থায় হলো তা সে পরোয়া করে না। তার নিকট হালাল হারামের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়টাই তার নিকট সমান। আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্ব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أم من الْحَرَام “এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে”। (সহীহ বুখারী হা/২০৫৯,সহীহ আল জামি হা/৮০০৩)
যাইহোক মূল কথায় আসি, পিতার হারাম সম্পত্তি তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশরা উত্তরাধিকারী সূত্রে গ্রহণ করতে পারবে কিনা এটি একটি ব্যাখ্যামূলক বিষয়, যা দুই এক কথায় পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। কারণ হারাম সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়টা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে সালাফগণ মতভেদ করেছেন। মাসয়ালা টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে যতটুকু সম্ভব ইনসাফের সাথে কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফদের বক্তব্যগুলোর আলোকে সহজে বের করার চেষ্টা করছি আলহামদুলিল্লাহ।
পিতার উপার্জিত হারাম সম্পত্তি ওয়ারিশ সূত্র গ্রহণ করার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে।তাই অবস্থা অনুযায়ী ফাতওয়া ভিন্ন হবে। যেমন:
(১). মৃত ব্যক্তি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় অজ্ঞতার কারণে হারাম উপার্জন করেন অর্থাৎ যদি তিনি হাকীকি বা প্রকৃতপক্ষে এই উপার্জন হারাম হওয়া সম্পর্কে না জেনে সম্পদ উপার্জন করে থাকেন ও পরবর্তীতে সঠিক বিধান জানার সঙ্গে সঙ্গে হারাম ত্যাগ করেন এবং উক্ত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠভাবে তওবা করে থাকেন তাহলে পূর্বের উপার্জিত সম্পদ তার জন্য ভোগ করা কিংবা তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী সূত্রে সন্তানের জন্য গ্রহণ করা জায়েয। কেননা তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। এই মর্মে দলিল হচ্ছে, আল্লাহ্ তাআলা সুদের নিষেধাজ্ঞা নাযিল করার পর সুদের ব্যাপারে বলেন; فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ “অতএব, যার নিকট তার প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর সে (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়, তাহলে আগে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহ্র কাছে। আর যারা ফিরে যাবে (অর্থাৎ পুনরায় সুদ খাবে) তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সুরা বাক্বারা, ২: ২৭৫)
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, “এই ফাতওয়াটি এমন কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে হারাম কর্মক্ষেত্রে কাজ করে এবং এর বিধান সম্পর্কে অবগত নয়, অথবা যাকে এমন কেউ (মুফতি) এটি জায়েজ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন; যা তিনি বিশ্বাস করেছিলেন”।মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ “অতএব, যার নিকট তার প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর সে (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়, তাহলে আগে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহ্র কাছে”। (সূরা বাকারা, ২/২৭৫; ফাতওয়া লাজনাতুদ দাইমাহ, খন্ড: ১৫ পৃষ্ঠা: ৪৬)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন; وأما الذي لا ريب فيه عندنا فهو: ما قبضه بتأويل أو جهل، فهنا له ما سلف، بلا ريب، كما دل عليه الكتاب والسنة والاعتبار “আর যে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন সন্দেহ নেই তা হলো,কোন দলিলকে অসমর্থিত ব্যাখ্যা (তা’বীল)-র ভিত্তিতে কিংবা অজ্ঞতার কারণে কেউ যা গ্রহণ করেছে; নিঃসন্দেহে তার ক্ষেত্রে ‘অতীতে যা নিয়েছে সেটা তার’ এটি প্রযোজ্য হবে; যেমনটি প্রমাণ করছে কিতাব, সুন্নাহ ও কিয়াস।” (তাফসির আয়াতিন উশকিলাত আলা কাছিরিন মিনাল উলামা; খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৫৯২)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন; إذا كان لا يعلم أن هذا حرام، فله كل ما أخذ وليس عليه شيء، أو أنه اغتر بفتوى عالم أنه ليس بحرام فلا يخرج شيئاً، وقد قال الله تعالى: (فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ. “যদি কেউ না জানে যে, এটা হারাম; তাহলে পূর্বে সে যা কিছু গ্রহণ করেছে সেটার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। কিংবা কেউ যদি কোন আলেমের ফতোয়া দ্বারা প্রতারিত হয় যে, এটি হারাম নয়; সেও কোন কিছু প্রত্যাহার করবে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “অতএব যার নিকট তার প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর সে যদি (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয় তাহলে অতীতে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই থাকবে এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহ্র কাছে ন্যস্ত থাকবে।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৭৫; উসাইমীন লিকা আশ-শাহরি: ১৯/৬৭)
তিনি আরো বলেছেন; “من فوائد الآية: أن ما أخذه الإنسان من الربا قبل العلم بالتحريم: فهو حلال له، بشرط أن يتوب وينتهي.” আয়াতটির শিক্ষার মধ্যে রয়েছে, সুদ যে হারাম তা জানার পূর্বে কোন ব্যক্তি যা গ্রহণ করেছে সেটা তার জন্য হালাল। তবে শর্ত হলো,”তাওবা করা এবং (সুদ) পরিহার করা”। (উসাইমীন; তাফসির সূরাতুল বাক্বারা,খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৭৭ এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৫৭২৫০)
(২). পিতা জীবিত অবস্থায় যে সম্পদ উপার্জন করেছে সেটা যদি মৌলিকভাবে সবটাই হারাম হয়, যেমন: অন্যের সম্পদ চুরি করা, ডাকাতি করা, ছিনতাই করা, ঘুষ গ্রহন করা ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জিত হয়, তাহলে দলিলের আলোকে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, এই সম্পত্তি পিতার মৃত্যুর পর তার সন্তানগন ওয়ারিশ সূত্রে গ্রহণ করতে পারবে না। এটি হানাফী, মালিকী, শাফাঈ এবং হাম্বলীসহ অধিকাংশ ওলামাদের মত। এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার (রাহিমাহুল্লাহ)-এরও পছন্দনীয় মত।
ইবনে রুশদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; وأما الميراث : فلا يُطَيِّب المال الحرام ، هذا هو الصحيح الذي يوجبه النظر . وقد روي عن بعض من تقدم أن الميراث يطيبه للوارث ، وليس ذلك بصحيح উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এটা হারাম সম্পদকে পবিত্র করতে পারে না। এটাই হলো সঠিক কথা এবং গবেষণা থেকে এটাই আবশ্যিক ভাবে প্রমানিত হয়। কতিপয় পূর্ববতী আলেম থেকে এটা বর্নিত হয়েছে যে,মিরাস তার মাল গুলো ওয়ারিসের জন্য পবিত্র করতে পারে,কিন্তু এই কথাটি সঠিক নয়। (মুকাদ্দামাতুল মুমহিদাত, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৬১৭ )।
ইয়াহয়া ইবনে ইব্রাহিম মালেকীকে হারাম মাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,মিরাস কি হারাম মালকে হালাল করতে পারবে নাকি পারবে না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: لا يحل المال الحرام في قول مالك “ইমাম মালেকের কথা অনুযায়ী এটা হারাম সম্পদকে হালাল করে না”।(আল মি’য়ারুল মু’রাব ৬/৪৭ )। তাছাড়া পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ وَ تُدۡلُوۡا بِهَاۤ اِلَی الۡحُکَّامِ لِتَاۡکُلُوۡا فَرِیۡقًا مِّنۡ اَمۡوَالِ النَّاسِ بِالۡاِثۡمِ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ করো না”। (সূরা বারাকাহ, ২/১৮৮)। তিনি আরো বলেছেন; یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡکُمۡ ۟হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। (সূরা নিসা; ৪/২৯)। উক্ত আয়াতের আলোকে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মৃত্যু হারাম সম্পদকে হালাল করে না; বরং যা করতে হবে তা হচ্ছে, যার সম্পদ অন্যায় ভাবে দখল করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি তার সম্পর্কে জানা যায় তাহলে এই সম্পদ তার মূল মালিকের কাছে ফেরত দিতে হবে; কিন্তু সে যদি পরিচিত না হয়, তবে উক্ত সম্পদ তার পক্ষ থেকে গরীব-মিসকিনদেরকে কিংবা জনকল্যাণমূলক কাজে দান করে দিতে হবে। (দেখুন হানাফি গ্রন্থ হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন; খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ১০৪, শাফেঈ মাযহাবের আলেম ইমাম নববী আল মাজমু; খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৪২৮ ইমাম গাজ্জালী ইহইয়া উলূমদ দ্বীন, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২১০, আল ইনসাফ, খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৩২৩, ইবনে তাইমিয়া আল ফাতওয়া আল কুবরা; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪৭৮)
(৩). পিতা যদি জীবিত থাকা অবস্থায় ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন এবং তিনি হালাল-হারাম মিশ্র উপার্জন করেন- হারামের মধ্যে যেমন, মদ-জুয়া, তামাক, বিড়ি সিগারেট ইত্যাদি হারাম বস্তু ক্রয়-বিক্রয় করে টাকা উপার্জন করে সম্পদ তৈরি করেন এবং সন্তানরা সেটা জানে তাহলে আহলুল ইমামগনের বিশুদ্ধ মতে, মূল সম্পদের মধ্যে যতটুকু হারাম রয়েছে সেটুকু কিংবা আনুমানিক ধারণা করে সম্পদের একটা অংশ আলাদা করে সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত দান-সাদকাহ করে দিবেন এবং বাকি সম্পদ ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করে নিবেন। এতে তারা নিজেরাও উপকৃত হবে এবং তার পিতার জন্যও কল্যানকর হবে বলে ইনশাআল্লাহ আশা করা যায়। কিন্তু ওয়ারিশগন যদি উপার্জনের হারাম অংশটি আলাদা না করে সম্পূর্ণ সম্পত্তি বন্টন করে নেন, তাহলেও একদল আলেমদের মতে সেটি জায়েজ। তবে প্রথম মতটি অধিক বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ।
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, منْ وَرِثَ مَالًا وَلَمْ يَعْلَمْ مِنْ أَيْنَ كَسَبَهُ مُوَرِّثُهُ , أَمِنْ حَلَالٍ أَمْ مِنْ حَرَامٍ ؟ وَلَمْ تَكُنْ عَلَامَةً , فَهُوَ حَلَالٌ بِإِجْمَاعِ الْعُلَمَاءِ , فَإِنْ عَلِمَ أَنَّ فِيهِ حَرَامًا وَشَكَّ فِي قَدْرِهِ أَخْرَجَ قَدْرَ الْحَرَامِ بِالِاجْتِهَادِ “যদি কোন ব্যক্তি অর্থের/সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় এবং তিনি না জানেন যে, মৃত ব্যক্তি উক্ত সম্পদ কোথা থেকে তা অর্জন করেছে, এটি হালাল না হারাম? যদি এই হারাম মালের কোনো নিদর্শন না পাওয়া যায়, তাহলে আলেমদের ঐক্যমত অনুসারে এটি বৈধ। আর যদি এটি জানা যায় যে, সেখানে কিছু হারাম আছে অথবা সে কিছু পরিমাণ মাল নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, তাহলে প্রবল ধারণার ভিত্তিতে হারাম মালের অংশটুকু সরিয়ে ফেলতে হবে”। (নববী আল মাজমু; খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৪২৮ )
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.]-কে একজন সুদখোর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো; যে তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকা অবস্থায় টাকা এবং একজন সন্তান রেখে গেছেন। সন্তানের জন্য কি ওই মালের উত্তরাধিকারী হওয়া জায়েজ নাকি জায়েজ না? তিনি জবাব দিলেন; الْقَدْرُ الَّذِي يَعْلَمُ الْوَلَدُ أَنَّهُ رِبًا : يُخْرِجُهُ , إمَّا أَنْ يَرُدَّهُ إلَى أَصْحَابِهِ إنْ أَمْكَنَ , وَإِلَّا تَصَدَّقَ بِهِ. وقد َبَيَّنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ الظُّلَامَةَ إذَا كَانَتْ فِي الْمَالِ طَالَبَ الْمَظْلُومُ بِهَا ظَالِمَهُ , وَلَمْ يَجْعَلْ الْمُطَالَبَةَ لِوَرَثَتِهِ , وَذَلِكَ أَنَّ الْوَرَثَةَ يَخْلُفُونَهُ فِي الدُّنْيَا , فَمَا أَمْكَنَ اسْتِيفَاؤُهُ فِي الدُّنْيَا كَانَ لِلْوَرَثَةِ , وَمَا لَمْ يُمْكِنْ اسْتِيفَاؤُهُ فِي الدُّنْيَا فَالطَّلَبُ بِهِ فِي الْآخِرَةِ لِلْمَظْلُومِ نَفْسِهِ সন্তান যদি জানে যে এই অংশটুকু সুদের অংশ তাহলে সেটা সে বের করে দিবে; যথাসম্ভব সে মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে দিবে। আর যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে দান করে দিবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্ট করে বলেছেন যে, মাজলুম ব্যক্তি জালেম ব্যক্তির কাছ থেকে তার মাল চাইতে পারে। কেননা সেই জালেম ব্যক্তি উক্ত মালের ওয়ারিস নয়; সেটা যতটুকু সম্ভব দুনিয়াতে তাকে দিয়ে দেওয়া উচিত আর দুনিয়াতে যদি সে না পায় বা তাকে না দেওয়া হয় তাহলে সে পরকালে অবশ্যই পেয়ে যাবে। (ফাতাওয়া আল-কুবরা, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪৭৮)
(৪). পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় হারাম উপার্জন করছে নাকি হালাল উপার্জন করছে নাকি হালাল-হারাম মিশ্র উপার্জন করেছে সন্তান সেটা নিশ্চিত করে জানেনা, এক্ষেত্রে পিতার মৃত্যুর পর উক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে ওয়ারিশগণ গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই, যদিও পিতার উপার্জন হারাম হয় তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ প্রথমত: সন্তানগণ নিশ্চিত করে সেটা জানে না। দ্বিতীয়ত: ফক্বীহগণ বলেছেন, হারাম পন্থায় উপার্জিত অর্থ শুধু উপার্জনকারীর জন্যই হারাম। সন্তান হিসাবে পিতা যদি তাকে উপহারস্বরূপ ঐ মাল থেকে কিছু দেয় কিংবা ওয়ারিশ সূত্রে গ্রহণ করে তবে তা গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। হারাম উপার্জনের জন্য উপার্জনকারী পিতা গুনাহগার হবেন। সন্তান বা ওয়ারিসরা নয়।এখানে ওয়ারিসদের ওজড় রয়েছে।(বিস্তারিত দেখুন; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৫০১৮; আহকামুল কুরআন, ১/৩২৪; আল-মাজমূঊ, ৯/৪৩০; ফাতাওয়া ফিক্বহিয়্যাহ আল-কুবরা, ২/২৩৩; কাশ্শাফুল ক্বিনা, ৩/৪৯৬ পৃ.)। দলিল হচ্ছে, মহান আল্লাহ বলেন, لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی “আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না”। (সূরা বনি ইসরাইল; ১৭/১৫)। কুরআনের অন্যত্রও আল্লাহ তা’আলা তা বলেছেন। যেমন, “যে সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সেই ভোগ করবে। আপনার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুমকারী নন।” (সূরা ফুসসিলাত: ৪৬; সূরা আল- জাসিয়াহ: ১৫)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন; قال بعض العلماء: ما كان محرما لكسبه ، فإنما إثمه على الكاسب لا على من أخذه بطريق مباح من الكاسب ، بخلاف ما كان محرما لعينه ، كالخمر والمغصوب ونحوهما ، وهذا القول وجيه قوي ، بدليل أن الرسول صلى الله عليه وسلم اشتري من يهودي طعاما لأهله ، وأكل من الشاة التي أهدتها له اليهودية بخيبر ، وأجاب دعوة اليهودي ، ومن المعلوم أن اليهود معظمهم يأخذون الربا ويأكلون السحت ، وربما يقوي هذا القول قوله صلى الله عليه وسلم في اللحم الذي تصدق به على بريرة : ( هو لها صدقة ولنا منها هدية ) কিছু আলেম বলেছেন; যা কিছু হারাম পন্থায় উপার্জন করা হয়েছে, তার গুনাহ সেই ব্যক্তির উপর বর্তাবে, যে তা উপার্জন করেছে, তার উপর নয় যে উপার্জনকারীর কাছ থেকে বৈধ উপায়ে গ্রহণ করেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে যার কাছে যে জিনিসটা হারাম সেটা সবার কাছেই হারাম যেমন মদ বা দখলকৃত জমি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস দ্বারা এই কথাটি আরো শক্তিশালী হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারের জন্য একজন ইহুদীর কাছ থেকে খাবার কিনেছিলেন, খায়বারে ইহুদি তাকে যে ভেড়া দিয়েছিলেন তা খেয়েছিলেন এবং তার দাওয়াতে গিয়েছিলেন। একথা সার্বজনীন বিদিত যে বেশিরভাগ ইহুদিরা সুদ গ্রহণ করে এবং বেআইনি কাজে লিপ্ত হয় (হারাম ভক্ষণ করে)। সম্ভবত এই কথাটি রাসূল (ﷺ)-এর ওই কথাটাকে শক্তিশালী করে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারীরাকে গোশত সাদকাহ করেছিলেন এবং বলেছিলেন এটা তার জন্য সাদকাহ আর আমাদের জন্য হাদিয়া। (উসাইমীন, আল ক্বওলুল মুফীদ আলা কিতাবুত তাওহীদ; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১১২ )
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন; وأما الخبيث لكسبه فمثل المأخوذ عن طريق الغش ، أو عن طريق الربا ، أو عن طريق الكذب ، وما أشبه ذلك ؛ وهذا محرم على مكتسبه ، وليس محرما على غيره إذا اكتسبه منه بطريق مباح ؛ ويدل لذلك أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يعامل اليهود مع أنهم كانوا يأكلون السحت ، ويأخذون الربا ، فدل ذلك على أنه لا يحرم على غير الكاسب অবৈধভাবে মাল উপার্জন করাটা প্রতারণা পন্থায় অথবা সুদের পদ্ধতিতে উপার্জন করা অথবা মিথ্যার পদ্ধতিতে ইত্যাদি অন্যান্য খারাপ পদ্ধতিতে মাল উপার্জন করার মতই নাপাক। এমন পদ্ধতিতে যে উপার্জন করবে তার জন্যই হারাম কিন্তু অন্যদের জন্য এটা হারাম নয়, যে বৈধ পদ্ধতিতে এটা তার কাছ থেকে গ্রহণ করবে। আর এটাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই হাদিস প্রমাণ করে যে, রাসূল (ﷺ) ইহুদীর বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন অথচ সে হারামে জর্জরিত এবং সুদ ভক্ষণ করত। এটাই প্রমাণ করছে, যে উপার্জন করবে তার পাপ হবে- অন্য কারো পাপ হবে না। (উসাইমীন; তাফসীরে সূরা বাকারা, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৯৮)
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয়েছে; যদি একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ পেয়ে থাকেন এবং তিনি জানেন যে এই অর্থের একটি অংশ খাঁটি হারাম সুদ এবং বাকি অংশ সম্পর্কে তিনি জানেন না অথবা হালাল-হারাম মিশ্রিত হয়, তাহলে তার হারাম স্পষ্ট সুদ নিয়ে কী করা উচিত (হারাম অর্থগুলোর জন্য তার করণীয় কি)? তিনি উত্তরে বলেন; لا بأس به هو حل له ؛ لأنه ملكه بطريق مباح وهو إرث , إلا إذا علمت أن هذا مال فلان , وأن الميت غصبه فحينئذٍ لا يحل لك , وأما إذا كان محرَّماً لكسبه كالربا وما أشبه ذلك : فهذا لا بأس به
“এতে দোষের কিছু নেই, এটা তার জন্য হালাল, কারণ সে এটা জায়েয উপায়ে মালিকানা পেয়েছে, যা উত্তরাধিকার। কিন্তু যদি আপনি জানেন যে এটা অমুকের টাকা এবং মৃত ব্যক্তি তা আত্মসাৎ করেছে, সেক্ষেত্রে এটা আপনার জন্য জায়েয নয়। (কিন্তু এমনটা যদি আপনি না জেনে থাকেন তাহলে কোন সমস্যা নাই)। আর যদি তা উপার্জন করা হারাম হয়, যেমন সুদ গ্রহণ বা এ জাতীয় কিছু, তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই”। (উসাইমীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং- প্রশ্ন নং ১২/২১৩ )
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে আশা করি আপনারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। আমাদের পাঠকদের সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে আপনারা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সামান্য কয়েকদিন ভোগ-বিলাসী জীবনযাপন করতে গিয়ে পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি থেকে যেন বঞ্চিত হবেন না।
তাই আসুন আমরা হারাম থেকে বেঁচে থাকি এবং পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক আমাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করি।মহান আল্লাহ আমাদেরকে হালাল জীবিকার উপর সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
যাইহোক মূল কথায় আসি, পিতার হারাম সম্পত্তি তার মৃত্যুর পর ওয়ারিশরা উত্তরাধিকারী সূত্রে গ্রহণ করতে পারবে কিনা এটি একটি ব্যাখ্যামূলক বিষয়, যা দুই এক কথায় পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। কারণ হারাম সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়টা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তাই বিষয়টি নিয়ে সালাফগণ মতভেদ করেছেন। মাসয়ালা টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে যতটুকু সম্ভব ইনসাফের সাথে কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফদের বক্তব্যগুলোর আলোকে সহজে বের করার চেষ্টা করছি আলহামদুলিল্লাহ।
পিতার উপার্জিত হারাম সম্পত্তি ওয়ারিশ সূত্র গ্রহণ করার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে।তাই অবস্থা অনুযায়ী ফাতওয়া ভিন্ন হবে। যেমন:
(১). মৃত ব্যক্তি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় অজ্ঞতার কারণে হারাম উপার্জন করেন অর্থাৎ যদি তিনি হাকীকি বা প্রকৃতপক্ষে এই উপার্জন হারাম হওয়া সম্পর্কে না জেনে সম্পদ উপার্জন করে থাকেন ও পরবর্তীতে সঠিক বিধান জানার সঙ্গে সঙ্গে হারাম ত্যাগ করেন এবং উক্ত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠভাবে তওবা করে থাকেন তাহলে পূর্বের উপার্জিত সম্পদ তার জন্য ভোগ করা কিংবা তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী সূত্রে সন্তানের জন্য গ্রহণ করা জায়েয। কেননা তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। এই মর্মে দলিল হচ্ছে, আল্লাহ্ তাআলা সুদের নিষেধাজ্ঞা নাযিল করার পর সুদের ব্যাপারে বলেন; فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ “অতএব, যার নিকট তার প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর সে (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়, তাহলে আগে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহ্র কাছে। আর যারা ফিরে যাবে (অর্থাৎ পুনরায় সুদ খাবে) তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সুরা বাক্বারা, ২: ২৭৫)
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ বলেছেন, “এই ফাতওয়াটি এমন কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে হারাম কর্মক্ষেত্রে কাজ করে এবং এর বিধান সম্পর্কে অবগত নয়, অথবা যাকে এমন কেউ (মুফতি) এটি জায়েজ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন; যা তিনি বিশ্বাস করেছিলেন”।মহান আল্লাহ বলেন, فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ “অতএব, যার নিকট তার প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর সে (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়, তাহলে আগে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহ্র কাছে”। (সূরা বাকারা, ২/২৭৫; ফাতওয়া লাজনাতুদ দাইমাহ, খন্ড: ১৫ পৃষ্ঠা: ৪৬)
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন; وأما الذي لا ريب فيه عندنا فهو: ما قبضه بتأويل أو جهل، فهنا له ما سلف، بلا ريب، كما دل عليه الكتاب والسنة والاعتبار “আর যে ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন সন্দেহ নেই তা হলো,কোন দলিলকে অসমর্থিত ব্যাখ্যা (তা’বীল)-র ভিত্তিতে কিংবা অজ্ঞতার কারণে কেউ যা গ্রহণ করেছে; নিঃসন্দেহে তার ক্ষেত্রে ‘অতীতে যা নিয়েছে সেটা তার’ এটি প্রযোজ্য হবে; যেমনটি প্রমাণ করছে কিতাব, সুন্নাহ ও কিয়াস।” (তাফসির আয়াতিন উশকিলাত আলা কাছিরিন মিনাল উলামা; খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৫৯২)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন; إذا كان لا يعلم أن هذا حرام، فله كل ما أخذ وليس عليه شيء، أو أنه اغتر بفتوى عالم أنه ليس بحرام فلا يخرج شيئاً، وقد قال الله تعالى: (فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ. “যদি কেউ না জানে যে, এটা হারাম; তাহলে পূর্বে সে যা কিছু গ্রহণ করেছে সেটার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। কিংবা কেউ যদি কোন আলেমের ফতোয়া দ্বারা প্রতারিত হয় যে, এটি হারাম নয়; সেও কোন কিছু প্রত্যাহার করবে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “অতএব যার নিকট তার প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর সে যদি (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয় তাহলে অতীতে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই থাকবে এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহ্র কাছে ন্যস্ত থাকবে।” (সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৭৫; উসাইমীন লিকা আশ-শাহরি: ১৯/৬৭)
তিনি আরো বলেছেন; “من فوائد الآية: أن ما أخذه الإنسان من الربا قبل العلم بالتحريم: فهو حلال له، بشرط أن يتوب وينتهي.” আয়াতটির শিক্ষার মধ্যে রয়েছে, সুদ যে হারাম তা জানার পূর্বে কোন ব্যক্তি যা গ্রহণ করেছে সেটা তার জন্য হালাল। তবে শর্ত হলো,”তাওবা করা এবং (সুদ) পরিহার করা”। (উসাইমীন; তাফসির সূরাতুল বাক্বারা,খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৩৭৭ এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৫৭২৫০)
(২). পিতা জীবিত অবস্থায় যে সম্পদ উপার্জন করেছে সেটা যদি মৌলিকভাবে সবটাই হারাম হয়, যেমন: অন্যের সম্পদ চুরি করা, ডাকাতি করা, ছিনতাই করা, ঘুষ গ্রহন করা ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জিত হয়, তাহলে দলিলের আলোকে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, এই সম্পত্তি পিতার মৃত্যুর পর তার সন্তানগন ওয়ারিশ সূত্রে গ্রহণ করতে পারবে না। এটি হানাফী, মালিকী, শাফাঈ এবং হাম্বলীসহ অধিকাংশ ওলামাদের মত। এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার (রাহিমাহুল্লাহ)-এরও পছন্দনীয় মত।
ইবনে রুশদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন; وأما الميراث : فلا يُطَيِّب المال الحرام ، هذا هو الصحيح الذي يوجبه النظر . وقد روي عن بعض من تقدم أن الميراث يطيبه للوارث ، وليس ذلك بصحيح উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এটা হারাম সম্পদকে পবিত্র করতে পারে না। এটাই হলো সঠিক কথা এবং গবেষণা থেকে এটাই আবশ্যিক ভাবে প্রমানিত হয়। কতিপয় পূর্ববতী আলেম থেকে এটা বর্নিত হয়েছে যে,মিরাস তার মাল গুলো ওয়ারিসের জন্য পবিত্র করতে পারে,কিন্তু এই কথাটি সঠিক নয়। (মুকাদ্দামাতুল মুমহিদাত, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৬১৭ )।
ইয়াহয়া ইবনে ইব্রাহিম মালেকীকে হারাম মাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে,মিরাস কি হারাম মালকে হালাল করতে পারবে নাকি পারবে না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: لا يحل المال الحرام في قول مالك “ইমাম মালেকের কথা অনুযায়ী এটা হারাম সম্পদকে হালাল করে না”।(আল মি’য়ারুল মু’রাব ৬/৪৭ )। তাছাড়া পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, وَ لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ وَ تُدۡلُوۡا بِهَاۤ اِلَی الۡحُکَّامِ لِتَاۡکُلُوۡا فَرِیۡقًا مِّنۡ اَمۡوَالِ النَّاسِ بِالۡاِثۡمِ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ করো না”। (সূরা বারাকাহ, ২/১৮৮)। তিনি আরো বলেছেন; یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡکُمۡ ۟হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। (সূরা নিসা; ৪/২৯)। উক্ত আয়াতের আলোকে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মৃত্যু হারাম সম্পদকে হালাল করে না; বরং যা করতে হবে তা হচ্ছে, যার সম্পদ অন্যায় ভাবে দখল করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি তার সম্পর্কে জানা যায় তাহলে এই সম্পদ তার মূল মালিকের কাছে ফেরত দিতে হবে; কিন্তু সে যদি পরিচিত না হয়, তবে উক্ত সম্পদ তার পক্ষ থেকে গরীব-মিসকিনদেরকে কিংবা জনকল্যাণমূলক কাজে দান করে দিতে হবে। (দেখুন হানাফি গ্রন্থ হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন; খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা: ১০৪, শাফেঈ মাযহাবের আলেম ইমাম নববী আল মাজমু; খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৪২৮ ইমাম গাজ্জালী ইহইয়া উলূমদ দ্বীন, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২১০, আল ইনসাফ, খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা: ৩২৩, ইবনে তাইমিয়া আল ফাতওয়া আল কুবরা; খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪৭৮)
(৩). পিতা যদি জীবিত থাকা অবস্থায় ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন এবং তিনি হালাল-হারাম মিশ্র উপার্জন করেন- হারামের মধ্যে যেমন, মদ-জুয়া, তামাক, বিড়ি সিগারেট ইত্যাদি হারাম বস্তু ক্রয়-বিক্রয় করে টাকা উপার্জন করে সম্পদ তৈরি করেন এবং সন্তানরা সেটা জানে তাহলে আহলুল ইমামগনের বিশুদ্ধ মতে, মূল সম্পদের মধ্যে যতটুকু হারাম রয়েছে সেটুকু কিংবা আনুমানিক ধারণা করে সম্পদের একটা অংশ আলাদা করে সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত দান-সাদকাহ করে দিবেন এবং বাকি সম্পদ ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করে নিবেন। এতে তারা নিজেরাও উপকৃত হবে এবং তার পিতার জন্যও কল্যানকর হবে বলে ইনশাআল্লাহ আশা করা যায়। কিন্তু ওয়ারিশগন যদি উপার্জনের হারাম অংশটি আলাদা না করে সম্পূর্ণ সম্পত্তি বন্টন করে নেন, তাহলেও একদল আলেমদের মতে সেটি জায়েজ। তবে প্রথম মতটি অধিক বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ।
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, منْ وَرِثَ مَالًا وَلَمْ يَعْلَمْ مِنْ أَيْنَ كَسَبَهُ مُوَرِّثُهُ , أَمِنْ حَلَالٍ أَمْ مِنْ حَرَامٍ ؟ وَلَمْ تَكُنْ عَلَامَةً , فَهُوَ حَلَالٌ بِإِجْمَاعِ الْعُلَمَاءِ , فَإِنْ عَلِمَ أَنَّ فِيهِ حَرَامًا وَشَكَّ فِي قَدْرِهِ أَخْرَجَ قَدْرَ الْحَرَامِ بِالِاجْتِهَادِ “যদি কোন ব্যক্তি অর্থের/সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় এবং তিনি না জানেন যে, মৃত ব্যক্তি উক্ত সম্পদ কোথা থেকে তা অর্জন করেছে, এটি হালাল না হারাম? যদি এই হারাম মালের কোনো নিদর্শন না পাওয়া যায়, তাহলে আলেমদের ঐক্যমত অনুসারে এটি বৈধ। আর যদি এটি জানা যায় যে, সেখানে কিছু হারাম আছে অথবা সে কিছু পরিমাণ মাল নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে, তাহলে প্রবল ধারণার ভিত্তিতে হারাম মালের অংশটুকু সরিয়ে ফেলতে হবে”। (নববী আল মাজমু; খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৪২৮ )
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.]-কে একজন সুদখোর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো; যে তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকা অবস্থায় টাকা এবং একজন সন্তান রেখে গেছেন। সন্তানের জন্য কি ওই মালের উত্তরাধিকারী হওয়া জায়েজ নাকি জায়েজ না? তিনি জবাব দিলেন; الْقَدْرُ الَّذِي يَعْلَمُ الْوَلَدُ أَنَّهُ رِبًا : يُخْرِجُهُ , إمَّا أَنْ يَرُدَّهُ إلَى أَصْحَابِهِ إنْ أَمْكَنَ , وَإِلَّا تَصَدَّقَ بِهِ. وقد َبَيَّنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنَّ الظُّلَامَةَ إذَا كَانَتْ فِي الْمَالِ طَالَبَ الْمَظْلُومُ بِهَا ظَالِمَهُ , وَلَمْ يَجْعَلْ الْمُطَالَبَةَ لِوَرَثَتِهِ , وَذَلِكَ أَنَّ الْوَرَثَةَ يَخْلُفُونَهُ فِي الدُّنْيَا , فَمَا أَمْكَنَ اسْتِيفَاؤُهُ فِي الدُّنْيَا كَانَ لِلْوَرَثَةِ , وَمَا لَمْ يُمْكِنْ اسْتِيفَاؤُهُ فِي الدُّنْيَا فَالطَّلَبُ بِهِ فِي الْآخِرَةِ لِلْمَظْلُومِ نَفْسِهِ সন্তান যদি জানে যে এই অংশটুকু সুদের অংশ তাহলে সেটা সে বের করে দিবে; যথাসম্ভব সে মালিকের কাছে ফেরত দিয়ে দিবে। আর যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে দান করে দিবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্ট করে বলেছেন যে, মাজলুম ব্যক্তি জালেম ব্যক্তির কাছ থেকে তার মাল চাইতে পারে। কেননা সেই জালেম ব্যক্তি উক্ত মালের ওয়ারিস নয়; সেটা যতটুকু সম্ভব দুনিয়াতে তাকে দিয়ে দেওয়া উচিত আর দুনিয়াতে যদি সে না পায় বা তাকে না দেওয়া হয় তাহলে সে পরকালে অবশ্যই পেয়ে যাবে। (ফাতাওয়া আল-কুবরা, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৪৭৮)
(৪). পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় হারাম উপার্জন করছে নাকি হালাল উপার্জন করছে নাকি হালাল-হারাম মিশ্র উপার্জন করেছে সন্তান সেটা নিশ্চিত করে জানেনা, এক্ষেত্রে পিতার মৃত্যুর পর উক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে ওয়ারিশগণ গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই, যদিও পিতার উপার্জন হারাম হয় তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ প্রথমত: সন্তানগণ নিশ্চিত করে সেটা জানে না। দ্বিতীয়ত: ফক্বীহগণ বলেছেন, হারাম পন্থায় উপার্জিত অর্থ শুধু উপার্জনকারীর জন্যই হারাম। সন্তান হিসাবে পিতা যদি তাকে উপহারস্বরূপ ঐ মাল থেকে কিছু দেয় কিংবা ওয়ারিশ সূত্রে গ্রহণ করে তবে তা গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। হারাম উপার্জনের জন্য উপার্জনকারী পিতা গুনাহগার হবেন। সন্তান বা ওয়ারিসরা নয়।এখানে ওয়ারিসদের ওজড় রয়েছে।(বিস্তারিত দেখুন; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৫০১৮; আহকামুল কুরআন, ১/৩২৪; আল-মাজমূঊ, ৯/৪৩০; ফাতাওয়া ফিক্বহিয়্যাহ আল-কুবরা, ২/২৩৩; কাশ্শাফুল ক্বিনা, ৩/৪৯৬ পৃ.)। দলিল হচ্ছে, মহান আল্লাহ বলেন, لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی “আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না”। (সূরা বনি ইসরাইল; ১৭/১৫)। কুরআনের অন্যত্রও আল্লাহ তা’আলা তা বলেছেন। যেমন, “যে সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সেই ভোগ করবে। আপনার রব তাঁর বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুমকারী নন।” (সূরা ফুসসিলাত: ৪৬; সূরা আল- জাসিয়াহ: ১৫)
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন; قال بعض العلماء: ما كان محرما لكسبه ، فإنما إثمه على الكاسب لا على من أخذه بطريق مباح من الكاسب ، بخلاف ما كان محرما لعينه ، كالخمر والمغصوب ونحوهما ، وهذا القول وجيه قوي ، بدليل أن الرسول صلى الله عليه وسلم اشتري من يهودي طعاما لأهله ، وأكل من الشاة التي أهدتها له اليهودية بخيبر ، وأجاب دعوة اليهودي ، ومن المعلوم أن اليهود معظمهم يأخذون الربا ويأكلون السحت ، وربما يقوي هذا القول قوله صلى الله عليه وسلم في اللحم الذي تصدق به على بريرة : ( هو لها صدقة ولنا منها هدية ) কিছু আলেম বলেছেন; যা কিছু হারাম পন্থায় উপার্জন করা হয়েছে, তার গুনাহ সেই ব্যক্তির উপর বর্তাবে, যে তা উপার্জন করেছে, তার উপর নয় যে উপার্জনকারীর কাছ থেকে বৈধ উপায়ে গ্রহণ করেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে যার কাছে যে জিনিসটা হারাম সেটা সবার কাছেই হারাম যেমন মদ বা দখলকৃত জমি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস দ্বারা এই কথাটি আরো শক্তিশালী হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারের জন্য একজন ইহুদীর কাছ থেকে খাবার কিনেছিলেন, খায়বারে ইহুদি তাকে যে ভেড়া দিয়েছিলেন তা খেয়েছিলেন এবং তার দাওয়াতে গিয়েছিলেন। একথা সার্বজনীন বিদিত যে বেশিরভাগ ইহুদিরা সুদ গ্রহণ করে এবং বেআইনি কাজে লিপ্ত হয় (হারাম ভক্ষণ করে)। সম্ভবত এই কথাটি রাসূল (ﷺ)-এর ওই কথাটাকে শক্তিশালী করে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারীরাকে গোশত সাদকাহ করেছিলেন এবং বলেছিলেন এটা তার জন্য সাদকাহ আর আমাদের জন্য হাদিয়া। (উসাইমীন, আল ক্বওলুল মুফীদ আলা কিতাবুত তাওহীদ; খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১১২ )
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন; وأما الخبيث لكسبه فمثل المأخوذ عن طريق الغش ، أو عن طريق الربا ، أو عن طريق الكذب ، وما أشبه ذلك ؛ وهذا محرم على مكتسبه ، وليس محرما على غيره إذا اكتسبه منه بطريق مباح ؛ ويدل لذلك أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يعامل اليهود مع أنهم كانوا يأكلون السحت ، ويأخذون الربا ، فدل ذلك على أنه لا يحرم على غير الكاسب অবৈধভাবে মাল উপার্জন করাটা প্রতারণা পন্থায় অথবা সুদের পদ্ধতিতে উপার্জন করা অথবা মিথ্যার পদ্ধতিতে ইত্যাদি অন্যান্য খারাপ পদ্ধতিতে মাল উপার্জন করার মতই নাপাক। এমন পদ্ধতিতে যে উপার্জন করবে তার জন্যই হারাম কিন্তু অন্যদের জন্য এটা হারাম নয়, যে বৈধ পদ্ধতিতে এটা তার কাছ থেকে গ্রহণ করবে। আর এটাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই হাদিস প্রমাণ করে যে, রাসূল (ﷺ) ইহুদীর বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন অথচ সে হারামে জর্জরিত এবং সুদ ভক্ষণ করত। এটাই প্রমাণ করছে, যে উপার্জন করবে তার পাপ হবে- অন্য কারো পাপ হবে না। (উসাইমীন; তাফসীরে সূরা বাকারা, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১৯৮)
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয়েছে; যদি একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ পেয়ে থাকেন এবং তিনি জানেন যে এই অর্থের একটি অংশ খাঁটি হারাম সুদ এবং বাকি অংশ সম্পর্কে তিনি জানেন না অথবা হালাল-হারাম মিশ্রিত হয়, তাহলে তার হারাম স্পষ্ট সুদ নিয়ে কী করা উচিত (হারাম অর্থগুলোর জন্য তার করণীয় কি)? তিনি উত্তরে বলেন; لا بأس به هو حل له ؛ لأنه ملكه بطريق مباح وهو إرث , إلا إذا علمت أن هذا مال فلان , وأن الميت غصبه فحينئذٍ لا يحل لك , وأما إذا كان محرَّماً لكسبه كالربا وما أشبه ذلك : فهذا لا بأس به
“এতে দোষের কিছু নেই, এটা তার জন্য হালাল, কারণ সে এটা জায়েয উপায়ে মালিকানা পেয়েছে, যা উত্তরাধিকার। কিন্তু যদি আপনি জানেন যে এটা অমুকের টাকা এবং মৃত ব্যক্তি তা আত্মসাৎ করেছে, সেক্ষেত্রে এটা আপনার জন্য জায়েয নয়। (কিন্তু এমনটা যদি আপনি না জেনে থাকেন তাহলে কোন সমস্যা নাই)। আর যদি তা উপার্জন করা হারাম হয়, যেমন সুদ গ্রহণ বা এ জাতীয় কিছু, তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই”। (উসাইমীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং- প্রশ্ন নং ১২/২১৩ )
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে আশা করি আপনারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। আমাদের পাঠকদের সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে আপনারা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সামান্য কয়েকদিন ভোগ-বিলাসী জীবনযাপন করতে গিয়ে পরকালের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি থেকে যেন বঞ্চিত হবেন না।
তাই আসুন আমরা হারাম থেকে বেঁচে থাকি এবং পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক আমাদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করি।মহান আল্লাহ আমাদেরকে হালাল জীবিকার উপর সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
জুয়েল মাহমুদ সালাফি
সম্পাদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী।
দাঈ জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার সৌদি আরব।
সম্পাদনায়: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী।
দাঈ জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার সৌদি আরব।
Last edited by a moderator: