রেশমী রুমাল আন্দোলন
কিছুক্ষণের জন্য যদি মেনে নেওয়া হয় যে, শামেলীর প্রকৃত ঘটনা তাই যা বর্তমান কালের দেওবন্দী লেখকরা প্রমাণের চেষ্টা করছেন, তাহলেও এ প্রশ্ন থেকে যায় যে, শামেলীর সীমিত পরিসরের ঘটনার পর দেওবন্দের মুরববীরা এই জিহাদ আন্দোলনকে কিভাবে জীবিত রেখেছিলেন? এ পথের কোন কোন কষ্টই বা দেওবন্দবাসীদের সইতে হয়েছে? কোন সে কর্মকান্ড যা থেকে জানা যাবে যে, বাস্তবিকই দেওবন্দের উল্লেখিত বুযর্গগণ জিহাদের এ পতাকাকে ঠিক সেভাবেই ধরে রেখেছিলেন, যেভাবে তারা ১৮৫৭ সালের জিহাদে তা উঁচিয়ে ধরেছিলেন? বাস্তবতা তো এই যে, সব রকম মনগড়া ইতিহাস রচনা করা সত্ত্বেও দেওবন্দী লেখকরা তার বিবরণ দিতে সক্ষম হননি।[1]
‘যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮৮)।
অবশ্য অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় (১৮৫৭-১৯১৪) পেরিয়ে যাওয়ার পর ‘রেশমী রুমাল’ নামে একটি আন্দোলনের খোঁজ পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালের পর যা শায়খুল হিন্দ শুরু করেছিলেন। এর ভিত্তিতে এ কথা বলা হয় যে, মাওলানা মাহমূদ হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও অন্য ৮ জন গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং প্রায় চার বছর মাল্টায় বন্দী থাকেন। এর বিবরণ মাওলানা মাদানী মরহূম ‘আসীরে মাল্টা’ বা ‘মাল্টার বন্দী’ নামক বইয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বলা হয় যে, হিন্দুস্থানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তুরষ্কের ওছমানী খিলাফত ও অন্যদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করা ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে মাওলানা মাহমূদ হাসান মরহূম রেশমী রুমালে কিছু যরূরী নির্দেশনা দিয়ে কতিপয় ব্যক্তিকে তুরষ্ক, হেজায প্রভৃতি স্থানে প্রেরণ করেন। কিন্তু গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ায় গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায় এবং সে রেশমী রুমাল গভর্ণমেন্টের হাতে চলে যায়। ফলে মাওলানা মাহমূদ হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও অন্যদের গ্রেফতার করা হয়।
সত্য এই যে, এ আন্দোলনের আসল রহস্য এখন পর্যন্ত উন্মোচিত হয়নি। ফলে তার প্রকৃত রূপরেখা এখন জানা প্রায় অসম্ভব। তবে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত তার মূল ডকুমেন্টস্-এর উর্দূ অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং এতদসংক্রান্ত সকল তথ্য-উপাত্ত ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ নামক বইয়ে সংকলন করা হয়েছে। বইটি লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা ঐ বইয়ের আলোকে আমাদের অধ্যয়নের ফলাফল নীচে তুলে ধরছি।-
১. এ আন্দোলনও ছিল কয়েকজন ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনার ফসল মাত্র। যার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে বলা হয়েছে। আর শায়খুল হিন্দকে তাদের দ্বারা প্রভাবিত ও তাদের একজন কর্মী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[2] কিন্তু দেওবন্দী লেখকগণ শায়খুল হিন্দকেই এর প্রতিষ্ঠাতা বলে সাব্যস্ত করেন। প্রতিষ্ঠাতা যেই হৌন না কেন, তাতে সকল দেওবন্দী আলেমের সমর্থন ছিল না। এজন্যই ইংরেজ ডকুমেন্টস্-এ শায়খুল হিন্দ, মাওলানা মাদানী, মাওলানা আযীয গুল ও মাওলানা সিন্ধী ছাড়া দেওবন্দী মুরববীদের অন্য কারো নাম পাওয়া যায় না।
২. এ আন্দোলনের পূর্বে দেওবন্দ মাদ্রাসায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনের প্রমাণ পাওয়া যায় না। ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ বইয়ের নিম্নের বর্ণনায় এ কথার সমর্থন মেলে।-
‘দারুল উলূম দেওবন্দ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানূতুভী ও মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহীর দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার পিছনে যে আসল উদ্দেশ্য ও মূল লক্ষ্য ছিল তা বাস্তবায়নে দেওবন্দের তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যে কেবল শায়খুল হিন্দই তৎপর হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের প্রদর্শিত ও রেখে যাওয়া রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করায় চাহিদা মতো দ্রুত ফল লাভের আশা করা সম্ভব নয়’।[3]
এ কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে যে, দেওবন্দ ঘরানার মধ্যে শায়খুল হিন্দই এক্ষেত্রে প্রথম কর্মতৎপর হয়েছিলেন। এজন্যই কাঙ্খিত ফল লাভের আশা ছিল না।
এছাড়া উক্ত গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে, ‘এই আন্দোলন চলাকালে মাদ্রাসার মুহতামিম (অধ্যক্ষ) ছাহেব রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি তিনি ইউপির গভর্ণরকে দাওয়াত করে দারুল উলূম দেওবন্দে এনে তাকে মানপত্র প্রদান করেন। এই যোগাযোগের ফলশ্রুতিতে হাফেয ছাহেবকে (হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদ, মুহতামিম, দারুল উলূম দেওবন্দ) ‘শামসুল ওলামা’ উপাধি প্রদান করা হয়’।[4]
যেন আন্দোলন চলাকালীন সময়েও দেওবন্দের অন্যান্য মুরববীগণ এ আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীতে ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের নীতিতে অটল ছিলেন। মাওলানা মাহমূদ হাসানের নিকট আন্দোলনের এক সদস্যের লেখা পত্রে এ বিষয়ে অভিযোগও লক্ষণীয়। যেখানে তিনি লিখেছেন,
‘মাদ্রাসার কর্তা ব্যক্তিগণ সরকারের খেদমতে ব্যস্ত। প্রদর্শনীর দরবারে চেহারা প্রদর্শনের গৌরবও জুটছে’।[5]
ডকুমেন্টস্-এ নিম্নোক্ত ভাষায় দেওবন্দ মাদ্রাসা ও তার তৎকালীন মুহতামিম সম্পর্কে বলা হয়েছে,
‘মাদ্রাসা’ দ্বারা এখানে দেওবন্দের আরবী মাদ্রাসার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেটি সাহারানপুর যেলার দেওবন্দে অবস্থিত। ... মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হলেন শামসুল ওলামা মেŠলভী হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদ, যিনি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা (মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানূতুভী)-এর পুত্র। তিনি একজন অনুগত ও ভদ্রলোক’।[6]
৩. মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী মরহূম ‘নক্বশে হায়াত’ (জীবনচিত্র) বইয়ে উল্লেখিত বাস্তবতার এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, যৌক্তিক ও কৌশলগত কারণে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ইংরেজ সরকারের সাথে এহেন ভক্তিপূর্ণ ও আনুগত্যশীল আচরণ করতেন, যাতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার কোন ক্ষতি সাধন করা না হয়। কিন্তু এ ব্যাখ্যা প্রথমত বাস্তবের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। বাস্তব তো এই যে, দেওবন্দের মুরববীদের বেশীর ভাগই শিক্ষাদানের সাথে জড়িত ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তৎপর জামা‘আত ও গোষ্ঠীগুলির সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তার প্রমাণ ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ বইয়ের নিম্নের ডকুমেন্টস্ থেকেও পাওয়া যায় :
‘মাদ্রাসা দারুল উলূম দেওবন্দে বিদ্রোহের সূচনা হয় ওবায়দুল্লাহ থেকে। ইনি ছিলেন শিখ সম্প্রদায় থেকে আগত নওমুসলিম। তিনি ১৮৮১-১৮৮৯ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন। ইংরেজ বিরোধী জোশ সৃষ্টির মানসে ১৯০৯ সালে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে আসেন। ১৯১৩ সালে ‘বিদেশী পণ্য বর্জন’ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার কারণে তাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়কালের মধ্যেই তিনি প্রধান শিক্ষক মাহমূদ হাসানকে তার সমমতাদর্শী বানিয়ে ফেলেন’।[7]
মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীও স্বীকার করেছেন যে, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়ার মূল কারণ ইউপির গভর্ণর মেস্টিনের দারুল উলূম দেওবন্দে আগমন এবং মুহতামিম ছাহেবের ‘শামসুল ওলামা’ উপাধি লাভ’।[8]
যেন ইংরেজ সরকারের প্রতি মাদ্রাসার আনুগত্য প্রমাণের জন্য মাওলানা সিন্ধী মরহূমকে দারুল উলূম দেওবন্দের অধ্যাপনার পদ থেকে অপসারণ করা হয়। কেননা তিনিই সেখানে এসে সবার আগে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। অনন্তর ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’-এ আছে যে, এ ধরনের আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে মাদ্রাসার পরিচালক সুযোগ বুঝে মৌলভী ওবায়দুল্লাহকে তলব করেন এবং কঠোর ভাষায় তাকে তিরষ্কার করেন।[9]
রাজনীতি থেকে দেওবন্দ মাদ্রাসার সম্পর্কহীনতার আরো বিবরণ লক্ষ্য করুন :
‘মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেমের পুত্র শামসুল ওলামা হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদের সতর্ক তত্ত্বাবধানে দেওবন্দ মাদ্রাসা বিগত বহু বছর ধরে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রগণ আধুনিক রাজনীতি ও বাইরের বিষয়াদি নিয়ে খুব অল্পই মাথা ঘামাতেন অথবা মোটেও মাথা ঘামাতেন না। ওবায়দুল্লাহর আগমনের পর এবং তার প্রভাবে মাদ্রাসার রং পাল্টে যেতে শুরু করে’।[10]
এসব উদ্ধৃতি থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীই প্রথম ব্যক্তি যিনি দারুল উলূম দেওবন্দে ইংরেজ সরকারের বিরোধিতার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেন। নতুবা তার আগে দারুল উলূম রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। সেকারণ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিতে হয়। যাতে ইংরেজ সরকারের প্রতি মাদ্রাসার আনুগত্য ব্যাহত না হয়।
৪. এ আন্দোলন নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না; বরং তাদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ সরকারের স্থলে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণেই তাতে শিখ ও বিপ্লবী হিন্দুরাও শামিল ছিল।[11]
এর অর্থ দাঁড়াল যে, এটি একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আন্দোলন, যা জিহাদ আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা জিহাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল নির্ভেজাল ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্য এ আন্দোলনের উদ্যোক্তারা জিহাদ আন্দোলনে সক্রিয় মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতাও লাভ করেছিলেন। সেটি একটি স্বতন্ত্র বিষয়। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বলে মুজাহিদরা তাদের সহযোগিতা করেছিলেন। সত্য বলতে কি রেশমী রুমাল আন্দোলনের যতটুকু চর্চা হয়েছিল তার মূল প্রেরণা ছিল প্রায় পৌনে এক শতাব্দী যাবৎ দেশব্যাপী চলমান ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওহাবীদের জিহাদ আন্দোলন। ইংরেজ বিরোধিতার এই পরিবেশ ও জায্বা রেশমী রুমাল আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিল এবং এর প্রতিষ্ঠাতারাও তা থেকে পুরো ফায়েদা হাছিল করেছিলেন। নতুবা শুধু দেওবন্দী ঘরানা ও দেওবন্দ মাদ্রাসার সাথে জড়িতরা যে এ আন্দোলনে বেশী কিছু তৎপরতা দেখাবে তেমন কোন আশা ছিল না। প্রসঙ্গত ইংরেজ ডকুমেন্টস্-এ মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও তার কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি তার ষড়যন্ত্রে ওহাবী আন্দোলনের কার্যকর মেশিনারী মৌলভী শ্রেণীর উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ইসলামী ঐক্যের হেফাযতকারীদের রাজনৈতিক সামর্থ্য ও মর্মবেদনা একীভূত করেছিলেন’।[12]
৫. এ আন্দোলনে ওহাবী মুজাহিদীন তথা আহলেহাদীস আলেমগণও পুরোমাত্রায় শরীক ছিলেন। ডকুমেন্টস্-এ এ কথার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। উদাহরণস্বরূপ নীচের ব্যক্তিবর্গের নাম ডকুমেন্টস্-এ পাওয়া যায়।
(১) মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী। ডকুমেন্টস্-এ তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বিখ্যাত ও অত্যন্ত প্রভাবশালী গোঁড়া ওহাবী মুবাল্লেগ। হিন্দুস্থানে সফর করেন এবং ওহাবীদের জালসা সমূহে বিভিন্ন ফিরকার সাথে বিতর্কে অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য রাখেন। যাফর আলীর কট্টর সহযোগী, ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সাথী এবং মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে বশীরের সঙ্গী। ত্রিপলী যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ ও কানপুর মসজিদের ঘটনায় শিয়ালকোটে তিনি রীতিমত অশান্তি সৃষ্টি ও শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন’।
(২) মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদী (হুসনুল বায়ান ফীমা ফী সীরাতিন নু‘মান গ্রন্থের লেখক)।
(৩) মৌলভী আব্দুল হক, মৌলভী মুহাম্মাদ গাওছ (লাহোর)-এর পুত্র। ডকুমেন্টস্-এ বলা হয়েছে, ইনি মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে মৌলভী বশীরের শ্যালক ও কট্টর ওহাবী ছিলেন।
(৪) মুজাহিদ বাহিনীর উপপ্রধান মাওলানা আব্দুল করীম।
(৫) আব্দুল খালেক, সরদার বাহাদুর মুহাম্মাদ আমীন খাঁর পুত্র, নিবাস আযীমাবাদ।
(৬) হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী। ডকুমেন্টস্-এ তাকে ‘প্রসিদ্ধ ওহাবী মৌলভী’ বলা হয়েছে।
(৭) আব্দুল্লাহ শেখ (শিয়ালকোট)। তাকে মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে মৌলভী বশীর ও মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদীর নিকটতম সাথী বলা হয়েছে।
(৮ ও ৯) আব্দুল লতীফ ও আব্দুল মজীদ। এ দু’জনকে জিহাদী দলের নেতা বলা হয়েছে।
(১০) মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী (মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরীর পিতা)।
(১১) মাওলানা সাইয়িদ আব্দুস সালাম ফারূকী। প্রসিদ্ধ আহলেহাদীস, দিল্লীর ফারূকী প্রেসের মালিক।
(১২) মাওলানা আব্দুর রহীম (শহীদ) ওরফে মৌলভী মুহাম্মাদ বশীর ওরফে মুহাম্মাদ নাযীর। লাহোরের চীনাওয়ালী মসজিদের সাবেক ইমাম মৌলভী রহীম বখশের পুত্র। তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘ওহাবীদের বই-পুস্তক বিক্রেতা, অত্যন্ত গোঁড়া ও আবেগী, জিহাদ আন্দোলনের অত্যন্ত সক্রিয় একজন সদস্য’।
(১৩) মৌলভী আব্দুর রহীম আযীমাবাদী। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইনি বিহার ও উড়িষ্যার একজন বিশিষ্ট ওহাবী। তার পূর্বসূরী নেতা আহমাদুল্লাহ যাকে ১৮৬৫ সালে ওহাবীদের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। জানা যায়, আহমাদুল্লাহ ছাহেব যে বংশের লোক তিনিও সেই বংশের লোক।
(১৪) আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদী। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ওহাবী মৌলভী, অত্যন্ত গোঁড়া এবং এ প্রদেশে জিহাদ আন্দোলনের একজন ভয়ংকর নেতা। যেই তার সাথে মিলিত হ’ত তার মধ্যেই তিনি জিহাদের চেতনা জাগ্রত করতেন। তিনি ওয়াযীরাবাদের এক মসজিদে মাযহাবী তরীকায় দরস প্রদানকারী হাফেয আব্দুল মান্নানের শিষ্যদের বিপদগামী করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন’।
(১৫) মাওলানা মুহিউদ্দীন ক্বাছূরী ওরফে বরকত আলী বি.এ। মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরীর ছেলে এবং মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরীর ভাই।
(১৬) মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরী। তাকে এই ষড়যন্ত্রের সক্রিয় নেতা বলা হয়েছে।
(১৭) মুহাম্মাদ আসলাম। ইনি পেশাওয়ারের কিস্সাখানী বাজারের একজন আতর ব্যবসায়ী এবং সীমান্ত এলাকার মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে বশীর, ফযল মাহমূদ ও অন্যান্য মুজাহিদদের সহযোদ্ধা।
(১৮) মুহাম্মাদ এলাহী (মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদীর ভাই)। ডকুমেন্টস্-এ তাকে ‘আহমাদী’ অর্থাৎ মির্যায়ী বা কাদিয়ানী বলা হয়েছে। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। তিনি আহলেহাদীস পরিবারের সন্তান এবং আহলেহাদীস ছিলেন।
(১৯) নাযীর আহমাদ কাতেব। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইনি ওয়াযীরাবাদের বিখ্যাত ওহাবী মৌলভী হাফেয আব্দুল মান্নানের ছাত্র। তারই মাধ্যমে মৌলভী ফযলে এলাহী খিরাদী (ওয়াযীরাবাদী)-র সাথে তার পরিচয় হয়, যিনি তার মধ্যে জিহাদের জায্বা সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে সে ওহাবী হয়ে যায়’।
(২০) রশীদুল্লাহ, পীর ঝান্ডাওয়ালা। বিখ্যাত সিন্ধী পীর। সাং গোঠ, তহশীল (থানা) হালা।
(২১) মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। তার সম্পর্কে ডকুমেন্টস্-এ বলা হয়েছে, ‘আঞ্জুমানে আহলেহাদীস, পাঞ্জাবের সভাপতি। হিন্দুস্থানে সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ ওহাবী’।
(২২) মৌলভী ওলী মুহাম্মাদ ফতূহীওয়ালা ওরফে মৌলভী মূসা। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত গোঁড়া ওহাবী মৌলভী, যিনি জোর তৎপরতার সাথে জিহাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারে এবং এতদুদ্দেশ্যে অর্থ ও লোক যোগাড়ে ব্যস্ত থাকেন’।
(২৩) নওয়াব যমীরুদ্দীন আহমাদ। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইনিই সম্ভবত ওহাবী মৌলভী নওয়াব যমীরুদ্দীন আহমাদ, যিনি দিল্লীতে যমীর মির্যা নামে পরিচিত। তিনি নওয়াব লোহারুর ভাই। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি আহলেহাদীস কনফারেন্স-এর সভাপতি ছিলেন। পরে অসুস্থতাজনিত কারণে ইস্তফা দেন’।[13]
নামের এই বিবরণী থেকে পরিষ্কার যে, রেশমী রুমাল আন্দোলনে আহলেহাদীস মনীষীগণ সমানভাবে শরীক ছিলেন। তাই এ আন্দোলনকে নির্ভেজাল দেওবন্দী আন্দোলন প্রমাণের চেষ্টা ভুল। অথচ দেওবন্দী লেখকগণের নীতি এটাই চলে আসছে। এমনকি মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী পর্যন্ত তার স্বরচিত আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘নক্বশে হায়াত’-এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছেন তাতে উল্লেখিত আহলেহাদীস মনীষীদের একজনের নামও উল্লেখ করেননি। শুধু নিজের ঘরানার লোকদের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উক্ত মূল ডকুমেন্টস্ প্রকাশিত হওয়ার পর এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ আন্দোলনেও আহলেহাদীস আলেমগণ পুরোপুরি শামিল ছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা এতটাই খাঁটি ও দৃঢ় মন নিয়ে আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন যে, আন্দোলনের কোন পর্যায়েই তারা গোপনীয়তা ফাঁস করেননি, যেখানে দেওবন্দী মনীষীগণের অনেকেই দৃঢ়তা ও অবিচলতার প্রমাণ দিতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ ডকুমেন্টস্-এ ১৩ জন লক্ষ্যচ্যুত ব্যক্তির নাম আছে যারা আনেদালনের ক্ষতি করেছেন এবং ইংরেজ সিআইডি-কে তথ্য সরবরাহ করেছেন। এমনকি শায়খুল হিন্দের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও হেজায সফরকালীন সময়ে তার স্থলাভিষিক্ত মাওলানা শাহ আব্দুর রহীম রায়পুরীর মতো ব্যক্তিও শেষ পর্যন্ত অবিচল থাকতে পারেননি। তিনি ইংরেজের সামনে আন্দোলন সংক্রান্ত দায়ের করা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং কিছু অভিযোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন।[14]
গোলাম রসূল মেহেরও ঐসব কথা স্বীকার করেছেন যা আমরা বর্ণনা করেছি। মেহের লিখেছেন, ‘শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান দেওবন্দী স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন দাঁড় করিয়েছিলেন যদিও জামা‘আতে মুজাহিদীনের সাথে সরাসরি তার যোগাযোগ ছিল না, তবুও দু’টি আন্দোলনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য ছিল। উভয়ের সংকল্পধারা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) ও সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-তে এসে মিলিত হয়েছিল। উভয়ের লক্ষ্যে বিশেষ ধরণের ঐক্য ছিল। উভয় দলই মুসলমানদের মাথা উঁচু করা এবং হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট ছিল। ...তারপরও প্রকাশ যে, শায়খুল হিন্দের নিযুক্ত কর্মীরা প্রয়োজন মুহূর্তে জামা‘আতে মুজাহিদীন-এর নিকট থেকে সাহায্য নিতেন। দুই জামা‘আতের কর্মীদের যেখানে এক পরিমন্ডলে কাজ করার সুযোগ মিলেছে সেখানে তারা এক সাথে মিলেমিশে কাজ করেছেন’।[15]
যাহোক, এ আন্দোলন নিরেট দেওবন্দী আন্দোলন ছিল না; বরং তার আগে ওহাবী আলেমদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল তার লোকজনও এতে শরীক ছিলেন এবং ওহাবী আলেম ও মুজাহিদগণও এই আন্দোলনে পুরো সহযোগিতা করেছিলেন।
৬. এ আন্দোলন দেওবন্দীদের নিজেদেরই দুর্বলতার কারণে কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়নি। কয়েকজন তো প্রথম থেকেই আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। এরূপ লক্ষ্যচ্যুত ১৩ জনের নাম ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ গ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছে। কোন আন্দোলন সফল করতে হ’লে যে ধরনের দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখানো দরকার দেওবন্দী আলেমগণ তা দেখাতে আগাগোড়াই ব্যর্থ ছিলেন। খোদ মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী যেসব পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তা অবিচল ও দৃঢ়চিত্তদের মান থেকে অনেক নীচে। ‘আসীরে মাল্টা’ গ্রন্থে তিনি পুরো নিশ্চয়তা ও নির্ভরতার সঙ্গে বলেছেন যে, হযরত শায়খুল হিন্দ না গালিব পাশা, আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার সাথে দেখা করেছেন, না তার পক্ষে এমন কোন সুযোগ ছিল। কিন্তু তার ‘নক্বশে হায়াত’ গ্রন্থে তিনি এক একটি নকশার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং সেই সাথে তার এরূপ গা বাঁচানো কর্মপদ্ধতির বৈধতার দু’টি ব্যাখ্যা পেশ করেছেন।
এক. সাংকেতিক উত্তর প্রদান- যার দু’টো অর্থ হবে, বক্তা নিবেন দ্বিতীয় অর্থ আর শ্রোতা বুঝবেন প্রথম অর্থ। তিনি বলেছেন, এরূপভাবে কথা বলা মিথ্যা নয় এবং এমন ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তা জায়েয।
গোলাম রসূল মেহের মাওলানা মাদানীর এই ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সাংকেতিক উত্তর’ প্রসঙ্গে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ সম্পর্কে যখন মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীর মতো একজন সম্মানিত আলেম বৈধতার ফৎওয়া দেন তখন আমার মতো অল্প-স্বল্প জানা মানুষের বলার আর কি থাকতে পারে? তারপরেও পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই যে, তার উক্ত কথায় মন তৃপ্ত নয়। আত্মরক্ষার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বনের কথা তিনি বলেছেন, তা-ই যদি কবুল করা হয় তাহ’লে মুজাহিদসুলভ কর্মকান্ড ও সেজন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে বলে বুঝতে হবে। একই সঙ্গে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, শরী‘আতে আযীমত বা অনড় ও অবিচল বিষয় বলে কিছু নেই। যা আছে তা শুধু ছাড় আর ছাড়। মূল লক্ষ্য পূরণে এমনভাবে কাজ করব যে, গায়ে একটু আঘাতও লাগবে না, আঘাত লাগার সম্ভাবনা দেখা দিলে লক্ষ্যের কপালে যা হয় হোক, আমি আগে জান বাঁচাব। লক্ষ্য পূরণের এমন ধ্যান-ধারণা যতক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাসের পৃষ্ঠাসমূহ থেকে অনড় ও অবিচলতার সকল ঘটনা ধুয়ে-মুছে ফেলা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মন কিভাবে তা মেনে নিতে পারে? যা মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী বলেছেন’।[16]
কিন্তু এ লেখকের মতে, বিষয় শুধু আযীমত ও রুখছত কেন্দ্রিক নয়, বরং তাতে ইতিহাস বিকৃতিরও কিছু বিষয় আছে। দেওবন্দের ছোট-বড় সবাই দেশের মুক্তির জন্য ভুল-শুদ্ধ সব রকম আন্দোলনের সমস্ত কৃতিত্ব যেভাবে দেওবন্দী মুরববীদের দেওয়ার চেষ্টা শুরু করছেন, তাতে এ ধরনের পরস্পর বিরোধী কথা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে তারা প্রকৃত অবস্থা থেকে দূরের নানা ব্যাখ্যার সাহায্য নিতে বাধ্য, যা ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া সম্ভব নয়।
যাহোক, কথা হচ্ছিল যে, আন্দোলনে শামিল দেওবন্দী বুযর্গদের কর্মপদ্ধতির দরুন আন্দোলন ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়। যদিও দ্বীনী আন্দোলনে বাহ্যিক সফলতা-অসফলতার কোন গুরুত্ব নেই। দ্বীনী আন্দোলনের কাজের ভিত্তি খালেছ নিয়ত এবং সঠিক কর্মপদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। যদি কোন আন্দোলনে এগুলি মওজুদ থাকে তাহ’লে বাহ্যিক অসফলতা সত্ত্বেও তা সফল। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে বাহ্যিক সফলতা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার নিকট তা সফল বিবেচিত হবে না।
হযরত শায়খুল হিন্দ ও অন্যদের নিয়ত নিশ্চয়ই সঠিক হবে, কিন্তু আন্দোলনের সফলতার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন এবং যে ধরনের কর্মীর দরকার ছিল তা এই আন্দোলনে জোটেনি। দেওবন্দী মুরববীদের অধিকাংশই এ আন্দোলন থেকে বিমুখ ছিলেন। অল্পকিছু যারা শরীক হয়েছিলেন তারা (রাজনীতির ময়দানের) বিদ্যা-বুদ্ধি ও কর্মকান্ডে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে গোলাম রসূল মেহের মরহূম লিখছেন, ‘হযরত মরহূম শায়খুল হিন্দ যে উদ্দীপনা, সততা, সাহসিকতা ও ভক্তি সহকারে কাজ করেছেন সে বিষয়ে এ অধম যার কিনা এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই সে কি-ইবা বলতে পারে। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, মূল পরিকল্পনা যে অবস্থার ভিতর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ তাতে মোটেও মেলেনি। যেহেতু পুরো পরিকল্পনা একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল এজন্য তার কোন দিকই স্থায়ী হয়নি। হযরতের কর্মীবাহিনীও কাজকর্মে, বিদ্যায়-মাহাত্ম্যে, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতায়, পরার্থপরতায়-আত্মত্যাগে এবং সাহসিকতা ও নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দানে নিজের তুলনা নিজেই ছিলেন। এদের কারো ইসলামী উদ্দীপনা ও আযাদীর স্পৃহা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত মুহূর্তের জন্যও নিস্তেজ হয়নি। কিন্তু আমি শত আদব সহকারে এ কথা বলার অনুমতি চাইছি যে, যে সকল কাজে এই মনীষীরা নিজেদের নিযুক্ত করেছিলেন তা সব দিক দিয়ে তাদের উপযোগী ছিল না। যে জেনারেল বিপদসংকুল স্থানে সৈনিকদের নেতৃত্ব দানের হিম্মত রাখেন, রাজনৈতিক ময়দানেও তিনি যে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন তা যরূরী নয়’।[17]
৭. আন্দোলনের দিনগুলিতেও দারুল উলূম দেওবন্দ সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন থেকে শুধু আলাদাই ছিল না; বরং আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীতে ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রমাণে ব্যস্ত ছিল। যার বিবরণ ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে। যার পরিষ্কার অর্থ দেওবন্দের মুরববীগণ এ আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এ কারণেই শায়খুল হিন্দ, মাওলানা মাদানী ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্যদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখনও দারুল উলূম দেওবন্দে তার কোন আঁচড় পড়েনি এবং সেখানে ধর-পাকড়ের কোন বালাই দেখা যায়নি। এ আন্দোলনকে বরং কিছু লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপার মনে করা হয়। এমন যদি না হ’ত তাহ’লে নিশ্চিতরূপে দারুল উলূমের দায়িত্বশীলদের ইংরেজ সরকারের নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচা কস্মিনকালেও সম্ভব ছিল না।
তাছাড়া শায়খুল হিন্দ ও অন্যদের গ্রেফতারের পর দেওবন্দের আলেমগণ যে পথ-পন্থা অবলম্বন করেন তাতে তো একথা পরিষ্কারভাবে সামনে এসে যায় যে, সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সাথে দেওবন্দের আলেমদের কোন সম্পর্ক ছিল না এবং রাজনীতি থেকে তারা সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। গ্রেফতারের পর দেওবন্দের আলেমগণ শায়খুল হিন্দ ও অন্যদের মুক্তির জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তাতে তারা তিনটি বিষয় বিশেষভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পান।
এক. শায়খুল হিন্দকে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দুই. দেওবন্দী আলেমদের মতো তিনিও রাজনৈতিক জটিলতা থেকে দূরে ছিলেন।
তিন. দেওবন্দী আলেমদের জামা‘আত সম্পূর্ণ নীরব জামা‘আত এবং রাজনীতির সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন। এ ধরনের আন্দোলন সমূহের সাথে তাদের মোটেও কোন সংযোগ নেই।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে দেওবন্দের আলেমগণ এ প্রসঙ্গে ইংরেজ গভর্ণরের নিকট সম্মিলিতভাবে যে দরখাস্ত পেশ করেন তাতে উক্ত তিনটি বিষয় গুরুত্বের সাথে এবং বার বার বলা হয়েছে।
আমরা পুরো দরখাস্ত এবং দেওবন্দের মাসিক ‘আর-রশীদ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নোট নামে যে ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার অনুলিপি এখানে উদ্ধৃত করছি। যে যুগে জিহাদ আন্দোলনের ওহাবী মুজাহিদগণ ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জান কুরবান করছিল সে যুগে দেওবন্দের আলেমদের রাজনৈতিক অবদানের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও মুজাহিদসুলভ কর্মকান্ডের চৌহদ্দী কতদূর কি ছিল, এ দরখাস্তের আলোকে যে কেউ তা দেখতে পাবেন। যার ঢাক-ঢোল এখন খুব জোরেশোরে পিটানো হচ্ছে। (দরখাস্তের পুরো কপি ‘আর-রশীদ’ পত্রিকা, দেওবন্দের সম্পাদকীয় নোটসহ পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে দ্রষ্টব্য)
[1]. বরং তার বিপরীতে ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রমাণ ১৮৭৫ সালে মিস্টার পামার প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়, যা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। এছাড়া শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান কর্তৃক ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত পার্টি ‘জমঈয়াতুল আনছার’-এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসাবে যেসব প্রস্তাব মঞ্জুর করা হয়েছিল, তন্মধ্যে একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য এমন ছোট ছোট পুস্তিকা বেশী বেশী প্রকাশ করতে হবে যাতে ইসলামী আক্বায়েদ শিক্ষাদান, আর্য সম্প্রদায়ের প্রশ্নের উত্তরদান এবং সরকারের প্রতি আনুগত্যের বার্তা মেলে’ (মুফতী আযীযুর রহমান, তাযকেরায়ে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ১৭২, ইদারায়ে মাদানী দারুত তালীফ, বিজনৌর, ভারত)।
[2]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ১৮।
[3]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮।
[4]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬০।
[5]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৮।
[6]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪০।
[7]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮।
[8]. নক্বশে হায়াত ২/২৪০ পৃ., টীকা দ্র.।
[9]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ২৬১-২৬২।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২ দ্রষ্টব্য।
[11]. বিস্তারিত জানতে নক্বশে হায়াত ২/২৩৮-২৪০ পৃ.।
[12]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ২৩৯।
[13]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, উদ্ধৃতির ক্রমানুযায়ী পৃষ্ঠা নং ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৯৬, ৩৯৯, ৪০০, ৪০১, ৪১৯, ৪৪৭, ৪৫০, ৪৫২, ৪৬৫, ৪৭০, ৪৭৫, ৪৮২, ৪৮৫।
[14]. নক্বশে হায়াত ২/২০৪ পৃ.।
[15]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, ৯ম অধ্যায়, পৃ. ৫৫২।
[16]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ৫৬২।
[17]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ৫৬১।
কিছুক্ষণের জন্য যদি মেনে নেওয়া হয় যে, শামেলীর প্রকৃত ঘটনা তাই যা বর্তমান কালের দেওবন্দী লেখকরা প্রমাণের চেষ্টা করছেন, তাহলেও এ প্রশ্ন থেকে যায় যে, শামেলীর সীমিত পরিসরের ঘটনার পর দেওবন্দের মুরববীরা এই জিহাদ আন্দোলনকে কিভাবে জীবিত রেখেছিলেন? এ পথের কোন কোন কষ্টই বা দেওবন্দবাসীদের সইতে হয়েছে? কোন সে কর্মকান্ড যা থেকে জানা যাবে যে, বাস্তবিকই দেওবন্দের উল্লেখিত বুযর্গগণ জিহাদের এ পতাকাকে ঠিক সেভাবেই ধরে রেখেছিলেন, যেভাবে তারা ১৮৫৭ সালের জিহাদে তা উঁচিয়ে ধরেছিলেন? বাস্তবতা তো এই যে, সব রকম মনগড়া ইতিহাস রচনা করা সত্ত্বেও দেওবন্দী লেখকরা তার বিবরণ দিতে সক্ষম হননি।[1]
وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
‘যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮৮)।
অবশ্য অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় (১৮৫৭-১৯১৪) পেরিয়ে যাওয়ার পর ‘রেশমী রুমাল’ নামে একটি আন্দোলনের খোঁজ পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালের পর যা শায়খুল হিন্দ শুরু করেছিলেন। এর ভিত্তিতে এ কথা বলা হয় যে, মাওলানা মাহমূদ হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও অন্য ৮ জন গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং প্রায় চার বছর মাল্টায় বন্দী থাকেন। এর বিবরণ মাওলানা মাদানী মরহূম ‘আসীরে মাল্টা’ বা ‘মাল্টার বন্দী’ নামক বইয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বলা হয় যে, হিন্দুস্থানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তুরষ্কের ওছমানী খিলাফত ও অন্যদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করা ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে মাওলানা মাহমূদ হাসান মরহূম রেশমী রুমালে কিছু যরূরী নির্দেশনা দিয়ে কতিপয় ব্যক্তিকে তুরষ্ক, হেজায প্রভৃতি স্থানে প্রেরণ করেন। কিন্তু গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ায় গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায় এবং সে রেশমী রুমাল গভর্ণমেন্টের হাতে চলে যায়। ফলে মাওলানা মাহমূদ হাসান, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও অন্যদের গ্রেফতার করা হয়।
সত্য এই যে, এ আন্দোলনের আসল রহস্য এখন পর্যন্ত উন্মোচিত হয়নি। ফলে তার প্রকৃত রূপরেখা এখন জানা প্রায় অসম্ভব। তবে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত তার মূল ডকুমেন্টস্-এর উর্দূ অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং এতদসংক্রান্ত সকল তথ্য-উপাত্ত ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ নামক বইয়ে সংকলন করা হয়েছে। বইটি লাহোর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা ঐ বইয়ের আলোকে আমাদের অধ্যয়নের ফলাফল নীচে তুলে ধরছি।-
১. এ আন্দোলনও ছিল কয়েকজন ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনার ফসল মাত্র। যার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে বলা হয়েছে। আর শায়খুল হিন্দকে তাদের দ্বারা প্রভাবিত ও তাদের একজন কর্মী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[2] কিন্তু দেওবন্দী লেখকগণ শায়খুল হিন্দকেই এর প্রতিষ্ঠাতা বলে সাব্যস্ত করেন। প্রতিষ্ঠাতা যেই হৌন না কেন, তাতে সকল দেওবন্দী আলেমের সমর্থন ছিল না। এজন্যই ইংরেজ ডকুমেন্টস্-এ শায়খুল হিন্দ, মাওলানা মাদানী, মাওলানা আযীয গুল ও মাওলানা সিন্ধী ছাড়া দেওবন্দী মুরববীদের অন্য কারো নাম পাওয়া যায় না।
২. এ আন্দোলনের পূর্বে দেওবন্দ মাদ্রাসায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনের প্রমাণ পাওয়া যায় না। ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ বইয়ের নিম্নের বর্ণনায় এ কথার সমর্থন মেলে।-
‘দারুল উলূম দেওবন্দ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানূতুভী ও মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহীর দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার পিছনে যে আসল উদ্দেশ্য ও মূল লক্ষ্য ছিল তা বাস্তবায়নে দেওবন্দের তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যে কেবল শায়খুল হিন্দই তৎপর হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের প্রদর্শিত ও রেখে যাওয়া রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করায় চাহিদা মতো দ্রুত ফল লাভের আশা করা সম্ভব নয়’।[3]
এ কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে যে, দেওবন্দ ঘরানার মধ্যে শায়খুল হিন্দই এক্ষেত্রে প্রথম কর্মতৎপর হয়েছিলেন। এজন্যই কাঙ্খিত ফল লাভের আশা ছিল না।
এছাড়া উক্ত গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে, ‘এই আন্দোলন চলাকালে মাদ্রাসার মুহতামিম (অধ্যক্ষ) ছাহেব রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি তিনি ইউপির গভর্ণরকে দাওয়াত করে দারুল উলূম দেওবন্দে এনে তাকে মানপত্র প্রদান করেন। এই যোগাযোগের ফলশ্রুতিতে হাফেয ছাহেবকে (হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদ, মুহতামিম, দারুল উলূম দেওবন্দ) ‘শামসুল ওলামা’ উপাধি প্রদান করা হয়’।[4]
যেন আন্দোলন চলাকালীন সময়েও দেওবন্দের অন্যান্য মুরববীগণ এ আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীতে ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের নীতিতে অটল ছিলেন। মাওলানা মাহমূদ হাসানের নিকট আন্দোলনের এক সদস্যের লেখা পত্রে এ বিষয়ে অভিযোগও লক্ষণীয়। যেখানে তিনি লিখেছেন,
مالكانِ مدرسہ سركار كى خدمت ميں لگے ہوئے ہيں. نمائش كے دربار ميں شركت كا فخر بهى نصيب ہونے لگا-
‘মাদ্রাসার কর্তা ব্যক্তিগণ সরকারের খেদমতে ব্যস্ত। প্রদর্শনীর দরবারে চেহারা প্রদর্শনের গৌরবও জুটছে’।[5]
ডকুমেন্টস্-এ নিম্নোক্ত ভাষায় দেওবন্দ মাদ্রাসা ও তার তৎকালীন মুহতামিম সম্পর্কে বলা হয়েছে,
‘মাদ্রাসা’ দ্বারা এখানে দেওবন্দের আরবী মাদ্রাসার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেটি সাহারানপুর যেলার দেওবন্দে অবস্থিত। ... মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হলেন শামসুল ওলামা মেŠলভী হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদ, যিনি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা (মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানূতুভী)-এর পুত্র। তিনি একজন অনুগত ও ভদ্রলোক’।[6]
৩. মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী মরহূম ‘নক্বশে হায়াত’ (জীবনচিত্র) বইয়ে উল্লেখিত বাস্তবতার এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, যৌক্তিক ও কৌশলগত কারণে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ইংরেজ সরকারের সাথে এহেন ভক্তিপূর্ণ ও আনুগত্যশীল আচরণ করতেন, যাতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার কোন ক্ষতি সাধন করা না হয়। কিন্তু এ ব্যাখ্যা প্রথমত বাস্তবের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। বাস্তব তো এই যে, দেওবন্দের মুরববীদের বেশীর ভাগই শিক্ষাদানের সাথে জড়িত ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তৎপর জামা‘আত ও গোষ্ঠীগুলির সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তার প্রমাণ ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ বইয়ের নিম্নের ডকুমেন্টস্ থেকেও পাওয়া যায় :
‘মাদ্রাসা দারুল উলূম দেওবন্দে বিদ্রোহের সূচনা হয় ওবায়দুল্লাহ থেকে। ইনি ছিলেন শিখ সম্প্রদায় থেকে আগত নওমুসলিম। তিনি ১৮৮১-১৮৮৯ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন। ইংরেজ বিরোধী জোশ সৃষ্টির মানসে ১৯০৯ সালে তিনি মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে আসেন। ১৯১৩ সালে ‘বিদেশী পণ্য বর্জন’ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার কারণে তাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়কালের মধ্যেই তিনি প্রধান শিক্ষক মাহমূদ হাসানকে তার সমমতাদর্শী বানিয়ে ফেলেন’।[7]
মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীও স্বীকার করেছেন যে, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়ার মূল কারণ ইউপির গভর্ণর মেস্টিনের দারুল উলূম দেওবন্দে আগমন এবং মুহতামিম ছাহেবের ‘শামসুল ওলামা’ উপাধি লাভ’।[8]
যেন ইংরেজ সরকারের প্রতি মাদ্রাসার আনুগত্য প্রমাণের জন্য মাওলানা সিন্ধী মরহূমকে দারুল উলূম দেওবন্দের অধ্যাপনার পদ থেকে অপসারণ করা হয়। কেননা তিনিই সেখানে এসে সবার আগে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। অনন্তর ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’-এ আছে যে, এ ধরনের আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে মাদ্রাসার পরিচালক সুযোগ বুঝে মৌলভী ওবায়দুল্লাহকে তলব করেন এবং কঠোর ভাষায় তাকে তিরষ্কার করেন।[9]
রাজনীতি থেকে দেওবন্দ মাদ্রাসার সম্পর্কহীনতার আরো বিবরণ লক্ষ্য করুন :
‘মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেমের পুত্র শামসুল ওলামা হাফেয মুহাম্মাদ আহমাদের সতর্ক তত্ত্বাবধানে দেওবন্দ মাদ্রাসা বিগত বহু বছর ধরে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রগণ আধুনিক রাজনীতি ও বাইরের বিষয়াদি নিয়ে খুব অল্পই মাথা ঘামাতেন অথবা মোটেও মাথা ঘামাতেন না। ওবায়দুল্লাহর আগমনের পর এবং তার প্রভাবে মাদ্রাসার রং পাল্টে যেতে শুরু করে’।[10]
এসব উদ্ধৃতি থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীই প্রথম ব্যক্তি যিনি দারুল উলূম দেওবন্দে ইংরেজ সরকারের বিরোধিতার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেন। নতুবা তার আগে দারুল উলূম রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। সেকারণ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিতে হয়। যাতে ইংরেজ সরকারের প্রতি মাদ্রাসার আনুগত্য ব্যাহত না হয়।
৪. এ আন্দোলন নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না; বরং তাদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ সরকারের স্থলে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণেই তাতে শিখ ও বিপ্লবী হিন্দুরাও শামিল ছিল।[11]
এর অর্থ দাঁড়াল যে, এটি একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আন্দোলন, যা জিহাদ আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা জিহাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল নির্ভেজাল ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্য এ আন্দোলনের উদ্যোক্তারা জিহাদ আন্দোলনে সক্রিয় মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতাও লাভ করেছিলেন। সেটি একটি স্বতন্ত্র বিষয়। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন বলে মুজাহিদরা তাদের সহযোগিতা করেছিলেন। সত্য বলতে কি রেশমী রুমাল আন্দোলনের যতটুকু চর্চা হয়েছিল তার মূল প্রেরণা ছিল প্রায় পৌনে এক শতাব্দী যাবৎ দেশব্যাপী চলমান ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওহাবীদের জিহাদ আন্দোলন। ইংরেজ বিরোধিতার এই পরিবেশ ও জায্বা রেশমী রুমাল আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিল এবং এর প্রতিষ্ঠাতারাও তা থেকে পুরো ফায়েদা হাছিল করেছিলেন। নতুবা শুধু দেওবন্দী ঘরানা ও দেওবন্দ মাদ্রাসার সাথে জড়িতরা যে এ আন্দোলনে বেশী কিছু তৎপরতা দেখাবে তেমন কোন আশা ছিল না। প্রসঙ্গত ইংরেজ ডকুমেন্টস্-এ মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও তার কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি তার ষড়যন্ত্রে ওহাবী আন্দোলনের কার্যকর মেশিনারী মৌলভী শ্রেণীর উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ইসলামী ঐক্যের হেফাযতকারীদের রাজনৈতিক সামর্থ্য ও মর্মবেদনা একীভূত করেছিলেন’।[12]
৫. এ আন্দোলনে ওহাবী মুজাহিদীন তথা আহলেহাদীস আলেমগণও পুরোমাত্রায় শরীক ছিলেন। ডকুমেন্টস্-এ এ কথার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। উদাহরণস্বরূপ নীচের ব্যক্তিবর্গের নাম ডকুমেন্টস্-এ পাওয়া যায়।
(১) মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী। ডকুমেন্টস্-এ তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বিখ্যাত ও অত্যন্ত প্রভাবশালী গোঁড়া ওহাবী মুবাল্লেগ। হিন্দুস্থানে সফর করেন এবং ওহাবীদের জালসা সমূহে বিভিন্ন ফিরকার সাথে বিতর্কে অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য রাখেন। যাফর আলীর কট্টর সহযোগী, ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর সাথী এবং মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে বশীরের সঙ্গী। ত্রিপলী যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ ও কানপুর মসজিদের ঘটনায় শিয়ালকোটে তিনি রীতিমত অশান্তি সৃষ্টি ও শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন’।
(২) মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদী (হুসনুল বায়ান ফীমা ফী সীরাতিন নু‘মান গ্রন্থের লেখক)।
(৩) মৌলভী আব্দুল হক, মৌলভী মুহাম্মাদ গাওছ (লাহোর)-এর পুত্র। ডকুমেন্টস্-এ বলা হয়েছে, ইনি মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে মৌলভী বশীরের শ্যালক ও কট্টর ওহাবী ছিলেন।
(৪) মুজাহিদ বাহিনীর উপপ্রধান মাওলানা আব্দুল করীম।
(৫) আব্দুল খালেক, সরদার বাহাদুর মুহাম্মাদ আমীন খাঁর পুত্র, নিবাস আযীমাবাদ।
(৬) হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী। ডকুমেন্টস্-এ তাকে ‘প্রসিদ্ধ ওহাবী মৌলভী’ বলা হয়েছে।
(৭) আব্দুল্লাহ শেখ (শিয়ালকোট)। তাকে মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে মৌলভী বশীর ও মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদীর নিকটতম সাথী বলা হয়েছে।
(৮ ও ৯) আব্দুল লতীফ ও আব্দুল মজীদ। এ দু’জনকে জিহাদী দলের নেতা বলা হয়েছে।
(১০) মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী (মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরীর পিতা)।
(১১) মাওলানা সাইয়িদ আব্দুস সালাম ফারূকী। প্রসিদ্ধ আহলেহাদীস, দিল্লীর ফারূকী প্রেসের মালিক।
(১২) মাওলানা আব্দুর রহীম (শহীদ) ওরফে মৌলভী মুহাম্মাদ বশীর ওরফে মুহাম্মাদ নাযীর। লাহোরের চীনাওয়ালী মসজিদের সাবেক ইমাম মৌলভী রহীম বখশের পুত্র। তার পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘ওহাবীদের বই-পুস্তক বিক্রেতা, অত্যন্ত গোঁড়া ও আবেগী, জিহাদ আন্দোলনের অত্যন্ত সক্রিয় একজন সদস্য’।
(১৩) মৌলভী আব্দুর রহীম আযীমাবাদী। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইনি বিহার ও উড়িষ্যার একজন বিশিষ্ট ওহাবী। তার পূর্বসূরী নেতা আহমাদুল্লাহ যাকে ১৮৬৫ সালে ওহাবীদের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। জানা যায়, আহমাদুল্লাহ ছাহেব যে বংশের লোক তিনিও সেই বংশের লোক।
(১৪) আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদী। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ওহাবী মৌলভী, অত্যন্ত গোঁড়া এবং এ প্রদেশে জিহাদ আন্দোলনের একজন ভয়ংকর নেতা। যেই তার সাথে মিলিত হ’ত তার মধ্যেই তিনি জিহাদের চেতনা জাগ্রত করতেন। তিনি ওয়াযীরাবাদের এক মসজিদে মাযহাবী তরীকায় দরস প্রদানকারী হাফেয আব্দুল মান্নানের শিষ্যদের বিপদগামী করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন’।
(১৫) মাওলানা মুহিউদ্দীন ক্বাছূরী ওরফে বরকত আলী বি.এ। মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরীর ছেলে এবং মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরীর ভাই।
(১৬) মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরী। তাকে এই ষড়যন্ত্রের সক্রিয় নেতা বলা হয়েছে।
(১৭) মুহাম্মাদ আসলাম। ইনি পেশাওয়ারের কিস্সাখানী বাজারের একজন আতর ব্যবসায়ী এবং সীমান্ত এলাকার মৌলভী আব্দুর রহীম ওরফে বশীর, ফযল মাহমূদ ও অন্যান্য মুজাহিদদের সহযোদ্ধা।
(১৮) মুহাম্মাদ এলাহী (মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদীর ভাই)। ডকুমেন্টস্-এ তাকে ‘আহমাদী’ অর্থাৎ মির্যায়ী বা কাদিয়ানী বলা হয়েছে। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। তিনি আহলেহাদীস পরিবারের সন্তান এবং আহলেহাদীস ছিলেন।
(১৯) নাযীর আহমাদ কাতেব। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইনি ওয়াযীরাবাদের বিখ্যাত ওহাবী মৌলভী হাফেয আব্দুল মান্নানের ছাত্র। তারই মাধ্যমে মৌলভী ফযলে এলাহী খিরাদী (ওয়াযীরাবাদী)-র সাথে তার পরিচয় হয়, যিনি তার মধ্যে জিহাদের জায্বা সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে সে ওহাবী হয়ে যায়’।
(২০) রশীদুল্লাহ, পীর ঝান্ডাওয়ালা। বিখ্যাত সিন্ধী পীর। সাং গোঠ, তহশীল (থানা) হালা।
(২১) মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। তার সম্পর্কে ডকুমেন্টস্-এ বলা হয়েছে, ‘আঞ্জুমানে আহলেহাদীস, পাঞ্জাবের সভাপতি। হিন্দুস্থানে সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ ওহাবী’।
(২২) মৌলভী ওলী মুহাম্মাদ ফতূহীওয়ালা ওরফে মৌলভী মূসা। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত গোঁড়া ওহাবী মৌলভী, যিনি জোর তৎপরতার সাথে জিহাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারে এবং এতদুদ্দেশ্যে অর্থ ও লোক যোগাড়ে ব্যস্ত থাকেন’।
(২৩) নওয়াব যমীরুদ্দীন আহমাদ। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ইনিই সম্ভবত ওহাবী মৌলভী নওয়াব যমীরুদ্দীন আহমাদ, যিনি দিল্লীতে যমীর মির্যা নামে পরিচিত। তিনি নওয়াব লোহারুর ভাই। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি আহলেহাদীস কনফারেন্স-এর সভাপতি ছিলেন। পরে অসুস্থতাজনিত কারণে ইস্তফা দেন’।[13]
নামের এই বিবরণী থেকে পরিষ্কার যে, রেশমী রুমাল আন্দোলনে আহলেহাদীস মনীষীগণ সমানভাবে শরীক ছিলেন। তাই এ আন্দোলনকে নির্ভেজাল দেওবন্দী আন্দোলন প্রমাণের চেষ্টা ভুল। অথচ দেওবন্দী লেখকগণের নীতি এটাই চলে আসছে। এমনকি মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী পর্যন্ত তার স্বরচিত আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘নক্বশে হায়াত’-এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছেন তাতে উল্লেখিত আহলেহাদীস মনীষীদের একজনের নামও উল্লেখ করেননি। শুধু নিজের ঘরানার লোকদের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উক্ত মূল ডকুমেন্টস্ প্রকাশিত হওয়ার পর এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ আন্দোলনেও আহলেহাদীস আলেমগণ পুরোপুরি শামিল ছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা এতটাই খাঁটি ও দৃঢ় মন নিয়ে আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন যে, আন্দোলনের কোন পর্যায়েই তারা গোপনীয়তা ফাঁস করেননি, যেখানে দেওবন্দী মনীষীগণের অনেকেই দৃঢ়তা ও অবিচলতার প্রমাণ দিতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ ডকুমেন্টস্-এ ১৩ জন লক্ষ্যচ্যুত ব্যক্তির নাম আছে যারা আনেদালনের ক্ষতি করেছেন এবং ইংরেজ সিআইডি-কে তথ্য সরবরাহ করেছেন। এমনকি শায়খুল হিন্দের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও হেজায সফরকালীন সময়ে তার স্থলাভিষিক্ত মাওলানা শাহ আব্দুর রহীম রায়পুরীর মতো ব্যক্তিও শেষ পর্যন্ত অবিচল থাকতে পারেননি। তিনি ইংরেজের সামনে আন্দোলন সংক্রান্ত দায়ের করা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং কিছু অভিযোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন।[14]
গোলাম রসূল মেহেরও ঐসব কথা স্বীকার করেছেন যা আমরা বর্ণনা করেছি। মেহের লিখেছেন, ‘শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান দেওবন্দী স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন দাঁড় করিয়েছিলেন যদিও জামা‘আতে মুজাহিদীনের সাথে সরাসরি তার যোগাযোগ ছিল না, তবুও দু’টি আন্দোলনের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য ছিল। উভয়ের সংকল্পধারা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) ও সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-তে এসে মিলিত হয়েছিল। উভয়ের লক্ষ্যে বিশেষ ধরণের ঐক্য ছিল। উভয় দলই মুসলমানদের মাথা উঁচু করা এবং হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট ছিল। ...তারপরও প্রকাশ যে, শায়খুল হিন্দের নিযুক্ত কর্মীরা প্রয়োজন মুহূর্তে জামা‘আতে মুজাহিদীন-এর নিকট থেকে সাহায্য নিতেন। দুই জামা‘আতের কর্মীদের যেখানে এক পরিমন্ডলে কাজ করার সুযোগ মিলেছে সেখানে তারা এক সাথে মিলেমিশে কাজ করেছেন’।[15]
যাহোক, এ আন্দোলন নিরেট দেওবন্দী আন্দোলন ছিল না; বরং তার আগে ওহাবী আলেমদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল তার লোকজনও এতে শরীক ছিলেন এবং ওহাবী আলেম ও মুজাহিদগণও এই আন্দোলনে পুরো সহযোগিতা করেছিলেন।
৬. এ আন্দোলন দেওবন্দীদের নিজেদেরই দুর্বলতার কারণে কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়নি। কয়েকজন তো প্রথম থেকেই আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। এরূপ লক্ষ্যচ্যুত ১৩ জনের নাম ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ গ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছে। কোন আন্দোলন সফল করতে হ’লে যে ধরনের দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখানো দরকার দেওবন্দী আলেমগণ তা দেখাতে আগাগোড়াই ব্যর্থ ছিলেন। খোদ মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী যেসব পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তা অবিচল ও দৃঢ়চিত্তদের মান থেকে অনেক নীচে। ‘আসীরে মাল্টা’ গ্রন্থে তিনি পুরো নিশ্চয়তা ও নির্ভরতার সঙ্গে বলেছেন যে, হযরত শায়খুল হিন্দ না গালিব পাশা, আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার সাথে দেখা করেছেন, না তার পক্ষে এমন কোন সুযোগ ছিল। কিন্তু তার ‘নক্বশে হায়াত’ গ্রন্থে তিনি এক একটি নকশার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন এবং সেই সাথে তার এরূপ গা বাঁচানো কর্মপদ্ধতির বৈধতার দু’টি ব্যাখ্যা পেশ করেছেন।
এক. সাংকেতিক উত্তর প্রদান- যার দু’টো অর্থ হবে, বক্তা নিবেন দ্বিতীয় অর্থ আর শ্রোতা বুঝবেন প্রথম অর্থ। তিনি বলেছেন, এরূপভাবে কথা বলা মিথ্যা নয় এবং এমন ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তা জায়েয।
গোলাম রসূল মেহের মাওলানা মাদানীর এই ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সাংকেতিক উত্তর’ প্রসঙ্গে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ সম্পর্কে যখন মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীর মতো একজন সম্মানিত আলেম বৈধতার ফৎওয়া দেন তখন আমার মতো অল্প-স্বল্প জানা মানুষের বলার আর কি থাকতে পারে? তারপরেও পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই যে, তার উক্ত কথায় মন তৃপ্ত নয়। আত্মরক্ষার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বনের কথা তিনি বলেছেন, তা-ই যদি কবুল করা হয় তাহ’লে মুজাহিদসুলভ কর্মকান্ড ও সেজন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে বলে বুঝতে হবে। একই সঙ্গে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, শরী‘আতে আযীমত বা অনড় ও অবিচল বিষয় বলে কিছু নেই। যা আছে তা শুধু ছাড় আর ছাড়। মূল লক্ষ্য পূরণে এমনভাবে কাজ করব যে, গায়ে একটু আঘাতও লাগবে না, আঘাত লাগার সম্ভাবনা দেখা দিলে লক্ষ্যের কপালে যা হয় হোক, আমি আগে জান বাঁচাব। লক্ষ্য পূরণের এমন ধ্যান-ধারণা যতক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাসের পৃষ্ঠাসমূহ থেকে অনড় ও অবিচলতার সকল ঘটনা ধুয়ে-মুছে ফেলা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মন কিভাবে তা মেনে নিতে পারে? যা মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী বলেছেন’।[16]
কিন্তু এ লেখকের মতে, বিষয় শুধু আযীমত ও রুখছত কেন্দ্রিক নয়, বরং তাতে ইতিহাস বিকৃতিরও কিছু বিষয় আছে। দেওবন্দের ছোট-বড় সবাই দেশের মুক্তির জন্য ভুল-শুদ্ধ সব রকম আন্দোলনের সমস্ত কৃতিত্ব যেভাবে দেওবন্দী মুরববীদের দেওয়ার চেষ্টা শুরু করছেন, তাতে এ ধরনের পরস্পর বিরোধী কথা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে তারা প্রকৃত অবস্থা থেকে দূরের নানা ব্যাখ্যার সাহায্য নিতে বাধ্য, যা ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া সম্ভব নয়।
যাহোক, কথা হচ্ছিল যে, আন্দোলনে শামিল দেওবন্দী বুযর্গদের কর্মপদ্ধতির দরুন আন্দোলন ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়। যদিও দ্বীনী আন্দোলনে বাহ্যিক সফলতা-অসফলতার কোন গুরুত্ব নেই। দ্বীনী আন্দোলনের কাজের ভিত্তি খালেছ নিয়ত এবং সঠিক কর্মপদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। যদি কোন আন্দোলনে এগুলি মওজুদ থাকে তাহ’লে বাহ্যিক অসফলতা সত্ত্বেও তা সফল। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে বাহ্যিক সফলতা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার নিকট তা সফল বিবেচিত হবে না।
হযরত শায়খুল হিন্দ ও অন্যদের নিয়ত নিশ্চয়ই সঠিক হবে, কিন্তু আন্দোলনের সফলতার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন এবং যে ধরনের কর্মীর দরকার ছিল তা এই আন্দোলনে জোটেনি। দেওবন্দী মুরববীদের অধিকাংশই এ আন্দোলন থেকে বিমুখ ছিলেন। অল্পকিছু যারা শরীক হয়েছিলেন তারা (রাজনীতির ময়দানের) বিদ্যা-বুদ্ধি ও কর্মকান্ডে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে গোলাম রসূল মেহের মরহূম লিখছেন, ‘হযরত মরহূম শায়খুল হিন্দ যে উদ্দীপনা, সততা, সাহসিকতা ও ভক্তি সহকারে কাজ করেছেন সে বিষয়ে এ অধম যার কিনা এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই সে কি-ইবা বলতে পারে। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, মূল পরিকল্পনা যে অবস্থার ভিতর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ তাতে মোটেও মেলেনি। যেহেতু পুরো পরিকল্পনা একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল এজন্য তার কোন দিকই স্থায়ী হয়নি। হযরতের কর্মীবাহিনীও কাজকর্মে, বিদ্যায়-মাহাত্ম্যে, তাক্বওয়া-পরহেযগারিতায়, পরার্থপরতায়-আত্মত্যাগে এবং সাহসিকতা ও নিজের উপর অন্যকে প্রাধান্য দানে নিজের তুলনা নিজেই ছিলেন। এদের কারো ইসলামী উদ্দীপনা ও আযাদীর স্পৃহা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত মুহূর্তের জন্যও নিস্তেজ হয়নি। কিন্তু আমি শত আদব সহকারে এ কথা বলার অনুমতি চাইছি যে, যে সকল কাজে এই মনীষীরা নিজেদের নিযুক্ত করেছিলেন তা সব দিক দিয়ে তাদের উপযোগী ছিল না। যে জেনারেল বিপদসংকুল স্থানে সৈনিকদের নেতৃত্ব দানের হিম্মত রাখেন, রাজনৈতিক ময়দানেও তিনি যে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন তা যরূরী নয়’।[17]
৭. আন্দোলনের দিনগুলিতেও দারুল উলূম দেওবন্দ সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন থেকে শুধু আলাদাই ছিল না; বরং আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীতে ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রমাণে ব্যস্ত ছিল। যার বিবরণ ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে। যার পরিষ্কার অর্থ দেওবন্দের মুরববীগণ এ আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এ কারণেই শায়খুল হিন্দ, মাওলানা মাদানী ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্যদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখনও দারুল উলূম দেওবন্দে তার কোন আঁচড় পড়েনি এবং সেখানে ধর-পাকড়ের কোন বালাই দেখা যায়নি। এ আন্দোলনকে বরং কিছু লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপার মনে করা হয়। এমন যদি না হ’ত তাহ’লে নিশ্চিতরূপে দারুল উলূমের দায়িত্বশীলদের ইংরেজ সরকারের নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচা কস্মিনকালেও সম্ভব ছিল না।
তাছাড়া শায়খুল হিন্দ ও অন্যদের গ্রেফতারের পর দেওবন্দের আলেমগণ যে পথ-পন্থা অবলম্বন করেন তাতে তো একথা পরিষ্কারভাবে সামনে এসে যায় যে, সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সাথে দেওবন্দের আলেমদের কোন সম্পর্ক ছিল না এবং রাজনীতি থেকে তারা সম্পূর্ণ আলাদা ছিলেন। গ্রেফতারের পর দেওবন্দের আলেমগণ শায়খুল হিন্দ ও অন্যদের মুক্তির জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তাতে তারা তিনটি বিষয় বিশেষভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পান।
এক. শায়খুল হিন্দকে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দুই. দেওবন্দী আলেমদের মতো তিনিও রাজনৈতিক জটিলতা থেকে দূরে ছিলেন।
তিন. দেওবন্দী আলেমদের জামা‘আত সম্পূর্ণ নীরব জামা‘আত এবং রাজনীতির সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন। এ ধরনের আন্দোলন সমূহের সাথে তাদের মোটেও কোন সংযোগ নেই।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে দেওবন্দের আলেমগণ এ প্রসঙ্গে ইংরেজ গভর্ণরের নিকট সম্মিলিতভাবে যে দরখাস্ত পেশ করেন তাতে উক্ত তিনটি বিষয় গুরুত্বের সাথে এবং বার বার বলা হয়েছে।
আমরা পুরো দরখাস্ত এবং দেওবন্দের মাসিক ‘আর-রশীদ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় নোট নামে যে ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার অনুলিপি এখানে উদ্ধৃত করছি। যে যুগে জিহাদ আন্দোলনের ওহাবী মুজাহিদগণ ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জান কুরবান করছিল সে যুগে দেওবন্দের আলেমদের রাজনৈতিক অবদানের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও মুজাহিদসুলভ কর্মকান্ডের চৌহদ্দী কতদূর কি ছিল, এ দরখাস্তের আলোকে যে কেউ তা দেখতে পাবেন। যার ঢাক-ঢোল এখন খুব জোরেশোরে পিটানো হচ্ছে। (দরখাস্তের পুরো কপি ‘আর-রশীদ’ পত্রিকা, দেওবন্দের সম্পাদকীয় নোটসহ পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে দ্রষ্টব্য)
[1]. বরং তার বিপরীতে ইংরেজ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রমাণ ১৮৭৫ সালে মিস্টার পামার প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায়, যা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। এছাড়া শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান কর্তৃক ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত পার্টি ‘জমঈয়াতুল আনছার’-এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসাবে যেসব প্রস্তাব মঞ্জুর করা হয়েছিল, তন্মধ্যে একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য এমন ছোট ছোট পুস্তিকা বেশী বেশী প্রকাশ করতে হবে যাতে ইসলামী আক্বায়েদ শিক্ষাদান, আর্য সম্প্রদায়ের প্রশ্নের উত্তরদান এবং সরকারের প্রতি আনুগত্যের বার্তা মেলে’ (মুফতী আযীযুর রহমান, তাযকেরায়ে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ১৭২, ইদারায়ে মাদানী দারুত তালীফ, বিজনৌর, ভারত)।
[2]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ১৮।
[3]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮।
[4]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬০।
[5]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৮।
[6]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪০।
[7]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮।
[8]. নক্বশে হায়াত ২/২৪০ পৃ., টীকা দ্র.।
[9]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ২৬১-২৬২।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২ দ্রষ্টব্য।
[11]. বিস্তারিত জানতে নক্বশে হায়াত ২/২৩৮-২৪০ পৃ.।
[12]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, পৃ. ২৩৯।
[13]. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ, উদ্ধৃতির ক্রমানুযায়ী পৃষ্ঠা নং ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৯৬, ৩৯৯, ৪০০, ৪০১, ৪১৯, ৪৪৭, ৪৫০, ৪৫২, ৪৬৫, ৪৭০, ৪৭৫, ৪৮২, ৪৮৫।
[14]. নক্বশে হায়াত ২/২০৪ পৃ.।
[15]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, ৯ম অধ্যায়, পৃ. ৫৫২।
[16]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ৫৬২।
[17]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ৫৬১।
মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীস আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীস আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
Last edited: