১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ওহাবী মুজাহিদদের অবদান
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ কি বিদ্রোহজনিত সংগ্রাম ছিল? নাকি কোন সঠিক উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য জিহাদের একটি অংশ ছিল? নাকি জাতিগত যুদ্ধ ছিল? এ নিয়ে মতপার্থক্যের অবকাশ আছে। তবে তা যে জিহাদ আন্দোলন থেকে ভিন্ন ছিল, সেটি খুবই পরিষ্কার। এজন্য কিছু লোক মনে করেন, মুজাহিদরা যেহেতু একটি দ্বীনী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাই তারা এই জাতিগত যুদ্ধে অংশ নেননি।[1] কিন্তু আরেক দল পর্যবেক্ষকের মতে এ জাতিগত যুদ্ধে ওহাবী মুজাহিদগণ তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে অংশ নিয়েছিলেন। ঘটনাবলীর আলোকে এ মতই অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়। কেননা ১৮৫৭ সালেও মুজাহিদদের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধ ও সংঘর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়। যার উল্লেখ উইলিয়াম হান্টার তার ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং গ্রন্থে (উর্দূ অনুবাদ : হামারে হিন্দুস্তানী মুসলমান) করেছেন।
গোলাম রসূল মেহেরও ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ গ্রন্থে মুজাহিদদের সেসব যরূরী কাজকর্মের উল্লেখ করেছেন যা অবস্থা প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে তারা আঞ্জাম দিয়েছিলেন।[2]
এছাড়া খালীক আহমাদ নিযামীও ওহাবী মুজাহিদদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার কথা যারা তুলেছেন তাদের দাবী প্রমাণসহ খন্ডন করেছেন। তিনি ‘১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা’ (১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক দিনলিপি) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আন্দোলনে (অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনে) কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণকারী অনেককেই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। বখত খাঁ সম্পর্কে আমাদের ধারণা হ’ল, তিনিও মুজাহিদীন জামা‘আতের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বাহাদুর শাহের মামলা চলাকালে তাকে ‘ওহাবী আক্বীদা’ পোষণকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। যে কেউই হান্টারের ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং পড়েছেন তিনিই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ঐ সময়ে ওহাবী শব্দ সাইয়েদ ছাহেব ও তার সমমনা আলেমদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হ’ত। আর হান্টারের কথা মতে তো ‘ওহাবী’ ও ‘বিদ্রোহী’ সমার্থক ছিল।
বখত খাঁ আলেমদের সাথে যেভাবে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতেন তাতেও এটা ফুটে ওঠে যে, তিনি সাইয়েদ ছাহেবের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আন্দোলনে অংশ নিতে তিনি যখন দিল্লীতে উপস্থিত হন, তখন একশ’ জন আলেম তার সাথী হয়েছিলেন। সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে টোংক থেকে ওহাবী আলেমদের একটি দল তার কাছে এসেছিলেন। এছাড়াও জয়পুর, ভূপাল, ঝাঁসী, হাসারা ও আগ্রা থেকে বহু আলেম তার পাশে ছুটে এসেছিলেন... মাওলানা লিয়াকত আলী এলাহাবাদীও এই চিন্তাধারার মুজাহিদ বলে মনে হয়... মাওলানা এনায়েত আলী ছাদেকপুরী, যার চেষ্টায় মর্দানে ৫৫ নং রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছিল। তিনি তো সাইয়েদ ছাহেবের খলীফা এবং মুজাহিদ জামা‘আতের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শহীদে আলীগড় মাওলানা আব্দুল জলীল ছিলেন সাইয়েদ ছাহেবের অন্যতম খলীফা। তিনি সাহসিকতার সাথে ইংরেজ শক্তির মুকাবিলা করেছিলেন। উল্লেখিত নামকরা ক’জন ব্যক্তি বাদেও ১৮৫৭ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরো অনেকেই সাইয়েদ ছাহেবের জামা‘আতের লোক অথবা সমমনা মানুষ ছিলেন। আর সম্ভবত এই কারণেই কিছু লোক ১৮৫৭ সালের সংগ্রামকে মুসলমানদের সংগ্রাম বলে অভিহিত করে থাকেন।[3]
জনৈক ইংরেজ লেখকের রায়ের প্রতিবাদে তিনি লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত যে, ওহাবীরা এ আন্দোলনে সামনে-পিছনে সব সারিতে ছিলেন। যুদ্ধ শেষে হিন্দুস্থানে ইংরেজদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা ওহাবীদের কঠোর সাজা দিয়েছিল এবং এ চিন্তাধারার লোকদের (চাকুরী, ব্যবসায় ইত্যাদি থেকে) তাড়িয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধোত্তর ওহাবীদের এই কঠোর সাজা প্রদানই প্রমাণ করে যে, ওহাবীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।[4]
‘হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক’ (হিন্দুস্থানে ওহাবী আন্দোলন) বইয়ের লেখকও ১৮৫৭ সালে ওহাবী মুজাহিদদের কর্মকান্ডের কম-বেশী বর্ণনা প্রদান করেছেন।
মোটকথা এ আলোচনার উদ্দেশ্য, ১৮৩১ সালে শহীদায়েনের শাহাদাতের পরে ছাদেকপুরী পরিবার জিহাদের পতাকা ও আন্দোলনের নেতৃত্ব যেভাবে সামাল দিয়েছিলেন তা স্বাধীনতা, দৃঢ়তা ও অবিচলতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। ১৮৫৭ সালের সংগ্রামের নেতৃত্ব যদিও ওহাবী মুজাহিদদের হাতে ছিল না, কিন্তু তারা তাতে অবশ্যই অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মাওলানা বাটালভী ও আহলেহাদীস জামা‘আত : একটি সংশয় নিরসন
কিছু লোক বলেন যে, ‘ওহাবী’ দ্বারা শুধু আহলেহাদীস উদ্দেশ্য নয়; বরং মাযহাব-সম্প্রদায় নির্বিশেষে যারাই ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তারা সবাই ওহাবী। এতে হানাফী-অহানাফী সবাই শামিল রয়েছেন। সত্য এই যে, সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর জীবদ্দশায় নিঃসন্দেহে হানাফী-আহলেহাদীস উভয়েই আন্দোলনে শরীক ছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে হানাফীরা ধীরে ধীরে আন্দোলন থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। যেমন মৌলভী মাহবূব আলী দেহলভী[5], মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী[6] প্রমুখ।
বালাকোটের দুঃখজনক ঘটনার পর আন্দোলনের নেতৃত্ব ছাদেকপুরী পরিবারের হাতে এসে গিয়েছিল। তারা ছিলেন হাদীস অনুযায়ী আমলকারী তথা আহলেহাদীস। এই পরিবার ও তাদের চিন্তাধারার লোকেরাই একশ’ বছরের বেশী সময় ধরে এই জিহাদ আন্দোলনকে জীবিত রেখেছিলেন। এমনকি ‘ওহাবী’ (আহলেহাদীস) ও ‘বিদ্রোহী’ সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে পরবর্তীকালে ওহাবী শব্দটি আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকদের জন্যই খাছ হয়ে যায় এবং ওহাবী শব্দ দ্বারা সর্বদা আহলেহাদীসদেরকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এমনি করে ওহাবী শব্দটি আহলেহাদীসের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী, যিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলেহাদীসের চিন্তা-চেতনার বিপরীত মত পোষণ করতেন, তিনি স্বীয় প্রচেষ্টায় সরকারের নিকট থেকে এই সিদ্ধান্ত পাশ করান যে, আহলেহাদীসকে যেন আহলেহাদীস বলা হয়, তাদেরকে যেন ওহাবী বলা না হয়। (এ বিষয়ে আলোচনার জন্য স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধ প্রয়োজন) তা সত্ত্বেও অবস্থার কোন হেরফের হয়নি। কেননা মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী মরহূমের ইংরেজ সরকারের বশ্যতা স্বীকারকে আহলেহাদীস জামা‘আত মেনে নেয়নি এবং সমষ্টিগতভাবে তারা জিহাদ আন্দোলনে শামিল ও মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতায় সদা সচেষ্ট ও তৎপর থাকে। এজন্যই ‘ওহাবিয়াত’ পরিভাষার মধ্যে শির্ক, বিদ‘আত ও জাহেলী রসম-রেওয়াজ উচ্ছেদের সাথে সাথে ইংরেজ বিরোধিতাও শেষ অবধি থেকে যায়। এ কারণেই আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকজন ইংরেজ সরকারের চোখে সর্বদা কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে এবং তাদের ধর-পাকড়ের ধারা আগে যেমন ছিল তেমনই চলতে থাকে। যেমনটা কাযী আব্দুর রহীম মরহূমের ভাষায় ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে যে, প্রত্যেক আহলেহাদীস মসজিদ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মুওয়ায্যিন অথবা খাদেম হিসাবে ইংরেজ কর্মচারীরা গুপ্তচরবৃত্তি করত। এছাড়াও সাইয়েদ সুলায়মান নাদভীর স্বীকারোক্তিও ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদীর যিন্দেগী পর্যন্ত আহলেহাদীস জামা‘আতের মধ্যে জিহাদের রূহ কার্যকর ছিল। মাওলানা রহীমাবাদী ১৯১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কাযীকোট (গুজরানওয়ালা)-এর ‘বোম কেস’-এর ঘটনা ১৯২১ সালে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে আহলেহাদীসের লোকদের সাজা দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদী, মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরী, মাওলানা আব্দুর রহীম বিন মাওলানা রহীম বখশ ওরফে মাওলানা মুহাম্মাদ বশীর শহীদ, আমীরুল মুজাহিদীন ছূফী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (রহঃ) ছাড়াও আরো অনেকে পরবর্তীতে জিহাদের পবিত্র মিশনকে জীবিত রেখেছিলেন এবং এ পথের সকল বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিলেন। যার কিছু বিবরণ ‘মুশাহাদাতে কাবুল ওয়া ইয়াগিস্তান’, ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ ও অন্যান্য বইয়ে পাওয়া যাবে। ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ গ্রন্থে এ বিবরণ ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরবর্তীকালে মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতার বেশীর ভাগ কাজ আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকেরাই আঞ্জাম দিয়েছেন।
এতদ্ব্যতীত রেশমী রুমাল আন্দোলনের সরকারী রিপোর্ট সংবলিত আসল যে দলীল-দস্তাবেয ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ বা শায়খুল হিন্দের আন্দোলন নামে ছাপা হয়েছে তাতেও আহলেহাদীস ব্যক্তিবর্গ ও আলেমদের নাম দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, ঐ দলীল-দস্তাবেযে আহলেহাদীস ব্যক্তিবর্গ ও আলেমদেরকে সবখানে ‘ওহাবী মৌলভী’, ‘গোঁড়া’, ‘উন্মাদ’ ইত্যাদি শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে কোন হানাফীকে ওহাবী বলা হয়নি। (এর বিস্তারিত বিবরণ রেশমী রুমাল আন্দোলন শিরোনামে সামনে আসছে।)
মাওলানা ওবায়দুললাহ সিন্ধীও এ কথা স্বীকার করেন যে, জিহাদ আন্দোলনে গায়ের মুক্বাল্লিদদের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। বরং তার মতে জিহাদ আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ এই একটা জিনিসই।
মাওলানা সিন্ধীর ধারণার সমালোচনা করতে গিয়ে মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী লিখেছেন, ‘মাওলানা সিন্ধীর মতে, সাইয়েদ আহমাদ শহীদের আন্দোলন সফল না হওয়ার কারণ এটাই মনে হয় যে, এতে শাওকানিয়াত, ওহাবিয়াত অথবা আরো পরিষ্কার করে বললে, গায়ের মুক্বাল্লিদিয়াতের সংমিশ্রণ ঘটেছিল’।[7]
মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী মাওলানা সিন্ধীর এ মত সম্পর্কে বলেন, ‘এই আন্দোলনের ঝান্ডাবাহীদের মধ্যে ফিক্বহী ঝগড়া-ঝাটি অথবা জোরে আমীন ও রাফ‘উল ইয়াদায়েনের মাধ্যমে বিদ‘আত উৎখাত কিংবা সুন্নাতের অনুসরণের চিন্তা কখনোই স্থান পায়নি। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ ও অন্যান্য যারা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের লেখা বই-পুস্তক, বক্তৃতা-বিবৃতি, তর্ক-বিতর্ক, পত্রাবলী ইত্যাদি মওজুদ আছে। সেসব থেকে দলীল দিতে হবে। জিহাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল আক্বীদা-বিশ্বাসের সংস্কার, আমল সংস্কার, তাওহীদের প্রচার-প্রসার, বাতিল খন্ডন, অবৈধ রসম-রেওয়াজের অবসান ঘটানো এবং ইসলামী বিধি-বিধান চালু করা। বাকী যেসব কথা তাদের নামে বলা হয় তা দু’একজনের কথা, যা এ ক্ষেত্রে দলীল হওয়ার উপযুক্ত নয়। ... তবে এটা হ’তে পারে যে, এ আন্দোলন ইত্তেবায়ে সুন্নাতের যে জায্বা সৃষ্টি করেছিল তার প্রভাবে বর্তমানে প্রাপ্ত হাদীসের গ্রন্থগুলিতে প্রথমবারেই যা সুন্নাত বলে নযরে ধরা পড়ে তা গ্রহণ করতে কিছু লোককে কোন তাক্বলীদী চিন্তা বিরত রাখতে পারেনি’।[8]
মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভীর এই পর্যালোচনা বড়ই বাস্তবসম্মত ও যাচাইকৃত। নিঃসন্দেহে ওহাবী মুজাহিদগণ ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েলকে ঝগড়া-ঝাটির মাধ্যম বানাননি। তারা জিহাদের উপরেই তাদের আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছিলেন। এ কারণেই আহলেহাদীস জনগণ ছাড়াও তারা অন্যান্য শ্রেণীর লোকদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। তারপরেও এ সত্য অনস্বীকার্য যে, যেহেতু তারা নিজেরা ছিলেন হাদীস অনুযায়ী আমলকারী এবং তাক্বলীদী জড়তা থেকে দূরে, সেহেতু তারা যেখানে যেখানে গিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষের যে যে মজলিসেই তাদের কথা বলা ও প্রভাব ফেলার সুযোগ মিলেছিল, সেখানে সেখানেই তাওহীদ ও সুন্নাতের মশাল জ্বলে উঠেছিল এবং তাক্বলীদের বন্ধন ভেঙ্গে খানখান হয়ে গিয়েছিল। আর জিহাদ আন্দোলনের এই দিকটাই মাওলানা সিন্ধী ও অন্যান্যদের গাত্রদাহ ও অন্তর্জ্বালার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন!
তাই মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী যদিও ‘ওহাবী’র পরিবর্তে ‘আহলেহাদীস’ শব্দের ব্যবহার সরকার থেকে মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার এ চেষ্টা জিহাদ আন্দোলনের উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকেরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জিহাদ আন্দোলনে উদ্দীপ্ত ও সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং মাওলানা বাটালভীর চেষ্টায় আহলেহাদীস জামা‘আতের মোড় ইংরেজ বিরোধিতার পরিবর্তে ইংরেজ আনুগত্যের দিকে ফিরে যাওয়ার দাবী একেবারেই অবাস্তব।
মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী গুজরানওয়ালা (রহঃ) এই একই বিষয়ে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আহলেহাদীসের পক্ষ থেকে ইংরেজদের সহযোগিতার উল্লেখযোগ্য কোন আওয়ায যদি উঠে থাকে তবে তা ছিল মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী মরহূমের আওয়ায। তবে এটা সুনিশ্চিত যে, এ আওয়াযে মাওলানা একাই ছিলেন। এটি তার ব্যক্তিগত মত ছিল। অবিভক্ত হিন্দুস্থানের উল্লেখযোগ্য কোন আহলেহাদীস এ দৃষ্টিভঙ্গিতে তার সাথে সহমত পোষণ করেননি। বরং যে সময়টায় মাওলানা তার পুস্তিকা ও লেখনীতে ইংরেজদের সহযোগিতা করে চলছিলেন, ঠিক সে সময়েই হিন্দুস্থান ও পাঞ্জাবে আহলেহাদীস জামা‘আতের বুযর্গগণ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর আন্দোলন সফল করার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। কোন গযনভী ও লাখভী খান্দান অথবা ছাদেকপুরী, রহীমাবাদী ও ক্বাছূরী বুযর্গদের কেউ কি মাওলানা বাটালভীর পক্ষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ছিলেন? সুতরাং মাওলানা বাটালভীর কাজকে আহলেহাদীস জামা‘আতের সমষ্টিগত কাজ বিবেচনা করলে বাস্তবতার উপর যুলুম করা হবে’।[9]
একইভাবে এ কথাও সম্পূর্ণ অসত্য যে, ওহাবী মুজাহিদীন বলতে হানাফী-আহলেহাদীস উভয়কেই বুঝায়। বরং সত্য এই যে, ওহাবী দ্বারা কেবল আহলেহাদীসকে বুঝানো হয়েছে, অন্য কাউকে নয়।
মোটকথা, এই বিবরণের উদ্দেশ্য এ সত্য তুলে ধরা যে, সাইয়েদায়েনের শাহাদাতের পর এই জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনকে যারা জীবিত রেখেছিলেন এবং এজন্য নিজেদের জান-মাল অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তারা ছিলেন কেবলই আহলেহাদীস। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। তারপর যখন ১৯১৯ সালে ও তার পরবর্তীকালে ‘খেলাফত আন্দোলন’, ‘অসহযোগ আন্দোলন’, ‘জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দ’ ‘আহরার’ ইত্যাদির মতো ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতীয় আন্দোলন ও সংগঠন সমূহের সূত্রপাত হল, তখন সেগুলিতে অবশ্য দেওবন্দী আলেমদের দেখা মিলতে লাগল। তখনো কিন্তু আহলেহাদীস আলেমরাও প্রতিটি আন্দোলনে দেওবন্দী বুযর্গদের সাথে সমানভাবে শরীক থেকেছেন। উল্লেখিত আন্দোলন ও সংগঠনগুলির রিপোর্ট দেখলেই তা বুঝা যাবে। তাতে অবশ্যই মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী, মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আহরার সহ আহলেহাদীস জামা‘আতের আরো অনেক আলেম ও ব্যক্তির নাম পাওয়া যাবে।
একইভাবে ক্বাছূরী বংশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যেমন মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী, তার পুত্র-পৌত্রগণ, তথা মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরী, মাওলানা মুহিউদ্দীন আহমাদ ক্বাছূরী প্রমুখের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় খিদমতকে কে ভুলতে পারে? এই গুরুজনেরা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে জানমালের অমূল্য কুরবানী পেশ করে গেছেন। কবির ভাষায়,
‘পাক-পবিত্র স্বভাবের এই প্রেমিকজনদের উপর মহান আল্লাহ রহমত বর্ষণ করুন’! আমীন!
জিহাদ আন্দোলন ও হানাফী আলেমগণ
পূর্বের বিস্তারিত আলোচনায় এ কথার স্পষ্ট খন্ডন হয়ে গেছে যে, হানাফী আলেমগণও কোন পর্যায়ে জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাস্তবতা এই যে, সাইয়েদ আহমাদ শহীদের জীবদ্দশায় যদিও হানাফী (ঐ সময়কার হানাফীরা দেওবন্দী বা ব্রেলভী হানাফী অবশ্যই ছিলেন না। তারা ছিলেন অলিউল্লাহী হানাফী, যাদের মাঝে তাক্বলীদী গোঁড়ামি ছিল না) ও আহলেহাদীস উভয় গোষ্ঠীর লোক এ আন্দোলনে শরীক ছিল বলে দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ আন্দোলনের সকল নেতৃত্ব তারাই দিয়েছিলেন যারা তাক্বলীদের বন্ধন থেকে শুধু মুক্তই ছিলেন না; বরং তাদের তাবলীগ ও প্রচারের ফলে তাক্বলীদের শৃঙ্খল টুটে যাচ্ছিল এবং হাদীস অনুযায়ী আমলের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যত ধর-পাকড় হয়েছে, যত সহায়-সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত হয়েছে এবং যত শাস্তি-সাজা হয়েছে তার তালিকার শীর্ষে ছাদেকপুরী পরিবারের নাম আসবে। এ পথে এই পরিবার যে দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখিয়েছেন, যে যে বালা-মুছীবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত। (এ বিষয়ের যরূরী বিবরণ মাওলানা মাসঊদ আলম নাদভীর ‘হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক’ গ্রন্থে দেখা যেতে পারে)। এই বেদনাবিধুর বিবরণে ও জিহাদের ইতিহাসে কোথাও হানাফী আলেমদের নাম নযরে আসে না। কিন্তু ছাদেকপুরী পরিবারের উদ্যমী মর্দে মুজাহিদগণ এ পথে তাদের সব কিছু কুরবানী দিয়েছিলেন। তাই হানাফী সাধকদের উদ্দেশ্যে এ পরিবার যথার্থই বলতে পারেন কবির ভাষায় :
كا مل اس فر قئہ زُهادسے اٹها نہ كو ئ
جو چند ہوئے تو يہى رندان قدح خوار ہوئے
‘এই সাধক দলের মাঝে কামেল কেউ আবির্ভূত হননি। দুয়েকজন যারা হয়েছেন তারা সাধনায় একেবারে বুঁদ হয়ে গিয়েছেন’।
হানাফী লেখকদের মনগড়া ইতিহাস :
এটা বড়ই দুঃখজনক যে, আজকাল হানাফী লেখকগণ হানাফী আলেমদের (১৮৫৭ সালের) স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরপুরুষ বানানোর চেষ্টা করেন। অথচ বীরপুরুষ হওয়া তো দূরের কথা, তারা এ যুদ্ধে মোটে অংশই নেননি। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধ আসলে জিহাদ আন্দোলনের অংশ ছিল কি-না, তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে। কেননা তাতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষই শামিল ছিল। কিন্তু তার আগে ও পরে যে জিহাদ আন্দোলন অব্যাহত ছিল তা ছিল এক নির্ভেজাল দ্বীনী আন্দোলন। এ আন্দোলন ইংরেজদের হয়রান-পেরেশান ও বেহাল দশা করে ছেড়েছিল এবং এ জিহাদ আন্দোলনই ছিল হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাইল ফলক। এই জিহাদ আন্দোলনে ১৮৫৭ সালের পরে হানাফী আলেমগণ কবে কোথায় শরীক ছিলেন? তারা কি ধরনের কাজ আঞ্জাম দিয়েছিলেন? কি কি বালা-মুছীবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন তারা হয়েছিলেন? কে আছেন যিনি তাদের নাম-ঠিকানা তুলে ধরতে পারবেন? তার প্রমাণ যোগাড় করতে পারবেন?
শামেলী যুদ্ধের ঘটনা :
খুব কষ্ট করে প্রমাণ করা এক ঘটনা হল শামেলী যুদ্ধের ঘটনা। এ যুদ্ধে যেন ক্বিয়ামত বয়ে গিয়েছিল এবং তাতে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতাগণ অংশ নিয়েছিলেন- এমনি ধারার জোরালো প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হয়। এমনকি এ ঘটনার ভিত্তিতে দেওবন্দী আলেমদের ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের হিরো প্রমাণ করা হয়। কিন্তু প্রথমত এ যুদ্ধের যে বর্ণনা বর্তমানকালে তুলে ধরা হয় তা আপত্তির ঊর্ধ্বে নয়। এ যুদ্ধে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানূতুভী, মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী, হাফেয যামেন শহীদ ও তাদের পীর মুর্শিদ হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জোরেশোরে উল্লেখ করা হয়। অথচ এটা বড়ই বিস্ময়কর যে, মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহীর প্রথম জীবনী লেখক মাওলানা আশেক এলাহী মীরাঠী ‘তাযকিরাতুর রশীদ’ গ্রন্থে শামেলী ও তার পরবর্তী ঘটনার বিস্তারিত যে বিবরণ তুলে ধরেছেন তাতে এ ঘটনা যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের কোন অংশ ছিল তার নিশ্চয়তা মেলে না। বরং সে বিবরণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শামেলীর এ ঘটনা ছিল মূলত ফাসাদী বা দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে দেওবন্দী মুরববীদের লড়াই। (তাযকিরাতুর রশীদ-এর ভাষায় ১৮৫৭ সালের রাজনৈতিক হাঙ্গামায় অংশগ্রহণকারীদের ফাসাদী বা দাঙ্গাবাজ বলা হয়েছে।)
সেই লড়াইয়ে দুই ‘ফাসাদীর’ গুলীতে হাফেয যামেন শহীদ হন। কিন্তু সরকারকে এ ঘটনার ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়। যার ভিত্তিতে মাওলানা নানূতুভী ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। মাওলানা নানূতুভী ও মাওলানা গাঙ্গুহী আত্মগোপন করেন, কিন্তু হাজী এমদাদুল্লাহ ছাহেব লুকিয়ে মক্কায় হিজরত করেন। কিছুদিন পর মাওলানা গাঙ্গুহীর মামলা চালু হ’লে তিনি আদালতে তার যবানবন্দীতে বলেন, ‘আমরা এই দাঙ্গাবাজদের থেকে যোজন যোজন দূরে’। ফলতঃ আদালতেও তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। আবার আদালতের দৃষ্টিতেও তারা জিহাদের অপরাধে ‘অপরাধী’ গণ্য হননি। এজন্য তাদেরকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
‘তাযকিরাতুর রশীদ’ গ্রন্থকারের উল্লেখিত বিবরণ সম্পর্কে আজকাল দেওবন্দী হানাফীরা বলেন যে, উক্ত জীবনীকার ইংরেজদের ভয়ে ঘটনার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টোভাবে তুলে ধরেছেন। আসলে ঘটনা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে, কিন্তু তিনি কৌশল ভেবে তা ইংরেজদের পক্ষে বানিয়ে দিয়েছেন। যাতে দেওবন্দী আলেমগণ ইংরেজদের ধর-পাকড় থেকে রেহাই পান এবং কোন ক্ষেত্রে তারা যে ইংরেজ বিরোধী কাজকর্মে অংশ নিয়েছিলেন তা অজ্ঞাত থাকে। কিন্তু প্রথমত একজন বিশ্বস্ত জীবনী লেখক থেকে আশা করা যায় না যে, তিনি কোন ঘটনা এমনভাবে বিকৃত করবেন যে তার আসল রূপই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়তঃ যখন দাবী করা হচ্ছে যে, দেওবন্দী আলেমগণ জিহাদ আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ও স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন তখন তা গোপন করার উদ্দেশ্য কী? তার স্পষ্ট উদ্দেশ্য তো এই যে, উল্লেখিত মুরববীদের ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ সঠিক প্রমাণিত হওয়ার পর তারা এক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করলে তখনই কেবল শামেলীর ঘটনা গোপন করা তাদের জন্য মানানসই হ’ত এবং ইংরেজরাও বুঝত যে, দেওবন্দের বর্তমান প্রজন্ম এখন যেভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে আলাদা হয়ে পঠন-পাঠনে ব্যস্ত রয়েছেন, তাদের প্রথম দিকের বুযর্গরাও একই কাজে মশগুল ছিলেন।
‘তাযকিরাতুর রশীদ’ গ্রন্থকারের বর্ণনা যদি ‘কৌশল’ বলে ধরে নেওয়া হয় তাহ’লেও নিশ্চিত রূপে এ কথা প্রমাণিত হবে যে, মাত্র একটি ঘটনাতে সীমিত পরিসরে শুধু কয়েকজন মুরববী জিহাদী তৎপরতায় অংশ নিয়েছিলেন। ব্যস এতটুকুই! না এর আগে কোন যুদ্ধে তারা তৎপরতা দেখিয়েছেন, না পরে।
মাওলানা মানাযির আহসান গীলানীর বর্ণনা :
শামেলীর ঘটনার যে চিত্র আজকালকের হানাফীরা প্রমাণ করতে চান তা সঠিক হলেই কেবল তাদের বর্ণিত কাহিনী সত্য হ’তে পারে। কিন্তু বাস্তবতা তো এই যে, শামেলীর ঘটনাকে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং মুজাহিদ আন্দোলনের অংশ প্রমাণ করাই অসম্ভব। মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’ নামে মোটা মোটা তিন খন্ডে মাওলানা নানূতুভীর যে জীবনী লিখেছেন তাতে তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাওলানা নানূতুভী এবং তার ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের সাথী-বন্ধুদের কোন ভূমিকা ছিল না। উক্ত গ্রন্থে তিনি ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার কিছু উদ্ধৃতি নিচে প্রদত্ত হ’ল :
‘আজকাল শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণতা, গৌরব ও মাহাত্ম্যের সবচেয়ে বড় মানদন্ড হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ। রাজনৈতিক অঙ্গনে যিনি যত বড় ভূমিকা পালন করেন তিনি তত বড় মাপের মানুষ হিসাবে বিবেচিত হন। অন্যান্য ময়দানে তার ভূমিকা যাই হোক না কেন, তিনি যে মর্যাদারই অধিকারী হোন না কেন নিজেকে রাজনৈতিক ময়দানের খেলোয়াড় প্রমাণ করতে না পারলে তিনি কিছুই নন। এই সাধারণ মানদন্ড দেখে কোন বাছ-বিচার না করে এ কথা মেনে নেওয়া যায় না যে, সিপাহী বিদ্রোহের আগুনে আমাদের নেতা ও মহান ইমামও (মাওলানা নানূতুভী) ঠিক সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যেভাবে দেশের সাধারণ জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমাদের নেতা ও মহান ইমামের নীতি অনুসারে এ ধরনের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক নয় এবং ঘটনাবলী থেকেও তার সমর্থন মেলে না’।[10]
অন্য এক স্থানে তিনি লিখেছেন, ‘এতটুকু কথা সর্বাবস্থায় নিশ্চিত এবং চাক্ষুস সাক্ষ্যের দাবী মতে অনস্বীকার্য যে, অন্যান্যদের সাথে বিদ্রোহের হাঙ্গামা ছড়িয়ে দিতে আমাদের নেতা ও মহান ইমাম এবং তার ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের সাথী-বন্ধুদের হাত থাকার দাবী কল্পনার ফানুস ছাড়া কিছু নয়। আর এমন উড়ো কথার কোন মূল্য নেই। বরং ঘটনা তাই যা গ্রন্থকার আশেক এলাহী মিরাঠী লিখেছেন, ‘মাওলানা ফাসাদীদের থেকে বহু যোজন দূরে ছিলেন’।[11]
শামেলীর ঘটনার আসল চিত্র :
রটনা যখন এত তখন শামেলীর ঘটনার আসল চিত্র কি ছিল? তার বিবরণ মাওলানা গীলানী এভাবে তুলে ধরেছেন যে, থানাভুনের কিছু লোককে স্থানীয় ইংরেজ শাসকরা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। তাদের মধ্যে কাযী পরিবারের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে তার বড় ভাই এতই ব্যথিত হন যে, জীবনের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এহেন অবস্থা দেখে স্থানীয় লোকজন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করে, যারা ভুল তথ্যের কারণে অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার ও উত্তরাধিকারীরা মযলূম। এই মযলূমদের সাহায্য করা এবং যালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা যরূরী। এজন্য তারা তাদের নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে স্থানীয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাতে ঐ মুরববীগণও (দেওবন্দের আলেমগণ) অংশ নিয়েছিলেন। মাওলানা গীলানীর ভাষ্য মতে, অনেকটা নিম্নের হাদীস তামিল করতে গিয়ে তারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদের হেফাযত করতে গিয়ে নিহত হ’ল সে শহীদ। আর যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের হেফাযত করতে গিয়ে নিহত হ’ল সে শহীদ’।[12]
এ যুদ্ধে যেহেতু কিছু ইংরেজ নিহত হয়েছিল তাই পরবর্তীতে মাওলানা নানূতুভীসহ কতিপয় লোককে বেশ কয়েকবার গোপনে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাওলানা নানূতুভী প্রতিবারই অস্বাভাবিক ও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তারপরেও এই সন্দেহজনক অবস্থা ১৮৬১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর ইংরেজ সরকার তাকে বিপজ্জনকদের তালিকা থেকে বাদ দেয়।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এতটুকুই, যাকে মাওলানা গীলানী তার নিজস্ব শৈলী অনুযায়ী একটু বিস্তারিত লিখেছেন। শেষে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যাহোক প্রাথমিক কারণ সমূহের প্রেক্ষিতে যদিও থানাভুনের এই জিহাদী আন্দোলন ছিল প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে একটি স্থানীয় আন্দোলন, তথাপি দেশের নাগরিকদের জান-মাল-ইয্যত রক্ষার যে আইনগত চুক্তি জনগণের সঙ্গে সরকারের ছিল, থানাভুনের লোকদের বেআইনি ফাঁসি দিয়ে সে চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে সরকার চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ করেছিল। ফলে এলাকার বাসিন্দারা প্রতিশোধ গ্রহণের কুরআনী নির্দেশ পালন করতে উদ্দীপিত হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। একইভাবে এর প্রভাব ও পরিণামের দিক দিয়ে এ আন্দোলনের সীমানা আল্লাহর ইচ্ছায় বেশী দূর ব্যাপ্তি লাভ করেনি’।[13]
হানাফী আলেমগণ ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে কেন অংশগ্রহণ করেননি?
উল্লেখিত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইংরেজ বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল হানাফী আলেমগণ তাতে শরীক ছিলেন না। শামেলীর ঘটনারও জিহাদ আন্দোলনের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না। তা ছিল কেবল যালেম শাসকের বিরুদ্ধে মযলূম প্রজাদের সীমিত পরিসরে এক খন্ডযুদ্ধ। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহ’লে হানাফী আলেমগণ জিহাদ আন্দোলন থেকে কেন দূরে ছিলেন? তারা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে কেন অংশ নেননি? এ প্রশ্নের উত্তর তো তারাই ভাল দিতে পারবেন। তারপরেও এর একটি কারণ মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আমরা এখানে সেটি উল্লেখ করছি। মানাযির আহসান গীলানী মরহূম এ কথা বিভিন্ন স্থানে স্বয়ং নিজে নওয়াব ছদর ইয়ার জঙ্গ (১৯০৫-১৯৪৪), মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শিরওয়ানী (১৮৬৬-১৯২৬), ছদরুছ ছুদূর, আছাফিয়া সরকার (হায়দরাবাদ-দাক্ষিণাত্য)-এর মুখ থেকে শুনেছেন। তিনি লিখছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছিলেন তাদের মধ্যে হযরত মাওলানা শাহ ফযলুর রহমান গঞ্জেমুরাদাবাদীও (১৭৯৩-১৮৯৫) ছিলেন। হঠাৎ একদিন মাওলানাকে দেখা গেল, তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন এবং জনৈক চৌধুরী, যিনি বিদ্রোহীদের দলের সেনাপতিত্ব করছিলেন তার নাম ধরে বলতে বলতে যাচ্ছেন,
‘আরে যুদ্ধ করে কি হবে? আমি তো খিযির (আঃ)-কে ইংরেজদের কাতারে দেখতে পাচ্ছি’। নওয়াব ছাহেবই আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, ‘বিদ্রোহ অবসানের পর গঞ্জেমুরাদাবাদের জনশূন্য মসজিদে গিয়ে হযরত মাওলানা শাহ ফযলুর রহমান অবস্থান করছিলেন। ঘটনাক্রমে যে রাস্তার ধারে মসজিদটি অবস্থিত সেই রাস্তা ধরে কোন কারণে ইংরেজ সেনারা যাচ্ছিল। মাওলানা মসজিদ থেকে তাদের দেখছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলেন এবং ইংরেজ বাহিনীর ঘোড়ার লাগাম, খুঁটো ইত্যাদি হাতে থাকা এক সহিসের সঙ্গে আলাপ করে আবার মসজিদে ফিরে এলেন। এখন স্মরণ নেই যে, জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে, নাকি তিনি নিজে থেকেই বলেছিলেন, যে সহিসের সাথে আমি কথা বলেছি তিনি হলেন খিযির। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ অবস্থা কেন? জওয়াবে বললেন, ফায়ছালা এমনই হয়েছে’।[14]
নিজেদের বুযর্গদের কাশ্ফ ও তাদের গায়েবী বিষয়াদি জানার প্রতি বিশ্বাসে দেওবন্দী হানাফীরা ব্রেলভী হানাফীদের চাইতেও চার ধাপ এগিয়ে। এজন্য তাদের এক বুযর্গের রূহানী কাশ্ফের মাধ্যমে যখন হযরত খিযির (আঃ) কর্তৃক ইংরেজদের কেবল সহযোগিতা ও সাহচর্য দান নয়; বরং ইংরেজ সেনাদের একজন মামুলী খাদেম (সহিস) হওয়ার কথা জানা গেছে, তখন তার পরিষ্কার উদ্দেশ্য তো জানাই গেল যে, ইংরেজ বাহিনী আল্লাহর পক্ষ থেকে গায়েবী মদদ ও সাহায্যপ্রাপ্ত। অতএব আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে হানাফী আলেমরা কিভাবে যুদ্ধে লড়বেন? তাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে কেনইবা তারা আল্লাহর গযবের শিকার হবেন?
ইংরেজ গভর্ণরের এক বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষ্য :
ঘটনা এই হোক আর যাই হোক, এ সত্য অস্বীকারের কোন উপায় নেই যে, সমষ্টিগতভাবে হানাফী আলেমগণ জিহাদ আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন এবং তাতে তারা অংশ নেননি। দেওবন্দের বুযর্গদের জিহাদ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কহীনতার প্রমাণ সেই বিশেষ প্রতিনিধির (মিস্টার পামর) বিবরণ থেকেও মেলে, যাকে ১৮৭৫ সালে ইংরেজ সরকার দারুল উলূম দেওবন্দ পরিদর্শনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তার রিপোর্টে লিখেছিলেন,
‘এই মাদ্রাসা সরকার বিরোধী নয়, বরং সরকার সমর্থক এবং সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতাকারী। এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরা এতটা স্বাধীন ও বিনয়ী যে তাদের একজনের সাথে আরেকজনের কোন সম্পর্ক নেই’।[15]
এছাড়াও ডব্লিউ উইলিয়াম হান্টার রচিত ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং (উর্দূ অনুবাদ : হামারে হিন্দুস্তানী মুসলমান) থেকেও এ কথার সমর্থন মেলে। যে সকল লোক ও জামা‘আত ইংরেজ সরকারের বিরোধী এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা যরূরী মনে করে তাদের পরিচয় তুলে ধরাই ছিল উক্ত বইয়ের লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে হান্টার বার বার ওহাবী আলেম-ওলামা, ছাদেকপুরী পরিবার ও তাদের সঙ্গী-সাথীদেরকে ইংরেজ সরকারের শত্রু লিখেছেন, তাদের কর্মতৎপরতা খুব করে তুলে ধরেছেন, ইংরেজ সৈনিকদের সাথে তাদের সংঘর্ষের বর্ণনা দিয়েছেন, এ পথে তাদের উপর আপতিত বিপদাপদ, কষ্ট-ক্লেশ ও মামলা-মোকদ্দমার কথা উল্লেখ করে তাদের অতুলনীয় দৃঢ়তা ও অনমনীয়তার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ঐ ইংরেজ পর্যবেক্ষক কোথাও দেওবন্দের মুরববীদের নাম উল্লেখ করেননি। যদি দেওবন্দের মুরববীগণ কোন এক পর্যায়েও ইংরেজদের বিরোধিতা করতেন এবং জিহাদ আন্দোলনে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তাহ’লে তাদের কর্মকান্ড হান্টারের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া এবং তাদের আলোচনা থেকে তার বই শূন্য থাকা সম্ভব ছিল না।
‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’[16] বইয়ের প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়াঁ তার বইয়ে যদিও শামেলীর ঘটনা বাড়িয়ে বর্ণনা করেছেন এবং এ ঘটনাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ আন্দোলনের অংশ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তবুও তিনি একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘এক্ষেত্রে ইতিহাসের একজন ছাত্র যখন দেখতে পায় ইতিহাসের পাতাগুলিতে মালাগড়, ফরখনগরের মতো অখ্যাত স্থানের নাম আছে কিন্তু এই এলাকা (অর্থাৎ মুযাফ্ফর নগর ও সাহারানপুর যেলা, যেখানে দেওবন্দ অবস্থিত) এবং এখানকার মুজাহিদদের কোন আলোচনা নেই তখন তার হয়রানী-পেরেশানির অন্ত থাকে না’।[17]
এটা সেই সত্য, যার প্রকাশ হঠাৎ করেই তাদের কলমের ডগায় এসে গেছে। নয়তো তারা এ এলাকাকে জিহাদ আন্দোলনে শামিল করতে যে বিস্তারিত বিবরণ হাযির করেছেন এ স্বীকারোক্তির পর তা সবই বানোয়াট ও মনগড়া ইতিহাস বৈ আর কি হ’তে পারে? মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী যাকে ‘কল্পনা বিলাস’ বলে অভিহিত করেছেন।
[1]. হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক, পৃ. ৬৯, নতুন সংস্করণ, লাহোর।
[2]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ২৯১-৩০১।
[3]. ১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা, পৃ. ১৫-১৬, নাদওয়াতুল মুছান্নিফীন, দিল্লী।
[4]. ১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা, পৃ. ১৫-১৬।
[5]. মৌলভী মাহবূব আলী শুধু একাই জামা‘আত থেকে বেরিয়ে যাননি, বরং জিহাদ আন্দোলনের বিরোধিতার পাশাপাশি আরেকটি কর্মক্ষেত্র দাঁড় করেন। এভাবে তিনি আন্দোলনের মারাত্মক ক্ষতি করেন। এজন্য মাওলানা মুহাম্মাদ জাফর থানেশ্বরী লিখেছেন, ‘মৌলভী মাহবূব আলীর এ বিপথগামিতার ফলে জিহাদী কর্মকান্ডের উপর যে আঘাত লেগেছিল তেমন আঘাত আন্দোলনের সৈনিকরা আজ পর্যন্ত কোন শিখ কিংবা দুর্রানীর হাতে লাভ করেননি’ (হায়াতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, পৃ. ২৩৬, নাফীস একাডেমী, করাচী)।
[6]. মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ছিলেন সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর একজন খলীফা। কিন্তু আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি ইংরেজ সরকারকে সমর্থন জানান এবং জিহাদের বিরুদ্ধে ফৎওয়া প্রদান করেন (তাযকেরায়ে ওলামায়ে হিন্দ, পৃ. ৩৯৬, উর্দূ অনুবাদ : মুহাম্মাদ আইয়ুব কাদেরী)। এ ফৎওয়া মূলত একটি বক্তৃতা, যা মাওলানা ছাহেব এক সেমিনারে প্রদান করেছিলেন। যার সারাংশ ‘ইসলামী মুযাকারায়ে ইলমিয়াহ’ নামেই মুদ্রিত হয়েছিল। তিনি তার বক্তৃতায় হিন্দুস্থান ‘দারুল হারব’ (যুদ্ধক্ষেত্র) হওয়ার আক্বীদা কেবল ওহাবীদের আক্বীদা বলে সাব্যস্ত করেন এবং বলেন যে, সকল হানাফীর মতে হিন্দুস্থান ‘দারুল ইসলাম’ (দেখুন : মুযাকারায়ে ইলমিয়াহ, পৃ. ৯, নওলকিশোর ছাপা, লাক্ষ্ণৌ, ১৮৭০)। ইংরেজ লেখক জেমস্ উকেন্লির বর্ণনা অনুযায়ী, ‘মৌলভী কারামত আলী বৃটিশ সরকারের সাহায্যকারী এবং ওহাবীদের কট্টর বিরোধী ছিলেন’। মাওলানা মাসউদ আলম নাদভীর উক্তি মতে, ‘আক্বীদা ও আমলের দিক হ’তে তিনি সাইয়েদ আহমাদের প্রধান সহযোগীদের থেকে একেবারেই আলাদা ছিলেন’ (হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক, পৃ. ৪৭, পাদটীকা দ্র.)।
[7]. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, ফেব্রুয়ারী ১৯৪৩, পৃ. ৯৯।
[8]. ঐ, পৃ. ৯৯।
[9]. মাসিক রাহীক্ব, লাহোর, অক্টোবর ১৯৫৭, পৃ. ১০৫-১০৬।
[10]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/৮৯ পৃ.।
[11]. ঐ, পৃ. ১০৯। [যারা যে ঘটনা থেকে যোজন যোজন দূরে তাদেরকে সেই ঘটনার নায়ক বানানো সত্যের অপলাপ ছাড়া কি হ’তে পারে?-সম্পাদক]।
[12]. আবুদাঊদ হা/৪৭৭২, মিশকাত হা/৩৫২৯।
[13]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/১৩৯ পৃ.।
[14]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/১০৩ পৃ.।
[15]. প্রফেসর আইয়ূব ক্বাদেরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আহসান নানূতুভী, পৃ. ১১৭।
[16]. ‘উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য’ শিরোনামে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ৪ খন্ডে এ বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। -সম্পাদক।
[17]. ওলামায়ে হিন্দ কী শানদার মাযী, ৪/২৪৯ পৃ., লাহোর।
মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীস আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ কি বিদ্রোহজনিত সংগ্রাম ছিল? নাকি কোন সঠিক উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য জিহাদের একটি অংশ ছিল? নাকি জাতিগত যুদ্ধ ছিল? এ নিয়ে মতপার্থক্যের অবকাশ আছে। তবে তা যে জিহাদ আন্দোলন থেকে ভিন্ন ছিল, সেটি খুবই পরিষ্কার। এজন্য কিছু লোক মনে করেন, মুজাহিদরা যেহেতু একটি দ্বীনী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাই তারা এই জাতিগত যুদ্ধে অংশ নেননি।[1] কিন্তু আরেক দল পর্যবেক্ষকের মতে এ জাতিগত যুদ্ধে ওহাবী মুজাহিদগণ তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে অংশ নিয়েছিলেন। ঘটনাবলীর আলোকে এ মতই অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়। কেননা ১৮৫৭ সালেও মুজাহিদদের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর যুদ্ধ ও সংঘর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়। যার উল্লেখ উইলিয়াম হান্টার তার ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং গ্রন্থে (উর্দূ অনুবাদ : হামারে হিন্দুস্তানী মুসলমান) করেছেন।
গোলাম রসূল মেহেরও ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ গ্রন্থে মুজাহিদদের সেসব যরূরী কাজকর্মের উল্লেখ করেছেন যা অবস্থা প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে তারা আঞ্জাম দিয়েছিলেন।[2]
এছাড়া খালীক আহমাদ নিযামীও ওহাবী মুজাহিদদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার কথা যারা তুলেছেন তাদের দাবী প্রমাণসহ খন্ডন করেছেন। তিনি ‘১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা’ (১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক দিনলিপি) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আন্দোলনে (অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনে) কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণকারী অনেককেই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়। বখত খাঁ সম্পর্কে আমাদের ধারণা হ’ল, তিনিও মুজাহিদীন জামা‘আতের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বাহাদুর শাহের মামলা চলাকালে তাকে ‘ওহাবী আক্বীদা’ পোষণকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। যে কেউই হান্টারের ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং পড়েছেন তিনিই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ঐ সময়ে ওহাবী শব্দ সাইয়েদ ছাহেব ও তার সমমনা আলেমদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হ’ত। আর হান্টারের কথা মতে তো ‘ওহাবী’ ও ‘বিদ্রোহী’ সমার্থক ছিল।
বখত খাঁ আলেমদের সাথে যেভাবে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখতেন তাতেও এটা ফুটে ওঠে যে, তিনি সাইয়েদ ছাহেবের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আন্দোলনে অংশ নিতে তিনি যখন দিল্লীতে উপস্থিত হন, তখন একশ’ জন আলেম তার সাথী হয়েছিলেন। সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে টোংক থেকে ওহাবী আলেমদের একটি দল তার কাছে এসেছিলেন। এছাড়াও জয়পুর, ভূপাল, ঝাঁসী, হাসারা ও আগ্রা থেকে বহু আলেম তার পাশে ছুটে এসেছিলেন... মাওলানা লিয়াকত আলী এলাহাবাদীও এই চিন্তাধারার মুজাহিদ বলে মনে হয়... মাওলানা এনায়েত আলী ছাদেকপুরী, যার চেষ্টায় মর্দানে ৫৫ নং রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছিল। তিনি তো সাইয়েদ ছাহেবের খলীফা এবং মুজাহিদ জামা‘আতের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শহীদে আলীগড় মাওলানা আব্দুল জলীল ছিলেন সাইয়েদ ছাহেবের অন্যতম খলীফা। তিনি সাহসিকতার সাথে ইংরেজ শক্তির মুকাবিলা করেছিলেন। উল্লেখিত নামকরা ক’জন ব্যক্তি বাদেও ১৮৫৭ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরো অনেকেই সাইয়েদ ছাহেবের জামা‘আতের লোক অথবা সমমনা মানুষ ছিলেন। আর সম্ভবত এই কারণেই কিছু লোক ১৮৫৭ সালের সংগ্রামকে মুসলমানদের সংগ্রাম বলে অভিহিত করে থাকেন।[3]
জনৈক ইংরেজ লেখকের রায়ের প্রতিবাদে তিনি লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত যে, ওহাবীরা এ আন্দোলনে সামনে-পিছনে সব সারিতে ছিলেন। যুদ্ধ শেষে হিন্দুস্থানে ইংরেজদের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারা ওহাবীদের কঠোর সাজা দিয়েছিল এবং এ চিন্তাধারার লোকদের (চাকুরী, ব্যবসায় ইত্যাদি থেকে) তাড়িয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধোত্তর ওহাবীদের এই কঠোর সাজা প্রদানই প্রমাণ করে যে, ওহাবীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।[4]
‘হিন্দুস্তান মেঁ ওহাবী তাহরীক’ (হিন্দুস্থানে ওহাবী আন্দোলন) বইয়ের লেখকও ১৮৫৭ সালে ওহাবী মুজাহিদদের কর্মকান্ডের কম-বেশী বর্ণনা প্রদান করেছেন।
মোটকথা এ আলোচনার উদ্দেশ্য, ১৮৩১ সালে শহীদায়েনের শাহাদাতের পরে ছাদেকপুরী পরিবার জিহাদের পতাকা ও আন্দোলনের নেতৃত্ব যেভাবে সামাল দিয়েছিলেন তা স্বাধীনতা, দৃঢ়তা ও অবিচলতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। ১৮৫৭ সালের সংগ্রামের নেতৃত্ব যদিও ওহাবী মুজাহিদদের হাতে ছিল না, কিন্তু তারা তাতে অবশ্যই অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মাওলানা বাটালভী ও আহলেহাদীস জামা‘আত : একটি সংশয় নিরসন
কিছু লোক বলেন যে, ‘ওহাবী’ দ্বারা শুধু আহলেহাদীস উদ্দেশ্য নয়; বরং মাযহাব-সম্প্রদায় নির্বিশেষে যারাই ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তারা সবাই ওহাবী। এতে হানাফী-অহানাফী সবাই শামিল রয়েছেন। সত্য এই যে, সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর জীবদ্দশায় নিঃসন্দেহে হানাফী-আহলেহাদীস উভয়েই আন্দোলনে শরীক ছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে হানাফীরা ধীরে ধীরে আন্দোলন থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। যেমন মৌলভী মাহবূব আলী দেহলভী[5], মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী[6] প্রমুখ।
বালাকোটের দুঃখজনক ঘটনার পর আন্দোলনের নেতৃত্ব ছাদেকপুরী পরিবারের হাতে এসে গিয়েছিল। তারা ছিলেন হাদীস অনুযায়ী আমলকারী তথা আহলেহাদীস। এই পরিবার ও তাদের চিন্তাধারার লোকেরাই একশ’ বছরের বেশী সময় ধরে এই জিহাদ আন্দোলনকে জীবিত রেখেছিলেন। এমনকি ‘ওহাবী’ (আহলেহাদীস) ও ‘বিদ্রোহী’ সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে পরবর্তীকালে ওহাবী শব্দটি আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকদের জন্যই খাছ হয়ে যায় এবং ওহাবী শব্দ দ্বারা সর্বদা আহলেহাদীসদেরকেই বুঝানো হয়ে থাকে। এমনি করে ওহাবী শব্দটি আহলেহাদীসের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী, যিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলেহাদীসের চিন্তা-চেতনার বিপরীত মত পোষণ করতেন, তিনি স্বীয় প্রচেষ্টায় সরকারের নিকট থেকে এই সিদ্ধান্ত পাশ করান যে, আহলেহাদীসকে যেন আহলেহাদীস বলা হয়, তাদেরকে যেন ওহাবী বলা না হয়। (এ বিষয়ে আলোচনার জন্য স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধ প্রয়োজন) তা সত্ত্বেও অবস্থার কোন হেরফের হয়নি। কেননা মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী মরহূমের ইংরেজ সরকারের বশ্যতা স্বীকারকে আহলেহাদীস জামা‘আত মেনে নেয়নি এবং সমষ্টিগতভাবে তারা জিহাদ আন্দোলনে শামিল ও মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতায় সদা সচেষ্ট ও তৎপর থাকে। এজন্যই ‘ওহাবিয়াত’ পরিভাষার মধ্যে শির্ক, বিদ‘আত ও জাহেলী রসম-রেওয়াজ উচ্ছেদের সাথে সাথে ইংরেজ বিরোধিতাও শেষ অবধি থেকে যায়। এ কারণেই আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকজন ইংরেজ সরকারের চোখে সর্বদা কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে এবং তাদের ধর-পাকড়ের ধারা আগে যেমন ছিল তেমনই চলতে থাকে। যেমনটা কাযী আব্দুর রহীম মরহূমের ভাষায় ইতিপূর্বে তুলে ধরা হয়েছে যে, প্রত্যেক আহলেহাদীস মসজিদ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মুওয়ায্যিন অথবা খাদেম হিসাবে ইংরেজ কর্মচারীরা গুপ্তচরবৃত্তি করত। এছাড়াও সাইয়েদ সুলায়মান নাদভীর স্বীকারোক্তিও ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, মাওলানা আব্দুল আযীয রহীমাবাদীর যিন্দেগী পর্যন্ত আহলেহাদীস জামা‘আতের মধ্যে জিহাদের রূহ কার্যকর ছিল। মাওলানা রহীমাবাদী ১৯১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
কাযীকোট (গুজরানওয়ালা)-এর ‘বোম কেস’-এর ঘটনা ১৯২১ সালে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে আহলেহাদীসের লোকদের সাজা দেওয়া হয়েছিল। তারপরেও আমীরুল মুজাহিদীন মাওলানা ফযলে এলাহী ওয়াযীরাবাদী, মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরী, মাওলানা আব্দুর রহীম বিন মাওলানা রহীম বখশ ওরফে মাওলানা মুহাম্মাদ বশীর শহীদ, আমীরুল মুজাহিদীন ছূফী মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (রহঃ) ছাড়াও আরো অনেকে পরবর্তীতে জিহাদের পবিত্র মিশনকে জীবিত রেখেছিলেন এবং এ পথের সকল বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিলেন। যার কিছু বিবরণ ‘মুশাহাদাতে কাবুল ওয়া ইয়াগিস্তান’, ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ ও অন্যান্য বইয়ে পাওয়া যাবে। ‘সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন’ গ্রন্থে এ বিবরণ ইতিপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরবর্তীকালে মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতার বেশীর ভাগ কাজ আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকেরাই আঞ্জাম দিয়েছেন।
এতদ্ব্যতীত রেশমী রুমাল আন্দোলনের সরকারী রিপোর্ট সংবলিত আসল যে দলীল-দস্তাবেয ‘তাহরীকে শায়খুল হিন্দ’ বা শায়খুল হিন্দের আন্দোলন নামে ছাপা হয়েছে তাতেও আহলেহাদীস ব্যক্তিবর্গ ও আলেমদের নাম দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, ঐ দলীল-দস্তাবেযে আহলেহাদীস ব্যক্তিবর্গ ও আলেমদেরকে সবখানে ‘ওহাবী মৌলভী’, ‘গোঁড়া’, ‘উন্মাদ’ ইত্যাদি শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে কোন হানাফীকে ওহাবী বলা হয়নি। (এর বিস্তারিত বিবরণ রেশমী রুমাল আন্দোলন শিরোনামে সামনে আসছে।)
মাওলানা ওবায়দুললাহ সিন্ধীও এ কথা স্বীকার করেন যে, জিহাদ আন্দোলনে গায়ের মুক্বাল্লিদদের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। বরং তার মতে জিহাদ আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ এই একটা জিনিসই।
মাওলানা সিন্ধীর ধারণার সমালোচনা করতে গিয়ে মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী লিখেছেন, ‘মাওলানা সিন্ধীর মতে, সাইয়েদ আহমাদ শহীদের আন্দোলন সফল না হওয়ার কারণ এটাই মনে হয় যে, এতে শাওকানিয়াত, ওহাবিয়াত অথবা আরো পরিষ্কার করে বললে, গায়ের মুক্বাল্লিদিয়াতের সংমিশ্রণ ঘটেছিল’।[7]
মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী মাওলানা সিন্ধীর এ মত সম্পর্কে বলেন, ‘এই আন্দোলনের ঝান্ডাবাহীদের মধ্যে ফিক্বহী ঝগড়া-ঝাটি অথবা জোরে আমীন ও রাফ‘উল ইয়াদায়েনের মাধ্যমে বিদ‘আত উৎখাত কিংবা সুন্নাতের অনুসরণের চিন্তা কখনোই স্থান পায়নি। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ ও অন্যান্য যারা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের লেখা বই-পুস্তক, বক্তৃতা-বিবৃতি, তর্ক-বিতর্ক, পত্রাবলী ইত্যাদি মওজুদ আছে। সেসব থেকে দলীল দিতে হবে। জিহাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল আক্বীদা-বিশ্বাসের সংস্কার, আমল সংস্কার, তাওহীদের প্রচার-প্রসার, বাতিল খন্ডন, অবৈধ রসম-রেওয়াজের অবসান ঘটানো এবং ইসলামী বিধি-বিধান চালু করা। বাকী যেসব কথা তাদের নামে বলা হয় তা দু’একজনের কথা, যা এ ক্ষেত্রে দলীল হওয়ার উপযুক্ত নয়। ... তবে এটা হ’তে পারে যে, এ আন্দোলন ইত্তেবায়ে সুন্নাতের যে জায্বা সৃষ্টি করেছিল তার প্রভাবে বর্তমানে প্রাপ্ত হাদীসের গ্রন্থগুলিতে প্রথমবারেই যা সুন্নাত বলে নযরে ধরা পড়ে তা গ্রহণ করতে কিছু লোককে কোন তাক্বলীদী চিন্তা বিরত রাখতে পারেনি’।[8]
মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভীর এই পর্যালোচনা বড়ই বাস্তবসম্মত ও যাচাইকৃত। নিঃসন্দেহে ওহাবী মুজাহিদগণ ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েলকে ঝগড়া-ঝাটির মাধ্যম বানাননি। তারা জিহাদের উপরেই তাদের আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছিলেন। এ কারণেই আহলেহাদীস জনগণ ছাড়াও তারা অন্যান্য শ্রেণীর লোকদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। তারপরেও এ সত্য অনস্বীকার্য যে, যেহেতু তারা নিজেরা ছিলেন হাদীস অনুযায়ী আমলকারী এবং তাক্বলীদী জড়তা থেকে দূরে, সেহেতু তারা যেখানে যেখানে গিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষের যে যে মজলিসেই তাদের কথা বলা ও প্রভাব ফেলার সুযোগ মিলেছিল, সেখানে সেখানেই তাওহীদ ও সুন্নাতের মশাল জ্বলে উঠেছিল এবং তাক্বলীদের বন্ধন ভেঙ্গে খানখান হয়ে গিয়েছিল। আর জিহাদ আন্দোলনের এই দিকটাই মাওলানা সিন্ধী ও অন্যান্যদের গাত্রদাহ ও অন্তর্জ্বালার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন!
তাই মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী যদিও ‘ওহাবী’র পরিবর্তে ‘আহলেহাদীস’ শব্দের ব্যবহার সরকার থেকে মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু তার এ চেষ্টা জিহাদ আন্দোলনের উপর কোন প্রভাব ফেলেনি। আহলেহাদীস জামা‘আতের লোকেরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জিহাদ আন্দোলনে উদ্দীপ্ত ও সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং মাওলানা বাটালভীর চেষ্টায় আহলেহাদীস জামা‘আতের মোড় ইংরেজ বিরোধিতার পরিবর্তে ইংরেজ আনুগত্যের দিকে ফিরে যাওয়ার দাবী একেবারেই অবাস্তব।
মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী গুজরানওয়ালা (রহঃ) এই একই বিষয়ে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আহলেহাদীসের পক্ষ থেকে ইংরেজদের সহযোগিতার উল্লেখযোগ্য কোন আওয়ায যদি উঠে থাকে তবে তা ছিল মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী মরহূমের আওয়ায। তবে এটা সুনিশ্চিত যে, এ আওয়াযে মাওলানা একাই ছিলেন। এটি তার ব্যক্তিগত মত ছিল। অবিভক্ত হিন্দুস্থানের উল্লেখযোগ্য কোন আহলেহাদীস এ দৃষ্টিভঙ্গিতে তার সাথে সহমত পোষণ করেননি। বরং যে সময়টায় মাওলানা তার পুস্তিকা ও লেখনীতে ইংরেজদের সহযোগিতা করে চলছিলেন, ঠিক সে সময়েই হিন্দুস্থান ও পাঞ্জাবে আহলেহাদীস জামা‘আতের বুযর্গগণ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর আন্দোলন সফল করার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। কোন গযনভী ও লাখভী খান্দান অথবা ছাদেকপুরী, রহীমাবাদী ও ক্বাছূরী বুযর্গদের কেউ কি মাওলানা বাটালভীর পক্ষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ছিলেন? সুতরাং মাওলানা বাটালভীর কাজকে আহলেহাদীস জামা‘আতের সমষ্টিগত কাজ বিবেচনা করলে বাস্তবতার উপর যুলুম করা হবে’।[9]
একইভাবে এ কথাও সম্পূর্ণ অসত্য যে, ওহাবী মুজাহিদীন বলতে হানাফী-আহলেহাদীস উভয়কেই বুঝায়। বরং সত্য এই যে, ওহাবী দ্বারা কেবল আহলেহাদীসকে বুঝানো হয়েছে, অন্য কাউকে নয়।
মোটকথা, এই বিবরণের উদ্দেশ্য এ সত্য তুলে ধরা যে, সাইয়েদায়েনের শাহাদাতের পর এই জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনকে যারা জীবিত রেখেছিলেন এবং এজন্য নিজেদের জান-মাল অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তারা ছিলেন কেবলই আহলেহাদীস। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। তারপর যখন ১৯১৯ সালে ও তার পরবর্তীকালে ‘খেলাফত আন্দোলন’, ‘অসহযোগ আন্দোলন’, ‘জমঈয়তে ওলামায়ে হিন্দ’ ‘আহরার’ ইত্যাদির মতো ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতীয় আন্দোলন ও সংগঠন সমূহের সূত্রপাত হল, তখন সেগুলিতে অবশ্য দেওবন্দী আলেমদের দেখা মিলতে লাগল। তখনো কিন্তু আহলেহাদীস আলেমরাও প্রতিটি আন্দোলনে দেওবন্দী বুযর্গদের সাথে সমানভাবে শরীক থেকেছেন। উল্লেখিত আন্দোলন ও সংগঠনগুলির রিপোর্ট দেখলেই তা বুঝা যাবে। তাতে অবশ্যই মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ দাঊদ গযনভী, মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ ইবরাহীম মীর শিয়ালকোটী, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আহরার সহ আহলেহাদীস জামা‘আতের আরো অনেক আলেম ও ব্যক্তির নাম পাওয়া যাবে।
একইভাবে ক্বাছূরী বংশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যেমন মাওলানা আব্দুল ক্বাদের ক্বাছূরী, তার পুত্র-পৌত্রগণ, তথা মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ক্বাছূরী, মাওলানা মুহিউদ্দীন আহমাদ ক্বাছূরী প্রমুখের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় খিদমতকে কে ভুলতে পারে? এই গুরুজনেরা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে জানমালের অমূল্য কুরবানী পেশ করে গেছেন। কবির ভাষায়,
خدا رحمت كند ايٍں عاشقان پاك طينت را
‘পাক-পবিত্র স্বভাবের এই প্রেমিকজনদের উপর মহান আল্লাহ রহমত বর্ষণ করুন’! আমীন!
জিহাদ আন্দোলন ও হানাফী আলেমগণ
পূর্বের বিস্তারিত আলোচনায় এ কথার স্পষ্ট খন্ডন হয়ে গেছে যে, হানাফী আলেমগণও কোন পর্যায়ে জিহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাস্তবতা এই যে, সাইয়েদ আহমাদ শহীদের জীবদ্দশায় যদিও হানাফী (ঐ সময়কার হানাফীরা দেওবন্দী বা ব্রেলভী হানাফী অবশ্যই ছিলেন না। তারা ছিলেন অলিউল্লাহী হানাফী, যাদের মাঝে তাক্বলীদী গোঁড়ামি ছিল না) ও আহলেহাদীস উভয় গোষ্ঠীর লোক এ আন্দোলনে শরীক ছিল বলে দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ আন্দোলনের সকল নেতৃত্ব তারাই দিয়েছিলেন যারা তাক্বলীদের বন্ধন থেকে শুধু মুক্তই ছিলেন না; বরং তাদের তাবলীগ ও প্রচারের ফলে তাক্বলীদের শৃঙ্খল টুটে যাচ্ছিল এবং হাদীস অনুযায়ী আমলের প্রতি আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যত ধর-পাকড় হয়েছে, যত সহায়-সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত হয়েছে এবং যত শাস্তি-সাজা হয়েছে তার তালিকার শীর্ষে ছাদেকপুরী পরিবারের নাম আসবে। এ পথে এই পরিবার যে দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখিয়েছেন, যে যে বালা-মুছীবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত। (এ বিষয়ের যরূরী বিবরণ মাওলানা মাসঊদ আলম নাদভীর ‘হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক’ গ্রন্থে দেখা যেতে পারে)। এই বেদনাবিধুর বিবরণে ও জিহাদের ইতিহাসে কোথাও হানাফী আলেমদের নাম নযরে আসে না। কিন্তু ছাদেকপুরী পরিবারের উদ্যমী মর্দে মুজাহিদগণ এ পথে তাদের সব কিছু কুরবানী দিয়েছিলেন। তাই হানাফী সাধকদের উদ্দেশ্যে এ পরিবার যথার্থই বলতে পারেন কবির ভাষায় :
كا مل اس فر قئہ زُهادسے اٹها نہ كو ئ
جو چند ہوئے تو يہى رندان قدح خوار ہوئے
‘এই সাধক দলের মাঝে কামেল কেউ আবির্ভূত হননি। দুয়েকজন যারা হয়েছেন তারা সাধনায় একেবারে বুঁদ হয়ে গিয়েছেন’।
হানাফী লেখকদের মনগড়া ইতিহাস :
এটা বড়ই দুঃখজনক যে, আজকাল হানাফী লেখকগণ হানাফী আলেমদের (১৮৫৭ সালের) স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরপুরুষ বানানোর চেষ্টা করেন। অথচ বীরপুরুষ হওয়া তো দূরের কথা, তারা এ যুদ্ধে মোটে অংশই নেননি। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধ আসলে জিহাদ আন্দোলনের অংশ ছিল কি-না, তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে। কেননা তাতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষই শামিল ছিল। কিন্তু তার আগে ও পরে যে জিহাদ আন্দোলন অব্যাহত ছিল তা ছিল এক নির্ভেজাল দ্বীনী আন্দোলন। এ আন্দোলন ইংরেজদের হয়রান-পেরেশান ও বেহাল দশা করে ছেড়েছিল এবং এ জিহাদ আন্দোলনই ছিল হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাইল ফলক। এই জিহাদ আন্দোলনে ১৮৫৭ সালের পরে হানাফী আলেমগণ কবে কোথায় শরীক ছিলেন? তারা কি ধরনের কাজ আঞ্জাম দিয়েছিলেন? কি কি বালা-মুছীবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন তারা হয়েছিলেন? কে আছেন যিনি তাদের নাম-ঠিকানা তুলে ধরতে পারবেন? তার প্রমাণ যোগাড় করতে পারবেন?
শামেলী যুদ্ধের ঘটনা :
খুব কষ্ট করে প্রমাণ করা এক ঘটনা হল শামেলী যুদ্ধের ঘটনা। এ যুদ্ধে যেন ক্বিয়ামত বয়ে গিয়েছিল এবং তাতে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতাগণ অংশ নিয়েছিলেন- এমনি ধারার জোরালো প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হয়। এমনকি এ ঘটনার ভিত্তিতে দেওবন্দী আলেমদের ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের হিরো প্রমাণ করা হয়। কিন্তু প্রথমত এ যুদ্ধের যে বর্ণনা বর্তমানকালে তুলে ধরা হয় তা আপত্তির ঊর্ধ্বে নয়। এ যুদ্ধে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানূতুভী, মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী, হাফেয যামেন শহীদ ও তাদের পীর মুর্শিদ হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জোরেশোরে উল্লেখ করা হয়। অথচ এটা বড়ই বিস্ময়কর যে, মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহীর প্রথম জীবনী লেখক মাওলানা আশেক এলাহী মীরাঠী ‘তাযকিরাতুর রশীদ’ গ্রন্থে শামেলী ও তার পরবর্তী ঘটনার বিস্তারিত যে বিবরণ তুলে ধরেছেন তাতে এ ঘটনা যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের কোন অংশ ছিল তার নিশ্চয়তা মেলে না। বরং সে বিবরণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শামেলীর এ ঘটনা ছিল মূলত ফাসাদী বা দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে দেওবন্দী মুরববীদের লড়াই। (তাযকিরাতুর রশীদ-এর ভাষায় ১৮৫৭ সালের রাজনৈতিক হাঙ্গামায় অংশগ্রহণকারীদের ফাসাদী বা দাঙ্গাবাজ বলা হয়েছে।)
সেই লড়াইয়ে দুই ‘ফাসাদীর’ গুলীতে হাফেয যামেন শহীদ হন। কিন্তু সরকারকে এ ঘটনার ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়। যার ভিত্তিতে মাওলানা নানূতুভী ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। মাওলানা নানূতুভী ও মাওলানা গাঙ্গুহী আত্মগোপন করেন, কিন্তু হাজী এমদাদুল্লাহ ছাহেব লুকিয়ে মক্কায় হিজরত করেন। কিছুদিন পর মাওলানা গাঙ্গুহীর মামলা চালু হ’লে তিনি আদালতে তার যবানবন্দীতে বলেন, ‘আমরা এই দাঙ্গাবাজদের থেকে যোজন যোজন দূরে’। ফলতঃ আদালতেও তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। আবার আদালতের দৃষ্টিতেও তারা জিহাদের অপরাধে ‘অপরাধী’ গণ্য হননি। এজন্য তাদেরকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
‘তাযকিরাতুর রশীদ’ গ্রন্থকারের উল্লেখিত বিবরণ সম্পর্কে আজকাল দেওবন্দী হানাফীরা বলেন যে, উক্ত জীবনীকার ইংরেজদের ভয়ে ঘটনার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টোভাবে তুলে ধরেছেন। আসলে ঘটনা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে, কিন্তু তিনি কৌশল ভেবে তা ইংরেজদের পক্ষে বানিয়ে দিয়েছেন। যাতে দেওবন্দী আলেমগণ ইংরেজদের ধর-পাকড় থেকে রেহাই পান এবং কোন ক্ষেত্রে তারা যে ইংরেজ বিরোধী কাজকর্মে অংশ নিয়েছিলেন তা অজ্ঞাত থাকে। কিন্তু প্রথমত একজন বিশ্বস্ত জীবনী লেখক থেকে আশা করা যায় না যে, তিনি কোন ঘটনা এমনভাবে বিকৃত করবেন যে তার আসল রূপই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়তঃ যখন দাবী করা হচ্ছে যে, দেওবন্দী আলেমগণ জিহাদ আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ও স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন তখন তা গোপন করার উদ্দেশ্য কী? তার স্পষ্ট উদ্দেশ্য তো এই যে, উল্লেখিত মুরববীদের ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ সঠিক প্রমাণিত হওয়ার পর তারা এক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করলে তখনই কেবল শামেলীর ঘটনা গোপন করা তাদের জন্য মানানসই হ’ত এবং ইংরেজরাও বুঝত যে, দেওবন্দের বর্তমান প্রজন্ম এখন যেভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে আলাদা হয়ে পঠন-পাঠনে ব্যস্ত রয়েছেন, তাদের প্রথম দিকের বুযর্গরাও একই কাজে মশগুল ছিলেন।
‘তাযকিরাতুর রশীদ’ গ্রন্থকারের বর্ণনা যদি ‘কৌশল’ বলে ধরে নেওয়া হয় তাহ’লেও নিশ্চিত রূপে এ কথা প্রমাণিত হবে যে, মাত্র একটি ঘটনাতে সীমিত পরিসরে শুধু কয়েকজন মুরববী জিহাদী তৎপরতায় অংশ নিয়েছিলেন। ব্যস এতটুকুই! না এর আগে কোন যুদ্ধে তারা তৎপরতা দেখিয়েছেন, না পরে।
মাওলানা মানাযির আহসান গীলানীর বর্ণনা :
শামেলীর ঘটনার যে চিত্র আজকালকের হানাফীরা প্রমাণ করতে চান তা সঠিক হলেই কেবল তাদের বর্ণিত কাহিনী সত্য হ’তে পারে। কিন্তু বাস্তবতা তো এই যে, শামেলীর ঘটনাকে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং মুজাহিদ আন্দোলনের অংশ প্রমাণ করাই অসম্ভব। মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’ নামে মোটা মোটা তিন খন্ডে মাওলানা নানূতুভীর যে জীবনী লিখেছেন তাতে তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন যে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাওলানা নানূতুভী এবং তার ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের সাথী-বন্ধুদের কোন ভূমিকা ছিল না। উক্ত গ্রন্থে তিনি ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার কিছু উদ্ধৃতি নিচে প্রদত্ত হ’ল :
‘আজকাল শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণতা, গৌরব ও মাহাত্ম্যের সবচেয়ে বড় মানদন্ড হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ। রাজনৈতিক অঙ্গনে যিনি যত বড় ভূমিকা পালন করেন তিনি তত বড় মাপের মানুষ হিসাবে বিবেচিত হন। অন্যান্য ময়দানে তার ভূমিকা যাই হোক না কেন, তিনি যে মর্যাদারই অধিকারী হোন না কেন নিজেকে রাজনৈতিক ময়দানের খেলোয়াড় প্রমাণ করতে না পারলে তিনি কিছুই নন। এই সাধারণ মানদন্ড দেখে কোন বাছ-বিচার না করে এ কথা মেনে নেওয়া যায় না যে, সিপাহী বিদ্রোহের আগুনে আমাদের নেতা ও মহান ইমামও (মাওলানা নানূতুভী) ঠিক সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যেভাবে দেশের সাধারণ জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমাদের নেতা ও মহান ইমামের নীতি অনুসারে এ ধরনের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক নয় এবং ঘটনাবলী থেকেও তার সমর্থন মেলে না’।[10]
অন্য এক স্থানে তিনি লিখেছেন, ‘এতটুকু কথা সর্বাবস্থায় নিশ্চিত এবং চাক্ষুস সাক্ষ্যের দাবী মতে অনস্বীকার্য যে, অন্যান্যদের সাথে বিদ্রোহের হাঙ্গামা ছড়িয়ে দিতে আমাদের নেতা ও মহান ইমাম এবং তার ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের সাথী-বন্ধুদের হাত থাকার দাবী কল্পনার ফানুস ছাড়া কিছু নয়। আর এমন উড়ো কথার কোন মূল্য নেই। বরং ঘটনা তাই যা গ্রন্থকার আশেক এলাহী মিরাঠী লিখেছেন, ‘মাওলানা ফাসাদীদের থেকে বহু যোজন দূরে ছিলেন’।[11]
শামেলীর ঘটনার আসল চিত্র :
রটনা যখন এত তখন শামেলীর ঘটনার আসল চিত্র কি ছিল? তার বিবরণ মাওলানা গীলানী এভাবে তুলে ধরেছেন যে, থানাভুনের কিছু লোককে স্থানীয় ইংরেজ শাসকরা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। তাদের মধ্যে কাযী পরিবারের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে তার বড় ভাই এতই ব্যথিত হন যে, জীবনের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এহেন অবস্থা দেখে স্থানীয় লোকজন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করে, যারা ভুল তথ্যের কারণে অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার ও উত্তরাধিকারীরা মযলূম। এই মযলূমদের সাহায্য করা এবং যালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা যরূরী। এজন্য তারা তাদের নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে স্থানীয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাতে ঐ মুরববীগণও (দেওবন্দের আলেমগণ) অংশ নিয়েছিলেন। মাওলানা গীলানীর ভাষ্য মতে, অনেকটা নিম্নের হাদীস তামিল করতে গিয়ে তারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ أَهْلِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ
‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদের হেফাযত করতে গিয়ে নিহত হ’ল সে শহীদ। আর যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের হেফাযত করতে গিয়ে নিহত হ’ল সে শহীদ’।[12]
এ যুদ্ধে যেহেতু কিছু ইংরেজ নিহত হয়েছিল তাই পরবর্তীতে মাওলানা নানূতুভীসহ কতিপয় লোককে বেশ কয়েকবার গোপনে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাওলানা নানূতুভী প্রতিবারই অস্বাভাবিক ও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তারপরেও এই সন্দেহজনক অবস্থা ১৮৬১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। তারপর ইংরেজ সরকার তাকে বিপজ্জনকদের তালিকা থেকে বাদ দেয়।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এতটুকুই, যাকে মাওলানা গীলানী তার নিজস্ব শৈলী অনুযায়ী একটু বিস্তারিত লিখেছেন। শেষে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যাহোক প্রাথমিক কারণ সমূহের প্রেক্ষিতে যদিও থানাভুনের এই জিহাদী আন্দোলন ছিল প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে একটি স্থানীয় আন্দোলন, তথাপি দেশের নাগরিকদের জান-মাল-ইয্যত রক্ষার যে আইনগত চুক্তি জনগণের সঙ্গে সরকারের ছিল, থানাভুনের লোকদের বেআইনি ফাঁসি দিয়ে সে চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে সরকার চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ করেছিল। ফলে এলাকার বাসিন্দারা প্রতিশোধ গ্রহণের কুরআনী নির্দেশ পালন করতে উদ্দীপিত হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। একইভাবে এর প্রভাব ও পরিণামের দিক দিয়ে এ আন্দোলনের সীমানা আল্লাহর ইচ্ছায় বেশী দূর ব্যাপ্তি লাভ করেনি’।[13]
হানাফী আলেমগণ ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে কেন অংশগ্রহণ করেননি?
উল্লেখিত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ইংরেজ বিরোধী যে আন্দোলন চলছিল হানাফী আলেমগণ তাতে শরীক ছিলেন না। শামেলীর ঘটনারও জিহাদ আন্দোলনের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না। তা ছিল কেবল যালেম শাসকের বিরুদ্ধে মযলূম প্রজাদের সীমিত পরিসরে এক খন্ডযুদ্ধ। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহ’লে হানাফী আলেমগণ জিহাদ আন্দোলন থেকে কেন দূরে ছিলেন? তারা ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে কেন অংশ নেননি? এ প্রশ্নের উত্তর তো তারাই ভাল দিতে পারবেন। তারপরেও এর একটি কারণ মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী ‘সাওয়ানিহে ক্বাসেমী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আমরা এখানে সেটি উল্লেখ করছি। মানাযির আহসান গীলানী মরহূম এ কথা বিভিন্ন স্থানে স্বয়ং নিজে নওয়াব ছদর ইয়ার জঙ্গ (১৯০৫-১৯৪৪), মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শিরওয়ানী (১৮৬৬-১৯২৬), ছদরুছ ছুদূর, আছাফিয়া সরকার (হায়দরাবাদ-দাক্ষিণাত্য)-এর মুখ থেকে শুনেছেন। তিনি লিখছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছিলেন তাদের মধ্যে হযরত মাওলানা শাহ ফযলুর রহমান গঞ্জেমুরাদাবাদীও (১৭৯৩-১৮৯৫) ছিলেন। হঠাৎ একদিন মাওলানাকে দেখা গেল, তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন এবং জনৈক চৌধুরী, যিনি বিদ্রোহীদের দলের সেনাপতিত্ব করছিলেন তার নাম ধরে বলতে বলতে যাচ্ছেন,
لٹر نے كا كيا فائده، خضر كو تو ميں انگر يز و ں كى صف ميں پار ہا ہوں
‘আরে যুদ্ধ করে কি হবে? আমি তো খিযির (আঃ)-কে ইংরেজদের কাতারে দেখতে পাচ্ছি’। নওয়াব ছাহেবই আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, ‘বিদ্রোহ অবসানের পর গঞ্জেমুরাদাবাদের জনশূন্য মসজিদে গিয়ে হযরত মাওলানা শাহ ফযলুর রহমান অবস্থান করছিলেন। ঘটনাক্রমে যে রাস্তার ধারে মসজিদটি অবস্থিত সেই রাস্তা ধরে কোন কারণে ইংরেজ সেনারা যাচ্ছিল। মাওলানা মসজিদ থেকে তাদের দেখছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলেন এবং ইংরেজ বাহিনীর ঘোড়ার লাগাম, খুঁটো ইত্যাদি হাতে থাকা এক সহিসের সঙ্গে আলাপ করে আবার মসজিদে ফিরে এলেন। এখন স্মরণ নেই যে, জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে, নাকি তিনি নিজে থেকেই বলেছিলেন, যে সহিসের সাথে আমি কথা বলেছি তিনি হলেন খিযির। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ অবস্থা কেন? জওয়াবে বললেন, ফায়ছালা এমনই হয়েছে’।[14]
নিজেদের বুযর্গদের কাশ্ফ ও তাদের গায়েবী বিষয়াদি জানার প্রতি বিশ্বাসে দেওবন্দী হানাফীরা ব্রেলভী হানাফীদের চাইতেও চার ধাপ এগিয়ে। এজন্য তাদের এক বুযর্গের রূহানী কাশ্ফের মাধ্যমে যখন হযরত খিযির (আঃ) কর্তৃক ইংরেজদের কেবল সহযোগিতা ও সাহচর্য দান নয়; বরং ইংরেজ সেনাদের একজন মামুলী খাদেম (সহিস) হওয়ার কথা জানা গেছে, তখন তার পরিষ্কার উদ্দেশ্য তো জানাই গেল যে, ইংরেজ বাহিনী আল্লাহর পক্ষ থেকে গায়েবী মদদ ও সাহায্যপ্রাপ্ত। অতএব আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে হানাফী আলেমরা কিভাবে যুদ্ধে লড়বেন? তাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে কেনইবা তারা আল্লাহর গযবের শিকার হবেন?
ইংরেজ গভর্ণরের এক বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষ্য :
ঘটনা এই হোক আর যাই হোক, এ সত্য অস্বীকারের কোন উপায় নেই যে, সমষ্টিগতভাবে হানাফী আলেমগণ জিহাদ আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন এবং তাতে তারা অংশ নেননি। দেওবন্দের বুযর্গদের জিহাদ আন্দোলনের সাথে সম্পর্কহীনতার প্রমাণ সেই বিশেষ প্রতিনিধির (মিস্টার পামর) বিবরণ থেকেও মেলে, যাকে ১৮৭৫ সালে ইংরেজ সরকার দারুল উলূম দেওবন্দ পরিদর্শনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তার রিপোর্টে লিখেছিলেন,
يہ مدرسہ خلاف سركار نہىں بلكہ موافق سركا ر و ممد و معادن سركار ہے- ىہاں كے تعليم يا فتہ لوگ ايسے آزاد اور نيك چلن ہىں كہ ايك دوسرے سے كچهہ واسطہ نہىں-
‘এই মাদ্রাসা সরকার বিরোধী নয়, বরং সরকার সমর্থক এবং সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতাকারী। এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরা এতটা স্বাধীন ও বিনয়ী যে তাদের একজনের সাথে আরেকজনের কোন সম্পর্ক নেই’।[15]
এছাড়াও ডব্লিউ উইলিয়াম হান্টার রচিত ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং (উর্দূ অনুবাদ : হামারে হিন্দুস্তানী মুসলমান) থেকেও এ কথার সমর্থন মেলে। যে সকল লোক ও জামা‘আত ইংরেজ সরকারের বিরোধী এবং ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করা যরূরী মনে করে তাদের পরিচয় তুলে ধরাই ছিল উক্ত বইয়ের লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে হান্টার বার বার ওহাবী আলেম-ওলামা, ছাদেকপুরী পরিবার ও তাদের সঙ্গী-সাথীদেরকে ইংরেজ সরকারের শত্রু লিখেছেন, তাদের কর্মতৎপরতা খুব করে তুলে ধরেছেন, ইংরেজ সৈনিকদের সাথে তাদের সংঘর্ষের বর্ণনা দিয়েছেন, এ পথে তাদের উপর আপতিত বিপদাপদ, কষ্ট-ক্লেশ ও মামলা-মোকদ্দমার কথা উল্লেখ করে তাদের অতুলনীয় দৃঢ়তা ও অনমনীয়তার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ঐ ইংরেজ পর্যবেক্ষক কোথাও দেওবন্দের মুরববীদের নাম উল্লেখ করেননি। যদি দেওবন্দের মুরববীগণ কোন এক পর্যায়েও ইংরেজদের বিরোধিতা করতেন এবং জিহাদ আন্দোলনে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তাহ’লে তাদের কর্মকান্ড হান্টারের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া এবং তাদের আলোচনা থেকে তার বই শূন্য থাকা সম্ভব ছিল না।
‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’[16] বইয়ের প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়াঁ তার বইয়ে যদিও শামেলীর ঘটনা বাড়িয়ে বর্ণনা করেছেন এবং এ ঘটনাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ আন্দোলনের অংশ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তবুও তিনি একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘এক্ষেত্রে ইতিহাসের একজন ছাত্র যখন দেখতে পায় ইতিহাসের পাতাগুলিতে মালাগড়, ফরখনগরের মতো অখ্যাত স্থানের নাম আছে কিন্তু এই এলাকা (অর্থাৎ মুযাফ্ফর নগর ও সাহারানপুর যেলা, যেখানে দেওবন্দ অবস্থিত) এবং এখানকার মুজাহিদদের কোন আলোচনা নেই তখন তার হয়রানী-পেরেশানির অন্ত থাকে না’।[17]
এটা সেই সত্য, যার প্রকাশ হঠাৎ করেই তাদের কলমের ডগায় এসে গেছে। নয়তো তারা এ এলাকাকে জিহাদ আন্দোলনে শামিল করতে যে বিস্তারিত বিবরণ হাযির করেছেন এ স্বীকারোক্তির পর তা সবই বানোয়াট ও মনগড়া ইতিহাস বৈ আর কি হ’তে পারে? মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী যাকে ‘কল্পনা বিলাস’ বলে অভিহিত করেছেন।
[1]. হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক, পৃ. ৬৯, নতুন সংস্করণ, লাহোর।
[2]. সারগুযাশ্তে মুজাহিদীন, পৃ. ২৯১-৩০১।
[3]. ১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা, পৃ. ১৫-১৬, নাদওয়াতুল মুছান্নিফীন, দিল্লী।
[4]. ১৮৫৭ সাল কা তারিখী রোযনামচা, পৃ. ১৫-১৬।
[5]. মৌলভী মাহবূব আলী শুধু একাই জামা‘আত থেকে বেরিয়ে যাননি, বরং জিহাদ আন্দোলনের বিরোধিতার পাশাপাশি আরেকটি কর্মক্ষেত্র দাঁড় করেন। এভাবে তিনি আন্দোলনের মারাত্মক ক্ষতি করেন। এজন্য মাওলানা মুহাম্মাদ জাফর থানেশ্বরী লিখেছেন, ‘মৌলভী মাহবূব আলীর এ বিপথগামিতার ফলে জিহাদী কর্মকান্ডের উপর যে আঘাত লেগেছিল তেমন আঘাত আন্দোলনের সৈনিকরা আজ পর্যন্ত কোন শিখ কিংবা দুর্রানীর হাতে লাভ করেননি’ (হায়াতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, পৃ. ২৩৬, নাফীস একাডেমী, করাচী)।
[6]. মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ছিলেন সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ)-এর একজন খলীফা। কিন্তু আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি ইংরেজ সরকারকে সমর্থন জানান এবং জিহাদের বিরুদ্ধে ফৎওয়া প্রদান করেন (তাযকেরায়ে ওলামায়ে হিন্দ, পৃ. ৩৯৬, উর্দূ অনুবাদ : মুহাম্মাদ আইয়ুব কাদেরী)। এ ফৎওয়া মূলত একটি বক্তৃতা, যা মাওলানা ছাহেব এক সেমিনারে প্রদান করেছিলেন। যার সারাংশ ‘ইসলামী মুযাকারায়ে ইলমিয়াহ’ নামেই মুদ্রিত হয়েছিল। তিনি তার বক্তৃতায় হিন্দুস্থান ‘দারুল হারব’ (যুদ্ধক্ষেত্র) হওয়ার আক্বীদা কেবল ওহাবীদের আক্বীদা বলে সাব্যস্ত করেন এবং বলেন যে, সকল হানাফীর মতে হিন্দুস্থান ‘দারুল ইসলাম’ (দেখুন : মুযাকারায়ে ইলমিয়াহ, পৃ. ৯, নওলকিশোর ছাপা, লাক্ষ্ণৌ, ১৮৭০)। ইংরেজ লেখক জেমস্ উকেন্লির বর্ণনা অনুযায়ী, ‘মৌলভী কারামত আলী বৃটিশ সরকারের সাহায্যকারী এবং ওহাবীদের কট্টর বিরোধী ছিলেন’। মাওলানা মাসউদ আলম নাদভীর উক্তি মতে, ‘আক্বীদা ও আমলের দিক হ’তে তিনি সাইয়েদ আহমাদের প্রধান সহযোগীদের থেকে একেবারেই আলাদা ছিলেন’ (হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক, পৃ. ৪৭, পাদটীকা দ্র.)।
[7]. মাসিক মা‘আরিফ, আযমগড়, ফেব্রুয়ারী ১৯৪৩, পৃ. ৯৯।
[8]. ঐ, পৃ. ৯৯।
[9]. মাসিক রাহীক্ব, লাহোর, অক্টোবর ১৯৫৭, পৃ. ১০৫-১০৬।
[10]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/৮৯ পৃ.।
[11]. ঐ, পৃ. ১০৯। [যারা যে ঘটনা থেকে যোজন যোজন দূরে তাদেরকে সেই ঘটনার নায়ক বানানো সত্যের অপলাপ ছাড়া কি হ’তে পারে?-সম্পাদক]।
[12]. আবুদাঊদ হা/৪৭৭২, মিশকাত হা/৩৫২৯।
[13]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/১৩৯ পৃ.।
[14]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/১০৩ পৃ.।
[15]. প্রফেসর আইয়ূব ক্বাদেরী, মাওলানা মুহাম্মাদ আহসান নানূতুভী, পৃ. ১১৭।
[16]. ‘উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য’ শিরোনামে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ৪ খন্ডে এ বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। -সম্পাদক।
[17]. ওলামায়ে হিন্দ কী শানদার মাযী, ৪/২৪৯ পৃ., লাহোর।
মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীস আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
Last edited: