‘জঙ্গিবাদ’ বর্তমানে আলোচিত সমালোচিত একটি আতঙ্কের নাম। ‘জঙ্গিবাদ’ হল চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের ছদ্ম আবরণ। আর এ কারণে জঙ্গিবাদকে ‘চরমপন্থা’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। অস্ত্রধারণ ও সহিংসতার মাধ্যমে বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি, ফাসাদ এবং ফেতনা তৈরি করে মানব মনে আতঙ্ক তৈরি করাই জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থার মৌলিক কাজ। উগ্রতা প্রদর্শনপূূর্বক মধ্যম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতিকে চরমত্বে আসীন করানোই জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থাবাদ। পক্ষান্তরে ইসলাম হল তাওহীদের মাধ্যমে আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করা। শারঈ মূলনীতির নিকট আত্মসমর্পণ করে সার্বিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের এজেন্ট বাস্তবায়নকারী ইসলামদ্রোহী মিডিয়া চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করছে। অথচ ইসলামী শরী‘আত, ইতিহাস ও বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে কিছু অমুসলিম এবং নামধারি মুসলিম ইসলামের অপব্যাখ্যা করে ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকা-ে লিপ্ত হচ্ছে। মূলত কুরআন সুন্নার মৌলিক জ্ঞান না থাকা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণই তাদেরকে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করছে। এ জন্য তারা সর্বাস্থায় উগ্রতা এবং চরমপন্থার পথ অবলম্বন করছে। অথচ ইসলামের মধ্যে উগ্রতা ও চরমপন্থার কোন স্থান নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘দ্বীনের মধ্যে কোন জবরদস্তি নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৬)।
এর পরেও কেউ যদি দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে জঙ্গি কর্মকাণ্ড, উগ্রতা ও চরমপন্থার মাধ্যমে কোন মানব হত্যা অথবা দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘যে কেউ সীমালংঘন ও যুলুম করে হত্যাকা- সংঘটিত করবে, আমি তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব’ (সূরা আন-নিসা : ৩০)।
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম:
ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে বা কোন স্বার্থ হাছিলের জন্য চোরাগোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, হত্যা, বোমা বিষ্ফোরণ, আত্মঘাতী হামলা কিংবা নির্দিষ্ট কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ‘জঙ্গীবাদ’ বা চরমপন্থা। ‘জঙ্গিবাদ’ চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের প্রতিরূপ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া বা বক্তৃতা-বিবৃতিতে জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যারা ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘জঙ্গি’। যারা সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত তাদেরকে ‘চরমপন্থী’ বলা হচ্ছে। আর যারা প্রচলিত সাধারণ রাজনৈতিক দলের নামে বা কোনো দল, মতবাদ, দর্শন বা আদর্শের নাম না নিয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ বলা হচ্ছে। অথচ এরূপ পার্থক্যের ভাষাগত বা তথ্যগত কোন ভিত্তি নেই। তারপরও কোনোরূপ ভাষাগত ভিত্তি ছাড়াই ‘জঙ্গিবাদ’-কে ইসলামের নামে সহিংসতা অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ ‘সন্ত্রাস’ ও ‘চরমপন্থা’ জঙ্গিবাদের চাইতে বেশি আতঙ্ক, উগ্রতা ও সহিংসতার নাম। তারপরও দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রি মিডিয়াতে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে উপেক্ষা করে জঙ্গিবাদকে মানুষের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যাতে মনে হচ্ছে একমাত্র ইসলাম ও মুসলিম ব্যক্তিই জঙ্গিবাদের মদদদাতা। অথচ ইসলামের সাথে এই জঙ্গিবাদের কোন সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে আহলেহাদীসদের উপরও জঙ্গিবাদের অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে। অথচ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের নিশঃর্ত অনুসারীকে ‘আহলেহাদীস’ বলা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে অনেক স্থানে ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন (সূরা আয-যুমার : ২৩), তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও কুরআনকে ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন (সহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭)।
তাই যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসকে অগ্রাধিকার দেন এবং এ দু’টির নিকট আত্মসমর্পণ করেন তাদেরকেই ‘আহলেহাদীস’ বলা হয়। ‘আহলেহাদীস’ হল (মতবাদ বিক্ষুদ্ধ ও আক্বীদাগত বিভ্রান্তিতে পতিত বিভক্ত উম্মত হতে পবিত্র) একজন আদর্শ মুসলিমের বৈশিষ্ট্যগত নাম। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল যুগেই এই নামটি সুপ্রসিদ্ধ। যদিও বৈশিষ্ট্যগত নাম হিসাবে আরো কতগুলো নাম বর্ণিত হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ, এ দু’টির দাওয়াতকে সার্বিক জীবনে ছড়িয়ে দেয়াই তাদের মূল টার্গেট। শিরকমুক্ত তাওহীদ এবং বিদ‘আতমুক্ত আমল প্রতিষ্ঠাই তাদের মৌলিক লক্ষ্য। আর এই মহতী কাজে আঞ্জাম দিতে গিয়ে তাদেরকে নানারূপী নির্যাতন, যুলম ও অপবাদের শিকার হতে হয়। বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে।
যুগ যুগ ধরে হিংসুকদের একটি শ্রেণী আহলেহাদীসদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে, বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে চিত্রিত করেছে, বর্তমানেও করছে। কখনো ওহাবী, কখনো লা মাযহাবী, কখনো রাফাদানী, ফরাযী, গাইর মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি। বিগত কিছু বছর যাবৎ জঙ্গী, চরমপন্থী বলে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন যে, ‘উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িতদের ৯০ শতাংশই আহলে হাদিস’, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে (১১/১২/১৯ তারিখে) প্রকাশিত হয়েছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আহলেহাদীসগণ যেমন শৈথিল্যবাদী নন তেমনি চরমপন্থীও নন। তারা সর্বদা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে থাকেন। তারা কখনো উগ্রবাদে বিশ্বাস করেন না। কারণ আহলেহাদীসদের সাথে চরমপন্থা, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের পরিচয়:
জঙ্গিবাদ শব্দটি ‘জঙ্গি’ এবং ‘বাদ’ দু’টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘জঙ্গি’ শব্দটি জঙ্গ শব্দের বিশেষণ। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, লড়াই, তুমুল কলহ ইত্যাদি। আর জঙ্গি অর্থ রণনিপুণ, রণদক্ষ।[১]
অর্থাৎ তুমুল কলহ সৃষ্টিকারীই জঙ্গি। ‘বাদ’ শব্দটি বিশেষ্য। অর্থ হল মত, মতবাদ। অতএব ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দের অর্থ হল যুদ্ধ বা তুমুল কলহের মতবাদ।
জঙ্গিকে ইংরেজীতে বলা হয় Militant (মিলিট্যান্ট)। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে, Using or willing to use force or strong pressure to achieve your aims, especially to achieve social or political change. ‘মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তি বা জোরালো প্রভাব ব্যবহার করার ইচ্ছা করে। বিশেষত সামাজিব বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য।[২]
Merriam-Wepster`s Collegiate Dictionary-তে Militant (মিলিট্যান্ট)-এর দু’টি অর্থ করা হয়েছে। 1. Engaged in warfare or combat fighting 2. Aggressively active (as in a cause). অর্থাৎ মিলিট্যান্ট (জঙ্গি) : যুদ্ধ বা সম্মুখসমরে লিপ্ত ব্যক্তি, যুদ্ধরত। উগ্রভাবে সক্রিয়’।[৩]
দ্বিতীয় অর্থটি আরো স্পষ্ট হবে ‘মাইক্রোসফট এনকার্টা’-এর পরিচয়ে। সেখানে জঙ্গি শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, Aggressive, extremely active in the defense or support of a cause, often to the point of extremism. ‘আগ্রাসী, কোন বিষয়ের পক্ষে বা সমর্থনে চরমভাবে সক্রিয়, যা প্রায়শ চরমপন্থা পর্যন্ত পৌঁছায়’।[৪]
চরমপন্থা হল উগ্রপন্থা বা উগ্রবাদ। আর যে ব্যক্তি এ পথ অবলম্বন করে তাকে চরমপন্থী বলা হয়। এর আরবী প্রতিশব্দ হল اَلتَّطَرُّفُ। সে দিক থেকে تَطَرُّفِىّ অর্থ চরমপন্থী এবং تَطَرُّفِيَّةٌ অর্থ চরমপন্থাবাদ।
চরমপন্থার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,
‘সে ন্যায়পূর্ণ পন্থার সীমালংঘন করেছে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেনি’।[৫]
‘চরম’ বিশেষ্য শব্দ। ‘চরম’ শব্দ সর্বোচ্চ, সর্বশেষ অবস্থা বা সংকটময় অবস্থা বা চূড়ান্ত সিন্ধান্তকে বুঝায়।[৬]
আর পন্থা অর্থ পথ বা উপায়। পন্থি হল বিশেষ ধর্ম সম্প্রাদায়ভুক্ত বা মতানুসারী।[৭]
অতএব চরমপন্থা অর্থ হল- সর্বোচ্চ উপায় বা সর্বশেষ পথ। আর চরমপন্থি হল উগ্রপন্থি।[৮]
চরমপন্থা হল কোন বিষয়ে চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বন করা। উগ্রতা প্রদর্শনপূূর্বক মধ্যম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতিকে চরমত্বে আসীন করানোই চরমপন্থা।[৯] Ultraism বা চরমপন্থাবাদ নামে মতবাদও প্রচলিত আছে। যাতে ধর্মমত ও অনুশাসনের ক্ষেত্রে সীমাতিক্রান্ত বুঝায়।[১০]
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আল্ট্রাইজম বা চরমপন্থাবাদ কথাটি মানবতা বিরোধী মতবাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[১১]
চরমপন্থীকে ইংরেজীতে বলা হয় Extremist। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে- A person whose opinions, especially about religion or politics, are extreme, and who may do things that are violent, illegal, etc. ‘কোন ব্যক্তির ধর্মীয় বা রাজনীতির বিষয়ে অভিমতের শেষ সীমা এবং যে হিংস্র, অবৈধ বা নিষিদ্ধ ইত্যাদি কাজ করতে পারে’।[১২]
চরমপন্থার সাথে গোঁড়ামির অনেকটা মিল রয়েছে। গোঁড়ামি হল অত্যন্ত পক্ষপাত বা পক্ষপাতের আতিশয্য, একগুঁয়েমী, যিদ। নিয়ম-কানুন বা যুক্তির তোয়াক্কা না করে কোন চিন্তা ও বিশ্বাসকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরাই গোঁড়ামি, যা সাধারণত ধর্মীয় ক্ষেত্রেই বেশী পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্র ও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে পরবর্তীতে প্রতিভাত হওয়া উন্নয়নশীল প্রক্রিয়া ও কৌশলকে উপেক্ষা করা। তাই শুধু ধর্ম নয়, বরং রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এমনকি প্রগতিবাদের ক্ষেত্রেও গোঁড়ামীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।[১৩]
মূলত গোঁড়ামি ও চরমপন্থা মনুষ্য প্রবৃত্তির খণ্ডিত দু’টি অংশ। এ জন্য শব্দ দু’টি সাধারণত পাশাপাশি আলোচিত হয়। আবার কখনো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। একপেশে সিদ্ধান্তের উপর অটুট থাকার মাধ্যমে যেমন চরমত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তেমনি কোন বিষয়ে চরম পন্থাকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টে-পৃষ্ঠে আঁকড়ে থাকলে গোঁড়ামির স্বরূপ ফুটে উঠে। এ জন্য চরমপন্থী ও গোঁড়া ব্যক্তি সত্য গ্রহণ করতে পারে না এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।[১৪]
উপরিউক্ত পরিচয় থেকে জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থা কোনটিই বে-আইনী অপরাধ বুঝায় না। বরং উপরিউক্ত অর্থের ভিত্তিতে সকল দেশের সকল রাজনৈতিক, আদর্শিক, পেশাজীবি ও সামাজিক দলই জঙ্গি বা চরমপন্থী। কেননা সকলেই উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য শক্তি প্রয়োগ করে এবং সকলেই তাদের নিজেদের আদর্শ ও স্বার্থ রক্ষায় উগ্রভাবে সক্রিয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত ‘জঙ্গি’ শব্দটি একটি আতঙ্কের নাম। জঙ্গি বলতে এখন বে-আইনী সহিংসতা ও খুনখারাবি, হত্যা, আত্মঘাতী বোমা হামলা ইত্যাদি বুঝানো হচ্ছে। অথচ এ অর্থে সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ পরিভাষা হল সন্ত্রাস (terrorism)।
‘সন্ত্রাস’ শব্দের অর্থ হল ভয়, ভীতি, শঙ্কা।[১৫]
আর ‘সন্ত্রাস’ হল, আতঙ্কগ্রস্ত করা, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা।[১৬]
কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি। আর সন্ত্রাসবাদ হল- রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠান-নীতি।[১৭]
ইংরেজীতে ‘সন্ত্রাস’ শব্দের প্রতিশব্দ হল, Terror। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে- Violent action or the threat of violent action that is intended to cause fear, usually for political purposes. . ‘সাধারণত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হিংস্র কাজ বা হিংস্র কাজের মাধ্যমে ভীতিপ্রদর্শন। যা দ্বারা আতঙ্ক বা ভীতি প্রদর্শনই মূল উদ্দেশ্য’।[১৮]
যেকোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পথ বেছে নেয়া। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য সংঘবদ্ধভাবে ভয় দেখিয়ে বশ বানানোর নীতি অবলম্বন করাকেই সন্ত্রাস বলে।[১৯]
The New Encyclopaedia Britannica- তে বলা হয়েছে, Terrorism, the systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective. ‘একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করার সুসংগঠিত পন্থাই হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদ’।[২০]
মার্কিন সরকারের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ((FBI)) -এফ. বি. আই-এর মতে ‘সন্ত্রাস’ হল-
Terrorism is the unlawful use of force or violence against person or property to intimidate or coerce a government. The civilian population or any segment there of in furtherance of political of social objectives. অর্থাৎ ‘সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোন সরকার, বেসরকারী জনগণ বা অন্য যেকোন অংশকে ভীতি প্রদর্শন বা দমনের জন্য ব্যক্তিবর্গ বা সম্পদের উপর অবৈধ শক্তি প্রয়োগ বা সহিংস ব্যবহারকে ‘সন্ত্রাস’ বলা হয়’।[২১]
ইসলামের পরিচয়:
ইসলাম শব্দের অর্থ মেনে নেয়া, আত্মসমর্পণ করা, বিনম্র হওয়া।[২২]
শরী‘আতের পরিভাষায় ইসলাম হল- ‘আল্লাহর তাওহীদ তথা তাঁর এককত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা এবং শিরক ও তার অনুসারীবৃন্দ হতে বিশুদ্ধ হওয়া’।[২৩]
আর মুসলিম হল আত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ যে আল্লাহর তাওহীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, সকল বিষয়ে তাঁর অনুগত হয় এবং শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার ইবাদত (কুরবানী ও হজ্জ), আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমুহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে, তাঁর কোন শরীক নেই, আর আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬২-১৬৩)।
ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন’ (সূরা আলে-‘ইমরান : ১৯)।
এ কারণে তিনি আমাদের জন্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন এবং তাঁর অভিমুখী হতে এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর’ (সূরা আয-যুমার : ৫৪)।
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে আমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছেন এবং তাঁর নির্দেশনার নিকট আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেহেতু ইসলামের বাহিরে অন্য কোন কিছু আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)।
‘হাদীসে জিবরীল’ নামে বিখ্যাত হাদীসে এসেছে। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘ইসলাম হল এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই, আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাযানের সিয়াম পালন করা, আর যদি আল্লাহর ঘরে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে তবে তার হজ্জ করা’।[২৪]
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত।[২৫]
তার মধ্যে প্রথম স্তম্ভ হল ‘এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত হক্ব কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। এখানে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ সাক্ষ্যের অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ব মা‘বূদ নেই। আর ‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্যের অর্থ : তিনি যা নির্দেশ করেছেন তা মেনে তার অনুসরণ করা, যা কিছুর সংবাদ দিয়েছেন তা বিশ্বাস করা, যা যা করতে নিষেধ ও সাবধান করেছেন তা থেকে চেঁচে থাকা এবং তিনি যেভাবে পথনির্দেশ করেছেন কেবল সেভাবেই আল্লাহর ইবাদত করা।[২৬]
তথ্যসূত্র :
[১]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (পরিমার্জিত সংস্করণ, পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ : ভাদ্র ১৪১০/ সেপ্টেম্বর ২০০৩), পৃ. ৪৪৮।
[২]. A.S Hornby, Oxford Advanced Learner’s Dictionary (OXFORD UNIVERSITY PRESS, New 9th Edition ), p. 982.
[৩]. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ (ঝিনাইদহ : আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ২য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারী ২০০৯), পৃ. ৯।
[৪]. ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, পৃ. ৯।
[৫]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও তার সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (দারুদ দাওয়াহ, তাবি), ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৫৫।
[৬]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৪০১।
[৭]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১৭।
[৮]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০১।
[৯]. মুযাফফর বিন মুহসিন, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন (রাজশাহী : বাংলাদেশ আহলেহাদীস যুবসংঘ, ২য় সংস্করণ, জুলাই ২০১৪), পৃ. ৩০।
[১০]. SAILENDRA BIWAS, SAMSAD ENNGLISH-BENGALI DICTIONARY (CALCUTTA; SAHITYA SAMSAD. 46th Impression; June 1998), P. 1227.
[১১]. বদিউর রহমান, সাহিত্য সংজ্ঞা অভিধান (ঢাকা: গতিধারা ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০০১), পৃ. ৮৩।
[১২]. Oxford Advanced Learner’s Dictionary, p. 545.
[১৩]. হারুনুর রশীদ, রাজনীতি কোষ (ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ৩৯ বাংলা বাজার, দ্বিতীয় প্রকাশ: আগষ্ট ২০০০), পৃ. ১৫৬-৫৭; সংগৃহীত : ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন, পৃ. ৩২।
[১৪]. ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন, পৃ. ৩২।
[১৫]. বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১ম প্রকাশ, ১৯৯২), পৃ. ২৬৬।
[১৬]. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান (কলিকাতা : সাহিত্য সংসদ, ২২তম মুদ্রণ, ১৯৯৮), পৃ. ৬৬১।
[১৭]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ১১১৩।
[১৮]. Oxford Advanced Learner’s Dictionary , p. 1618.
[১৯]. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, পৃ. ৬৬১; বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, পৃ. ৫৪১।
[২০]. The New Encyclopaedia Britannica (USA: 2002), Vol. 11, P. 650.
[২১]. ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম, জিহাদ ও জঙ্গীবাদ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ৩৮।
[২২]. নুখবাতু মিনাল ওলামাই (মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের করেকজন বিশেষজ্ঞ আলেম), উছূলুল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়া ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দাওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ১৪২১ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮; আল-ঈমানুল কাবীর লি ইবনে তাইমিয়া; তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (আম্মান : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৫ম সংস্করণ, ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।
[২৩]. মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু আলী আল-ইয়ামানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিত তাওহীদ (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১৪২৭ হি./২০০৬ খৃ.), পৃ. ৪৩।
[২৪]. সহীহ মুসলিম, হা/৮; সহীহ বুখারী, হা/৮।
[২৫]. সহীহ বুখারী, হা/৮, ৪৫১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৮।
[২৬]. উছূলুল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৯।
বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের এজেন্ট বাস্তবায়নকারী ইসলামদ্রোহী মিডিয়া চরমপন্থা এবং জঙ্গিবাদকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করছে। অথচ ইসলামী শরী‘আত, ইতিহাস ও বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে কিছু অমুসলিম এবং নামধারি মুসলিম ইসলামের অপব্যাখ্যা করে ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকা-ে লিপ্ত হচ্ছে। মূলত কুরআন সুন্নার মৌলিক জ্ঞান না থাকা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণই তাদেরকে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করছে। এ জন্য তারা সর্বাস্থায় উগ্রতা এবং চরমপন্থার পথ অবলম্বন করছে। অথচ ইসলামের মধ্যে উগ্রতা ও চরমপন্থার কোন স্থান নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَاۤ اِکۡرَاہَ فِی الدِّیۡنِ
‘দ্বীনের মধ্যে কোন জবরদস্তি নেই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৫৬)।
এর পরেও কেউ যদি দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে জঙ্গি কর্মকাণ্ড, উগ্রতা ও চরমপন্থার মাধ্যমে কোন মানব হত্যা অথবা দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাহলে তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ عُدۡوَانًا وَّ ظُلۡمًا فَسَوۡفَ نُصۡلِیۡہِ نَارًا
‘যে কেউ সীমালংঘন ও যুলুম করে হত্যাকা- সংঘটিত করবে, আমি তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব’ (সূরা আন-নিসা : ৩০)।
জঙ্গিবাদ বনাম ইসলাম:
ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে বা কোন স্বার্থ হাছিলের জন্য চোরাগোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, হত্যা, বোমা বিষ্ফোরণ, আত্মঘাতী হামলা কিংবা নির্দিষ্ট কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ‘জঙ্গীবাদ’ বা চরমপন্থা। ‘জঙ্গিবাদ’ চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের প্রতিরূপ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকা, মিডিয়া বা বক্তৃতা-বিবৃতিতে জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যারা ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত তাদেরকে বলা হচ্ছে ‘জঙ্গি’। যারা সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত তাদেরকে ‘চরমপন্থী’ বলা হচ্ছে। আর যারা প্রচলিত সাধারণ রাজনৈতিক দলের নামে বা কোনো দল, মতবাদ, দর্শন বা আদর্শের নাম না নিয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ বলা হচ্ছে। অথচ এরূপ পার্থক্যের ভাষাগত বা তথ্যগত কোন ভিত্তি নেই। তারপরও কোনোরূপ ভাষাগত ভিত্তি ছাড়াই ‘জঙ্গিবাদ’-কে ইসলামের নামে সহিংসতা অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ ‘সন্ত্রাস’ ও ‘চরমপন্থা’ জঙ্গিবাদের চাইতে বেশি আতঙ্ক, উগ্রতা ও সহিংসতার নাম। তারপরও দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রি মিডিয়াতে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে উপেক্ষা করে জঙ্গিবাদকে মানুষের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যাতে মনে হচ্ছে একমাত্র ইসলাম ও মুসলিম ব্যক্তিই জঙ্গিবাদের মদদদাতা। অথচ ইসলামের সাথে এই জঙ্গিবাদের কোন সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে আহলেহাদীসদের উপরও জঙ্গিবাদের অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে। অথচ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের নিশঃর্ত অনুসারীকে ‘আহলেহাদীস’ বলা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে অনেক স্থানে ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন (সূরা আয-যুমার : ২৩), তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও কুরআনকে ‘হাদীস’ বলে উল্লেখ করেছেন (সহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭)।
তাই যারা সার্বিক জীবনে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসকে অগ্রাধিকার দেন এবং এ দু’টির নিকট আত্মসমর্পণ করেন তাদেরকেই ‘আহলেহাদীস’ বলা হয়। ‘আহলেহাদীস’ হল (মতবাদ বিক্ষুদ্ধ ও আক্বীদাগত বিভ্রান্তিতে পতিত বিভক্ত উম্মত হতে পবিত্র) একজন আদর্শ মুসলিমের বৈশিষ্ট্যগত নাম। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল যুগেই এই নামটি সুপ্রসিদ্ধ। যদিও বৈশিষ্ট্যগত নাম হিসাবে আরো কতগুলো নাম বর্ণিত হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ, এ দু’টির দাওয়াতকে সার্বিক জীবনে ছড়িয়ে দেয়াই তাদের মূল টার্গেট। শিরকমুক্ত তাওহীদ এবং বিদ‘আতমুক্ত আমল প্রতিষ্ঠাই তাদের মৌলিক লক্ষ্য। আর এই মহতী কাজে আঞ্জাম দিতে গিয়ে তাদেরকে নানারূপী নির্যাতন, যুলম ও অপবাদের শিকার হতে হয়। বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে।
যুগ যুগ ধরে হিংসুকদের একটি শ্রেণী আহলেহাদীসদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে, বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে চিত্রিত করেছে, বর্তমানেও করছে। কখনো ওহাবী, কখনো লা মাযহাবী, কখনো রাফাদানী, ফরাযী, গাইর মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি। বিগত কিছু বছর যাবৎ জঙ্গী, চরমপন্থী বলে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন যে, ‘উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িতদের ৯০ শতাংশই আহলে হাদিস’, যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে (১১/১২/১৯ তারিখে) প্রকাশিত হয়েছে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আহলেহাদীসগণ যেমন শৈথিল্যবাদী নন তেমনি চরমপন্থীও নন। তারা সর্বদা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে থাকেন। তারা কখনো উগ্রবাদে বিশ্বাস করেন না। কারণ আহলেহাদীসদের সাথে চরমপন্থা, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের পরিচয়:
জঙ্গিবাদ শব্দটি ‘জঙ্গি’ এবং ‘বাদ’ দু’টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘জঙ্গি’ শব্দটি জঙ্গ শব্দের বিশেষণ। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, লড়াই, তুমুল কলহ ইত্যাদি। আর জঙ্গি অর্থ রণনিপুণ, রণদক্ষ।[১]
অর্থাৎ তুমুল কলহ সৃষ্টিকারীই জঙ্গি। ‘বাদ’ শব্দটি বিশেষ্য। অর্থ হল মত, মতবাদ। অতএব ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দের অর্থ হল যুদ্ধ বা তুমুল কলহের মতবাদ।
জঙ্গিকে ইংরেজীতে বলা হয় Militant (মিলিট্যান্ট)। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে, Using or willing to use force or strong pressure to achieve your aims, especially to achieve social or political change. ‘মিলিট্যান্ট বা জঙ্গি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তি বা জোরালো প্রভাব ব্যবহার করার ইচ্ছা করে। বিশেষত সামাজিব বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য।[২]
Merriam-Wepster`s Collegiate Dictionary-তে Militant (মিলিট্যান্ট)-এর দু’টি অর্থ করা হয়েছে। 1. Engaged in warfare or combat fighting 2. Aggressively active (as in a cause). অর্থাৎ মিলিট্যান্ট (জঙ্গি) : যুদ্ধ বা সম্মুখসমরে লিপ্ত ব্যক্তি, যুদ্ধরত। উগ্রভাবে সক্রিয়’।[৩]
দ্বিতীয় অর্থটি আরো স্পষ্ট হবে ‘মাইক্রোসফট এনকার্টা’-এর পরিচয়ে। সেখানে জঙ্গি শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, Aggressive, extremely active in the defense or support of a cause, often to the point of extremism. ‘আগ্রাসী, কোন বিষয়ের পক্ষে বা সমর্থনে চরমভাবে সক্রিয়, যা প্রায়শ চরমপন্থা পর্যন্ত পৌঁছায়’।[৪]
চরমপন্থা হল উগ্রপন্থা বা উগ্রবাদ। আর যে ব্যক্তি এ পথ অবলম্বন করে তাকে চরমপন্থী বলা হয়। এর আরবী প্রতিশব্দ হল اَلتَّطَرُّفُ। সে দিক থেকে تَطَرُّفِىّ অর্থ চরমপন্থী এবং تَطَرُّفِيَّةٌ অর্থ চরমপন্থাবাদ।
চরমপন্থার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,
جَاوَزَ حَدَّ الْاِعْتِدَالِ وَلَمْ يَتَوَسَّطْ
‘সে ন্যায়পূর্ণ পন্থার সীমালংঘন করেছে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেনি’।[৫]
‘চরম’ বিশেষ্য শব্দ। ‘চরম’ শব্দ সর্বোচ্চ, সর্বশেষ অবস্থা বা সংকটময় অবস্থা বা চূড়ান্ত সিন্ধান্তকে বুঝায়।[৬]
আর পন্থা অর্থ পথ বা উপায়। পন্থি হল বিশেষ ধর্ম সম্প্রাদায়ভুক্ত বা মতানুসারী।[৭]
অতএব চরমপন্থা অর্থ হল- সর্বোচ্চ উপায় বা সর্বশেষ পথ। আর চরমপন্থি হল উগ্রপন্থি।[৮]
চরমপন্থা হল কোন বিষয়ে চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বন করা। উগ্রতা প্রদর্শনপূূর্বক মধ্যম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতিকে চরমত্বে আসীন করানোই চরমপন্থা।[৯] Ultraism বা চরমপন্থাবাদ নামে মতবাদও প্রচলিত আছে। যাতে ধর্মমত ও অনুশাসনের ক্ষেত্রে সীমাতিক্রান্ত বুঝায়।[১০]
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আল্ট্রাইজম বা চরমপন্থাবাদ কথাটি মানবতা বিরোধী মতবাদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[১১]
চরমপন্থীকে ইংরেজীতে বলা হয় Extremist। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে- A person whose opinions, especially about religion or politics, are extreme, and who may do things that are violent, illegal, etc. ‘কোন ব্যক্তির ধর্মীয় বা রাজনীতির বিষয়ে অভিমতের শেষ সীমা এবং যে হিংস্র, অবৈধ বা নিষিদ্ধ ইত্যাদি কাজ করতে পারে’।[১২]
চরমপন্থার সাথে গোঁড়ামির অনেকটা মিল রয়েছে। গোঁড়ামি হল অত্যন্ত পক্ষপাত বা পক্ষপাতের আতিশয্য, একগুঁয়েমী, যিদ। নিয়ম-কানুন বা যুক্তির তোয়াক্কা না করে কোন চিন্তা ও বিশ্বাসকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরাই গোঁড়ামি, যা সাধারণত ধর্মীয় ক্ষেত্রেই বেশী পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্র ও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে পরবর্তীতে প্রতিভাত হওয়া উন্নয়নশীল প্রক্রিয়া ও কৌশলকে উপেক্ষা করা। তাই শুধু ধর্ম নয়, বরং রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এমনকি প্রগতিবাদের ক্ষেত্রেও গোঁড়ামীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।[১৩]
মূলত গোঁড়ামি ও চরমপন্থা মনুষ্য প্রবৃত্তির খণ্ডিত দু’টি অংশ। এ জন্য শব্দ দু’টি সাধারণত পাশাপাশি আলোচিত হয়। আবার কখনো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। একপেশে সিদ্ধান্তের উপর অটুট থাকার মাধ্যমে যেমন চরমত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তেমনি কোন বিষয়ে চরম পন্থাকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টে-পৃষ্ঠে আঁকড়ে থাকলে গোঁড়ামির স্বরূপ ফুটে উঠে। এ জন্য চরমপন্থী ও গোঁড়া ব্যক্তি সত্য গ্রহণ করতে পারে না এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।[১৪]
উপরিউক্ত পরিচয় থেকে জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থা কোনটিই বে-আইনী অপরাধ বুঝায় না। বরং উপরিউক্ত অর্থের ভিত্তিতে সকল দেশের সকল রাজনৈতিক, আদর্শিক, পেশাজীবি ও সামাজিক দলই জঙ্গি বা চরমপন্থী। কেননা সকলেই উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য শক্তি প্রয়োগ করে এবং সকলেই তাদের নিজেদের আদর্শ ও স্বার্থ রক্ষায় উগ্রভাবে সক্রিয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত ‘জঙ্গি’ শব্দটি একটি আতঙ্কের নাম। জঙ্গি বলতে এখন বে-আইনী সহিংসতা ও খুনখারাবি, হত্যা, আত্মঘাতী বোমা হামলা ইত্যাদি বুঝানো হচ্ছে। অথচ এ অর্থে সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ পরিভাষা হল সন্ত্রাস (terrorism)।
‘সন্ত্রাস’ শব্দের অর্থ হল ভয়, ভীতি, শঙ্কা।[১৫]
আর ‘সন্ত্রাস’ হল, আতঙ্কগ্রস্ত করা, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা।[১৬]
কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি। আর সন্ত্রাসবাদ হল- রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠান-নীতি।[১৭]
ইংরেজীতে ‘সন্ত্রাস’ শব্দের প্রতিশব্দ হল, Terror। Oxford Advanced Learner’s Dictionary-তে বলা হয়েছে- Violent action or the threat of violent action that is intended to cause fear, usually for political purposes. . ‘সাধারণত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হিংস্র কাজ বা হিংস্র কাজের মাধ্যমে ভীতিপ্রদর্শন। যা দ্বারা আতঙ্ক বা ভীতি প্রদর্শনই মূল উদ্দেশ্য’।[১৮]
যেকোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পথ বেছে নেয়া। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য সংঘবদ্ধভাবে ভয় দেখিয়ে বশ বানানোর নীতি অবলম্বন করাকেই সন্ত্রাস বলে।[১৯]
The New Encyclopaedia Britannica- তে বলা হয়েছে, Terrorism, the systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective. ‘একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করার সুসংগঠিত পন্থাই হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদ’।[২০]
মার্কিন সরকারের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ((FBI)) -এফ. বি. আই-এর মতে ‘সন্ত্রাস’ হল-
Terrorism is the unlawful use of force or violence against person or property to intimidate or coerce a government. The civilian population or any segment there of in furtherance of political of social objectives. অর্থাৎ ‘সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোন সরকার, বেসরকারী জনগণ বা অন্য যেকোন অংশকে ভীতি প্রদর্শন বা দমনের জন্য ব্যক্তিবর্গ বা সম্পদের উপর অবৈধ শক্তি প্রয়োগ বা সহিংস ব্যবহারকে ‘সন্ত্রাস’ বলা হয়’।[২১]
ইসলামের পরিচয়:
ইসলাম শব্দের অর্থ মেনে নেয়া, আত্মসমর্পণ করা, বিনম্র হওয়া।[২২]
শরী‘আতের পরিভাষায় ইসলাম হল- ‘আল্লাহর তাওহীদ তথা তাঁর এককত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা এবং শিরক ও তার অনুসারীবৃন্দ হতে বিশুদ্ধ হওয়া’।[২৩]
আর মুসলিম হল আত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ যে আল্লাহর তাওহীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, সকল বিষয়ে তাঁর অনুগত হয় এবং শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ .لَا شَرِیۡکَ لَہٗ وَ بِذٰلِکَ اُمِرۡتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার ইবাদত (কুরবানী ও হজ্জ), আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমুহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে, তাঁর কোন শরীক নেই, আর আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬২-১৬৩)।
ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰہِ الۡاِسۡلَامُ
‘নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন’ (সূরা আলে-‘ইমরান : ১৯)।
এ কারণে তিনি আমাদের জন্য ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন এবং তাঁর অভিমুখী হতে এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَہٗ
‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর’ (সূরা আয-যুমার : ৫৪)।
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে আমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছেন এবং তাঁর নির্দেশনার নিকট আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেহেতু ইসলামের বাহিরে অন্য কোন কিছু আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَنۡ یَّبۡتَغِ غَیۡرَ الۡاِسۡلَامِ دِیۡنًا فَلَنۡ یُّقۡبَلَ مِنۡہُ وَ ہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
‘আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)।
‘হাদীসে জিবরীল’ নামে বিখ্যাত হাদীসে এসেছে। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘ইসলাম হল এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই, আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাযানের সিয়াম পালন করা, আর যদি আল্লাহর ঘরে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে তবে তার হজ্জ করা’।[২৪]
ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত।[২৫]
তার মধ্যে প্রথম স্তম্ভ হল ‘এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত হক্ব কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। এখানে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ সাক্ষ্যের অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ব মা‘বূদ নেই। আর ‘মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্যের অর্থ : তিনি যা নির্দেশ করেছেন তা মেনে তার অনুসরণ করা, যা কিছুর সংবাদ দিয়েছেন তা বিশ্বাস করা, যা যা করতে নিষেধ ও সাবধান করেছেন তা থেকে চেঁচে থাকা এবং তিনি যেভাবে পথনির্দেশ করেছেন কেবল সেভাবেই আল্লাহর ইবাদত করা।[২৬]
তথ্যসূত্র :
[১]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (পরিমার্জিত সংস্করণ, পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ : ভাদ্র ১৪১০/ সেপ্টেম্বর ২০০৩), পৃ. ৪৪৮।
[২]. A.S Hornby, Oxford Advanced Learner’s Dictionary (OXFORD UNIVERSITY PRESS, New 9th Edition ), p. 982.
[৩]. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ (ঝিনাইদহ : আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ২য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারী ২০০৯), পৃ. ৯।
[৪]. ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ, পৃ. ৯।
[৫]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও তার সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (দারুদ দাওয়াহ, তাবি), ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৫৫।
[৬]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৪০১।
[৭]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১৭।
[৮]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০১।
[৯]. মুযাফফর বিন মুহসিন, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন (রাজশাহী : বাংলাদেশ আহলেহাদীস যুবসংঘ, ২য় সংস্করণ, জুলাই ২০১৪), পৃ. ৩০।
[১০]. SAILENDRA BIWAS, SAMSAD ENNGLISH-BENGALI DICTIONARY (CALCUTTA; SAHITYA SAMSAD. 46th Impression; June 1998), P. 1227.
[১১]. বদিউর রহমান, সাহিত্য সংজ্ঞা অভিধান (ঢাকা: গতিধারা ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০০১), পৃ. ৮৩।
[১২]. Oxford Advanced Learner’s Dictionary, p. 545.
[১৩]. হারুনুর রশীদ, রাজনীতি কোষ (ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ৩৯ বাংলা বাজার, দ্বিতীয় প্রকাশ: আগষ্ট ২০০০), পৃ. ১৫৬-৫৭; সংগৃহীত : ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন, পৃ. ৩২।
[১৪]. ভ্রান্তির বেড়াজালে ইক্বামতে দ্বীন, পৃ. ৩২।
[১৫]. বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১ম প্রকাশ, ১৯৯২), পৃ. ২৬৬।
[১৬]. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান (কলিকাতা : সাহিত্য সংসদ, ২২তম মুদ্রণ, ১৯৯৮), পৃ. ৬৬১।
[১৭]. বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ১১১৩।
[১৮]. Oxford Advanced Learner’s Dictionary , p. 1618.
[১৯]. সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, পৃ. ৬৬১; বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, পৃ. ৫৪১।
[২০]. The New Encyclopaedia Britannica (USA: 2002), Vol. 11, P. 650.
[২১]. ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম, জিহাদ ও জঙ্গীবাদ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ৩৮।
[২২]. নুখবাতু মিনাল ওলামাই (মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের করেকজন বিশেষজ্ঞ আলেম), উছূলুল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ (সঊদী আরব : ওযারাতুশ শুয়ূনিল ইসলামিয়া ওয়াল আওক্বাফ ওয়াদ দাওয়াতি ওয়াল ইরশাদ, ১৪২১ হি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮; আল-ঈমানুল কাবীর লি ইবনে তাইমিয়া; তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (আম্মান : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৫ম সংস্করণ, ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।
[২৩]. মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনু আলী আল-ইয়ামানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিত তাওহীদ (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১৪২৭ হি./২০০৬ খৃ.), পৃ. ৪৩।
[২৪]. সহীহ মুসলিম, হা/৮; সহীহ বুখারী, হা/৮।
[২৫]. সহীহ বুখারী, হা/৮, ৪৫১৪; সহীহ মুসলিম, হা/৮।
[২৬]. উছূলুল ঈমান ফী যূইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৯।
Last edited: