ইলম আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নে‘মত, যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না তার কি সমান?’ (সূরা আয-যুমার : ৯)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হতে পারে?’ (সূরা আর-রা‘দ : ১৬)।
ইলম নিতে হয় আলেমদের থেকে। যাদের আক্বীদা, মানহাজ বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করে। তবে নিচের আক্বীদা-মানহাজে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের থেকে ইলম বা ফাতাওয়া গ্রহণ করা যাবে না। (১) যে ব্যক্তির আক্বীদা মানহাজ বিশুদ্ধ নয়, বরং শিরক-বিদ‘আত মিশ্রিত। অর্থাৎ মাজারে প্রার্থনাকারী, তাবীয ব্যবহারের পক্ষে ওকালতি কারী, পীর-মুরীদী প্রথায় বিশ্বাসী, ঈদে মীলাদুন্নবী পালনকারী, মৃত ব্যক্তির জন্য ৪ দিন, ৪০ দিন পালনকারী ইত্যাদি ব্যক্তিদের থেকে ইলম নেয়া যাবে না (সূরা আন-নিসা : ৪৮; সূরা আল-মায়েদাহ : ৭২; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৭৮; মিশকাত, হা/১৪)।
(২) আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ নিরাকার, সর্বত্র বিরাজমান, রাসূল (ﷺ) নূরের নবী, তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি নন, সৃষ্টি ¯্রষ্টার অংশ, অলীরা গায়েব জানেন ইত্যাদি ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে থাকে তাদের কাছ থেকে ইলম নেয়া যাবে না (সূরা আন-নামল : ৬৫; সূরা ত্বোহা : ৫; সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০)।
(৩) যে ব্যক্তি শরী‘আতের মৌলিক বিষয়সমূহ অর্থাৎ আক্বীদা, মানহাজ, হালাল-হারাম, ফরয, ওযাজিব, সুন্নাত, নফল, মুবাহ, কাফের ফাতওয়া দেয়া ইত্যাদি সম্পর্কে সালাফদের মানহাজ অনুযায়ী সঠিক জ্ঞান রাখে না এমন ব্যক্তির নিকট থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (ইবনু মাজাহ, হা/২২৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৫৫, সনদ হাসান)।
(৪) যে আলেমের মধ্যে কুরআন, সহীহ হাদীস, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ, নাসিখ এবং মানসূখ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান নেই, ফলে ইজমা বিরোধী অথবা মানসূখ দলীল বা জাল ও যঈফ হাদীস অনুযায়ী কোন হুকুম দেন। এধরনের ব্যক্তিদের কাছ থেকেও ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২, সনদ হাসান)। শায়খ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যঈফ হাদীসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না এবং তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামের সঙ্গে সম্পৃক্তও করা যাবে না...’ (উছাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, টেপ নং-২৭৬)।
(৫) সেই নির্বোধ লোক, যে প্রকাশ্যে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করে; যদিও সে লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী বা জানলেওয়ালা হয়। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা ত্বোহা : ১২৪; সূরা আল-আহযাব : ৫৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৮০; সহীহুল জামে‘, হা/৭৯৮৪; ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬২)।
(৬) সেই বিদ‘আতী, যে তার প্রবৃত্তির দিকে মানুষকে আহ্বান করে এবং বিদ‘আতে হাসানাহ ও বিদ‘আতে সাইয়িআহ নামে দুই প্রকার বিদআত আছে বলে বিশ্বাস করে এবং সেটা প্রচার করে। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয়। কেননা শরী‘আতে হাসানাহ, সায়্যিআহ নামে কোন ভাল-খারাপ বিদ‘আত নেই। বরং সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (সহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭; নাসাঈ হা/১৫৭৮; মিশকাত, হা/১৪১)।
(৭) যে ব্যক্তির অন্তরে ইখলাছ নেই। যে মানুষের সাথে কথা-বার্তায় মিথ্যা বলে, যদিও আমরা তাকে হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করি না। এমন ব্যক্তির কাছ থেকেও ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা আল-বাইয়িনাহ : ৫; সূরা আয-যুমার : ১১; সহীহ বুখারী, হা/৩৩)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল গ্রহণ করেন না, যতক্ষণ না এ দু’টি রুকন তাতে বিদ্যমান থাকে। যথা- (১) শরী‘আতের পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া এবং (২) শিরক মুক্ত অর্থাৎ ইখলাছের সাথে হওয়া’ (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩)।
(৮) সেই সৎকর্মপরায়ণ ইবাদতগুজার মহৎ বান্দা, যে কুরআনের আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীস স্মরণে রাখতে পারে না। ফলে ক্বিয়াস করে ভুল ফাতাওয়া দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (বায়হাক্বী, হা/৫৭৫১; মিশকাত, হা/২৫৫; সহীহুল জামে‘, হা/১৭২৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬২)।
(৯) যে হাদীস সহীহ ও যঈফ যেমন সনদ, রিজাল প্রভৃতি সম্পর্কে উছূল জানে না এবং দলীল থেকে বিধি-বিধান বের করার যোগ্যতা রাখে না। ফলে ইলম বিহীন বিনা দলীলে ফাতাওয়া দেয়। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয়। মুগীরাহ ইবনু শু‘বা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার পক্ষ হতে যে লোক কোন হাদীস বর্ণনা করে অথচ সে জানে যে, তা মিথ্যা, তাহলে সে মিথ্যুকদের একজন’ (তিরমিযী, হা/২৬৬২; ইবনু মাজাহ, হা/৪১; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২)।
(১০) যে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শারঈ জ্ঞান জানে না। অর্থাৎ ঘটনার সাথে বিধি-বিধান সম্বলিত আয়াত ও হাদীসসমূহ জানে না এবং যে সব দলীলের মাধ্যমে হুকুম ভিন্ন হয়ে যায়, তাও জানে না। যেমন خاص করা, শর্তযুক্ত করা প্রভৃতি। ফলে এদের দাবি বিরোধী কোন হুকুম দিয়ে বসেন। এমন ব্যক্তি থেকে ফাতাওয়া নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা আয-যারিয়াত : ১০; তিরমিযী, হা/২৬৬২; সহীহ মুসলিমে মুক্বাদামাহ; ইবনু মাজাহ, হা/৪১; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২)।
(১১) যে আক্বীদা ও মানহাজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শুধু আমল বা ফযীলতের আলোচনা করে এবং যে ইখতেলাফি মাসআলায় কুরআন ও সুন্নাহর ইত্তেবা ও প্রসিদ্ধ সালাফদের মতামত প্রাধান্য না দিয়ে তাক্বলীদে শাখছী অর্থাৎ অন্ধ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট ইমামের মতামত প্রাধান্য দেয়, এমন ব্যক্তি থেকে ইলম বা ফাতাওয়া নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা আল-ফুরক্বান : ২৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪; সহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/১৪০১)।
(১২) এমন ব্যক্তি যার আক্বীদা ও মানহাজ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে কোন্ মানহাজ অনুযায়ী কথা বলে বুঝা মুশকিল হয়ে যায়। আবার সবার মন জয় করে থাকার জন্য যে দলের কাছে যায় সেটির গুণ গায় এবং মাসআলার ক্ষেত্রে এটাও ঠিক ওটাও ঠিক অর্থাৎ শৈথিল্য করে। এমন আলেমদের নিকট থেকে ইলম বা ফাতাওয়া নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘¯্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৪৭৯৫; মিশকাত, হা/৩৬৯৬)। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটা দ্বীনের ইলম। সুতরাং তোমরা দেখ যে, কাদের নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছ’ (ইবনু আব্দুল বার্র, আত-তামহীদ, ১/৪৫ পৃ.)।
ইমাম মালিক ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘চার ধরনের লোক থেকে ইলম গ্রহণ করা যাবে না। যথা : (১) সেই নির্বোধ লোক, যে প্রকাশ্যে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করে; যদিও সে লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী হয়। (২) সেই বিদ‘আতী, যে তার প্রবৃত্তির দিকে মানুষকে আহ্বান করে। (৩) যে ব্যক্তি মানুষের সাথে কথাবার্তায় মিথ্যা বলে, যদিও আমি তাকে হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করি না। (৪) সেই সৎকর্মপরায়ণ ইবাদতগুজার মহৎ বান্দা, যে নিজের বর্ণিত হাদীস স্মরণে রাখতে পারে না’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬২)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীনকে সম্মান করতে পসন্দ করে, সে যেন বিদ‘আতীদের সংস্রব বর্জন করে। কেননা বিদ‘আতীদের সংস্রব খোস-পাঁচড়ার চেয়েও অধিক সংক্রামক’ (আল-বিদা‘উ ওয়ান নাহয়ু ‘আনহা, আছার নং-১৩১, পৃ. ৯৬)। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, ‘তোমরা বিদ‘আতীদের মজলিসে বসো না। কেননা তাদের মজলিসসমূহ হৃদয়কে রোগগ্রস্ত করে’ (ইবনুল বাত্তাহ, আল-ইবানাহ আল-কুবরা, ২/৪৩৮ পৃ.)।
সালাম ইবনু মুতীঈ বলেন, জনৈক ব্যক্তি আইয়ূব নামক বিদ‘আতীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হে আবূ বকর! আমি কি তোমার নিকট একটি কথা জিজ্ঞেস করব? তিনি বললেন, আইয়ূবকে পরিত্যাগ কর এবং অর্ধেক কথাও নয় অর্ধেক কথাও নয় অর্থাৎ তার কোন কথা শ্রবণ কর না’ (আল-ফিরইয়াবী, আল-কাদর, হা/৩৩৫)। ইবরাহীম নাখয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিদ‘আতীদের নিকট বসো না, তাদের সাথে কথা বলো না। আমি আশংকা করি যে তারা তোমাদের অন্তরকে প্রভাবিত করে ফেলবে’ (‘আল-বিদা‘ ওয়ান নাহয়ু আনহা, পৃ. ৫৬; আল-ই‘তিছাম, ১/১৭২ পৃ.)।
মুহাদ্দিছ যায়েদ ইবন আসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীস মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যে তার উপর আমল করে সে শয়তানের খাদেম’ (তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃ. ৭; আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীস, ১/৩৩৩ পৃ.)।
তাইতো ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) দুই-তৃতীয়াংশ ফৎওয়ার ক্ষেত্রে না জানার ওযর পেশ করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আলেমের রক্ষাকবচ হল ‘আমি জানি না বলা’। যদি সে এ রক্ষাকবচ ব্যবহারে গাফেল হয়, তাহলে সে ধ্বংসে নিক্ষিপ্ত হবে’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭/১৬৭ পৃ.)। অতএব সকল আলেমের কর্তব্য হল জেনে-শুনে যাচাই-বাছাই করে সহীহ দলীলভিত্তিক ফাতাওয়া দেয়া। আর জানা না থাকলে ‘আল্লাহ ভালো জানেন’ বলা (সহীহ বুখারী, হা/৪৭৭৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৯৮; মিশকাত, হা/২৭২)।
উল্লেখ্য, কোন আলেম যদি জ্ঞান অর্জন ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে দলীলবিহীন ফৎওয়া দেন, তাহলে তার দায়িত্ব তার উপরেই (আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হতে পারে?’ (সূরা আর-রা‘দ : ১৬)।
ইলম নিতে হয় আলেমদের থেকে। যাদের আক্বীদা, মানহাজ বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করে। তবে নিচের আক্বীদা-মানহাজে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের থেকে ইলম বা ফাতাওয়া গ্রহণ করা যাবে না। (১) যে ব্যক্তির আক্বীদা মানহাজ বিশুদ্ধ নয়, বরং শিরক-বিদ‘আত মিশ্রিত। অর্থাৎ মাজারে প্রার্থনাকারী, তাবীয ব্যবহারের পক্ষে ওকালতি কারী, পীর-মুরীদী প্রথায় বিশ্বাসী, ঈদে মীলাদুন্নবী পালনকারী, মৃত ব্যক্তির জন্য ৪ দিন, ৪০ দিন পালনকারী ইত্যাদি ব্যক্তিদের থেকে ইলম নেয়া যাবে না (সূরা আন-নিসা : ৪৮; সূরা আল-মায়েদাহ : ৭২; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৭৮; মিশকাত, হা/১৪)।
(২) আল্লাহ ও রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী। অর্থাৎ যারা আল্লাহ নিরাকার, সর্বত্র বিরাজমান, রাসূল (ﷺ) নূরের নবী, তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি নন, সৃষ্টি ¯্রষ্টার অংশ, অলীরা গায়েব জানেন ইত্যাদি ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে থাকে তাদের কাছ থেকে ইলম নেয়া যাবে না (সূরা আন-নামল : ৬৫; সূরা ত্বোহা : ৫; সূরা আল-কাহ্ফ : ১১০)।
(৩) যে ব্যক্তি শরী‘আতের মৌলিক বিষয়সমূহ অর্থাৎ আক্বীদা, মানহাজ, হালাল-হারাম, ফরয, ওযাজিব, সুন্নাত, নফল, মুবাহ, কাফের ফাতওয়া দেয়া ইত্যাদি সম্পর্কে সালাফদের মানহাজ অনুযায়ী সঠিক জ্ঞান রাখে না এমন ব্যক্তির নিকট থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (ইবনু মাজাহ, হা/২২৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৫৫, সনদ হাসান)।
(৪) যে আলেমের মধ্যে কুরআন, সহীহ হাদীস, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ, নাসিখ এবং মানসূখ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান নেই, ফলে ইজমা বিরোধী অথবা মানসূখ দলীল বা জাল ও যঈফ হাদীস অনুযায়ী কোন হুকুম দেন। এধরনের ব্যক্তিদের কাছ থেকেও ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২, সনদ হাসান)। শায়খ ইবনু উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যঈফ হাদীসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না এবং তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামের সঙ্গে সম্পৃক্তও করা যাবে না...’ (উছাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, টেপ নং-২৭৬)।
(৫) সেই নির্বোধ লোক, যে প্রকাশ্যে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করে; যদিও সে লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী বা জানলেওয়ালা হয়। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা ত্বোহা : ১২৪; সূরা আল-আহযাব : ৫৮; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৮০; সহীহুল জামে‘, হা/৭৯৮৪; ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬২)।
(৬) সেই বিদ‘আতী, যে তার প্রবৃত্তির দিকে মানুষকে আহ্বান করে এবং বিদ‘আতে হাসানাহ ও বিদ‘আতে সাইয়িআহ নামে দুই প্রকার বিদআত আছে বলে বিশ্বাস করে এবং সেটা প্রচার করে। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয়। কেননা শরী‘আতে হাসানাহ, সায়্যিআহ নামে কোন ভাল-খারাপ বিদ‘আত নেই। বরং সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (সহীহ মুসলিম, হা/৮৬৭; নাসাঈ হা/১৫৭৮; মিশকাত, হা/১৪১)।
(৭) যে ব্যক্তির অন্তরে ইখলাছ নেই। যে মানুষের সাথে কথা-বার্তায় মিথ্যা বলে, যদিও আমরা তাকে হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করি না। এমন ব্যক্তির কাছ থেকেও ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা আল-বাইয়িনাহ : ৫; সূরা আয-যুমার : ১১; সহীহ বুখারী, হা/৩৩)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কোন আমল গ্রহণ করেন না, যতক্ষণ না এ দু’টি রুকন তাতে বিদ্যমান থাকে। যথা- (১) শরী‘আতের পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া এবং (২) শিরক মুক্ত অর্থাৎ ইখলাছের সাথে হওয়া’ (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৩)।
(৮) সেই সৎকর্মপরায়ণ ইবাদতগুজার মহৎ বান্দা, যে কুরআনের আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীস স্মরণে রাখতে পারে না। ফলে ক্বিয়াস করে ভুল ফাতাওয়া দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয় (বায়হাক্বী, হা/৫৭৫১; মিশকাত, হা/২৫৫; সহীহুল জামে‘, হা/১৭২৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬২)।
(৯) যে হাদীস সহীহ ও যঈফ যেমন সনদ, রিজাল প্রভৃতি সম্পর্কে উছূল জানে না এবং দলীল থেকে বিধি-বিধান বের করার যোগ্যতা রাখে না। ফলে ইলম বিহীন বিনা দলীলে ফাতাওয়া দেয়। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলম নেয়া নিরাপদ নয়। মুগীরাহ ইবনু শু‘বা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার পক্ষ হতে যে লোক কোন হাদীস বর্ণনা করে অথচ সে জানে যে, তা মিথ্যা, তাহলে সে মিথ্যুকদের একজন’ (তিরমিযী, হা/২৬৬২; ইবনু মাজাহ, হা/৪১; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২)।
(১০) যে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শারঈ জ্ঞান জানে না। অর্থাৎ ঘটনার সাথে বিধি-বিধান সম্বলিত আয়াত ও হাদীসসমূহ জানে না এবং যে সব দলীলের মাধ্যমে হুকুম ভিন্ন হয়ে যায়, তাও জানে না। যেমন خاص করা, শর্তযুক্ত করা প্রভৃতি। ফলে এদের দাবি বিরোধী কোন হুকুম দিয়ে বসেন। এমন ব্যক্তি থেকে ফাতাওয়া নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা আয-যারিয়াত : ১০; তিরমিযী, হা/২৬৬২; সহীহ মুসলিমে মুক্বাদামাহ; ইবনু মাজাহ, হা/৪১; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২)।
(১১) যে আক্বীদা ও মানহাজের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শুধু আমল বা ফযীলতের আলোচনা করে এবং যে ইখতেলাফি মাসআলায় কুরআন ও সুন্নাহর ইত্তেবা ও প্রসিদ্ধ সালাফদের মতামত প্রাধান্য না দিয়ে তাক্বলীদে শাখছী অর্থাৎ অন্ধ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট ইমামের মতামত প্রাধান্য দেয়, এমন ব্যক্তি থেকে ইলম বা ফাতাওয়া নেয়া নিরাপদ নয় (সূরা আল-ফুরক্বান : ২৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪; সহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/১৪০১)।
(১২) এমন ব্যক্তি যার আক্বীদা ও মানহাজ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে কোন্ মানহাজ অনুযায়ী কথা বলে বুঝা মুশকিল হয়ে যায়। আবার সবার মন জয় করে থাকার জন্য যে দলের কাছে যায় সেটির গুণ গায় এবং মাসআলার ক্ষেত্রে এটাও ঠিক ওটাও ঠিক অর্থাৎ শৈথিল্য করে। এমন আলেমদের নিকট থেকে ইলম বা ফাতাওয়া নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘¯্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৪৭৯৫; মিশকাত, হা/৩৬৯৬)। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এটা দ্বীনের ইলম। সুতরাং তোমরা দেখ যে, কাদের নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছ’ (ইবনু আব্দুল বার্র, আত-তামহীদ, ১/৪৫ পৃ.)।
ইমাম মালিক ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘চার ধরনের লোক থেকে ইলম গ্রহণ করা যাবে না। যথা : (১) সেই নির্বোধ লোক, যে প্রকাশ্যে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ করে; যদিও সে লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী হয়। (২) সেই বিদ‘আতী, যে তার প্রবৃত্তির দিকে মানুষকে আহ্বান করে। (৩) যে ব্যক্তি মানুষের সাথে কথাবার্তায় মিথ্যা বলে, যদিও আমি তাকে হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করি না। (৪) সেই সৎকর্মপরায়ণ ইবাদতগুজার মহৎ বান্দা, যে নিজের বর্ণিত হাদীস স্মরণে রাখতে পারে না’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬২)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীনকে সম্মান করতে পসন্দ করে, সে যেন বিদ‘আতীদের সংস্রব বর্জন করে। কেননা বিদ‘আতীদের সংস্রব খোস-পাঁচড়ার চেয়েও অধিক সংক্রামক’ (আল-বিদা‘উ ওয়ান নাহয়ু ‘আনহা, আছার নং-১৩১, পৃ. ৯৬)। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, ‘তোমরা বিদ‘আতীদের মজলিসে বসো না। কেননা তাদের মজলিসসমূহ হৃদয়কে রোগগ্রস্ত করে’ (ইবনুল বাত্তাহ, আল-ইবানাহ আল-কুবরা, ২/৪৩৮ পৃ.)।
সালাম ইবনু মুতীঈ বলেন, জনৈক ব্যক্তি আইয়ূব নামক বিদ‘আতীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হে আবূ বকর! আমি কি তোমার নিকট একটি কথা জিজ্ঞেস করব? তিনি বললেন, আইয়ূবকে পরিত্যাগ কর এবং অর্ধেক কথাও নয় অর্ধেক কথাও নয় অর্থাৎ তার কোন কথা শ্রবণ কর না’ (আল-ফিরইয়াবী, আল-কাদর, হা/৩৩৫)। ইবরাহীম নাখয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বিদ‘আতীদের নিকট বসো না, তাদের সাথে কথা বলো না। আমি আশংকা করি যে তারা তোমাদের অন্তরকে প্রভাবিত করে ফেলবে’ (‘আল-বিদা‘ ওয়ান নাহয়ু আনহা, পৃ. ৫৬; আল-ই‘তিছাম, ১/১৭২ পৃ.)।
মুহাদ্দিছ যায়েদ ইবন আসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীস মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যে তার উপর আমল করে সে শয়তানের খাদেম’ (তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত, পৃ. ৭; আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীস, ১/৩৩৩ পৃ.)।
তাইতো ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) দুই-তৃতীয়াংশ ফৎওয়ার ক্ষেত্রে না জানার ওযর পেশ করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আলেমের রক্ষাকবচ হল ‘আমি জানি না বলা’। যদি সে এ রক্ষাকবচ ব্যবহারে গাফেল হয়, তাহলে সে ধ্বংসে নিক্ষিপ্ত হবে’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৭/১৬৭ পৃ.)। অতএব সকল আলেমের কর্তব্য হল জেনে-শুনে যাচাই-বাছাই করে সহীহ দলীলভিত্তিক ফাতাওয়া দেয়া। আর জানা না থাকলে ‘আল্লাহ ভালো জানেন’ বলা (সহীহ বুখারী, হা/৪৭৭৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৯৮; মিশকাত, হা/২৭২)।
উল্লেখ্য, কোন আলেম যদি জ্ঞান অর্জন ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে দলীলবিহীন ফৎওয়া দেন, তাহলে তার দায়িত্ব তার উপরেই (আবূ দাঊদ, হা/৩৬৫৭; মিশকাত, হা/২৪২)।
সূত্র: আল-ইখলাছ।