রবীঊল আউয়াল আরবী বারটি মাসের তৃতীয় মাস। এই মাস মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্ম ও মৃত্যুর মাস। এ মাসে শরী‘আত কর্তৃক কোন বিশেষ ইবাদত ও অনুষ্ঠান না থাকলেও অনেক মুসলমান বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ইবাদত পালন করে থাকেন। আলোচ্য প্রবন্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ ঊল্লেখ করার সাথে সাথে এ মাসের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলি আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।-
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন ও নবুঅতের পূর্বাভাস :
মুহাম্মাদ (ﷺ) শেষনবী ও রাসূল হিসাবে শেষ যামানায় আসবেন সেটা মহান আল্লাহ তা‘আলা অনেক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নবুঅত কখন অবধারিত হয়েছে? তিনি বললেন, যখন আদম (আঃ) তাঁর শরীর ও রূহের মধ্যে ছিল’।[1] অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নবীদের কাছ থেকে মুহাম্মাদ (ﷺ) নবী হওয়ার আগে তাঁর প্রতি ঈমান আনার জন্য অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,
‘আর (স্মরণ কর) যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত দান করেছি, এর পরে যখন তোমাদের কাছে সেই রাসূল আসবেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবের সত্যায়ন করবেন, তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং তোমাদের স্বীকৃতির উপর আমার অঙ্গীকার নিচ্ছ? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে অন্যতম সাক্ষী রইলাম’ (আলে ইমরান ৩/৮১)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ এমন কোন রাসূল প্রেরণ করেননি যার কাছ থেকে এই শপথ গ্রহণ করেননি। তথা প্রত্যেক রাসূলের কাছে তিনি এই মর্মে শপথ নিয়েছেন যে, যদি আল্লাহ মুহাম্মাদকে প্রেরণ করেন এবং সেই নবী বা রাসূল জীবিত থাকেন, তাহ’লে তারা যেন মুহাম্মাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও তাকে সাহায্য করে। তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন তাদের উম্মতের কাছ থেকে এই বলে শপথ নেয় যে, যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে প্রেরণ করা হয় এবং তারা জীবিত থাকে, তাহ’লে তারা যেন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং তাকে সহযোগিতা করে।[2]
ইবরাহীম (আঃ) মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দিবেন এবং তাদের (অন্তরসমূহকে) পরিচ্ছন্ন করবেন। নিশ্চয়ই আপনি মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)।
ঈসা (আঃ)ও মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
‘(স্মরণ কর,) যখন মারিয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিল, হে ইস্রাঈল বংশীয়গণ! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্বে প্রেরিত তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম ‘আহমাদ’। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, এটি প্রকাশ্য জাদু’ (ছাফ ৬১/৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে যিনি নিরক্ষর নবী, যার বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)।
মুহাম্মাদ (ﷺ) ১০ বা ১২ বছর বয়সে চাচা আবূ ত্বালেবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ার বুছরা শহরে পৌঁছলে সেখানে খ্রিষ্টান পাদ্রী জিরজিস ওরফে বাহীরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবী হওয়ার সুসংবাদ দেন।[3]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীঊল আউয়াল[4] সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল’।[5]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আমুল ফীল’ বা হস্তী বছরে জন্মগ্রহণ করেছেন।[6] এ মর্মে একটি হাদীসে এসেছে, ক্বায়েস ইবনু মাখরামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘আমি ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হস্তী বছরে (আবরাহার বাহিনী ধ্বংসের বছর) জন্মগ্রহণ করি। তিনি বলেন, ইয়াসার ইবনু লাইছ গোত্রীয় কুবাছ ইবনু আশইয়ামকে ওছমান ইবনু আফফান (রাঃ) প্রশ্ন করেন, আপনি বড় নাকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)? তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার চাইতে অনেক বড়, তবে আমি তাঁর আগে জন্মগ্রহণ করি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতীর বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। আমার মা আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন যেখানে গিয়ে আমি পাখিগুলির (হাতিগুলির) মলের রং সবুজে বদল হয়ে যেতে দেখেছি।[7] ‘আমুল ফীল’ বা হাতীর বছর কত খ্রিষ্টাব্দে হয়েছিল তার দু’টি মত পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আবার কারো কারো মতে ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে।[8]
ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ইংরেজী পঞ্জিকা মতে, তারিখটি ছিল ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অথবা ২২শে এপ্রিল। এ বছরটি ছিল বাদশাহ নওশেরওয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার চল্লিশতম বছর।[9]
আমাদের সমাজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ রবীঊল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ প্রসিদ্ধ থাকলেও ৯ই রবীঊল আউয়াল রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম দিবস বলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ মত প্রকাশ করেছেন। তাই তিনি ৯ই রবীঊল আউয়াল ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন।[10]
এই মতটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ। আর এই মতের পক্ষে আল্লামা হুমাইদী, ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম, ইবনু কাছীর, ইবনু হাজার আসক্বালানী, বদরুদ্দীন আইনীসহ অন্যান্য বিদ্বানগণ রয়েছেন। মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ﷺ)-এর সঠিক জন্ম তারিখ অকাট্যভাবে জানা যায়নি। রাসূল (ﷺ) রবীঊল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন, রবীঊল আউয়ালের ১২ তারিখ নয়।[11]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, তিনি সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন। আবূ কাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সোমবার দিনে ছিয়াম রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বললেন, ওটি এমন একটি দিন, যেদিন আমার জন্ম হয়েছে, যেদিন আমি (নবীরূপে) প্রেরিত হয়েছি অথবা ঐ দিনে আমার প্রতি (সর্বপ্রথম) ‘অহী’ অবতীর্ণ করা হয়েছে’।[12]
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘নবী করীম (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন সোমবার, নবুওয়াত লাভ করেন সোমবার, মৃত্যুবরণ করেন সোমবার, হিজরতের জন্য মক্কা থেকে মদীনায় গমন করেন সোমবার, মদীনায় আগমন করেন সোমবার, হাজারে আসওয়াদকে উত্তোলন করেন সোমবার’।[13]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যু :
রাসূল (ﷺ) কোন তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবেঈ ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে। ১লা রবীঊল আউয়াল,[14] ২রা রবীঊল আউয়াল, ১২ই রবীঊল আউয়াল ও ১৩ই রবীঊল আউয়াল।[15] অধিকাংশ জীবনীকারের মতে দিনটি ছিল ১১ হিজরীর ১২ই রবীঊল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন। তবে সহীহ হাদীস অনুযায়ী রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল।[16] অতএব সেটা ঠিক রাখতে হ’লে তাঁর জন্ম ৯ই রবীঊল আউয়াল সোমবার। আর তিনি ১১ হিজরী সনের ১লা রবীঊল আউয়াল সোমবার সকাল ১০-টার দিকে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।[17]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম-মৃত্যু দিবস প্রকাশ না করার কারণ :
মহান আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলে দিতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইচ্ছা করলে তাঁর জন্ম তারিখ জেনে নিতে পারতেন। সাহাবীগণও ইচ্ছা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যু তারিখ লিখে রাখতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জানাননি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেননি এবং সাহাবীগণও স্মরণে রাখেননি। তার কয়েকটি কারণে হ’তে পারে-
এক- এর মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ জানেন।
দুই- ইসলামের দৃষ্টিতে কারো জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনে কোন কল্যাণ নেই। যদি কল্যাণ থাকত তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের, তাঁর পিতা-মাতা অথবা দাদা-নানার জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করতেন।
তিন- মহান আল্লাহ যদি জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনের বিধান রাখতেন, তাহ’লে সারা বছর মানুষকে শুধু জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করতে হ’ত। এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূল,[18] এক লক্ষ চবিবশ হাযার সাহাবী,[19] অসংখ্য ইমাম, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সকলের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করলে প্রতিদিন অসংখ্য জন্ম-মৃত্যু দিবস হ’ত তখন কার জন্ম-মৃত্যু দিবস রেখে কারটা পালন করত মানুষ?
চার- জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করা বিধর্মীদের রীতি। তাই এ সকল ক্ষেত্রে বিধর্মীদের বিরোধিতা করাই ইসলামের নির্দেশ।
পাঁচ- রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রেরণ করা হয়েছে তাঁর অনুসরণ করে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করে অনুষ্ঠান সর্বস্ব হওয়ার জন্য নয়।
রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে সমাজে প্রচলিত কর্মকান্ড :
(১) মীলাদ পালন : ‘মীলাদ’ (ميلاد) অথবা মাওলিদ (مولد) আরবী শব্দ। যার অর্থ-জন্ম, জন্মকাল, জন্ম তারিখ। আর ‘মীলাদুন্নবী’ অর্থ- নবীর জন্ম দিন বা নবীর জন্ম সময়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস মনে করে ১২ই রবীঊল আউয়াল তারিখ তাঁর জন্মের বা জীবনের কিছু বিবরণ, ওয়ায-নছীহত, তাঁর প্রতি কিছু দরূদ পাঠের মাধ্যমে মীলাদ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। বর্তমানে মীলাদের এমন প্রসার পেয়েছে যে, মুসলিমগণ শুধু একদিন মীলাদ পালন করে ক্ষান্ত হয়নি বরং বছরের প্রতিটি দিন যে কোন অনুষ্ঠানে মীলাদ পালন করে থাকে। ঘর উদ্বোধন, দোকান উদ্বোধন, পিতা-মাতার জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন, ছেলে-মেয়েদের আক্বীক্বা, সুন্নাতে খাতনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আগে-পরে মীলাদের আয়োজন করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মদিন নিঃসন্দেহে মুসলিমদের জন্য একটি আনন্দের দিন। কিন্তু এই জন্মদিন রাসূল (ﷺ) নিজে পালন করেননি, তাঁর সাহাবীগণ, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, করেননি; প্রসিদ্ধ চার ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) পালন করেননি এবং এসব পালন করতে বলে যাননি। তাই এই দিনে কোন অনুষ্ঠান করা, অতিরিক্ত কোন ইবাদত চালু করা, ছওয়াবের আশায় ধর্মের মধ্যে অতিরঞ্জন করা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছে যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[20]
মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘শরী‘আতের দিক থেকে যদি মীলাদ মাহফিল উদযাপন করা সঠিক হ’ত, তবে নবী করীম (ﷺ) তা করতেন অথবা তাঁর উম্মতকে করতে বলতেন। আর পবিত্র কুরআন বা হাদীসে অবশ্যই তা সংরক্ষিত থাকত’।[21]
(২) ঈদে মীলাদুন্নবী পালন : এক শ্রেণীর মুসলিম শুধু মীলাদুন্নবী পালন করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা এই দিনটিকে ঈদ বানিয়ে নিয়েছে। তারা ইসলামের দু’টি ঈদের সাথে এ দিনটিকে তৃতীয় আরেকটি ঈদ বানিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং তারা বলে থাকে, সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মীলাদুন্নবী। আর ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা উম্মতের উপর ফরয ইত্যাদি। অথচ ইসলামে অনুমোদিত ঈদ কেবল দু’টি। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘রাসূল (ﷺ) যখন মদীনায় আসলেন তখন দেখলেন বছরের দু’টি দিনে মদীনাবাসীরা আনন্দ-ফূর্তি করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ দিন দু’টি কি? তারা বলল যে, আমরা ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে এ দু’দিন আনন্দ-ফূর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা এ দু’দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দু’টি দিন তোমাদের দিয়েছেন। তা হ’ল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর’।[22]
(৩) ক্বিয়াম করা : ক্বিয়াম (قيام) আরবী শব্দ। অর্থ- দন্ডায়মান হওয়া, দাঁড়ানো অবস্থা ইত্যাদি। মীলাদে কুরআন তেলাওয়াত, যিকর-আযকার ও বিভিন্ন ভাষায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসার এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাযির হয়েছেন মনে করে তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়াকে ক্বিয়াম বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মীলাদ অনুষ্ঠানে হাযির হন এই বিশ্বাস নিয়ে ক্বিয়াম করা হারাম ও শিরকী কাজ। কারণ আল্লাহ ছাড়া কেউ হাযির-নাযির নন এবং তিনি ব্যতীত কেউ গায়েবের খবর রাখেন না (আন‘আম ৬/৫০; নমল ২৭/৬৫; লোক্বমান ৩১/৩৪)।
আর মৃত্যুর পর কোন রূহ দুনিয়াতে ফিরে আসা সম্ভব নয় (মুমিনূন ২৩/১০০)।
যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃত্যুবরণ করেছেন (যুমার ৩৯/৩১; আলে ইমরান ৩/১৪৪)। সুতরাং তাঁর অথবা তাঁর আত্মার পৃথিবীর কোন মীলাদ-মাহফিল বা ক্বিয়াম অনুষ্ঠানে আসার সুযোগ নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবিত অবস্থায়ও সাহাবীদের এমন কর্ম অপসন্দ করেছেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরামের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে অধিক প্রিয় ব্যক্তি আর কেউ ছিল না। কিন্তু তবুও তাদের অবস্থা এই ছিল যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আগমন করতে দেখতেন তার সম্মানার্থে তারা দাঁড়াতেন না। কেননা তারা জানতেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এটা পসন্দ করেন না’।[23] মু‘আবিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যার মনের অভিলাষ এই যে, মানুষ তার সম্মুখে মূর্তির মতো দন্ডায়মান থাকুক, সে যেন জাহান্নামকে নিজের বাসস্থান বানিয়ে নেয়’।[24]
(৪) বিধর্মীদের অনুসরণে জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন : জনম-মৃত্যু দিবস পালন ইসলামের রীতি নয়; বরং বিধর্মীদের রীতি। তারা তাদের ধর্মের প্রধান ব্যক্তিদের জন্মদিবস পালন করে থাকে। হিন্দুধর্মের অনুসারীরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিবস উপলক্ষে জন্মাষ্টমী পালন করে থাকে। হিন্দু পঞ্জিকা মতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে তা পালন করা হয়।[25] ঈসা (আঃ)-এর জন্ম কখন হয়েছে, তা জানা না থাকলেও খৃষ্টানরা যীশুর জন্মদিবস হিসাবে ২৫শে ডিসেম্বর বড় দিন পালন করে থাকে।[26] আর মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মের লোকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা জায়েয নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অর্ন্তভুক্ত’।[27]
বর্তমানে মানুষ শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস পালনে থেমে নেই; বরং নিজেদের জন্মদিন, ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন, পিতা-মাতার জন্ম-মৃত্যু দিন, এমনকি নেতা-নেত্রীর জন্ম-মৃত্যু দিবসও পালন করে থাকে। যার কোনটিই জায়েয নয়।
(৫) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসায় অতিরঞ্জন করা : মীলাদ অনুষ্ঠানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে, তাঁর সম্মানে অতিরঞ্জিত করা হয়। অনেক সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয় (নাঊযুবিল্লাহ)। মীলাদে পঠিতব্য অতি পরিচিত একটি উর্দূ কবিতার একটি অংশ এরূপ, ‘ওহ জো মুস্তাবী আরশ থা খোদা হো কর্, উতার পড়া হ্যায় মদীনা মেঁ মুছতফা হো কর্’। অর্থ-‘আরশের অধিপতি আল্লাহ ছিলেন যিনি, তিনিই মদীনায় নেমে এলেন মুছতফা রূপে’।[28]
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসা করতে গিয়ে তাকে নূরে মুহাম্মাদী অর্থাৎ তিনি নূরের তৈরি, তাঁকে সৃষ্টি না করা হ’লে আসমান-যমীন সৃষ্টি করা হ’ত না, তাঁর নূরে আরশ-কুরসী, জান্নাত-জাহান্নাম, আসমান-যমীন সৃষ্টি হয়েছে, আদম (আঃ) তার নামের অসীলায় ক্ষমা পেয়েছেন, মে‘রাজে আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতাসহ আরশে উঠিয়ে আরশের গৌরব বৃদ্ধি করেন ইত্যাদি মিথ্যা অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি কথা বলে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘খ্রিস্টানরা মারইয়াম-এর পুত্র ‘ঈসা (আ.)-এর প্রশংসায় যেভাবে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা সেভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। আমি তো আল্লাহর বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল বল’।[29] এমনকি তাঁর নামে মিথ্যা বলাকেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সালামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
‘যে ব্যক্তি আমার উপর এমন কথা আরোপ করে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়’।[30]
(৬) মিথ্যা দরূদ বানানো : সমাজে বহুল প্রচলিত, মীলাদের সময় পঠিত একটি প্রচলিত দরূদ (?) হ’ল-
‘তিনি (মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর পরিপূর্ণতার দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেছেন। তাঁর সৌন্দর্যের কারণে অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে। তাঁর সমস্ত স্বভাব-চরিত্র সুন্দর। তোমরা তাঁর উপর ও তাঁর পরিবারের উপর দরূদ পাঠ কর’।
সমাজে প্রচলিত উক্ত বাক্যগুলো আসলে কোন দরূদ নয়, বরং এটি পারস্য কবি শেখ সা‘দী (৫৮৫ বা ৬০৬-৬৯১ হিঃ)-এর গ্রন্থের একটি কবিতার অংশ। তিনি রাসূলের প্রশংসায় এটি রচনা করেছেন।
এই কবিতায় শিরকের মিশ্রণ রয়েছে। কারণ এখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ﷺ) নিজের পরিপূর্ণতা দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেন। আসলে রাসূল (ﷺ) নিজের যোগ্যতার দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেননি, বরং আল্লাহ তাঁকে উচ্চ আসনে পেঁŠছিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
‘আর আমরা তোমার (মর্যাদার) জন্য তোমার স্মরণকে সমুন্নত করেছি’ (ইনশিরাহ, ৯৪/০৪)। সুতরাং দুনিয়ায় ও আখেরাতে রাসূল (ﷺ)-এর যত সম্মান, যত মর্যাদা সব তাকে আল্লাহ দিয়েছেন। এটা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ। সুতরাং কেউ যদি বিশ^াস করে যে, আল্লাহর রাসূল নিজের যোগ্যতায় এত বড় মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন, তাহ’লে তিনি আল্লাহর ক্ষমতার সাথে শিরক করবেন।
এছাড়া রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি সালাম জানাতে ও দরূদ পাঠ করতে বলা হয় যে,
‘হে নবী! আপনার প্রতি সালাম। হে রাসূল! আপনার প্রতি সালাম। হে হাবীব! আপনার প্রতি সালাম। আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার উপর রহমত’।
উল্লেখ্য যে, প্রচলিত কথাগুলি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত কোন দরূদ নয়। বরং এগুলি মানুষের বানানো দরূদের নামে জালিয়াতি।
আর এসব আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ীও ভুল। কারণ সম্মানিত কাউকে ডাকার জন্য সম্মান দিয়ে ডাকতে হয়। অথচ এখানে সমস্ত নবীদের সর্দার, দুনিয়া-আখেরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তাকে অনির্দিষ্ট বাক্যে ডাকা হয়েছে যা আদবের খেলাপ।
আর আল্লাহ কুরআনের যত জায়গায় রাসূলকে সম্বোধন করেছেন সেখানে يا نبي বা يا رسول না বলে يا ايها الرسول বা يا ايها النبي বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘হে নবী! তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং যেসব মুমিন তোমার অনুসরণ করেছে তাদের জন্যও’ (আনফাল ৮/৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও’ (মায়েদা ৫/৬৭)।
সুতরাং রাসূল (ﷺ)-এর সম্মানের জন্য, ছওয়াবের আশায় দরূদ পাঠ করতে হ’লে রাসূল (ﷺ)-এর শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ীই করতে হবে। অন্যথা রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞার করণে ছওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম-মৃত্যু দিবস উপলক্ষে করণীয় :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম অথবা মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বিশেষ কোন আমলের বর্ণনা শরী‘আতে নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে কোন আমল করেননি, তাঁর লক্ষাধিক সাহাবা কিছু করেননি, খুলাফায়ে রাশেদীনের কেউ কিছু করেননি, এমনকি তাঁর আত্মীয়-স্বজন কেউ কিছু করেননি। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত কোন ইবাদত করা, অনুষ্ঠান করা জায়েয নয়। বরং প্রতিদিন যেসকল ইবাদত পালন করা হয়, ঐ দিনও তাই পালন করতে হবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মহববত করা, তাঁকে সম্মান করা, তাঁর পরিপূর্ণ ইত্তেবা করা ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন,
‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
পরিশেষে বলব, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস পালন নয়, বরং পরিপূর্ণভাবে তাঁকে অনুসরণই কাম্য। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. তিরমিযী হা/৩৬০৯; সহীহাহ হা/১৮৫৬; মিশকাত হা/৫৭৫৮।
[2]. ইবনে কাছীর, সূরা আলে ইমরান ৮১ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[3]. তিরমিযী হা/৫৯১৮; মিশকাত হা/৫৯১৮।
[4]. সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, (মৃ. ১৯৩০ খ্রিঃ) রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (উর্দূ), দিল্লী : ১৯৮০ খ্রিঃ ১/৪০; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ৫৪, গৃহীত: সীরাতুর রাসূল (ﷺ), পৃঃ ৫৬।
[5]. মুসলিম হা/১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৫; বুখারী হা/১৩৮৭।
[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/৭৪।
[7]. তিরমিযী হা/৩৬১৯; সহীহাহ হা/৩১৫২।
[8]. আকরাম যিয়া আল-উমরী, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ আস-সহীহা ১/৯৬-৯৮; মাহদী রেজাকুল্লাহ আহমাদ, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ১০-১১০ পৃ.। গৃহীত : ইয়াউস সুনান, পৃ. ৫৫৫।
[9]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৪১।
[10]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুল রাসূল (ﷺ), পৃ. ৫৬।
[11]. মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, (ঈমান পর্ব) প্রশ্ন নং ৮৯।
[12]. মুসলিম (ই.ফা) হা/২৮০৪, (ই.সে) হা/২৬১৩।
[13]. আহমাদ হা/৩৫০৬, আহমাদ শাকের এর সনদকে সহীহ বলেছেন। আহমাদ ৪/১৭২; ত্বাবারানী ১২/২৩৭ হা/১২৯৮৪।
[14]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, সীরাতুল রাসূল (ﷺ) পৃ. ৫৬।
[15]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯; ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর : কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা পৃ. ১২৫-১২৬।
[16]. মুসলিম হা/১১৬২; বুখারী হা/১৩৮৭।
[17]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুল রাসূল (ﷺ) পৃ. ৭৪৩।
[18]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫৭৩৭; সহীহাহ হা/২৬৬৮।
[19]. মির‘আত শরহ মিশকাত, হা/২৫৬৯ এর ব্যাখ্যা দ্র.।
[20]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; আবূদাঊদ ৪৬০৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪।
[21]. মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, (ঈমান পর্ব) প্রশ্ন নং ৮৯।
[22]. আবূদাঊদ হা/১১৩৪; নাসাঈ হা/১৫৫৬; আহমাদ হা/১২০০৬।
[23]. তিরমিযী হা/২৭৫৪; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৪৬; আহমাদ, হা/১২৩৭০; সহীহাহ হা/৩৫৮।
[24]. আবূদাঊদ হা/৫২২৯; তিরমিযী হা/২৭৫৫; সহীহাহ হা/৩৫৭।
[25]. উইকিপিডিয়া, একটি মুক্ত বিশ্বকোষ জন্মাষ্টমী।
[26]. উইকিপিডিয়া, একটি মুক্ত বিশ্বকোষ বড়দিন।
[27]. আবূদাঊদ, হা/৪০৩১; সহীহুল জামে‘ হা/৬১৪৯।
[28]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মীলাদ প্রসঙ্গ, পৃ. ১৮।
[29]. বুখারী হা/৩৪৪৫, ৬৮৩০; সহীহুল জামে‘ হা/১৩৩১৯; মিশকাত হা/৪৮৯৭।
[30]. বুখারী হা/১০৯।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন ও নবুঅতের পূর্বাভাস :
মুহাম্মাদ (ﷺ) শেষনবী ও রাসূল হিসাবে শেষ যামানায় আসবেন সেটা মহান আল্লাহ তা‘আলা অনেক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قالوا يا رسولَ اللهِ! مَتى وجَبت لكَ النُّبوَّةُ؟ قال: وآدمُ بين الرُّوحِ والجسَدِ،
‘লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নবুঅত কখন অবধারিত হয়েছে? তিনি বললেন, যখন আদম (আঃ) তাঁর শরীর ও রূহের মধ্যে ছিল’।[1] অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নবীদের কাছ থেকে মুহাম্মাদ (ﷺ) নবী হওয়ার আগে তাঁর প্রতি ঈমান আনার জন্য অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ-
‘আর (স্মরণ কর) যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত দান করেছি, এর পরে যখন তোমাদের কাছে সেই রাসূল আসবেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবের সত্যায়ন করবেন, তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং তোমাদের স্বীকৃতির উপর আমার অঙ্গীকার নিচ্ছ? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে অন্যতম সাক্ষী রইলাম’ (আলে ইমরান ৩/৮১)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ এমন কোন রাসূল প্রেরণ করেননি যার কাছ থেকে এই শপথ গ্রহণ করেননি। তথা প্রত্যেক রাসূলের কাছে তিনি এই মর্মে শপথ নিয়েছেন যে, যদি আল্লাহ মুহাম্মাদকে প্রেরণ করেন এবং সেই নবী বা রাসূল জীবিত থাকেন, তাহ’লে তারা যেন মুহাম্মাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও তাকে সাহায্য করে। তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন তাদের উম্মতের কাছ থেকে এই বলে শপথ নেয় যে, যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে প্রেরণ করা হয় এবং তারা জীবিত থাকে, তাহ’লে তারা যেন মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং তাকে সহযোগিতা করে।[2]
ইবরাহীম (আঃ) মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দিবেন এবং তাদের (অন্তরসমূহকে) পরিচ্ছন্ন করবেন। নিশ্চয়ই আপনি মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (বাক্বারাহ ২/১২৯)।
ঈসা (আঃ)ও মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَابَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ-
‘(স্মরণ কর,) যখন মারিয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিল, হে ইস্রাঈল বংশীয়গণ! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আমার পূর্বে প্রেরিত তাওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম ‘আহমাদ’। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, এটি প্রকাশ্য জাদু’ (ছাফ ৬১/৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,
الَّذِيْنَ يَتَّبِعُوْنَ الرَّسُوْلَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِيْ يَجِدُوْنَهُ مَكْتُوْبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ،
‘যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে যিনি নিরক্ষর নবী, যার বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)।
মুহাম্মাদ (ﷺ) ১০ বা ১২ বছর বয়সে চাচা আবূ ত্বালেবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ার বুছরা শহরে পৌঁছলে সেখানে খ্রিষ্টান পাদ্রী জিরজিস ওরফে বাহীরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবী হওয়ার সুসংবাদ দেন।[3]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীঊল আউয়াল[4] সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল’।[5]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আমুল ফীল’ বা হস্তী বছরে জন্মগ্রহণ করেছেন।[6] এ মর্মে একটি হাদীসে এসেছে, ক্বায়েস ইবনু মাখরামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
وُلِدْتُ أَنَا وَرَسُولُ اللهِ، صلى الله عليه وسلم عَامَ الْفِيلِ. وَسَأَلَ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ قُبَاثَ بْنَ أَشْيَمَ أَخَا بَنِي يَعْمُرَ بْنِ لَيْثٍ أََنْتَ أَكْبَرُ أَمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَكْبَرُ مِنِّي وَأَنَا أَقْدَمُ مِنْهُ فِي الْمِيلاَدِ وُلِدَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَامَ الْفِيلِ،
‘আমি ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হস্তী বছরে (আবরাহার বাহিনী ধ্বংসের বছর) জন্মগ্রহণ করি। তিনি বলেন, ইয়াসার ইবনু লাইছ গোত্রীয় কুবাছ ইবনু আশইয়ামকে ওছমান ইবনু আফফান (রাঃ) প্রশ্ন করেন, আপনি বড় নাকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)? তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার চাইতে অনেক বড়, তবে আমি তাঁর আগে জন্মগ্রহণ করি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতীর বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। আমার মা আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন যেখানে গিয়ে আমি পাখিগুলির (হাতিগুলির) মলের রং সবুজে বদল হয়ে যেতে দেখেছি।[7] ‘আমুল ফীল’ বা হাতীর বছর কত খ্রিষ্টাব্দে হয়েছিল তার দু’টি মত পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আবার কারো কারো মতে ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে।[8]
ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ইংরেজী পঞ্জিকা মতে, তারিখটি ছিল ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অথবা ২২শে এপ্রিল। এ বছরটি ছিল বাদশাহ নওশেরওয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার চল্লিশতম বছর।[9]
আমাদের সমাজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ রবীঊল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ প্রসিদ্ধ থাকলেও ৯ই রবীঊল আউয়াল রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম দিবস বলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ মত প্রকাশ করেছেন। তাই তিনি ৯ই রবীঊল আউয়াল ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন।[10]
এই মতটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ। আর এই মতের পক্ষে আল্লামা হুমাইদী, ইমাম ইবনু হাযম, ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম, ইবনু কাছীর, ইবনু হাজার আসক্বালানী, বদরুদ্দীন আইনীসহ অন্যান্য বিদ্বানগণ রয়েছেন। মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ﷺ)-এর সঠিক জন্ম তারিখ অকাট্যভাবে জানা যায়নি। রাসূল (ﷺ) রবীঊল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন, রবীঊল আউয়ালের ১২ তারিখ নয়।[11]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, তিনি সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন। আবূ কাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سُئِلَ عَنْ صَومِ يَوْمِ الاِثْنَيْنِ فَقَالَ ذَلِكَ يَومٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَومٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ،
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সোমবার দিনে ছিয়াম রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বললেন, ওটি এমন একটি দিন, যেদিন আমার জন্ম হয়েছে, যেদিন আমি (নবীরূপে) প্রেরিত হয়েছি অথবা ঐ দিনে আমার প্রতি (সর্বপ্রথম) ‘অহী’ অবতীর্ণ করা হয়েছে’।[12]
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
وُلِدَ النبيُّ صلى الله عليه وسلم يومَ الاثنينِ واستُنْبِئَ يومَ الاثنينِ وتوفيَ يومَ الاثنينِ وخرج مهاجرًا من مكةَ إلى المدينةِ يومَ الاثنينِ وقَدِمَ المدينةَ يومَ الاثنينِ ورُفِعَ الحجرُ الأسودُ يومَ الاثنينِ-
‘নবী করীম (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন সোমবার, নবুওয়াত লাভ করেন সোমবার, মৃত্যুবরণ করেন সোমবার, হিজরতের জন্য মক্কা থেকে মদীনায় গমন করেন সোমবার, মদীনায় আগমন করেন সোমবার, হাজারে আসওয়াদকে উত্তোলন করেন সোমবার’।[13]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যু :
রাসূল (ﷺ) কোন তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবেঈ ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে। ১লা রবীঊল আউয়াল,[14] ২রা রবীঊল আউয়াল, ১২ই রবীঊল আউয়াল ও ১৩ই রবীঊল আউয়াল।[15] অধিকাংশ জীবনীকারের মতে দিনটি ছিল ১১ হিজরীর ১২ই রবীঊল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন। তবে সহীহ হাদীস অনুযায়ী রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল।[16] অতএব সেটা ঠিক রাখতে হ’লে তাঁর জন্ম ৯ই রবীঊল আউয়াল সোমবার। আর তিনি ১১ হিজরী সনের ১লা রবীঊল আউয়াল সোমবার সকাল ১০-টার দিকে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।[17]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম-মৃত্যু দিবস প্রকাশ না করার কারণ :
মহান আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্ম তারিখ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলে দিতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইচ্ছা করলে তাঁর জন্ম তারিখ জেনে নিতে পারতেন। সাহাবীগণও ইচ্ছা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মৃত্যু তারিখ লিখে রাখতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা জানাননি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেননি এবং সাহাবীগণও স্মরণে রাখেননি। তার কয়েকটি কারণে হ’তে পারে-
এক- এর মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ জানেন।
দুই- ইসলামের দৃষ্টিতে কারো জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনে কোন কল্যাণ নেই। যদি কল্যাণ থাকত তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের, তাঁর পিতা-মাতা অথবা দাদা-নানার জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করতেন।
তিন- মহান আল্লাহ যদি জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনের বিধান রাখতেন, তাহ’লে সারা বছর মানুষকে শুধু জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করতে হ’ত। এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূল,[18] এক লক্ষ চবিবশ হাযার সাহাবী,[19] অসংখ্য ইমাম, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন সকলের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করলে প্রতিদিন অসংখ্য জন্ম-মৃত্যু দিবস হ’ত তখন কার জন্ম-মৃত্যু দিবস রেখে কারটা পালন করত মানুষ?
চার- জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করা বিধর্মীদের রীতি। তাই এ সকল ক্ষেত্রে বিধর্মীদের বিরোধিতা করাই ইসলামের নির্দেশ।
পাঁচ- রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রেরণ করা হয়েছে তাঁর অনুসরণ করে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করে অনুষ্ঠান সর্বস্ব হওয়ার জন্য নয়।
রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে সমাজে প্রচলিত কর্মকান্ড :
(১) মীলাদ পালন : ‘মীলাদ’ (ميلاد) অথবা মাওলিদ (مولد) আরবী শব্দ। যার অর্থ-জন্ম, জন্মকাল, জন্ম তারিখ। আর ‘মীলাদুন্নবী’ অর্থ- নবীর জন্ম দিন বা নবীর জন্ম সময়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস মনে করে ১২ই রবীঊল আউয়াল তারিখ তাঁর জন্মের বা জীবনের কিছু বিবরণ, ওয়ায-নছীহত, তাঁর প্রতি কিছু দরূদ পাঠের মাধ্যমে মীলাদ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। বর্তমানে মীলাদের এমন প্রসার পেয়েছে যে, মুসলিমগণ শুধু একদিন মীলাদ পালন করে ক্ষান্ত হয়নি বরং বছরের প্রতিটি দিন যে কোন অনুষ্ঠানে মীলাদ পালন করে থাকে। ঘর উদ্বোধন, দোকান উদ্বোধন, পিতা-মাতার জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন, ছেলে-মেয়েদের আক্বীক্বা, সুন্নাতে খাতনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আগে-পরে মীলাদের আয়োজন করা হয়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মদিন নিঃসন্দেহে মুসলিমদের জন্য একটি আনন্দের দিন। কিন্তু এই জন্মদিন রাসূল (ﷺ) নিজে পালন করেননি, তাঁর সাহাবীগণ, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, করেননি; প্রসিদ্ধ চার ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) পালন করেননি এবং এসব পালন করতে বলে যাননি। তাই এই দিনে কোন অনুষ্ঠান করা, অতিরিক্ত কোন ইবাদত চালু করা, ছওয়াবের আশায় ধর্মের মধ্যে অতিরঞ্জন করা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رد،
‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছে যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[20]
মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘শরী‘আতের দিক থেকে যদি মীলাদ মাহফিল উদযাপন করা সঠিক হ’ত, তবে নবী করীম (ﷺ) তা করতেন অথবা তাঁর উম্মতকে করতে বলতেন। আর পবিত্র কুরআন বা হাদীসে অবশ্যই তা সংরক্ষিত থাকত’।[21]
(২) ঈদে মীলাদুন্নবী পালন : এক শ্রেণীর মুসলিম শুধু মীলাদুন্নবী পালন করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা এই দিনটিকে ঈদ বানিয়ে নিয়েছে। তারা ইসলামের দু’টি ঈদের সাথে এ দিনটিকে তৃতীয় আরেকটি ঈদ বানিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং তারা বলে থাকে, সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মীলাদুন্নবী। আর ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করা উম্মতের উপর ফরয ইত্যাদি। অথচ ইসলামে অনুমোদিত ঈদ কেবল দু’টি। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَدِمَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا، فَقَالَ: مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ قَالُوا: كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:&إِنَّ اللهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا: يَوْمَ الْأَضْحَى، وَيَوْمَ الْفِطْرِ
‘রাসূল (ﷺ) যখন মদীনায় আসলেন তখন দেখলেন বছরের দু’টি দিনে মদীনাবাসীরা আনন্দ-ফূর্তি করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ দিন দু’টি কি? তারা বলল যে, আমরা ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে এ দু’দিন আনন্দ-ফূর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা এ দু’দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দু’টি দিন তোমাদের দিয়েছেন। তা হ’ল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর’।[22]
(৩) ক্বিয়াম করা : ক্বিয়াম (قيام) আরবী শব্দ। অর্থ- দন্ডায়মান হওয়া, দাঁড়ানো অবস্থা ইত্যাদি। মীলাদে কুরআন তেলাওয়াত, যিকর-আযকার ও বিভিন্ন ভাষায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসার এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাযির হয়েছেন মনে করে তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়াকে ক্বিয়াম বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মীলাদ অনুষ্ঠানে হাযির হন এই বিশ্বাস নিয়ে ক্বিয়াম করা হারাম ও শিরকী কাজ। কারণ আল্লাহ ছাড়া কেউ হাযির-নাযির নন এবং তিনি ব্যতীত কেউ গায়েবের খবর রাখেন না (আন‘আম ৬/৫০; নমল ২৭/৬৫; লোক্বমান ৩১/৩৪)।
আর মৃত্যুর পর কোন রূহ দুনিয়াতে ফিরে আসা সম্ভব নয় (মুমিনূন ২৩/১০০)।
যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃত্যুবরণ করেছেন (যুমার ৩৯/৩১; আলে ইমরান ৩/১৪৪)। সুতরাং তাঁর অথবা তাঁর আত্মার পৃথিবীর কোন মীলাদ-মাহফিল বা ক্বিয়াম অনুষ্ঠানে আসার সুযোগ নেই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবিত অবস্থায়ও সাহাবীদের এমন কর্ম অপসন্দ করেছেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরামের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেয়ে অধিক প্রিয় ব্যক্তি আর কেউ ছিল না। কিন্তু তবুও তাদের অবস্থা এই ছিল যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আগমন করতে দেখতেন তার সম্মানার্থে তারা দাঁড়াতেন না। কেননা তারা জানতেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এটা পসন্দ করেন না’।[23] মু‘আবিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَتَمَثَّلَ لَهُ الرِّجَالُ قِيَامًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
‘যার মনের অভিলাষ এই যে, মানুষ তার সম্মুখে মূর্তির মতো দন্ডায়মান থাকুক, সে যেন জাহান্নামকে নিজের বাসস্থান বানিয়ে নেয়’।[24]
(৪) বিধর্মীদের অনুসরণে জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন : জনম-মৃত্যু দিবস পালন ইসলামের রীতি নয়; বরং বিধর্মীদের রীতি। তারা তাদের ধর্মের প্রধান ব্যক্তিদের জন্মদিবস পালন করে থাকে। হিন্দুধর্মের অনুসারীরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিবস উপলক্ষে জন্মাষ্টমী পালন করে থাকে। হিন্দু পঞ্জিকা মতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে তা পালন করা হয়।[25] ঈসা (আঃ)-এর জন্ম কখন হয়েছে, তা জানা না থাকলেও খৃষ্টানরা যীশুর জন্মদিবস হিসাবে ২৫শে ডিসেম্বর বড় দিন পালন করে থাকে।[26] আর মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মের লোকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা জায়েয নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ،
‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদেরই অর্ন্তভুক্ত’।[27]
বর্তমানে মানুষ শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস পালনে থেমে নেই; বরং নিজেদের জন্মদিন, ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন, পিতা-মাতার জন্ম-মৃত্যু দিন, এমনকি নেতা-নেত্রীর জন্ম-মৃত্যু দিবসও পালন করে থাকে। যার কোনটিই জায়েয নয়।
(৫) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসায় অতিরঞ্জন করা : মীলাদ অনুষ্ঠানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে, তাঁর সম্মানে অতিরঞ্জিত করা হয়। অনেক সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয় (নাঊযুবিল্লাহ)। মীলাদে পঠিতব্য অতি পরিচিত একটি উর্দূ কবিতার একটি অংশ এরূপ, ‘ওহ জো মুস্তাবী আরশ থা খোদা হো কর্, উতার পড়া হ্যায় মদীনা মেঁ মুছতফা হো কর্’। অর্থ-‘আরশের অধিপতি আল্লাহ ছিলেন যিনি, তিনিই মদীনায় নেমে এলেন মুছতফা রূপে’।[28]
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসা করতে গিয়ে তাকে নূরে মুহাম্মাদী অর্থাৎ তিনি নূরের তৈরি, তাঁকে সৃষ্টি না করা হ’লে আসমান-যমীন সৃষ্টি করা হ’ত না, তাঁর নূরে আরশ-কুরসী, জান্নাত-জাহান্নাম, আসমান-যমীন সৃষ্টি হয়েছে, আদম (আঃ) তার নামের অসীলায় ক্ষমা পেয়েছেন, মে‘রাজে আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতাসহ আরশে উঠিয়ে আরশের গৌরব বৃদ্ধি করেন ইত্যাদি মিথ্যা অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি কথা বলে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا: عبدُ الله ورسولُه
‘খ্রিস্টানরা মারইয়াম-এর পুত্র ‘ঈসা (আ.)-এর প্রশংসায় যেভাবে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা সেভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। আমি তো আল্লাহর বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল বল’।[29] এমনকি তাঁর নামে মিথ্যা বলাকেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সালামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি,
مَنْ يَقُلْ عَلَىَّ مَا لَمْ أَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ،
‘যে ব্যক্তি আমার উপর এমন কথা আরোপ করে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়’।[30]
(৬) মিথ্যা দরূদ বানানো : সমাজে বহুল প্রচলিত, মীলাদের সময় পঠিত একটি প্রচলিত দরূদ (?) হ’ল-
بلغ العلى بكماله، كشف الدجى بجماله، حسنت جميع خصاله، صلوا عليه وآله،
‘তিনি (মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর পরিপূর্ণতার দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেছেন। তাঁর সৌন্দর্যের কারণে অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে। তাঁর সমস্ত স্বভাব-চরিত্র সুন্দর। তোমরা তাঁর উপর ও তাঁর পরিবারের উপর দরূদ পাঠ কর’।
সমাজে প্রচলিত উক্ত বাক্যগুলো আসলে কোন দরূদ নয়, বরং এটি পারস্য কবি শেখ সা‘দী (৫৮৫ বা ৬০৬-৬৯১ হিঃ)-এর গ্রন্থের একটি কবিতার অংশ। তিনি রাসূলের প্রশংসায় এটি রচনা করেছেন।
এই কবিতায় শিরকের মিশ্রণ রয়েছে। কারণ এখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ﷺ) নিজের পরিপূর্ণতা দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেন। আসলে রাসূল (ﷺ) নিজের যোগ্যতার দ্বারা উচ্চ আসনে পৌঁছেননি, বরং আল্লাহ তাঁকে উচ্চ আসনে পেঁŠছিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
‘আর আমরা তোমার (মর্যাদার) জন্য তোমার স্মরণকে সমুন্নত করেছি’ (ইনশিরাহ, ৯৪/০৪)। সুতরাং দুনিয়ায় ও আখেরাতে রাসূল (ﷺ)-এর যত সম্মান, যত মর্যাদা সব তাকে আল্লাহ দিয়েছেন। এটা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ। সুতরাং কেউ যদি বিশ^াস করে যে, আল্লাহর রাসূল নিজের যোগ্যতায় এত বড় মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন, তাহ’লে তিনি আল্লাহর ক্ষমতার সাথে শিরক করবেন।
এছাড়া রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি সালাম জানাতে ও দরূদ পাঠ করতে বলা হয় যে,
يا نبي سلام عليك، يا رسول سلام عليك، يا حبيب سلام عليك صلوات الله عليك،.
‘হে নবী! আপনার প্রতি সালাম। হে রাসূল! আপনার প্রতি সালাম। হে হাবীব! আপনার প্রতি সালাম। আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার উপর রহমত’।
উল্লেখ্য যে, প্রচলিত কথাগুলি আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত কোন দরূদ নয়। বরং এগুলি মানুষের বানানো দরূদের নামে জালিয়াতি।
আর এসব আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ীও ভুল। কারণ সম্মানিত কাউকে ডাকার জন্য সম্মান দিয়ে ডাকতে হয়। অথচ এখানে সমস্ত নবীদের সর্দার, দুনিয়া-আখেরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ তাকে অনির্দিষ্ট বাক্যে ডাকা হয়েছে যা আদবের খেলাপ।
আর আল্লাহ কুরআনের যত জায়গায় রাসূলকে সম্বোধন করেছেন সেখানে يا نبي বা يا رسول না বলে يا ايها الرسول বা يا ايها النبي বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ،
‘হে নবী! তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং যেসব মুমিন তোমার অনুসরণ করেছে তাদের জন্যও’ (আনফাল ৮/৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ
‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও’ (মায়েদা ৫/৬৭)।
সুতরাং রাসূল (ﷺ)-এর সম্মানের জন্য, ছওয়াবের আশায় দরূদ পাঠ করতে হ’লে রাসূল (ﷺ)-এর শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ীই করতে হবে। অন্যথা রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞার করণে ছওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম-মৃত্যু দিবস উপলক্ষে করণীয় :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম অথবা মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বিশেষ কোন আমলের বর্ণনা শরী‘আতে নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে কোন আমল করেননি, তাঁর লক্ষাধিক সাহাবা কিছু করেননি, খুলাফায়ে রাশেদীনের কেউ কিছু করেননি, এমনকি তাঁর আত্মীয়-স্বজন কেউ কিছু করেননি। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত কোন ইবাদত করা, অনুষ্ঠান করা জায়েয নয়। বরং প্রতিদিন যেসকল ইবাদত পালন করা হয়, ঐ দিনও তাই পালন করতে হবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মহববত করা, তাঁকে সম্মান করা, তাঁর পরিপূর্ণ ইত্তেবা করা ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ-
‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
পরিশেষে বলব, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্ম দিবস পালন নয়, বরং পরিপূর্ণভাবে তাঁকে অনুসরণই কাম্য। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. তিরমিযী হা/৩৬০৯; সহীহাহ হা/১৮৫৬; মিশকাত হা/৫৭৫৮।
[2]. ইবনে কাছীর, সূরা আলে ইমরান ৮১ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
[3]. তিরমিযী হা/৫৯১৮; মিশকাত হা/৫৯১৮।
[4]. সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, (মৃ. ১৯৩০ খ্রিঃ) রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (উর্দূ), দিল্লী : ১৯৮০ খ্রিঃ ১/৪০; আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ৫৪, গৃহীত: সীরাতুর রাসূল (ﷺ), পৃঃ ৫৬।
[5]. মুসলিম হা/১১৬২; মিশকাত হা/২০৪৫; বুখারী হা/১৩৮৭।
[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/৭৪।
[7]. তিরমিযী হা/৩৬১৯; সহীহাহ হা/৩১৫২।
[8]. আকরাম যিয়া আল-উমরী, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ আস-সহীহা ১/৯৬-৯৮; মাহদী রেজাকুল্লাহ আহমাদ, আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ১০-১১০ পৃ.। গৃহীত : ইয়াউস সুনান, পৃ. ৫৫৫।
[9]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৪১।
[10]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুল রাসূল (ﷺ), পৃ. ৫৬।
[11]. মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, (ঈমান পর্ব) প্রশ্ন নং ৮৯।
[12]. মুসলিম (ই.ফা) হা/২৮০৪, (ই.সে) হা/২৬১৩।
[13]. আহমাদ হা/৩৫০৬, আহমাদ শাকের এর সনদকে সহীহ বলেছেন। আহমাদ ৪/১৭২; ত্বাবারানী ১২/২৩৭ হা/১২৯৮৪।
[14]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, সীরাতুল রাসূল (ﷺ) পৃ. ৫৬।
[15]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯; ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর : কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা পৃ. ১২৫-১২৬।
[16]. মুসলিম হা/১১৬২; বুখারী হা/১৩৮৭।
[17]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুল রাসূল (ﷺ) পৃ. ৭৪৩।
[18]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫৭৩৭; সহীহাহ হা/২৬৬৮।
[19]. মির‘আত শরহ মিশকাত, হা/২৫৬৯ এর ব্যাখ্যা দ্র.।
[20]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/১৭১৮; আবূদাঊদ ৪৬০৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪।
[21]. মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, (ঈমান পর্ব) প্রশ্ন নং ৮৯।
[22]. আবূদাঊদ হা/১১৩৪; নাসাঈ হা/১৫৫৬; আহমাদ হা/১২০০৬।
[23]. তিরমিযী হা/২৭৫৪; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৪৬; আহমাদ, হা/১২৩৭০; সহীহাহ হা/৩৫৮।
[24]. আবূদাঊদ হা/৫২২৯; তিরমিযী হা/২৭৫৫; সহীহাহ হা/৩৫৭।
[25]. উইকিপিডিয়া, একটি মুক্ত বিশ্বকোষ জন্মাষ্টমী।
[26]. উইকিপিডিয়া, একটি মুক্ত বিশ্বকোষ বড়দিন।
[27]. আবূদাঊদ, হা/৪০৩১; সহীহুল জামে‘ হা/৬১৪৯।
[28]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মীলাদ প্রসঙ্গ, পৃ. ১৮।
[29]. বুখারী হা/৩৪৪৫, ৬৮৩০; সহীহুল জামে‘ হা/১৩৩১৯; মিশকাত হা/৪৮৯৭।
[30]. বুখারী হা/১০৯।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: