Well-known member
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ঈদে মিলাদুন্নবি-এর শুরুর কথা:
ইসলামের সোনালী অধ্যায়ের তিন শতাব্দী তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগ, সাহাবিদের যুগ এবং তাবেঈদের যুগ পার হয়ে গেলেও ইতিহাসে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, কোন একজন সাহাবি, তাবেঈ বা তাবে তাবেঈ মিলাদ উদযাপন করেছেন।
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি তাদের ভালবাসা কি কম ছিল? কখনও নয়। বরং তাঁরা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রচণ্ড ভাবে ভালবাসতেন। তারা ছিলেন তার সুন্নত-আদর্শ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং শরীয়তের বিধিবিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী।
মিলাদের উৎপত্তি কারক হল, বনি উবায়দিয়া বা ফাতেমিয় সম্প্রদায়:
ঐতিহাসিকগণ বলেন, যারা সর্বপ্রথম এই বিদআতকে রূপদান করে তারা হল, বনি উবাইদ আল কাদ্দাহ। এরানিজেদেরকে ফাতেমি বলে অবিহিত করত এবংনিজেদেরকে আলি রা. এর বংশধর বলে দাবী করত। এরাই ফাতেমি দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাতা।” [আল বিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ, ১১/২০২]
এদের পরিচয় ও আসল রূপ:
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.কে এই ফাতেমিয়দের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর হলে তিনি উত্তরে বলেন, “তারা ছিল জঘন্য ধরণের পাপাচারী এবংনিকৃষ্ট কাফের। কেউ যদি তাদেরকে ইমানদার এবং পরহেজগার বলে সাক্ষ্য দেয় অথবা তাদের বংশ পরম্পরাকে সঠিক বলে স্বীকৃতি দেয় তবে তারা এমন বিষয়ে কথা বলল যে ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
“সে বিষয়ের পিছে ছুট না যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই।“[1] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
“তবে যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দিল।”[2]
এ সকল লোকদের ব্যাপারে সমস্ত আলেম সমাজ, ইমামগণ এবং সর্বস্তরের মানুষ সাক্ষ্য দেয় যে, এরা ছিল নাস্তিক, ধর্মচ্যুত এবং মুনাফিক। এরা বাহ্যিক ভাবে যদিও ইসলাম প্রকাশ করত কিন্তু তাদের অন্তরে লুকানো ছিল কুফরি। সুতরাং কেউ যদি তাদের ইমানের সাক্ষ্য দেয় তবে সে এমন বিষয়ে সাক্ষ্য দিল, যে ব্যাপারে তার জ্ঞান নেই। কারণ, তাদের কার্যক্রম থেকে এমন কিছু পাওয়া যায় না যাতে তাদের ইমানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
অনুরূপভাবে তাদের বংশগত সম্পর্কের ব্যাপারেও অধিকাংশ আলেমগণ দোষারোপ করেছেন। তারা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে এরা অগ্নিপূজক অথবা ইহুদিদের সন্তান। এটাই হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলিদের অনেক আলেমের প্রসিদ্ধ মতামত। এমনকি মুহাদ্দেসিনগণ, আহলে কালাম, বংশ বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষেরও মন্তব্য এটাই। যে সকল লেখক মানুষের জীবন পঞ্জিকা এবং ইতিহাস লিখেছেন তারাও এ বিষয়টি তাদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
সর্বপ্রথম যারা মিলাদ তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম অনুষ্ঠান পালনের বিদআত সূচনা করে তারা হল বাতেনি সম্প্রদায়। যাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, দীন ইসলামের মাঝে পরিবর্তন সাধন করে তার মধ্যে এমন কিছু ঢুকানো যার অস্তিত্ব দীনের মধ্যে ছিল না। কারণ, ইসলামি শরীয়ত এবং রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত থেকে মানুষকে দূরে সরানোর সব চেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, তাদেরকে বিদআতের মধ্যে ব্যস্ত রাখা।
মাকরীযী বলেন, ফাতেমি খলিফাগণ বিভিন্ন দিনকে আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবেনির্ধারণ করেছিল এবং এসব দিনে তারা জন-সাধারণের মাঝে খাদ্য বিতরণ এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রী প্রদান করত।
উবায়দিয়ারা সারা বছর ধরে যে সব দিনকে আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবে পালন করত সেগুলো হল:
১) নব বর্ষ ২) আশুরা ৩) রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস ৪) আলি রা. এর জন্ম দিবস ৫) হাসান রা. এর জন্ম দিবস ৬) হুসাইন রা. এর জন্ম দিবস ৭) ফাতেমাতুজ জোহরা রা. এর জন্ম দিবস ৮) ক্ষমতাসীন শাসকের জন্ম দিবস ৯) রজব মাসের ১ম দিন ৯) রজব মাসের ১৫ তারিখের রাত ১০) শাবান মাসের ১ম দিন ১১) অর্ধশাবানের রাত (শবে বরাত) ১২) রমজানের ১ম রাত ১৩) রমাজানের ১ম দিন ১৪) রমজানের মধ্যভাগ ১৫) রমজানের শেষ রাত ১৬) ঈদুল ফিতরের মৌসুম ১৭) কুরবানির মৌসুম ১৮) গাদির উৎসব ১৯) নওরোজ (নববর্ষ) ২০) এবং ২১) যিশু খৃষ্টের জন্ম দিন (বড়দিন) ইত্যাদি।
মাকরিযির পক্ষ থেকে এটা একটি স্পষ্ট সাক্ষ্য। যদিও তিনি এদেরকে আলি রা. এর বংশধর হিসেবে শুধু স্বীকৃতি দেন না বরং তাদের পক্ষাবলম্বন করে বিরোধীদের জবাব দেন। কিন্তু তিনি অকপটে এ কথার সাক্ষ্য দিলেনে যে, এ ফাতেমিয়রাই মুসলিমদের বিপদের কারণ। এরাই বিভিন্ন বিদআতি অনুষ্ঠানের পথ উন্মুক্ত করে। এমন কি এরা অগ্নিপূজক এবং খৃষ্টানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদীও পালন করে। যেমন নওরোজ বা নববর্ষ এবং যিশু খৃষ্টের জন্ম দিন (বড় দিন) ইত্যাদি।
এতেই প্রমাণিত হয় যে, এদের অবস্থান ইসলাম থেকে শুধু দূরেই নয় বরং এরা ইসলাম ও মুসলিমদের ঘোরতর দুশমনও যদিও এরা বাহ্যিক ভাবে তা স্বীকার করে না।
মোটকথা, বনি উবাইদ আল কাদ্দাহ তথা ফাতেমিয়রাই সর্ব প্রথম মিলাদ অনুষ্ঠান শুরু করে।
সউদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি শাইখ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম আলুশ শাইখ রহ. বলেন, “হিজরি ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এই বিদআত তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস পালনের প্রথা সর্ব প্রথম চালু করেন আবু সাঈদ কুকুবুরি। যদিও এ মর্মে অন্য আরও একাধিক মত রয়েছে।[3]
কিছু আলেম যেমন ইমাম সুয়ুতি রাহ. এই বিদআতের পক্ষে প্রমাণাদি খুঁজতে বাধ্য হলেন যাতে মিলাদের বিদআতকে বৈধতা দেওয়া যায়। আবার অনেক আলেম একদিকে সরকারের ভয়ে অন্য দিকে জন সাধারণের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার আশংকায় এ বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পেরে নীরবতা অবলম্বন করলেন।
প্রথম সংশয়: আশুরার রোজার উপর ভিত্তি করে মিলাদ উদযাপন!
ইমাম সুয়ুতি বলেন, মিলাদের স্বপক্ষে ইমাম ইবনে হাজার হাদিস থেকে একটি প্রমাণ বের করেছেন। আমি তার সাথে আরও একটি প্রমাণ বের করেছি।
তিনি (ইমাম সুয়ুতি) বলেন, যুগের হাফেজে হাদিস শাইখুল ইসলাম আহমদ ইবনে হাজারকে মিলাদ করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি যা বলেন তা হুবহু তুলে ধরা হল:
“মিলাদ করা বিদআত। এর স্বপক্ষে ইসলামের প্রথম তিন শ্রেষ্ঠ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মনিষী তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈন থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তদুপরি মিলাদে কিছু ভালো জিনিস রয়েছে আর কিছু খারাপ জিনিস রয়েছে। কেউ যদি মিলাদে ভালো জিনিসগুলোর উদ্দেশ্য করে এবং মন্দ জিনিসগুলো পরিত্যাগ করে তবে তা ‘বিদআতে হাসানা’ হিসেবে গণ্য হবে; অন্যথায় নয়। আমি এ ব্যাপারে একটি মজবুত প্রমাণ পেয়েছি। আর তা হল, সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদিনা গমন করার পর দেখলেন ইহুদিরা মুহররম মাসের দশ তারিখে আশুরার রোজা পালন করছে। তিনি এ ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এই দিনে আল্লাহ তাআলা ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং মুসা আ. কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ আমরা এ দিনে রোজা পালন করি।
তাই উক্ত হাদিস থেকে এই প্রমাণ গ্রহণ করা যেতে পারে যে, কোন একটি বিশেষ দিনে সুসংবাদ বা কল্যাণের বার্তা এলে কিংবা কোন বিপদ মুক্ত হলে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কিছু আমল করা যায় এবং প্রতি বছর ঐ বিশেষ দিনটি ফিরে আসলে সে আমলগুলো পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে। আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা যায় বিভিন্নভাবে। যেমন: সেজদায়ে শোকর, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার দিনটির চেয়ে এত বড় আনন্দের এবং এত বিশালনিয়ামতের দিন আর কী হতে পারে?
অতএব এ ভিত্তিতে রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিনটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যাতে মুসা আ. এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশুরার রোজা রাখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এ দিকটি যারা খেয়াল করে না তারা মাসের যে কোন দিন মিলাদ করতে কোন দ্বিধা করে না। কিছু মানুষ এটাকে আরেকটু ঢিল দিয়ে বছরের যে কোন একদিন পালন করে থাকে। কিন্তু এতে কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে।[4]
এই সংশয়ের জবাব: উপরে উত্থাপিত সংশয়ের একাধিক জবাব রয়েছে।নিন্মে সেগুলো তুলে ধরা হল:
প্রথমত:
ইবনে হাজার রাহ. প্রথমেই স্পষ্টভাবে স্বীকার করেনিয়েছেন যে, রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম উপলক্ষে মিলাদ উদযাপন করা বিদআত। যা ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর মনিষীগণ তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈগণ থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অতএব মিলাদ বাতিল প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট। কারণ, মিলাদে যদি ভালো কিছু থাকত তবে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণ এবং তাদের পরবর্তীতে ইসলামের জ্ঞানী-গুনি এবং মহা মনিষীগণ সবার আগে সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য ছুটে যেতেন।
দ্বিতীয়ত:
আশুরার দিন রোজা রাখার হাদিসের উপর ভিত্তি করে মিলাদকে বৈধতা দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ইবনে হাজার রা. তো নিজেই স্বীকার করেছেন যে, মিলাদ করা বিদআত। কেননা সালাফে-সালেহিন তথা ইসলামের প্রথম তিন যুগের মনিষীগণ থেকে প্রমাণিত নয়।
সালাফে-সালেহিন যেহেতু উপরোক্ত আশুরার হাদিসের উপর ভিত্তি করে মিলাদ করেননি। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, এটাকে টেনে এনে মিলাদের পক্ষে দলিল বানানো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এটাকে মিলাদের স্বপক্ষে দলিল বানাতে চান তাদের বুঝ এবং ইসলামের প্রথম যুগের মনিষীদের বুঝের মধ্যে কোন মিল নেই।
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবি এবং তাবেঈণগণ হাদিসের বক্তব্যকে যে অর্থে বুঝেননি এবং তা আমল করেননি তার উল্টো অর্থে যদি পরবর্তী যুগের লোকেরা হাদিসকে ব্যাখ্যা দিতে যায় তাহলে তা হবে মারাত্মক অন্যায়। কারণ এটা তাঁদের ইজমা বা সর্ব সম্মত মতের বিপরীত। আর তাঁরা কখনই বতিলের উপর একমত হতে পারে না।
তৃতীয়ত:
আশুরার রোজার উপর ভিত্তি করে মিলাদকে বৈধ করা করা একটি অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কারণ যে কোন এবাদত গ্রহণযোগ্য হতে হলে শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীলের উপর তার ভিত্তি থাকতে হবে। এক্ষেত্রেনিজস্ব খেয়াল-খুশি আর মনগড়া ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান যোগ্য।
চতুর্থত:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো মুহররম মাসে দশ তারিখে রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তিনি তো মিলাদ করতে বলেননি। কিংবা ঈদে মিলাদুন্নবি তথা তাঁর জন্মোৎসব পালন করতে বলেননি। কিংবানিজেও কখনও করেননি।
মিলাদে যদি কোন উপকার থাকত তবে অবশ্যই তিনি তাঁর উম্মতকে স্পষ্টভাবে তা পালন করার কথা বলে যেতেন। কারণ, দুনিয়া-আখিরাতের এমন কোন কল্যাণকর দিক নেই যা তিনি তার উম্মতকে বলে দেননি কিংবা এমন কোন ক্ষতিকর দিক নেই যে ব্যাপারে সাবধান করেননি। বরং তিনি দীনের ভিতর নতুন নতুন বিদআত তৈরি করার ব্যাপারে কঠিন ভাবে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন,
“দীনের মধ্যে নতুন সৃষ্ট বিষয়াদি থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত বিষয়ই গোমরাহি।[5]
তিনি বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দেওয়ার শুরুতে বলতেন:
“অতঃপর, সর্বোত্তম বাণী হল আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তমনির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরনির্দেশনা। সব চেয়েনিকৃষ্ট জিনিস হল দীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়াদি। আর প্রতিটি নতুন বিষয়ই ভ্রষ্টতা।[6]
দ্বিতীয় সংশয়:
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃকনিজের আকিকানিজেই করার হাদিস থেকে মিলাদের পক্ষে দলিল আবিষ্কার!!
ইমাম সুয়ুতি আরও বলেন, মিলাদের স্বপক্ষে ইমাম ইবনে হাজার রা. এর উপরোক্ত দলিল ছাড়াও আমি আরেকটি দলিল বের করেছি। আর তা হল,
সুনান বায়হাকিতে আনাস রা. হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পরনিজেইনিজের আকিকা দিয়েছেন। যদিও তাঁর দাদা আব্দুল মোত্তালেব জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর আকিকা দিয়েছিলেন। আর আকিকা তো একাধিক বার দেওয়া যায় না। তাই বিষয়টার তাৎপর্য এভাবে গ্রহণ করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা যেহেতু তাকে জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেছেন তার কৃতজ্ঞতা আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি আকিকা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনিনিজেইনিজের নামে দরুদ ও সালাম পেশ করতেন।
সুতরাং রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস উপলক্ষে আমাদের কর্তব্য হল, সম্মিলিতভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়, ভোজ সভার আয়োজন সহ আরও বিভিন্ন নেক কাজ আঞ্জাম দেওয়া এবং আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করা।[7]
উক্ত সংশয়ের জবাব: প্রথম কথা হল, রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃকনিজেইনিজের আকিকা দেওয়ার হাদিসটি মুহাদ্দিসগণেরনিকট সনদগতভাবে প্রমাণিত নয়।
নিম্নে মুহাদ্দিসগণের মতামত তুলে ধরা হল:
১. আব্দুর রাজ্জাক রহ. তার মুসান্নাফ কিতাবে বলেন, আমাদেরনিকট আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাররার হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কাতাদা থেকে। কাতাদা বর্ণনা করেছেন আনাস থেকে। তিনি বলেন, “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়তের পরেনিজেইনিজের আকিকা দিয়েছেন।”
ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া এ হাদিসটি আব্দুর রাজ্জাক-এর বরাতে উল্লেখ করে বলেন, “আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করার কারণে ইবনে মুহাররারকে বর্জন করেছেন।” [8]
২. হাফেজ ইবনে হাজার রহ. ফাত্হুল বারীতে উল্লেখ করেছেন, উক্ত হাদিসটি প্রমাণিত নয় এবং তিনি হাদিসটি ইমাম বাজ্জারের দিকে সম্বন্ধ করে বল , ইমাম বাযযার বলেছেন, “এ হাদিসটি আব্দুল্লাহ মুহারারারের একক বর্ণনা। কিন্তু তিনি দুর্বল।[9]
৩. ইমাম নওয়াবি আল মুহাযযাব কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থ আল মাজমু কিতাবে বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরনিজের আকিকা করার ব্যাপারে গ্রন্থকার যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তা আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। কাতাদা আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়তের পরনিজেনিজের আকিকা দিয়েছেন। কিন্তু এ হাদিসটি বাতিল। হাদিসের সনদে উল্লেখিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাররার সর্বসম্মত ভাবে দুর্বল রাবী (বর্ণনাকারী)। হাফেজ ইবনে হাজার তাকে مَتْرُوْكٌ বা পরিত্যক্ত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ ভালো জানেন।[10]
৪. ইমাম জাহাবি মিজানুল ইতিদাল গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার-এর জীবনী লিখেছেন এবং তার ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. এর মন্তব্য উল্লেখ করার পর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তিনি একজন পরিত্যক্ত এবং অনির্ভর যোগ্য বর্ণনাকারী। তিনি আরও বলেন, আনাস রা. থেকে কাতাদা কর্তৃক “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবি হওয়ার পরনিজেনিজের আকিকা করেছেন” মর্মে বর্ণিত হাদিসটি তার অন্যতম একটি সমস্যাপূর্ণ বিষয়।[11]
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
ঈদে মিলাদুন্নবি-এর শুরুর কথা:
ইসলামের সোনালী অধ্যায়ের তিন শতাব্দী তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগ, সাহাবিদের যুগ এবং তাবেঈদের যুগ পার হয়ে গেলেও ইতিহাসে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, কোন একজন সাহাবি, তাবেঈ বা তাবে তাবেঈ মিলাদ উদযাপন করেছেন।
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি তাদের ভালবাসা কি কম ছিল? কখনও নয়। বরং তাঁরা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রচণ্ড ভাবে ভালবাসতেন। তারা ছিলেন তার সুন্নত-আদর্শ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং শরীয়তের বিধিবিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী।
মিলাদের উৎপত্তি কারক হল, বনি উবায়দিয়া বা ফাতেমিয় সম্প্রদায়:
ঐতিহাসিকগণ বলেন, যারা সর্বপ্রথম এই বিদআতকে রূপদান করে তারা হল, বনি উবাইদ আল কাদ্দাহ। এরানিজেদেরকে ফাতেমি বলে অবিহিত করত এবংনিজেদেরকে আলি রা. এর বংশধর বলে দাবী করত। এরাই ফাতেমি দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাতা।” [আল বিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ, ১১/২০২]
এদের পরিচয় ও আসল রূপ:
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.কে এই ফাতেমিয়দের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর হলে তিনি উত্তরে বলেন, “তারা ছিল জঘন্য ধরণের পাপাচারী এবংনিকৃষ্ট কাফের। কেউ যদি তাদেরকে ইমানদার এবং পরহেজগার বলে সাক্ষ্য দেয় অথবা তাদের বংশ পরম্পরাকে সঠিক বলে স্বীকৃতি দেয় তবে তারা এমন বিষয়ে কথা বলল যে ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ
“সে বিষয়ের পিছে ছুট না যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই।“[1] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
إِلَّا مَن شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
“তবে যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দিল।”[2]
এ সকল লোকদের ব্যাপারে সমস্ত আলেম সমাজ, ইমামগণ এবং সর্বস্তরের মানুষ সাক্ষ্য দেয় যে, এরা ছিল নাস্তিক, ধর্মচ্যুত এবং মুনাফিক। এরা বাহ্যিক ভাবে যদিও ইসলাম প্রকাশ করত কিন্তু তাদের অন্তরে লুকানো ছিল কুফরি। সুতরাং কেউ যদি তাদের ইমানের সাক্ষ্য দেয় তবে সে এমন বিষয়ে সাক্ষ্য দিল, যে ব্যাপারে তার জ্ঞান নেই। কারণ, তাদের কার্যক্রম থেকে এমন কিছু পাওয়া যায় না যাতে তাদের ইমানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
অনুরূপভাবে তাদের বংশগত সম্পর্কের ব্যাপারেও অধিকাংশ আলেমগণ দোষারোপ করেছেন। তারা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে এরা অগ্নিপূজক অথবা ইহুদিদের সন্তান। এটাই হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলিদের অনেক আলেমের প্রসিদ্ধ মতামত। এমনকি মুহাদ্দেসিনগণ, আহলে কালাম, বংশ বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষেরও মন্তব্য এটাই। যে সকল লেখক মানুষের জীবন পঞ্জিকা এবং ইতিহাস লিখেছেন তারাও এ বিষয়টি তাদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
সর্বপ্রথম যারা মিলাদ তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম অনুষ্ঠান পালনের বিদআত সূচনা করে তারা হল বাতেনি সম্প্রদায়। যাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, দীন ইসলামের মাঝে পরিবর্তন সাধন করে তার মধ্যে এমন কিছু ঢুকানো যার অস্তিত্ব দীনের মধ্যে ছিল না। কারণ, ইসলামি শরীয়ত এবং রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত থেকে মানুষকে দূরে সরানোর সব চেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, তাদেরকে বিদআতের মধ্যে ব্যস্ত রাখা।
মাকরীযী বলেন, ফাতেমি খলিফাগণ বিভিন্ন দিনকে আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবেনির্ধারণ করেছিল এবং এসব দিনে তারা জন-সাধারণের মাঝে খাদ্য বিতরণ এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রী প্রদান করত।
উবায়দিয়ারা সারা বছর ধরে যে সব দিনকে আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবে পালন করত সেগুলো হল:
১) নব বর্ষ ২) আশুরা ৩) রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস ৪) আলি রা. এর জন্ম দিবস ৫) হাসান রা. এর জন্ম দিবস ৬) হুসাইন রা. এর জন্ম দিবস ৭) ফাতেমাতুজ জোহরা রা. এর জন্ম দিবস ৮) ক্ষমতাসীন শাসকের জন্ম দিবস ৯) রজব মাসের ১ম দিন ৯) রজব মাসের ১৫ তারিখের রাত ১০) শাবান মাসের ১ম দিন ১১) অর্ধশাবানের রাত (শবে বরাত) ১২) রমজানের ১ম রাত ১৩) রমাজানের ১ম দিন ১৪) রমজানের মধ্যভাগ ১৫) রমজানের শেষ রাত ১৬) ঈদুল ফিতরের মৌসুম ১৭) কুরবানির মৌসুম ১৮) গাদির উৎসব ১৯) নওরোজ (নববর্ষ) ২০) এবং ২১) যিশু খৃষ্টের জন্ম দিন (বড়দিন) ইত্যাদি।
মাকরিযির পক্ষ থেকে এটা একটি স্পষ্ট সাক্ষ্য। যদিও তিনি এদেরকে আলি রা. এর বংশধর হিসেবে শুধু স্বীকৃতি দেন না বরং তাদের পক্ষাবলম্বন করে বিরোধীদের জবাব দেন। কিন্তু তিনি অকপটে এ কথার সাক্ষ্য দিলেনে যে, এ ফাতেমিয়রাই মুসলিমদের বিপদের কারণ। এরাই বিভিন্ন বিদআতি অনুষ্ঠানের পথ উন্মুক্ত করে। এমন কি এরা অগ্নিপূজক এবং খৃষ্টানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদীও পালন করে। যেমন নওরোজ বা নববর্ষ এবং যিশু খৃষ্টের জন্ম দিন (বড় দিন) ইত্যাদি।
এতেই প্রমাণিত হয় যে, এদের অবস্থান ইসলাম থেকে শুধু দূরেই নয় বরং এরা ইসলাম ও মুসলিমদের ঘোরতর দুশমনও যদিও এরা বাহ্যিক ভাবে তা স্বীকার করে না।
মোটকথা, বনি উবাইদ আল কাদ্দাহ তথা ফাতেমিয়রাই সর্ব প্রথম মিলাদ অনুষ্ঠান শুরু করে।
সউদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি শাইখ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম আলুশ শাইখ রহ. বলেন, “হিজরি ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এই বিদআত তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস পালনের প্রথা সর্ব প্রথম চালু করেন আবু সাঈদ কুকুবুরি। যদিও এ মর্মে অন্য আরও একাধিক মত রয়েছে।[3]
মিলাদ পন্থীদের কতিপয় ৫টি বহুল প্রচলিত সংশয় এবং সেগুলোর খণ্ডন:
উবাইদিয়াদের শাসনামলে মিলাদ চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে তা ব্যাপকতা লাভ করতে লাগল। মুসলিমগণ জিহাদ ছেড়ে দিল এবং তারা রুহানি ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এই বিদআতটি সাধারণ মানুষের মনে শিকড় গেড়ে বসল। এমনকি অনেক মূর্খ মানুষেরনিকট এটা আকিদা-বিশ্বাসের একটি অংশ হয়ে দাঁড়ালো।কিছু আলেম যেমন ইমাম সুয়ুতি রাহ. এই বিদআতের পক্ষে প্রমাণাদি খুঁজতে বাধ্য হলেন যাতে মিলাদের বিদআতকে বৈধতা দেওয়া যায়। আবার অনেক আলেম একদিকে সরকারের ভয়ে অন্য দিকে জন সাধারণের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার আশংকায় এ বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পেরে নীরবতা অবলম্বন করলেন।
প্রথম সংশয়: আশুরার রোজার উপর ভিত্তি করে মিলাদ উদযাপন!
ইমাম সুয়ুতি বলেন, মিলাদের স্বপক্ষে ইমাম ইবনে হাজার হাদিস থেকে একটি প্রমাণ বের করেছেন। আমি তার সাথে আরও একটি প্রমাণ বের করেছি।
তিনি (ইমাম সুয়ুতি) বলেন, যুগের হাফেজে হাদিস শাইখুল ইসলাম আহমদ ইবনে হাজারকে মিলাদ করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি যা বলেন তা হুবহু তুলে ধরা হল:
“মিলাদ করা বিদআত। এর স্বপক্ষে ইসলামের প্রথম তিন শ্রেষ্ঠ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মনিষী তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈন থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তদুপরি মিলাদে কিছু ভালো জিনিস রয়েছে আর কিছু খারাপ জিনিস রয়েছে। কেউ যদি মিলাদে ভালো জিনিসগুলোর উদ্দেশ্য করে এবং মন্দ জিনিসগুলো পরিত্যাগ করে তবে তা ‘বিদআতে হাসানা’ হিসেবে গণ্য হবে; অন্যথায় নয়। আমি এ ব্যাপারে একটি মজবুত প্রমাণ পেয়েছি। আর তা হল, সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদিনা গমন করার পর দেখলেন ইহুদিরা মুহররম মাসের দশ তারিখে আশুরার রোজা পালন করছে। তিনি এ ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এই দিনে আল্লাহ তাআলা ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং মুসা আ. কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ আমরা এ দিনে রোজা পালন করি।
তাই উক্ত হাদিস থেকে এই প্রমাণ গ্রহণ করা যেতে পারে যে, কোন একটি বিশেষ দিনে সুসংবাদ বা কল্যাণের বার্তা এলে কিংবা কোন বিপদ মুক্ত হলে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কিছু আমল করা যায় এবং প্রতি বছর ঐ বিশেষ দিনটি ফিরে আসলে সে আমলগুলো পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে। আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা যায় বিভিন্নভাবে। যেমন: সেজদায়ে শোকর, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার দিনটির চেয়ে এত বড় আনন্দের এবং এত বিশালনিয়ামতের দিন আর কী হতে পারে?
অতএব এ ভিত্তিতে রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিনটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যাতে মুসা আ. এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশুরার রোজা রাখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এ দিকটি যারা খেয়াল করে না তারা মাসের যে কোন দিন মিলাদ করতে কোন দ্বিধা করে না। কিছু মানুষ এটাকে আরেকটু ঢিল দিয়ে বছরের যে কোন একদিন পালন করে থাকে। কিন্তু এতে কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে।[4]
এই সংশয়ের জবাব: উপরে উত্থাপিত সংশয়ের একাধিক জবাব রয়েছে।নিন্মে সেগুলো তুলে ধরা হল:
প্রথমত:
ইবনে হাজার রাহ. প্রথমেই স্পষ্টভাবে স্বীকার করেনিয়েছেন যে, রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম উপলক্ষে মিলাদ উদযাপন করা বিদআত। যা ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর মনিষীগণ তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈগণ থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অতএব মিলাদ বাতিল প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট। কারণ, মিলাদে যদি ভালো কিছু থাকত তবে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণ এবং তাদের পরবর্তীতে ইসলামের জ্ঞানী-গুনি এবং মহা মনিষীগণ সবার আগে সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য ছুটে যেতেন।
দ্বিতীয়ত:
আশুরার দিন রোজা রাখার হাদিসের উপর ভিত্তি করে মিলাদকে বৈধতা দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ইবনে হাজার রা. তো নিজেই স্বীকার করেছেন যে, মিলাদ করা বিদআত। কেননা সালাফে-সালেহিন তথা ইসলামের প্রথম তিন যুগের মনিষীগণ থেকে প্রমাণিত নয়।
সালাফে-সালেহিন যেহেতু উপরোক্ত আশুরার হাদিসের উপর ভিত্তি করে মিলাদ করেননি। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, এটাকে টেনে এনে মিলাদের পক্ষে দলিল বানানো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এটাকে মিলাদের স্বপক্ষে দলিল বানাতে চান তাদের বুঝ এবং ইসলামের প্রথম যুগের মনিষীদের বুঝের মধ্যে কোন মিল নেই।
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবি এবং তাবেঈণগণ হাদিসের বক্তব্যকে যে অর্থে বুঝেননি এবং তা আমল করেননি তার উল্টো অর্থে যদি পরবর্তী যুগের লোকেরা হাদিসকে ব্যাখ্যা দিতে যায় তাহলে তা হবে মারাত্মক অন্যায়। কারণ এটা তাঁদের ইজমা বা সর্ব সম্মত মতের বিপরীত। আর তাঁরা কখনই বতিলের উপর একমত হতে পারে না।
তৃতীয়ত:
আশুরার রোজার উপর ভিত্তি করে মিলাদকে বৈধ করা করা একটি অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কারণ যে কোন এবাদত গ্রহণযোগ্য হতে হলে শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীলের উপর তার ভিত্তি থাকতে হবে। এক্ষেত্রেনিজস্ব খেয়াল-খুশি আর মনগড়া ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান যোগ্য।
চতুর্থত:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো মুহররম মাসে দশ তারিখে রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তিনি তো মিলাদ করতে বলেননি। কিংবা ঈদে মিলাদুন্নবি তথা তাঁর জন্মোৎসব পালন করতে বলেননি। কিংবানিজেও কখনও করেননি।
মিলাদে যদি কোন উপকার থাকত তবে অবশ্যই তিনি তাঁর উম্মতকে স্পষ্টভাবে তা পালন করার কথা বলে যেতেন। কারণ, দুনিয়া-আখিরাতের এমন কোন কল্যাণকর দিক নেই যা তিনি তার উম্মতকে বলে দেননি কিংবা এমন কোন ক্ষতিকর দিক নেই যে ব্যাপারে সাবধান করেননি। বরং তিনি দীনের ভিতর নতুন নতুন বিদআত তৈরি করার ব্যাপারে কঠিন ভাবে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন,
وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ
“দীনের মধ্যে নতুন সৃষ্ট বিষয়াদি থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত বিষয়ই গোমরাহি।[5]
তিনি বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দেওয়ার শুরুতে বলতেন:
أَمَّا بَعْدُ: فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
“অতঃপর, সর্বোত্তম বাণী হল আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তমনির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরনির্দেশনা। সব চেয়েনিকৃষ্ট জিনিস হল দীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়াদি। আর প্রতিটি নতুন বিষয়ই ভ্রষ্টতা।[6]
দ্বিতীয় সংশয়:
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃকনিজের আকিকানিজেই করার হাদিস থেকে মিলাদের পক্ষে দলিল আবিষ্কার!!
ইমাম সুয়ুতি আরও বলেন, মিলাদের স্বপক্ষে ইমাম ইবনে হাজার রা. এর উপরোক্ত দলিল ছাড়াও আমি আরেকটি দলিল বের করেছি। আর তা হল,
সুনান বায়হাকিতে আনাস রা. হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পরনিজেইনিজের আকিকা দিয়েছেন। যদিও তাঁর দাদা আব্দুল মোত্তালেব জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর আকিকা দিয়েছিলেন। আর আকিকা তো একাধিক বার দেওয়া যায় না। তাই বিষয়টার তাৎপর্য এভাবে গ্রহণ করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা যেহেতু তাকে জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেছেন তার কৃতজ্ঞতা আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি আকিকা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনিনিজেইনিজের নামে দরুদ ও সালাম পেশ করতেন।
সুতরাং রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস উপলক্ষে আমাদের কর্তব্য হল, সম্মিলিতভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়, ভোজ সভার আয়োজন সহ আরও বিভিন্ন নেক কাজ আঞ্জাম দেওয়া এবং আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করা।[7]
উক্ত সংশয়ের জবাব: প্রথম কথা হল, রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃকনিজেইনিজের আকিকা দেওয়ার হাদিসটি মুহাদ্দিসগণেরনিকট সনদগতভাবে প্রমাণিত নয়।
নিম্নে মুহাদ্দিসগণের মতামত তুলে ধরা হল:
১. আব্দুর রাজ্জাক রহ. তার মুসান্নাফ কিতাবে বলেন, আমাদেরনিকট আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাররার হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কাতাদা থেকে। কাতাদা বর্ণনা করেছেন আনাস থেকে। তিনি বলেন, “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়তের পরেনিজেইনিজের আকিকা দিয়েছেন।”
ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া এ হাদিসটি আব্দুর রাজ্জাক-এর বরাতে উল্লেখ করে বলেন, “আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করার কারণে ইবনে মুহাররারকে বর্জন করেছেন।” [8]
২. হাফেজ ইবনে হাজার রহ. ফাত্হুল বারীতে উল্লেখ করেছেন, উক্ত হাদিসটি প্রমাণিত নয় এবং তিনি হাদিসটি ইমাম বাজ্জারের দিকে সম্বন্ধ করে বল , ইমাম বাযযার বলেছেন, “এ হাদিসটি আব্দুল্লাহ মুহারারারের একক বর্ণনা। কিন্তু তিনি দুর্বল।[9]
৩. ইমাম নওয়াবি আল মুহাযযাব কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থ আল মাজমু কিতাবে বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরনিজের আকিকা করার ব্যাপারে গ্রন্থকার যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তা আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। কাতাদা আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়তের পরনিজেনিজের আকিকা দিয়েছেন। কিন্তু এ হাদিসটি বাতিল। হাদিসের সনদে উল্লেখিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাররার সর্বসম্মত ভাবে দুর্বল রাবী (বর্ণনাকারী)। হাফেজ ইবনে হাজার তাকে مَتْرُوْكٌ বা পরিত্যক্ত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ ভালো জানেন।[10]
৪. ইমাম জাহাবি মিজানুল ইতিদাল গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার-এর জীবনী লিখেছেন এবং তার ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. এর মন্তব্য উল্লেখ করার পর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তিনি একজন পরিত্যক্ত এবং অনির্ভর যোগ্য বর্ণনাকারী। তিনি আরও বলেন, আনাস রা. থেকে কাতাদা কর্তৃক “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবি হওয়ার পরনিজেনিজের আকিকা করেছেন” মর্মে বর্ণিত হাদিসটি তার অন্যতম একটি সমস্যাপূর্ণ বিষয়।[11]
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল