ভূমিকা :
চোখ বন্ধ করে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়া, দলীল ও প্রমাণ ব্যতীত নবী ছাড়া অন্য কারো কথা মানাকে (এবং সেটাকে নিজের উপর আবশ্যিক মনে করাকে) তাক্বলীদ (মুত্বলাক বা নিঃশর্ত তাক্বলীদ) বলা হয়।
তাক্বলীদের একটি প্রকার হ’ল তাক্বলীদে শাখছী। যাতে মুক্বাল্লিদ প্রকারান্তরে (আমলের ক্ষেত্রে) এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, ‘মুসলমানদের উপর চার ইমামের (মালেক, শাফেঈ, আহমাদ ও আবূ হানীফা) মধ্য থেকে শুধুমাত্র একজন ইমামের (যেমন- পাক-ভারতে ইমাম আবূ হানীফার) (দলীলবিহীন এবং ইজতিহাদী রায়সমূহের) তাক্বলীদ ওয়াজিব। আর অবশিষ্ট তিন ইমামের তাক্বলীদ হারাম’।
তাক্বলীদের এ দু’টি প্রকার[1] বাতিল এবং প্রত্যাখ্যাত। যেমনটি কুরআন, হাদীস, ইজমা ও সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা প্রমাণিত।
সম্মানিত শিক্ষক হাফেয যুবায়ের আলী যাঈ তাক্বলীদের (শাখছী এবং গায়ের শাখছী) খন্ডনে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেন, ‘আল-হাদীস’ (হাযারো) পত্রিকায় পাঁচ কিস্তিতে যেটিকে প্রকাশ করা হয়েছিল (সংখ্যা ৮-১২)।
এখন সকলের উপকারের জন্য উক্ত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধটিকে সামান্য সংশোধন ও সংযোজন সহ সাধারণ মুসলমানদের কল্যাণের নিমিত্তে প্রকাশ করা হ’ল।
আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন নিজ অনুগ্রহে মানুষদেরকে তাক্বলীদের অন্ধকার থেকে বের করে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন, হাদীস ও ইজমার উপর পরিচালিত করেন-আমীন!
‘আল্লাহ সকল বস্ত্তর উপর ক্ষমতাবান’ (মায়েদাহ ৫/৪০)।
সতর্কীকরণ : আহলেহাদীস-এর (মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ) তাক্বলীদপন্থীদের (যেমন-দেওবন্দী, ব্রেলভী ও তাদের মত অন্য লোকদের) সাথে ঈমান, আক্বীদা এবং উছূলের পর একটি মৌলিক মতপার্থক্য হ’ল তাক্বলীদে শাখছী বিষয়ে। তাক্বলীদপন্থী আলেমগণ এই মৌলিক মতভেদপূর্ণ বিষয়টি থেকে পালানোর পথ বেছে নিতে গিয়ে চতুরতার সাথে তাক্বলীদে মুত্বলাকের উপর আলোচনা-পর্যালোচনা ও বাহাছ-মুনাযারা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কখনো তাক্বলীদে শাখছী বিষয়ে আলোচনা-বিতর্ক এবং তাহক্বীক্বের জন্য প্রস্ত্তত হন না। আশরাফ আলী থানবী ছাহেব যার পা ধোয়া পানি পান করা (দেওবন্দীদের নিকটে) আখেরাতে নাজাতের কারণ।[2] বলেছেন, ‘কিন্তু তাক্বলীদে শাখছীর উপর তো কখনো ইজমাও হয়নি’।[3]
তাক্বলীদে শাখছী সম্পর্কে মুহাম্মাদ তাক্বী ওছমানী দেওবন্দী ছাহেব লিখেছেন, ‘এটি কোন শারঈ বিধান ছিল না। বরং একটি ইনতেযামী ফৎওয়া ছিল’।[4]
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হ’ল, এই শরী‘আত বিবর্জিত বিধানকে ঐ লোকগুলি নিজেদের উপরে ওয়াজিব আখ্যা দিয়েছেন এবং কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থেকেছেন।
আহমাদ ইয়ার না‘ঈমী (ব্রেলভী) লিখেছেন, ‘শরী‘আত ও তরীকত দু’টিরই চার চারটি সিলসিলা অর্থাৎ হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী। এভাবে কাদেরী, চিশতী, নকশবন্দী, সাহরাওয়ার্দী। এ সকল সিলসিলা একেবারেই বিদ‘আত’।[5]
দুঃখের বিষয় এসব লোক নিজেদের বিদ‘আতী হওয়া স্বীকার করা সত্ত্বেও বিদ‘আতকে ভাগ করে কিছু বিদ‘আতকে নিজের বুকের উপরে সাজিয়ে বসে আছেন।
এক্ষণে তাক্বলীদ (শাখছী ও গায়ের শাখছী) বিষয়ে দলীলভিত্তিক বিস্তারিত খন্ডনের জন্য এ গ্রন্থটি ‘দ্বীন (ইসলাম) মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা’ অধ্যয়ন শুরু করুন। অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ।
-ফযলে আকবর কাশ্মীরী (১৩ই রবীঊল আউয়াল ১৪২৭ হিঃ)।
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান :
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হেŠক তাঁর বিশ্বস্ত রাসূলের উপর। অতঃপর আহলেহাদীস ও তাক্বলীদপন্থীদের মাঝে একটি মৌলিক মতভেদ পূর্ণ বিষয় হ’ল তাক্বলীদ। এই প্রবন্ধে (গ্রন্থে) তাক্বলীদের মাসআলার পর্যালোচনা এবং শেষে মাস্টার মুহাম্মাদ আমীন উকাড়বী দেওবন্দী ছাহেবের সংশয় ও ভুল-ভ্রান্তিগুলোর জবাব পেশ করা হ’ল।
তাক্বলীদের উপর আলোচনা করার পূর্বে এর অন্তর্নিহিত মর্ম জানা অত্যন্ত যরূরী।
তাক্বলীদের আভিধানিক অর্থ :
একটি প্রসিদ্ধ অভিধান গ্রন্থ ‘আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব’-এ লিখিত আছে,
‘সে অমুক ব্যক্তির তাক্বলীদ করল : দলীল এবং প্রমাণ ছাড়া তার কথা বা কাজের আনুগত্য করল’।[6]
দেওবন্দীদের নির্ভরযোগ্য অভিধান গ্রন্থ ‘আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ’-এ লিখিত আছে- فلانا...قلد ‘তাক্বলীদ করা, বিনা দলীলে অনুসরণ করা, চোখ বন্ধ করে কারো পিছনে চলা’।[7]
التقليد : ‘চিন্তা-ভাবনা না করে বা বিনা দলীলে (১) অনুসরণ (২) অনুকরণ (৩) সোপর্দকরণ’।[8]
‘মিছবাহুল লুগাত’ (পৃঃ ৭০১) গ্রন্থে লিখিত আছে, وقلده فى كذا ‘চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সে তার অমুক কথার অনুসরণ করেছে’।
খ্রিষ্টানদের ‘আল-মুনজিদ’ অভিধানে আছে, قلده فى كذا ‘কোন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কারো অনুসরণ করা’।[9]
‘হাসানুল লুগাত (জামে‘) ফারসী-উর্দূ’ অভিধানে লিখিত আছে, ‘বিনা দলীলে কারো অনুসরণ করা’।[10]
‘জামে‘উল লুগাত’ (উর্দূ) অভিধানে আছে, ‘তাক্বলীদ : আনুগত্য করা, পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তদন্ত ছাড়াই কারো অনুসরণ করা’।[11]
অভিধানের এ সকল সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাসমূহের সংক্ষিপ্তসার এই যে, (দ্বীনের মধ্যে) চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই চোখ বন্ধ করে, দলীল-প্রমাণ ব্যতীত এবং চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কোন ব্যক্তির (যিনি নবী নন) অনুসরণ ও আনুগত্য করাকে তাক্বলীদ বলা হয়।
জ্ঞাতব্য : অভিধানে তাক্বলীদের আরো অর্থ আছে। তবে দ্বীনের মধ্যে তাক্বলীদের এটাই মর্ম, যা উপরে বর্ণনা করা হ’ল।
তাক্বলীদের পারিভাষিক অর্থ :
হানাফীদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘মুসাল্লামুছ ছুবূত’-এ লিখিত আছে,
‘তাক্বলীদ : (নবী ব্যতীত) অন্য কারো কথার উপর দলীল-প্রমাণ ছাড়া আমল করা। যেমন সাধারণ মানুষ (মূর্খ) তার মত আরেকজনের এবং মুজতাহিদের তার মত আরেকজন মুজতাহিদের কথাকে গ্রহণ করা। তবে নবী করীম (ﷺ) বা ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এই (তাক্বলীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা (তাক্বলীদ নয়)। কেননা দলীল এ দু’টিকে ওয়াজিব করেছে। কিন্তু প্রচলিত আছে যে, সাধারণ মানুষ মুজতাহিদের মুক্বাল্লিদ। ইমাম (শাফেঈ মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত) ইমামুল হারামাইন বলেছেন, ‘এই (সংজ্ঞার) উপরেই অধিকাংশ উছূলবিদ (একমত) আছেন’।[12]
হানাফীদের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ ‘ফাওয়াতিহুর রাহমূত’-এর মধ্যে লিখিত আছে,
‘(অনুচ্ছেদ : নবী ব্যতীত অন্য কারো কথার উপর দলীল ছাড়া আমল করাকে তাক্বলীদ বলে)। এটি আমলের সাথে সম্পৃক্ত। আর হুজ্জাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল চারটি দলীলের একটি। নতুবা মুজতাহিদের বক্তব্য তার (সাধারণ মানুষ) জন্য দলীল ও হুজ্জাত। যেমন সাধারণ মানুষের মুজতাহিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা এবং মুজতাহিদের তার মত অন্য আরেকজন মুজতাহিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা। আর নবী করীম (ﷺ) এবং ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা এটি দলীলের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়। যদিও পরবর্তীগণ এই আমলকে তাক্বলীদ বলেছেন। কিন্তু এই (তাক্বলীদ না হওয়া আমল)-এর আবশ্যকতা দলীল দ্বারা প্রমাণিত আছে। এজন্য এটি দলীলের উপর আমল, নবী ব্যতীত অন্যের কথার উপর আমল নয়। কিন্তু ‘উরফ’ (সামাজিক প্রথা) নির্দেশ করেছে যে, সাধারণ মানুষ মুজতাহিদের দিকে প্রত্যাবর্তন করার কারণে তারা মুক্বাল্লিদ হয়। ইমামুল হারামাইন বলেছেন, এর উপর অধিকাংশ উছূলবিদ রয়েছেন (যে এটি তাক্বলীদ নয়)। আর এটি প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য অভিমত’।[13]
কামাল ইবনুল হুমাম হানাফী (মৃঃ ৮৬১ হিঃ) লিখেছেন,
‘তাক্বলীদের মাসআলা : ঐ ব্যক্তির কথার উপর দলীলবিহীন আমল করাকে তাক্বলীদ বলে, যার কথা (চারটি) দলীলের মধ্য হ’তে একটি নয়। সুতরাং নবী করীম (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[14]
এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনু আমীর আল-হাজ্জ (হানাফী, মৃঃ ৮৭৯ হিঃ) লিখেছেন,
(আত-তাক্বরীর ওয়াত-তাহবীর ফী ইলমিল উছূল ৩/৪৫৩, ৪৫৪)।
[জ্ঞাতব্য : এ বক্তব্যের সারমর্মও ওটাই, যা পূর্বের উদ্ধৃতিতে আছে। অর্থাৎ নবী করীম (ﷺ)-এর দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়।]
ক্বাযী মুহাম্মাদ আ‘লা থানবী হানাফী (মৃঃ ১১৯১ হিঃ) লিখেছেন,
(কাশ্শাফু ইছতিলাহাতিল ফুনূন ২/১১৭৮)।
[জ্ঞাতব্য : এ বক্তব্যেরও সারমর্ম এটাই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুজতাহিদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং বিচারকের সাক্ষীদের সাক্ষীর ভিত্তিতে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়।]
আলী বিন মুহাম্মাদ বিন আলী আল-জুরজানী হানাফী (মৃঃ ৮১৬ হিঃ) বলেছেন,
‘তাক্বলীদ হ’ল (নবী ব্যতীত) অন্য কারো কথাকে দলীল ও প্রমাণ ছাড়া গ্রহণ করা’।[15]
মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান ঈদ আল-মাহলাবী হানাফী বলেছেন,
[জ্ঞাতব্য : এই ভাষ্যেরও এটাই মর্ম যে, রাসূল (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং বিচারকের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়।]
মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ আল-আস‘আদী বলেছেন,
তাক্বলীদ (ক) সংজ্ঞা :
(১) আভিধানিক অর্থ : গলায় কোন বস্ত্ত পরা। (২) পারিভাষিক অর্থ : বিনা দলীলে কারো কথাকে মেনে নেয়া।
তাক্বলীদের প্রকৃত স্বরূপ এটাই। কিন্তু ফক্বীহদের নিকটে এর মর্ম হ’ল ‘কোন মুজতাহিদের সকল বা অধিকাংশ মূলনীতি ও কায়েদাসমূহ অথবা সম্পূর্ণ বা অধিকাংশ আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতি নিজেকে অনুগত করে নেয়া’।[17]
ক্বারী চান মুহাম্মাদ দেওবন্দী লিখেছেন, ‘আর দলীল ছাড়া কোন কথাকে মেনে নেয়াই হ’ল তাক্বলীদ। অর্থাৎ বিনা দলীলে কোন কথার অনুসরণ করা ও মেনে নেয়া এটাই হ’ল তাক্বলীদ’।[18]
মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘কেননা কারো কথার দলীল জানা ব্যতীত তা গ্রহণ করার নাম তাক্বলীদ। আলেমগণ বলেছেন যে, এই সংজ্ঞার আলোকে ইমামের কথাকে দলীল জেনে গ্রহণ করা তাক্বলীদ থেকে বের হয়ে গেছে। কেননা তা তাক্বলীদ নয়; বরং দলীল দ্বারা মাসআলা গ্রহণ করা, মুজতাহিদের নিকট থেকে মাসআলা গ্রহণ করা নয়’।[19]
আশরাফ আলী থানবী দেওবন্দীর ‘মালফূযাত’ গ্রন্থে লিখিত আছে, ‘এক ভদ্রলোক জানতে চান যে, তাক্বলীদের স্বরূপ কি? তাক্বলীদ কাকে বলে? তিনি বললেন, দলীল ছাড়া উম্মতের কারো কথা মানাকে তাক্বলীদ বলে। তিনি আরয করলেন যে, আল্লাহ ও রাসূলের কথা মানাকেও কি তাক্বলীদ বলা হবে? (থানবী) বললেন, আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মানাকে তাক্বলীদ বলা হবে না। একে ইত্তিবা বলা হয়’।[20]
সরফরায খান ছফদর দেওবন্দী গাখড়ুবী লিখেছেন, ‘এই বাক্য দ্বারা স্পষ্ট হ’ল যে, পারিভাষিকভাবে তাক্বলীদের মর্ম এই যে, যার কথা হুজ্জাত (দলীল) নয় তার কথার উপর আমল করা। যেমন- সাধারণ মানুষের জাহেলের কথা এবং মুজতাহিদের অন্য মুজতাহিদের কথা গ্রহণ করা, যা হুজ্জাত (প্রমাণ) নয়। এর বিপরীত হ’ল, রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশের দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়। কেননা তাঁর নির্দেশ তো দলীল। আর এভাবে ইজমাও দলীল এবং একইভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ ‘তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (নাহল ১৬/৪৩) আয়াতটির আলোকে ওয়াজিব। আর এভাবেই বিচারকের مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ ‘তাদের মধ্য হ’তে যাদের সাক্ষ্যে তোমরা সন্তুষ্ট থাকো’ (বাক্বারাহ ২/২৮২) ও يَحْكُمُ بِهِ ذَوا عَدْلٍ مِنْكُمْ ‘আর সমান নির্ধারণের বিষয়টি ফায়ছালা করবে তোমাদের মধ্যকার দু’জন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি’ (মায়েদাহ ৫/৯৫) দলীলগুলোর আলোকে ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীদের দিকে রুজূ করাও তাক্বলীদ নয়। কেননা শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে তার
কথা দলীল’।[21]
মুফতী আহমাদ ইয়ার না‘ঈমী ব্রেলভী লিখেছেন, ‘মুসাল্লামুছ ছুবূত গ্রন্থে আছে- الْعَمَلُ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ التَّقْلِيدُ অনুবাদ সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। এই সংজ্ঞা দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, হুযূর (আঃ)-এর অনুসরণ করাকে তাক্বলীদ বলা যাবে না। কেননা তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজ শারঈ দলীল। তাক্বলীদের মধ্যে শারঈ দলীলকে না দেখার প্রবণতা থাকে। সুতরাং আমাদেরকে হুযূর (আঃ)-এর উম্মত বলা হবে, মুক্বাল্লিদ নয়। একইভাবে সাহাবায়ে কেরাম এবং আইম্মায়ে দ্বীন হুযূর (আঃ)-এর উম্মত, মুক্বাল্লিদ নন। এভাবে আলেমের আনুগত্য যা সাধারণ মুসলমান করে থাকে, তাকেও তাক্বলীদ বলা যাবে না। কেননা কেউই ঐ আলেমদের কথা বা তাদের কাজকে নিজের জন্য হুজ্জাত বানায় না। বরং এটা মনে করে তাদের কথা মানে যে, আলেম মানুষ। বই দেখে বলে থাকবেন হয়ত’।[22]
গোলাম রাসূল সাঈদী ব্রেলভী লিখেছেন, ‘তাক্বলীদের অর্থ হ’ল দলীলসমূহ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কোন ইমামের কথার উপর আমল করা। আর ইত্তিবা দ্বারা এটা উদ্দেশ্য যে, কোন ইমামের কথাকে কিতাব ও সুন্নাতের অনুকূলে পেয়ে এবং শারঈ দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত জেনে সেই কথাকে অগ্রাধিকার দেয়া’।[23]
সাঈদী ছাহেব আরো লিখেছেন, ‘শায়খ আবূ ইসহাক্ব বলেছেন, দলীল ছাড়া কথা গ্রহণ করা এবং তার উপর আমল করা তাক্বলীদ...। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা মুজতাহিদগণের ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা বা সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা বা বিচারকের সাক্ষীদের বক্তব্যের আলোকে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়’।[24]
সাঈদী ছাহেব আরো লিখেছেন, ‘ইমাম গাযালী লিখেছেন যে,
‘তাক্বলীদ হ’ল বিনা দলীলে কারো কথাকে গ্রহণ করা’।[25]
সাঈদী ছাহেব লিখছেন, ‘তাক্বলীদের যতগুলি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে এই কথা শামিল আছে যে, দলীল জানা ব্যতিরেকে কারো কথার উপর আমল করা তাক্বলীদ’।[26]
সরফরায খান ছফদর দেওবন্দী লিখেছেন, ‘আর এটি সর্বসম্মত কথা যে, ইক্তিদা ও ইত্তিবা এক জিনিস আর তাক্বলীদ অন্য জিনিস’।[27]
জ্ঞাতব্য : এই সর্বসম্মত কথার বিপরীতে সরফরায খান ছফদর ছাহেব নিজেই লিখেছেন যে, ‘তাক্বলীদ ও ইত্তিবা একই জিনিস’।[28] এতে বুঝা গেল যে, বৈপরীত্য ও বিরোধিতার উপত্যকায় সরফরায খান ছাহেব নিমজ্জিত আছেন।
সারকথা : হানাফী, দেওবন্দী ও ব্রেলভীদের উক্ত সংজ্ঞাগুলি ও ব্যাখ্যাসমূহ হ’তে প্রমাণিত হ’ল-
(১) চোখ বন্ধ করে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, দলীল ও প্রমাণ ব্যতিরেকে নবী ব্যতীত অন্য কারো কথা মানার নাম তাক্বলীদ।
(২) কুরআন, হাদীস ও ইজমার উপর আমল করা তাক্বলীদ নয়। আলেমের নিকট থেকে মূর্খের মাসআলা জিজ্ঞাসা করা এবং বিচারকের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়।
(৩) তাক্বলীদ ও দলীল অনুসরণের (اتباع بالدليل) মাঝে পার্থক্য রয়েছে।
খত্বীব বাগদাদী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,
‘মোটকথা তাক্বলীদ হ’ল দলীল ছাড়া কারো কোন কথা মেনে নেওয়া’।[29]
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) লিখেছেন,
‘আবূ আব্দুল্লাহ বিন খুয়াইয মিনদাদ আল-বাছরী আল-মালেকী বলেছেন, শরী‘আতে তাক্বলীদের অর্থ হ’ল এমন কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, যে কথার কথকের কাছে এর কোন দলীল নেই। এটি শরী‘আতে নিষিদ্ধ। আর ইত্তিবা হ’ল যার উপর দলীল সাব্যস্ত হয়েছে’।[30]
জ্ঞাতব্য : সরফরায খান ছফদর দেওবন্দী ‘আদ-দীবাজুল মুযাহ্হাব’ গ্রন্থ থেকে ইবনু খুয়াইয মিনদাদ (মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ, মৃঃ সম্ভবত ৩৯০ হিঃ) সম্পর্কে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করেছেন।[31]
নিবেদন হ’ল যে, ইবনু খুয়াইয মিনদাদ এই কথায় একক ব্যক্তি নন। বরং হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম এবং আল্লামা সৈয়ূত্বী তার অনুকূলে রয়েছেন। তাঁরা তার উক্তিকে সমালোচনা ছাড়াই বর্ণনা করেছেন। এমনকি সরফরায খান ছফদর তার একটি বক্তব্যে ইবনু খুয়াইয মিনদাদের অনুকূলে আছেন।[32]
দ্বিতীয় এই যে, উপরোল্লিখিত ইবনু খুয়াইয মিনদাদের উপর কড়া সমালোচনা নেই। বরং
প্রভৃতি শব্দাবলী আছে।[33]
আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী ও ইবনু আব্দিল বার্র-এর সমালোচনাও সুস্পষ্ট নয়।[34]
ইবনু খুয়াইয মিনদাদের জীবনী নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহেও আছে, শীরাযীর ‘ত্বাবাক্বাতুল ফুক্বাহা’ (পৃঃ ১৬৮), ক্বাযী ইয়াযের ‘তারতীবুল মাদারিক’ (৪/৬০৬), ‘মু‘জামুল মুওয়াল্লিফীন’ (৩/৭৫)।
হানাফী, ব্রেলভী ও দেওবন্দী আলেমগণ এমন ব্যক্তিদের বক্তব্য পেশ করে থাকেন, যাদের ন্যায়পরায়ণতা ও ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অনেক মুহাদ্দিছের কঠোর সমালোচনা রয়েছে। যেমন- (১) ক্বাযী আবু ইউসুফ। (২) মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী। (৩) হাসান বিন যিয়াদ আল-লুলুঈ। (৪) আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়া‘কূব আল-হারেছী প্রমুখ (দ্রঃ মীযানুল ই‘তিদাল; লিসানুল মীযান প্রভৃতি)।
জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাহল্লী আশ-শাফেঈ (মৃঃ ৮৬৪ হিঃ) বলেছেন, والتقليد قبُول قَول الْقَائِل بِلَا حجَّة
‘তাক্বলীদ হ’ল প্রমাণ ছাড়া কারো কোন কথা গ্রহণ করা। তবে নবী করীম (ﷺ)-এর কথা গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলা হয় না’।[35]
ইবনুল হাজেব আন-নাহবী আল-মালেকী (মৃঃ ৬৪৬ হিঃ) বলেছেন,
‘সুতরাং তাক্বলীদ হ’ল, দলীল ছাড়া অন্যের কথার উপর আমল করা। আর নবী করীম (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয় দলীল সাব্যস্ত থাকার কারণে। আর (এই) নামের ব্যাপারে
কোনই বিবাদ নেই’।[36]
আলী বিন মুহাম্মাদ আল-আমেদী আশ-শাফেঈ (মৃঃ ৬৩১ হিঃ) বলেছেন,
‘তাক্বলীদ হ’ল, অন্যের কথার উপর আবশ্যকীয় দলীল ব্যতিরেকে আমল করা...। সুতরাং নবী করীম (ﷺ)-এর কথা এবং সমকালীন মুজতাহিদগণের ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, সাধারণ মানুষের মুফতীর কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচারকের ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়’।[37]
আবূ হামিদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-গাযালী (মৃঃ ৫০৫ হিঃ) বলেছেন,
‘বিনা দলীলে কারো কোন কথা গ্রহণ করাই হ’ল তাক্বলীদ’।[38]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম বলেছেন,
‘আর যা দলীল ব্যতীত হবে তাই তাক্বলীদ’।[39]
আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ হাম্বলী বলেছেন,
‘আর ফক্বীহদের নিকটে এটা (তাক্বলীদ) হ’ল বিনা দলীলে কারো কথা গ্রহণ করা। এই অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী করীম (ﷺ)-এর কথা এবং ইজমাকে গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলা হয় না’।[40]
ইবনু হাযম আন্দালুসী আয-যাহেরী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেছেন,
‘কেননা প্রকৃতপক্ষে তাক্বলীদ হ’ল নবী করীম (ﷺ) ছাড়া অন্য কারো কথাকে দলীল ছাড়াই গ্রহণ করা। আর এটির নাম তাক্বলীদ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। আর এটি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীল কায়েম আছে’।[41]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ) বলেছেন,
‘কতিপয় ইমাম এ থেকে (এই মাসআলাকে) আলাদা করেছেন। কেননা তাক্বলীদ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, দলীল ছাড়া অন্যের কথা গ্রহণ করা। আর তার উপর নবুঅতের প্রমাণের সাথে সাথে দলীল কায়েম হয়ে যায়। এমনকি তার দৃঢ় বিশ্বাস এসে যায়। সুতরাং সে নবী করীম (ﷺ) থেকে যা শ্রবণ করেছে তার কাছে তা নিশ্চিতরূপে সত্য। যখন সে এ আক্বীদা পোষণ করবে তখন সে মুক্বাল্লিদ নয়। কেননা সে অন্যের কথাকে দলীল ছাড়া গ্রহণ করেনি। আর এটাই সকল সালাফে ছালেহীনের পুরাপুরি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি যে, এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীস থেকে যা তাদের নিকটে প্রতীয়মান হয়েছে তা গ্রহণ করা। ফলে তারা ‘মুহকামাত’ (কুরআনের সুস্পষ্ট হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত আয়াতসমূহ)-এর উপর ঈমান এনেছেন এবং ‘মুতাশাবিহাত’ (যার মর্মার্থ অস্পষ্ট)-এর বিষয়টি তাদের প্রতিপালকের নিকট সোপর্দ করে দিয়েছেন (যে তিনিই এর অর্থ ভাল জানেন)।[42]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) লিখেছেন,
‘আলেমদের ঐক্যমত অনুযায়ী তাক্বলীদ কোন ইলম নয়’।[43]
সারকথা : হানাফী, দেওবন্দী, ব্রেলভী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী, যাহেরী এবং হাদীসের ভাষ্যকারগণের উক্ত সংজ্ঞাগুলি থেকে প্রতীয়মান হ’ল, তাক্বলীদের মর্ম এটাই যে, দলীল ও প্রমাণ বিহীন বক্তব্যকে (চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, অন্ধের মত) মেনে নেয়া।
[1]. তাক্বলীদ দুই প্রকার (১) তাক্বলীদে শাখছী (২) তাক্বলীদে মুত্বলাক্ব তথা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির তাক্বলীদের পরিবর্তে একেক মাসআলায় একেকজন ইমামের তাক্বলীদ করা। তাক্বলীদে মুত্বলাক্ব এবং তাক্বলীদে গায়ের শাখছী একই জিনিস। নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির তাক্বলীদ করাকে ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বলা হয়। -অনুবাদক।
[2]. তাযকিরাতুর রশীদ ১/১১৩ পৃঃ।
[3]. ঐ, ১/১৩১ পৃঃ।
[4]. তাক্বলীদ কী শারঈ হায়ছিয়াত (ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৪১৩ হিঃ), পৃঃ ৬৫।
[5]. জা-আল হক্ব (পুরাতন সংস্করণ) ১/২২২, ‘বিদ‘আতের প্রকারভেদ সমূহের পরিচয় ও আলামাত’।
[6]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : দারুদ দাওয়াহ, মুআস্সাসাহ ছাক্বাফিয়াহ), পৃঃ ৭৫৪।
[7]. আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ (লাহোর, করাচী : ইদারায়ে ইসলামিয়াত), পৃঃ ১৩৪৬।
[8]. ঐ।
[9]. আল-মুনজিদ (আরবী-উর্দূ) (করাচী : দারুল ইশা‘আত), পৃঃ ৮৩১।
[10]. হাসানুল লুগাত, পৃঃ ২১৬।
[11]. জামে‘উল লুগাত’ (উর্দূ), (করাচী : দারুল ইশা‘আত), পৃঃ ১৬৬।
[12]. মুসাল্লামুছ ছুবূত (ছাপা : ১৩১৬ হিঃ), পৃঃ ২৮৯; ফাওয়াতিহূর রাহমূত ২/৪০০।
[13]. ফাওয়াতিহূর রাহমূত বি-শারহি মুসাল্লামিছ ছুবূত ফী উছূলিল ফিক্বহ ২/৪০০।
[14]. তাহরীর ইবনে হুমাম ফী ইলমিল উছূল ৩/৪৫৩।
[15]. কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ২৯।
[16]. তাসহীলুল উছূল ইলা ইলমিল উছূল, পৃঃ ৩২৫।
[17]. উছূলুল ফিক্বহ, পৃঃ ২৬৭। এই গ্রন্থের উপর মুহাম্মাদ তাক্বী ওছমানী দেওবন্দী ছাহেব অভিমত লিখেছেন।
[18]. গায়ের মুক্বাল্লিদীন সে চান্দে মা‘রূযাত (হামীদ, আটোক : জমঈয়তে ইশা‘আতুত তাওহীদ ওয়াস-সুন্নাহ), পৃঃ ১, আরয-১।
[19]. আপ ফৎওয়া ক্যায়সে দেঁ, (করাচী : মাকতাবা নু‘মানিয়া), পৃঃ ৭৬।
[20]. আল-ইফাযাতুল ইয়াওমিয়াহ মিনাল ইফাদাতিল ক্বওমিয়াহ/ মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত ৩/১৫৯, বচন নং ২২৮।
[21]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ (ছাপা : ছফর ১৪১৩ হিঃ), পৃঃ ৩৫, ৩৬।
[22]. জা-আল হক্ব (পুরাতন সংস্করণ), ১/১৬।
[23]. শরহ সহীহ মুসলিম (লাহোর : ফরীদ বুক স্টল), ৫/৬৩।
[24]. ঐ, ৩/৩২৯।
[25]. ঐ, ৩/৩৩০।
[26]. ঐ।
[27]. আল-মিনহাজুল ওয়াযেহ ই‘য়ানী রাহে সুন্নাত (৯ম সংস্করণ, জুমাদাছ ছানিয়াহ, ১৩৯৫ হিঃ/জুন ১৯৭৫ইং), পৃঃ ৩৫।
[28]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ, পৃঃ ৩২।
[29]. আল-ফাক্বীহ ওয়াল-মুতাফাক্কিহ ২/৬৬।
[30]. জামে‘উ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহি ২/১১৭, অন্য সংস্করণ ২/১৪৩; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন ২/১৯৭; সুয়ূত্বী, আর-রদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয ওয়া জাহিলা আন্নাল ইজতিহাদা ফী কুল্লি আছরিন ফারয, পৃঃ ১২৩।
[31]. আল-কালামুল মুফীদ, পৃঃ ৩৩, ৩৪।
[32]. দ্রঃ রাহে সুন্নাত, পৃঃ ৩৫।
[33]. দ্রঃ আদ-দীবাজুল মুযাহ্হাব, পৃঃ ৩৬৩, জীবনী ক্রমিক নং ৪৯১; লিসানুল মীযান ৫/২৯১।
[34]. দ্রঃ যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ২৭/২১৭; ছাফাদী, আল-ওয়াফী বিল-অফায়াত ২/৩৯, জীবনী ক্রমিক নং ৩৩৯।
[35]. শারহুল ওয়ারাক্বাত ফী ইলমি উছূলিল ফিক্বহ, পৃঃ ১৪।
[36]. মুনহাতাল উছূল ওয়াল আমাল ফী ইলমাই আল-উছূল ওয়াল জাদল, পৃঃ ২১৮, ২১৯।
[37]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ৪/২২৭।
[38]. আল-মুসতাছফা মিন ইলমিল উছূল ২/৩৮৭।
[39]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ১/৭।
[40]. রাওযাতুন নাযির ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির ২/৪৫০।
[41]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ৬/২৬৯।
[42]. ফাৎহুল বারী ১৩/৩৫১, হা/৭৩৭২-এর আলোচনা দ্রঃ।
[43]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/১৮৮।
চোখ বন্ধ করে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়া, দলীল ও প্রমাণ ব্যতীত নবী ছাড়া অন্য কারো কথা মানাকে (এবং সেটাকে নিজের উপর আবশ্যিক মনে করাকে) তাক্বলীদ (মুত্বলাক বা নিঃশর্ত তাক্বলীদ) বলা হয়।
তাক্বলীদের একটি প্রকার হ’ল তাক্বলীদে শাখছী। যাতে মুক্বাল্লিদ প্রকারান্তরে (আমলের ক্ষেত্রে) এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, ‘মুসলমানদের উপর চার ইমামের (মালেক, শাফেঈ, আহমাদ ও আবূ হানীফা) মধ্য থেকে শুধুমাত্র একজন ইমামের (যেমন- পাক-ভারতে ইমাম আবূ হানীফার) (দলীলবিহীন এবং ইজতিহাদী রায়সমূহের) তাক্বলীদ ওয়াজিব। আর অবশিষ্ট তিন ইমামের তাক্বলীদ হারাম’।
তাক্বলীদের এ দু’টি প্রকার[1] বাতিল এবং প্রত্যাখ্যাত। যেমনটি কুরআন, হাদীস, ইজমা ও সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা প্রমাণিত।
সম্মানিত শিক্ষক হাফেয যুবায়ের আলী যাঈ তাক্বলীদের (শাখছী এবং গায়ের শাখছী) খন্ডনে একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেন, ‘আল-হাদীস’ (হাযারো) পত্রিকায় পাঁচ কিস্তিতে যেটিকে প্রকাশ করা হয়েছিল (সংখ্যা ৮-১২)।
এখন সকলের উপকারের জন্য উক্ত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধটিকে সামান্য সংশোধন ও সংযোজন সহ সাধারণ মুসলমানদের কল্যাণের নিমিত্তে প্রকাশ করা হ’ল।
আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন নিজ অনুগ্রহে মানুষদেরকে তাক্বলীদের অন্ধকার থেকে বের করে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন, হাদীস ও ইজমার উপর পরিচালিত করেন-আমীন!
وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘আল্লাহ সকল বস্ত্তর উপর ক্ষমতাবান’ (মায়েদাহ ৫/৪০)।
সতর্কীকরণ : আহলেহাদীস-এর (মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ) তাক্বলীদপন্থীদের (যেমন-দেওবন্দী, ব্রেলভী ও তাদের মত অন্য লোকদের) সাথে ঈমান, আক্বীদা এবং উছূলের পর একটি মৌলিক মতপার্থক্য হ’ল তাক্বলীদে শাখছী বিষয়ে। তাক্বলীদপন্থী আলেমগণ এই মৌলিক মতভেদপূর্ণ বিষয়টি থেকে পালানোর পথ বেছে নিতে গিয়ে চতুরতার সাথে তাক্বলীদে মুত্বলাকের উপর আলোচনা-পর্যালোচনা ও বাহাছ-মুনাযারা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কখনো তাক্বলীদে শাখছী বিষয়ে আলোচনা-বিতর্ক এবং তাহক্বীক্বের জন্য প্রস্ত্তত হন না। আশরাফ আলী থানবী ছাহেব যার পা ধোয়া পানি পান করা (দেওবন্দীদের নিকটে) আখেরাতে নাজাতের কারণ।[2] বলেছেন, ‘কিন্তু তাক্বলীদে শাখছীর উপর তো কখনো ইজমাও হয়নি’।[3]
তাক্বলীদে শাখছী সম্পর্কে মুহাম্মাদ তাক্বী ওছমানী দেওবন্দী ছাহেব লিখেছেন, ‘এটি কোন শারঈ বিধান ছিল না। বরং একটি ইনতেযামী ফৎওয়া ছিল’।[4]
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হ’ল, এই শরী‘আত বিবর্জিত বিধানকে ঐ লোকগুলি নিজেদের উপরে ওয়াজিব আখ্যা দিয়েছেন এবং কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থেকেছেন।
আহমাদ ইয়ার না‘ঈমী (ব্রেলভী) লিখেছেন, ‘শরী‘আত ও তরীকত দু’টিরই চার চারটি সিলসিলা অর্থাৎ হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী। এভাবে কাদেরী, চিশতী, নকশবন্দী, সাহরাওয়ার্দী। এ সকল সিলসিলা একেবারেই বিদ‘আত’।[5]
দুঃখের বিষয় এসব লোক নিজেদের বিদ‘আতী হওয়া স্বীকার করা সত্ত্বেও বিদ‘আতকে ভাগ করে কিছু বিদ‘আতকে নিজের বুকের উপরে সাজিয়ে বসে আছেন।
এক্ষণে তাক্বলীদ (শাখছী ও গায়ের শাখছী) বিষয়ে দলীলভিত্তিক বিস্তারিত খন্ডনের জন্য এ গ্রন্থটি ‘দ্বীন (ইসলাম) মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা’ অধ্যয়ন শুরু করুন। অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ।
-ফযলে আকবর কাশ্মীরী (১৩ই রবীঊল আউয়াল ১৪২৭ হিঃ)।
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান :
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হেŠক তাঁর বিশ্বস্ত রাসূলের উপর। অতঃপর আহলেহাদীস ও তাক্বলীদপন্থীদের মাঝে একটি মৌলিক মতভেদ পূর্ণ বিষয় হ’ল তাক্বলীদ। এই প্রবন্ধে (গ্রন্থে) তাক্বলীদের মাসআলার পর্যালোচনা এবং শেষে মাস্টার মুহাম্মাদ আমীন উকাড়বী দেওবন্দী ছাহেবের সংশয় ও ভুল-ভ্রান্তিগুলোর জবাব পেশ করা হ’ল।
তাক্বলীদের উপর আলোচনা করার পূর্বে এর অন্তর্নিহিত মর্ম জানা অত্যন্ত যরূরী।
তাক্বলীদের আভিধানিক অর্থ :
একটি প্রসিদ্ধ অভিধান গ্রন্থ ‘আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব’-এ লিখিত আছে,
وقلَّد فلانًا : اتَّبعه فيما يقول أو يفعل من غير حجة ولا دليل-
‘সে অমুক ব্যক্তির তাক্বলীদ করল : দলীল এবং প্রমাণ ছাড়া তার কথা বা কাজের আনুগত্য করল’।[6]
দেওবন্দীদের নির্ভরযোগ্য অভিধান গ্রন্থ ‘আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ’-এ লিখিত আছে- فلانا...قلد ‘তাক্বলীদ করা, বিনা দলীলে অনুসরণ করা, চোখ বন্ধ করে কারো পিছনে চলা’।[7]
التقليد : ‘চিন্তা-ভাবনা না করে বা বিনা দলীলে (১) অনুসরণ (২) অনুকরণ (৩) সোপর্দকরণ’।[8]
‘মিছবাহুল লুগাত’ (পৃঃ ৭০১) গ্রন্থে লিখিত আছে, وقلده فى كذا ‘চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সে তার অমুক কথার অনুসরণ করেছে’।
খ্রিষ্টানদের ‘আল-মুনজিদ’ অভিধানে আছে, قلده فى كذا ‘কোন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কারো অনুসরণ করা’।[9]
‘হাসানুল লুগাত (জামে‘) ফারসী-উর্দূ’ অভিধানে লিখিত আছে, ‘বিনা দলীলে কারো অনুসরণ করা’।[10]
‘জামে‘উল লুগাত’ (উর্দূ) অভিধানে আছে, ‘তাক্বলীদ : আনুগত্য করা, পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তদন্ত ছাড়াই কারো অনুসরণ করা’।[11]
অভিধানের এ সকল সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাসমূহের সংক্ষিপ্তসার এই যে, (দ্বীনের মধ্যে) চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই চোখ বন্ধ করে, দলীল-প্রমাণ ব্যতীত এবং চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কোন ব্যক্তির (যিনি নবী নন) অনুসরণ ও আনুগত্য করাকে তাক্বলীদ বলা হয়।
জ্ঞাতব্য : অভিধানে তাক্বলীদের আরো অর্থ আছে। তবে দ্বীনের মধ্যে তাক্বলীদের এটাই মর্ম, যা উপরে বর্ণনা করা হ’ল।
তাক্বলীদের পারিভাষিক অর্থ :
হানাফীদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘মুসাল্লামুছ ছুবূত’-এ লিখিত আছে,
التقليد : العمل بقول الغير من غير حجة كأخذ العامي والمجتهد من مثله، فالرجوع إلي النبي عليه الصلاة والسلام أو إلي الإجماع ليس منه وكذا العامي إلي المفتي والقاضي إلي العدول لإ يجاب النص ذلك عليهما لكن العرف علي أن العامي مقلد للمجتهد، قال الإمام : وعليه معظم الأصوليين-
‘তাক্বলীদ : (নবী ব্যতীত) অন্য কারো কথার উপর দলীল-প্রমাণ ছাড়া আমল করা। যেমন সাধারণ মানুষ (মূর্খ) তার মত আরেকজনের এবং মুজতাহিদের তার মত আরেকজন মুজতাহিদের কথাকে গ্রহণ করা। তবে নবী করীম (ﷺ) বা ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এই (তাক্বলীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা (তাক্বলীদ নয়)। কেননা দলীল এ দু’টিকে ওয়াজিব করেছে। কিন্তু প্রচলিত আছে যে, সাধারণ মানুষ মুজতাহিদের মুক্বাল্লিদ। ইমাম (শাফেঈ মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত) ইমামুল হারামাইন বলেছেন, ‘এই (সংজ্ঞার) উপরেই অধিকাংশ উছূলবিদ (একমত) আছেন’।[12]
হানাফীদের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ ‘ফাওয়াতিহুর রাহমূত’-এর মধ্যে লিখিত আছে,
(فصل: التقليد العمل بقول الغير من غير حجة) متعلق بالعمل والمراد بالجحة حجة من الحجج الأربع والا فقول المجتهد دليله وحجته (كأخذ العامي) من المجتهد (و) اخذ (المجتهد من مثله فالرجوع الي النبي عليه) وآله وأصحابه (الصلاة والسلام او الي الاجماع ليس منه) فإنه رجوع الي الدليل (وكذا) رجوع (العامي الي المفتي والقاضي الي العدول) ليس هذا الرجوع نفسه تقليدا، وان كان العمل بما أخذوا بعده تقليدا (لا يجاب النص ذلك عليهما) فهو عمل بحجة لا بقول الغير فقط (لكن العرف) دل (علي ان العامي مقلد للمجتهد) بالرجوع اليه. (قال الامام) امام الحرمين (وعليه معظم الاصوليين) وهو المشتهرالمعتمد عليه-
‘(অনুচ্ছেদ : নবী ব্যতীত অন্য কারো কথার উপর দলীল ছাড়া আমল করাকে তাক্বলীদ বলে)। এটি আমলের সাথে সম্পৃক্ত। আর হুজ্জাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল চারটি দলীলের একটি। নতুবা মুজতাহিদের বক্তব্য তার (সাধারণ মানুষ) জন্য দলীল ও হুজ্জাত। যেমন সাধারণ মানুষের মুজতাহিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা এবং মুজতাহিদের তার মত অন্য আরেকজন মুজতাহিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা। আর নবী করীম (ﷺ) এবং ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা এটি দলীলের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়। যদিও পরবর্তীগণ এই আমলকে তাক্বলীদ বলেছেন। কিন্তু এই (তাক্বলীদ না হওয়া আমল)-এর আবশ্যকতা দলীল দ্বারা প্রমাণিত আছে। এজন্য এটি দলীলের উপর আমল, নবী ব্যতীত অন্যের কথার উপর আমল নয়। কিন্তু ‘উরফ’ (সামাজিক প্রথা) নির্দেশ করেছে যে, সাধারণ মানুষ মুজতাহিদের দিকে প্রত্যাবর্তন করার কারণে তারা মুক্বাল্লিদ হয়। ইমামুল হারামাইন বলেছেন, এর উপর অধিকাংশ উছূলবিদ রয়েছেন (যে এটি তাক্বলীদ নয়)। আর এটি প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য অভিমত’।[13]
কামাল ইবনুল হুমাম হানাফী (মৃঃ ৮৬১ হিঃ) লিখেছেন,
مَسْأَلَةُ التَّقْلِيد الْعَمَلُ بِقَوْلِ مَنْ لَيْسَ قَوْلُهُ إحْدَى الْحُجَجِ بِلَا حُجَّةٍ مِنْهَا فَلَيْسَ الرُّجُوعُ إلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْإِجْمَاعُ مِنْهُ-
‘তাক্বলীদের মাসআলা : ঐ ব্যক্তির কথার উপর দলীলবিহীন আমল করাকে তাক্বলীদ বলে, যার কথা (চারটি) দলীলের মধ্য হ’তে একটি নয়। সুতরাং নবী করীম (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[14]
এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনু আমীর আল-হাজ্জ (হানাফী, মৃঃ ৮৭৯ হিঃ) লিখেছেন,
(مَسْأَلَةُ التَّقْلِيدِ الْعَمَلُ بِقَوْلِ مَنْ لَيْسَ قَوْلُهُ إحْدَى الْحُجَجِ) الْأَرْبَعِ الشَّرْعِيَّةِ (بِلَا حُجَّةٍ مِنْهَا فَلَيْسَ الرُّجُوعُ إلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْإِجْمَاعُ مِنْهُ) أَيْ مِنَ التَّقْلِيدِ عَلَى هَذَا؛ لِأَنَّ كُلًّا مِنْهُمَا حُجَّةٌ شَرْعِيَّةٌ مِنْ الْحُجَجِ الْأَرْبَعِ، وَكَذَا لَيْسَ مِنْهُ عَلَى هَذَا عَمَلُ الْعَامِّيِّ بِقَوْلِ الْمُفْتِي وَعَمَلُ الْقَاضِي بِقَوْلِ الْعُدُولِ؛ لِأَنَّ كُلًّا مِنْهُمَا، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ إحْدَى الْحُجَجِ فَلَيْسَ الْعَمَلُ بِهِ بِلَا حُجَّةٍ شَرْعِيَّةٍ لِإِيجَابِ النَّصِّ أَخْذَ الْعَامِّيِّ بِقَوْلِ الْمُفْتِي وَأَخْذَ الْقَاضِي بِقَوْلِ الْعُدُولِ-
(আত-তাক্বরীর ওয়াত-তাহবীর ফী ইলমিল উছূল ৩/৪৫৩, ৪৫৪)।
[জ্ঞাতব্য : এ বক্তব্যের সারমর্মও ওটাই, যা পূর্বের উদ্ধৃতিতে আছে। অর্থাৎ নবী করীম (ﷺ)-এর দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়।]
ক্বাযী মুহাম্মাদ আ‘লা থানবী হানাফী (মৃঃ ১১৯১ হিঃ) লিখেছেন,
التقليد... الثاني العمل بقول الغير من غير حجة واريد بالقول ما يعم الفعل والتقرير تغليبا ولذا قيل في بعض شروح الحسامي التقليد اتباع الانسان غيره فيما يقول أو يفعل معتقدا للحقية من غير نظر إلي الدليل كأن هذا المتبع جعل قول الغير أو فعله قلادة في عنقه من غير مطالبة دليل كأخذ العامى والمجتهد بقول مثله أي كأخذ العامى بقول العامي واخذ المجتهد بقول المجتهد وعلي هذا فلا يكون الرجوع إلي الرسول عليه الصلاة والسلام تقليدا له وكذا إلي الإجماع وكذا رجوع العامى إلي المفتي أي الي المجتهد وكذا رجوع القاضي إلي العدول في شهادتهم لقيام الحجة فيها فقول الرسول بالمعجزة والإجماع بما تقرر من حجته وقول الشاهد والمفتي بالاجماع...
(কাশ্শাফু ইছতিলাহাতিল ফুনূন ২/১১৭৮)।
[জ্ঞাতব্য : এ বক্তব্যেরও সারমর্ম এটাই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়। অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের মুজতাহিদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং বিচারকের সাক্ষীদের সাক্ষীর ভিত্তিতে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়।]
আলী বিন মুহাম্মাদ বিন আলী আল-জুরজানী হানাফী (মৃঃ ৮১৬ হিঃ) বলেছেন,
(التقليد) عبارة عن قبول قول الغير بلا حجة ولا دليل-
‘তাক্বলীদ হ’ল (নবী ব্যতীত) অন্য কারো কথাকে দলীল ও প্রমাণ ছাড়া গ্রহণ করা’।[15]
মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান ঈদ আল-মাহলাবী হানাফী বলেছেন,
التَّقْلِيدُ... وَفِي الِاصْطِلَاحِ: هُوَ الْعَمَلُ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ حُجَّة مِنَ الْحُجَجِ الْأَرْبَعِ فَيَخْرُجُ الْعَمَلُ بِقَوْلِ الرَّسُولِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْعَمَلُ بِالْإِجْمَاعِ لِأَنَّ كُلًّا مِنْهُمَا حُجَّةٌ وَخَرَجَ أَيْضًا رُجُوعُ الْقَاضِي إِلَى شَهَادَةِ الْعُدُولِ لِأَنَّ الدَّلِيلَ عَلَيْهِ مَا فِي الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ، مِنَ الْأَمْرِ بِالشَّهَادَةِ، وَالْعَمَلِ بِهَا، وَقَدْ وَقَعَ الْإِجْمَاعُ عَلَى ذَلِكَ.[16]
[জ্ঞাতব্য : এই ভাষ্যেরও এটাই মর্ম যে, রাসূল (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং বিচারকের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়।]
মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ আল-আস‘আদী বলেছেন,
তাক্বলীদ (ক) সংজ্ঞা :
(১) আভিধানিক অর্থ : গলায় কোন বস্ত্ত পরা। (২) পারিভাষিক অর্থ : বিনা দলীলে কারো কথাকে মেনে নেয়া।
তাক্বলীদের প্রকৃত স্বরূপ এটাই। কিন্তু ফক্বীহদের নিকটে এর মর্ম হ’ল ‘কোন মুজতাহিদের সকল বা অধিকাংশ মূলনীতি ও কায়েদাসমূহ অথবা সম্পূর্ণ বা অধিকাংশ আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতি নিজেকে অনুগত করে নেয়া’।[17]
ক্বারী চান মুহাম্মাদ দেওবন্দী লিখেছেন, ‘আর দলীল ছাড়া কোন কথাকে মেনে নেয়াই হ’ল তাক্বলীদ। অর্থাৎ বিনা দলীলে কোন কথার অনুসরণ করা ও মেনে নেয়া এটাই হ’ল তাক্বলীদ’।[18]
মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘কেননা কারো কথার দলীল জানা ব্যতীত তা গ্রহণ করার নাম তাক্বলীদ। আলেমগণ বলেছেন যে, এই সংজ্ঞার আলোকে ইমামের কথাকে দলীল জেনে গ্রহণ করা তাক্বলীদ থেকে বের হয়ে গেছে। কেননা তা তাক্বলীদ নয়; বরং দলীল দ্বারা মাসআলা গ্রহণ করা, মুজতাহিদের নিকট থেকে মাসআলা গ্রহণ করা নয়’।[19]
আশরাফ আলী থানবী দেওবন্দীর ‘মালফূযাত’ গ্রন্থে লিখিত আছে, ‘এক ভদ্রলোক জানতে চান যে, তাক্বলীদের স্বরূপ কি? তাক্বলীদ কাকে বলে? তিনি বললেন, দলীল ছাড়া উম্মতের কারো কথা মানাকে তাক্বলীদ বলে। তিনি আরয করলেন যে, আল্লাহ ও রাসূলের কথা মানাকেও কি তাক্বলীদ বলা হবে? (থানবী) বললেন, আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মানাকে তাক্বলীদ বলা হবে না। একে ইত্তিবা বলা হয়’।[20]
সরফরায খান ছফদর দেওবন্দী গাখড়ুবী লিখেছেন, ‘এই বাক্য দ্বারা স্পষ্ট হ’ল যে, পারিভাষিকভাবে তাক্বলীদের মর্ম এই যে, যার কথা হুজ্জাত (দলীল) নয় তার কথার উপর আমল করা। যেমন- সাধারণ মানুষের জাহেলের কথা এবং মুজতাহিদের অন্য মুজতাহিদের কথা গ্রহণ করা, যা হুজ্জাত (প্রমাণ) নয়। এর বিপরীত হ’ল, রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশের দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়। কেননা তাঁর নির্দেশ তো দলীল। আর এভাবে ইজমাও দলীল এবং একইভাবে সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ ‘তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (নাহল ১৬/৪৩) আয়াতটির আলোকে ওয়াজিব। আর এভাবেই বিচারকের مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ ‘তাদের মধ্য হ’তে যাদের সাক্ষ্যে তোমরা সন্তুষ্ট থাকো’ (বাক্বারাহ ২/২৮২) ও يَحْكُمُ بِهِ ذَوا عَدْلٍ مِنْكُمْ ‘আর সমান নির্ধারণের বিষয়টি ফায়ছালা করবে তোমাদের মধ্যকার দু’জন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি’ (মায়েদাহ ৫/৯৫) দলীলগুলোর আলোকে ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীদের দিকে রুজূ করাও তাক্বলীদ নয়। কেননা শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে তার
কথা দলীল’।[21]
মুফতী আহমাদ ইয়ার না‘ঈমী ব্রেলভী লিখেছেন, ‘মুসাল্লামুছ ছুবূত গ্রন্থে আছে- الْعَمَلُ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ التَّقْلِيدُ অনুবাদ সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। এই সংজ্ঞা দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, হুযূর (আঃ)-এর অনুসরণ করাকে তাক্বলীদ বলা যাবে না। কেননা তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজ শারঈ দলীল। তাক্বলীদের মধ্যে শারঈ দলীলকে না দেখার প্রবণতা থাকে। সুতরাং আমাদেরকে হুযূর (আঃ)-এর উম্মত বলা হবে, মুক্বাল্লিদ নয়। একইভাবে সাহাবায়ে কেরাম এবং আইম্মায়ে দ্বীন হুযূর (আঃ)-এর উম্মত, মুক্বাল্লিদ নন। এভাবে আলেমের আনুগত্য যা সাধারণ মুসলমান করে থাকে, তাকেও তাক্বলীদ বলা যাবে না। কেননা কেউই ঐ আলেমদের কথা বা তাদের কাজকে নিজের জন্য হুজ্জাত বানায় না। বরং এটা মনে করে তাদের কথা মানে যে, আলেম মানুষ। বই দেখে বলে থাকবেন হয়ত’।[22]
গোলাম রাসূল সাঈদী ব্রেলভী লিখেছেন, ‘তাক্বলীদের অর্থ হ’ল দলীলসমূহ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কোন ইমামের কথার উপর আমল করা। আর ইত্তিবা দ্বারা এটা উদ্দেশ্য যে, কোন ইমামের কথাকে কিতাব ও সুন্নাতের অনুকূলে পেয়ে এবং শারঈ দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত জেনে সেই কথাকে অগ্রাধিকার দেয়া’।[23]
সাঈদী ছাহেব আরো লিখেছেন, ‘শায়খ আবূ ইসহাক্ব বলেছেন, দলীল ছাড়া কথা গ্রহণ করা এবং তার উপর আমল করা তাক্বলীদ...। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা মুজতাহিদগণের ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা বা সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা বা বিচারকের সাক্ষীদের বক্তব্যের আলোকে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়’।[24]
সাঈদী ছাহেব আরো লিখেছেন, ‘ইমাম গাযালী লিখেছেন যে,
التَّقْلِيدُ هُوَ قَبُوْلُ قَوْلٍ بِلَا حُجَّةٍ
‘তাক্বলীদ হ’ল বিনা দলীলে কারো কথাকে গ্রহণ করা’।[25]
সাঈদী ছাহেব লিখছেন, ‘তাক্বলীদের যতগুলি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে এই কথা শামিল আছে যে, দলীল জানা ব্যতিরেকে কারো কথার উপর আমল করা তাক্বলীদ’।[26]
সরফরায খান ছফদর দেওবন্দী লিখেছেন, ‘আর এটি সর্বসম্মত কথা যে, ইক্তিদা ও ইত্তিবা এক জিনিস আর তাক্বলীদ অন্য জিনিস’।[27]
জ্ঞাতব্য : এই সর্বসম্মত কথার বিপরীতে সরফরায খান ছফদর ছাহেব নিজেই লিখেছেন যে, ‘তাক্বলীদ ও ইত্তিবা একই জিনিস’।[28] এতে বুঝা গেল যে, বৈপরীত্য ও বিরোধিতার উপত্যকায় সরফরায খান ছাহেব নিমজ্জিত আছেন।
সারকথা : হানাফী, দেওবন্দী ও ব্রেলভীদের উক্ত সংজ্ঞাগুলি ও ব্যাখ্যাসমূহ হ’তে প্রমাণিত হ’ল-
(১) চোখ বন্ধ করে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, দলীল ও প্রমাণ ব্যতিরেকে নবী ব্যতীত অন্য কারো কথা মানার নাম তাক্বলীদ।
(২) কুরআন, হাদীস ও ইজমার উপর আমল করা তাক্বলীদ নয়। আলেমের নিকট থেকে মূর্খের মাসআলা জিজ্ঞাসা করা এবং বিচারকের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়।
(৩) তাক্বলীদ ও দলীল অনুসরণের (اتباع بالدليل) মাঝে পার্থক্য রয়েছে।
খত্বীব বাগদাদী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,
وجملته أن التقليد هو قبول القول من غير دليل-
‘মোটকথা তাক্বলীদ হ’ল দলীল ছাড়া কারো কোন কথা মেনে নেওয়া’।[29]
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) লিখেছেন,
وَقَالَ أَبُو عَبْدِ اللهِ بْنُ خُوَيْزٍ مِنْدَادٌ الْبَصْرِيُّ الْمَالِكِيُّ: التَّقْلِيْدُ مَعْنَاهُ فِي الشَّرْعِ الرُّجُوْعُ إِلَى قَوْلٍ لَا حُجَّةَ لِقَائِلِهِ عَلَيْهِ، وَهَذَا مَمْنُوْعٌ مِنْهُ فِي الشَّرِيْعَةِ، وَالِاتِّبَاعُ مَا ثَبَتَ عَلَيْهِ حُجَّةٌ-
‘আবূ আব্দুল্লাহ বিন খুয়াইয মিনদাদ আল-বাছরী আল-মালেকী বলেছেন, শরী‘আতে তাক্বলীদের অর্থ হ’ল এমন কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, যে কথার কথকের কাছে এর কোন দলীল নেই। এটি শরী‘আতে নিষিদ্ধ। আর ইত্তিবা হ’ল যার উপর দলীল সাব্যস্ত হয়েছে’।[30]
জ্ঞাতব্য : সরফরায খান ছফদর দেওবন্দী ‘আদ-দীবাজুল মুযাহ্হাব’ গ্রন্থ থেকে ইবনু খুয়াইয মিনদাদ (মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ, মৃঃ সম্ভবত ৩৯০ হিঃ) সম্পর্কে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করেছেন।[31]
নিবেদন হ’ল যে, ইবনু খুয়াইয মিনদাদ এই কথায় একক ব্যক্তি নন। বরং হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম এবং আল্লামা সৈয়ূত্বী তার অনুকূলে রয়েছেন। তাঁরা তার উক্তিকে সমালোচনা ছাড়াই বর্ণনা করেছেন। এমনকি সরফরায খান ছফদর তার একটি বক্তব্যে ইবনু খুয়াইয মিনদাদের অনুকূলে আছেন।[32]
দ্বিতীয় এই যে, উপরোল্লিখিত ইবনু খুয়াইয মিনদাদের উপর কড়া সমালোচনা নেই। বরং
ولم يكن بالجيد النظر ولا قوي الفقه
প্রভৃতি শব্দাবলী আছে।[33]
আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী ও ইবনু আব্দিল বার্র-এর সমালোচনাও সুস্পষ্ট নয়।[34]
ইবনু খুয়াইয মিনদাদের জীবনী নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহেও আছে, শীরাযীর ‘ত্বাবাক্বাতুল ফুক্বাহা’ (পৃঃ ১৬৮), ক্বাযী ইয়াযের ‘তারতীবুল মাদারিক’ (৪/৬০৬), ‘মু‘জামুল মুওয়াল্লিফীন’ (৩/৭৫)।
হানাফী, ব্রেলভী ও দেওবন্দী আলেমগণ এমন ব্যক্তিদের বক্তব্য পেশ করে থাকেন, যাদের ন্যায়পরায়ণতা ও ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে অনেক মুহাদ্দিছের কঠোর সমালোচনা রয়েছে। যেমন- (১) ক্বাযী আবু ইউসুফ। (২) মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী। (৩) হাসান বিন যিয়াদ আল-লুলুঈ। (৪) আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়া‘কূব আল-হারেছী প্রমুখ (দ্রঃ মীযানুল ই‘তিদাল; লিসানুল মীযান প্রভৃতি)।
জালালুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাহল্লী আশ-শাফেঈ (মৃঃ ৮৬৪ হিঃ) বলেছেন, والتقليد قبُول قَول الْقَائِل بِلَا حجَّة
فعلى هَذَا قبُول قَول النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم لا يُسمى تقليْدا
‘তাক্বলীদ হ’ল প্রমাণ ছাড়া কারো কোন কথা গ্রহণ করা। তবে নবী করীম (ﷺ)-এর কথা গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলা হয় না’।[35]
ইবনুল হাজেব আন-নাহবী আল-মালেকী (মৃঃ ৬৪৬ হিঃ) বলেছেন,
فَالتَّقْلِيدُ الْعَمَلُ بِقَوْلِ غَيْرِكَ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ. وَلَيْسَ الرُّجُوعُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى الْإِجْمَاعِ، وَالْعَامِّيُّ إِلَى الْمُفْتِي، وَالْقَاضِي إِلَى الْعُدُولِ بِتَقْلِيدٍ لِقِيَامِ الْحُجَّةِ. وَلَا مُشَاحَةَ فِي التَّسْمِيَة-
‘সুতরাং তাক্বলীদ হ’ল, দলীল ছাড়া অন্যের কথার উপর আমল করা। আর নবী করীম (ﷺ) ও ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, সাধারণ মানুষের মুফতীর দিকে এবং বিচারকের সাক্ষীদের দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয় দলীল সাব্যস্ত থাকার কারণে। আর (এই) নামের ব্যাপারে
কোনই বিবাদ নেই’।[36]
আলী বিন মুহাম্মাদ আল-আমেদী আশ-শাফেঈ (মৃঃ ৬৩১ হিঃ) বলেছেন,
أَمَّا (التَّقْلِيدُ) فَعِبَارَةٌ عَنِ الْعَمَلِ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ مُلْزِمَةٍ... فَالرُّجُوعُ إِلَى قَوْلِ النَّبِيِّ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَإِلَى مَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْعَصْرِ مِنَ الْمُجْتَهِدِينَ، وَرُجُوعُ الْعَامِّيِّ إِلَى قَوْلِ الْمُفْتِي، وَكَذَلِكَ عَمَلُ الْقَاضِي بِقَوْلِ الْعُدُولِ لَا يَكُونُ تَقْلِيدًا-
‘তাক্বলীদ হ’ল, অন্যের কথার উপর আবশ্যকীয় দলীল ব্যতিরেকে আমল করা...। সুতরাং নবী করীম (ﷺ)-এর কথা এবং সমকালীন মুজতাহিদগণের ইজমার দিকে প্রত্যাবর্তন করা, সাধারণ মানুষের মুফতীর কথার দিকে প্রত্যাবর্তন করা এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচারকের ফায়ছালা করা তাক্বলীদ নয়’।[37]
আবূ হামিদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-গাযালী (মৃঃ ৫০৫ হিঃ) বলেছেন,
التَّقْلِيدُ هُوَ قَبُوْلُ قَوْلٍ بِلَا حُجَّةٍ
‘বিনা দলীলে কারো কোন কথা গ্রহণ করাই হ’ল তাক্বলীদ’।[38]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম বলেছেন,
وَأَمَّا بِدُوْنِ الدَّلِيلِ فَإِنَّمَا هُوَ تَقْلِيدٌ-
‘আর যা দলীল ব্যতীত হবে তাই তাক্বলীদ’।[39]
আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ হাম্বলী বলেছেন,
وهو في عرف الفقهاء قبول قول الغير من غير حجة، أخذًا من هذا المعنى فلا يسمى الأخذ بقول النبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم والإجماع تقليدًا-
‘আর ফক্বীহদের নিকটে এটা (তাক্বলীদ) হ’ল বিনা দলীলে কারো কথা গ্রহণ করা। এই অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী করীম (ﷺ)-এর কথা এবং ইজমাকে গ্রহণ করাকে তাক্বলীদ বলা হয় না’।[40]
ইবনু হাযম আন্দালুসী আয-যাহেরী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেছেন,
لأن التقليد على الحقيقة إنما هو قبول ما قاله قائل دون النبي صلى الله عليه وسلم بغير برهان، فهذا هو الذي أجمعت الأمة على تسميته تقليدا وقام البرهان على بطلانه-
‘কেননা প্রকৃতপক্ষে তাক্বলীদ হ’ল নবী করীম (ﷺ) ছাড়া অন্য কারো কথাকে দলীল ছাড়াই গ্রহণ করা। আর এটির নাম তাক্বলীদ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। আর এটি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীল কায়েম আছে’।[41]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ) বলেছেন,
وَقَدِ انْفَصَلَ بَعْضُ الْأَئِمَّةِ عَنْ ذَلِكَ بِأَنَّ الْمُرَادَ بِالتَّقْلِيدِ أَخْذُ قَوْلِ الْغَيْرِ بِغَيْرِ حُجَّةٍ وَمَنْ قَامَتْ عَلَيْهِ حُجَّةٌ بِثُبُوتِ النُّبُوَّةِ حَتَّى حَصَلَ لَهُ الْقَطْعُ بِهَا فَمَهْمَا سَمِعَهُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ مَقْطُوعًا عِنْدَهُ بِصِدْقِهِ فَإِذَا اعْتَقَدَهُ لَمْ يَكُنْ مُقَلِّدًا لِأَنَّهُ لَمْ يَأْخُذْ بِقَوْلِ غَيْرِهِ بِغَيْرِ حُجَّةٍ وَهَذَا مُسْتَنَدُ السَّلَفِ قَاطِبَةً فِي الْأَخْذِ بِمَا ثَبَتَ عِنْدَهُمْ مِنْ آيَاتِ الْقُرْآنِ وَأَحَادِيثِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيمَا يَتَعَلَّقُ بِهَذَا الْبَابِ فَآمَنُوا بِالْمُحْكَمِ مِنْ ذَلِكَ وَفَوَّضُوا أَمْرَ الْمُتَشَابِهِ مِنْهُ إِلَى رَبِّهِمْ-
‘কতিপয় ইমাম এ থেকে (এই মাসআলাকে) আলাদা করেছেন। কেননা তাক্বলীদ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, দলীল ছাড়া অন্যের কথা গ্রহণ করা। আর তার উপর নবুঅতের প্রমাণের সাথে সাথে দলীল কায়েম হয়ে যায়। এমনকি তার দৃঢ় বিশ্বাস এসে যায়। সুতরাং সে নবী করীম (ﷺ) থেকে যা শ্রবণ করেছে তার কাছে তা নিশ্চিতরূপে সত্য। যখন সে এ আক্বীদা পোষণ করবে তখন সে মুক্বাল্লিদ নয়। কেননা সে অন্যের কথাকে দলীল ছাড়া গ্রহণ করেনি। আর এটাই সকল সালাফে ছালেহীনের পুরাপুরি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি যে, এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীস থেকে যা তাদের নিকটে প্রতীয়মান হয়েছে তা গ্রহণ করা। ফলে তারা ‘মুহকামাত’ (কুরআনের সুস্পষ্ট হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত আয়াতসমূহ)-এর উপর ঈমান এনেছেন এবং ‘মুতাশাবিহাত’ (যার মর্মার্থ অস্পষ্ট)-এর বিষয়টি তাদের প্রতিপালকের নিকট সোপর্দ করে দিয়েছেন (যে তিনিই এর অর্থ ভাল জানেন)।[42]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) লিখেছেন,
وَالتَّقْلِيدُ لَيْسَ بِعِلْمٍ بِاتِّفَاقِ أَهْلِ الْعِلْمِ
‘আলেমদের ঐক্যমত অনুযায়ী তাক্বলীদ কোন ইলম নয়’।[43]
সারকথা : হানাফী, দেওবন্দী, ব্রেলভী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী, যাহেরী এবং হাদীসের ভাষ্যকারগণের উক্ত সংজ্ঞাগুলি থেকে প্রতীয়মান হ’ল, তাক্বলীদের মর্ম এটাই যে, দলীল ও প্রমাণ বিহীন বক্তব্যকে (চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, অন্ধের মত) মেনে নেয়া।
[1]. তাক্বলীদ দুই প্রকার (১) তাক্বলীদে শাখছী (২) তাক্বলীদে মুত্বলাক্ব তথা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির তাক্বলীদের পরিবর্তে একেক মাসআলায় একেকজন ইমামের তাক্বলীদ করা। তাক্বলীদে মুত্বলাক্ব এবং তাক্বলীদে গায়ের শাখছী একই জিনিস। নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির তাক্বলীদ করাকে ‘তাক্বলীদে শাখছী’ বলা হয়। -অনুবাদক।
[2]. তাযকিরাতুর রশীদ ১/১১৩ পৃঃ।
[3]. ঐ, ১/১৩১ পৃঃ।
[4]. তাক্বলীদ কী শারঈ হায়ছিয়াত (ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৪১৩ হিঃ), পৃঃ ৬৫।
[5]. জা-আল হক্ব (পুরাতন সংস্করণ) ১/২২২, ‘বিদ‘আতের প্রকারভেদ সমূহের পরিচয় ও আলামাত’।
[6]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব (ইস্তাম্বুল, তুরস্ক : দারুদ দাওয়াহ, মুআস্সাসাহ ছাক্বাফিয়াহ), পৃঃ ৭৫৪।
[7]. আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ (লাহোর, করাচী : ইদারায়ে ইসলামিয়াত), পৃঃ ১৩৪৬।
[8]. ঐ।
[9]. আল-মুনজিদ (আরবী-উর্দূ) (করাচী : দারুল ইশা‘আত), পৃঃ ৮৩১।
[10]. হাসানুল লুগাত, পৃঃ ২১৬।
[11]. জামে‘উল লুগাত’ (উর্দূ), (করাচী : দারুল ইশা‘আত), পৃঃ ১৬৬।
[12]. মুসাল্লামুছ ছুবূত (ছাপা : ১৩১৬ হিঃ), পৃঃ ২৮৯; ফাওয়াতিহূর রাহমূত ২/৪০০।
[13]. ফাওয়াতিহূর রাহমূত বি-শারহি মুসাল্লামিছ ছুবূত ফী উছূলিল ফিক্বহ ২/৪০০।
[14]. তাহরীর ইবনে হুমাম ফী ইলমিল উছূল ৩/৪৫৩।
[15]. কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ২৯।
[16]. তাসহীলুল উছূল ইলা ইলমিল উছূল, পৃঃ ৩২৫।
[17]. উছূলুল ফিক্বহ, পৃঃ ২৬৭। এই গ্রন্থের উপর মুহাম্মাদ তাক্বী ওছমানী দেওবন্দী ছাহেব অভিমত লিখেছেন।
[18]. গায়ের মুক্বাল্লিদীন সে চান্দে মা‘রূযাত (হামীদ, আটোক : জমঈয়তে ইশা‘আতুত তাওহীদ ওয়াস-সুন্নাহ), পৃঃ ১, আরয-১।
[19]. আপ ফৎওয়া ক্যায়সে দেঁ, (করাচী : মাকতাবা নু‘মানিয়া), পৃঃ ৭৬।
[20]. আল-ইফাযাতুল ইয়াওমিয়াহ মিনাল ইফাদাতিল ক্বওমিয়াহ/ মালফূযাতে হাকীমুল উম্মত ৩/১৫৯, বচন নং ২২৮।
[21]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ (ছাপা : ছফর ১৪১৩ হিঃ), পৃঃ ৩৫, ৩৬।
[22]. জা-আল হক্ব (পুরাতন সংস্করণ), ১/১৬।
[23]. শরহ সহীহ মুসলিম (লাহোর : ফরীদ বুক স্টল), ৫/৬৩।
[24]. ঐ, ৩/৩২৯।
[25]. ঐ, ৩/৩৩০।
[26]. ঐ।
[27]. আল-মিনহাজুল ওয়াযেহ ই‘য়ানী রাহে সুন্নাত (৯ম সংস্করণ, জুমাদাছ ছানিয়াহ, ১৩৯৫ হিঃ/জুন ১৯৭৫ইং), পৃঃ ৩৫।
[28]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ, পৃঃ ৩২।
[29]. আল-ফাক্বীহ ওয়াল-মুতাফাক্কিহ ২/৬৬।
[30]. জামে‘উ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহি ২/১১৭, অন্য সংস্করণ ২/১৪৩; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন ২/১৯৭; সুয়ূত্বী, আর-রদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয ওয়া জাহিলা আন্নাল ইজতিহাদা ফী কুল্লি আছরিন ফারয, পৃঃ ১২৩।
[31]. আল-কালামুল মুফীদ, পৃঃ ৩৩, ৩৪।
[32]. দ্রঃ রাহে সুন্নাত, পৃঃ ৩৫।
[33]. দ্রঃ আদ-দীবাজুল মুযাহ্হাব, পৃঃ ৩৬৩, জীবনী ক্রমিক নং ৪৯১; লিসানুল মীযান ৫/২৯১।
[34]. দ্রঃ যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ২৭/২১৭; ছাফাদী, আল-ওয়াফী বিল-অফায়াত ২/৩৯, জীবনী ক্রমিক নং ৩৩৯।
[35]. শারহুল ওয়ারাক্বাত ফী ইলমি উছূলিল ফিক্বহ, পৃঃ ১৪।
[36]. মুনহাতাল উছূল ওয়াল আমাল ফী ইলমাই আল-উছূল ওয়াল জাদল, পৃঃ ২১৮, ২১৯।
[37]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ৪/২২৭।
[38]. আল-মুসতাছফা মিন ইলমিল উছূল ২/৩৮৭।
[39]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ১/৭।
[40]. রাওযাতুন নাযির ওয়া জুন্নাতুল মুনাযির ২/৪৫০।
[41]. আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম ৬/২৬৯।
[42]. ফাৎহুল বারী ১৩/৩৫১, হা/৭৩৭২-এর আলোচনা দ্রঃ।
[43]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/১৮৮।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: