- Joined
- Jul 24, 2023
- Threads
- 520
- Comments
- 533
- Reactions
- 5,571
- Thread Author
- #1
ভ্রাতৃত্ব
মু’মিন-মুসলিমগণ সবাই পরস্পর ভাই-ভাই। তাদের মধ্যে প্রধানতম সম্পর্ক হল ঈমানী-ভ্রাতৃত্বের। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘একান্তভাবেই মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু’পক্ষের (বিবদমান) ভাইদের মধ্যে সমঝোতা করে দাও এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের উপর রহমত নাযিল হয়’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১০)।
কোন অমুসলিম যদি তওবাহ করে ইসলাম গ্রহণ করে এবং মৌলিক আমলগুলোতে যতœবান হয়, তাহলে তার জাত-পাত-বংশ-অতীত কিছুই না দেখে সরাসরি তাকে ভাই হিসাবে গভীর আন্তরিকতার সাথে নিঃসঙ্কোচে মুসলিম সমাজে গ্রহণ করে নিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‘অতঃপর তারা যদি তওবাহ করে এবং সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনের অন্তর্গত ভাই। আর আমরা আয়াতগুলোকে বিবৃত করে থাকি সেই কওমের জন্য, যারা জানে’ (সূরা আত-তওবাহ : ১১)।
মুমিনদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতা আল্লাহ্র দেয়া এক বিরাট নে‘য়ামত (অনুগ্রহ)। ঐক্যের উপর ভিত্তি করে ভ্রাতৃত্ব যেমন দৃশ্যমান হয়, তেমনই আবার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মযবুত হলে ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী ও অটুট হয়। রাব্বুল আলামীন বলেন,
‘আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (কুরআন-সুন্নাহ) সকলে মিলে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ে যেও না এবং তোমরা স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নে‘য়ামতকে যখন তোমরা এক অপরের শত্রু ছিলে অতঃপর তিনি তোমাদের আত্মাগুলোর মধ্যে মিলন সংঘটিত করে দিলেন, ফলতঃ তোমরা তাঁরই অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা অগ্নিকু-ের কিনারায় অবস্থান করছিলে, তিনি তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা হেদায়াত লাভ করতে পার’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
ইসলামী সাংগঠনের কর্মীদের ক্ষেত্রে এই ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক আরো গভীর আরো নিবিড়। কেননা তাঁরা হলেন সমাজের অধিকতর সচেতন ও দায়িত্বশীল মানুষ। সার্বিক বিচরণ ক্ষেত্রে তাদের আচরণভঙ্গি মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কীভাবে মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের আহ্বান আরো ব্যাপক হয় এবং এর বন্ধন আরো সৃদৃঢ় হয় Ñ তাদের চালচলন ও কর্মসূচির মধ্যে সেটা খুবই গুরুত্বের সাথে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন।
ভ্রাতৃত্বের মূল শিকড় হল ‘ইখলাছ’। ইখলাছের সাথে যা কিছুই করা হোক না কেন তা কখনো বিনষ্ট হয় না; বরং দুনিয়াতেও সফলতা লাভ করে আর আখেরাতের জন্যও সঞ্চিত থাকে। ইখলাছ না থাকাটাই সকল বিনষ্টের মূল। নিখাদ আন্তরিকতা, নিঃস্বার্থতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহায্য-সহযোগিতা, খোঁজ-খবর, আদান-প্রদান, অনুদান-অবদান, নিজ স্কন্ধে দায়িত্ব গ্রহণ, আপদ-বিপদে পাশে দ-ায়মান ইত্যাদি ভ্রাতৃত্বের বাহন।
এ গুণগুলোই যদি কোন সমাজের সদস্যদের মধ্যে না থাকে, তাহলে তাদের ভ্রাতৃত্বের বুলি শুধু মৌখিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবতার মুখ দেখে না। ভ্রাতৃত্বের গভীরতা ও আবেদন বন্ধুত্বের ঊর্ধ্বে; যদিও বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব একে অপরের সম্পূরক। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুই মুসলিম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্বোধনের পরিভাষা হল ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ আর মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্বোধনের পরিভাষা হল বন্ধুপ্রতীম দেশ ।
বলা বাহুল্য, আত্মম্ভরিতা, হামবড়াই, হিংসা-বিদ্বেষ, হীন স্বার্থপরতা, ধনলালসা, ক্ষমতালিপ্সা, পদলোভ, ব্যক্তিতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, আখের গোছানোর বাসনা, কপটতা, ধূর্ততা, সুযোগ সন্ধানী মানসিকতা, হীনমন্যতা ইত্যাদি নিয়ে কক্ষনো যথার্থ ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না; বরং হয় সাময়িক আনুষ্ঠানিকতা ও বাহ্যিক সামাজিকতা। শেষ পর্যায়ে এজাতীয় সমস্যায় জর্জরিত লোকদের সমন্বয়ে কোন বৃহত্তর কাজের পদক্ষেপ নেয়া তো দূরস্থান, কোন ক্ষুদ্রতর কাজে হাত দেয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। বাস্তবতা বিবর্জিত ভ্রাতৃত্বের দাবির মাধ্যমে কোন টেকসই আদর্শিক সমাজ গঠিত হয় না।
ভ্রাতৃত্ব কায়েম হওয়া ও তা টিকে থাকার জন্য শুধু কিছু গুণ থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং অনেকগুলো দোষ এড়িয়ে চলা কর্তব্য। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিমদেরকে এমন সব ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যেগুলো পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বকে নষ্ট করে দেয়। হাদীসে এসেছে,
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা কুধারণা পরিহার কর। কেননা কুধারণা হল বড় মিথ্যা কথা। আর তোমরা একে অপরের দোষ খুঁজে বেড়িও না, পরস্পর গুপ্তচরবৃত্তি কর না, আড়াল থেকে ইঙ্গিত করে একে অপরের জিনিসের দাম বাড়িও না, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ কর না, একে অপরকে ঘৃণা কর না, একজন আরেকজন থেকে পিঠ ফিরিয়ে নিও না (দূরত্ব রচনা কর না), আর তোমরা পরস্পর আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও।[১]
প্রথম যুগের মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের মৌলিক সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল; নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেটিকে আবার আনুষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মদীনাহতে হিজরতের পরপরই। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন,
‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়িতে মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে (আনুষ্ঠানিক) ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করলেন। তাঁরা ছিলেন ৯০ জন; যাদের মধ্যে অর্ধেক ছিলেন মুহাজির আর অর্ধেক ছিলেন আনছার। তিনি তাঁদের মধ্যে সহানুভূতি ও সহযোগিতার ভ্রাতৃত্ব তৈরি করলেন। এমনকি তারা পরস্পর ওয়ারিস হবেন এই ঘোষণাও দিলেন। বদরের যুদ্ধ পর্যন্ত এ ওয়ারিসের হুকুম বহাল থাকে। অতঃপর তাদের পস্পরের ওয়ারিস হওয়ার বিষয়টি কুরআন দ্বারা রহিত হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘উলুল আরহামরা (রক্ত সম্পর্কীয় ও নিকট আত্মীয়রা) একে অপরের ক্ষেত্রে (ওয়ারিস প্রাপ্তির) অধিক হকদার আল্লাহর বিধানে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয় অধিক জানেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৭৫)। অতঃপর আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে ওয়ারিসের বিধান বহাল থাকে এবং আনুষ্ঠানিক ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে ওয়ারিস প্রাপ্তির বিধান রহিত হয়ে যায়।[২] এই আনুষ্ঠানিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব সম্পর্কে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলিম শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
‘এই ভ্রাতৃত্বের মর্মার্থ হল, যাতে জাহেলিয়্যাতের গোঠবদ্ধতা বিলীন হয়ে যায় এবং বংশ, দেশ ও বর্ণভিত্তিক পার্থক্যগুলো মিটে যায়; আর (কারো সাথে) মিত্রতা ও বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি ইসলাম ছাড়া আর অন্য কিছু না থাকে। এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে অপরকে প্রাধান্য দেয়া, সহমর্মীতা ও আন্তরিক নৈকট্যের অনুভূতি বিশেষভাবে জাগ্রত হয় এবং এদিক থেকে নতুন (মদীনাহর ইসলামী) সমাজটি সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তে পরিণত হয়’।[৩]
আল্লামা আবুল হাসান আলী নাদভী এই ভ্রাতৃত্বের তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলেন,
‘এই ভ্রাতৃত্ব ছিল বিশ^ ইসলামী ভ্রাতৃত্বের এক মূল ভিত্তি; স্বীয় ক্ষেত্রে যার দৃষ্টান্ত অনন্য। এটি ছিল দাওয়াত ও রিসালতের ধারক-বাহক এক উম্মতের উত্থানের সূচনা। যে উম্মত নতুন দুনিয়া গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠিত হবে নির্দিষ্ট সহীহ আকীদাহ’র উপর এবং সৎ উদ্দেশ্যে। যা জগতকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে রক্ষা করবে এবং পরস্পর মারামারি ও হত্যাকা- থেকে উদ্ধার করবে এবং ঈমান, আন্তরিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্মিলিত কাজের নব-গঠিত সম্পর্কের উপর কায়েম থাকবে। আর মুহাজির ও আনছারীদের পরিসরে সীমাবদ্ধ এই ভ্রাতৃত্বের আনুষ্ঠানিকতা ছিল দুনিয়ায় মানবতা ও নতুন জীবনের এক প্রারম্ভের সূচনা ও শর্ত স্বরূপ। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা আয়তনে ছোট্ট শহরের (মদীনাহ) মধ্যে অবস্থিত সীমিত সংখ্যক (গুটি কতক) এই মানব-গোষ্ঠীকে আহ্বান করে বলছেন, ‘এবং যারা কুফরী করেছে তারা একে অপরের বন্ধু, আর যদি তোমরা (পরস্পরে) তা (বন্ধুত্ব) না কর, তাহলে যমীনে ফিতনা হবে ও মহা ফাসাদের সৃষ্টি হবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৭৩)।[৪] সহীহুল বুখারীতেও এ ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে বিবরণ এসেছে,
‘অধ্যায় : কীভাবে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে (আনুষ্ঠানিক) ভ্রাতৃত্ব গঠন করে ছিলেন’।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুর রহমান বিন আঊফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সা‘দ ইবনুর রাবী’ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিলেন। তিনি তাঁর কাছে মালের অর্ধেক পরিমাণ ও স্ত্রীদের অর্ধেক সংখ্যক উপস্থাপন করলেন। তখন আব্দুর রাহমান বিন আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহ আপনার মাল ও পরিবারে বরকত দান করুন! আপনি আমাকে বাজারের সন্ধান দিন। অতঃপর তিনি বাজারে পনির ও ঘি কেনা-বেচা করে বেশ লাভবান হলেন। কিছুদিন পর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার হাতে মেহেদির হলুদ রং দেখতে পেয়ে বললেন, হে আব্দুর রহমান! তোমার ঘটনা কী? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আনছারীদের এক মেয়েকে বিয়ে করেছি। তিনি বললেন, তাকে বিয়েতে কী দিয়েছ? তিনি বললেন, ‘নাওয়াত’[৫] পরিমাণ স্বর্ণ দিয়েছি। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, একটি ছাগল বা ভেড়া যব্হ করে হলেও ওলীমা কর’।[৬]
আনছারীগণের সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর অর্থ এই নয় যে, মুহাজিরগণ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য তাদের উপর স্থায়ীভাবে নির্ভরশীল হয়ে আজীবন কাটিয়েছেনÑ না, তা আদৌ নয়। বরং হিজরতের প্রাথমিক ঝাপটা সামলে নেয়ার সাথে সাথে সবাই যার যার কর্মসংস্থানের দিকে মনোযোগী হয়েছেন। আনছারীদের মধ্যে কারো কারো একাধিক স্ত্রী থাকলে একজনকে ত্বালাক দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মুহাজির ভাই-এর বিয়ের জন্য, এর অর্থ এই নয় যে, এ উদ্দেশ্যে ত্বালাক দেয়ার ও বিয়ে করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বরং বিষয়টি এমন যে, তারা সকল প্রকার সর্বোচ্চ বৈধ ত্যাগ প্রদানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তৎকালীন আরবীয় সমাজে শুধু চারজন নয় বরং ডজনে ডজনে বিয়ে করার এবং যত্রযত্র যখন তখন ত্বালাক দেয়ার প্রচলন ছিল। এমনকি দাম্পত্য কর্তব্য আদৌ পালন না করে বিয়ের নামে কোন নারীকে যুগযুগ ধরে অত্যাচার করার নযীর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং কোন বিপদগ্রস্ত মুহাজির ভাইয়ের জন্য কারো কোন অতিরিক্ত স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দেয়ার প্রস্তাব করা তখন তেমন কোন অসঙ্গত কাজ ছিল না। কিন্তু যেনা, ব্যভিচার ও অবৈধ যৌনাচার সকল ধর্মে সকল সুসভ্য সমাজে ঘৃণিত কাজ ছিল। আর এ গর্হিত কাজগুলো মাক্কী জীবনেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গগুলোকে সংযত রাখে। কিন্তু তাদের নিজেদের স্ত্রীগণ এবং অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যতীত, এতে তারা নিন্দিত হবে না। আর যারা এগুলো ছাড়া অন্য কোন পথ কামনা করবে, তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৫-৭)। তিনি আরো নির্দেশ করেন,
‘আর তোমরা যেনা-ব্যভিচারের ধারে কাছে যেও না, কেননা এটা হল গর্হিত কাজ এবং নিকৃষ্ট পন্থা’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২)। তিনি আরো ইরশাদ করেন,
‘আর তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না এবং তারা আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করে না যথার্থ হক্ব কারণ ব্যতীত এবং তারা যেনা-ব্যভিচার করে না। আর যে ব্যক্তি এগুলো করে সে পাপের শাস্তি ভোগ করবে। ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সে স্থায়ীভাবে হীন পরিস্থিতিতে থাকবে’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৬৮-৬৯)।
এগুলো সবই মাক্কায় অবতীর্ণ আয়াত। বিয়ে ও ত্বালাকের বিস্তারিত বিধিবিধান মদীনাতে অবতীর্ণ হয় এবং পারিবারিক ও সামাজিক বিধিবিধান সর্বোচ্চ মার্জিতরূপ ও উৎকৃষ্টতা লাভ করে। পরবর্তীতে অপরের বিয়ের সুবিধার্থে ইচ্ছাপূর্বক নিজ বৈধ স্ত্রীকে ত্বালাক দেয়ার প্রস্তাবনার ঘটনা আর ঘটেনি। ওটি ছিল তৎকালীন সমাজের বৈধ প্রচলনের সাথে সঙ্গতি রেখে উপস্থিত সমস্যার মানবিক ও নৈতিক সমাধানের একটি পথ মাত্র।
‘হিজরত’ ও ‘রিফিউযী’ সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত ইসলাম দেখিয়েছে ও শিখিয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে নযীরবিহীন। মানবতা বিবর্জিত নব্য জাহিলিয়্যাতের সমাজে কত দেশ শুধু কথিত ধর্ম ও বর্ণবৈষম্যকে কেন্দ্র করে কত নারী-শিশুকে ঘরছাড়া করছে, পথে ঘাটে যেখানে সেখানে নির্বিচারে কত বানী আদমকে হত্যা করছে, অনাহারে অর্ধাহারে খোলা আকাশের নীচে তাদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। কবে কোন্ দিন তারা তাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরতে পারবে তার কোন হদীস নেই। বহু কথিত সভ্য ও ধনাঢ্য দেশ সহযোগিতার হাত বাড়াতে কুন্ঠিত হচ্ছে। কেউ কেউ নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে পাশ কাটাচ্ছে। রাজনৈতিক সমস্যা ও কূটনৈতিক আচারের অজুহাতে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেশান্তরিত হওয়া মানুষগুলোকে কত দেশের সীমান্তে আটকে দেয়া হচ্ছে বা মৃত্যুপুরীতে আবার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে নিগৃহীত হওয়ার জন্য। যারা দু’দিন আগেও নিজ দেশে স্বাধীন ও স্বচ্ছল জীবন-যাবন করত। আজ তারা পরাধীন, নিঃস্ব, অচল, অসাড় হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক হিজরত এবং আন্তর্জাতিক আশ্রয় সংক্রান্ত সংস্থাগুলো তো এই সেদিন প্রতিষ্ঠিত হল। এ সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু এগুলোর পরিধি, কার্যক্রম ও কর্মক্ষমতা আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন। বিশে^র বর্বরদের অত্যাচারের তুলনায় এগুলোর পরিধি ও প্রতিকারের ক্ষমতা খুবই অপ্রতুল। কেননা বহু শর্তসাপেক্ষে বিতাড়িত নিগৃহীত গৃহত্যাগীদের কাছে কিছু কিছু মানবিক সাহায্য-সহযোগিতাই শুধু পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে, আর কিছু নয়। হিজরতের (সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রি.) পর আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ শত বছর আগে ইসলাম এ বিষয়ে মানবতা, ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ মৌলিক বিধিবিধান পেশ করেছে এবং যথাযথভাবে অনুশীলন ও কার্যকর করে দেখিয়ে দিয়েছে।
দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে যারা হিজরত করে আরেক দেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বসবাস করেন তাদের ক্ষেত্রে ইসলামী পরিভাষা সরাসরি ‘রিফিউযি’, ‘শরণার্থী’ ইত্যাদি নয়; বরং তাদের ক্ষেত্রে পরিভাষা হল ‘মুহাজির’। আর যাদের কাছে হিজরত করে যাওয়া হয় তাদেরকে স্থায়ী আশ্রয়দাতা বলা হয়নি, বরং সাময়িক আশ্রয়দাতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের পদবী হল ‘আনছার’ (সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানকারী)। কেননা তাঁরা দুনিয়ার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সে দেশের প্রথম ও স্থায়ী মালিকানার অধিকারী নন, বরং তারা তুলনামূলকভাবে আগে সে দেশের বাসিন্দা বা নাগরিক হয়েছেন মাত্র। তাই কুরআন আনছারীগণকে বলছে, ‘তারা মদীনাহতে মুহাজিরদের আগে বসতি স্থাপন করেছে’ (সূরা আল-হাশর : ৯)।
অর্থাৎ মদীনাহ’র ক্ষেত্রে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে বসবাসের দিক থেকে পার্থক্য ছিল শুধু Ñ এক দল আগে বসতি স্থাপন করেছে আরেক দল পরে। যদিও ‘হাবাশাহ’-এর হিজরতের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। কেননা হাবাশাহ’র জনসাধারণ তখন ইসলাম গ্রহণ করেনি।
বিশে^র সম্ভ্রান্ত-জাহেলরা তাদের কল্পিত প্রতিপক্ষ লোকদেরকে যুগযুগ বসবাসকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও বলছে, ওরাতো এ দেশের বাসিন্দা নয়, ওরা তো বহিরাগত। সুতরাং ওদেরকে বের করে দাও। মুসলিম হলে তো তাদেরকে বহিষ্কার ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোন কথাই নেই। সম্প্রতি ভারত সরকার এ বিষয়ে ‘এন আর সি’ নামে বর্বরতার এক নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ ভারতে কথিত হিন্দু আর্যদের আগমন ৫০০০ হাজার বছরের আগে নয়। এখন তাদের আগের বাসিন্দারা যদি বলে, তোমরাও এদেশের আদি বাসিন্দা নও। সুতরাং বের হয়ে যাওÑ সেটা কি অমূলক হবে? তবে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের এই অমানবিক বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহল থেকে প্রচ- প্রতিবাদের ঝড়ও উঠেছে Ñতাদেরকে কায়মনোবাক্যে ধন্যবাদ। আমেরিকাতে কিছু স্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যাকা- বর্ণবাদি নাগরিক বৈষম্যের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমারের (বার্মার) বর্বররা সেদেশে শত শত বছর যাবৎ স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আরাকানী (রাখাইনী/রোহিঙ্গা) মুসলিমদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে, তাদের বাড়ীঘরে অগ্নি সংযোগ করছে, তাদেরকে সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে, মহিলাদের ইয্যত-সম্ভ্রম নষ্ট করছে, নারী-শিশুদের আহাজারীতে আকাশ-বাতাস বাষ্পীভূত হয়ে উঠেছে। সে দেশের কম ও বেশি ১৪ লক্ষ মুসলিম নারী-শিশু-পুরুষ বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কবে তাদের সমস্যার সমাধান হবে, কবে তারা তাদের নিজেদের দেশে বৈধ নাগরিকের স্বীকৃতি নিয়ে স্বসম্মানে ফিরে যেতে পারবে Ñতা কেউ বলা তো দূরস্থান, আভাস ইঙ্গীতও দিতে পারছে না।
মুসলিমরা যাতে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃদৃঢ় করার ও তা অব্যাহত রাখার সাথে সাথে এর বিশেষ মর্মার্থগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, সে জন্য এ সম্পৃক্ত কয়েকটি আয়াত উপস্থাপন করা সঙ্গত মনে করছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং হিজরত করেছে এবং আল্লাহ্র পথে তাদের মালগুলো এবং জানসমূহ দিয়ে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে এবং সাহায্য করেছে, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করেনি তাদের হিজরত করার আগ পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্ব করার দায়িত্ব তোমাদের নেই। আর যদি তারা দ্বীন সংক্রান্ত বিষয়ে তোমাদের সাহায্য চায়, তাহলে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। কিন্তু এমন সম্প্রদায় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়। আর তোমরা যা কর তা আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা। এবং যারা কুফুরী করেছে তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু; যদি তোমরা তা (মুমিনদের পরস্পর বন্ধুত্ব সুদৃঢ় ও কাফিরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন) না কর, তাহলে যমীনে ফিতনা হবে ও মহা বিপর্যয় দেখা দিবে। আর যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন; তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক জীবিকা। আর যারা পরে ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং তোমাদের সঙ্গে থেকে জিহাদ করেছে তারাও তোমাদের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহর বিধানে (রক্ত-সম্পর্কীয়) আত্মীয়গণ পরস্পরে অন্যের চাইতে (সম্পদের ওয়ারিসের) বেশি হক্দার। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে অধিক জানেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫)। এ আয়াতগুলোর সাথে সূরা আল-হাশরের ৮ ও ৯ নং আয়াত মিলিয়ে পড়ে নিলে বক্ষ্যমাণ বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘(এই ‘ফাইয়’ বা যুদ্ধবিহীনভাবে প্রাপ্ত সম্পদ) অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পদাদি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এমতাবস্থায় যে, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে সহযোগিতা করে, তারাই হল সত্যাশ্রয়ী। আর তাদের (আনছারদের) জন্যও যারা (এই নগরীতে) বসবাস স্থাপন করেছে তাদের (মুহাজিরদের) পূর্বে এবং ঈমান এনেছে। তারা তাদের কাছে যারা হিজরত করে এসেছে তাদেরকে ভালবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্য অন্তরে কোন কামনা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয় যদিও তাদের অভাবগ্রস্ত রয়েছে এবং যাদরেকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই হল সফলকাম’ (সূরা আল-হাশর : ৮-৯)।
মদীনায় নতুন সমাজ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় মুহাজির ও আনছারীগণের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টির সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাঁদের ও সকল মুসলিমের মধ্যে সামাজিক চুক্তি সম্পাদন। অপরদিকে সেখানকার অমুসলিম বাসিন্দা এবং বিশেষভাবে ইয়াহুদীদের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তিপত্র লিপিবদ্ধকরণ। মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের ওয়াদানামা খুব সংক্ষিপ্তভাবে নি¤œরূপ :
بسم الله الرحمن الرحيم.
هَذا كِتاب مِن مُحمَّد النبيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كِتاباً بَين المُؤمِنين والمُسلِمين من قُرَيش ويَثْرِب ومَن تَبِعَهُم فلَحِقَ بِهم وجاهَدَ مَعهُم :
أنّهُم أمَّة واحِدةٌ من دُونِ النَّاسِ.
المُهاجِرُون من قُريش عَلى رِبعَتِهم يَتَعاقَلُون بَينَهُم، وهُم يَفدُون عانِيهِم بالمَعرُوفِ والقِسطِ بَين المُؤمنِين. وكلُّ قَبيلَة من الأنصارِ على رِبعَتِهم يَتَعاقلُون مَعاقِلِهُم الأولى وكُلّ طائفَةٍ مِنهُم تَفدِي عانِيْها بالمَعرُوفِ والقِسطِ بينَ المُؤمِنِين.
وأنّ المُؤمنِين لايَترُكُون مُفرَحاً بَينهُم أن يُعطُوه بالمَعروفِ في فِداء أو عَقل.
وأنّ المُؤمنين المُتَّقين على مَن بَغَى عَليهم أو ابْتَغَى دَسِيعة ظُلم أو إِثم أو عُدوان أو فَساد بين المُؤمنين. وأنّ أَيديهِم عليه جَميعاً ولَو كان وَلَد أحدِهم.
ولا يَقتُلُ مُؤمن مُؤمناً في كافِر ولا يَنصُرُ كافراً على مُؤمِن.
وأنّ ذِمَّةَ اللهِ واحِدة يُجير علَيهِم أَدناهُم.
وأنَّ مَن تَبِعَنا من اليَهود فأنّ له النَّصرَ والأُسوة، غير مَظلُومِين ولا مُتَناصِرين عَليهم.
وأنّ سِلمَ المُؤمِنين واحِد، لايُسالِمُ مُؤمن دُون مُؤمِن في قِتال في سَبيلِ اللهِ إلا على سَواءٍ وعَدلٍ بَينَهم.
وأنّ المُؤمنين يُبيئ بعضُهم على بَعض بِما نالَ دِماءهم في سبيلِ الله.
وأنَّ المُؤمِنين المُتَّقِين علَى أحسَن هُدى وأقوَمه.
وأنّه لا يُجير مُشرِك مَالاً لِقُريش ولا نَفساً، ولا يَحُولُ دُونَه على مُؤمن.
وأنّه من اعْتَبَطَ مُؤمناً قتلاً عن بيِّنَة فإنّه قُودَ بِه، إلّا أن يَرضَى وَلِيُّ المَقتُول.
وأنّ المُؤمنين عَليه كافّة، ولا يَحلُّ لَهم إلا قِيام عليه.
وأنّه لا يَحِلّ لِمُؤمن أقرَّ بِما في هَذه الصَّحيفَة أن يَنصُرَ مُحْدثاً ولا يُؤوِيه، وأنّه مَن نَصَرَهُ أو آواه فإنّ عَليه لَعنة اللهِ وغَضبَه يَوم القِيامة، ولا يُؤخَذ منه صَرف ولا عَدْل.
وأنَّكم مَهما اخْتلَفتُم فيه مِن شَيئ فإنَّ مَردّه إلى اللهِ عزّ وجلّ وإلى مُحمَّدٍ صلّى الله عليه وسلَّم".
আল্লাহর নামে যিনি অসীম দয়ালু ও অতীব করুণাময়।
‘এটা নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ হতে সম্পাদিত পত্র, যে পত্র কুরাইশদের ও ইয়াছরিবের (মদীনাহর) মুমিন মুসলিমগণ এবং যারা তাদের অনুগমন করেছে ও তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং তাদের সাথে জিহাদ করেছে; তাদের পরস্পরকে সংশ্লিষ্ট করবে।
মুসলিমরা অন্যদের বাদে এক উম্মত।
কুরাইশ গোত্রীয় মুহাজিরগণ তাদের নিজ অবস্থানে একে অপরের রক্তপণ (ইষড়ড়ফ গড়হবু) বহণ করবে। তারা তাদের মধ্যকার বন্দি মুমিনদের মুক্তিপণ (জধহংড়স) আদায় করবে সদাচরণ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। আনছারীগণের প্রত্যেক কবিলা তাদের অবস্থানে রক্তপণের দায়গ্রস্তদের রক্তপণ পরিশোধ করবে। তাদের প্রত্যেক দল তাদের মুমিন বন্দীদের মুক্তিপণ আদায় করবে সদাচরণ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে।
মুমিনগণ তাদের পরস্পরের কোন আর্থিক ভারী দায় ও বোঝা ফেলে রাখবে না বরং তা তারা দিয়ে দিবে; সে দায় বন্দিমুক্তি পণ ও রক্তপণ যে দায়ই হোক না কেন।
মুত্তাকীন মুমিনরা তার বিরুদ্ধে একট্টা হয়ে দাঁড়াবে যে তাদের উপর অক্রমণ করবে বা বড় ধরনের যুলুম, পাপাচার, সীমালঙ্ঘন ও ফাসাদের চেষ্টা করবে। তার বিরুদ্ধে তাদের সকলের হাত এক হাত হিসাবে গণ্য হবে (সমবেতভাবে প্রতিহত করবে), যদিও বা সে তাদের কারো পুত্রও হয়।
কোন কাফেরের জন্য কোন মুমিন আরেক মুমিনকে হত্যা করবে না আর কোন মুমিনের বিরুদ্ধে কোন কাফেরকে সাহায্য করবে না।
আল্লাহর যিম্মাদারী সকলের জন্য এক, মুসলিমদের সর্বনি¤œস্তরের ব্যক্তিও কাউকে আশ্রয় দেয়ার অধিকার রাখে (সুতরাং সে যদি কাউকে আশ্রয় দেয়, তাহলে সকলকে তা মেনে নিতে হবে)।
ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে যে আমাদের অনুসরণ করবে তার জন্য সহযোগিতা ও সামাজিক সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকবে, যুলুম, পরাভব ও প্রতিহিংসা বিহীনভাবে।
মুমিনদের সন্ধি বা শান্তিচুক্তি এক (সবার জন্য প্রযোজ্য)। আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে কোন মুমিন আরেক মুমিনকে বাদ দিয়ে শান্তি চুক্তি করবে না। বরং যখন তা করবে পারস্পরিক সমানাধিকার ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে করবে।
মুমিনগণ একে অপরের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে (তথা আশ্রয় দিবে ও নিবে) এই অধিকারে যে, তারা আল্লাহর পথে রক্ত ঝরিয়েছে।
মুত্তাকীন মুমিনরা উৎকৃষ্ট হেদায়াত ও বলিষ্ঠ পথ-পদ্ধতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
কোন মুশরিক কুরাইশদের কোন ব্যক্তিকে আশ্রয় দিবে না বা তার মালামাল সংরক্ষণের দায়িত্ব নিবে না। আর তাকে রক্ষার জন্য কোন মুমিনের সামনে প্রতিরোধ করবে না।
কেউ যদি কোন মুমিনকে অকারণে হত্যা করে এবং তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হবে। কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তির রক্তের দাবিদার (মৃত্যুদ- না দিতে) রাযি হয়, তাহলে মুত্যুদ- দেয়া হবে না। মুমিনরা এ বিষয়ে সবাই একমত থাকবে, তাদের জন্য এটা কার্যকর না করা বৈধ হবে না।
যে মুমিন ব্যক্তি এই পত্রের বিধান মেনে নিয়েছে তদুপরি আল্লাহর উপর এবং আখেরাতের উপর যথাযথভাবে ঈমান এনেছে তার জন্য কোন বিদ‘আতীকে সহযোগিতা করা ও আশ্রয় দেয়া হালাল (বৈধ) নয়। যদি কেউ বিদ‘আতীকে সাহায্য করে কিংবা আশ্রয় দেয়, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার উপর আল্লাহর লা‘নত (অভিশাপ) এবং গযব (ক্রোধ), তার কাছ থেকে কোন বিনিময় ও বদল গ্রহণ করা হবে না।
আর যে কোন বিষয়ে যখনই তোমরা কোন মতবিরোধ করবে বা বিবাদে উপনীত হবে, তা মীমাংসার জন্য প্রত্যাবর্তন করতে হবে আল্লাহর দিকে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিকে’।[৭]
উপরিউক্ত ভ্রাতৃচুক্তির মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় করার দ্বীনী কর্তব্যই শুধু ভেসে ওঠে না, বরং বিশে^র শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতার বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের অনন্য দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে। উল্লেখ্য যে, চুক্তিপত্রের ভাষা অতি সংক্ষিপ্ত, সুগভীর অর্থবহ এবং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যসম্বলিত।
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৬০৬৬ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৩ (শব্দের সামান্য তারতম্যের সাথে)।
[২]. ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ, ৩য় খ-, পৃ. ৬৪-৬৫; আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৩।
[৩]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৩।
[৪]. নাদভী, আস-সীরাহ আন-নাবাভিয়্যাহ, পৃ. ২৮২।
[৫]. নাওয়াত: পাঁচ দিরহাম মূল্যমানের স্বর্ণ। (আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৪)।
[৬]. দেখুন: বুখারী, হা/৩৯৩৭, মানাকিবুল আনছার, অধ্যায়: ৫০।
[৭]. আল্লামা আব্দুল মালেক ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাভিয়্যাহ, পৃ. ৩৫৩-৩৫৪; ইমাম ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খ-, ২৩৮-২৪০।
মু’মিন-মুসলিমগণ সবাই পরস্পর ভাই-ভাই। তাদের মধ্যে প্রধানতম সম্পর্ক হল ঈমানী-ভ্রাতৃত্বের। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَ اَخَوَیۡکُمۡ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ.
‘একান্তভাবেই মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু’পক্ষের (বিবদমান) ভাইদের মধ্যে সমঝোতা করে দাও এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের উপর রহমত নাযিল হয়’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১০)।
কোন অমুসলিম যদি তওবাহ করে ইসলাম গ্রহণ করে এবং মৌলিক আমলগুলোতে যতœবান হয়, তাহলে তার জাত-পাত-বংশ-অতীত কিছুই না দেখে সরাসরি তাকে ভাই হিসাবে গভীর আন্তরিকতার সাথে নিঃসঙ্কোচে মুসলিম সমাজে গ্রহণ করে নিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
فَاِنۡ تَابُوۡا وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ فَاِخۡوَانُکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ نُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ .
‘অতঃপর তারা যদি তওবাহ করে এবং সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনের অন্তর্গত ভাই। আর আমরা আয়াতগুলোকে বিবৃত করে থাকি সেই কওমের জন্য, যারা জানে’ (সূরা আত-তওবাহ : ১১)।
মুমিনদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতা আল্লাহ্র দেয়া এক বিরাট নে‘য়ামত (অনুগ্রহ)। ঐক্যের উপর ভিত্তি করে ভ্রাতৃত্ব যেমন দৃশ্যমান হয়, তেমনই আবার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মযবুত হলে ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী ও অটুট হয়। রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِہٖۤ اِخۡوَانًا وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡہَا کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ.
‘আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (কুরআন-সুন্নাহ) সকলে মিলে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ে যেও না এবং তোমরা স্মরণ কর তোমাদের উপর আল্লাহর নে‘য়ামতকে যখন তোমরা এক অপরের শত্রু ছিলে অতঃপর তিনি তোমাদের আত্মাগুলোর মধ্যে মিলন সংঘটিত করে দিলেন, ফলতঃ তোমরা তাঁরই অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা অগ্নিকু-ের কিনারায় অবস্থান করছিলে, তিনি তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা হেদায়াত লাভ করতে পার’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
ইসলামী সাংগঠনের কর্মীদের ক্ষেত্রে এই ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক আরো গভীর আরো নিবিড়। কেননা তাঁরা হলেন সমাজের অধিকতর সচেতন ও দায়িত্বশীল মানুষ। সার্বিক বিচরণ ক্ষেত্রে তাদের আচরণভঙ্গি মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কীভাবে মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের আহ্বান আরো ব্যাপক হয় এবং এর বন্ধন আরো সৃদৃঢ় হয় Ñ তাদের চালচলন ও কর্মসূচির মধ্যে সেটা খুবই গুরুত্বের সাথে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন।
ভ্রাতৃত্বের মূল শিকড় হল ‘ইখলাছ’। ইখলাছের সাথে যা কিছুই করা হোক না কেন তা কখনো বিনষ্ট হয় না; বরং দুনিয়াতেও সফলতা লাভ করে আর আখেরাতের জন্যও সঞ্চিত থাকে। ইখলাছ না থাকাটাই সকল বিনষ্টের মূল। নিখাদ আন্তরিকতা, নিঃস্বার্থতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহায্য-সহযোগিতা, খোঁজ-খবর, আদান-প্রদান, অনুদান-অবদান, নিজ স্কন্ধে দায়িত্ব গ্রহণ, আপদ-বিপদে পাশে দ-ায়মান ইত্যাদি ভ্রাতৃত্বের বাহন।
এ গুণগুলোই যদি কোন সমাজের সদস্যদের মধ্যে না থাকে, তাহলে তাদের ভ্রাতৃত্বের বুলি শুধু মৌখিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবতার মুখ দেখে না। ভ্রাতৃত্বের গভীরতা ও আবেদন বন্ধুত্বের ঊর্ধ্বে; যদিও বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব একে অপরের সম্পূরক। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দুই মুসলিম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্বোধনের পরিভাষা হল ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ আর মুসলিম ও অমুসলিম রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্বোধনের পরিভাষা হল বন্ধুপ্রতীম দেশ ।
বলা বাহুল্য, আত্মম্ভরিতা, হামবড়াই, হিংসা-বিদ্বেষ, হীন স্বার্থপরতা, ধনলালসা, ক্ষমতালিপ্সা, পদলোভ, ব্যক্তিতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, আখের গোছানোর বাসনা, কপটতা, ধূর্ততা, সুযোগ সন্ধানী মানসিকতা, হীনমন্যতা ইত্যাদি নিয়ে কক্ষনো যথার্থ ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না; বরং হয় সাময়িক আনুষ্ঠানিকতা ও বাহ্যিক সামাজিকতা। শেষ পর্যায়ে এজাতীয় সমস্যায় জর্জরিত লোকদের সমন্বয়ে কোন বৃহত্তর কাজের পদক্ষেপ নেয়া তো দূরস্থান, কোন ক্ষুদ্রতর কাজে হাত দেয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। বাস্তবতা বিবর্জিত ভ্রাতৃত্বের দাবির মাধ্যমে কোন টেকসই আদর্শিক সমাজ গঠিত হয় না।
ভ্রাতৃত্ব কায়েম হওয়া ও তা টিকে থাকার জন্য শুধু কিছু গুণ থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং অনেকগুলো দোষ এড়িয়ে চলা কর্তব্য। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিমদেরকে এমন সব ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যেগুলো পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বকে নষ্ট করে দেয়। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ وَلَا تَحَسَّسُوْا وَلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا تَنَافَسُوْا وَلَا تَحَاسَدُوْا وَلَا تَبَاغَضُوْا وَلَا تَدَابَرُوْا وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا.
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা কুধারণা পরিহার কর। কেননা কুধারণা হল বড় মিথ্যা কথা। আর তোমরা একে অপরের দোষ খুঁজে বেড়িও না, পরস্পর গুপ্তচরবৃত্তি কর না, আড়াল থেকে ইঙ্গিত করে একে অপরের জিনিসের দাম বাড়িও না, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ কর না, একে অপরকে ঘৃণা কর না, একজন আরেকজন থেকে পিঠ ফিরিয়ে নিও না (দূরত্ব রচনা কর না), আর তোমরা পরস্পর আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও।[১]
প্রথম যুগের মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের মৌলিক সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল; নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেটিকে আবার আনুষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মদীনাহতে হিজরতের পরপরই। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন,
ثم آخَى رسولُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَين المُهاجِرين والأنصارِ في دارِ أنَس بن مالك وكانُوا تِسعين رَجلاً نِصفُهم من المُهاجرين ونِصفهُم من الأنصار؛ آخَى بَينهم على المُواساة....
‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাড়িতে মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে (আনুষ্ঠানিক) ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করলেন। তাঁরা ছিলেন ৯০ জন; যাদের মধ্যে অর্ধেক ছিলেন মুহাজির আর অর্ধেক ছিলেন আনছার। তিনি তাঁদের মধ্যে সহানুভূতি ও সহযোগিতার ভ্রাতৃত্ব তৈরি করলেন। এমনকি তারা পরস্পর ওয়ারিস হবেন এই ঘোষণাও দিলেন। বদরের যুদ্ধ পর্যন্ত এ ওয়ারিসের হুকুম বহাল থাকে। অতঃপর তাদের পস্পরের ওয়ারিস হওয়ার বিষয়টি কুরআন দ্বারা রহিত হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اُولُوا الۡاَرۡحَامِ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلٰی بِبَعۡضٍ فِیۡ کِتٰبِ اللّٰہِ اِنَّ اللّٰہَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ.
‘উলুল আরহামরা (রক্ত সম্পর্কীয় ও নিকট আত্মীয়রা) একে অপরের ক্ষেত্রে (ওয়ারিস প্রাপ্তির) অধিক হকদার আল্লাহর বিধানে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয় অধিক জানেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৭৫)। অতঃপর আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিতে ওয়ারিসের বিধান বহাল থাকে এবং আনুষ্ঠানিক ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে ওয়ারিস প্রাপ্তির বিধান রহিত হয়ে যায়।[২] এই আনুষ্ঠানিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব সম্পর্কে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলিম শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
ومَعنى هذا الإخاء أن تَذوبَ عَصبِيَّات الجاهلِيَّة وتَسقُطَ فَوارقَ النسبِ واللونِ والوَطَن؛ فلا يَكونُ أساسُ الوَلاء والبَراء إلا بالإسلام...
‘এই ভ্রাতৃত্বের মর্মার্থ হল, যাতে জাহেলিয়্যাতের গোঠবদ্ধতা বিলীন হয়ে যায় এবং বংশ, দেশ ও বর্ণভিত্তিক পার্থক্যগুলো মিটে যায়; আর (কারো সাথে) মিত্রতা ও বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি ইসলাম ছাড়া আর অন্য কিছু না থাকে। এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে অপরকে প্রাধান্য দেয়া, সহমর্মীতা ও আন্তরিক নৈকট্যের অনুভূতি বিশেষভাবে জাগ্রত হয় এবং এদিক থেকে নতুন (মদীনাহর ইসলামী) সমাজটি সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তে পরিণত হয়’।[৩]
আল্লামা আবুল হাসান আলী নাদভী এই ভ্রাতৃত্বের তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলেন,
وكانَ هذا الإخاء أساساً لإخاء إسلامِيِّ عالَميّ فَريد من نَوعه، ومُقدِّمة لِنَهضَة أمَّة ذاتِ دَعوةٍ ورِسالة، تَنطلِق لِصِياغة عالَم جَديد قائمٍ على عَقيدة صَحيحَة مُعيَّنة وأهدافٍ صالِحة مُنقِذة لِلعالَم من الشَّقاء والتَّناحُر والاِنتِحار وعلى عَلاقاتٍ جَديدة من الإيمان والإخاء المَعنَويِّ والعَمل المُشترِك. وكانَ هذا الإخاء المَحدُود بينَ المُهاجِرين والأنصار طَليعة وشَريطَة لِاستِئناف حَياةٍ جَديدةٍ في العالَم والإنسانيَّة؛ لِذلك خَاطبَ اللهُ هذه الحَفنةَ البَشريَّة في مَدينةٍ صَغيرةٍ بقوله:{وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ}.
‘এই ভ্রাতৃত্ব ছিল বিশ^ ইসলামী ভ্রাতৃত্বের এক মূল ভিত্তি; স্বীয় ক্ষেত্রে যার দৃষ্টান্ত অনন্য। এটি ছিল দাওয়াত ও রিসালতের ধারক-বাহক এক উম্মতের উত্থানের সূচনা। যে উম্মত নতুন দুনিয়া গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, যা প্রতিষ্ঠিত হবে নির্দিষ্ট সহীহ আকীদাহ’র উপর এবং সৎ উদ্দেশ্যে। যা জগতকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে রক্ষা করবে এবং পরস্পর মারামারি ও হত্যাকা- থেকে উদ্ধার করবে এবং ঈমান, আন্তরিক ভ্রাতৃত্ব ও সম্মিলিত কাজের নব-গঠিত সম্পর্কের উপর কায়েম থাকবে। আর মুহাজির ও আনছারীদের পরিসরে সীমাবদ্ধ এই ভ্রাতৃত্বের আনুষ্ঠানিকতা ছিল দুনিয়ায় মানবতা ও নতুন জীবনের এক প্রারম্ভের সূচনা ও শর্ত স্বরূপ। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা আয়তনে ছোট্ট শহরের (মদীনাহ) মধ্যে অবস্থিত সীমিত সংখ্যক (গুটি কতক) এই মানব-গোষ্ঠীকে আহ্বান করে বলছেন, ‘এবং যারা কুফরী করেছে তারা একে অপরের বন্ধু, আর যদি তোমরা (পরস্পরে) তা (বন্ধুত্ব) না কর, তাহলে যমীনে ফিতনা হবে ও মহা ফাসাদের সৃষ্টি হবে’ (সূরা আল-আনফাল : ৭৩)।[৪] সহীহুল বুখারীতেও এ ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে বিবরণ এসেছে,
باب كيف آخَى النَّبي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَين أصحابِه.
‘অধ্যায় : কীভাবে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে (আনুষ্ঠানিক) ভ্রাতৃত্ব গঠন করে ছিলেন’।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুর রহমান বিন আঊফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে সা‘দ ইবনুর রাবী’ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিলেন। তিনি তাঁর কাছে মালের অর্ধেক পরিমাণ ও স্ত্রীদের অর্ধেক সংখ্যক উপস্থাপন করলেন। তখন আব্দুর রাহমান বিন আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহ আপনার মাল ও পরিবারে বরকত দান করুন! আপনি আমাকে বাজারের সন্ধান দিন। অতঃপর তিনি বাজারে পনির ও ঘি কেনা-বেচা করে বেশ লাভবান হলেন। কিছুদিন পর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার হাতে মেহেদির হলুদ রং দেখতে পেয়ে বললেন, হে আব্দুর রহমান! তোমার ঘটনা কী? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আনছারীদের এক মেয়েকে বিয়ে করেছি। তিনি বললেন, তাকে বিয়েতে কী দিয়েছ? তিনি বললেন, ‘নাওয়াত’[৫] পরিমাণ স্বর্ণ দিয়েছি। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, একটি ছাগল বা ভেড়া যব্হ করে হলেও ওলীমা কর’।[৬]
আনছারীগণের সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর অর্থ এই নয় যে, মুহাজিরগণ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য তাদের উপর স্থায়ীভাবে নির্ভরশীল হয়ে আজীবন কাটিয়েছেনÑ না, তা আদৌ নয়। বরং হিজরতের প্রাথমিক ঝাপটা সামলে নেয়ার সাথে সাথে সবাই যার যার কর্মসংস্থানের দিকে মনোযোগী হয়েছেন। আনছারীদের মধ্যে কারো কারো একাধিক স্ত্রী থাকলে একজনকে ত্বালাক দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মুহাজির ভাই-এর বিয়ের জন্য, এর অর্থ এই নয় যে, এ উদ্দেশ্যে ত্বালাক দেয়ার ও বিয়ে করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বরং বিষয়টি এমন যে, তারা সকল প্রকার সর্বোচ্চ বৈধ ত্যাগ প্রদানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তৎকালীন আরবীয় সমাজে শুধু চারজন নয় বরং ডজনে ডজনে বিয়ে করার এবং যত্রযত্র যখন তখন ত্বালাক দেয়ার প্রচলন ছিল। এমনকি দাম্পত্য কর্তব্য আদৌ পালন না করে বিয়ের নামে কোন নারীকে যুগযুগ ধরে অত্যাচার করার নযীর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং কোন বিপদগ্রস্ত মুহাজির ভাইয়ের জন্য কারো কোন অতিরিক্ত স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দেয়ার প্রস্তাব করা তখন তেমন কোন অসঙ্গত কাজ ছিল না। কিন্তু যেনা, ব্যভিচার ও অবৈধ যৌনাচার সকল ধর্মে সকল সুসভ্য সমাজে ঘৃণিত কাজ ছিল। আর এ গর্হিত কাজগুলো মাক্কী জীবনেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ لِفُرُوۡجِہِمۡ حٰفِظُوۡنَ- اِلَّا عَلٰۤی اَزۡوَاجِہِمۡ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُمۡ فَاِنَّہُمۡ غَیۡرُ مَلُوۡمِیۡنَ- فَمَنِ ابۡتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡعٰدُوۡنَ.
‘আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গগুলোকে সংযত রাখে। কিন্তু তাদের নিজেদের স্ত্রীগণ এবং অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যতীত, এতে তারা নিন্দিত হবে না। আর যারা এগুলো ছাড়া অন্য কোন পথ কামনা করবে, তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী’ (সূরা আল-মুমিনূন : ৫-৭)। তিনি আরো নির্দেশ করেন,
وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّہٗ کَانَ فَاحِشَۃً وَ سَآءَ سَبِیۡلًا.
‘আর তোমরা যেনা-ব্যভিচারের ধারে কাছে যেও না, কেননা এটা হল গর্হিত কাজ এবং নিকৃষ্ট পন্থা’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২)। তিনি আরো ইরশাদ করেন,
وَ الَّذِیۡنَ لَا یَدۡعُوۡنَ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ وَ لَا یَقۡتُلُوۡنَ النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ لَا یَزۡنُوۡنَ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ یَلۡقَ اَثَامًا- یُّضٰعَفۡ لَہُ الۡعَذَابُ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ یَخۡلُدۡ فِیۡہٖ مُہَانًا.
‘আর তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহকে ডাকে না এবং তারা আল্লাহ যাকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করে না যথার্থ হক্ব কারণ ব্যতীত এবং তারা যেনা-ব্যভিচার করে না। আর যে ব্যক্তি এগুলো করে সে পাপের শাস্তি ভোগ করবে। ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সে স্থায়ীভাবে হীন পরিস্থিতিতে থাকবে’ (সূরা আল-ফুরক্বান : ৬৮-৬৯)।
এগুলো সবই মাক্কায় অবতীর্ণ আয়াত। বিয়ে ও ত্বালাকের বিস্তারিত বিধিবিধান মদীনাতে অবতীর্ণ হয় এবং পারিবারিক ও সামাজিক বিধিবিধান সর্বোচ্চ মার্জিতরূপ ও উৎকৃষ্টতা লাভ করে। পরবর্তীতে অপরের বিয়ের সুবিধার্থে ইচ্ছাপূর্বক নিজ বৈধ স্ত্রীকে ত্বালাক দেয়ার প্রস্তাবনার ঘটনা আর ঘটেনি। ওটি ছিল তৎকালীন সমাজের বৈধ প্রচলনের সাথে সঙ্গতি রেখে উপস্থিত সমস্যার মানবিক ও নৈতিক সমাধানের একটি পথ মাত্র।
‘হিজরত’ ও ‘রিফিউযী’ সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত ইসলাম দেখিয়েছে ও শিখিয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে নযীরবিহীন। মানবতা বিবর্জিত নব্য জাহিলিয়্যাতের সমাজে কত দেশ শুধু কথিত ধর্ম ও বর্ণবৈষম্যকে কেন্দ্র করে কত নারী-শিশুকে ঘরছাড়া করছে, পথে ঘাটে যেখানে সেখানে নির্বিচারে কত বানী আদমকে হত্যা করছে, অনাহারে অর্ধাহারে খোলা আকাশের নীচে তাদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। কবে কোন্ দিন তারা তাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরতে পারবে তার কোন হদীস নেই। বহু কথিত সভ্য ও ধনাঢ্য দেশ সহযোগিতার হাত বাড়াতে কুন্ঠিত হচ্ছে। কেউ কেউ নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে পাশ কাটাচ্ছে। রাজনৈতিক সমস্যা ও কূটনৈতিক আচারের অজুহাতে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেশান্তরিত হওয়া মানুষগুলোকে কত দেশের সীমান্তে আটকে দেয়া হচ্ছে বা মৃত্যুপুরীতে আবার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে নিগৃহীত হওয়ার জন্য। যারা দু’দিন আগেও নিজ দেশে স্বাধীন ও স্বচ্ছল জীবন-যাবন করত। আজ তারা পরাধীন, নিঃস্ব, অচল, অসাড় হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক হিজরত এবং আন্তর্জাতিক আশ্রয় সংক্রান্ত সংস্থাগুলো তো এই সেদিন প্রতিষ্ঠিত হল। এ সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু এগুলোর পরিধি, কার্যক্রম ও কর্মক্ষমতা আরো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন। বিশে^র বর্বরদের অত্যাচারের তুলনায় এগুলোর পরিধি ও প্রতিকারের ক্ষমতা খুবই অপ্রতুল। কেননা বহু শর্তসাপেক্ষে বিতাড়িত নিগৃহীত গৃহত্যাগীদের কাছে কিছু কিছু মানবিক সাহায্য-সহযোগিতাই শুধু পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে, আর কিছু নয়। হিজরতের (সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রি.) পর আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ শত বছর আগে ইসলাম এ বিষয়ে মানবতা, ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ মৌলিক বিধিবিধান পেশ করেছে এবং যথাযথভাবে অনুশীলন ও কার্যকর করে দেখিয়ে দিয়েছে।
দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে যারা হিজরত করে আরেক দেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বসবাস করেন তাদের ক্ষেত্রে ইসলামী পরিভাষা সরাসরি ‘রিফিউযি’, ‘শরণার্থী’ ইত্যাদি নয়; বরং তাদের ক্ষেত্রে পরিভাষা হল ‘মুহাজির’। আর যাদের কাছে হিজরত করে যাওয়া হয় তাদেরকে স্থায়ী আশ্রয়দাতা বলা হয়নি, বরং সাময়িক আশ্রয়দাতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের পদবী হল ‘আনছার’ (সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানকারী)। কেননা তাঁরা দুনিয়ার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সে দেশের প্রথম ও স্থায়ী মালিকানার অধিকারী নন, বরং তারা তুলনামূলকভাবে আগে সে দেশের বাসিন্দা বা নাগরিক হয়েছেন মাত্র। তাই কুরআন আনছারীগণকে বলছে, ‘তারা মদীনাহতে মুহাজিরদের আগে বসতি স্থাপন করেছে’ (সূরা আল-হাশর : ৯)।
অর্থাৎ মদীনাহ’র ক্ষেত্রে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে বসবাসের দিক থেকে পার্থক্য ছিল শুধু Ñ এক দল আগে বসতি স্থাপন করেছে আরেক দল পরে। যদিও ‘হাবাশাহ’-এর হিজরতের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। কেননা হাবাশাহ’র জনসাধারণ তখন ইসলাম গ্রহণ করেনি।
বিশে^র সম্ভ্রান্ত-জাহেলরা তাদের কল্পিত প্রতিপক্ষ লোকদেরকে যুগযুগ বসবাসকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও বলছে, ওরাতো এ দেশের বাসিন্দা নয়, ওরা তো বহিরাগত। সুতরাং ওদেরকে বের করে দাও। মুসলিম হলে তো তাদেরকে বহিষ্কার ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোন কথাই নেই। সম্প্রতি ভারত সরকার এ বিষয়ে ‘এন আর সি’ নামে বর্বরতার এক নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ ভারতে কথিত হিন্দু আর্যদের আগমন ৫০০০ হাজার বছরের আগে নয়। এখন তাদের আগের বাসিন্দারা যদি বলে, তোমরাও এদেশের আদি বাসিন্দা নও। সুতরাং বের হয়ে যাওÑ সেটা কি অমূলক হবে? তবে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের এই অমানবিক বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহল থেকে প্রচ- প্রতিবাদের ঝড়ও উঠেছে Ñতাদেরকে কায়মনোবাক্যে ধন্যবাদ। আমেরিকাতে কিছু স্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যাকা- বর্ণবাদি নাগরিক বৈষম্যের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমারের (বার্মার) বর্বররা সেদেশে শত শত বছর যাবৎ স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আরাকানী (রাখাইনী/রোহিঙ্গা) মুসলিমদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে, তাদের বাড়ীঘরে অগ্নি সংযোগ করছে, তাদেরকে সাগরে ভাসিয়ে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে, মহিলাদের ইয্যত-সম্ভ্রম নষ্ট করছে, নারী-শিশুদের আহাজারীতে আকাশ-বাতাস বাষ্পীভূত হয়ে উঠেছে। সে দেশের কম ও বেশি ১৪ লক্ষ মুসলিম নারী-শিশু-পুরুষ বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কবে তাদের সমস্যার সমাধান হবে, কবে তারা তাদের নিজেদের দেশে বৈধ নাগরিকের স্বীকৃতি নিয়ে স্বসম্মানে ফিরে যেতে পারবে Ñতা কেউ বলা তো দূরস্থান, আভাস ইঙ্গীতও দিতে পারছে না।
মুসলিমরা যাতে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃদৃঢ় করার ও তা অব্যাহত রাখার সাথে সাথে এর বিশেষ মর্মার্থগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, সে জন্য এ সম্পৃক্ত কয়েকটি আয়াত উপস্থাপন করা সঙ্গত মনে করছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ ہَاجَرُوۡا وَ جٰہَدُوۡا بِاَمۡوَالِہِمۡ وَ اَنۡفُسِہِمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ الَّذِیۡنَ اٰوَوۡا وَّ نَصَرُوۡۤا اُولٰٓئِکَ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یُہَاجِرُوۡا مَا لَکُمۡ مِّنۡ وَّلَایَتِہِمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ حَتّٰی یُہَاجِرُوۡا وَ اِنِ اسۡتَنۡصَرُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ فَعَلَیۡکُمُ النَّصۡرُ اِلَّا عَلٰی قَوۡمٍۭ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَہُمۡ مِّیۡثَاقٌ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ - وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بَعۡضُہُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ اِلَّا تَفۡعَلُوۡہُ تَکُنۡ فِتۡنَۃٌ فِی الۡاَرۡضِ وَ فَسَادٌ کَبِیۡرٌ-وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ ہَاجَرُوۡا وَ جٰہَدُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ وَ الَّذِیۡنَ اٰوَوۡا وَّ نَصَرُوۡۤا اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡۢ بَعۡدُ وَ ہَاجَرُوۡا وَ جٰہَدُوۡا مَعَکُمۡ فَاُولٰٓئِکَ مِنۡکُمۡ وَ اُولُوا الۡاَرۡحَامِ بَعۡضُہُمۡ اَوۡلٰی بِبَعۡضٍ فِیۡ کِتٰبِ اللّٰہِ اِنَّ اللّٰہَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ.
‘নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং হিজরত করেছে এবং আল্লাহ্র পথে তাদের মালগুলো এবং জানসমূহ দিয়ে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে এবং সাহায্য করেছে, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করেনি তাদের হিজরত করার আগ পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্ব করার দায়িত্ব তোমাদের নেই। আর যদি তারা দ্বীন সংক্রান্ত বিষয়ে তোমাদের সাহায্য চায়, তাহলে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। কিন্তু এমন সম্প্রদায় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়। আর তোমরা যা কর তা আল্লাহ সম্যক দ্রষ্টা। এবং যারা কুফুরী করেছে তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু; যদি তোমরা তা (মুমিনদের পরস্পর বন্ধুত্ব সুদৃঢ় ও কাফিরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন) না কর, তাহলে যমীনে ফিতনা হবে ও মহা বিপর্যয় দেখা দিবে। আর যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন; তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক জীবিকা। আর যারা পরে ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং তোমাদের সঙ্গে থেকে জিহাদ করেছে তারাও তোমাদের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহর বিধানে (রক্ত-সম্পর্কীয়) আত্মীয়গণ পরস্পরে অন্যের চাইতে (সম্পদের ওয়ারিসের) বেশি হক্দার। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে অধিক জানেন’ (সূরা আল-আনফাল : ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫)। এ আয়াতগুলোর সাথে সূরা আল-হাশরের ৮ ও ৯ নং আয়াত মিলিয়ে পড়ে নিলে বক্ষ্যমাণ বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لِلۡفُقَرَآءِ الۡمُہٰجِرِیۡنَ الَّذِیۡنَ اُخۡرِجُوۡا مِنۡ دِیَارِہِمۡ وَ اَمۡوَالِہِمۡ یَبۡتَغُوۡنَ فَضۡلًا مِّنَ اللّٰہِ وَ رِضۡوَانًا وَّ یَنۡصُرُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الصّٰدِقُوۡنَ- وَ الَّذِیۡنَ تَبَوَّؤُ الدَّارَ وَ الۡاِیۡمَانَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ یُحِبُّوۡنَ مَنۡ ہَاجَرَ اِلَیۡہِمۡ وَ لَا یَجِدُوۡنَ فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ حَاجَۃً مِّمَّاۤ اُوۡتُوۡا وَ یُؤۡثِرُوۡنَ عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِہِمۡ خَصَاصَۃٌ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِہٖ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ.
‘(এই ‘ফাইয়’ বা যুদ্ধবিহীনভাবে প্রাপ্ত সম্পদ) অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ী ও সম্পদাদি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এমতাবস্থায় যে, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে সহযোগিতা করে, তারাই হল সত্যাশ্রয়ী। আর তাদের (আনছারদের) জন্যও যারা (এই নগরীতে) বসবাস স্থাপন করেছে তাদের (মুহাজিরদের) পূর্বে এবং ঈমান এনেছে। তারা তাদের কাছে যারা হিজরত করে এসেছে তাদেরকে ভালবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্য অন্তরে কোন কামনা পোষণ করে না। আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয় যদিও তাদের অভাবগ্রস্ত রয়েছে এবং যাদরেকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই হল সফলকাম’ (সূরা আল-হাশর : ৮-৯)।
মদীনায় নতুন সমাজ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় মুহাজির ও আনছারীগণের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টির সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাঁদের ও সকল মুসলিমের মধ্যে সামাজিক চুক্তি সম্পাদন। অপরদিকে সেখানকার অমুসলিম বাসিন্দা এবং বিশেষভাবে ইয়াহুদীদের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তিপত্র লিপিবদ্ধকরণ। মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের ওয়াদানামা খুব সংক্ষিপ্তভাবে নি¤œরূপ :
بسم الله الرحمن الرحيم.
هَذا كِتاب مِن مُحمَّد النبيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كِتاباً بَين المُؤمِنين والمُسلِمين من قُرَيش ويَثْرِب ومَن تَبِعَهُم فلَحِقَ بِهم وجاهَدَ مَعهُم :
أنّهُم أمَّة واحِدةٌ من دُونِ النَّاسِ.
المُهاجِرُون من قُريش عَلى رِبعَتِهم يَتَعاقَلُون بَينَهُم، وهُم يَفدُون عانِيهِم بالمَعرُوفِ والقِسطِ بَين المُؤمنِين. وكلُّ قَبيلَة من الأنصارِ على رِبعَتِهم يَتَعاقلُون مَعاقِلِهُم الأولى وكُلّ طائفَةٍ مِنهُم تَفدِي عانِيْها بالمَعرُوفِ والقِسطِ بينَ المُؤمِنِين.
وأنّ المُؤمنِين لايَترُكُون مُفرَحاً بَينهُم أن يُعطُوه بالمَعروفِ في فِداء أو عَقل.
وأنّ المُؤمنين المُتَّقين على مَن بَغَى عَليهم أو ابْتَغَى دَسِيعة ظُلم أو إِثم أو عُدوان أو فَساد بين المُؤمنين. وأنّ أَيديهِم عليه جَميعاً ولَو كان وَلَد أحدِهم.
ولا يَقتُلُ مُؤمن مُؤمناً في كافِر ولا يَنصُرُ كافراً على مُؤمِن.
وأنّ ذِمَّةَ اللهِ واحِدة يُجير علَيهِم أَدناهُم.
وأنَّ مَن تَبِعَنا من اليَهود فأنّ له النَّصرَ والأُسوة، غير مَظلُومِين ولا مُتَناصِرين عَليهم.
وأنّ سِلمَ المُؤمِنين واحِد، لايُسالِمُ مُؤمن دُون مُؤمِن في قِتال في سَبيلِ اللهِ إلا على سَواءٍ وعَدلٍ بَينَهم.
وأنّ المُؤمنين يُبيئ بعضُهم على بَعض بِما نالَ دِماءهم في سبيلِ الله.
وأنَّ المُؤمِنين المُتَّقِين علَى أحسَن هُدى وأقوَمه.
وأنّه لا يُجير مُشرِك مَالاً لِقُريش ولا نَفساً، ولا يَحُولُ دُونَه على مُؤمن.
وأنّه من اعْتَبَطَ مُؤمناً قتلاً عن بيِّنَة فإنّه قُودَ بِه، إلّا أن يَرضَى وَلِيُّ المَقتُول.
وأنّ المُؤمنين عَليه كافّة، ولا يَحلُّ لَهم إلا قِيام عليه.
وأنّه لا يَحِلّ لِمُؤمن أقرَّ بِما في هَذه الصَّحيفَة أن يَنصُرَ مُحْدثاً ولا يُؤوِيه، وأنّه مَن نَصَرَهُ أو آواه فإنّ عَليه لَعنة اللهِ وغَضبَه يَوم القِيامة، ولا يُؤخَذ منه صَرف ولا عَدْل.
وأنَّكم مَهما اخْتلَفتُم فيه مِن شَيئ فإنَّ مَردّه إلى اللهِ عزّ وجلّ وإلى مُحمَّدٍ صلّى الله عليه وسلَّم".
আল্লাহর নামে যিনি অসীম দয়ালু ও অতীব করুণাময়।
‘এটা নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ হতে সম্পাদিত পত্র, যে পত্র কুরাইশদের ও ইয়াছরিবের (মদীনাহর) মুমিন মুসলিমগণ এবং যারা তাদের অনুগমন করেছে ও তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং তাদের সাথে জিহাদ করেছে; তাদের পরস্পরকে সংশ্লিষ্ট করবে।
মুসলিমরা অন্যদের বাদে এক উম্মত।
কুরাইশ গোত্রীয় মুহাজিরগণ তাদের নিজ অবস্থানে একে অপরের রক্তপণ (ইষড়ড়ফ গড়হবু) বহণ করবে। তারা তাদের মধ্যকার বন্দি মুমিনদের মুক্তিপণ (জধহংড়স) আদায় করবে সদাচরণ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। আনছারীগণের প্রত্যেক কবিলা তাদের অবস্থানে রক্তপণের দায়গ্রস্তদের রক্তপণ পরিশোধ করবে। তাদের প্রত্যেক দল তাদের মুমিন বন্দীদের মুক্তিপণ আদায় করবে সদাচরণ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে।
মুমিনগণ তাদের পরস্পরের কোন আর্থিক ভারী দায় ও বোঝা ফেলে রাখবে না বরং তা তারা দিয়ে দিবে; সে দায় বন্দিমুক্তি পণ ও রক্তপণ যে দায়ই হোক না কেন।
মুত্তাকীন মুমিনরা তার বিরুদ্ধে একট্টা হয়ে দাঁড়াবে যে তাদের উপর অক্রমণ করবে বা বড় ধরনের যুলুম, পাপাচার, সীমালঙ্ঘন ও ফাসাদের চেষ্টা করবে। তার বিরুদ্ধে তাদের সকলের হাত এক হাত হিসাবে গণ্য হবে (সমবেতভাবে প্রতিহত করবে), যদিও বা সে তাদের কারো পুত্রও হয়।
কোন কাফেরের জন্য কোন মুমিন আরেক মুমিনকে হত্যা করবে না আর কোন মুমিনের বিরুদ্ধে কোন কাফেরকে সাহায্য করবে না।
আল্লাহর যিম্মাদারী সকলের জন্য এক, মুসলিমদের সর্বনি¤œস্তরের ব্যক্তিও কাউকে আশ্রয় দেয়ার অধিকার রাখে (সুতরাং সে যদি কাউকে আশ্রয় দেয়, তাহলে সকলকে তা মেনে নিতে হবে)।
ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে যে আমাদের অনুসরণ করবে তার জন্য সহযোগিতা ও সামাজিক সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকবে, যুলুম, পরাভব ও প্রতিহিংসা বিহীনভাবে।
মুমিনদের সন্ধি বা শান্তিচুক্তি এক (সবার জন্য প্রযোজ্য)। আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে কোন মুমিন আরেক মুমিনকে বাদ দিয়ে শান্তি চুক্তি করবে না। বরং যখন তা করবে পারস্পরিক সমানাধিকার ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে করবে।
মুমিনগণ একে অপরের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে (তথা আশ্রয় দিবে ও নিবে) এই অধিকারে যে, তারা আল্লাহর পথে রক্ত ঝরিয়েছে।
মুত্তাকীন মুমিনরা উৎকৃষ্ট হেদায়াত ও বলিষ্ঠ পথ-পদ্ধতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
কোন মুশরিক কুরাইশদের কোন ব্যক্তিকে আশ্রয় দিবে না বা তার মালামাল সংরক্ষণের দায়িত্ব নিবে না। আর তাকে রক্ষার জন্য কোন মুমিনের সামনে প্রতিরোধ করবে না।
কেউ যদি কোন মুমিনকে অকারণে হত্যা করে এবং তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হবে। কিন্তু যদি মৃত ব্যক্তির রক্তের দাবিদার (মৃত্যুদ- না দিতে) রাযি হয়, তাহলে মুত্যুদ- দেয়া হবে না। মুমিনরা এ বিষয়ে সবাই একমত থাকবে, তাদের জন্য এটা কার্যকর না করা বৈধ হবে না।
যে মুমিন ব্যক্তি এই পত্রের বিধান মেনে নিয়েছে তদুপরি আল্লাহর উপর এবং আখেরাতের উপর যথাযথভাবে ঈমান এনেছে তার জন্য কোন বিদ‘আতীকে সহযোগিতা করা ও আশ্রয় দেয়া হালাল (বৈধ) নয়। যদি কেউ বিদ‘আতীকে সাহায্য করে কিংবা আশ্রয় দেয়, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার উপর আল্লাহর লা‘নত (অভিশাপ) এবং গযব (ক্রোধ), তার কাছ থেকে কোন বিনিময় ও বদল গ্রহণ করা হবে না।
আর যে কোন বিষয়ে যখনই তোমরা কোন মতবিরোধ করবে বা বিবাদে উপনীত হবে, তা মীমাংসার জন্য প্রত্যাবর্তন করতে হবে আল্লাহর দিকে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিকে’।[৭]
উপরিউক্ত ভ্রাতৃচুক্তির মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় করার দ্বীনী কর্তব্যই শুধু ভেসে ওঠে না, বরং বিশে^র শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতার বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের অনন্য দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে। উল্লেখ্য যে, চুক্তিপত্রের ভাষা অতি সংক্ষিপ্ত, সুগভীর অর্থবহ এবং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যসম্বলিত।
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৬০৬৬ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৩ (শব্দের সামান্য তারতম্যের সাথে)।
[২]. ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ, ৩য় খ-, পৃ. ৬৪-৬৫; আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৩।
[৩]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৩।
[৪]. নাদভী, আস-সীরাহ আন-নাবাভিয়্যাহ, পৃ. ২৮২।
[৫]. নাওয়াত: পাঁচ দিরহাম মূল্যমানের স্বর্ণ। (আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৪)।
[৬]. দেখুন: বুখারী, হা/৩৯৩৭, মানাকিবুল আনছার, অধ্যায়: ৫০।
[৭]. আল্লামা আব্দুল মালেক ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাভিয়্যাহ, পৃ. ৩৫৩-৩৫৪; ইমাম ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৩য় খ-, ২৩৮-২৪০।
-ড. মুহাম্মাদ মুসলেহুদ্দীন
Last edited: