মতবাদবিক্ষুব্ধ অশান্ত পৃথিবীতে ইসলামী পুনর্জাগরণ নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে মানবতার সামনে উপস্থাপন করতে হলে শক্তিশালী কাঠামো ও যুক্তিগ্রাহ্য মূলনীতি অত্যাবশ্যক। আর উক্ত মূলনীতি হতে হবে পরীক্ষিত ও চূড়ান্ত। তাহলে তা হবে দীর্ঘস্থায়ী ও সুপ্রতিষ্ঠিত, যাকে লক্ষ্য করে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। উক্ত পরীক্ষিত ও চ্যালেঞ্জিং মূলনীতিই হল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদত্ত ও প্রদর্শিত কর্মকৌশল, যার দ্বারা তিনি তমসাচ্ছন্ন জাহেলিয়াতের ভিতকে গুঁড়িয়ে দিয়ে অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস পবিত্র অহিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘পুরুষ কিংবা নারীদের মধ্যে মুমিন হয়ে যে ব্যক্তি সৎকর্ম সম্পাদন করবে, অবশ্যই আমি তাকে আনন্দময় জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রদান করব’ (সূরা আন-নাহল : ৯৭)। উক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ প্রদত্ত শর্তগুলো বান্দা পূরণ করলে আল্লাহ তা‘আলা যেকোন সময় বিজয় দান করবেন। আর ইসলামী পুনর্জাগরণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে না।
ইসলামী পুনর্জাগরণ মানবতার জন্য কল্যাণের বার্তা নিয়ে হাযির হয়। নিপীড়িত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত মানুষ ইসলামী জাগরণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। যখন যে ভূখণ্ডে ইসলামের বিজয় সাধিত হয়েছে, তখন সর্বশ্রেণীর মানুষ তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেয়েছে। আসলে ইসলামের মূল দাবীই হল, আত্মমানবতার কল্যাণ সাধন ও শান্তির আবহ স্থায়ীকরণ। আল্লাহ বলেন,
‘তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছ না? অথচ অসহায় পুরুষ, নারী এবং শিশুরা বলছে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই অত্যাচারী অধিবাসীদের এলাকা থেকে বের করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পৃষ্ঠপোষক ও আপনার নিকট হতে একজন সাহায্যকারী প্রেরণ করুন’ (সূরা আন-নিসা : ৭৫)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন ইসলামের বিজয় সাধিত হয়, তখন সর্বদিকে নিরাপত্তা বিরাজ করে। পৃথিবীতে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ইসলামী পুনর্জাগরণ হয়ে উঠে বিশ্ব মানবতার গৌরব ও সৌভাগ্যের প্রতীক। এ জন্য কতিপয় সুদৃঢ় মূলনীতি অনুসরণ করেই এই পথে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমরা নিম্নে ১০টি মূলনীতি আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
মূলনীতির গুরুত্ব
কোন বিষয়ে আলোচনা পেশ করতে গিয়ে মূল পয়েন্টগুলো মূলনীতি হিসাবে পেশ করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। আলোচনাকে বোধগম্য ও সারগর্ভ করে উপস্থাপন করা এবং পাঠকদেরকে মনোযোগী করার জন্য এটি উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হি./১৭০৩-১৭৬২ খৃ.) উপমহাদেশে হাদীস ভিত্তিক জাগরণের জন্য অনেকগুলো মূলনীতি আলোচনা করেছেন। যেমন তিনি এক স্থানে বলেন,
‘তারা (পূর্ববর্তীগণ) যদি আল্লাহর কিতাবে সমাধান না পেতেন, তাহলে রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত গ্রহণ করতেন। সে সুন্নাত ফক্বীহদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকুক, বা নির্দিষ্ট কোন নগর বা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক কিংবা শুধু একটি মাত্র সনদে বর্ণিত হোক। সে হাদীসের উপর সাহাবীগণ এবং অন্যান্য বিদ্বানগণ আমল করে থাকুন অথবা না করে থাকুন’।[১]
অনুরূপ ইবনু হাযম আন্দালুসীও (৩৮৪-৪৫৬ হি.) তাঁর ‘আল-মুহাল্লা’ কিতাবে বেশকিছু মূলনীতি তুলে ধরেছেন। যেমন তিনি এক জায়গায় বলেন, ‘কোন বিষয়ে মানুষ মতভেদ করলে অথবা কোন মাসআলা নিয়ে কেউ বিতর্ক করলে কুরআন ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজিব। উক্ত দু’টি বস্তু ছাড়া অন্য কোনকিছুর দিকে প্রত্যাবর্তন করা যাবে না। মদীনাবাসী অথবা অন্য কোন শহরের অধিবাসীদের আমলের দিকে প্রত্যাবর্তন জায়েয হবে না। এর পক্ষে দলীল হল মহান আল্লাহর বক্তব্য- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক তাদের। তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিলে সেটাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। অতএব প্রমাণিত হল যে, বিতর্কের সময় আল্লাহর কালাম ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত ছাড়া অন্য কোনকিছুর দিকে প্রত্যাবর্তন করা বৈধ নয়। তাছাড়া রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত অন্য কারো কথার দিকে ফিরে যাওয়া হারাম। কারণ যে ব্যক্তি রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অপর কোন মানুষের উক্তির দিকে ফিরে যাবে, সে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে। কারণ আল্লাহর আদেশ ছিল শুধু তাঁর ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উক্তির দিকে ফিরে যাবে। বিশেষতঃ মহান আল্লাহর শর্ত হল, তাঁর এই কথা- ‘যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে থাক’।[২]
এছাড়া মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (১৭০৩-১৭৬১ খৃ.) সমাজ সংস্কারের জন্য পেশ করেছেন ‘তিনটি মূলনীতি’, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি শুরু করেছেন এভাবে-
‘আপনি জানুন! আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আমাদের জন্য ওয়াজিব হল চারটি বিষয় উপলব্ধি করা । প্রথমটি হল- জ্ঞান অর্জন করা। আর তা হল- দলীল সমূহের মাধ্যমে আল্লাহ, তাঁর নবী এবং দ্বীন ইসলামকে উপলব্ধি করা। দ্বিতীয়টি হল, ইলম অনুযায়ী আমল করা। তৃতীয়টি হল, তার দিকে দাওয়াত প্রদান করা। চতুর্থটি হল, কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা’।[৩] অতঃপর তিনি বলেন,
‘যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় কোন্ তিনটি মূলনীতি, যা উপলব্ধি করা মানুষের জন্য ওয়াজিব? তখন আপনি বলবেন, বান্দার উপলব্ধি করা ওয়াজিব তার প্রতিপালককে, তার দ্বীনকে এবং তার নবী (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে’।[৪] অতঃপর তিনি অতি সংক্ষেপে দলীলসহ মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। অনুরূপ আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ ও দ্বীনের মূলনীতি বিশারদ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন (১৯২৭-২০০১ খৃ.)ও ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য ১৪টি মূলনীতি পর্যালোচনা করেছেন।[৫] তাই কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক মূলনীতির গুরুত্ব অনেক বেশী। কারণ এতে সহজেই পাঠকের হৃদয়ে মুখ্য বিষয় রেখাপাত করে।
মূলনীতিসমূহের বিশ্লেষণ
ইসলামী পুনর্জাগরণের আলোচনায় আমরা যে সমস্ত মূলনীতি পেশ করতে চাচ্ছি, নিম্নে সেগুলোর বিশ্লেষণ উল্লেখ করা হল-
মূলনীতি-১ : নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর সামনে আত্মসমর্পণ
পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত অভ্রান্ত সংবিধান। মুসলিম হিসাবে এই সংবিধানের উপর বিশ্বাস রাখা এবং যথাযথভাবে সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করা ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তোমরা তারই অনুসরণ কর। তা ব্যতীত অন্য বন্ধুদের অনুসরণ কর না। তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা কোন মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করবে, সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)।
উক্ত আয়াতের মাধ্যমে কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য করা অপরিহার্য হয়ে যায়। এমনকি দুনিয়াবী জীবনে মুসলিম নেতৃত্বের আনুগত্য করার সময় যদি কোন ক্ষেত্রে তার সাথে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, তখনও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের দিকেই ফিরে যেতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক তাদের। তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মতভেদ হলে সেটাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক থেকে উত্তম’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)।
উক্ত প্রত্যাদেশের কারণ হল, কুরআন-সুন্নাহর সামনে আত্মসমর্পণের মধ্যেই মুসলিম জাগরণ নিহিত আছে। এ জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে বাক্য দ্বারা সর্বপ্রথম কুফর ও শিরকে নিমজ্জিত জাতিকে আহ্বান করেছিলেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রবী‘আহ ইবনু আব্বাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেলায় সমবেত লোকদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ বল, তাহলে তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে।[৬]
উক্ত তাওহীদী বার্তার মধ্যেই বিশ্ববিজয়ের সম্মোহনী শক্তি নিহিত রয়েছে। কারণ এ বাক্যের মাধ্যমেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াতকে পরাজিত করে ইসলামকে বিজয়ী করেছিলেন। সেই সাথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পৃথিবীর শেষাবধি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, মুসলিম উম্মাহ যতদিন কুরআন ও সুন্নাহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন তারা বিজয়ী বেশেই থাকবে। বিদায় হজ্জের ভাষণে মানব জাতিকে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,
‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের মধ্যে যা ছেড়ে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাক, তবে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল- আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত’।[৭]
তাই ইসলামী পুনর্জাগরণ কুরআন-সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। অন্যথা তা হবে অসার ও ভঙ্গুর। যেমন আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালিহ আল-উছায়মীন (১৯২৭-২০০১ খৃ.) বলেন, ‘আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা যে, এই পুনর্জাগরণ ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে এখন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, যেমনটি আমাদের কাছে সংবাদ আসছে। তবে এই পুনর্জাগরণ আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। কারণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত না হলে এই জাগরণ হবে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মত, যা নির্মাণের চেয়ে বিনাশই বেশী করবে। কিন্তু যদি তা কুরআন-সুন্নাহর দৃঢ় ভিত্তির উপর ভিত্তিশীল হয়, তবে মুসলিম উম্মাহসহ অন্যদের উপরও এর কার্যকরী প্রভাব পড়বে’।[৮] অতঃপর তিনি দৃঢ় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন,
‘নিশ্চয় মুসলিম উম্মাহ, শাসকগোষ্ঠী ও প্রজাসাধারণ যদি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্র বিধানের দিকে ফিরে আসত এবং কাফের সম্প্রদায়কে শত্রু আর মুমিনদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করত, তাহলে তারা পূর্ব থেকে পশ্চিম- সারা জাহানের মালিক হয়ে যেত’।[৯] মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯ খৃ./১৩৩৩-১৪২০ হি.) বলেন,
‘আমাদের মূলনীতি কুরআন-সুন্নাহ এবং আমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের অনুসরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, তাঁর ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িম এবং যারা তাঁদের মূলনীতির উপর পরিচালিত হয়েছেন, তাদের দাওয়াতের প্রভাবের উপর। যেমন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, যার প্রথম কৃতিত্ব হল তাওহীদী দাওয়াতের পুনর্জীবন দান করা’।[১০] ড. ইসরার আহমাদ বলেন,
“For this task as well, besides critical knowledge of contemporary world affairs and social sciences, a deep and sound understanding of the Qur’an and Sunnah is called for”.
‘আর এ কাজের জন্য সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ঘটনাবলী ও সামাজিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর গভীর ও পরিপূর্ণ বুঝ অপরিহার্য’।[১১]
অতএব কুরআন ও সুন্নাহর সামনে নিংশর্ত আত্মসমর্পণই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখানেই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তেমনি বিশ্ববিজয়ের চাবিকাঠিও এখানেই লুক্কায়িত আছে।
আত্মসমর্পণের দৃষ্টান্ত
কুরআন-সুন্নাহকে ভালবাসা আর বাস্তব জীবনে তার প্রতি আমল করা এক বিষয় নয়। তাই ইসলামের বিধি-বিধান বাস্তব জীবনে কার্যকর করতে হবে। তখনই সমাজের উপর ইসলাম প্রভাব বিস্তার করবে। আর যখন ইসলামের উপর থেকে আনুগত্যের ধারা প্রত্যাখ্যাত হবে, তখনই মুসলিম জাতির বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে যাবে। তাই সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে দ্বীনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন, ঠিক সেভাবে আমাদেরকেও করতে হবে। যেমন-
‘আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু ত্বালহার বাড়ীতে জনগণকে পানি পান করাচ্ছিলাম। সেদিন তাদের মদ ছিল অত্যন্ত দামী। এ সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আহ্বানকারীকে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি ঘোষণা কর, সাবধান! নিশ্চয় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তখন আবু ত্বালহা আমাকে বললেন, তুমি বের হও এবং মদ ঢেলে ফেল। তাই আমি বের হলাম এবং মদ ঢেলে ফেললাম। এতে মদীনার রাস্তায় মদের স্রোত প্রবাহিত হল। এ সময় কতিপয় লোক বলল, যাদের পেটে মদ রয়েছে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, এরূপ লোকদের উপর কোন গুনাহ নেই, যা তারা পানাহার করেছে’।[১২] অন্য একটি হাদীসে এসেছে,
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মদীনায় খুৎবা দিতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, হে মানবমণ্ডলী নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মদের ব্যাপারে বিধান পেশ করবেন। আল্লাহ এ বিষয়ে অচিরেই নির্দেশনা প্রদান করবেন। তাই যার কাছে মদের অবশিষ্ট কিছু আছে, সে যেন তা বিক্রি করে দেয় এবং তা থেকে উপকার লাভ করে। রাবী বলেন, কিছুদিন পরেই তিনি বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন। অতএব কারো কাছে মদ থাকা অবস্থায় যদি এই আয়াত পৌঁছে, তবে সে যেন তা পান না করে এবং বিক্রি না করে। অতঃপর যাদের কাছে মদ ছিল তারা মদীনার রাস্তার দিকে নিয়ে গেল এবং ঢেলে ফেলল’।[১৩]
উক্ত দু’টি হাদীস প্রমাণ করে আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম তার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন এবং আমল করেছেন। তাঁরা বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেননি। তাদের এই দ্বিধাহীন নিঃস্বার্থ আনুগত্যই ইসলামের অনুপম আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। অন্য হাদীসে এসেছে,
‘সালামা ইবনু আকওয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে খায়বারের দিকে বের হলাম। অতঃপর আল্লাহ মুসলিম বাহিনীর উপর বিজয় দান করলেন। বিজয়ের দিন তারা যখন সন্ধ্যায় উপনীত হলেন, তখন তারা অনেক চুলা জ্বালালেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কিসের জন্য আগুন জ্বালিয়েছ? তারা বললেন, গোশত রান্নার জন্য। তিনি বললেন, কিসের গোশত? তারা বললেন, গৃহপালিত গাধার গোশত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, গোশত ঢেলে ফেল এবং পাতিল ভেঙ্গে দাও। জনৈক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালআম)! আমরা গোশত ঢেলে ফেলি, আর পাত্র ধুয়ে নিই। তিনি বললেন, ঠিক আছে’।[১৪]
উক্ত হাদীসেও নির্ভেজাল খাঁটি আনুগত্যের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। সাহাবায়ে কেরাম ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থাতেও বিজয়ের দিন রান্না করা গোশত ফেলে দিতে একটু দ্বিধা করলেন না। অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন বের হলেন, তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লোকদের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, হে ওমর! আপনি বসুন। তিনি বসতে অস্বীকার করলেন। লোকেরা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট থেকে আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে আগমন করল। অতঃপর আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হামদ ও ছানার পর বললেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইবাদত করতে চায়, সে যেন জেনে নেয়, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, সে যেন জেনে রাখে আল্লাহ জীবিত, তিনি কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না। আল্লাহ বলেন, ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, সে কখনও আল্লাহ্র ক্ষতি করতে পারবে না। বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদেরকে পুরস্কৃত করবেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৪৪)।
রাবী বলেন, আল্লাহর শপথ! মানুষ যেন জানতই না আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছেন। অবশেষে আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আয়াতটি পাঠ করলেন। অতঃপর প্রত্যেকেই আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট থেকে এই আয়াত বুঝতে পারলেন। যে ব্যক্তিই এটি বেশী শুনেছে সেই পাঠ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, সাঈদ ইবনু মুসাইয়াব আমাকে বলেছেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহর কসম! আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছাড়া অন্য কারো কাছে এই আয়াত আমি শুনিনি। তখন আমি বুঝতে পারলাম। অবশেষে আমার দুই পা ফসকে গেল এবং মাটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, যখন বুঝতে পারলাম যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন’।[১৫]
তাঁদের আনুগত্যের স্পৃহা ছিল কত শক্তিশালী, কত গভীর! কুরআনের আয়াত পাওয়া মাত্রই সম্পূর্ণ পরিবেশটাই ঘুরে গেল। সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর এই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ মুসলিম উম্মাহকে আরো মুগ্ধ করেছে। নিম্নের হাদীসে আরো কঠিন আনুগত্যের কথা বর্ণিত হয়েছে,
‘বারা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করেন, তখন তিনি বায়তুল মাক্বদেসের দিকে মুখ করে ১৬ কিংবা ১৭ মাস সালাত আদায় করেন। তবে তিনি কা‘বার দিকে মুখ করে সালাত আদায়কে পসন্দ করতেন। তাই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, ‘নিশ্চয় আকাশের দিকে আপনার মুখমণ্ডল উত্তোলন করার দৃশ্য আমি অবলোকন করি। আমি আপনাকে ক্বিবলামুখীই করব, যা আপনি কামনা করছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪৪)।
একদা কা‘বার দিকে ক্বিবলা করে দেয়া হল। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে একজন সাহাবী আছরের সালাত আদায় করে আনছারীদের নিকট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর তিনি সাক্ষ্য দিলেন যে, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সালাত আদায় করেছেন, যখন কা‘বার দিকে ক্বিবলা পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। তখন তারা আছর সালাতে রুকূ‘ অবস্থায় কা‘বার দিকে ঘুরে গেলেন।[১৬]
আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা কী তা উক্ত বর্ণনায় ফুটে উঠেছে। হাদীস পাওয়া মাত্রই তারা কাল-বিলম্ব না করে রুকূ অবস্থাতেই ক্বিবলা পরিবর্তন করে নিলেন। এই ওয়াক্তের সালাত এভাবেই আদায় করি- এই চিন্তাটুকুও তাঁদের মধ্যে জাগেনি।
অতএব ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য অভ্রান্ত বিধানের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ অন্যতম প্রধান শর্ত। সাহাবায়ে কেরাম এই মূলনীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করার কারণেই বিশ্ববিজয়ের আহ্বান তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছিল।
তথ্যসূত্র :
[১] আল-ইমাম আহমাদ শাহ অলিউল্লাহ ইবনু আব্দুর রহীম আদ-দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১ম খণ্ড (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খৃ.), পৃ. ২৭৭।
[২]. আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনু আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু হাযম আল-আন্দালুসী আল-কুরতুবী আয-যাহিরী, আল-মুহাল্লা, ১ম খণ্ড (বৈরুত : দারুল ফিকর, তা.বি.), পৃ. ৫৫।
[৩] মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, আল-উছূলুছ ছালাছাহ (সঊদী আরব : আল-ইকাডিমিয়াইতুল ইলমিয়াহ, ১৪২৭ হি.), পৃ. ১।
[৪] আল-উছূলুছ ছালাছাহ, পৃ. ৩।
[৫] শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিছ আল-উছায়মীন, আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত (রিয়াদ : মাদারু ওয়াতান, ১৪২৬ হি.), পৃ. ৫৬।
[৬] আবুবকর মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনু খুযায়মাহ আস-সুলামী আন-নীসাপুরী, তাহক্বীক্ব : ড. মুছত্বফা আল-আ‘যামী, সহীহ ইবনে খুযায়মাহ, ১ম খণ্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৭০ খৃ./১৩৯০ হি.), পৃ. ৮২, হা/১৫৯।
[৭] মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল্লাহ আবু আব্দিল্লাহ আল-হাকিম আন-নায়সাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ সহীহাইন, ১ম খ- (রিয়াদ : দারুল মায়মান, ১৪৩৫ হি./২০১৪ খৃ.), পৃ. ২২২, হাদীস সংখ্যা-৩২২, ‘ইলম’ অধ্যায়।
[৮] আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত, পৃ. ৯।
[৯] আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত, পৃ. ১০।
[১০] মুহাম্মাদ হাস্সানাইন হাসান, হাস্সানাইন, তাজদীদুদ দ্বীন : মাফহূমুহু ওয়া যাওয়াবিতুহু ও আছারুহু (মাক্কা আল-মুকাররামাহ : ২০০৭ খৃ./১৪২৮ হি.), পৃ. ১৩৬।
[১১] Dr. Israr Ahmad, ISLAMIC RENAISSANCE : THE REAL TASK AHEAD (Lahore : MARKAZI ANJUMAN KHUDDAM-UL-QUR’AN, 2001), p. 28.
[১২] আল-বুখারী, সহীহুল বুখারী (কায়রো : দারুত তাক্বওয়া, ১৪৩৪ হি./২০১২ খৃ.), পৃ. ৩০৪, হাদীস সংখ্যা-২৪৬৪, ‘মাযালিম’ অধ্যায়, ‘রাস্তায় মদ ঢেলে ফেলা’ অনুচ্ছেদ-৩১; সূরা আল-মায়িদাহ : ৯৩।
[১৩] আল-ইমাম আল-হাফিয আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশায়রী আন-নায়সাপুরী, সহীহ মুসলিম (কায়রো : দারুত তাক্বওয়া, ১৪৩৪ হি./২০১২ খৃ.), পৃ. ৪৭৫, হাদীস সংখ্যা-১৫৭৮, ‘মুসাক্বাত’ অধ্যায়, ‘মদ বিক্রয় করা হারাম’ অনুচ্ছেদ-১২।
[১৪] সহীহ মুসলিম, পৃ. ৬০৩, হা/১৮০২, ‘শিকার ও যবহ’ অধ্যায়, গৃহ পালিত গাধার গোশত খাওয়া হারাম’ অনুচ্ছেদ-৫।
[১৫] সহীহুল বুখারী, পৃ. ৫৫২, হা/৪৪৫৪, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসুস্থতা ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ-৮৩।
[১৬] সহীহুল বুখারী, পৃ. ৮৮৫, হা/৭২৫২, ‘খবরে আহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১ এবং পৃ. ৬০, হা/৩৯৯, ‘সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩১।
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘পুরুষ কিংবা নারীদের মধ্যে মুমিন হয়ে যে ব্যক্তি সৎকর্ম সম্পাদন করবে, অবশ্যই আমি তাকে আনন্দময় জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রদান করব’ (সূরা আন-নাহল : ৯৭)। উক্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ প্রদত্ত শর্তগুলো বান্দা পূরণ করলে আল্লাহ তা‘আলা যেকোন সময় বিজয় দান করবেন। আর ইসলামী পুনর্জাগরণ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে না।
ইসলামী পুনর্জাগরণ মানবতার জন্য কল্যাণের বার্তা নিয়ে হাযির হয়। নিপীড়িত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত মানুষ ইসলামী জাগরণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। যখন যে ভূখণ্ডে ইসলামের বিজয় সাধিত হয়েছে, তখন সর্বশ্রেণীর মানুষ তাদের হারানো অধিকার ফিরে পেয়েছে। আসলে ইসলামের মূল দাবীই হল, আত্মমানবতার কল্যাণ সাধন ও শান্তির আবহ স্থায়ীকরণ। আল্লাহ বলেন,
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا
‘তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছ না? অথচ অসহায় পুরুষ, নারী এবং শিশুরা বলছে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই অত্যাচারী অধিবাসীদের এলাকা থেকে বের করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পৃষ্ঠপোষক ও আপনার নিকট হতে একজন সাহায্যকারী প্রেরণ করুন’ (সূরা আন-নিসা : ৭৫)।
আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন ইসলামের বিজয় সাধিত হয়, তখন সর্বদিকে নিরাপত্তা বিরাজ করে। পৃথিবীতে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ইসলামী পুনর্জাগরণ হয়ে উঠে বিশ্ব মানবতার গৌরব ও সৌভাগ্যের প্রতীক। এ জন্য কতিপয় সুদৃঢ় মূলনীতি অনুসরণ করেই এই পথে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমরা নিম্নে ১০টি মূলনীতি আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
মূলনীতির গুরুত্ব
কোন বিষয়ে আলোচনা পেশ করতে গিয়ে মূল পয়েন্টগুলো মূলনীতি হিসাবে পেশ করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। আলোচনাকে বোধগম্য ও সারগর্ভ করে উপস্থাপন করা এবং পাঠকদেরকে মনোযোগী করার জন্য এটি উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হি./১৭০৩-১৭৬২ খৃ.) উপমহাদেশে হাদীস ভিত্তিক জাগরণের জন্য অনেকগুলো মূলনীতি আলোচনা করেছেন। যেমন তিনি এক স্থানে বলেন,
فَإِذَا لَمْ يَجِدُوْا فِىْ كِتَابِ اللهِ أَخَذُوْا سُنَّةَ رَسُوْلِ اللهِ r سَوَاءً كَانَ مُسْتَفِيْضًا دَائِرًا بَيْنَ الْفُقَهَاءِ أَوْ يَكُوْنَ مُخْتَصًّا بِأَهْلِ بَلَدٍ أَوْ أَهْلِ بَيْتٍ أَوْ بِطَرِيْقٍ خَاصَّةٍ وَسَوَاءً عَمِلَ بِهِ الصَّحَابَةُ وَاْلفُقَهَاءُ أَوْ لَمْ يَعْمَلُوْا بِهِ
‘তারা (পূর্ববর্তীগণ) যদি আল্লাহর কিতাবে সমাধান না পেতেন, তাহলে রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত গ্রহণ করতেন। সে সুন্নাত ফক্বীহদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকুক, বা নির্দিষ্ট কোন নগর বা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক কিংবা শুধু একটি মাত্র সনদে বর্ণিত হোক। সে হাদীসের উপর সাহাবীগণ এবং অন্যান্য বিদ্বানগণ আমল করে থাকুন অথবা না করে থাকুন’।[১]
অনুরূপ ইবনু হাযম আন্দালুসীও (৩৮৪-৪৫৬ হি.) তাঁর ‘আল-মুহাল্লা’ কিতাবে বেশকিছু মূলনীতি তুলে ধরেছেন। যেমন তিনি এক জায়গায় বলেন, ‘কোন বিষয়ে মানুষ মতভেদ করলে অথবা কোন মাসআলা নিয়ে কেউ বিতর্ক করলে কুরআন ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজিব। উক্ত দু’টি বস্তু ছাড়া অন্য কোনকিছুর দিকে প্রত্যাবর্তন করা যাবে না। মদীনাবাসী অথবা অন্য কোন শহরের অধিবাসীদের আমলের দিকে প্রত্যাবর্তন জায়েয হবে না। এর পক্ষে দলীল হল মহান আল্লাহর বক্তব্য- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক তাদের। তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিলে সেটাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। অতএব প্রমাণিত হল যে, বিতর্কের সময় আল্লাহর কালাম ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত ছাড়া অন্য কোনকিছুর দিকে প্রত্যাবর্তন করা বৈধ নয়। তাছাড়া রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যতীত অন্য কারো কথার দিকে ফিরে যাওয়া হারাম। কারণ যে ব্যক্তি রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া অপর কোন মানুষের উক্তির দিকে ফিরে যাবে, সে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে। কারণ আল্লাহর আদেশ ছিল শুধু তাঁর ও তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উক্তির দিকে ফিরে যাবে। বিশেষতঃ মহান আল্লাহর শর্ত হল, তাঁর এই কথা- ‘যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে থাক’।[২]
এছাড়া মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (১৭০৩-১৭৬১ খৃ.) সমাজ সংস্কারের জন্য পেশ করেছেন ‘তিনটি মূলনীতি’, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি শুরু করেছেন এভাবে-
اِعْلَمْ رَحِمَكَ اللهُ أَنَّهُ يَجِبُ عَلَيْنَا تَعَلُّمُ أَرْبَعَ مَسَائِلَ اَلْمَسْأَلَةُ الْأُوْلَى اَلْعِلْمُ وَهُوَ مَعْرِفَةُ اللهِ وَمَعْرِفَةُ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعْرِفَةُ دِيْنِ الْإِسْلامِ بالْأَدِلَّةِ اَلْمَسْأَلَةُ الثَّانِيَةُ اَلْعَمَلُ بِهِ. اَلْمَسْأَلَةُ الثَّالِثَةُ الدَّعْوَةُ إِلَيْهِ. اَلْمَسْأَلَةُ الرَّابِعَةُ الصَّبْرُ عَلَى الْأَذَى فِيْهِ
‘আপনি জানুন! আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আমাদের জন্য ওয়াজিব হল চারটি বিষয় উপলব্ধি করা । প্রথমটি হল- জ্ঞান অর্জন করা। আর তা হল- দলীল সমূহের মাধ্যমে আল্লাহ, তাঁর নবী এবং দ্বীন ইসলামকে উপলব্ধি করা। দ্বিতীয়টি হল, ইলম অনুযায়ী আমল করা। তৃতীয়টি হল, তার দিকে দাওয়াত প্রদান করা। চতুর্থটি হল, কষ্টে ধৈর্য ধারণ করা’।[৩] অতঃপর তিনি বলেন,
فَإِذَا قِيْلَ لَكَ مَا الْأُصُوْلُ الثَّلاثَةُ الَّتِىْ يَجِبُ عَلَى الْإِنْسَانِ مَعْرِفَتُهَا؟ فَقُلْ مَعْرِفَةُ الْعَبْدِ رَبَّهُ وَدِيْنَهُ وَنَبِيَّهُ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় কোন্ তিনটি মূলনীতি, যা উপলব্ধি করা মানুষের জন্য ওয়াজিব? তখন আপনি বলবেন, বান্দার উপলব্ধি করা ওয়াজিব তার প্রতিপালককে, তার দ্বীনকে এবং তার নবী (ছাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে’।[৪] অতঃপর তিনি অতি সংক্ষেপে দলীলসহ মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। অনুরূপ আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ ও দ্বীনের মূলনীতি বিশারদ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন (১৯২৭-২০০১ খৃ.)ও ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য ১৪টি মূলনীতি পর্যালোচনা করেছেন।[৫] তাই কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক মূলনীতির গুরুত্ব অনেক বেশী। কারণ এতে সহজেই পাঠকের হৃদয়ে মুখ্য বিষয় রেখাপাত করে।
মূলনীতিসমূহের বিশ্লেষণ
ইসলামী পুনর্জাগরণের আলোচনায় আমরা যে সমস্ত মূলনীতি পেশ করতে চাচ্ছি, নিম্নে সেগুলোর বিশ্লেষণ উল্লেখ করা হল-
মূলনীতি-১ : নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর সামনে আত্মসমর্পণ
পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত অভ্রান্ত সংবিধান। মুসলিম হিসাবে এই সংবিধানের উপর বিশ্বাস রাখা এবং যথাযথভাবে সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করা ফরয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُو
‘তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তোমরা তারই অনুসরণ কর। তা ব্যতীত অন্য বন্ধুদের অনুসরণ কর না। তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা কোন মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করবে, সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৩৬)।
উক্ত আয়াতের মাধ্যমে কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য করা অপরিহার্য হয়ে যায়। এমনকি দুনিয়াবী জীবনে মুসলিম নেতৃত্বের আনুগত্য করার সময় যদি কোন ক্ষেত্রে তার সাথে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, তখনও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের দিকেই ফিরে যেতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক তাদের। তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মতভেদ হলে সেটাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক থেকে উত্তম’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)।
উক্ত প্রত্যাদেশের কারণ হল, কুরআন-সুন্নাহর সামনে আত্মসমর্পণের মধ্যেই মুসলিম জাগরণ নিহিত আছে। এ জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে বাক্য দ্বারা সর্বপ্রথম কুফর ও শিরকে নিমজ্জিত জাতিকে আহ্বান করেছিলেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রবী‘আহ ইবনু আব্বাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেলায় সমবেত লোকদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু’ বল, তাহলে তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে।[৬]
উক্ত তাওহীদী বার্তার মধ্যেই বিশ্ববিজয়ের সম্মোহনী শক্তি নিহিত রয়েছে। কারণ এ বাক্যের মাধ্যমেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত জাহেলিয়াতকে পরাজিত করে ইসলামকে বিজয়ী করেছিলেন। সেই সাথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পৃথিবীর শেষাবধি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, মুসলিম উম্মাহ যতদিন কুরআন ও সুন্নাহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন তারা বিজয়ী বেশেই থাকবে। বিদায় হজ্জের ভাষণে মানব জাতিকে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّىْ قَدْ تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوْا أبَدًا كِتَابَ اللهِ وَ سُنَّةَ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের মধ্যে যা ছেড়ে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাক, তবে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল- আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত’।[৭]
তাই ইসলামী পুনর্জাগরণ কুরআন-সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। অন্যথা তা হবে অসার ও ভঙ্গুর। যেমন আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালিহ আল-উছায়মীন (১৯২৭-২০০১ খৃ.) বলেন, ‘আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা যে, এই পুনর্জাগরণ ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে এখন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত, যেমনটি আমাদের কাছে সংবাদ আসছে। তবে এই পুনর্জাগরণ আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। কারণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত না হলে এই জাগরণ হবে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মত, যা নির্মাণের চেয়ে বিনাশই বেশী করবে। কিন্তু যদি তা কুরআন-সুন্নাহর দৃঢ় ভিত্তির উপর ভিত্তিশীল হয়, তবে মুসলিম উম্মাহসহ অন্যদের উপরও এর কার্যকরী প্রভাব পড়বে’।[৮] অতঃপর তিনি দৃঢ় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন,
إن الأمة الإسلامية لو رجعت إلى دين الله حقا لو رجع رعاتها ورعيتها إلى دين الله حقا واتخذوا المؤمنين أولياء واتخذوا الكافرين أعداء لملكوا مشارق الأرض ومغاربها
‘নিশ্চয় মুসলিম উম্মাহ, শাসকগোষ্ঠী ও প্রজাসাধারণ যদি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্র বিধানের দিকে ফিরে আসত এবং কাফের সম্প্রদায়কে শত্রু আর মুমিনদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করত, তাহলে তারা পূর্ব থেকে পশ্চিম- সারা জাহানের মালিক হয়ে যেত’।[৯] মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯ খৃ./১৩৩৩-১৪২০ হি.) বলেন,
منهجنا قائم على اتباع الكتاب والسنة وعلى ما كان عليه سلفنا الصالح والتأثر بدعوة شيخ الإسلام ابن تيمية ثم تلميذه ابن القيم ومن سار على منهجهم كالشيخ محمد بن عبد الوهاب الذي كان له الفضل الأول بإحياء دعوة التوحيد
‘আমাদের মূলনীতি কুরআন-সুন্নাহ এবং আমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের অনুসরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ, তাঁর ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িম এবং যারা তাঁদের মূলনীতির উপর পরিচালিত হয়েছেন, তাদের দাওয়াতের প্রভাবের উপর। যেমন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, যার প্রথম কৃতিত্ব হল তাওহীদী দাওয়াতের পুনর্জীবন দান করা’।[১০] ড. ইসরার আহমাদ বলেন,
“For this task as well, besides critical knowledge of contemporary world affairs and social sciences, a deep and sound understanding of the Qur’an and Sunnah is called for”.
‘আর এ কাজের জন্য সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ঘটনাবলী ও সামাজিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর গভীর ও পরিপূর্ণ বুঝ অপরিহার্য’।[১১]
অতএব কুরআন ও সুন্নাহর সামনে নিংশর্ত আত্মসমর্পণই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখানেই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তেমনি বিশ্ববিজয়ের চাবিকাঠিও এখানেই লুক্কায়িত আছে।
আত্মসমর্পণের দৃষ্টান্ত
কুরআন-সুন্নাহকে ভালবাসা আর বাস্তব জীবনে তার প্রতি আমল করা এক বিষয় নয়। তাই ইসলামের বিধি-বিধান বাস্তব জীবনে কার্যকর করতে হবে। তখনই সমাজের উপর ইসলাম প্রভাব বিস্তার করবে। আর যখন ইসলামের উপর থেকে আনুগত্যের ধারা প্রত্যাখ্যাত হবে, তখনই মুসলিম জাতির বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে যাবে। তাই সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে দ্বীনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন, ঠিক সেভাবে আমাদেরকেও করতে হবে। যেমন-
عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ كُنْتُ سَاقِىَ الْقَوْمِ فِىْ مَنْزِلِ أَبِىْ طَلْحَةَ وَكَانَ خَمْرُهُمْ يَوْمَئِذٍ الْفَضِيْخَ فَأَمَرَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُنَادِيًا يُنَادِىْ أَلاَ إِنَّ الْخَمْرَ قَدْ حُرِّمَتْ قَالَ فَقَالَ لِىْ أَبُو طَلْحَةَ اخْرُجْ فَأَهْرِقْهَا فَخَرَجْتُ فَهَرَقْتُهَا فَجَرَتْ فِىْ سِكَكِ الْمَدِيْنَةِ فَقَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ قَدْ قُتِلَ قَوْمٌ وَهْىَ فِىْ بُطُوْنِهِمْ فَأَنْزَلَ اللهُ [ لَيْسَ عَلَى الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيْمَا طَعِمُوْا]
‘আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু ত্বালহার বাড়ীতে জনগণকে পানি পান করাচ্ছিলাম। সেদিন তাদের মদ ছিল অত্যন্ত দামী। এ সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আহ্বানকারীকে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি ঘোষণা কর, সাবধান! নিশ্চয় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তখন আবু ত্বালহা আমাকে বললেন, তুমি বের হও এবং মদ ঢেলে ফেল। তাই আমি বের হলাম এবং মদ ঢেলে ফেললাম। এতে মদীনার রাস্তায় মদের স্রোত প্রবাহিত হল। এ সময় কতিপয় লোক বলল, যাদের পেটে মদ রয়েছে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, এরূপ লোকদের উপর কোন গুনাহ নেই, যা তারা পানাহার করেছে’।[১২] অন্য একটি হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ بِالْمَدِيْنَةِ قَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ تَعَالَى يُعَرِّضُ بِالْخَمْرِ وَلَعَلَّ اللهَ سَيُنْزِلُ فِيْهَا أَمْرًا فَمَنْ كَانَ عِنْدَهُ مِنْهَا شَىْءٌ فَلْيَبِعْهُ وَلْيَنْتَفِعْ بِهِ قَالَ فَمَا لَبِثْنَا إِلاَّ يَسِيْرًا حَتَّى قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللهَ تَعَالَى حَرَّمَ الْخَمْرَ فَمَنْ أَدْرَكَتْهُ هَذِهِ الآيَةُ وَعِنْدَهُ مِنْهَا شَىْءٌ فَلاَ يَشْرَبْ وَلاَ يَبِعْ قَالَ فَاسْتَقْبَلَ النَّاسُ بِمَا كَانَ عِنْدَهُ مِنْهَا فِىْ طَرِيْقِ الْمَدِيْنَةِ فَسَفَكُوْهَا
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মদীনায় খুৎবা দিতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, হে মানবমণ্ডলী নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মদের ব্যাপারে বিধান পেশ করবেন। আল্লাহ এ বিষয়ে অচিরেই নির্দেশনা প্রদান করবেন। তাই যার কাছে মদের অবশিষ্ট কিছু আছে, সে যেন তা বিক্রি করে দেয় এবং তা থেকে উপকার লাভ করে। রাবী বলেন, কিছুদিন পরেই তিনি বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন। অতএব কারো কাছে মদ থাকা অবস্থায় যদি এই আয়াত পৌঁছে, তবে সে যেন তা পান না করে এবং বিক্রি না করে। অতঃপর যাদের কাছে মদ ছিল তারা মদীনার রাস্তার দিকে নিয়ে গেল এবং ঢেলে ফেলল’।[১৩]
উক্ত দু’টি হাদীস প্রমাণ করে আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম তার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন এবং আমল করেছেন। তাঁরা বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেননি। তাদের এই দ্বিধাহীন নিঃস্বার্থ আনুগত্যই ইসলামের অনুপম আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। অন্য হাদীসে এসেছে,
‘সালামা ইবনু আকওয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে খায়বারের দিকে বের হলাম। অতঃপর আল্লাহ মুসলিম বাহিনীর উপর বিজয় দান করলেন। বিজয়ের দিন তারা যখন সন্ধ্যায় উপনীত হলেন, তখন তারা অনেক চুলা জ্বালালেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কিসের জন্য আগুন জ্বালিয়েছ? তারা বললেন, গোশত রান্নার জন্য। তিনি বললেন, কিসের গোশত? তারা বললেন, গৃহপালিত গাধার গোশত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, গোশত ঢেলে ফেল এবং পাতিল ভেঙ্গে দাও। জনৈক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালআম)! আমরা গোশত ঢেলে ফেলি, আর পাত্র ধুয়ে নিই। তিনি বললেন, ঠিক আছে’।[১৪]
উক্ত হাদীসেও নির্ভেজাল খাঁটি আনুগত্যের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। সাহাবায়ে কেরাম ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থাতেও বিজয়ের দিন রান্না করা গোশত ফেলে দিতে একটু দ্বিধা করলেন না। অন্য বর্ণনায় এসেছে,
‘আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) যখন বের হলেন, তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লোকদের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, হে ওমর! আপনি বসুন। তিনি বসতে অস্বীকার করলেন। লোকেরা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট থেকে আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছে আগমন করল। অতঃপর আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হামদ ও ছানার পর বললেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইবাদত করতে চায়, সে যেন জেনে নেয়, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, সে যেন জেনে রাখে আল্লাহ জীবিত, তিনি কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না। আল্লাহ বলেন, ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল গত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি মারা যান অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, সে কখনও আল্লাহ্র ক্ষতি করতে পারবে না। বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদেরকে পুরস্কৃত করবেন’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৪৪)।
রাবী বলেন, আল্লাহর শপথ! মানুষ যেন জানতই না আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছেন। অবশেষে আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আয়াতটি পাঠ করলেন। অতঃপর প্রত্যেকেই আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট থেকে এই আয়াত বুঝতে পারলেন। যে ব্যক্তিই এটি বেশী শুনেছে সেই পাঠ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, সাঈদ ইবনু মুসাইয়াব আমাকে বলেছেন, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহর কসম! আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছাড়া অন্য কারো কাছে এই আয়াত আমি শুনিনি। তখন আমি বুঝতে পারলাম। অবশেষে আমার দুই পা ফসকে গেল এবং মাটির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, যখন বুঝতে পারলাম যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন’।[১৫]
তাঁদের আনুগত্যের স্পৃহা ছিল কত শক্তিশালী, কত গভীর! কুরআনের আয়াত পাওয়া মাত্রই সম্পূর্ণ পরিবেশটাই ঘুরে গেল। সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর এই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ মুসলিম উম্মাহকে আরো মুগ্ধ করেছে। নিম্নের হাদীসে আরো কঠিন আনুগত্যের কথা বর্ণিত হয়েছে,
عَنِ الْبَرَاءِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَمَّا قَدِمَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِيْنَةَ صَلَّى نَحْوَ بَيْتِ الْمَقْدِسِ سِتَّةَ عَشَرَ أَوْ سَبْعَةَ عَشَرَ شَهْرًا وَكَانَ يُحِبُّ أَنْ يُوَجَّهَ إِلَى الْكَعْبَةِ فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى ( قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِى السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ) فَوُجِّهَ نَحْوَ الْكَعْبَةِ وَصَلَّى مَعَهُ رَجُلٌ الْعَصْرَ ثُمَّ خَرَجَ فَمَرَّ عَلَى قَوْمٍ مِنَ الأَنْصَارِ فَقَالَ هُوَ يَشْهَدُ أَنَّهُ صَلَّى مَعَ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَّهُ قَدْ وُجِّهَ إِلَى الْكَعْبَةِ فَانْحَرَفُوْا وَهُمْ رُكُوْعٌ فِىْ صَلاَةِ الْعَصْرِ
‘বারা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করেন, তখন তিনি বায়তুল মাক্বদেসের দিকে মুখ করে ১৬ কিংবা ১৭ মাস সালাত আদায় করেন। তবে তিনি কা‘বার দিকে মুখ করে সালাত আদায়কে পসন্দ করতেন। তাই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, ‘নিশ্চয় আকাশের দিকে আপনার মুখমণ্ডল উত্তোলন করার দৃশ্য আমি অবলোকন করি। আমি আপনাকে ক্বিবলামুখীই করব, যা আপনি কামনা করছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৪৪)।
একদা কা‘বার দিকে ক্বিবলা করে দেয়া হল। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে একজন সাহাবী আছরের সালাত আদায় করে আনছারীদের নিকট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর তিনি সাক্ষ্য দিলেন যে, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সালাত আদায় করেছেন, যখন কা‘বার দিকে ক্বিবলা পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। তখন তারা আছর সালাতে রুকূ‘ অবস্থায় কা‘বার দিকে ঘুরে গেলেন।[১৬]
আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা কী তা উক্ত বর্ণনায় ফুটে উঠেছে। হাদীস পাওয়া মাত্রই তারা কাল-বিলম্ব না করে রুকূ অবস্থাতেই ক্বিবলা পরিবর্তন করে নিলেন। এই ওয়াক্তের সালাত এভাবেই আদায় করি- এই চিন্তাটুকুও তাঁদের মধ্যে জাগেনি।
অতএব ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য অভ্রান্ত বিধানের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ অন্যতম প্রধান শর্ত। সাহাবায়ে কেরাম এই মূলনীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করার কারণেই বিশ্ববিজয়ের আহ্বান তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছিল।
তথ্যসূত্র :
[১] আল-ইমাম আহমাদ শাহ অলিউল্লাহ ইবনু আব্দুর রহীম আদ-দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১ম খণ্ড (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খৃ.), পৃ. ২৭৭।
[২]. আবু মুহাম্মাদ আলী ইবনু আহমাদ ইবনু সাঈদ ইবনু হাযম আল-আন্দালুসী আল-কুরতুবী আয-যাহিরী, আল-মুহাল্লা, ১ম খণ্ড (বৈরুত : দারুল ফিকর, তা.বি.), পৃ. ৫৫।
[৩] মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব, আল-উছূলুছ ছালাছাহ (সঊদী আরব : আল-ইকাডিমিয়াইতুল ইলমিয়াহ, ১৪২৭ হি.), পৃ. ১।
[৪] আল-উছূলুছ ছালাছাহ, পৃ. ৩।
[৫] শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিছ আল-উছায়মীন, আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত (রিয়াদ : মাদারু ওয়াতান, ১৪২৬ হি.), পৃ. ৫৬।
[৬] আবুবকর মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনু খুযায়মাহ আস-সুলামী আন-নীসাপুরী, তাহক্বীক্ব : ড. মুছত্বফা আল-আ‘যামী, সহীহ ইবনে খুযায়মাহ, ১ম খণ্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৭০ খৃ./১৩৯০ হি.), পৃ. ৮২, হা/১৫৯।
[৭] মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল্লাহ আবু আব্দিল্লাহ আল-হাকিম আন-নায়সাপুরী, আল-মুস্তাদরাক আলাছ সহীহাইন, ১ম খ- (রিয়াদ : দারুল মায়মান, ১৪৩৫ হি./২০১৪ খৃ.), পৃ. ২২২, হাদীস সংখ্যা-৩২২, ‘ইলম’ অধ্যায়।
[৮] আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত, পৃ. ৯।
[৯] আছ-ছাহওয়াতুল ইসলামিয়াহ : যাওয়াবিত ওয়া তাওজীহাত, পৃ. ১০।
[১০] মুহাম্মাদ হাস্সানাইন হাসান, হাস্সানাইন, তাজদীদুদ দ্বীন : মাফহূমুহু ওয়া যাওয়াবিতুহু ও আছারুহু (মাক্কা আল-মুকাররামাহ : ২০০৭ খৃ./১৪২৮ হি.), পৃ. ১৩৬।
[১১] Dr. Israr Ahmad, ISLAMIC RENAISSANCE : THE REAL TASK AHEAD (Lahore : MARKAZI ANJUMAN KHUDDAM-UL-QUR’AN, 2001), p. 28.
[১২] আল-বুখারী, সহীহুল বুখারী (কায়রো : দারুত তাক্বওয়া, ১৪৩৪ হি./২০১২ খৃ.), পৃ. ৩০৪, হাদীস সংখ্যা-২৪৬৪, ‘মাযালিম’ অধ্যায়, ‘রাস্তায় মদ ঢেলে ফেলা’ অনুচ্ছেদ-৩১; সূরা আল-মায়িদাহ : ৯৩।
[১৩] আল-ইমাম আল-হাফিয আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশায়রী আন-নায়সাপুরী, সহীহ মুসলিম (কায়রো : দারুত তাক্বওয়া, ১৪৩৪ হি./২০১২ খৃ.), পৃ. ৪৭৫, হাদীস সংখ্যা-১৫৭৮, ‘মুসাক্বাত’ অধ্যায়, ‘মদ বিক্রয় করা হারাম’ অনুচ্ছেদ-১২।
[১৪] সহীহ মুসলিম, পৃ. ৬০৩, হা/১৮০২, ‘শিকার ও যবহ’ অধ্যায়, গৃহ পালিত গাধার গোশত খাওয়া হারাম’ অনুচ্ছেদ-৫।
[১৫] সহীহুল বুখারী, পৃ. ৫৫২, হা/৪৪৫৪, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অসুস্থতা ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ-৮৩।
[১৬] সহীহুল বুখারী, পৃ. ৮৮৫, হা/৭২৫২, ‘খবরে আহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১ এবং পৃ. ৬০, হা/৩৯৯, ‘সালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩১।
ড. মুযাফফর বিন মুহসিন
Last edited: