কুরআন তেলাওয়াতে রয়েছে অসংখ্য ও অগণিত নেকি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি লাভ করার অন্যতম মাধ্যম। অলৌকিক মাহাত্ম্যে পরিপূর্ণ আল-কুরআনের প্রতিটি অক্ষর, শব্দ, আয়াত এবং সূরা রহমত ও বরকত দিয়ে পরিপূর্ণণ। যা তেলাওয়াত করলে মুমিনের ঈমান বৃদ্ধি পায়, তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয় এবং অন্তর প্রকম্পিত হয়। গায়ের চামড়া রোমাঞ্চিত হয় এবং দেহমন বিনম্র হয়। এই আল-কুরআন তেলাওয়াতের কিছু আদব রয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হল।
১. আল-কুরআনের মর্যাদা অনুধাবন করা
কুরআন তেলাওয়াতের প্রথম এবং অন্যতম আদব হল আল-কুরআনের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা অনুধাবন করা ও জানা। আল-কুরআন কী? এর মর্যাদাই বা কী? এটা কার কালাম? এটা কেন অবতীর্ণ হয়েছে এবং কুরআন তেলাওয়াত করলে কী হবে? এগুলো সম্পর্কে অবগত না হলে তেলাওয়াত করে প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্যই কুরআন তেলাওয়াতের পূর্বে তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হতে হবে। মানুষ যখন উপলব্ধি করবে যে, এটা আল্লাহর কালাম, মানবজাতির জন্য হেদায়াত, দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণ ও মুক্তির দিশারী, আলো, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, জীবন-ব্যবস্থা ও মানুষের সংবিধান ইত্যাদি, তখন তেলাওয়াতকারীর মনে কুরআনের প্রতি ঈমান, সম্মান এবং শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাবে এবং এটাকে জীবনের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করবে। তখনই সে তেলাওয়াত করে প্রশান্তি লাভ করবে।
২. ইখলাছের সাথে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াত করা ইবাদত। আর ইবাদত কবুলের প্রথম শর্ত হল আল্লাহর সন্তুষ্টি। তেলাওয়াতের সময় ইখলাছ তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে ইবাদত নষ্ট হবে এবং তা শিরকে পরিণত হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে’ (সূরা আল-বায়্যিনাহ : ৫)। আর আমল বিশুদ্ধ ও কবুল হয় আমলকারীর নিয়তের উপর।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[১]
যারা ইখলাছ ব্যতীত লোক দেখানো, টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত করে, তারা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে, আখেরাতে মিসকীন হবে এবং তাদেরকে উবুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[২]
৩. মিসওয়াক করা
কুরআন তেলাওয়াতের পূর্বে মেসওয়াক করে মুখ পরিষ্কার করা তেলাওয়াতের অন্যতম শিষ্টাচার। সালাত, তেলাওয়াত, ওযূ এবং খুত্ববার পূর্বে মেসওয়াক করা সুন্নাত। মেসওয়াকে রয়েছে পবিত্রতা ও আল্লাহর সন্তষ্টি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘মেসওয়াকে রয়েছে মুখের পবিত্রতা এবং আল্লাহর সন্তষ্টি’।[৩]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘নিশ্চয় বান্দা যখন মেসওয়াক করে। অতঃপর সালাতে দাঁড়ায়, তখন একজন ফেরেশতা এসে তার পিছনে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে থাকেন ও নিকটবর্তী হন এবং অনুরূপ বাক্য শুনতে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ মুছল্লীর মুখের উপরে রাখেন। অতঃপর যখনই সে কোন আয়াত তেলাওয়াত করে তখন তা ফেরেশতার পেটে চলে যায়। অতএব তোমরা কুরআনের জন্য তোমাদের মুখকে পবিত্র কর’।[৪]
৪. পবিত্র অবস্থায় তেলাওয়াত করা
ওযূ করে পবিত্র অবস্থায় তেলাওয়াত করা উত্তম।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘ওযূ ব্যতীত আমি আল্লাহর নাম নেয়া অপসন্দ করি’।[৫] তবে মুহদিছ (ওযূ ছাড়া) অবস্থায় তেলাওয়াত করাও বৈধ। গোসল বা তায়াম্মুম ব্যতীত জুনুবি (গোসল ফরয এমন) অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করবে না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত যেন কেউ কুরআন স্পর্শ না করে’।[৬]
৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র পরিবেশে তেলাওয়াত করা
কুরআন আল্লাহর কালাম এবং পবিত্র কিতাব। তাই তা তেলাওয়াত করার জন্য পবিত্র জায়গা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সুতরাং অপবিত্র জায়গায় তা পাঠ করা বৈধ নয়। পবিত্র জায়গা সেটা হতে পারে বাড়ীর সুন্দর পরিবেশ, মসজিদ ইত্যাদি।
৬. তেলাওয়াতের শুরুতে শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করা ও আল্লাহর নামে শুরু করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল-তেলাওয়াতের শুরুতে শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং আল্লাহর নামে শুরু করা। কেননা শয়তান কখনোই চায় না যে, আপনি আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করুন এবং তাতে হেদায়াত তালাশ করুন। আবার আপনি পাঠ করলেও শয়তান আপনার মনকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে চায় এবং চেষ্টা করে; যাতে করে আপনার মনোযোগ নষ্ট করে দেয়া যায়। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন,
‘যখন তুমি কুরআন তেলাওয়াত করবে, তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে’ (সূরা আন-নাহল : ৯৮)।
৭. ক্বিবলামুখী হয়ে তেলাওয়াত করা
মুস্তাহাব হল ক্বিবলামুখী অবস্থায় তেলাওয়াত করা। এটা কুরআনের অন্যতম আদব।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘প্রত্যেক জিনিসের প্রধান আছে। আর মজলিসের প্রধান হল ক্বিবলামুখে বসা’।[৭]
৮. অনুধাবনসহ তেলাওয়াত করা এবং আয়াতের পুনরাবৃত্তি করা
তেলাওয়াতের সময় একাগ্রতা বজায় রাখা, আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা। কুরআন শুধু বাড়ীতে গচ্ছিত রাখা, লটকানো, গলা, হাতে বা কোমরে বেঁধে তাবীয করা, কেউ মারা গেলে কুরআন-খানী করা, কোন অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে বরকতের উদ্দেশ্যে পাঠ করার জন্য নয়। বরং তেলাওয়াতের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা, তার উপদেশ গ্রহণ করা এবং বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ’ (সূরা মুহাম্মাদ : ২৪)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এ এক কল্যাণময় কিতাব, এটা আমরা আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা ছোয়াদ : ২৯)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআনকে অনুধাবন করতেন এবং বুঝে পড়তেন। যেমন সূরা হূদ ও তার অনুরূপ সূরা তাঁর চুল পাকিয়ে দিয়েছিল।[৮]
তেলাওয়াতের সময় গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের মর্ম অনুধাবনের জন্য তা পুনরাবৃত্তি করা। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে সালাতে দাঁড়িয়ে একটি মাত্র আয়াত পড়তে পড়তে ভোর করেছিলেন। আয়াতটি হল-
‘(হে আল্লাহ!) যদি আপনি তাদের শাস্তি দিন। তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ১৮)।[৯] অনুরূপভাবে সাহাবীগণও তাই করতেন (সূরা আল-জাছিয়া : ২১)।[১০]
৯. তেলাওয়াতের সময় সিজদা করা এবং আল্লাহর ভয়ে কান্না করা
পৃথিবীতে সবকিছু আল্লাহকে সিজদা করে। তাঁর সামনে সবাই বিনয় ও নীচতা প্রকাশ করে। মুমিনরা খুশি মনে এবং কাফিররা বাধ্য হয়ে তাঁর সামনে সিজদায় পতিত হয়। তাদের ছায়াগুলো সকাল সন্ধ্যায় তাঁর সামনে ঝুঁকে পড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলোও সকাল-সন্ধ্যায়’ (সূরা আর-রা‘দ : ১৫)। মহান আল্লাহকে সিজদা করার মধ্যে রয়েছে বিশেষ মর্যাদা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পড়ে এবং সিজদা করে, শয়তান তখন কাঁদতে কাঁদতে একদিকে চলে যায় এবং বলে, হায় আমার দুর্ভাগ্য! আদম সন্তানকে সিজদার আদেশ করা হলে সে সিজদা করে। ফলে তার জন্য জান্নাত। আর আমাকে সিজদার আদেশ করা হলে আমি তা অস্বীকার করেছি, ফলে আমার জন্য জাহান্নাম’।[১১]
তাই বলা যায় যে, কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াত আসলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সিজদা করা। বিশেষ করে তেলাওয়াতের সিজদা করা এবং আল্লাহর ভয়ে কান্না করা। এটা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। তবে তা যেন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয়। কুরআন তেলাওয়াতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হত।[১২]
অনুরূপভাবে সাহাবীগণও তেলাওয়াতের সময় সিজদা করত এবং কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ত (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৭-১০৯)।
১০. ‘মাদ’ সহ তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব ‘মাদ’ সহকারে অর্থাৎ ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে, প্রত্যেক অক্ষরকে তার উৎসস্থল থেকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করে, যেখানে টানতে হবে সেখানে টেনে তেলাওয়াত করা। আলেমগণ মাদসহ তেলাওয়াত করাকে শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন,
‘আর কুরআন পাঠ করুন ধীরে ধীরে (সুন্দরভাবে)’ (সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন।[১৩]
১১. অনুগ্রহ কামনা করা এবং মন্দ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা
তেলাওয়াতের সময় রহমতের আয়াত আসলে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত কামনা করা, শাস্তির আয়াত আসলে মন্দ ও শাস্তি থেকে পরিত্রাণ চাওয়া ইত্যাদি।
হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা আল-বাক্বারাহ শুরু করলেন, আমি মনে মনে বললাম যে, হয়তো তিনি একশ’ আয়াত তেলাওয়াত করে রুকূ করবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন, আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি দু’শ আয়াত তেলাওয়াত করে রুকূতে যাবেন, কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি পূর্ণ সূরা এক রাক‘আতেই তেলাওয়াত করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং সূরা আন-নিসা শুরু করে তাও তেলাওয়াত করলেন। তারপর সূরা আলে ‘ইমরানও শুরু করে তাও তেলাওয়াত করে ফেললেন। তিনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। যদি তিনি এমন কোন আয়াত তেলাওয়াত করে ফেলতেন যাতে কোন তাসবীহ রয়েছে তবে তাসবীহ পাঠ করতেন, যদি কোন যাঞ্ছা করার আয়াত তেলাওয়াত করতেন তখন যাঞ্ছা করতেন। যদি কোন বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন আশ্রয় প্রার্থনা করতেন’।[১৪]
১২. কুরআনকে হেফাযত করা
কুরআনের অন্যতম আদব হল তা হেফাযত করা অর্থাৎ কুরআনের প্রতি সদা লক্ষ্য রাখা, বারবার তেলাওয়াত করা, মুখস্থ করা এবং স্মরণ রাখা। কেননা এগুলো না করলে কুরআনকে ভুলিয়ে দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা কুরআনের প্রতি সদা লক্ষ্য রাখবে। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন রয়েছে, নিশ্চয় কুরআন রশিতে বাঁধা উট অপেক্ষাও অধিক পলায়নপর’।[১৫]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন,
‘কারও এরূপ বলা কি জঘন্য কথা! যে বলে, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং সে যেন বলে তাকে ভুলানো হয়েছে। সুতরাং তোমরা পুনঃ পুনঃ কুরআন স্মরণ করবে। কেননা এটা মানুষের অন্তর হতে চতুষ্পদ জন্তু অপেক্ষাও অধিক পলায়নপর’।[১৬]
নবী (ﷺ) আরো বলেছেন,
‘কুরআনের হাফেযদের উদাহরণ হল- ঐ মালিকের ন্যায়, যে উট বেধে রাখে। যতি সে উট বাধে, তাহলে সে উট তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু সে যদি বাঁধন খুলে দেয়, তাহলে উট নিয়ন্ত্রণে থাকে না, পালিয়ে যায়’।[১৭]
১৩. সুমধুর সুরে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল সুন্দর ও সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করা। কেননা সুমধুর সুর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহ তা‘আলাও তা পসন্দ করেন। তাছাড়া যে ব্যক্তি সুন্দর করে তেলাওয়াত করে না; সে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মত না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা সুমধুর স্বর দ্বারা কুরআনকে সুন্দর কর’।[১৮]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা তোমাদের সুরের দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যম-িত কর। কেননা সুমধুর সুর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে’।[১৯]
১৪. সাগ্রহে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল তা সাগ্রহে তেলাওয়াত করা। মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটলে কুরআন পড়া পরিত্যাগ করা।
জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমরা কুরআন পড়, যতক্ষণ তোমাদের মন তা সাগ্রহে চায়। অতঃপর যখন মনের ভাব অন্যরূপ দেখ, তখন তা ছেড়ে উঠে যাও![২০]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যখন তোমাদের কেউ রাতে উঠবে ও (ঘুমের চাপের কারণে) জিহ্বায় কুরআন পড়তে এমন অসুবিধা বোধ করবে যে, সে কি বলছে তা বুঝতে পারবে না, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে’।[২১]
১৫. তেলাওয়াতের জন্য উত্তম পোশাক এবং সময় নির্ধারণ করা
কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মার্জিত পোশাক পরিধান করা উত্তম। পুরুষের উচিত শরীরে পোশাক রাখা। যদিও মহিলাদের মাথায় কাপড়, হিজাব বা ওড়না থাকা যরূরী নয়, তবুও কুরআন পড়ার সময় আদবের সাথে সালাতের পোশাকের ন্যায় পোশাক পরিধান করা ভাল। এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতীককে সম্মান জানানো হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘এটাই (আল্লাহর) বিধান। আর কেউ আল্লাহর (দ্বীনের) প্রতীকসমূহের সম্মান করলে এটা তো তা হৃদয়ের তাক্বওয়ারই বহিঃপ্রকাশ’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩২)।
অনুরূপভাবে উত্তম সময় নির্বাচন করা। ব্যস্ত না থাকলে অবসর সময় কুরআন তেলাওয়াত করা ভাল। আর রাতে তেলাওয়াত সবচেয়ে উত্তম (সূরা আল-মুয্যাম্মিল : ৬-৭, ২০)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে সূরা আস-সাজদাহ এবং সূরা আল-মুলক পাঠ না করা পর্যন্ত ঘুমাতেন না।[২২] বিশেষ করে ফজরের সময় কুরআন তেলাওয়াত করা মর্যাদাপূর্ণ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘ফজরের কুরআন। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (ফেরেশতা) উপস্থিত থাকে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৮)।
১৬. কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করা ও খতম করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত তেলাওয়াত করা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘কাজ সেই পরিমাণ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমরা করতে সমর্থ হও। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কখনও ছওয়াবদানে বিরক্তবোধ করেন না, যতক্ষণ না তোমরা বিরক্ত হও’।[২৩]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন,
‘আর আল্লাহর নিকট ঐ আমল সবচেয়ে প্রিয়, যা সর্বদা করা হয়, তা কম হলেও’।[২৪]
মাঝে মাঝে সময় ও সামর্থ্য অনুযায়ী কুরআন খতম করা উচিত। কুরআন খতমে নেকি অনেক। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি কুরআনের কোন একটি অক্ষর পাঠ করবে তার জন্য একটি নেকী রয়েছে। আর এক নেকী হচ্ছে আমলের দশগুণ। আমি বলছি না যে আলিফ-লাম-মীম একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর।[২৫]
কুরআনে অক্ষরের সংখ্যা মতান্তরে ৩,২১,১৮০ অথবা ৩,২৩,০১৫ অথবা ৩,০০৭৪০টি।[২৬]
তাহলে একবার খতম করলে কত নেকি (সুবহা-নাল্লাহ)।
১৭. কুরআন তেলাওয়াত শেষে দু‘আ পড়া
কুরআন পাঠ শেষে দু‘আ পড়াও কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব। খতমের পরেও দু‘আ করা যায়। তবে খতমের পরে নির্দিষ্ট কোন দু‘আ নেই। ‘দু‘আয়ে খতমুল কুরআন’ শিরোনামে যে লম্বা দু‘আ আছে, অনেকেই এটা পড়ে থাকে। এটা শরী‘আতে বৈধ নয়। কারণ এ দু‘আর কোন ভিত্তি নেই। তেলাওয়াত শেষে অনেকেই ‘ছাদাক্বাল্লাহুল আযীম’ (صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمُ) পড়ে। মুহাদ্দিছ উলামায়ে কেরাম এই প্রথাকে বিদ‘আত বলেছেন।[২৭]
নবী (ﷺ) কুরআন পড়তেন এবং খতম করতেন। কিন্তু একটি বারের জন্যও তিনি ঐ দু‘আ পড়েছেন; এ রকম প্রমাণ নেই। সাহাবীদের নিকট কুরআন শুনতেন। কিন্তু তাদেরকে কখনো ঐ দু‘আ পড়তে নির্দেশ দেননি। বরং বলেছেন, (أَمْسِكْ) ‘থামো’[২৮], (حَسْبُكَ الْآنَ) ‘এবার বন্ধ কর’।[২৯]
অবশ্য কুরআন পড়ার মজলিস শেষে কাফফারাতুল মাজলিসের দু‘আ বলা সুন্নাত।
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখনই কোন মজলিসে বসতেন অথবা কুরআন তেলাওয়াত করতেন অথবা সালাত পড়তেন, তখনই বলতেন,
‘হে আল্লাহ! আপনার পবিত্রতা আপনার প্রশংসার সাথে, আপনি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই। আমি আপনার নিকট ক্ষমা চাই ও তওবা করি’।[৩০]
জ্ঞাতব্য : উক্ত দু‘আ পাঠ করলে যদি (মজলিস, তেলাওয়াত বা সালাতে) ভাল কথা হয়ে থাকে, তবে তা তার পক্ষে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মোহরস্বরূপ হবে, আর যদি মন্দ কথা হয়ে থাকে, তবে এটা তার পক্ষে কাফ্ফারা হয়ে যাবে।[৩১]
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/১; সহীহ মুসলিম, হা/১৯০৭।
[২]. সহীহ মুসলিম, হা/১৯০৫; মিশকাত, হা/২০৫।
[৩]. সহীহ বুখারী, ‘সিয়াম’ অধ্যায়, ‘অনুচ্ছেদ-২৭; মুসনাদুশ শাফেয়ী, হা/৪১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪২৪৯; নাসাঈ, হা/৫।
[৪]. মুসনাদুল বাযযার, হা/৬০৩, সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২১৩।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/১৭; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৫৯২; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৮০৩; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/২০৬, সনদ সহীহ।
[৬]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৬৮০; মিশকাত, হা/৪৬৫, সনদ সহীহ।
[৭]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৫১৩; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/২৩৫৪; সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬৪৫।
[৮]. ইমাম তিরমিযী, আশ-শামাইল (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুল কিতাব, ১৪১২ হি.), পৃ. ৫৭, হা/৪১; ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আল-আছবাহানী, দালাইলুন নবুওত (রিয়াদ : দারুত তায়্যিবাহ, ১৪০৯ হি.), পৃ. ১৩৮।
[৯]. নাসাঈ, হা/১০১০; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৫০, সনদ সহীহ।
[১০]. নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/১১৮৩৩; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১২৩৭, সনদ সহীহ।
[১১]. সহীহ মুসলিম, হা/৮১; ইবনু মাজাহ, হা/১০৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৭১১; মিশকাত, হা/৮৯৫।
[১২]. সহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২; সহীহ মুসলিম, হা/৮০০; মিশকাত, হা/২১৯৫।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৪৬; সহীহ মুসলিম, হা/৭৭২; নাসাঈ, হা/১৬৬৪; মিশকাত, হা/২১৯১।
[১৪]. সহীহ মুসলিম, হা/৭৭২; নাসাঈ, হা/১৬৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩০৯; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/৬৮৪।
[১৫]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৩৩; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯১; মিশকাত, হা/২১৮৭।
[১৬]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৩২; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯০; মিশকাত, হা/২১৮৮।
[১৭]. সহীহ বুখারী হা/৫০৩১; সহীহ মুসলিম হা/৭৮৯; মিশকাত, হা/২১৮৯।
[১৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৫১৭; আবূ দাঊদ, হা/১৪৬৮; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৪২; মিশকাত, হা/২১৯৯, সনদ সহীহ।
[১৯]. দারেমী, হা/৩৫০১; মিশকাত, হা/২২০৮।
[২০]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৬০; মিশকাত, হা/২১৯০।
[২১]. সহীহ মুসলিম, হা/৭৮৭; আবূ দাঊদ, হা/১৩১১; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৭২।
[২২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৭০০; তিরমিযী, হা/২৮৯২; শারহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৬; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/৫৮৫।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/১১৫১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৮২; মিশকাত, হা/১২৪৩।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/৫৮৬১, ‘লিবাস’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৭।
[২৫]. তিরমিযী, হা/২৯১০; মিশকাত, হা/২১৩৭, সনদ সহীহ।
[২৬]. আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৫; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৯।
[২৭]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪৯, ফাতাওয়া নং ৩৩০৩; ফাতাওয়া উছায়মীন, ৩৯তম খণ্ড, পৃ. ১-৬।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৫৫।
[২৯]. সহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২; সহীহ মুসলিম, হা/৮০০; মিশকাত, হা/২১৯৫।
[৩০]. সুনানুল কুবরা, হা/১০০৬৭, ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাতি’ অধ্যায়, ‘কী বলে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করবে’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩১৬৪, সনদ সহীহ।
[৩১]. সুনানুল কুবরা, হা/১০০৬৭, ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাতি’ অধ্যায়, ‘কী বলে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করবে’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ, হা/১৩৪৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩১৬৪, সনদ সহীহ।
১. আল-কুরআনের মর্যাদা অনুধাবন করা
কুরআন তেলাওয়াতের প্রথম এবং অন্যতম আদব হল আল-কুরআনের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা অনুধাবন করা ও জানা। আল-কুরআন কী? এর মর্যাদাই বা কী? এটা কার কালাম? এটা কেন অবতীর্ণ হয়েছে এবং কুরআন তেলাওয়াত করলে কী হবে? এগুলো সম্পর্কে অবগত না হলে তেলাওয়াত করে প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব নয়। এজন্যই কুরআন তেলাওয়াতের পূর্বে তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হতে হবে। মানুষ যখন উপলব্ধি করবে যে, এটা আল্লাহর কালাম, মানবজাতির জন্য হেদায়াত, দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণ ও মুক্তির দিশারী, আলো, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, জীবন-ব্যবস্থা ও মানুষের সংবিধান ইত্যাদি, তখন তেলাওয়াতকারীর মনে কুরআনের প্রতি ঈমান, সম্মান এবং শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাবে এবং এটাকে জীবনের সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করবে। তখনই সে তেলাওয়াত করে প্রশান্তি লাভ করবে।
২. ইখলাছের সাথে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াত করা ইবাদত। আর ইবাদত কবুলের প্রথম শর্ত হল আল্লাহর সন্তুষ্টি। তেলাওয়াতের সময় ইখলাছ তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে ইবাদত নষ্ট হবে এবং তা শিরকে পরিণত হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ
‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে’ (সূরা আল-বায়্যিনাহ : ৫)। আর আমল বিশুদ্ধ ও কবুল হয় আমলকারীর নিয়তের উপর।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ
‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[১]
যারা ইখলাছ ব্যতীত লোক দেখানো, টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত করে, তারা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে, আখেরাতে মিসকীন হবে এবং তাদেরকে উবুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[২]
৩. মিসওয়াক করা
কুরআন তেলাওয়াতের পূর্বে মেসওয়াক করে মুখ পরিষ্কার করা তেলাওয়াতের অন্যতম শিষ্টাচার। সালাত, তেলাওয়াত, ওযূ এবং খুত্ববার পূর্বে মেসওয়াক করা সুন্নাত। মেসওয়াকে রয়েছে পবিত্রতা ও আল্লাহর সন্তষ্টি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
اَلسِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ
‘মেসওয়াকে রয়েছে মুখের পবিত্রতা এবং আল্লাহর সন্তষ্টি’।[৩]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا تَسَوَّكَ ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي قَامَ الْمَلَكُ خَلْفَهُ فَتَسَمَّعَ لِقِرَاءَتِهِ فَيَدْنُوْ مِنْهُ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيْهِ فَمَا يَخْرُجُ مِنْ فِيْهِ شَيْءٌ مِنَ الْقُرْآنِ إِلَّا صَارَ فِيْ جَوْفِ الْمَلَكِ فَطَهِّرُوْا أَفْوَاهَكُمْ لِلْقُرْآنِ
‘নিশ্চয় বান্দা যখন মেসওয়াক করে। অতঃপর সালাতে দাঁড়ায়, তখন একজন ফেরেশতা এসে তার পিছনে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে থাকেন ও নিকটবর্তী হন এবং অনুরূপ বাক্য শুনতে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ মুছল্লীর মুখের উপরে রাখেন। অতঃপর যখনই সে কোন আয়াত তেলাওয়াত করে তখন তা ফেরেশতার পেটে চলে যায়। অতএব তোমরা কুরআনের জন্য তোমাদের মুখকে পবিত্র কর’।[৪]
৪. পবিত্র অবস্থায় তেলাওয়াত করা
ওযূ করে পবিত্র অবস্থায় তেলাওয়াত করা উত্তম।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إِنِّيْ كَرِهْتُ أَنْ أَذْكُرَ اللهَ إِلَّا عَلَى طُهْرٍ
‘ওযূ ব্যতীত আমি আল্লাহর নাম নেয়া অপসন্দ করি’।[৫] তবে মুহদিছ (ওযূ ছাড়া) অবস্থায় তেলাওয়াত করাও বৈধ। গোসল বা তায়াম্মুম ব্যতীত জুনুবি (গোসল ফরয এমন) অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করবে না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
لَا يَمَسُّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ
‘পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত যেন কেউ কুরআন স্পর্শ না করে’।[৬]
৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র পরিবেশে তেলাওয়াত করা
কুরআন আল্লাহর কালাম এবং পবিত্র কিতাব। তাই তা তেলাওয়াত করার জন্য পবিত্র জায়গা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সুতরাং অপবিত্র জায়গায় তা পাঠ করা বৈধ নয়। পবিত্র জায়গা সেটা হতে পারে বাড়ীর সুন্দর পরিবেশ, মসজিদ ইত্যাদি।
৬. তেলাওয়াতের শুরুতে শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করা ও আল্লাহর নামে শুরু করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল-তেলাওয়াতের শুরুতে শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং আল্লাহর নামে শুরু করা। কেননা শয়তান কখনোই চায় না যে, আপনি আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করুন এবং তাতে হেদায়াত তালাশ করুন। আবার আপনি পাঠ করলেও শয়তান আপনার মনকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে চায় এবং চেষ্টা করে; যাতে করে আপনার মনোযোগ নষ্ট করে দেয়া যায়। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন,
فَاِذَا قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ مِنَ الشَّیۡطٰنِ الرَّجِیۡمِ
‘যখন তুমি কুরআন তেলাওয়াত করবে, তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে’ (সূরা আন-নাহল : ৯৮)।
৭. ক্বিবলামুখী হয়ে তেলাওয়াত করা
মুস্তাহাব হল ক্বিবলামুখী অবস্থায় তেলাওয়াত করা। এটা কুরআনের অন্যতম আদব।
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِنَّ لِكُلِّ شَيْءٍ سَيِّدًا وَإِنَّ سَيِّدَ الْمَجَالِسِ قُبَالَةَ الْقِبْلَةِ
‘প্রত্যেক জিনিসের প্রধান আছে। আর মজলিসের প্রধান হল ক্বিবলামুখে বসা’।[৭]
৮. অনুধাবনসহ তেলাওয়াত করা এবং আয়াতের পুনরাবৃত্তি করা
তেলাওয়াতের সময় একাগ্রতা বজায় রাখা, আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা। কুরআন শুধু বাড়ীতে গচ্ছিত রাখা, লটকানো, গলা, হাতে বা কোমরে বেঁধে তাবীয করা, কেউ মারা গেলে কুরআন-খানী করা, কোন অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে বরকতের উদ্দেশ্যে পাঠ করার জন্য নয়। বরং তেলাওয়াতের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা, তার উপদেশ গ্রহণ করা এবং বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ اَمۡ عَلٰی قُلُوۡبٍ اَقۡفَالُہَا
‘তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ’ (সূরা মুহাম্মাদ : ২৪)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ اِلَیۡکَ مُبٰرَکٌ لِّیَدَّبَّرُوۡۤا اٰیٰتِہٖ وَ لِیَتَذَکَّرَ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ
‘এ এক কল্যাণময় কিতাব, এটা আমরা আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা ছোয়াদ : ২৯)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুরআনকে অনুধাবন করতেন এবং বুঝে পড়তেন। যেমন সূরা হূদ ও তার অনুরূপ সূরা তাঁর চুল পাকিয়ে দিয়েছিল।[৮]
তেলাওয়াতের সময় গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের মর্ম অনুধাবনের জন্য তা পুনরাবৃত্তি করা। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে সালাতে দাঁড়িয়ে একটি মাত্র আয়াত পড়তে পড়তে ভোর করেছিলেন। আয়াতটি হল-
اِنۡ تُعَذِّبۡہُمۡ فَاِنَّہُمۡ عِبَادُکَ ۚ وَ اِنۡ تَغۡفِرۡ لَہُمۡ فَاِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
‘(হে আল্লাহ!) যদি আপনি তাদের শাস্তি দিন। তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান’ (সূরা আল-মায়েদাহ : ১৮)।[৯] অনুরূপভাবে সাহাবীগণও তাই করতেন (সূরা আল-জাছিয়া : ২১)।[১০]
৯. তেলাওয়াতের সময় সিজদা করা এবং আল্লাহর ভয়ে কান্না করা
পৃথিবীতে সবকিছু আল্লাহকে সিজদা করে। তাঁর সামনে সবাই বিনয় ও নীচতা প্রকাশ করে। মুমিনরা খুশি মনে এবং কাফিররা বাধ্য হয়ে তাঁর সামনে সিজদায় পতিত হয়। তাদের ছায়াগুলো সকাল সন্ধ্যায় তাঁর সামনে ঝুঁকে পড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলোও সকাল-সন্ধ্যায়’ (সূরা আর-রা‘দ : ১৫)। মহান আল্লাহকে সিজদা করার মধ্যে রয়েছে বিশেষ মর্যাদা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِذَا قَرَأَ ابْنُ آدَمَ السَّجْدَةَ فَسَجَدَ اعْتَزَلَ الشَّيْطَانُ يَبْكِيْ يَقُوْلُ يَا وَيْلَتِيْ أُمِرَ ابْنُ آدَمَ بِالسُّجُوْدِ فَسَجَدَ فَلَهُ الْجَنَّةُ وَأُمِرْتُ بِالسُّجُوْدِ فَأَبَيْتُ فَلِي النَّارُ
‘আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পড়ে এবং সিজদা করে, শয়তান তখন কাঁদতে কাঁদতে একদিকে চলে যায় এবং বলে, হায় আমার দুর্ভাগ্য! আদম সন্তানকে সিজদার আদেশ করা হলে সে সিজদা করে। ফলে তার জন্য জান্নাত। আর আমাকে সিজদার আদেশ করা হলে আমি তা অস্বীকার করেছি, ফলে আমার জন্য জাহান্নাম’।[১১]
তাই বলা যায় যে, কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াত আসলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সিজদা করা। বিশেষ করে তেলাওয়াতের সিজদা করা এবং আল্লাহর ভয়ে কান্না করা। এটা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। তবে তা যেন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয়। কুরআন তেলাওয়াতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হত।[১২]
অনুরূপভাবে সাহাবীগণও তেলাওয়াতের সময় সিজদা করত এবং কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ত (সূরা বানী ইসরাঈল : ১০৭-১০৯)।
১০. ‘মাদ’ সহ তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব ‘মাদ’ সহকারে অর্থাৎ ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে, প্রত্যেক অক্ষরকে তার উৎসস্থল থেকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করে, যেখানে টানতে হবে সেখানে টেনে তেলাওয়াত করা। আলেমগণ মাদসহ তেলাওয়াত করাকে শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وَ رَتِّلِ الۡقُرۡاٰنَ تَرۡتِیۡلًا
‘আর কুরআন পাঠ করুন ধীরে ধীরে (সুন্দরভাবে)’ (সূরা আল-মুযযাম্মিল : ৪)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন।[১৩]
১১. অনুগ্রহ কামনা করা এবং মন্দ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা
তেলাওয়াতের সময় রহমতের আয়াত আসলে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত কামনা করা, শাস্তির আয়াত আসলে মন্দ ও শাস্তি থেকে পরিত্রাণ চাওয়া ইত্যাদি।
হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা আল-বাক্বারাহ শুরু করলেন, আমি মনে মনে বললাম যে, হয়তো তিনি একশ’ আয়াত তেলাওয়াত করে রুকূ করবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন, আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি দু’শ আয়াত তেলাওয়াত করে রুকূতে যাবেন, কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি পূর্ণ সূরা এক রাক‘আতেই তেলাওয়াত করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং সূরা আন-নিসা শুরু করে তাও তেলাওয়াত করলেন। তারপর সূরা আলে ‘ইমরানও শুরু করে তাও তেলাওয়াত করে ফেললেন। তিনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। যদি তিনি এমন কোন আয়াত তেলাওয়াত করে ফেলতেন যাতে কোন তাসবীহ রয়েছে তবে তাসবীহ পাঠ করতেন, যদি কোন যাঞ্ছা করার আয়াত তেলাওয়াত করতেন তখন যাঞ্ছা করতেন। যদি কোন বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত তেলাওয়াত করতেন, তখন আশ্রয় প্রার্থনা করতেন’।[১৪]
১২. কুরআনকে হেফাযত করা
কুরআনের অন্যতম আদব হল তা হেফাযত করা অর্থাৎ কুরআনের প্রতি সদা লক্ষ্য রাখা, বারবার তেলাওয়াত করা, মুখস্থ করা এবং স্মরণ রাখা। কেননা এগুলো না করলে কুরআনকে ভুলিয়ে দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
تَعَاهَدُوا الْقُرْآنَ فَوَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَهُوَ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنَ الْإِبِلِ فِيْ عُقُلِهَا
‘তোমরা কুরআনের প্রতি সদা লক্ষ্য রাখবে। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার জীবন রয়েছে, নিশ্চয় কুরআন রশিতে বাঁধা উট অপেক্ষাও অধিক পলায়নপর’।[১৫]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন,
بِئْسَ مَالِأَحَدِهِمْ أَنْ يَقُوْلَ نَسِيْتُ آيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ بَلْ نُسِّيَ وَاسْتَذْكِرُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنْ صُدُوْرِ الرِّجَالِ مِنَ النَّعَمِ
‘কারও এরূপ বলা কি জঘন্য কথা! যে বলে, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং সে যেন বলে তাকে ভুলানো হয়েছে। সুতরাং তোমরা পুনঃ পুনঃ কুরআন স্মরণ করবে। কেননা এটা মানুষের অন্তর হতে চতুষ্পদ জন্তু অপেক্ষাও অধিক পলায়নপর’।[১৬]
নবী (ﷺ) আরো বলেছেন,
إِنَّمَا مَثَلُ صَاحِبِ الْقُرْآنِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْإِبِلِ الْمُعَقَّلَةِ إِنْ عَاهَدَ عَلَيْهَا أَمْسَكَهَا وَإِنْ أَطْلَقَهَا ذَهَبَتْ
‘কুরআনের হাফেযদের উদাহরণ হল- ঐ মালিকের ন্যায়, যে উট বেধে রাখে। যতি সে উট বাধে, তাহলে সে উট তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু সে যদি বাঁধন খুলে দেয়, তাহলে উট নিয়ন্ত্রণে থাকে না, পালিয়ে যায়’।[১৭]
১৩. সুমধুর সুরে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল সুন্দর ও সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করা। কেননা সুমধুর সুর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহ তা‘আলাও তা পসন্দ করেন। তাছাড়া যে ব্যক্তি সুন্দর করে তেলাওয়াত করে না; সে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উম্মত না।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ
‘তোমরা সুমধুর স্বর দ্বারা কুরআনকে সুন্দর কর’।[১৮]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
حَسِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يُزِيْدُ الْقُرْآنَ حُسْنًا
‘তোমরা তোমাদের সুরের দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যম-িত কর। কেননা সুমধুর সুর কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে’।[১৯]
১৪. সাগ্রহে তেলাওয়াত করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল তা সাগ্রহে তেলাওয়াত করা। মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটলে কুরআন পড়া পরিত্যাগ করা।
জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِقْرَؤُوْا الْقُرْآنَ مَا ائْتَلَفَتْ عَلَيْهِ قُلُوْبُكُمْ فَإِذَا اخْتَلَفْتُمْ فَقُوْمُوْا عَنْهُ
‘তোমরা কুরআন পড়, যতক্ষণ তোমাদের মন তা সাগ্রহে চায়। অতঃপর যখন মনের ভাব অন্যরূপ দেখ, তখন তা ছেড়ে উঠে যাও![২০]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ مِنَ اللَّيْلِ فَاسْتَعْجَمَ الْقُرْآنُ عَلَى لِسَانِهِ فَلَمْ يَدْرِ مَا يَقُوْلُ فَلْيَضْطَجِعْ
‘যখন তোমাদের কেউ রাতে উঠবে ও (ঘুমের চাপের কারণে) জিহ্বায় কুরআন পড়তে এমন অসুবিধা বোধ করবে যে, সে কি বলছে তা বুঝতে পারবে না, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে’।[২১]
১৫. তেলাওয়াতের জন্য উত্তম পোশাক এবং সময় নির্ধারণ করা
কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মার্জিত পোশাক পরিধান করা উত্তম। পুরুষের উচিত শরীরে পোশাক রাখা। যদিও মহিলাদের মাথায় কাপড়, হিজাব বা ওড়না থাকা যরূরী নয়, তবুও কুরআন পড়ার সময় আদবের সাথে সালাতের পোশাকের ন্যায় পোশাক পরিধান করা ভাল। এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতীককে সম্মান জানানো হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ذٰلِکَ ٭ وَ مَنۡ یُّعَظِّمۡ شَعَآئِرَ اللّٰہِ فَاِنَّہَا مِنۡ تَقۡوَی الۡقُلُوۡبِ
‘এটাই (আল্লাহর) বিধান। আর কেউ আল্লাহর (দ্বীনের) প্রতীকসমূহের সম্মান করলে এটা তো তা হৃদয়ের তাক্বওয়ারই বহিঃপ্রকাশ’ (সূরা আল-হাজ্জ : ৩২)।
অনুরূপভাবে উত্তম সময় নির্বাচন করা। ব্যস্ত না থাকলে অবসর সময় কুরআন তেলাওয়াত করা ভাল। আর রাতে তেলাওয়াত সবচেয়ে উত্তম (সূরা আল-মুয্যাম্মিল : ৬-৭, ২০)।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে সূরা আস-সাজদাহ এবং সূরা আল-মুলক পাঠ না করা পর্যন্ত ঘুমাতেন না।[২২] বিশেষ করে ফজরের সময় কুরআন তেলাওয়াত করা মর্যাদাপূর্ণ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ ؕ اِنَّ قُرۡاٰنَ الۡفَجۡرِ کَانَ مَشۡہُوۡدًا
‘ফজরের কুরআন। নিশ্চয় ফজরের কুরআন (ফেরেশতা) উপস্থিত থাকে’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৮)।
১৬. কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করা ও খতম করা
কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব হল সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত তেলাওয়াত করা।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
خُذُوْا مِنَ الْأَعْمَالِ مَا تُطِيْقُوْنَ فَإِنَّ اللهَ لَا يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوْا
‘কাজ সেই পরিমাণ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমরা করতে সমর্থ হও। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কখনও ছওয়াবদানে বিরক্তবোধ করেন না, যতক্ষণ না তোমরা বিরক্ত হও’।[২৩]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন,
وَإِنَّ أَحَبَّ الأَعْمَالِ إِلَى اللهِ مَا دَامَ وَإِنْ قَلَّ
‘আর আল্লাহর নিকট ঐ আমল সবচেয়ে প্রিয়, যা সর্বদা করা হয়, তা কম হলেও’।[২৪]
মাঝে মাঝে সময় ও সামর্থ্য অনুযায়ী কুরআন খতম করা উচিত। কুরআন খতমে নেকি অনেক। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا لَا أَقُوْلُ آلم حَرْفٌ. أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيْمٌ حَرْفٌ
‘যে ব্যক্তি কুরআনের কোন একটি অক্ষর পাঠ করবে তার জন্য একটি নেকী রয়েছে। আর এক নেকী হচ্ছে আমলের দশগুণ। আমি বলছি না যে আলিফ-লাম-মীম একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর।[২৫]
কুরআনে অক্ষরের সংখ্যা মতান্তরে ৩,২১,১৮০ অথবা ৩,২৩,০১৫ অথবা ৩,০০৭৪০টি।[২৬]
তাহলে একবার খতম করলে কত নেকি (সুবহা-নাল্লাহ)।
১৭. কুরআন তেলাওয়াত শেষে দু‘আ পড়া
কুরআন পাঠ শেষে দু‘আ পড়াও কুরআন তেলাওয়াতের অন্যতম আদব। খতমের পরেও দু‘আ করা যায়। তবে খতমের পরে নির্দিষ্ট কোন দু‘আ নেই। ‘দু‘আয়ে খতমুল কুরআন’ শিরোনামে যে লম্বা দু‘আ আছে, অনেকেই এটা পড়ে থাকে। এটা শরী‘আতে বৈধ নয়। কারণ এ দু‘আর কোন ভিত্তি নেই। তেলাওয়াত শেষে অনেকেই ‘ছাদাক্বাল্লাহুল আযীম’ (صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمُ) পড়ে। মুহাদ্দিছ উলামায়ে কেরাম এই প্রথাকে বিদ‘আত বলেছেন।[২৭]
নবী (ﷺ) কুরআন পড়তেন এবং খতম করতেন। কিন্তু একটি বারের জন্যও তিনি ঐ দু‘আ পড়েছেন; এ রকম প্রমাণ নেই। সাহাবীদের নিকট কুরআন শুনতেন। কিন্তু তাদেরকে কখনো ঐ দু‘আ পড়তে নির্দেশ দেননি। বরং বলেছেন, (أَمْسِكْ) ‘থামো’[২৮], (حَسْبُكَ الْآنَ) ‘এবার বন্ধ কর’।[২৯]
অবশ্য কুরআন পড়ার মজলিস শেষে কাফফারাতুল মাজলিসের দু‘আ বলা সুন্নাত।
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখনই কোন মজলিসে বসতেন অথবা কুরআন তেলাওয়াত করতেন অথবা সালাত পড়তেন, তখনই বলতেন,
سُبْحَانَكَ اَللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ
‘হে আল্লাহ! আপনার পবিত্রতা আপনার প্রশংসার সাথে, আপনি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই। আমি আপনার নিকট ক্ষমা চাই ও তওবা করি’।[৩০]
জ্ঞাতব্য : উক্ত দু‘আ পাঠ করলে যদি (মজলিস, তেলাওয়াত বা সালাতে) ভাল কথা হয়ে থাকে, তবে তা তার পক্ষে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মোহরস্বরূপ হবে, আর যদি মন্দ কথা হয়ে থাকে, তবে এটা তার পক্ষে কাফ্ফারা হয়ে যাবে।[৩১]
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/১; সহীহ মুসলিম, হা/১৯০৭।
[২]. সহীহ মুসলিম, হা/১৯০৫; মিশকাত, হা/২০৫।
[৩]. সহীহ বুখারী, ‘সিয়াম’ অধ্যায়, ‘অনুচ্ছেদ-২৭; মুসনাদুশ শাফেয়ী, হা/৪১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪২৪৯; নাসাঈ, হা/৫।
[৪]. মুসনাদুল বাযযার, হা/৬০৩, সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২১৩।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/১৭; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৫৯২; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৮০৩; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/২০৬, সনদ সহীহ।
[৬]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৬৮০; মিশকাত, হা/৪৬৫, সনদ সহীহ।
[৭]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৫১৩; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/২৩৫৪; সনদ সহীহ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬৪৫।
[৮]. ইমাম তিরমিযী, আশ-শামাইল (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুল কিতাব, ১৪১২ হি.), পৃ. ৫৭, হা/৪১; ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আল-আছবাহানী, দালাইলুন নবুওত (রিয়াদ : দারুত তায়্যিবাহ, ১৪০৯ হি.), পৃ. ১৩৮।
[৯]. নাসাঈ, হা/১০১০; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৫০, সনদ সহীহ।
[১০]. নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/১১৮৩৩; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১২৩৭, সনদ সহীহ।
[১১]. সহীহ মুসলিম, হা/৮১; ইবনু মাজাহ, হা/১০৫২; মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৭১১; মিশকাত, হা/৮৯৫।
[১২]. সহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২; সহীহ মুসলিম, হা/৮০০; মিশকাত, হা/২১৯৫।
[১৩]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৪৬; সহীহ মুসলিম, হা/৭৭২; নাসাঈ, হা/১৬৬৪; মিশকাত, হা/২১৯১।
[১৪]. সহীহ মুসলিম, হা/৭৭২; নাসাঈ, হা/১৬৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৩০৯; সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, হা/৬৮৪।
[১৫]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৩৩; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯১; মিশকাত, হা/২১৮৭।
[১৬]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৩২; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯০; মিশকাত, হা/২১৮৮।
[১৭]. সহীহ বুখারী হা/৫০৩১; সহীহ মুসলিম হা/৭৮৯; মিশকাত, হা/২১৮৯।
[১৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৫১৭; আবূ দাঊদ, হা/১৪৬৮; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৪২; মিশকাত, হা/২১৯৯, সনদ সহীহ।
[১৯]. দারেমী, হা/৩৫০১; মিশকাত, হা/২২০৮।
[২০]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৬০; মিশকাত, হা/২১৯০।
[২১]. সহীহ মুসলিম, হা/৭৮৭; আবূ দাঊদ, হা/১৩১১; ইবনু মাজাহ, হা/১৩৭২।
[২২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৭০০; তিরমিযী, হা/২৮৯২; শারহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯৬; সনদ সহীহ, সিলসিলা সহীহাহ, হা/৫৮৫।
[২৩]. সহীহ বুখারী, হা/১১৫১; সহীহ মুসলিম, হা/৭৮২; মিশকাত, হা/১২৪৩।
[২৪]. সহীহ বুখারী, হা/৫৮৬১, ‘লিবাস’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৭।
[২৫]. তিরমিযী, হা/২৯১০; মিশকাত, হা/২১৩৭, সনদ সহীহ।
[২৬]. আল-জামিঊ লি আহকামিল কুরআন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৫; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৯।
[২৭]. ফাতাওয়া লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪৯, ফাতাওয়া নং ৩৩০৩; ফাতাওয়া উছায়মীন, ৩৯তম খণ্ড, পৃ. ১-৬।
[২৮]. সহীহ বুখারী, হা/৫০৫৫।
[২৯]. সহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২; সহীহ মুসলিম, হা/৮০০; মিশকাত, হা/২১৯৫।
[৩০]. সুনানুল কুবরা, হা/১০০৬৭, ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাতি’ অধ্যায়, ‘কী বলে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করবে’ অনুচ্ছেদ; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩১৬৪, সনদ সহীহ।
[৩১]. সুনানুল কুবরা, হা/১০০৬৭, ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাতি’ অধ্যায়, ‘কী বলে কুরআন তেলাওয়াত শেষ করবে’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ, হা/১৩৪৪; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩১৬৪, সনদ সহীহ।
Last edited: