অন্যান্য আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস-এর ভয়াবহ দাবানল বা অগ্নিকাণ্ডে মুসলিমদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?

Joined
Feb 18, 2023
Threads
4
Comments
11
Reactions
53
প্রশ্ন: আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস-এর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মুসলিমদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? যেখানে আমাদের মসজিদও পুড়ে গিয়েছে। আমাদের অনেক দ্বীনী ভাই এই আগুন লাগাকে আল্লাহর আজাব বা অভিশাপ বলে প্রচার করছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্ট্যান্ড কী হওয়া উচিত?

উত্তর: আলিমগণ বলেছেন, কাফেরদের উপরে বিপদ-বিপর্যয়, ভূমিকম্প, দাবানল, মহামারী ইত্যাদি আপতিত হলে নিঃসন্দেহে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব (শাস্তি) এবং অন্যান্যদের জন্য সতর্কীকরণ। আর মুমিনদের ওপরে আপতিত বা এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। যারা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে অর্থাৎ যারা তকদিরের লিখনে সন্তুষ্ট থেকে দ্বীনের উপর অবিচল থাকবে, বিপদে ধৈর্য ধারণ করবে, অস্থিরতা প্রকাশ করবে না ও হাহুতাশ করবে না এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে না আল্লাহ তাদের গুনাহ মোচন করেন, আখিরাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তাদেরকে দান করবেন অবারিত প্রতিদান।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنْ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ​

"আর অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফল-ফসলের ক্ষতি সাধনের দ্বারা। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।" [সূরা আল-বাকারা: ১৫৫]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ​

"নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান তাদের পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে হিসাব ছাড়াই।" [সূরা যুমার: ১০]

মুসলিম শরিফের হাদিসে বলা হয়েছে:

عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ: إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ​

"মুমিনের অবস্থা আশ্চর্যজনক! তার সমস্ত বিষয়ই কল্যাণময়। আর এটি মুমিন ব্যতীত কারো জন্য হয় না। যদি তার কাছে সুখের কিছু পৌঁছায়, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আর সেটি তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তাকে দুঃখ স্পর্শ করে, সে ধৈর্য ধারণ করে, আর সেটিও তার জন্য কল্যাণকর হয়।" [সহিহ মুসলিম]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:

الأنبياءُ ثم الأمثلُ فالأمثلُ يُبتَلى الناسُ على قدرِ دِينِهم فمن ثَخنَ دِينُه اشتدَّ بلاؤه ومن ضعُف دِينُه ضعُفَ بلاؤه وإنَّ الرجلَ لَيصيبُه البلاءُ حتى يمشيَ في الناسِ ما عليه خطيئةٌ​

“মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হন, নবীগণ। তারপর তাদের পর যারা উত্তম, তারপর তাদের পর যারা উত্তম। একনাগাড়ে বান্দার উপর বিপদ আপতিত হতে থাকে, যতক্ষণ না তা তাকে এমন অবস্থায় পৌঁছে দেয় যে, সে পৃথিবীতে পাপমুক্ত হয়ে চলতে থাকে।” [সহিহ তারগিব, ৩৪০২]

আহমদ তার মুসনাদে আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

ما يزالُ البلاءُ بالمؤمنِ والمؤمنةِ في نفسِه وولدِه ومالِه حتَّى يلقَى اللهَ تعالَى وما عليه خطيئةٌ​

“মুমিন পুরুষ বা মুমিন নারীর জীবন, সন্তান বা সম্পত্তিতে বিপদ আপতিত হতে থাকে, যতক্ষণ না সে আল্লাহর সঙ্গে পাপমুক্ত অবস্থায় সাক্ষাৎ করে।” [আত তারগিব ২/২২৬-সহিহ বা হাসান]

পক্ষান্তরে আল্লাহ দ্রোহী জালিম গোষ্ঠী ধ্বংস হলে তাদের জুলুম, অন্যায়-অবিচার, পাপাচার এবং অনিষ্ট থেকে মানুষ-জীবজন্তু-পশুপাখি সবাই নিষ্কৃতি লাভ করে। আল্লাহর জমিন থেকে পাপ পঙ্কিলতা হ্রাস পায়। জালিমদের ধ্বংসের ফলে মজলুমের মনে প্রশান্তি আসে। এই কারণে আমরা আল্লাহর জমিনে পাপ পঙ্কিলতা ও নোংরামি বিস্তৃত কারী জালিমদের ধ্বংসে আনন্দ অনুভব করব।

এ বিষয়ে বিখ্যাত ফতোয়ার ওয়েব সাইট ইসলাম ওয়েব (islamweb) এ লেখা হয়েছে:

فإذا فرح المسلم بما يصيب الظلمة والكفرة من المصائب؛ لكون ذلك يقلل من فسادهم وشرهم، أو يكف شيئا من بأسهم، أو يكون عبرة وذكرى لهم ولغيرهم، أو غير ذلك مما يوافق مراد الشرع، ولا يخالف الفطرة، ففرحه هذا محمود، وقد مر على رسول الله صلى الله عليه وسلم بجنازة، فقال: مستريح ومستراح منه، قالوا: يا رسول الله، ما المستريح والمستراح منه؟ قال: العبد المؤمن يستريح من نصب الدنيا وأذاها إلى رحمة الله، والعبد الفاجر يستريح منه العباد والبلاد والشجر والدواب. رواه البخاري ومسلم.​

"যদি কোনও মুসলমান অত্যাচারী ও অবিশ্বাসীদের বিপদ বা দুঃখে আনন্দিত হয় এই কারণে যে, তা তাদের অন্যায়-অপকর্ম ও মন্দ কার্যক্রম কমিয়ে দেয় অথবা তাদের কোনও ক্ষতি থেকে বিরত রাখে অথবা তাদের ও অন্যদের জন্য শিক্ষার উপাদান হয়, কিংবা এমন কিছু হয় যা শরিয়তের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ফিতরতের বিপরীত না হয় তাহলে এই আনন্দ প্রশংসনীয়।

রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একবার একটি জানাজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বললেন: "কেউ শান্তি পেয়েছে এবং কারো কাছ থেকে শান্তি পাওয়া হয়েছে।" সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, "হে আল্লাহর রসুল, কে শান্তি পেয়েছে এবং কার কাছ থেকে শান্তি পাওয়া হয়েছে?" তিনি বললেন: "মুমিন বান্দা দুনিয়ার ক্লান্তি ও কষ্ট থেকে আল্লাহর রহমতের দিকে শান্তি পায়, আর পাপী বান্দা থেকে মানুষ, দেশ, গাছপালা এবং জীবজন্তু শান্তি পায়।" [এটি বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে]”

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে মুমিনদের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

১. মুমিনগণ এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করবে। তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর শক্তি অসীম। তিনি অপরাজেয় শক্তির অধিকারী। তার শক্তিমত্তা ও পরাক্রমের সামনে সৃষ্টি জগত অত্যন্ত তুচ্ছ। ফলে সে আরও বেশি আল্লাহর প্রতি অভিমূখী হবে এবং তার আনুগত্যের সামনে নিজেকে সমর্পণ করবে।

২. পাশাপাশি সে আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করবে। অর্থাৎ যখন মানুষ শান্তি ও নিরাপদে থাকে তখন সে আল্লাহর কত বড় নিয়ামতে ডুবে থাকে সে কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করবে এবং যে সময় সে আল্লাহর ব্যাপারে গাফেল থাকে বা তাকে ভুলে থাকে সে জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

৩. এসব ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখে সে কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা স্মরণ করবে।

৪. সে আরও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে বান্দাকে ভীতি প্রদর্শন করেন যেন, তারা তাদের পাপাচার থেকে তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসে। আল্লাহ বলেন,

وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلَّا تَخْوِيفًا​

"আর আমরা নিদর্শনসমূহ প্রেরণ করি কেবল ভয় প্রদর্শনের জন্য।" [সূরা ইসরা: ৫৯]

কাতাদা রহ. বলেছেন,

"إِنَّ اللَّهَ يُخَوِّفُ النَّاسَ بِمَا شَاءَ مِنْ آيَاتِه لَعَلَّهُمْ يَعْتَبِرُونَ، أَوْ يَذَّكَّرُونَ، أَوْ يَرْجِعُونَ"​

"নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহের মাধ্যমে মানুষকে যেভাবে ইচ্ছা ভয় প্রদর্শন করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে, স্মরণ করে বা ফিরে আসে।"

জালিম সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নিকট বদদুআ করা:

- নুহ আলাইহিস সালাম সীমা লঙ্ঘনকারী জালিমদের ধ্বংসের জন্য দোয়া করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{ وَقَالَ نُوحٞ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ دَيَّارًا }
{ إِنَّكَ إِن تَذَرۡهُمۡ يُضِلُّواْ عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوٓاْ إِلَّا فَاجِرٗا كَفَّارٗا }​

"নুহ আরও বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! জমিনের কাফিরদের মধ্য থেকে কোনও গৃহবাসীকে ছেড়ে দিবেন না ।আপনি তাদেরকে ছেড়ে দিলে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুষ্কৃতিকারী-কাফির।" [সূরা নূহ: ২৬ ও ২৭]

- মুসা আলাইহিস সালাম ফেরান এবং তার অনুসারীদের জন্য বদ দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ বলেন,

{ وَقَالَ مُوسَىٰ رَبَّنَآ إِنَّكَ ءَاتَيۡتَ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَأَهُۥ زِينَةٗ وَأَمۡوَٰلٗا فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّواْ عَن سَبِيلِكَۖ رَبَّنَا ٱطۡمِسۡ عَلَىٰٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ وَٱشۡدُدۡ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَلَا يُؤۡمِنُواْ حَتَّىٰ يَرَوُاْ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِيمَ }​

"মুসা বললেন, ‘হে আমাদের রব! আপনি তো ফিরাউন ও তার পরিষদবর্গকে দুনিয়ার জীবনে শোভা ও সম্পদ দান করেছেন। যা দ্বারা তারা মানুষকে আপনার পথ থেকে ভ্রষ্ট করে। হে আমাদের রব।

হে প্রভু-পরওয়ারদিগার! তাদের সম্পদ নষ্ট করে দিন আর তাদের অন্তর শক্ত করে দিন। ফলে তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।"[ সুরা ইউনুস: ৮৮]

- নবী করীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম নিজেও যে সকল মুশরিকরা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তাদের বিরুদ্ধে বদ দোয়া করেছেন ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর সমকালীন দুর্ভিক্ষের মতো দুর্ভিক্ষ দেওয়ার জন্য। এবং বাস্তবেও তা ঘটেছিল। [সহিহ বুখারী]

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়ে যেসব ইমানদার-সৎকর্মশীল মৃত্যু বরণ করে তাদের পরিণতি কী?

এ কথা সত্য যে, পৃথিবীতে যখন বিপদ-বিপর্যয় ও বালা-মসিবত নেমে আসে তখন কাফের-মুশরিকদের পাশাপাশি ইমানদার ও নিরাপরাধ ভালো মানুষ, শিশু বাচ্চা ইত্যাদি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাই পৃথিবীতে আল্লাহর নিয়ম।

এক্ষেত্রে কথা হলো, বিপদাপদ ও দুর্যোগে যেসব সৎকর্ম শীল ও ভালো মানুষ মৃত্যু বরণ করবে এবং যারা শাস্তির হকদার ছিল না তারপরও শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তাঁর জ্ঞানের আলোকে তাদের নিয়ত অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করবেন। অর্থাৎ ইমানদার সৎকর্ম শীলদেরকে তিনি আখিরাতে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন। কিন্তু যারা কাফের-মুশরিক ও আল্লাহ দ্রোহী তারা দুনিয়াতে যেমন ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিলো তারা আখিরাতেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। অর্থাৎ তাদেরকে তিনি আখিরাতের জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনে নিক্ষেপ করবেন।

আল্লাহু আলাম।

আল্লাহ আমাদেরকে সবধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।



- আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি​
 
Back
Top