ইসলাম সাংঘর্ষিক কিংবা মন্দ কথা বলার পর কেউ যদি বলে, আপনার একথা ইসলামের দৃষ্টিতে ভুল ও আপত্তিকর। তখন জবাব আসে, আমি তো তা ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই বলেছি। আমার তো কোনো খারাপ অভিপ্রায় ছিল না। আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন সালিহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘অনেক মানুষ বলে, অন্তর ও উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে শব্দ ও বাক্য শুদ্ধ করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের একথা কি সঠিক?”
জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের একথা দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় যে, আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী বাক্য ও শব্দকে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে বলা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তা সঠিক। কেননা, যদি অর্থ ঠিক থাকে তবে ব্যাকরণগত ভুল তেমন দোষণীয় নয়। আর যদি উদ্দেশ্য হয় যে, শিরক ও কুফরী বোঝায় এমন কথা ও বাক্যকে শুদ্ধ করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তাদের এ কথা ভুল। বরং সেসব বাক্য ও কথা অবশ্যই শুদ্ধ করতে হবে। একথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, নিয়ত ঠিক রেখে তোমার জিহ্বায় যা আসে তাই বলো। বরং ইসলামী শারীআত অনুযায়ী বাক্য ও কথাকে অবশ্যই শুদ্ধ করতে হবে।'
কুফরী ও শিরকী নিয়ত না থাকলেও অনেক সময় উচ্চারিত কথার কারণে মানুষ ঈমানহারা হয়ে যেতে পারে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“যদি তাদেরকে প্রশ্ন করেন তাহলে তারা বলবে, 'আমরা তো শুধুই কথাবার্তা বলছিলাম আর খেল-তামাশা করছিলাম।'
এ আয়াত প্রমাণ করে, তারা নিজেদের অজুহাতের কথা স্বীকার করেছিল।
আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন,
'তোমরা কি আল্লাহ ও তাঁর বিধানসমূহ এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছিলে? তোমরা অজুহাত দেখিয়ো না। তোমরা ঈমান আনার পর কুফরী করেছো।'১
এ আয়াত প্রমাণ করেন, তাদের কুফরী করা মোটেও উদ্দেশ্য ছিল না। তারা মনে করেছিল, এসব কথা কুফরী নয়। তারপরও আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কুফরী। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ঈমান আনার পর কাফির হয়ে যায়। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা দুর্বল ঈমানদার ছিল। হারাম জানার পরও তারা সেই হারামে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে তারা তা কুফরী মনে করেনি। তারা তা কুফরী বলে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও কাফির হয়ে যায়।”২
এ ব্যাপারে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তার সে-আলোচনা দীর্ঘ হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো। তিনি বলেন,
‘আমরা অনেক স্পষ্ট দলীল এবং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস পায়। সেসব দলীল ও হাদীস থেকে প্রতিভাত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন আমল সংশোধনের ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেছেন, তেমন কথা ও বাক্য সংশোধনের ব্যাপারেও গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
যেমন তিনি বলেন,
তা থেকে বেঁচে থাকবে যার কারণে কৈফিয়াত পেশ করতে হয় ও ক্ষমা চাইতে হয়।৩
এই হাদীসটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সমৃদ্ধ হাদীস।
এই হাদীসের তুনলায় আরেকটি অত্যন্ত স্পষ্ট হাদীস পাওয়া যায়। সেই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
এমন কোনো কথা বলবে না যার কারণে মানুষের কাছে কৈফিয়াত পেশ করতে হয় ও ক্ষমা চাইতে হয়।৪
কথা বলার সময় শুধু নিয়্যাতটাই মূখ্য বিষয় নয়—তা আরও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্ম থেকে। তাঁর কোনো সাহাবী থেকে কখনো ভুল কথা ও বাক্য প্রকাশ পেলে তিনি সেই সাহাবীর অন্তরের শুদ্ধতার দিকে তাকাতেন না। অন্তর ও নিয়্যাতের দিকে না তাকিয়েই সরাসরি তার বাক্যকে সঠিক করে দিতেন। কারণ, জগত-সমূহের রবের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি তাদের কথা ও আমলকেও পরিশুদ্ধ করে দেবেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন। সেই সময় কোনো এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বলল, 'আল্লাহ যা চান ও আপনি যা চান, ইয়া রাসূলাল্লাহ।' তার এ কথা শুনে কিছুটা অস্বস্তি ও রাগ নিয়ে তিনি বললেন, “তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলে? বরং সেভাবে না বলে এভাবে বলো, “আল্লাহ এককভাবে যা চান।”
অন্য বর্ণনায় আছে, এভাবে বলো, ‘আল্লাহ যা চান তারপর আপনি যা চান।৫
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই কথা ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলে?'—নিয়ে গভীরভাবে ভাবুন ও চিন্তা করুন। আমরা যদি সেই সাহাবীকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর শরীক ও অংশীদার বানানো কি আপনার উদ্দেশ্য ছিলো?' তিনি অবশ্যই বলতেন, ‘নাঊযুবিল্লাহ! আল্লাহর সাথে শরীক ও অংশীদার স্থাপন করা থেকে মুক্তির পাওয়ার জন্যই তো মুহাম্মাদকে নবী ও রাসূল হিসেবে তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।' এরপরও নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাক্য বলা নিয়ে আপত্তি তোলেন। অথচ বোঝাই যাচ্ছে, সেই সাহাবীর উদ্দেশ্য এমনটা ছিলো না।
এ ধরনের আরেকটি হাদীস পাওয়া যায়। হাদীসটি হলো,
এক সাহাবী সকাল বেলা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আজ রাতে একটি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা হলো, আমি মদীনার কোনো এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। পথিমধ্যে এক ইহুদীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাকে বললাম, ‘ইহুদী সম্প্রদায়, তোমরা যদি “ওযাইরকে আল্লাহর সন্তান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।' সেই ইহুদী আমার বিপরীতে বললো, 'মুসলিম সম্প্রদায়, তোমরা যদি “আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মাদ যা চান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।'
এরপর আমি আবার চলা শুরু করলাম। পথিমধ্যে এক খ্রিষ্টানের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাকে বললাম, ‘খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, তোমরা যদি ‘ঈসাকে আল্লাহর সন্তান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।' সেই খ্রিষ্টান আমার বিপরীতে বললো, ‘মুসলিম সম্প্রদায়, তোমরা যদি 'আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মাদ যা চান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।'
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটিকে বলেন, “তুমি তোমার এই স্বপ্ন কাউকে বলেছ?' লোকটি বললো, “না”।
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবায় দাঁড়ালেন। খুতবায় সাহাবীদের বললেন, আমি যখন তোমাদের কাউকে ‘আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মাদ যা চান' বলতে শুনতাম তখন লজ্জা পেতাম। এখন থেকে তোমাদের কেউ যেন 'আল্লাহ যান ও মুহাম্মাদ চান' না বলে; বরং যেন বলে, ‘একমাত্র আল্লাহ যা চান।”৬
এই হাদীস ও পূর্বের হাদীসে বাক্যকে শুদ্ধ করার ব্যাপারটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘আল্লাহর কসম, আমার নিয়্যাত উত্তম আছে'— একথার ধোঁকায় কেউ যেন না পড়ে। ভাই আমার, আল্লাহ তোমার ও তোমার উত্তম নিয়্যাতে বরকত দিন। তুমি কি চাও না আল্লাহ যেন তোমার উত্তম কথায় বরকত দেন?! তুমি কি পছন্দ করো না যে, তোমার ভালো আমলের সাথে সাথে যেন তোমার কথা ও বাক্যও ভালো হোক?
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাক্য ও কথা শুদ্ধ ও সুন্দর করার ব্যাপারে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। অথচ এ বিষয়টির ব্যাপারে আজ অধিকাংশ মুসলিম অসচেতন। শুনুন এ ব্যাপারে তিনি কী বলেছেন। তিনি বলেন, 'তোমাদের কেউ যেন না বলে আমার নফস খবীস হয়ে গেছে; বরং যেন বলে, লাকিস হয়ে গেছে।৭
এই হাদীসে তিনি নফসের ক্ষেত্রে খবীস না বলে লাকিস বলতে বলেছেন। অথচ খবীস ও লাকিস উভয়ের অর্থ একই। তবে খবীস শব্দ সামাজিকভাবে নীচু মানের শব্দ। তাই তিনি একই অর্থবোধক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে বলেছেন; যাতে সে শব্দ মোলায়েম ও সুশ্ৰী শোনা যায়।
এই হাদীসে মুসলিম ব্যক্তির নফসের অবস্থা বোঝানো হয়েছে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, মুসলিমের অবস্থা শিষের মতো। বাতাস প্রবাহিত হলে শিষ একবার ডানে হেলে পড়ে আবার বামে হেলে পড়ে। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ বাতাসে শিষ যেমন এদিক সেদিক হেলে পড়ে, তেমন মুমিনের নফস প্রবৃত্তি ও কামনার তাড়নায় এদিক সেদিক চলে যায়।
নফস এদিক সেদিক তখন চলে যায় যখন তাতে খবীস জিনিস সংযুক্ত হয়। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত হাদীসে মূলত এই খবীস অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু সরাসরি খবীস শব্দ প্রয়োগ না করে লাকিস শব্দ প্রয়োগ করতে বলেছেন।
ইসলাম যখন তার অনুসারীকে নিজের খবীস নফসের ক্ষেত্রে ভালো শব্দ প্রয়োগ করার পরামর্শ দেয় এবং বাক্য সংশোধন করতে বলে, তখন দ্বীন নবী ও রবের ক্ষেত্রে কীভাবে অশুদ্ধ ও খারাপ বাক্য ব্যবহার করা বৈধ হতে পারে?! অবশ্যই অবশ্যই তা বৈধ হতে পারে না।
অন্তর ও আমল সংশোধন করার লক্ষ্যে যেমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটেছে তেমন বাক্য ও কথা সংশোধনের লক্ষ্যেও তাঁর আগমন ঘটেছে। এসবের ক্ষেত্রে নিয়্যাত ঠিক থাকা যথেষ্ট নয়।৮
১. সূরা তাওবা, আয়াত : ৬৫-৬৬
২. মাজমূউল ফাতওয়া, ৭/২৭৩
৩. সিলসিলাহ সহীহাহ, ৩৫৪
৪. সিলসিলাহ সহীহাহ, ১৯১৪
৫. মুসনাদ আহমাদ, ১৮৩৯
৬. সুনানু ইবন মাজাহ, ২১১৮
৭. সহীহুল বুখারী, ৫৯৭০; সহীহ মুসলিস, ২২৫০
৮. মুওয়াফাকাতুল মুবাত্তানুল মুখবার, পৃ. ১৫-২৫
জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের একথা দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় যে, আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী বাক্য ও শব্দকে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে বলা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তা সঠিক। কেননা, যদি অর্থ ঠিক থাকে তবে ব্যাকরণগত ভুল তেমন দোষণীয় নয়। আর যদি উদ্দেশ্য হয় যে, শিরক ও কুফরী বোঝায় এমন কথা ও বাক্যকে শুদ্ধ করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তাদের এ কথা ভুল। বরং সেসব বাক্য ও কথা অবশ্যই শুদ্ধ করতে হবে। একথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, নিয়ত ঠিক রেখে তোমার জিহ্বায় যা আসে তাই বলো। বরং ইসলামী শারীআত অনুযায়ী বাক্য ও কথাকে অবশ্যই শুদ্ধ করতে হবে।'
কুফরী ও শিরকী নিয়ত না থাকলেও অনেক সময় উচ্চারিত কথার কারণে মানুষ ঈমানহারা হয়ে যেতে পারে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ
“যদি তাদেরকে প্রশ্ন করেন তাহলে তারা বলবে, 'আমরা তো শুধুই কথাবার্তা বলছিলাম আর খেল-তামাশা করছিলাম।'
এ আয়াত প্রমাণ করে, তারা নিজেদের অজুহাতের কথা স্বীকার করেছিল।
আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন,
قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (٥٦) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ
'তোমরা কি আল্লাহ ও তাঁর বিধানসমূহ এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছিলে? তোমরা অজুহাত দেখিয়ো না। তোমরা ঈমান আনার পর কুফরী করেছো।'১
এ আয়াত প্রমাণ করেন, তাদের কুফরী করা মোটেও উদ্দেশ্য ছিল না। তারা মনে করেছিল, এসব কথা কুফরী নয়। তারপরও আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কুফরী। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ঈমান আনার পর কাফির হয়ে যায়। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা দুর্বল ঈমানদার ছিল। হারাম জানার পরও তারা সেই হারামে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে তারা তা কুফরী মনে করেনি। তারা তা কুফরী বলে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও কাফির হয়ে যায়।”২
এ ব্যাপারে আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তার সে-আলোচনা দীর্ঘ হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো। তিনি বলেন,
‘আমরা অনেক স্পষ্ট দলীল এবং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস পায়। সেসব দলীল ও হাদীস থেকে প্রতিভাত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন আমল সংশোধনের ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেছেন, তেমন কথা ও বাক্য সংশোধনের ব্যাপারেও গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
যেমন তিনি বলেন,
وَإِيَّاكَ وَمَا يُعْتَذَرُ مِنْهُ
তা থেকে বেঁচে থাকবে যার কারণে কৈফিয়াত পেশ করতে হয় ও ক্ষমা চাইতে হয়।৩
এই হাদীসটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সমৃদ্ধ হাদীস।
এই হাদীসের তুনলায় আরেকটি অত্যন্ত স্পষ্ট হাদীস পাওয়া যায়। সেই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا تَكَلَّمَنَّ بِكَلَّامٍ يَعْتَذِرُ بِهِ عِنْدَ النَّاسِ
এমন কোনো কথা বলবে না যার কারণে মানুষের কাছে কৈফিয়াত পেশ করতে হয় ও ক্ষমা চাইতে হয়।৪
কথা বলার সময় শুধু নিয়্যাতটাই মূখ্য বিষয় নয়—তা আরও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্ম থেকে। তাঁর কোনো সাহাবী থেকে কখনো ভুল কথা ও বাক্য প্রকাশ পেলে তিনি সেই সাহাবীর অন্তরের শুদ্ধতার দিকে তাকাতেন না। অন্তর ও নিয়্যাতের দিকে না তাকিয়েই সরাসরি তার বাক্যকে সঠিক করে দিতেন। কারণ, জগত-সমূহের রবের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি তাদের কথা ও আমলকেও পরিশুদ্ধ করে দেবেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন। সেই সময় কোনো এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বলল, 'আল্লাহ যা চান ও আপনি যা চান, ইয়া রাসূলাল্লাহ।' তার এ কথা শুনে কিছুটা অস্বস্তি ও রাগ নিয়ে তিনি বললেন, “তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলে? বরং সেভাবে না বলে এভাবে বলো, “আল্লাহ এককভাবে যা চান।”
অন্য বর্ণনায় আছে, এভাবে বলো, ‘আল্লাহ যা চান তারপর আপনি যা চান।৫
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই কথা ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলে?'—নিয়ে গভীরভাবে ভাবুন ও চিন্তা করুন। আমরা যদি সেই সাহাবীকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর শরীক ও অংশীদার বানানো কি আপনার উদ্দেশ্য ছিলো?' তিনি অবশ্যই বলতেন, ‘নাঊযুবিল্লাহ! আল্লাহর সাথে শরীক ও অংশীদার স্থাপন করা থেকে মুক্তির পাওয়ার জন্যই তো মুহাম্মাদকে নবী ও রাসূল হিসেবে তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।' এরপরও নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাক্য বলা নিয়ে আপত্তি তোলেন। অথচ বোঝাই যাচ্ছে, সেই সাহাবীর উদ্দেশ্য এমনটা ছিলো না।
এ ধরনের আরেকটি হাদীস পাওয়া যায়। হাদীসটি হলো,
এক সাহাবী সকাল বেলা নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আজ রাতে একটি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা হলো, আমি মদীনার কোনো এক রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। পথিমধ্যে এক ইহুদীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাকে বললাম, ‘ইহুদী সম্প্রদায়, তোমরা যদি “ওযাইরকে আল্লাহর সন্তান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।' সেই ইহুদী আমার বিপরীতে বললো, 'মুসলিম সম্প্রদায়, তোমরা যদি “আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মাদ যা চান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।'
এরপর আমি আবার চলা শুরু করলাম। পথিমধ্যে এক খ্রিষ্টানের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। আমি তাকে বললাম, ‘খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, তোমরা যদি ‘ঈসাকে আল্লাহর সন্তান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।' সেই খ্রিষ্টান আমার বিপরীতে বললো, ‘মুসলিম সম্প্রদায়, তোমরা যদি 'আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মাদ যা চান' বলার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শরীক না করতে তবে তোমরা কতই না উত্তম জাতি।'
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটিকে বলেন, “তুমি তোমার এই স্বপ্ন কাউকে বলেছ?' লোকটি বললো, “না”।
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবায় দাঁড়ালেন। খুতবায় সাহাবীদের বললেন, আমি যখন তোমাদের কাউকে ‘আল্লাহ যা চান ও মুহাম্মাদ যা চান' বলতে শুনতাম তখন লজ্জা পেতাম। এখন থেকে তোমাদের কেউ যেন 'আল্লাহ যান ও মুহাম্মাদ চান' না বলে; বরং যেন বলে, ‘একমাত্র আল্লাহ যা চান।”৬
এই হাদীস ও পূর্বের হাদীসে বাক্যকে শুদ্ধ করার ব্যাপারটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘আল্লাহর কসম, আমার নিয়্যাত উত্তম আছে'— একথার ধোঁকায় কেউ যেন না পড়ে। ভাই আমার, আল্লাহ তোমার ও তোমার উত্তম নিয়্যাতে বরকত দিন। তুমি কি চাও না আল্লাহ যেন তোমার উত্তম কথায় বরকত দেন?! তুমি কি পছন্দ করো না যে, তোমার ভালো আমলের সাথে সাথে যেন তোমার কথা ও বাক্যও ভালো হোক?
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাক্য ও কথা শুদ্ধ ও সুন্দর করার ব্যাপারে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। অথচ এ বিষয়টির ব্যাপারে আজ অধিকাংশ মুসলিম অসচেতন। শুনুন এ ব্যাপারে তিনি কী বলেছেন। তিনি বলেন, 'তোমাদের কেউ যেন না বলে আমার নফস খবীস হয়ে গেছে; বরং যেন বলে, লাকিস হয়ে গেছে।৭
এই হাদীসে তিনি নফসের ক্ষেত্রে খবীস না বলে লাকিস বলতে বলেছেন। অথচ খবীস ও লাকিস উভয়ের অর্থ একই। তবে খবীস শব্দ সামাজিকভাবে নীচু মানের শব্দ। তাই তিনি একই অর্থবোধক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে বলেছেন; যাতে সে শব্দ মোলায়েম ও সুশ্ৰী শোনা যায়।
এই হাদীসে মুসলিম ব্যক্তির নফসের অবস্থা বোঝানো হয়েছে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, মুসলিমের অবস্থা শিষের মতো। বাতাস প্রবাহিত হলে শিষ একবার ডানে হেলে পড়ে আবার বামে হেলে পড়ে। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ বাতাসে শিষ যেমন এদিক সেদিক হেলে পড়ে, তেমন মুমিনের নফস প্রবৃত্তি ও কামনার তাড়নায় এদিক সেদিক চলে যায়।
নফস এদিক সেদিক তখন চলে যায় যখন তাতে খবীস জিনিস সংযুক্ত হয়। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত হাদীসে মূলত এই খবীস অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু সরাসরি খবীস শব্দ প্রয়োগ না করে লাকিস শব্দ প্রয়োগ করতে বলেছেন।
ইসলাম যখন তার অনুসারীকে নিজের খবীস নফসের ক্ষেত্রে ভালো শব্দ প্রয়োগ করার পরামর্শ দেয় এবং বাক্য সংশোধন করতে বলে, তখন দ্বীন নবী ও রবের ক্ষেত্রে কীভাবে অশুদ্ধ ও খারাপ বাক্য ব্যবহার করা বৈধ হতে পারে?! অবশ্যই অবশ্যই তা বৈধ হতে পারে না।
অন্তর ও আমল সংশোধন করার লক্ষ্যে যেমন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটেছে তেমন বাক্য ও কথা সংশোধনের লক্ষ্যেও তাঁর আগমন ঘটেছে। এসবের ক্ষেত্রে নিয়্যাত ঠিক থাকা যথেষ্ট নয়।৮
- উস্তায আব্দুল্লাহ মাহমুদ।
১. সূরা তাওবা, আয়াত : ৬৫-৬৬
২. মাজমূউল ফাতওয়া, ৭/২৭৩
৩. সিলসিলাহ সহীহাহ, ৩৫৪
৪. সিলসিলাহ সহীহাহ, ১৯১৪
৫. মুসনাদ আহমাদ, ১৮৩৯
৬. সুনানু ইবন মাজাহ, ২১১৮
৭. সহীহুল বুখারী, ৫৯৭০; সহীহ মুসলিস, ২২৫০
৮. মুওয়াফাকাতুল মুবাত্তানুল মুখবার, পৃ. ১৫-২৫