আমানত আদায়ের আরো কিছু নমুনা :
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ওহোদের দিন তার পিতা ছয় মেয়ে ও কিছু ঋণ তার উপর রেখে শাহাদত বরণ করেন। (তিনি বলেন,) এরপর যখন খেজুর কাটার সময় এল তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বললাম, আপনি জানেন যে, আমার পিতা ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং বিশাল ঋণভার রেখে গেছেন। এখন আমি চাই ঋণদাতাগণ আপনাকে দেখুক। তখন তিনি বললেন, তুমি যাও এবং বাগানের এক কোণে সব খেজুর কেটে জমা কর। জাবির (রাঃ) বলেন, আমি তাই করলাম। এরপর নবী করীম (ﷺ)-কে ডেকে আনলাম। যখন তারা নবী করীম (ﷺ)-কে দেখলেন, তখন তারা আমার উপর আরো রাগান্বিত হ’লেন। নবী করীম (ﷺ) তাদের আচরণ দেখে বাগানের বড় স্তূপটির চারপাশে তিনবার ঘুরে এসে এর উপর বসে বললেন, তোমার ঋণদাতাদেরকে ডাক। তিনি তাদেরকে মেপে মেপে দিতে লাগলেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা আমার পিতার আমানত (ঋণ) আদায় করে দিলেন। আমিও চাচ্ছিলাম যে, একটি খেজুর নিয়ে আমি আমার বোনদের নিকট যেতে না পারলেও আল্লাহ তা‘আলা যেন আমার পিতার আমানত আদায় করে দেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা খেজুরের সবক’টি স্তূপই অবশিষ্ট রাখলেন। এমনকি আমি দেখলাম যে, নবী করীম (ﷺ) যে গাদায় উপবিষ্ট ছিলেন তার থেকে যেন একটি খেজুরও কমেনি।[1]
যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদদের কারণে আবুবকর (রাঃ) আমার নিকটে লোক পাঠালেন তখন তাঁর কাছে ওমর (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, ওমর (রাঃ) আমার কাছে এসে বলেছেন যে, কুরআনের বহু হাফেয ইমামার যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এজন্য আমার ভয় হচ্ছে যে, আরো অনেক জায়গায় যদি কুরআনের হাফেযগণ এমন ব্যাপক হারে শহীদ হন, তাহ’লে কুরআনের বহু অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং আমি মনে করি যে, আপনি কুরআন সংকলনের আদেশ দিন। আমি বললাম, কী করে আমি এমন কাজ করব, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেননি? ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটা উত্তম কাজ। ওমর (রাঃ) আমাকে এ বিষয়ে বারবার বলছিলেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা আমার অন্তর খুলে দিলেন। যে বিষয়ে তিনি ওমর (রাঃ)-এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন এবং আমিও এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করলাম, যা ওমর (রাঃ) পোষণ করেছিলেন। যায়েদ (রাঃ) বলেন যে, এরপর আবুবকর (রাঃ) বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক, তোমার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। তুমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অহী লিখতে। কাজেই তুমি কুরআন খোঁজ কর এবং তা একত্রিত কর। যায়েদ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! কুরআন খোঁজ করে একত্রিত করার নির্দেশ না দিয়ে যদি আমাকে পাহাড়গুলোর একটিকে স্থানান্তর করার দায়িত্ব অর্পণ করা হ’ত, তাও আমার জন্য ভারী মনে হ’ত না। আমি বললাম, কী করে আপনারা দু’জন এমন একটি কাজ করবেন, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেননি। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! এটি একটি উত্তম কাজ। আমি আমার কথা বার বার বলতে থাকলাম। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা আমার অন্তর খুলে দিলেন, যে বিষয়ে আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন এবং তাঁরা দু’জন যা ভাল মনে করলেন আমিও তা ভাল মনে করলাম। কাজেই আমি কুরআন খোঁজ করতে শুরু করলাম খেজুরের ডাল, পাতলা চামড়ার টুকরা, সাদা পাথর ও মানুষের অন্তর থেকে আমি কুরআন জমা করলাম।
সূরা তওবার শেষ অংশ لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন’... (তওবাহ ৯/১২৮) থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এ অংশটুকু খুযাইমাহ কিংবা আবু খুযাইমাহর কাছে পেলাম। আমি তা সূরার সঙ্গে জুড়ে দিলাম। কুরআনের এ সংকলিত ছহীফাগুলো আবুবকরের জীবনকাল পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে ওফাত দিলেন। পরে ওমরের জীবনকাল পর্যন্ত তাঁর নিকট ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাঁর ওফাত দিলেন, তারপর হাফছাহ বিনতে ওমর (রাঃ)-এর কাছে ছিল।[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আমানতের দৃষ্টান্ত :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন মানব জাতির মাঝে সর্বাধিক তাক্বওয়াশীল এবং নীতিবান। ন্যায়-ইনছাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর মাঝে পক্ষপাতের লেশমাত্র বিদ্যমান ছিল না। তেমনিভাবে ঋণ পরিশোধ ও আমানতদারীর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বদা সচেতন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। নিম্নে তাঁর আমানতদারীতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল।-
১। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ) ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এক প্রকার (রঙিন) চামড়ার থলেতে করে সামান্য কিছু স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তখনও এগুলো থেকে সংযুক্ত মাটি পরিস্কার করা হয়নি। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চার জনের মাঝে স্বর্ণখন্ডটি বণ্টন করে দিলেন। তারা হ’লেন, ‘উয়াইনাহ ইবনু বাদর, আকরা ইবনু হাবিস, যায়েদ আল-খায়ল এবং চতুর্থ জন আলকামাহ কিংবা ‘আমির ইবনু তুফায়ল (রাঃ)। তখন সাহাবীগণের মধ্য থেকে একজন বললেন, এটা পাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের থেকে আমরাই অধিক হকদার ছিলাম। রাবী বলেন, কথাটি নবী করীম (ﷺ) পর্যন্ত গিয়ে পেঁŠছল। তিনি বললেন, তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না? অথচ আমি আসমানের অধিবাসীদের আস্থাভাজন (আমানতদার), সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে। রাবী বলেন, এমন সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। লোকটির চোখ দু’টি ছিল কোটরাগত, চোয়ালের হাড় যেন বেরিয়ে পড়ছে, উঁচু কপাল বিশিষ্ট, দাড়ি অতি ঘন, মাথাটি ন্যাড়া, পরণের লুঙ্গী উপরে উত্থিত। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহকে ভয় করুন। নবী করীম (ﷺ) বললেন, তোমার জন্য আফসোস! আল্লাকে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি অধিক হকদার নই? রাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, লোকটি চলে গেলে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, না, হ’তে পারে সে সালাত আদায় করে।
খালিদ (রাঃ) বললেন, অনেক সালাত আদায়কারী এমন আছে যারা মুখে এমন কথা উচ্চারণ করে যা তাদের অন্তরে নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমাকে মানুষের অন্তর ছিদ্র করে, পেট ফেড়ে দেখার জন্য বলা হয়নি। তারপর তিনি লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তখন লোকটি পিঠ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে যারা শ্রুতিমধুর কণ্ঠে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নীচে নামবে না। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে লক্ষ্যবস্ত্তর দেহ ভেদ করে তীর বেরিয়ে যায়। (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার মনে হয় তিনি এ কথাও বলেছেন, যদি আমি তাদেরকে পাই তাহ’লে অবশ্যই আমি তাদেরকে ছামূদ জাতির মতো হত্যা করব’।[3]
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরণের দু’টি মোটা কিতরী কাপড় ছিল। যখন তিনি বসতেন তখন তাঁর দেহের ঘামে কাপড় দু’টি ভিজে ভারী হয়ে যেত। একবার কোন ইহূদীর সিরিয়া হ’তে কাপড়ের চালান এলে আমি বললাম, আপনি যদি তার নিকট হ’তে সুবিধামত সময়ে মূল্য পরিশোধের শর্তে লোক পাঠিয়ে এক জোড়া কাপড় কিনে নিতেন! তিনি তার নিকট লোক পাঠালেন। ইহূদী বলল, আমি জানি সে (মুহাম্মাদ) কি করতে চায়। সে আমার মাল অথবা নগদ অর্থ হস্তগত করার পরিকল্পনা করছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সে মিথ্যা বলেছে। তার ভাল করেই জানা আছে যে, আমি তাদের মধ্যে বেশী আল্লাহভীরু এবং সবচেয়ে বেশী আমানতদার’।[4]
আমানতের গুরুত্ব :
রাসূল (ﷺ) নবুঅত লাভের পূর্ব থেকেই ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার হিসাবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সে সময় তার সমাজ ব্যবস্থায় অন্যান্য মানুষের মাঝে এই উত্তম গুণটি বিদ্যমান ছিল না। যার ফলে তাদের সমাজ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে ওঠে।
মানুষ যত দ্বীন থেকে দূরে সরে যাবে এবং আমানতের খেয়ানত করবে বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় তত বেশী অশান্তি ও বিপর্যয় নেমে আসবে। আর এজন্যই ইসলাম আমানতের প্রতি এত গুরুত্ব দিয়েছে। কেবল দুনিয়ায় বিপর্যয় নয়, এর জন্য রয়েছে আখেরাতে মর্মান্তিক শাস্তি। আর আমানত রক্ষার বিনিময়ে রয়েছে সম্মান ও চিরস্থায়ী ঠিকানা জান্নাত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, আর যারা তাদের সাক্ষ্য দানে অটল এবং নিজেদের সালাতে যত্নবান তারা সম্মানিত হবে জান্নাতে’ (মা‘আরিজ ৭০/১৯-৩৫)। হাদীসে এসেছে,
আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে কোন দায়িত্বে নিয়োগ করবেন না? তখন তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, হে আবু যার! তুমি দুর্বল মানুষ। আর এটা হচ্ছে এক (বিরাট) আমানত। আর এ নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ক্বিয়ামতের দিন লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণ হবে। অবশ্য যে হক সহকারে এটাকে গ্রহণ করে এবং এ দায়িত্ব গ্রহণের ফলে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তার কথা আলাদা’।[5]
হুযায়ফা ও আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা (হাশরের দিন) সমস্ত মানুষকে একত্রিত করবেন। তখন ঈমানদার লোকেরা উঠে দাঁড়াবে। এমন সময় জান্নাত তাদের নিকট আনা হবে। তারা আদম (আঃ)-এর নিকট এসে বলবে, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য জান্নাত খুলে দিন। তিনি বলবেন, তোমাদের পিতার অপরাধই তো তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করেছে। আমি এর যোগ্য নই, তোমরা আমার ছেলে ইবরাহীম খলীলুল্লাহর নিকটে যাও। তিনি বলেন, তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। আমি তো শুধু বিনয়ী দূরবর্তী খলীল ছিলাম। তোমরা বরং মূসা (আঃ)-এর নিকট যাও। আল্লাহ তা‘আলা যার সাথে কথোপকথন করেছেন। তারা মূসা (আঃ)-এর নিকটে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। তোমরা আল্লাহর কালিমা ও রূহ ঈসা (আঃ)-এর নিকটে যাও। ঈসা (আঃ) বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। অতঃপর তারা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কাছে চলে আসবে। তিনি উঠে দাঁড়াবেন। তাঁকে (শাফা‘আতের) অনুমতি দেয়া হবে। আমানত ও দয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ দু’টি পুলছিরাতের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে যাবে। তোমাদের প্রথম দলটি বিদ্যুৎ বেগে পার হয়ে যাবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। বিদ্যুৎ বেগে পার হওয়ার অর্থ কি? তিনি বললেন, তোমরা কি দেখ না? তা চোখের পলকে কিভাবে যাওয়া-আসা করে। অতঃপর বাতাসের গতিতে, তারপর পাখীর গতিতে এবং দ্রুত দৌঁড়ের গতিতে (পর্যায়ক্রমে) পুলছিরাত পার হবে। আর এ পার্থক্য কেবল তাদের কৃতকর্মের দরুনই হবে। তখন তোমাদের নবী পুলছিরাতের উপর দাঁড়িয়ে থেকে বলবেন, হে রব! শান্তি বর্ষণ করুন, শান্তি বর্ষণ করুন। এক পর্যায়ে বান্দাদের সৎকাজের পরিমাণ কম হওয়ার জন্য তারা অক্ষম হয়ে পড়বে। এমনকি পাছা ঘষতে ঘষতে সামনে অগ্রসর হবে। আর পুলছিরাতের উভয় পার্শ্বে লোহার অাঁকড়া ঝুলানো থাকবে। যাকে গ্রেফতার করার আদেশ দেয়া হবে, এগুলো তাঁকে গ্রেফতার করবে। যার গায়ে শুধু অাঁচড় লাগবে সে মুক্তি পাবে। আর অন্য সকলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যে সত্তার হাতে আবু হুরায়রার জান, তার কসম! জাহান্নামের গভীরতা সত্তর বছরের দূরত্বের সমান’।[6]
অন্য হাদীসে এসেছে,
আবু হুরাইরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইমাম হ’ল (সালাতের) যামিন এবং মুওয়াযযিন হ’ল তাদের (সালাতের ও ছিয়ামের) আমানতদার। হে আল্লাহ! ইমামকে সৎপথ দেখাও এবং মুওয়াযযিনকে মাফ কর’।[7]
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, فَأَدَاءُ الأَمَانَةِ أَحَقُّ مِنْ تَطَوُّعِ الْوَصِيَّةِ. ‘অতঃপর আমানত আদায় করা নফল অছিয়ত থেকেও অগ্রাধিকার প্রাপ্ত’।[8]
হুযায়ফাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের হাদীস বর্ণনা করেছেন যে,
‘আমানত আসমান হ’তে মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে অবতীর্ণ হয়েছে, তারপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং মানুষ কুরআন পাঠ করেছে এবং সুন্নাত শিক্ষা করেছে’।[9]
আমানতের খেয়ানতকারীর পরিণতি :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ ‘যে ব্যক্তি যা খেয়ানত করে, তা নিয়ে সে ক্বিয়ামতের দিন হাযির হবে’ (আলে ইমরান ৩/১৬১)।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করীম (ﷺ) আমাদের মাঝে দাঁড়ান এবং গনীমতের মাল আত্মসাৎ প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। আর তিনি তা মারাত্মক অপরাধ ও তার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এ অবস্থায় ক্বিয়ামতের দিন না পাই যে, তার কাঁধে বকরি বয়ে বেড়াচ্ছে আর তা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে চিৎকার করছে। অথবা তার কাঁধে রয়েছে ঘোড়া আর তা হিহি করে আওয়াজ করছে। ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো (দুনিয়ায়) তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ কাঁধে বয়ে বেড়াবে উট যা চিৎকার করছে, সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! একটু সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে ধন-দৌলত এবং আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে কাপড়ের টুকরাসমূহ যা দুলতে থাকবে। সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না, আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি’।[10]
উপরে বর্ণিত হাদীসটি দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও দেশের জনগণের সম্পদ রক্ষার আমানতে খেয়ানত করার পরিণতি বুঝা যায়। এভাবে অন্যান্য আমানতের খেয়ানতকারী তার খেয়ানত অনুযায়ী শাস্তির সম্মুখীন হবে। আর তা হবে অত্যন্ত লাঞ্ছনা এবং অবমাননাকর।
উল্লেখ্য, আমানতের খেয়ানত করা কবীরা গোনাহ, যা তওবা ব্যতীত মাফ হবে না। আর সে খেয়ানত যদি আল্লাহ তা‘আলার হক সংশ্লিষ্ট হয়, যেমন সালাত আদায় না করা, কাফফারা না দেয়া, রামাযানের ছিয়াম পালন না করা, অনুরূপ আরো আল্লাহর হক সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি আদায় করা না হ’লে তাঁর কাছে তওবা করতে হবে অধিক পরিমাণে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আর আমানতের খেয়ানত যদি বান্দার কোন হক সংশ্লিষ্ট হয় তাহ’লে তা তৎক্ষণাৎ আদায় করা। যেমন গচ্ছিত রাখা কারো সম্পদ খেয়ানত করলে তা ফেরত দেয়া অথবা তার থেকে মাফ করে নেওয়া।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন,
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ হ’তে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন তার কোন দীনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ নেকী তার নিকট হ’তে নেয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে প্রতিপক্ষের পাপ হ’তে নিয়ে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে’।[11]
আমানতের উপকারিতা :
আমানত হ’ল বৃহত্তম চারিত্রিক গুণ যা আল্লাহ তা‘আলা মুমিন বান্দার বৈশিষ্ট্যের সাথে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘নিশ্চয়ই সফলকাম হবে মুমিনগণ। যারা তাদের সালাতে বিনয়ী-নম্র। যারা অনর্থক ক্রিয়া-কলাপ থেকে নির্লিপ্ত। যারা যাকাত প্রদানে সচেষ্ট। যারা তাদের যৌনাঙ্গ ব্যবহারে সংযত। তবে তাদের স্ত্রীগণ ও মালিকানাধীন দাসীরা ব্যতীত। কেননা এতে তারা নিন্দিত হবে না। অতএব যারা এদের ব্যতীত অন্যদের কামনা করবে, তারা হবে সীমালংঘনকারী। আর যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার সমূহ রক্ষাকারী এবং যারা তাদের সালাত সমূহের হেফাযতকারী, তারাই হবে উত্তরাধিকারী। যারা উত্তরাধিকার লাভ করবে জান্নাতুল ফেরদৌসের। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (মুমিনূন ২৩/১-১১)।
২. আমানত হ’ল ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্য।
৩. আমানতের মাধ্যমে দ্বীন হেফাযত হয় এবং এর মাধ্যমে মানুষের জাগতিক সম্পদ, জান-মাল, ইয্যত ও সম্মান রক্ষা পায়। ইনছাফ তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রকৃত হকদার তার হক ফেরত পায় এবং ন্যায্য পদ থেকে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তি বঞ্চিত হয় না। ফলে এর মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে স্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. আমানতদার বা বিশ্বস্ত লোককে আল্লাহ তা‘আলা ও সাধারণ মানুষ ভালবাসেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
‘বিশ্বস্ত কোষাধ্যক্ষ যে ঠিকমত ব্যয় করে, কখনও বলেছেন, যাকে দান করতে বলা হয় তাকে তা পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দেয়, সেও (কোষাধ্যক্ষ) দানকারীদের একজন।[12] অর্থাৎ দানকারীর মত সেও নেকী পায়।
৫. আমানত হ’ল দ্বীন ইসলামের মেরুদন্ড এবং বান্দার জন্য আল্লাহর পরীক্ষা।
৬. যে সমাজের সবার মাঝে আমানত পরিলক্ষিত হয় সে সমাজে কল্যাণ ও বরকত বিদ্যমান থাকে।
পরিশেষে বলব, আমানত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা রক্ষা করা ঈমানের অপররিহার্য অঙ্গ। পক্ষান্তরে আমানতের খেয়ানত ঈমানহীনতার পরিচায়ক। যার জন্য পরকালে কঠিন ও লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে। তাই সকলকে আমানত রক্ষার জন্য সচেষ্ট হওয়া যরূরী। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমানতের দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করার তাওফীক দিন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তা কায়েম করার শক্তি সামর্থ্য দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৪০৫৩, ফাৎহুল বারী হা/৫/২৭৮১।
[2]. বুখারী হা/৭১৯১, যারা নিখে দেয় তারা হবে বিশ্বস্ত বা আমানতদার ও বুদ্ধিমান অধ্যায়। আহকাম পর্ব।
[3]. বুখারী হা/৪৩৫১; মুসলিম হা/১০৬৪।
[4]. সহীহ আত-তিরমিযী, হা/১২১৩।
[5]. মুসলিম হা/১৮২৫; মিশকাত হা/৩৬৮২।
[6]. মুসলিম হা/১৯৫; মিশকাত হা/৫৬০৮-৫৬০৯।
[7]. তিরমিযী হা/২০৭, আবুদাঊদ হা/৫১৭, মিশকাত হা/৬৬৩; ইরওয়া হা/২১৭।
[8]. বুখারী, তরজমাতুল বাব-৯; ফাতহুল বারী হা/৪৪৩।
[9]. বুখারী হা/৭২৭৬; মুসলিম হা/১৪৩; মিশকাত হা/৫৩৮১।
[10]. বুখারী হা/৩০৭৩; মুসলিম হা/১৮৩১।
[11]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬।
[12]. বুখারী হা/২৩১৯ ওয়াকালাহ (প্রতিনিধিত্ব) পর্ব (৪০), ‘কোষাগার ইত্যাদিতে বিশ্বস্ত প্রতিনিধি নিয়োগ’ অধ্যায়।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ওহোদের দিন তার পিতা ছয় মেয়ে ও কিছু ঋণ তার উপর রেখে শাহাদত বরণ করেন। (তিনি বলেন,) এরপর যখন খেজুর কাটার সময় এল তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বললাম, আপনি জানেন যে, আমার পিতা ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং বিশাল ঋণভার রেখে গেছেন। এখন আমি চাই ঋণদাতাগণ আপনাকে দেখুক। তখন তিনি বললেন, তুমি যাও এবং বাগানের এক কোণে সব খেজুর কেটে জমা কর। জাবির (রাঃ) বলেন, আমি তাই করলাম। এরপর নবী করীম (ﷺ)-কে ডেকে আনলাম। যখন তারা নবী করীম (ﷺ)-কে দেখলেন, তখন তারা আমার উপর আরো রাগান্বিত হ’লেন। নবী করীম (ﷺ) তাদের আচরণ দেখে বাগানের বড় স্তূপটির চারপাশে তিনবার ঘুরে এসে এর উপর বসে বললেন, তোমার ঋণদাতাদেরকে ডাক। তিনি তাদেরকে মেপে মেপে দিতে লাগলেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা আমার পিতার আমানত (ঋণ) আদায় করে দিলেন। আমিও চাচ্ছিলাম যে, একটি খেজুর নিয়ে আমি আমার বোনদের নিকট যেতে না পারলেও আল্লাহ তা‘আলা যেন আমার পিতার আমানত আদায় করে দেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা খেজুরের সবক’টি স্তূপই অবশিষ্ট রাখলেন। এমনকি আমি দেখলাম যে, নবী করীম (ﷺ) যে গাদায় উপবিষ্ট ছিলেন তার থেকে যেন একটি খেজুরও কমেনি।[1]
যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদদের কারণে আবুবকর (রাঃ) আমার নিকটে লোক পাঠালেন তখন তাঁর কাছে ওমর (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, ওমর (রাঃ) আমার কাছে এসে বলেছেন যে, কুরআনের বহু হাফেয ইমামার যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এজন্য আমার ভয় হচ্ছে যে, আরো অনেক জায়গায় যদি কুরআনের হাফেযগণ এমন ব্যাপক হারে শহীদ হন, তাহ’লে কুরআনের বহু অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং আমি মনে করি যে, আপনি কুরআন সংকলনের আদেশ দিন। আমি বললাম, কী করে আমি এমন কাজ করব, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেননি? ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এটা একটা উত্তম কাজ। ওমর (রাঃ) আমাকে এ বিষয়ে বারবার বলছিলেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা আমার অন্তর খুলে দিলেন। যে বিষয়ে তিনি ওমর (রাঃ)-এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন এবং আমিও এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করলাম, যা ওমর (রাঃ) পোষণ করেছিলেন। যায়েদ (রাঃ) বলেন যে, এরপর আবুবকর (রাঃ) বললেন, তুমি একজন বুদ্ধিমান যুবক, তোমার সম্পর্কে আমাদের কোন অভিযোগ নেই। তুমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অহী লিখতে। কাজেই তুমি কুরআন খোঁজ কর এবং তা একত্রিত কর। যায়েদ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! কুরআন খোঁজ করে একত্রিত করার নির্দেশ না দিয়ে যদি আমাকে পাহাড়গুলোর একটিকে স্থানান্তর করার দায়িত্ব অর্পণ করা হ’ত, তাও আমার জন্য ভারী মনে হ’ত না। আমি বললাম, কী করে আপনারা দু’জন এমন একটি কাজ করবেন, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) করেননি। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! এটি একটি উত্তম কাজ। আমি আমার কথা বার বার বলতে থাকলাম। এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা আমার অন্তর খুলে দিলেন, যে বিষয়ে আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর অন্তর খুলে দিয়েছিলেন এবং তাঁরা দু’জন যা ভাল মনে করলেন আমিও তা ভাল মনে করলাম। কাজেই আমি কুরআন খোঁজ করতে শুরু করলাম খেজুরের ডাল, পাতলা চামড়ার টুকরা, সাদা পাথর ও মানুষের অন্তর থেকে আমি কুরআন জমা করলাম।
সূরা তওবার শেষ অংশ لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন’... (তওবাহ ৯/১২৮) থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এ অংশটুকু খুযাইমাহ কিংবা আবু খুযাইমাহর কাছে পেলাম। আমি তা সূরার সঙ্গে জুড়ে দিলাম। কুরআনের এ সংকলিত ছহীফাগুলো আবুবকরের জীবনকাল পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে ওফাত দিলেন। পরে ওমরের জীবনকাল পর্যন্ত তাঁর নিকট ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাঁর ওফাত দিলেন, তারপর হাফছাহ বিনতে ওমর (রাঃ)-এর কাছে ছিল।[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আমানতের দৃষ্টান্ত :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন মানব জাতির মাঝে সর্বাধিক তাক্বওয়াশীল এবং নীতিবান। ন্যায়-ইনছাফ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমাত্র অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর মাঝে পক্ষপাতের লেশমাত্র বিদ্যমান ছিল না। তেমনিভাবে ঋণ পরিশোধ ও আমানতদারীর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সর্বদা সচেতন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। নিম্নে তাঁর আমানতদারীতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হ’ল।-
১। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ) ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এক প্রকার (রঙিন) চামড়ার থলেতে করে সামান্য কিছু স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তখনও এগুলো থেকে সংযুক্ত মাটি পরিস্কার করা হয়নি। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চার জনের মাঝে স্বর্ণখন্ডটি বণ্টন করে দিলেন। তারা হ’লেন, ‘উয়াইনাহ ইবনু বাদর, আকরা ইবনু হাবিস, যায়েদ আল-খায়ল এবং চতুর্থ জন আলকামাহ কিংবা ‘আমির ইবনু তুফায়ল (রাঃ)। তখন সাহাবীগণের মধ্য থেকে একজন বললেন, এটা পাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের থেকে আমরাই অধিক হকদার ছিলাম। রাবী বলেন, কথাটি নবী করীম (ﷺ) পর্যন্ত গিয়ে পেঁŠছল। তিনি বললেন, তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না? অথচ আমি আসমানের অধিবাসীদের আস্থাভাজন (আমানতদার), সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে। রাবী বলেন, এমন সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। লোকটির চোখ দু’টি ছিল কোটরাগত, চোয়ালের হাড় যেন বেরিয়ে পড়ছে, উঁচু কপাল বিশিষ্ট, দাড়ি অতি ঘন, মাথাটি ন্যাড়া, পরণের লুঙ্গী উপরে উত্থিত। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহকে ভয় করুন। নবী করীম (ﷺ) বললেন, তোমার জন্য আফসোস! আল্লাকে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি অধিক হকদার নই? রাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, লোকটি চলে গেলে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, না, হ’তে পারে সে সালাত আদায় করে।
খালিদ (রাঃ) বললেন, অনেক সালাত আদায়কারী এমন আছে যারা মুখে এমন কথা উচ্চারণ করে যা তাদের অন্তরে নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আমাকে মানুষের অন্তর ছিদ্র করে, পেট ফেড়ে দেখার জন্য বলা হয়নি। তারপর তিনি লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তখন লোকটি পিঠ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে যারা শ্রুতিমধুর কণ্ঠে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নীচে নামবে না। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে, যেভাবে লক্ষ্যবস্ত্তর দেহ ভেদ করে তীর বেরিয়ে যায়। (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার মনে হয় তিনি এ কথাও বলেছেন, যদি আমি তাদেরকে পাই তাহ’লে অবশ্যই আমি তাদেরকে ছামূদ জাতির মতো হত্যা করব’।[3]
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ثَوْبَانِ قِطْرِيَّانِ غَلِيْظَانِ فَكَانَ إِذَا قَعَدَ فَعَرِقَ ثَقُلاَ عَلَيْهِ فَقَدِمَ بَزٌّ مِنَ الشَّامِ لِفُلاَنٍ الْيَهُودِىِّ. فَقُلْتُ لَوْ بَعَثْتَ إِلَيْهِ فَاشْتَرَيْتَ مِنْهُ ثَوْبَيْنِ إِلَى الْمَيْسَرَةِ. فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ فَقَالَ قَدْ عَلِمْتُ مَا يُرِيدُ إِنَّمَا يُرِيدُ أَنْ يَذْهَبَ بِمَالِى أَوْ بِدَرَاهِمِى. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَذَبَ قَدْ عَلِمَ أَنِّى مِنْ أَتْقَاهُمْ لِلَّهِ وَآدَاهُمْ لِلأَمَانَةِ-
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরণের দু’টি মোটা কিতরী কাপড় ছিল। যখন তিনি বসতেন তখন তাঁর দেহের ঘামে কাপড় দু’টি ভিজে ভারী হয়ে যেত। একবার কোন ইহূদীর সিরিয়া হ’তে কাপড়ের চালান এলে আমি বললাম, আপনি যদি তার নিকট হ’তে সুবিধামত সময়ে মূল্য পরিশোধের শর্তে লোক পাঠিয়ে এক জোড়া কাপড় কিনে নিতেন! তিনি তার নিকট লোক পাঠালেন। ইহূদী বলল, আমি জানি সে (মুহাম্মাদ) কি করতে চায়। সে আমার মাল অথবা নগদ অর্থ হস্তগত করার পরিকল্পনা করছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, সে মিথ্যা বলেছে। তার ভাল করেই জানা আছে যে, আমি তাদের মধ্যে বেশী আল্লাহভীরু এবং সবচেয়ে বেশী আমানতদার’।[4]
আমানতের গুরুত্ব :
রাসূল (ﷺ) নবুঅত লাভের পূর্ব থেকেই ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার হিসাবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সে সময় তার সমাজ ব্যবস্থায় অন্যান্য মানুষের মাঝে এই উত্তম গুণটি বিদ্যমান ছিল না। যার ফলে তাদের সমাজ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে ওঠে।
মানুষ যত দ্বীন থেকে দূরে সরে যাবে এবং আমানতের খেয়ানত করবে বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় তত বেশী অশান্তি ও বিপর্যয় নেমে আসবে। আর এজন্যই ইসলাম আমানতের প্রতি এত গুরুত্ব দিয়েছে। কেবল দুনিয়ায় বিপর্যয় নয়, এর জন্য রয়েছে আখেরাতে মর্মান্তিক শাস্তি। আর আমানত রক্ষার বিনিময়ে রয়েছে সম্মান ও চিরস্থায়ী ঠিকানা জান্নাত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যারা তাদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, আর যারা তাদের সাক্ষ্য দানে অটল এবং নিজেদের সালাতে যত্নবান তারা সম্মানিত হবে জান্নাতে’ (মা‘আরিজ ৭০/১৯-৩৫)। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَلاَ تَسْتَعْمِلُنِى قَالَ فَضَرَبَ بِيَدِهِ عَلَى مَنْكِبِى ثُمَّ قَالَ : يَا أَبَا ذَرٍّ إِنَّكَ ضَعِيفٌ وَإِنَّهَا أَمَانَةٌ وَإِنَّهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ خِزْىٌ وَنَدَامَةٌ إِلاَّ مَنْ أَخَذَهَا بِحَقِّهَا وَأَدَّى الَّذِى عَلَيْهِ فِيهَا-
আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে কোন দায়িত্বে নিয়োগ করবেন না? তখন তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, হে আবু যার! তুমি দুর্বল মানুষ। আর এটা হচ্ছে এক (বিরাট) আমানত। আর এ নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ক্বিয়ামতের দিন লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণ হবে। অবশ্য যে হক সহকারে এটাকে গ্রহণ করে এবং এ দায়িত্ব গ্রহণের ফলে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তার কথা আলাদা’।[5]
হুযায়ফা ও আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা (হাশরের দিন) সমস্ত মানুষকে একত্রিত করবেন। তখন ঈমানদার লোকেরা উঠে দাঁড়াবে। এমন সময় জান্নাত তাদের নিকট আনা হবে। তারা আদম (আঃ)-এর নিকট এসে বলবে, হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য জান্নাত খুলে দিন। তিনি বলবেন, তোমাদের পিতার অপরাধই তো তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করেছে। আমি এর যোগ্য নই, তোমরা আমার ছেলে ইবরাহীম খলীলুল্লাহর নিকটে যাও। তিনি বলেন, তারা ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। আমি তো শুধু বিনয়ী দূরবর্তী খলীল ছিলাম। তোমরা বরং মূসা (আঃ)-এর নিকট যাও। আল্লাহ তা‘আলা যার সাথে কথোপকথন করেছেন। তারা মূসা (আঃ)-এর নিকটে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। তোমরা আল্লাহর কালিমা ও রূহ ঈসা (আঃ)-এর নিকটে যাও। ঈসা (আঃ) বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। অতঃপর তারা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কাছে চলে আসবে। তিনি উঠে দাঁড়াবেন। তাঁকে (শাফা‘আতের) অনুমতি দেয়া হবে। আমানত ও দয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ দু’টি পুলছিরাতের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে যাবে। তোমাদের প্রথম দলটি বিদ্যুৎ বেগে পার হয়ে যাবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। বিদ্যুৎ বেগে পার হওয়ার অর্থ কি? তিনি বললেন, তোমরা কি দেখ না? তা চোখের পলকে কিভাবে যাওয়া-আসা করে। অতঃপর বাতাসের গতিতে, তারপর পাখীর গতিতে এবং দ্রুত দৌঁড়ের গতিতে (পর্যায়ক্রমে) পুলছিরাত পার হবে। আর এ পার্থক্য কেবল তাদের কৃতকর্মের দরুনই হবে। তখন তোমাদের নবী পুলছিরাতের উপর দাঁড়িয়ে থেকে বলবেন, হে রব! শান্তি বর্ষণ করুন, শান্তি বর্ষণ করুন। এক পর্যায়ে বান্দাদের সৎকাজের পরিমাণ কম হওয়ার জন্য তারা অক্ষম হয়ে পড়বে। এমনকি পাছা ঘষতে ঘষতে সামনে অগ্রসর হবে। আর পুলছিরাতের উভয় পার্শ্বে লোহার অাঁকড়া ঝুলানো থাকবে। যাকে গ্রেফতার করার আদেশ দেয়া হবে, এগুলো তাঁকে গ্রেফতার করবে। যার গায়ে শুধু অাঁচড় লাগবে সে মুক্তি পাবে। আর অন্য সকলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যে সত্তার হাতে আবু হুরায়রার জান, তার কসম! জাহান্নামের গভীরতা সত্তর বছরের দূরত্বের সমান’।[6]
অন্য হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الإِمَامُ ضَامِنٌ وَالْمُؤَذِّنُ مُؤْتَمَنٌ اللَّهُمَّ أَرْشِدِ الأَئِمَّةَ وَاغْفِرْ لِلْمُؤَذِّنِينَ-
আবু হুরাইরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘ইমাম হ’ল (সালাতের) যামিন এবং মুওয়াযযিন হ’ল তাদের (সালাতের ও ছিয়ামের) আমানতদার। হে আল্লাহ! ইমামকে সৎপথ দেখাও এবং মুওয়াযযিনকে মাফ কর’।[7]
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, فَأَدَاءُ الأَمَانَةِ أَحَقُّ مِنْ تَطَوُّعِ الْوَصِيَّةِ. ‘অতঃপর আমানত আদায় করা নফল অছিয়ত থেকেও অগ্রাধিকার প্রাপ্ত’।[8]
হুযায়ফাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের হাদীস বর্ণনা করেছেন যে,
أَنَّ الأَمَانَةَ نَزَلَتْ مِنَ السَّمَاءِ فِى جَذْرِ قُلُوبِ الرِّجَالِ، وَنَزَلَ الْقُرْآنُ فَقَرَءُوْا الْقُرْآنَ وَعَلِمُوا مِنَ السُّنَّةِ-
‘আমানত আসমান হ’তে মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে অবতীর্ণ হয়েছে, তারপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং মানুষ কুরআন পাঠ করেছে এবং সুন্নাত শিক্ষা করেছে’।[9]
আমানতের খেয়ানতকারীর পরিণতি :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ ‘যে ব্যক্তি যা খেয়ানত করে, তা নিয়ে সে ক্বিয়ামতের দিন হাযির হবে’ (আলে ইমরান ৩/১৬১)।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করীম (ﷺ) আমাদের মাঝে দাঁড়ান এবং গনীমতের মাল আত্মসাৎ প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। আর তিনি তা মারাত্মক অপরাধ ও তার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এ অবস্থায় ক্বিয়ামতের দিন না পাই যে, তার কাঁধে বকরি বয়ে বেড়াচ্ছে আর তা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে চিৎকার করছে। অথবা তার কাঁধে রয়েছে ঘোড়া আর তা হিহি করে আওয়াজ করছে। ঐ ব্যক্তি আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো (দুনিয়ায়) তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ কাঁধে বয়ে বেড়াবে উট যা চিৎকার করছে, সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! একটু সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে ধন-দৌলত এবং আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে কাপড়ের টুকরাসমূহ যা দুলতে থাকবে। সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না, আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি’।[10]
উপরে বর্ণিত হাদীসটি দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও দেশের জনগণের সম্পদ রক্ষার আমানতে খেয়ানত করার পরিণতি বুঝা যায়। এভাবে অন্যান্য আমানতের খেয়ানতকারী তার খেয়ানত অনুযায়ী শাস্তির সম্মুখীন হবে। আর তা হবে অত্যন্ত লাঞ্ছনা এবং অবমাননাকর।
উল্লেখ্য, আমানতের খেয়ানত করা কবীরা গোনাহ, যা তওবা ব্যতীত মাফ হবে না। আর সে খেয়ানত যদি আল্লাহ তা‘আলার হক সংশ্লিষ্ট হয়, যেমন সালাত আদায় না করা, কাফফারা না দেয়া, রামাযানের ছিয়াম পালন না করা, অনুরূপ আরো আল্লাহর হক সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি আদায় করা না হ’লে তাঁর কাছে তওবা করতে হবে অধিক পরিমাণে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আর আমানতের খেয়ানত যদি বান্দার কোন হক সংশ্লিষ্ট হয় তাহ’লে তা তৎক্ষণাৎ আদায় করা। যেমন গচ্ছিত রাখা কারো সম্পদ খেয়ানত করলে তা ফেরত দেয়া অথবা তার থেকে মাফ করে নেওয়া।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন,
مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُوْنَ دِيْنَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ-
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ হ’তে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন তার কোন দীনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ নেকী তার নিকট হ’তে নেয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে প্রতিপক্ষের পাপ হ’তে নিয়ে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে’।[11]
আমানতের উপকারিতা :
আমানত হ’ল বৃহত্তম চারিত্রিক গুণ যা আল্লাহ তা‘আলা মুমিন বান্দার বৈশিষ্ট্যের সাথে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاَتِهِمْ خَاشِعُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ، إِلاَّ عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ، فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ، أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ، الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-
‘নিশ্চয়ই সফলকাম হবে মুমিনগণ। যারা তাদের সালাতে বিনয়ী-নম্র। যারা অনর্থক ক্রিয়া-কলাপ থেকে নির্লিপ্ত। যারা যাকাত প্রদানে সচেষ্ট। যারা তাদের যৌনাঙ্গ ব্যবহারে সংযত। তবে তাদের স্ত্রীগণ ও মালিকানাধীন দাসীরা ব্যতীত। কেননা এতে তারা নিন্দিত হবে না। অতএব যারা এদের ব্যতীত অন্যদের কামনা করবে, তারা হবে সীমালংঘনকারী। আর যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার সমূহ রক্ষাকারী এবং যারা তাদের সালাত সমূহের হেফাযতকারী, তারাই হবে উত্তরাধিকারী। যারা উত্তরাধিকার লাভ করবে জান্নাতুল ফেরদৌসের। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (মুমিনূন ২৩/১-১১)।
২. আমানত হ’ল ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্য।
৩. আমানতের মাধ্যমে দ্বীন হেফাযত হয় এবং এর মাধ্যমে মানুষের জাগতিক সম্পদ, জান-মাল, ইয্যত ও সম্মান রক্ষা পায়। ইনছাফ তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রকৃত হকদার তার হক ফেরত পায় এবং ন্যায্য পদ থেকে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তি বঞ্চিত হয় না। ফলে এর মাধ্যমে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে স্থিতিশীলতা বিরাজ করে এবং সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. আমানতদার বা বিশ্বস্ত লোককে আল্লাহ তা‘আলা ও সাধারণ মানুষ ভালবাসেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
الْخَازِنُ الأَمِيْنُ الَّذِىْ يُنْفِقُ وَرُبَّمَا قَالَ الَّذِى يُعْطِى مَا أُمِرَ بِهِ كَامِلاً مُوَفَّرًا، طَيِّبٌ نَفْسُهُ، إِلَى الَّذِى أُمِرَ بِهِ، أَحَدُ الْمُتَصَدِّقَيْنِ-
‘বিশ্বস্ত কোষাধ্যক্ষ যে ঠিকমত ব্যয় করে, কখনও বলেছেন, যাকে দান করতে বলা হয় তাকে তা পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্টচিত্তে দিয়ে দেয়, সেও (কোষাধ্যক্ষ) দানকারীদের একজন।[12] অর্থাৎ দানকারীর মত সেও নেকী পায়।
৫. আমানত হ’ল দ্বীন ইসলামের মেরুদন্ড এবং বান্দার জন্য আল্লাহর পরীক্ষা।
৬. যে সমাজের সবার মাঝে আমানত পরিলক্ষিত হয় সে সমাজে কল্যাণ ও বরকত বিদ্যমান থাকে।
পরিশেষে বলব, আমানত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা রক্ষা করা ঈমানের অপররিহার্য অঙ্গ। পক্ষান্তরে আমানতের খেয়ানত ঈমানহীনতার পরিচায়ক। যার জন্য পরকালে কঠিন ও লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে। তাই সকলকে আমানত রক্ষার জন্য সচেষ্ট হওয়া যরূরী। আল্লাহ আমাদের সকলকে আমানতের দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করার তাওফীক দিন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তা কায়েম করার শক্তি সামর্থ্য দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৪০৫৩, ফাৎহুল বারী হা/৫/২৭৮১।
[2]. বুখারী হা/৭১৯১, যারা নিখে দেয় তারা হবে বিশ্বস্ত বা আমানতদার ও বুদ্ধিমান অধ্যায়। আহকাম পর্ব।
[3]. বুখারী হা/৪৩৫১; মুসলিম হা/১০৬৪।
[4]. সহীহ আত-তিরমিযী, হা/১২১৩।
[5]. মুসলিম হা/১৮২৫; মিশকাত হা/৩৬৮২।
[6]. মুসলিম হা/১৯৫; মিশকাত হা/৫৬০৮-৫৬০৯।
[7]. তিরমিযী হা/২০৭, আবুদাঊদ হা/৫১৭, মিশকাত হা/৬৬৩; ইরওয়া হা/২১৭।
[8]. বুখারী, তরজমাতুল বাব-৯; ফাতহুল বারী হা/৪৪৩।
[9]. বুখারী হা/৭২৭৬; মুসলিম হা/১৪৩; মিশকাত হা/৫৩৮১।
[10]. বুখারী হা/৩০৭৩; মুসলিম হা/১৮৩১।
[11]. বুখারী হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১২৬।
[12]. বুখারী হা/২৩১৯ ওয়াকালাহ (প্রতিনিধিত্ব) পর্ব (৪০), ‘কোষাগার ইত্যাদিতে বিশ্বস্ত প্রতিনিধি নিয়োগ’ অধ্যায়।
সূত্র: আত-তাহরীক।
Last edited: