শুরুকথা
দাওয়াত মুমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মিশন। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন তাঁদের সকলেরই মিশন ছিল দাওয়াত। দাওয়াত দানের মাধ্যমেই তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলোর মশাল প্রজ্জ্বলিত করেছেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ক্রমশ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ন্যায়নীতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। যুলুম-নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, ঘুষ-দুর্নীতি প্রভৃতি পাপাচারের বিষবাষ্পে জাতি আজ দিশেহারা। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে দাওয়াতের ব্যাপক প্রসারের বিকল্প নেই। আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে দাওয়াতের পরিচয়, বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, দাঈদের বৈশিষ্ট্য এবং আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের কৌশল নিয়ে আলোচনা করব ইনশআল্লাহ।
দাওয়াত ও হিকমাহ
শিরোনাম শুনে মনে হতে পারে দাওয়াতী কাজের জন্য যে কৌশলগুলো নিয়ে আমরা কথা বলব তা আমাদের তৈরি করা বর্তমান যুগেই বিদ্যমান- পূর্বের যুগে এগুলো ছিল না। কিন্তু না, পূর্ব যুগেও সময়োপযোগী কৌশল ছিল। তাঁরাও কৌশল জানতেন এবং সে অনুযায়ী কাজও করতেন। কোন দাঈ বা আলিম বিপদে পড়লে আমরা অনেক সময় বলে থাকি ‘কথা-বার্তা বলার ক্ষেত্রে একটু কৌশলী হতে হবে, বক্তৃতায় হিকমাহ অবলম্বন করতে হবে, সময় ও স্থান বুঝে বিষয় নির্বাচন করতে হবে, তাহলে এ সকল বিপদে পড়ত না’ ইত্যাদি। কথাগুলো অবশ্যই শিক্ষণীয় এবং প্রয়োজনীয়, যা মেনে চলা উচিত। আমরা যে ধারণা করে আছি তাঁরা কৌশল অবলম্বন করেনি। এ ধারণাও ভুল। কারণ পূর্ব যুগের সালাফী বিদ্বাননরা বিভিন্ন সময় মুছীবতে পড়েছেন, জেল-যুলুম-জরিমানা-নির্যাতন সহ্য করেছেন। অথচ সাহাবীদের পরে দুনিয়াতে তাঁরাই বেশী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং অসম্ভব সুন্দর কৌশলী ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম ইবনু তায়মিয়া ড় তারা সবাই বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার ছিলেন। তাদের কৌশল নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তাহলে বলব আমার বোকার স্বর্গে বাস করছি। আসলে দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে মুছীবতে পড়া তা যেন সুন্নাতে বা আদর্শে পরিণত হয়েছে। কৌশলী হলেও সালাফদের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না। ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৫০জন তিরন্দাজ বাহিনীকে জাবালে রূমাতে থাকতে বলেছিলেন। তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,
‘তোমরা যদি দেখ যে, আমাদেরকে পাখিরা ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে, তথাপি তোমরা আমার পক্ষ হতে সংবাদ না পেলে স্বস্থান ত্যাগ করবে না। আর যদি তোমরা দেখ যে, আমরা শত্রু দলকে পদদলিত করেছি, তখনও আমার পক্ষ হতে সংবাদ প্রেরণ করা ব্যতীত স্বস্থান ত্যাগ করবে না’।[১] কৌশল জানতেন কি-না এ হাদীস পড়লেই বুঝা যায়। এছাড়াও সাহাবীরা বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কৌশলী হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। দাওয়াতী ক্ষেত্রেও তারা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন।
দাওয়াতের পরিচয়
دعوة শব্দটি আরবী। শাব্দিক অর্থ আহ্বান করা, ডাকা, সাহায্য কামনা করা, নিমন্ত্রণ করা, প্রার্থনা করা, চিৎকার করা, দু‘আ করা, উৎসাহ দেয়া, কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে আহ্বান করা, অনুপ্রাণিত করা ইত্যাদি। দাওয়াতের পরিচয় দিতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘আল্লাহর দিকে দাওয়াত হল- আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর রাসূলগণ কর্তৃক আনিত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত। এভাবে যে, তাঁরা যা বলেছেন তা সত্য হিসাবে মেনে নেয়া এবং তাঁরা যা আদেশ করেছেন তা পালন করা’।[২]
কেউ কেউ বলেছেন, ‘আল্লাহর দেয়া দ্বীন ইসলাম মানুষের নিকট প্রচার করা, তাদের শিক্ষা দেয়া এবং তাদের জীবনে তা বাস্তবায়নের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়ার নামই দাওয়াত।[৩]
মুহাম্মাদ নামির আল-খাতীব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কল্যাণকর কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়া, মন্দ কাজ পরিত্যাগ করা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা, ভালর কাছাকাছি হওয়া এবং খারাপ থেকে দূরে থাকা, হক্বের অনুসরণ করা এবং ভ্রান্ত পথ বর্জন করার প্রচেষ্টার নাম দাওয়াত।[৪]
দাওয়াতের বিষয়বস্তু
দাওয়াতের বিষয়বস্তু হল পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ‘ইসলাম’। মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰہِ الۡاِسۡلَامُ ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন ইসলাম’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯)। অর্থাৎ মানুষকে আহ্বান করতে হবে পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানের দিকে। তথা বিষয়বস্তুর আলোকে ইচ্ছামত বিষয় নির্বাচন করে মানুষকে দাওয়াত দেয়ার অধিকার আমাদের নেই। বিষয়বস্তু পূর্ব থেকেই নির্বাচন করা আছে- প্রথমে আক্বীদা অতঃপর শরী‘আতের হুকুম-আহকাম। মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকে আহ্বান করে দাওয়াত দিয়েছেন এভাবে,
‘হে মুমিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং এ কিতাবের প্রতি, যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ঐ কিতাবের প্রতি, যা পূর্বে অবতীর্ণ করেছিলেন এবং যে আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাসমূহ, তাঁর কিতাব সমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং পরকাল সম্বন্ধে অবিশ্বাস করে তবে নিশ্চয় ভীষণভাবে পথ ভ্রষ্ট হয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১৩৬)। সুতরাং দাওয়াতের বিষয়বস্তু হল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আক্বীদা ও আহকাম।
দাওয়াতের উদ্দেশ্য
দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি কামনা করা। মুমিন জীবনের প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা (সূরা আল-ফাত্হ : ২৯)।
মহান আল্লাহ বলেন,
‘(হে নবী!) আপনি বলুন! আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬২)।
তারপরও দাওয়াতের বিষয়টি একটু ভিন্ন। কারণ দাওয়াতের ব্যাপারে মহান আল্লাহ শুধু আল্লাহর পথের দিকে আহ্বান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।
লক্ষ্য হবে আমার ও তার হেদায়াত, অফুরন্ত নেকী এবং বিনিময়ে সুমহান জান্নাত। মনে রাখার দরকার যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে খায়বার জয়ের পূর্বে পতাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন,
‘আল্লাহর কসম, তোমার মাধ্যমে (দাওয়াতে) যদি একটি ব্যক্তিও হেদায়াত পায়, তাহলে সেটাই তোমার জন্য আরবের লাল উট অপেক্ষা উত্তম হবে’।[৫] মহান আল্লাহ বলেন,
‘তাঁর কাছে কারও কোন প্রতিদান যোগ্য নে‘মত প্রাপ্য নয় একমাত্র স্বীয় পালনকর্তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত’ (সূরা আল-লাইল : ১৯-২০)। দাওয়াতের মাধ্যমে নিজের সুনাম সুখ্যাতি অর্জন, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ অর্জন কিংবা ধন-সম্পদ লাভ ইত্যাদি কোনভাবেই কামনা করা যাবে না। যদি এমন হয় তাহলে সেটা আর দাওয়াত থাকে না।
দাওয়াতের গুরুত্ব
ছওমকে যেমন শরীরের যাকাত বলা হয় অনুরূপভাবে দাওয়াত বা প্রচার-প্রসার হল ইলমের যাকাত। সম্পদশালী ব্যক্তি যেমন তার সম্পদ থেকে যাকাত দেয়, অনুরূপ আলেমও তার ইলম থেকে প্রচারের মাধ্যমে যাকাত আদায় করবেন। আমরা এখনো আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর জমাকৃত হাদীস থেকে উপকৃত হই; পক্ষান্তরে রাজা-বাদশাদের রেখে যাওয়া কোন সম্পদ থেকে কোন উপকার লাভ করতে পারি না।[৬] তাই ইলম অর্জন করে তা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মহান আল্লাহ বলেন,
‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১১০ )।
উক্ত আয়াত প্রমাণ করে দাওয়াতী কাজ করা এমন ওয়াজিব, যা অনেকের পক্ষ থেকে একজন করলেও তা পালন হয়ে যায়। যাকে ওয়াজিব কিফাঈ বলে। এছাড়াও নবী-রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্যই ছিল শুধু দাওয়াত। নবী-রাসূলদের যাত্রা যখন শেষ হল, ইসলাম তখন নবীদের ওয়ারিছ হিসাবে আলেম বা দাঈদের ঘোষণা করল।[৭] যেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই দাওয়াতী প্রচষ্টা অব্যাহত থাকে, চিরকাল সরল সঠিক পথ মানুষ চিনতে পারে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসতে পারে। দাওয়াতের গুরুত্বের ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদীসটি যথার্থই বলা যায়-
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করে কিন্তু সে অনুযায়ী মানুষের কাছে পৌঁছায় না বা প্রচার করে না, তার উদাহরণ হচ্ছে ঐ সম্পদ জমাকারীর ন্যায়, যে শুধুই অর্থ-সম্পদ জমা করে অথচ সেখান থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে না।[৮]
ঈমান আনার পর নতুনভাবে ঈমান আনার প্রয়োজন হয় না, সালাত নির্দিষ্ট সময় ও সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত, হজ্জ জীবনে একবারই, ছওম বছরে একবার, অনুরূপ যাকাতও একবার ফরয। কিন্তু দাওয়াতী কাজ মহান আল্লাহ সর্বদা সতেজ রাখার জন্যই এই ব্যবস্থাপনা রেখেছেন। আল্লাহ বলেন,
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, এটাই আমার পথ, আমি ও আমার অনুসারীরা সুদৃঢ় দলীল সহকারে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি’ (সূরা ইউসুফ : ১০৮)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
‘তার কথার চাইতে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে ও সৎকর্ম করে এবং বলে আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা হামীম সাজদা : ৩৩)।
দাওয়াতের গুরুত্বের ব্যাপারে সূরা আলে ‘ইমরানের ১১০ নং আয়াতটি পড়ে ওমর ইবনু খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন,
‘হে মানব সকল! তোমাদের যে চায় এ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হতে, সে যেন আল্লাহর দেয়া শর্ত পূরণ করে। বলা হল আল্লাহর দেয়া শর্ত কোন্টি? তিনি বলেন, ‘ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ’।[৯]
আল্লাহ বলেন,
‘তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত তা অবশ্যই মন্দ ছিল’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৭৯)।
ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীস নিয়ে এসেছেন। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তা‘আলা শীঘ্রই তোমাদের উপর তার শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তার নিকট দু‘আ করলেও তিনি তোমাদের সেই দু‘আ কবুল করবেন না’।[১০]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার হলেও মক্কা-মদীনায় তাদের কবরের সংখ্যা সব মিলিয়ে ২০ হাজারের মত। অনুসন্ধান করলে জানা যায় যে, তারা শুধু দাওয়াতী কাজেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। বিধায় তাদের কবর এখানে এত কম। শুধু নিজ জন্মভূমি অথবা পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম স্থানের কারণে তারা সেখানেই থেকে যাননি; বরং ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছেন। জিহাদের ময়দানে প্রথমে তরবারী চালানোর পূর্বেই সেখানেও দাওয়াতী কাজ করতে হয়, যা বদর, খায়বার সহ বিভিন্ন যুদ্ধে লক্ষ্য করা যায়।[১১]
মহান আল্লাহ নিজেও দাওয়াত দিয়েছেন বা আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘আর আল্লাহ শান্তি-নিরাপত্তার দিকে আহ্বান জানান’ (সূরা ইউনুস : ২৫)।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মত হিসাবে একটি বাণী অবশ্যই জীবনে কাজে লাগানো উচিত তা হচ্ছে দাওয়াত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর, যদিও একটি আয়াতও হয়’।[১২] যে নির্দেশ মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে এভাবে দিয়েছেন,
‘হে রাসূল! আপনার উপর আপনার প্রতিপালক যা অবতীর্ণ করেছেন তা পৌঁছে দিন। যদি এ কাজ না করেন তবে রিসালাতের দায়িত্বই পালন করলেন না’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭)।
নূহ (আলাইহিস সালাম) দিনে-রাতে সর্বদা দাওয়াতী কাজ করেছেন (সূরা নূহ : ৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার একটি হাদীস শুনেছে এবং যেভাবে শুনেছে ঠিক সেভাবেই তা অপরের নিকট পৌঁছে দিয়েছে।[১৩]
খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারি মহান আল্লাহ ইসলামকে কিভাবে চলমান রেখেছেন। উত্তরে একটি কথাই আসে তাহল দাওয়াত।
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে ডাকে, সে তার অনুসারীদের সমপরিমাণ ছওয়াব পাবে এবং তাতে তার অনুসারীদের পুরস্কারে কোনরূপ ঘাটতি হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ গুনাহ হয় এবং এতে তার অনুসারীদের পাপের বোঝা কিছুমাত্র কমবে না’।[১৪]
কয়েকটি বিষয়ে দাঈদের সাবধান থাকা আবশ্যক
তাড়াহুড়া না করা
প্রত্যেক দাঈর দায়িত্ব হল তার জ্ঞান ও কৌশল অনুযায়ী সাধ্যমত মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে কোনভাবেই তাড়াহুড়া না করা। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাদের দায়িত্ব হল দাওয়াতী কাজ করা, রিসালাতের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো, মানুষকে জানানো, সংশোধনের চেষ্টা করা। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির ন্যায় তাড়াহুড়া মোটেই করা যাবে না। মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের ধৈর্য ধারণ করতে এবং তাড়াহুড়া না করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ বলেন,
‘অতএব আপনি ছবর করুন, যেমন উচ্চ সাহসী নবীগণ ছবর করেছেন। আর তাদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবেন না’ (সূরা আল-আহক্বাফ : ৩৫)।
হেদায়াত কে পাবে আর কে পাবে না, হক্ব মেনে নিলে কার মাধ্যমে ইসলামের উপকার হবে আর কার কারণে ইসলামের ক্ষতি হবে এটা কেবল আল্লাহর হাতে। সুতরাং এই মানুসিকতা মোটেই রাখা যাবে না যে, অমুক ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করলে ইসলামের বেশী উপকার হত, অমুক নেতা হক্ব মেনে নিলে দাওয়াতী কাজে সুবিধা পাওয়া যেত। তাই তার কাছে বার বার যাওয়া এবং তাকেই বেশী মূল্যায়ন করা।
মহান আল্লাহ এমন কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
‘আপনি যাকে পসন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৬)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্য আপনি দ্রুত অহী আবৃত্তি করবেন না’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৬)।
তিনি আরো বলেন,
‘আপনার প্রতি আল্লাহর অহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আপনি কুরআন গ্রহণের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না (সূরা ত্বোহা : ১১৪)।
ইবনুল ক্বাইয়িম রাহি. বলেন,
‘নিশ্চয় তাড়াহুড়া হয় শয়তানের পক্ষ থেকে’।[১৫]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘যে তোমাদেরকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলিম নও’ (সূরা আন-নিসা ৯৪) আয়াতের ঘটনা হচ্ছে- এক ব্যক্তির কিছু ছাগল ছিল, মুসলিমদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলে সে তাঁদেরকে ভয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলল। কিন্তু তারা (ভুল বুঝে তাড়াহুড়া করে) তাকে হত্যা করল এবং ছাগলের পাল নিয়ে নিল- এ প্রসঙ্গে আয়াতটি নাযিল হয়েছে।[১৬]
তাড়াহুড়ার ফল বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভাল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অকল্যাণই বয়ে আনে।[১৭]
অনুরূপ দু‘আর ক্ষেত্রেও তাড়াহুড়া করা যাবে না। যা নিষেধ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
‘মানুষ যেভাবে কণ্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয় (সূরা বানী ইসরাঈল : ১১)।
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৩০৩৯; আবূ দাঊদ, হা/২৬৬২।
[২]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১৫তম খ-, পৃ. ১৫৭।
[৩]. মুহাম্মাদ আল-বায়ানুন, ইলমুদ দাওয়াহ, পৃ. ১৭।
[৪]. মুরশিদু দু‘আত, পৃ. ২৪।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/২৯৪২।
[৬]. শাইখ ছালিহ আল-উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ২৬তম খ-, পৃ. ২১৯।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৪১।
[৮]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৬৮৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৪৭৯।
[৯]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ২য় খ-, পৃ. ৮৯; ফাৎহুল ক্বাদীর, ১ম খ-, পৃ. ৪২৭; তাফসীরে ত্বাবারী, ৫ম খ-, পৃ. ৬৭২।
[১০]. তিরমিযী, হা/২১৬৯।
[১১]. সহীহ বুখারী, হা/২৯৪২; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৩১।
[১২]. সহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১।
[১৩]. ইবনু মাজাহ, হা/২৩০, সনদ সহীহ।
[১৪]. সহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৯; মিশকাত, হা/১৫৮।
[১৫]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আর-রূহ, পৃ. ২৫৮।
[১৬]. সহীহ বুখারী, হা/৪৫৯১।
[১৭]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৮২।
দাওয়াত মুমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মিশন। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন তাঁদের সকলেরই মিশন ছিল দাওয়াত। দাওয়াত দানের মাধ্যমেই তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলোর মশাল প্রজ্জ্বলিত করেছেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ক্রমশ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ন্যায়নীতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। যুলুম-নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, ঘুষ-দুর্নীতি প্রভৃতি পাপাচারের বিষবাষ্পে জাতি আজ দিশেহারা। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে দাওয়াতের ব্যাপক প্রসারের বিকল্প নেই। আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে দাওয়াতের পরিচয়, বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, গুরুত্ব, দাঈদের বৈশিষ্ট্য এবং আধুনিক যুগে দাওয়াতী কাজের কৌশল নিয়ে আলোচনা করব ইনশআল্লাহ।
দাওয়াত ও হিকমাহ
শিরোনাম শুনে মনে হতে পারে দাওয়াতী কাজের জন্য যে কৌশলগুলো নিয়ে আমরা কথা বলব তা আমাদের তৈরি করা বর্তমান যুগেই বিদ্যমান- পূর্বের যুগে এগুলো ছিল না। কিন্তু না, পূর্ব যুগেও সময়োপযোগী কৌশল ছিল। তাঁরাও কৌশল জানতেন এবং সে অনুযায়ী কাজও করতেন। কোন দাঈ বা আলিম বিপদে পড়লে আমরা অনেক সময় বলে থাকি ‘কথা-বার্তা বলার ক্ষেত্রে একটু কৌশলী হতে হবে, বক্তৃতায় হিকমাহ অবলম্বন করতে হবে, সময় ও স্থান বুঝে বিষয় নির্বাচন করতে হবে, তাহলে এ সকল বিপদে পড়ত না’ ইত্যাদি। কথাগুলো অবশ্যই শিক্ষণীয় এবং প্রয়োজনীয়, যা মেনে চলা উচিত। আমরা যে ধারণা করে আছি তাঁরা কৌশল অবলম্বন করেনি। এ ধারণাও ভুল। কারণ পূর্ব যুগের সালাফী বিদ্বাননরা বিভিন্ন সময় মুছীবতে পড়েছেন, জেল-যুলুম-জরিমানা-নির্যাতন সহ্য করেছেন। অথচ সাহাবীদের পরে দুনিয়াতে তাঁরাই বেশী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং অসম্ভব সুন্দর কৌশলী ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম ইবনু তায়মিয়া ড় তারা সবাই বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার ছিলেন। তাদের কৌশল নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তাহলে বলব আমার বোকার স্বর্গে বাস করছি। আসলে দাওয়াতী কাজ করতে গিয়ে মুছীবতে পড়া তা যেন সুন্নাতে বা আদর্শে পরিণত হয়েছে। কৌশলী হলেও সালাফদের আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না। ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৫০জন তিরন্দাজ বাহিনীকে জাবালে রূমাতে থাকতে বলেছিলেন। তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,
إِنْ رَأَيْتُمُوْنَا تَخْطَفُنَا الطَّيْرُ فَلَا تَبْرَحُوْا مَكَانَكُمْ هَذَا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ وَإِنْ رَأَيْتُمُوْنَا هَزَمْنَا الْقَوْمَ وَأَوْطَأْنَاهُمْ فَلَا تَبْرَحُوْا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ
‘তোমরা যদি দেখ যে, আমাদেরকে পাখিরা ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে, তথাপি তোমরা আমার পক্ষ হতে সংবাদ না পেলে স্বস্থান ত্যাগ করবে না। আর যদি তোমরা দেখ যে, আমরা শত্রু দলকে পদদলিত করেছি, তখনও আমার পক্ষ হতে সংবাদ প্রেরণ করা ব্যতীত স্বস্থান ত্যাগ করবে না’।[১] কৌশল জানতেন কি-না এ হাদীস পড়লেই বুঝা যায়। এছাড়াও সাহাবীরা বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কৌশলী হয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। দাওয়াতী ক্ষেত্রেও তারা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন।
দাওয়াতের পরিচয়
دعوة শব্দটি আরবী। শাব্দিক অর্থ আহ্বান করা, ডাকা, সাহায্য কামনা করা, নিমন্ত্রণ করা, প্রার্থনা করা, চিৎকার করা, দু‘আ করা, উৎসাহ দেয়া, কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে আহ্বান করা, অনুপ্রাণিত করা ইত্যাদি। দাওয়াতের পরিচয় দিতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
اَلدَّعْوَةُ إلَى اللهِ هِيَ الدَّعْوَةُ إلَى الْإِيْمَانِ بِهِ وَبِمَا جَاءَتْ بِهِ رُسُلُهُ بِتَصْدِيْقِهِمْ فِيْمَا أَخْبَرُوْا بِهِ وَطَاعَتِهِمْ فِيْمَا أَمَرُوْا
‘আল্লাহর দিকে দাওয়াত হল- আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর রাসূলগণ কর্তৃক আনিত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত। এভাবে যে, তাঁরা যা বলেছেন তা সত্য হিসাবে মেনে নেয়া এবং তাঁরা যা আদেশ করেছেন তা পালন করা’।[২]
কেউ কেউ বলেছেন, ‘আল্লাহর দেয়া দ্বীন ইসলাম মানুষের নিকট প্রচার করা, তাদের শিক্ষা দেয়া এবং তাদের জীবনে তা বাস্তবায়নের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়ার নামই দাওয়াত।[৩]
মুহাম্মাদ নামির আল-খাতীব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘কল্যাণকর কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়া, মন্দ কাজ পরিত্যাগ করা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা, ভালর কাছাকাছি হওয়া এবং খারাপ থেকে দূরে থাকা, হক্বের অনুসরণ করা এবং ভ্রান্ত পথ বর্জন করার প্রচেষ্টার নাম দাওয়াত।[৪]
দাওয়াতের বিষয়বস্তু
দাওয়াতের বিষয়বস্তু হল পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ‘ইসলাম’। মহান আল্লাহ বলেন, اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰہِ الۡاِسۡلَامُ ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন ইসলাম’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৯)। অর্থাৎ মানুষকে আহ্বান করতে হবে পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানের দিকে। তথা বিষয়বস্তুর আলোকে ইচ্ছামত বিষয় নির্বাচন করে মানুষকে দাওয়াত দেয়ার অধিকার আমাদের নেই। বিষয়বস্তু পূর্ব থেকেই নির্বাচন করা আছে- প্রথমে আক্বীদা অতঃপর শরী‘আতের হুকুম-আহকাম। মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকে আহ্বান করে দাওয়াত দিয়েছেন এভাবে,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ الۡکِتٰبِ الَّذِیۡ نَزَّلَ عَلٰی رَسُوۡلِہٖ وَ الۡکِتٰبِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ مِنۡ قَبۡلُ وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاللّٰہِ وَ مَلٰٓئِکَتِہٖ وَ کُتُبِہٖ وَ رُسُلِہٖ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا
‘হে মুমিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং এ কিতাবের প্রতি, যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ঐ কিতাবের প্রতি, যা পূর্বে অবতীর্ণ করেছিলেন এবং যে আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাসমূহ, তাঁর কিতাব সমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং পরকাল সম্বন্ধে অবিশ্বাস করে তবে নিশ্চয় ভীষণভাবে পথ ভ্রষ্ট হয়েছে’ (সূরা আন-নিসা : ১৩৬)। সুতরাং দাওয়াতের বিষয়বস্তু হল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আক্বীদা ও আহকাম।
দাওয়াতের উদ্দেশ্য
দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি কামনা করা। মুমিন জীবনের প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা (সূরা আল-ফাত্হ : ২৯)।
মহান আল্লাহ বলেন,
قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন! আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৬২)।
তারপরও দাওয়াতের বিষয়টি একটু ভিন্ন। কারণ দাওয়াতের ব্যাপারে মহান আল্লাহ শুধু আল্লাহর পথের দিকে আহ্বান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা আন-নাহল : ১২৫)।
লক্ষ্য হবে আমার ও তার হেদায়াত, অফুরন্ত নেকী এবং বিনিময়ে সুমহান জান্নাত। মনে রাখার দরকার যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে খায়বার জয়ের পূর্বে পতাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন,
فَوَاللَّهِ لَأَنْ يُهْدَى بِكَ رَجُلٌ وَاحِدٌ خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ
‘আল্লাহর কসম, তোমার মাধ্যমে (দাওয়াতে) যদি একটি ব্যক্তিও হেদায়াত পায়, তাহলে সেটাই তোমার জন্য আরবের লাল উট অপেক্ষা উত্তম হবে’।[৫] মহান আল্লাহ বলেন,
وَ مَا لِاَحَدٍ عِنۡدَہٗ مِنۡ نِّعۡمَۃٍ تُجۡزٰۤی- اِلَّا ابۡتِغَآءَ وَجۡہِ رَبِّہِ الۡاَعۡلٰی
‘তাঁর কাছে কারও কোন প্রতিদান যোগ্য নে‘মত প্রাপ্য নয় একমাত্র স্বীয় পালনকর্তার সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত’ (সূরা আল-লাইল : ১৯-২০)। দাওয়াতের মাধ্যমে নিজের সুনাম সুখ্যাতি অর্জন, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ অর্জন কিংবা ধন-সম্পদ লাভ ইত্যাদি কোনভাবেই কামনা করা যাবে না। যদি এমন হয় তাহলে সেটা আর দাওয়াত থাকে না।
দাওয়াতের গুরুত্ব
ছওমকে যেমন শরীরের যাকাত বলা হয় অনুরূপভাবে দাওয়াত বা প্রচার-প্রসার হল ইলমের যাকাত। সম্পদশালী ব্যক্তি যেমন তার সম্পদ থেকে যাকাত দেয়, অনুরূপ আলেমও তার ইলম থেকে প্রচারের মাধ্যমে যাকাত আদায় করবেন। আমরা এখনো আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর জমাকৃত হাদীস থেকে উপকৃত হই; পক্ষান্তরে রাজা-বাদশাদের রেখে যাওয়া কোন সম্পদ থেকে কোন উপকার লাভ করতে পারি না।[৬] তাই ইলম অর্জন করে তা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মহান আল্লাহ বলেন,
کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡہَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ
‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১১০ )।
উক্ত আয়াত প্রমাণ করে দাওয়াতী কাজ করা এমন ওয়াজিব, যা অনেকের পক্ষ থেকে একজন করলেও তা পালন হয়ে যায়। যাকে ওয়াজিব কিফাঈ বলে। এছাড়াও নবী-রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্যই ছিল শুধু দাওয়াত। নবী-রাসূলদের যাত্রা যখন শেষ হল, ইসলাম তখন নবীদের ওয়ারিছ হিসাবে আলেম বা দাঈদের ঘোষণা করল।[৭] যেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই দাওয়াতী প্রচষ্টা অব্যাহত থাকে, চিরকাল সরল সঠিক পথ মানুষ চিনতে পারে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসতে পারে। দাওয়াতের গুরুত্বের ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদীসটি যথার্থই বলা যায়-
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَثَلُ الَّذِيْ يَتَعَلَّمُ الْعِلْمَ ثُمَّ لَا يُحَدِّثُ بِهِ كَمَثَلِ الَّذِيْ يَكْنِزُ الْكَنْزَ فلَا يُنْفِقُ مِنْهُ
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করে কিন্তু সে অনুযায়ী মানুষের কাছে পৌঁছায় না বা প্রচার করে না, তার উদাহরণ হচ্ছে ঐ সম্পদ জমাকারীর ন্যায়, যে শুধুই অর্থ-সম্পদ জমা করে অথচ সেখান থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে না।[৮]
ঈমান আনার পর নতুনভাবে ঈমান আনার প্রয়োজন হয় না, সালাত নির্দিষ্ট সময় ও সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত, হজ্জ জীবনে একবারই, ছওম বছরে একবার, অনুরূপ যাকাতও একবার ফরয। কিন্তু দাওয়াতী কাজ মহান আল্লাহ সর্বদা সতেজ রাখার জন্যই এই ব্যবস্থাপনা রেখেছেন। আল্লাহ বলেন,
قُلۡ ہٰذِہٖ سَبِیۡلِیۡۤ اَدۡعُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ عَلٰی بَصِیۡرَۃٍ اَنَا وَ مَنِ اتَّبَعَنِیۡ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, এটাই আমার পথ, আমি ও আমার অনুসারীরা সুদৃঢ় দলীল সহকারে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি’ (সূরা ইউসুফ : ১০৮)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
وَ مَنۡ اَحۡسَنُ قَوۡلًا مِّمَّنۡ دَعَاۤ اِلَی اللّٰہِ وَ عَمِلَ صَالِحًا وَّ قَالَ اِنَّنِیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ
‘তার কথার চাইতে কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে ও সৎকর্ম করে এবং বলে আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা হামীম সাজদা : ৩৩)।
দাওয়াতের গুরুত্বের ব্যাপারে সূরা আলে ‘ইমরানের ১১০ নং আয়াতটি পড়ে ওমর ইবনু খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন,
يا أيها الناس من سره أن يكون من تلك الأمة فليؤد شرط الله منها
‘হে মানব সকল! তোমাদের যে চায় এ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হতে, সে যেন আল্লাহর দেয়া শর্ত পূরণ করে। বলা হল আল্লাহর দেয়া শর্ত কোন্টি? তিনি বলেন, ‘ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ’।[৯]
আল্লাহ বলেন,
کَانُوۡا لَا یَتَنَاہَوۡنَ عَنۡ مُّنۡکَرٍ فَعَلُوۡہُ لَبِئۡسَ مَا کَانُوۡا یَفۡعَلُوۡنَ
‘তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত তা অবশ্যই মন্দ ছিল’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৭৯)।
ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীস নিয়ে এসেছেন। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوْشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُوْنَهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ
‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তা‘আলা শীঘ্রই তোমাদের উপর তার শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তার নিকট দু‘আ করলেও তিনি তোমাদের সেই দু‘আ কবুল করবেন না’।[১০]
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার হলেও মক্কা-মদীনায় তাদের কবরের সংখ্যা সব মিলিয়ে ২০ হাজারের মত। অনুসন্ধান করলে জানা যায় যে, তারা শুধু দাওয়াতী কাজেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। বিধায় তাদের কবর এখানে এত কম। শুধু নিজ জন্মভূমি অথবা পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম স্থানের কারণে তারা সেখানেই থেকে যাননি; বরং ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছেন। জিহাদের ময়দানে প্রথমে তরবারী চালানোর পূর্বেই সেখানেও দাওয়াতী কাজ করতে হয়, যা বদর, খায়বার সহ বিভিন্ন যুদ্ধে লক্ষ্য করা যায়।[১১]
মহান আল্লাহ নিজেও দাওয়াত দিয়েছেন বা আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَ اللّٰہُ یَدۡعُوۡۤا اِلٰی دَارِ السَّلٰمِ
‘আর আল্লাহ শান্তি-নিরাপত্তার দিকে আহ্বান জানান’ (সূরা ইউনুস : ২৫)।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মত হিসাবে একটি বাণী অবশ্যই জীবনে কাজে লাগানো উচিত তা হচ্ছে দাওয়াত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর, যদিও একটি আয়াতও হয়’।[১২] যে নির্দেশ মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে এভাবে দিয়েছেন,
یٰۤاَیُّہَا الرَّسُوۡلُ بَلِّغۡ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ وَ اِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَہٗ
‘হে রাসূল! আপনার উপর আপনার প্রতিপালক যা অবতীর্ণ করেছেন তা পৌঁছে দিন। যদি এ কাজ না করেন তবে রিসালাতের দায়িত্বই পালন করলেন না’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৬৭)।
নূহ (আলাইহিস সালাম) দিনে-রাতে সর্বদা দাওয়াতী কাজ করেছেন (সূরা নূহ : ৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তির মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার একটি হাদীস শুনেছে এবং যেভাবে শুনেছে ঠিক সেভাবেই তা অপরের নিকট পৌঁছে দিয়েছে।[১৩]
খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারি মহান আল্লাহ ইসলামকে কিভাবে চলমান রেখেছেন। উত্তরে একটি কথাই আসে তাহল দাওয়াত।
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا
‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে ডাকে, সে তার অনুসারীদের সমপরিমাণ ছওয়াব পাবে এবং তাতে তার অনুসারীদের পুরস্কারে কোনরূপ ঘাটতি হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে, তার জন্য তার অনুসারীদের সমপরিমাণ গুনাহ হয় এবং এতে তার অনুসারীদের পাপের বোঝা কিছুমাত্র কমবে না’।[১৪]
কয়েকটি বিষয়ে দাঈদের সাবধান থাকা আবশ্যক
তাড়াহুড়া না করা
প্রত্যেক দাঈর দায়িত্ব হল তার জ্ঞান ও কৌশল অনুযায়ী সাধ্যমত মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে কোনভাবেই তাড়াহুড়া না করা। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাদের দায়িত্ব হল দাওয়াতী কাজ করা, রিসালাতের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো, মানুষকে জানানো, সংশোধনের চেষ্টা করা। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির ন্যায় তাড়াহুড়া মোটেই করা যাবে না। মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের ধৈর্য ধারণ করতে এবং তাড়াহুড়া না করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ বলেন,
فَاصۡبِرۡ کَمَا صَبَرَ اُولُوا الۡعَزۡمِ مِنَ الرُّسُلِ وَ لَا تَسۡتَعۡجِلۡ لَّہُمۡ
‘অতএব আপনি ছবর করুন, যেমন উচ্চ সাহসী নবীগণ ছবর করেছেন। আর তাদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবেন না’ (সূরা আল-আহক্বাফ : ৩৫)।
হেদায়াত কে পাবে আর কে পাবে না, হক্ব মেনে নিলে কার মাধ্যমে ইসলামের উপকার হবে আর কার কারণে ইসলামের ক্ষতি হবে এটা কেবল আল্লাহর হাতে। সুতরাং এই মানুসিকতা মোটেই রাখা যাবে না যে, অমুক ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ করলে ইসলামের বেশী উপকার হত, অমুক নেতা হক্ব মেনে নিলে দাওয়াতী কাজে সুবিধা পাওয়া যেত। তাই তার কাছে বার বার যাওয়া এবং তাকেই বেশী মূল্যায়ন করা।
মহান আল্লাহ এমন কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
اِنَّکَ لَا تَہۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ
‘আপনি যাকে পসন্দ করেন, তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন (সূরা আল-ক্বাছাছ : ৫৬)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَا تُحَرِّکۡ بِہٖ لِسَانَکَ لِتَعۡجَلَ بِہٖ
‘তাড়াতাড়ি শিখে নেয়ার জন্য আপনি দ্রুত অহী আবৃত্তি করবেন না’ (সূরা আল-ক্বিয়ামাহ : ১৬)।
তিনি আরো বলেন,
وَ لَا تَعۡجَلۡ بِالۡقُرۡاٰنِ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یُّقۡضٰۤی اِلَیۡکَ وَحۡیُہٗ
‘আপনার প্রতি আল্লাহর অহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আপনি কুরআন গ্রহণের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না (সূরা ত্বোহা : ১১৪)।
ইবনুল ক্বাইয়িম রাহি. বলেন,
إنما كانت العجلة من الشيطان
‘নিশ্চয় তাড়াহুড়া হয় শয়তানের পক্ষ থেকে’।[১৫]
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
وَلَا تَقُوْلُوْا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا
‘যে তোমাদেরকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলিম নও’ (সূরা আন-নিসা ৯৪) আয়াতের ঘটনা হচ্ছে- এক ব্যক্তির কিছু ছাগল ছিল, মুসলিমদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলে সে তাঁদেরকে ভয়ে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলল। কিন্তু তারা (ভুল বুঝে তাড়াহুড়া করে) তাকে হত্যা করল এবং ছাগলের পাল নিয়ে নিল- এ প্রসঙ্গে আয়াতটি নাযিল হয়েছে।[১৬]
তাড়াহুড়ার ফল বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভাল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অকল্যাণই বয়ে আনে।[১৭]
অনুরূপ দু‘আর ক্ষেত্রেও তাড়াহুড়া করা যাবে না। যা নিষেধ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَ یَدۡعُ الۡاِنۡسَانُ بِالشَّرِّ دُعَآءَہٗ بِالۡخَیۡرِ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ عَجُوۡلًا
‘মানুষ যেভাবে কণ্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে। মানুষ তো খুবই দ্রুততা প্রিয় (সূরা বানী ইসরাঈল : ১১)।
তথ্যসূত্র :
[১]. সহীহ বুখারী, হা/৩০৩৯; আবূ দাঊদ, হা/২৬৬২।
[২]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া (দারুল ওয়াফা, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬ হি./২০০৫ খ্রি.), ১৫তম খ-, পৃ. ১৫৭।
[৩]. মুহাম্মাদ আল-বায়ানুন, ইলমুদ দাওয়াহ, পৃ. ১৭।
[৪]. মুরশিদু দু‘আত, পৃ. ২৪।
[৫]. সহীহ বুখারী, হা/২৯৪২।
[৬]. শাইখ ছালিহ আল-উছায়মীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ২৬তম খ-, পৃ. ২১৯।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৪১।
[৮]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৬৮৯; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩৪৭৯।
[৯]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ২য় খ-, পৃ. ৮৯; ফাৎহুল ক্বাদীর, ১ম খ-, পৃ. ৪২৭; তাফসীরে ত্বাবারী, ৫ম খ-, পৃ. ৬৭২।
[১০]. তিরমিযী, হা/২১৬৯।
[১১]. সহীহ বুখারী, হা/২৯৪২; সহীহ মুসলিম, হা/১৭৩১।
[১২]. সহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১।
[১৩]. ইবনু মাজাহ, হা/২৩০, সনদ সহীহ।
[১৪]. সহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪; আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৯; মিশকাত, হা/১৫৮।
[১৫]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আর-রূহ, পৃ. ২৫৮।
[১৬]. সহীহ বুখারী, হা/৪৫৯১।
[১৭]. আবূ দাঊদ, হা/৩৫৮২।
-মুকাররম বিন মুহসিন মাদানী
Last edited: