• আসসালামু আলাইকুম, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের ফোরামে মেজর কিছু চেঞ্জ আসবে যার ফলে ফোরামে ১-৩ দিন মেইনটেনেন্স মুডে থাকবে। উক্ত সময়ে আপনাদের সকলকে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

সালাফী আকিদা ও মানহাজে - Salafi Forum

Salafi Forum হচ্ছে সালাফী ও সালাফদের আকিদা, মানহাজ শিক্ষায় নিবেদিত একটি সমৃদ্ধ অনলাইন কমিউনিটি ফোরাম। জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিযুক্ত হউন, সালাফী আলেমদের দিকনির্দেশনা অনুসন্ধান করুন। আপনার ইলম প্রসারিত করুন, আপনার ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং সালাফিদের সাথে দ্বীনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ আকিদা ও মানহাজের জ্ঞান অর্জন করতে, ও সালাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে এবং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে আজই আমাদের সাথে যোগ দিন।

হজ হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন

Mahmud ibn Shahidullah

Knowledge Sharer

ilm Seeker
Q&A Master
Salafi User
Threads
520
Comments
533
Reactions
5,566
Credits
2,602
ভূমিকা

হজ্জ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। ইসলামের অন্যান্য বিধানের মত হজ্জও কোন অনুষ্ঠানসর্বস্ব নয়, বরং ইসলামের বড় থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটি বিধানের পশ্চাতে আল্লাহর নিগূঢ় তত্ত্ব এবং প্রভূত কল্যাণ নিহিত। কখনও কখনও আল্লাহ তা‘আলা কতিপয় নিদর্শনের মাধ্যমে তার অপার মহিমার বহিঃপ্রকাশ ঘটান, যে নিদর্শনাবলী এমন কিছু ঘটনা বিজড়িত ও লালিত, যা মানবতাকে তাওহীদের অনুপ্রেরণা দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় মহান আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পণ ও জীবন কুরবানীর গৌরবময় ইতিহাস। এ নিদর্শনগুলোকে আল-কুরআনের ভাষায় ‘শাআ‘ইরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহ’ বলা হয়। হজ্জও আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের অন্যতম। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয ইবাদত।

হজ্জের পরিচয়

হজ্জ (حج) আরবী শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা। শরী‘আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কা‘বা ঘর এবং উহার সংশ্লিষ্ট কয়েকটি স্থানে ইসলামের বিধানানুসারে অবস্থান করা, যিয়ারত করা ও অনুষ্ঠান পালন করাকে হজ্জ বলা হয়।[১] হজ্জ শব্দের ‘হা’ বর্ণের উপর ‘যবর’ যোগে পড়লে ক্রিয়ামূলের অর্থ দেয়- হজ্জ সম্পাদন করা। ‘যের’ যোগে পড়লে বিশেষ্যের অর্থ দেয়- হজ্জ একটি কর্মের নাম বিশেষ। আর ‘পেশ’ যোগে পড়লে অর্থ হয় ‘দলীল’।[২]

আল্লামা আব্দুর রহমান আল-জাযাইরী বলেন, হজ্জের আভিধানিক অর্থ মহৎ কোন কাজের ইচ্ছা পোষণ করা।[৩]
‘ফিক্বহুস সুন্নাহ’-এর গ্রন্থকার বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর হুক্ম পালনার্থে মক্কার দিকে গমনের ইচ্ছা করাকে হজ্জ বলে।[৪]
অর্থাৎ হজ্জের নিয়তে নির্দিষ্ট স্থান হতে ইহরাম বেঁধে আল্লাহর বিধান পালনার্থে কা‘বা ত্বাওয়াফ, ‘আরাফার ময়দানে অবস্থান এবং তদসংশ্লিষ্ট কার্যাবলী নির্দিষ্ট নিয়মে সম্পাদন করাই হজ্জ।

হজ্জের মাঝে দৈহিক, আর্থিক ও মানসিক সব ধরনের ত্যাগ বিদ্যমান থাকায় ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَ لِلّٰہِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡہِ سَبِیۡلًا وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ​

‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কা‘বা ঘরের হজ্জ পালন করা ঐ সমস্ত মানুষের উপর ফরয, যারা ঐ কা‘বা ঘর পর্যন্ত পথ অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে। আর যারা কুফরী করবে (অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ পালন করবে না) তারা জেনে রাখুক, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বিশ্ব জগতের মুখাপেক্ষী নন’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)।

বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হজ্জের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَ اَذِّنۡ فِی النَّاسِ بِالۡحَجِّ یَاۡتُوۡکَ رِجَالًا وَّ عَلٰی کُلِّ ضَامِرٍ یَّاۡتِیۡنَ مِنۡ کُلِّ فَجٍّ عَمِیۡقٍ​

‘আর মানুষের মধ্যে তুমি হজ্জের ঘোষণা প্রদান কর। তখন তারা পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটে আরোহণ করে দূর-দূরান্তর থেকে তোমার কাছে এসে উপস্থিত হবে’ (সূরা আল-হজ্জ : ২৭)।

হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) ইবনু আব্বাস (রা.)-এর বরাত দিয়ে বলেন, ইবরাহীম ন তাঁর অবস্থান স্থলে দাঁড়িয়ে আহ্বান করেছিলেন। অন্য মতে, তিনি পাথর অথবা ছাফা পাহাড়ের উপর অথবা আবু কুবাইস পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে এই আহ্বান করেন।[৫]
পরবর্তী আয়াতে ‘কল্যাণ প্রত্যক্ষ’ করার ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে কল্যাণ বলতে দুনিয়া এবং পরকালীন কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। আখেরাতের কল্যাণ হল, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দুনিয়ার কল্যাণ হল তারা যা লাভ করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কুরবানীর পশু হতে।[৬] বস্তুত হজ্জ এক মহা কল্যাণকর ইবাদত।

প্রতিবছর মুসলিম উম্মাহ্র দ্বারে দ্বারে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য, দাসত্ব, ত্যাগ, মহিমা, সৌহার্দ ও ঐক্যের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত হয় হজ্জের মওসুম। মুসলিম উম্মাহর পরম কাম্য ও বিশ্ব সম্মেলন হচ্ছে এ হজ্জ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে লক্ষ লক্ষ মুসলিম হজ্জের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় তাদের মিলন কেন্দ্র আল্লাহর পবিত্র ঘর কা‘বার পানে। হজ্জের কেন্দ্রভূমি এ পবিত্র ঘরের মাহাত্ম্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেছেন,

اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّا جَعَلۡنَا حَرَمًا اٰمِنًا وَّ یُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنۡ حَوۡلِہِمۡ اَفَبِالۡبَاطِلِ یُؤۡمِنُوۡنَ وَ بِنِعۡمَۃِ اللّٰہِ یَکۡفُرُوۡنَ​

‘মানুষ কি আমার এ মহিমা প্রত্যক্ষ করে না যে, আমরা হারামকে শান্তি নিকেতনে পরিণত করেছি? আর তার চতুর্পার্শ্বকে জনাকীর্ণ করে তুলেছি? এরপরও কি তারা মিথ্যাকে প্রত্যয় করতে থাকবে এবং আল্লাহর নে‘মতকে অস্বীকার করবে’? (সূরা আল-‘আনকাবূত : ৬৭)।

মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম ন-এর হাতে যে ঘরের ধারা সূচিত হয়েছিল, কালের গতিধারায় সে মহিমান্বিত ঘর তার পবিত্রতা, ভাবগম্ভীরতা ও উজ্জ্বল মর্যাদা হারিয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতির উৎসে, যেখানে উলঙ্গ অবস্থায় ত্বাওয়াফ বা প্রদক্ষিণকে পুণ্য বলে মনে করা হত। অবশেষে মহানবী মুহাম্মাদ ফ-এর উপর এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের দায়িত্ব অর্পিত হল। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡہِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ​

‘অতএব এ মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ্জ করে নিল তার জন্য অশ্লীল কথা, অশ্লীল আচরণ এবং ঝগড়া-বিবাদ নিষিদ্ধ’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৯৭)।

রাসূলুল্লাহ (ছা.) হজ্জের বিকৃত রূপকে আমূল পরিবর্তন করে ইবরাহীম ন-এর চেতনায় ফিরে আনলেন। হজ্জ হয়ে উঠল তাওহীদী চেতনার উৎস; আল্লাহ্র ভয়, তার অপরিসীম ক্ষমতা, বড়ত্ব ও মহত্বের প্রতীক। ক্ষমা, অনুগ্রহ, অনুকম্পা পাওয়ার অনন্য উপায় ।

হজ্জ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলন

ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে কালেমা বা তাওহীদ, সালাত ও সিয়াম এককভাবে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক। সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করলেও তা একটি নির্দিষ্ট সমাজ বা এলাকা-ভিত্তিক। কিন্তু হজ্জ ব্যক্তি কেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও তা বিশ্বজনীন। বিশ্বের সব দেশ, ভাষা, বর্ণ, গোত্রের সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারী একই সষ্টার উদ্দেশ্যে একটি মাত্র কেন্দ্রের দিকে একই সময়ে সমবেত হয় আল্লাহর ঘরে। সে অগণিত মানুষের ব্যাকুল চিত্তের একটি মাত্র আওয়াজ মুখরিত হয় হারামের চতুর্দিকে-

لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ​

অর্থ : ‘আপনার ডাকেই হাযির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি এসেছি, আপনার কোন শরীক নেই, আমি আপনার নিকট হাযির হয়েছি। সকল প্রশংসা একমাত্র আপনার জন্যই, সব নে‘মত আপনারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই আপনার। আপনার কোন শরীক নেই’।[৭]

ওমরাহ বছরের যে কোন সময় এমনকি হজ্জের সময়ও আদায় করা যায়। কিন্তু হজ্জ কেবল নির্দিষ্ট দিন সমূহে আদায় করতে হয়। হজ্জ উপলক্ষে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও আত্মসংযমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রামাযান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ গুণগুলো অর্জন করতে হয়। তবে সিয়াম ও হজ্জের মধ্যে একটি বিরাট পার্থক্য এই যে, সিয়াম সাধারণত নিজ গৃহে, পরিবার-পরিজনসহ আদায় করা হয়। কিন্তু হজ্জের জন্য সফরের ক্লেশ, পরিজনহীন অবস্থায় অজানা পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এ অবস্থায় একমাত্র আল্লাহর স্মরণ, তার উপর একান্ত নির্ভরতা ও নিজ লক্ষ্যের কথা চিন্তা করে আত্মসংযমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা অত্যাবশ্যক। এদিকে ইংগিত আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ بِبَکَّۃَ مُبٰرَکًا وَّ ہُدًی لِّلۡعٰلَمِیۡنَ- فِیۡہِ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ مَّقَامُ اِبۡرٰہِیۡم وَ مَنۡ دَخَلَہٗ کَانَ اٰمِنًا وَ لِلّٰہِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡہِ سَبِیۡلًا وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ​

‘মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয় তা মক্কায়। এটা বরকতময় ও বিশ্ব জগতের জন্য হেদায়াত। এতে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শন ‘মাক্বামে ইবরাহীম’। যে কেউ সেখানে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ফরয। আর যে অস্বীকার করবে, নিশ্চয় আল্লাহ সৃষ্টিজগত হতে অমুখাপেক্ষী’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৯৬-৯৭)।

উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কা‘বা গৃহের মর্যাদা, গুরুত্ব ও তার ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানবজাতির সর্বপ্রথম ইবাদত গৃহ হিসাবে পবিত্র কা‘বা নির্মিত হয়। আল্লাহর নির্দেশে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম এবং তার পুত্র ইসমাঈল (আ.) এ পবিত্র গৃহ নির্মাণ করেন। মাক্বামে ইবরাহীম সে পবিত্র স্মৃতির স্মারক হিসাবে আজও কা‘বা গৃহের সামনে বিদ্যমান। জাহিলী যুগে কাফির-মুশরিকরাও কা‘বার এ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করে চলত। আপন পিতৃ হন্তাকেও হারামের মধ্যে পেলে প্রতিশোধ নেয়ার কথা চিন্তা করত না। পৃথিবীর এ বরকতময় পবিত্রতম স্থানে মুসলিমগণ প্রতি বছর হজ্জ পালনের মাধ্যমে নিজেকে যেমন পবিত্র-পরিশুদ্ধ করে, সামগ্রিকভাবে বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণ চিন্তা, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সর্বোপরি সারা পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও বিজয়কে সুনিশ্চিত করার জন্যও তেমনি সম্মিলিত পরামর্শ গ্রহণ ও কর্ম-পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ পায়।

মহানবী (ছা.) বিদায় হজ্জে যে ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করেছিলেন, তা শুধু সেখানে উপস্থিত মুসলিমদের জন্যই নয়; বরং উপস্থিত-অনুপস্থিত সকল মুসলিম তথা সমগ্র মানব জাতির জন্য দিক-নির্দেশনা স্বরূপ ও অপরিসীম গুরুত্ববহ এক মহা মূল্যবান চিরন্তন দলীল। ১০৩৭ খ্রি. বৃটেনে ঘোষিত ম্যাগনাকার্টা, যেটাকে স্বাধীনতা সনদ বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মাইল ফলক রূপে চি‎ি‎‎হ্নত করা হয়। তার চেয়ে বিদায় হজ্জের ভাষণ ছিল বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর কোন বিকল্প নেই। ‘আরাফাতের ময়দানে আজও সেই একই স্থানে দাঁড়িয়ে খুৎবা পেশ করার রীতি প্রচলিত আছে। বিভিন্ন দেশের মুসলিম মনীষীগণ আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার প্রয়োজন ও প্রেক্ষিত অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়ে থাকেন।[৮]

মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রস্থল

পবিত্র কা‘বা সারা বিশ্বের কেন্দ্রভূমি, যেখানে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র-গোত্র, ভাষা-বর্ণ নির্বিশেষে সমবেত তাওহীদী জনতার সবল কণ্ঠে সুস্পষ্ট ঘোষণা, স্রষ্টার সমীপে বান্দার এই যে বিশ্বজনীন আবেগ উচ্ছসিত উচ্চারিত কণ্ঠ, এর ফলে মানব জাতির এক ও নির্বিশেষ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সত্তার সর্বজনীন প্রকাশ, এর তাৎপর্য সীমাহীন ও অনন্য মহিমায় সমুজ্জ্বল। ইসলামের এ আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বজনীনতার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে মিল্লাতে ইসলামিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিগণ একত্রিত হয়ে মিল্লাতের সকল সমস্যা, উন্নতি-অগ্রগতি আলোচনা-পর্যালাচনা করবে এবং পরবর্তীতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও পরামর্শের ভিত্তিতে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসাবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা। সাথে সাথে এ কাজে যত প্রকারের প্রতিবন্ধকতা আছে, তা যথাযথরূপে মুকাবিলা করার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক কার্যকরী কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথ নির্দেশ প্রদান করা। তাই হজ্জ শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত ও সাধারণ মুসলিমদের আন্তর্জাতিক বার্ষিক সম্মেলনই নয়, বরং বিশ্ব মুসলিমের নেতৃস্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গেরও এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন তথা বিশ্ব সম্মেলন।

হজ্জ ইসলামী পুনর্জাগরণের অন্যতম মাধ্যম

ইসলামী পুনর্জাগরণের অন্যতম মাধ্যম হজ্জ এবং কা‘বা। রামাযান মাস যেমন সমগ্র মুসলিম জাহানে তাক্বওয়া-পরহেযগারীর একটি অনন্য মওসুম, ঠিক তেমনি হজ্জও মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামী জিন্দেগী ও জাগরণের এক মহা মূল্যবান মুহূর্ত। এটা কোন অত্যুক্তি নয়, বরং শরী‘আত প্রণেতা কর্তৃক নির্দেশিত ইলাহী ব্যবস্থাপনা। দুনিয়ার অবস্থা যতই খারাপ হোক না কেন, কালের গতি যতই জটিল হোক না কেন, বিশ্ব ব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং তার প্রতিষ্ঠা অব্যাহত গতিতেই চলতে থাকবে। মানব দেহে হৃদপিন্ডের যে অবস্থান এবং গুরুত্ব, ঠিক তেমনি সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় কা‘বা ঘরের অবস্থান। মানব দেহের দিল যতদিন সক্রিয় থাকবে ততদিন নানা প্রকার রোগের আক্রমণে যতই দুর্বল আর শক্তিহীন হোক না কেন, সে যেমন মরে যাবে না, ঠিক তেমনি ইসলামী দুনিয়ায় এই দিলও প্রতি বছর দূর-দূরান্তর পর্যন্ত প্রসারিত ‘ধমনীর’ মাধ্যমে রক্ত শুষতে এবং তা আবার সমগ্র দেহে বিস্তার লাভ করতে থাকবে। যতদিন এ দিল সক্রিয় থাকবে এবং রক্তের এ প্রবহধারা চলতে থাকবে, ততদিন সে দেহের জীবন শেষ হওয়া সম্ভব নয়, রোগ-ব্যাধিতে সে দেহ যতই ক্ষীণ, জর্জরিত ও দুর্বল হোক না কেন।

পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ এক কথায় সমগ্র দিক হতে অগণিত জাতি এবং অসংখ্য দেশ হতে লাখ লাখ মানুষ হাযার হাযার মাইল পথ অতিক্রম করে একই কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসছে। তাদের শারীরিক গঠন ও আকৃতি বিভিন্ন, বর্ণ বিভিন্ন, ভাষা বিভিন্ন কিন্তু কেন্দ্রের নিকটবর্তী এক নির্র্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত পৌঁছেই নিজ নিজ জাতীয় পোশাক খুলে ফেলে এবং সকলেই একই ধরনের পোশাক পরিধান করে। এভাবে দুনিয়ার হাযার হাযার জাতির মধ্য হতে লক্ষ লক্ষ তাওহীদী জনতা ছুটে এসে একই পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে। সকলের পোশাক এক, সকলের একই ইমাম, একই গতিবিধি ও একই ভাষায় সালাত আদায় করে। এভাবে সমবেত লক্ষ জনতার ভাষা, জাতি, দেশ, বংশ এবং গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য বিচূর্ণ হয়ে একাকার হয়ে যায়। এতে সমগ্র বিশ্বাসী মানুষের সমন্বয়ে যেন একটি বিরাট জামা‘আত সৃষ্টি হয়। তারপর এ বিশাল আন্তর্জাতিক ঐক্য যখন পথের প্রত্যেক চড়াই-উৎরাইয়ে একই ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে এগিয়ে চলে, তখন এক আশ্চর্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেখানে অবাতিরত হয় এক অভাবনীয় দৃশ্যের। সে পরিবেশে মানুষ নিজেকে ভুলে গিয়ে এক অচিন্তনীয় ভাবধারায় মত্ত হয়ে পড়ে। এসব কাজে যে পবিত্র পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক মনোভাবের সৃষ্টি হয়, দুনিয়ার অন্য কোন ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থায় তার তুলনা নেই।[৯]

এ উদ্দেশ্য ও অনুভূতি সামনে রেখে হজ্জ উদ্যাপন করলে একদিকে যেমন ব্যক্তিগতভাবে উন্নত চরিত্রের মানুষ হওয়া যাবে, অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক দৃঢ় ও অটুট হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কার্যকর কর্মসূচী প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন সহজ হবে।

সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বজনীন মানবতার বিকাশ

হজ্জ সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বজনীন মানবতা বিকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম। হজ্জের দু’টি দিকই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্যক্তিগত, অন্যটি আন্তর্জাতিক বা সর্বজনীন। দু’টি দিকই বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইসলামের অন্যান্য ফরয ইবাদত ঘরে বসে, দৈনন্দিন জীবন-যাত্রা অব্যাহত রেখে, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন পরিবৃত অবস্থায় পালন করা সম্ভব। কিন্ত হজ্জ এসব কিছুর ঊর্ধ্বে এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। হজ্জের উদ্দেশ্যে নিজের ঘর-সংসার, সাংসারিক-জাগতিক সকল কাজ এবং আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সব কিছু পরিত্যাগ করে আল্লাহর মেহমান হিসাবে সফরে বের হতে হয়। সারা জীবন ব্যাপী কষ্টার্জিত অর্থে যে নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলা হয়, আনন্দ-ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে যে নিবিড় মায়াময় সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, একমাত্র আল্লাহ্র মহব্বতে সে সবকিছুর মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে ‘লাব্বাইক’ অর্থাৎ ‘আমি আমার মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি’ উচ্চারণ করে দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, সফরের সীমাহীন তাকলীফ সহ্য করে আল্লাহ্র ঘরে উপনীত হতে হয়। এভাবে হজ্জ সমাপন করে যখন কেউ ঘরে ফিরে আসে, তখন তার অবস্থা সদ্যজাত মা‘ছূম শিশুর মতই হয়ে যায়। দুনিয়ার লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, পঙ্কিল-আবিলতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হজ্জের দ্বারা যে চারিত্রিক উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে, তা মানুষকে আশরাফুল মাখলূক্বাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এর কার্যকর ভূমিকা সত্যিই বাস্তবিক।[১০]

ইহরাম বেঁধে ‘লাব্বাইক’ বলে যখন হারাম শরীফের চতুর্দিক থেকে মানুষ ছুটে আসে এবং বায়তুল্লাহ শরীফ ত্বাওয়াফ করতে থাকে, তখন ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র সকল ভেদাভেদ লোপ পায়। যে মহান স্রষ্টা আসমান-যমীন, জিন-ইনসান তথা সমস্ত জগৎ ও মাখলূক্বাতের স্রষ্টা, যিনি আমাদের ইহ-পরকালের একমাত্র প্রভু, তার ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে হাযির হওয়ার পর দুনিয়ায় প্রচলিত মানুষের মনগড়া কৃত্রিম ভেদাভেদের কথা কখনও মনে স্থান পায় না। এমন অকৃত্রিম সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ^জনীন মানবতার বিকাশ আর কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না। মিনা ও ‘আরাফার দৃশ্য ভিন্ন কিছুই নয় বরং সেখানকার অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা। মিনার ময়দানে যেখানে ইবরাহীম ন তার প্রাণাধিক পুত্র ইসমাঈল ন-কে আল্লাহ্র নির্দেশে কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং কিশোর বালক আল্লাহর হুকুম পালনার্থে পরম স্নেহ বৎসল পিতার উদ্যত ছুরির সামনে সাগ্রহে নিজেকে কুরবানী করতে সঁপে দিয়েছিলেন, সে মহান আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত পুণ্যভূমিতে সর্বকালের মানুষের জন্য যে শিক্ষা ও অত্যুজ্জ্বল আদর্শ বিদ্যমান, তা চোখের সামনে জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে। সে ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ইবরাহীম ন-এর সুন্নাত হিসাবে সেখানে কুরবানীর অনুষ্ঠান করতে হয়। এ মিনার ময়দানে কুমন্ত্রণাদাতা শয়তানের বুকে বার বার পাথর নিক্ষেপ করে নফসের সমস্ত শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হয়।[১১]

উপসংহার


ইসলামী শরী‘আতে হজ্জের মর্যাদা ও তাৎপর্য অপরিসীম। সাম্য-মৈত্রী, ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠায় হজ্জের রয়েছে সীমাহীন গুরুত্ব। হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্ম অহমিকা বর্জনে হজ্জের প্রভাব সত্যিই আশ্চর্যজনক। ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সংস্কৃতি ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের লাখ লাখ মুসলিম প্রতি বছর এক গন্তব্য পানে হাযির হয়। সেখানে থাকে না কোন দ্বন্দ্ব, আত্ম অহংকারের দম্ভ, দুনিয়ার চাকচিক্য আর অর্থের বড়াই। সবাই যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই ভাই হয়ে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা মহান প্রভু আল্লাহ্র দরবারে হাযির হওয়ার আগ্রহে ব্যাকুল। নিজেদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার চূড়ান্ত ব্যস্ততা। সত্যি এক অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় দৃশ্য। তাই মুসলিম উম্মাহ্র বিশ্ব সম্মেলনকেন্দ্র হিসাবে হজ্জের গুরুত্ব সত্যিই অবর্ণনীয়।



তথ্যসূত্র :
১. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব, ১ম খণ্ড (কায়রো : দারুল হাদীস, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৬১৫।
২. মাজদুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব আল-ফাইরূযাবাদী, আল-কামূসুল মুহীত্ব, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ১৮২।
৩. ইয়াহইয়া ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু বুহাইয়া আল-হাম্বলী, কিতাবুল ইফসাহ আল-আয়ানী আছ-ছিহাহ ‘আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ, ১ম খ- (রিয়াদ, তা.বি.), পৃ. ২৭১।
৪. সাইয়িদ সাবিক, ফিক্বহুস সুন্নাহ, ১ম খণ্ড (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ৫২৭।
৫. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর আদ-দিমাস্কী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৫ম খণ্ড (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি.), পৃ. ৪১৪। নোট : এই সূত্রটি পরবর্তীতে ‘তাফসীর ইবনু কাছীর’ শিরোনামে উল্লেখ করা হবে।
৬. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪১৪।
৭. সহীহ বুখারী, হা/১৫৪৯; সহীহ মুসলিম, হা/২৮১১।
৮. মুহাম্মদ মতিউর রহমান, পবিত্র হজ্জ ও কুরবানী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৩৭ বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ৮-৯।
৯. পবিত্র হজ্জ ও কুরবানী, পৃ. ১২-১৩।
১০. পবিত্র হজ্জ ও কুরবানী, পৃ. ১৩।
১১. পবিত্র হজ্জ ও কুরবানী, পৃ. ১৩-১৪।



প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
*চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়​
 
Last edited:
COMMENTS ARE BELOW
Top